৭১ ) সে বললোঃ “তোমাদের রবের অভিসম্পাত পড়েছে তোমাদের ওপর এবং তাঁর গযবও। তোমরা কি আমার সাথে এমন কিছু নাম নিয়ে বিতর্ক করছো, যেগুলো তৈরী করেছো তোমরা ও তোমাদের বাপ-দাদারা ৫৪ এবং যেগুলোর স্বপক্ষে আল্লাহ কোন সনদ নাযিল করেননি? ৫৫ ঠিক আছে, তোমরা অপেক্ষা করো এবং আমিও তোমাদের সাথে অপেক্ষা করছি।”
قَالَ قَدْ وَقَعَ عَلَيْكُم مِّن رَّبِّكُمْ رِجْسٌۭ وَغَضَبٌ ۖ أَتُجَـٰدِلُونَنِى فِىٓ أَسْمَآءٍۢ سَمَّيْتُمُوهَآ أَنتُمْ وَءَابَآؤُكُم مَّا نَزَّلَ ٱللَّهُ بِهَا مِن سُلْطَـٰنٍۢ ۚ فَٱنتَظِرُوٓا۟ إِنِّى مَعَكُم مِّنَ ٱلْمُنتَظِرِينَ ٧١
৭২ ) অবশেষে নিজ অনুগ্রহে আমি হূদ ও তার সাথীদেরকে উদ্ধার করি এবং আমার আয়াতকে যারা মিথ্যা বলেছিল এবং যারা ঈমান আনেনি তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেই। ৫৬
فَأَنجَيْنَـٰهُ وَٱلَّذِينَ مَعَهُۥ بِرَحْمَةٍۢ مِّنَّا وَقَطَعْنَا دَابِرَ ٱلَّذِينَ كَذَّبُوا۟ بِـَٔايَـٰتِنَا ۖ وَمَا كَانُوا۟ مُؤْمِنِينَ ٧٢
৭৩ ) আর সামূদের ৫৭ কাছে পাঠাই তাদের ভাই সালেহকে। সে বলেঃ হে আমার সম্প্রদায়ের ভাইয়েরা! তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। তোমাদের কাছে তোমাদের রবের সুস্পষ্ট প্রমাণ এসে গেছে। আল্লাহর এ উটনীটি তোমাদের জন্য একটি নিদর্শন। ৫৮ কাজেই তাকে আল্লাহর জমিতে চরে খাবার জন্য ছেড়ে দাও। কোন অসদুদ্দেশ্যে এর গায়ে হাত দিয়ো না। অন্যথায় একটি যন্ত্রণাদায়ক আযাব তোমাদের ওপর আপতিত হবে।
وَإِلَىٰ ثَمُودَ أَخَاهُمْ صَـٰلِحًۭا ۗ قَالَ يَـٰقَوْمِ ٱعْبُدُوا۟ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَـٰهٍ غَيْرُهُۥ ۖ قَدْ جَآءَتْكُم بَيِّنَةٌۭ مِّن رَّبِّكُمْ ۖ هَـٰذِهِۦ نَاقَةُ ٱللَّهِ لَكُمْ ءَايَةًۭ ۖ فَذَرُوهَا تَأْكُلْ فِىٓ أَرْضِ ٱللَّهِ ۖ وَلَا تَمَسُّوهَا بِسُوٓءٍۢ فَيَأْخُذَكُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌۭ ٧٣
৭৪ ) স্মরণ করো সেই সময়ের কথা, যখন আল্লাহ আদ জাতির পর তোমাদেরকে তার স্থলাভিষিক্ত করেন এবং পৃথিবীতে তোমাদেরকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন, যার ফলে আজ তোমরা তাদের সমতলভূমিতে বিপুলায়তন প্রাসাদ ও তার পাহাড় কেটে বাসগৃহ নির্মাণ করছো। ৫৯ কাজেই তাঁর সর্বময় ক্ষমতার স্মরণ থেকে গাফেল হয়ে যেয়ো না এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না। ৬০
وَٱذْكُرُوٓا۟ إِذْ جَعَلَكُمْ خُلَفَآءَ مِنۢ بَعْدِ عَادٍۢ وَبَوَّأَكُمْ فِى ٱلْأَرْضِ تَتَّخِذُونَ مِن سُهُولِهَا قُصُورًۭا وَتَنْحِتُونَ ٱلْجِبَالَ بُيُوتًۭا ۖ فَٱذْكُرُوٓا۟ ءَالَآءَ ٱللَّهِ وَلَا تَعْثَوْا۟ فِى ٱلْأَرْضِ مُفْسِدِينَ ٧٤
৭৫ ) তার সম্প্রদায়ের স্বঘোষিত প্রতাপশালী নেতারা দুর্বল শ্রেণীর মুমিনদেরকে বললোঃ “তোমরা কি সত্যিই জানো, সালেহ তার রবের প্রেরিত নবী?” তারা জবাব দিলোঃ “নিশ্চয়ই, যে বাণী সহকারে তাঁকে পাঠানো হয়েছে আমরা তা বিশ্বাস করি।”
قَالَ ٱلْمَلَأُ ٱلَّذِينَ ٱسْتَكْبَرُوا۟ مِن قَوْمِهِۦ لِلَّذِينَ ٱسْتُضْعِفُوا۟ لِمَنْ ءَامَنَ مِنْهُمْ أَتَعْلَمُونَ أَنَّ صَـٰلِحًۭا مُّرْسَلٌۭ مِّن رَّبِّهِۦ ۚ قَالُوٓا۟ إِنَّا بِمَآ أُرْسِلَ بِهِۦ مُؤْمِنُونَ ٧٥
৭৬ ) ঐ শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদাররা বললো, “তোমরা যা বিশ্বাস কর আমরা তা অস্বীকার করি।”
قَالَ ٱلَّذِينَ ٱسْتَكْبَرُوٓا۟ إِنَّا بِٱلَّذِىٓ ءَامَنتُم بِهِۦ كَـٰفِرُونَ ٧٦
৭৭ ) তারপর তারা সেই উটনীটিকে মেরে ফেললো, ৬১ পূর্ণদাম্ভিকতা সহকারে নিজেদের রবের হুকুম অমান্য করলো এবং সালেহকে বললোঃ “নিয়ে এসো সেই আযাব, যার হুমকি তুমি আমাদের দিয়ে থাকো, যদি সত্যিই তুমি নবী হয়ে থাকো।”
فَعَقَرُوا۟ ٱلنَّاقَةَ وَعَتَوْا۟ عَنْ أَمْرِ رَبِّهِمْ وَقَالُوا۟ يَـٰصَـٰلِحُ ٱئْتِنَا بِمَا تَعِدُنَآ إِن كُنتَ مِنَ ٱلْمُرْسَلِينَ ٧٧
৭৮ ) অবশেষে একটি প্রলয়ংকর দুর্যোগ তাদেরকে গ্রাস করলো ৬২ এবং তারা নিজেদের ঘরের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে রইল।
فَأَخَذَتْهُمُ ٱلرَّجْفَةُ فَأَصْبَحُوا۟ فِى دَارِهِمْ جَـٰثِمِينَ ٧٨
৭৯ ) আর সালেহ একথা বলতে বলতে তাদের জনপদ থেকে বের হয়ে গেলোঃ “হে আমার সম্প্রদায়! আমার রবের বাণী আমি তোমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছি এবং আমি তোমাদের জন্য যথেষ্ট কল্যাণ কামনা করেছি। কিন্তু আমি কি করবো, তোমরা তো নিজেদের হিতাকাংখীকে পছন্দই কর না।”
فَتَوَلَّىٰ عَنْهُمْ وَقَالَ يَـٰقَوْمِ لَقَدْ أَبْلَغْتُكُمْ رِسَالَةَ رَبِّى وَنَصَحْتُ لَكُمْ وَلَـٰكِن لَّا تُحِبُّونَ ٱلنَّـٰصِحِينَ ٧٩
৮০ ) আর লূতকে আমি পয়গম্বর করে পাঠাই। তারপর স্মরণ করো, যখন সে নিজের সম্প্রদায়ের ৬৩ লোকদেরকে বললোঃ “তোমরা কি এতই নির্লজ্জ হয়ে গেলে যে, দুনিয়ার ইতিপূর্বে কেউ কখনো করেনি এমন অশ্লীল কাজ করে চলেছো?
وَلُوطًا إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِۦٓ أَتَأْتُونَ ٱلْفَـٰحِشَةَ مَا سَبَقَكُم بِهَا مِنْ أَحَدٍۢ مِّنَ ٱلْعَـٰلَمِينَ ٨٠
৫৪.
অর্থাৎ তোমরা কাউকে বৃষ্টির দেবতা, কাউকে বায়ুর দেবতা, কাউকে ধন-সম্পদের দেবতা, আবার কাউকে রোগের দেবতা, বলে থাকো। অথচ তাদের কেউ মূলত কোন জিনিসের স্রষ্টা ও প্রতিপালক নয়। বর্তমান যুগেও আমরা এর দৃষ্টান্ত দেখি। এ যুগেও লোকেরা দেখি কাউকে বিপদ মোচনকারী বলে থাকে। অথচ বিপদ থেকে উদ্ধার করার কোন ক্ষমতাই তার নেই। লোকেরা কাউকে 'গনজ বখশ' (গুপ্ত ধনভাণ্ডার দানকারী) বলে অভিহিত করে থাকে। অথচ তার কাছে কাউকে দান করার মত কোন ধনভাণ্ডার নেই। কাউকে 'দাতা' বলা হয়ে থাকে। অথচ সে কোন জিনিসের মালিকই নয় যে, কাউকে দান করতে পারবে। কাউকে 'গরীব নওয়াজ' আখ্যা দেয়া হয়ে থাকে। অথচ তিনি নিজেই গরীব। যে ধরনের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ফলে কোন গরীবকে প্রতিপালন ও তার প্রতি অনুগ্রহ করা যেতে পারে সেই ধরনের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বে তার কোন অংশ নেই। কাউকে 'গউস' (ফরিয়াদ শ্রবণকারী) বলা হয় অথচ কারোর ফরিয়াদ শুনার এবং তার প্রতিকার করার কোন ক্ষমতাই তার নেই। কাজেই এ ধরনের যাবতীয় নাম বা উপাধি নিছক নাম বা উপাধি ছাড়া আর কিছুই নয়। এ নামগুলোর পিছনে কোন সত্তা বা ব্যক্তিত্ব নেই। যারা এগুলো নিয়ে ঝগড়া ও বিতর্ক করে তারা আসলে কোন বাস্তব জিনিসের জন্য নয়, বরং কেবল কতিপয় নামের জন্যই ঝগড়া ও বিতর্ক করে।
৫৫.
অর্থাৎ তোমরা নিজেরাই যে আল্লাহকে সর্বশ্রেষ্ঠ রব বলে থাকো তিনি তোমাদের এ বানোয়াট ইলাহদের সার্বভৌম ক্ষমতা-কর্তৃত্ব ও প্রভুত্বের স্বপক্ষে কোন সনদ দান করেননি। তিনি কোথাও বলেননি যে, আমি অমুকের ও অমুকের কাছে আমার ইলাহী কর্তৃত্বের এ পরিমাণ অংশ স্থানান্তরিত করে দিয়েছি। কাউকে ‘বিপদ ত্রাতা’ অথবা 'গনজ বখশ' হবার কোন পরোয়ানা তিনি দেননি। তোমরা নিজেরাই নিজেদের ধারণা ও কল্পনা অনুযায়ী তাঁর ইলাহী ক্ষমতার যতটুকু অংশ যাকে ইচ্ছা তাকে দান করে দিয়েছো।
৫৬.
‘নিশ্চিহ্ন করে দেই’ অর্থাৎ তাদেরকে বিধ্বস্ত ও ধ্বংস করে দিয়েছি। দুনিয়ার বুক থেকে তাদের নাম-নিশানা মুছে দিয়েছি। প্রাথমিক পর্বের ‘আদ’ জাতি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে এবং তাদের যাবতীয় নিদর্শনও দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, একথা আরববাসীদের ঐতিহাসিক কথামালা ও কিংবদন্তী সমূহ থেকেও প্রমাণিত হয় এবং আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহও এর সত্যতা প্রমাণ করে। তাই আরব ঐতিহাসিকগণ তাদেরকে বিলুপ্ত জাতি হিসেবেই গণ্য করে থাকেন। তারপর আদ জাতির কেবলমাত্র সেই অংশটুকুই দুনিয়ার বুকে রয়ে গেছে, যারা ছিল হযরত হূদ আলাইহিস সালামের অনুসারী। এটাও আরব ইতিহাসের একটি স্বীকৃত সত্য। ইতিহাসে আদ জাতির এ অবশিষ্টাংশ দ্বিতীয় আদ নামে খ্যাত। উপরে আমরা হিসনে গুরাবের যে পুরাতন ফলকটির কথা উল্লেখ করেছি সেটি আসলে তাদেরই স্মৃতিফলক। প্রত্নতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞগণ এ স্মৃতি ফলকে (এটিকে হযরত ঈসার জন্মের প্রায় ১৮ শত বছর পূর্বের লিখন বলে মনে করা হচ্ছে) যে উৎকীর্ণ লিখন পাঠ করেছেন, তার কতিপয় বাক্য নীচে উদ্ধৃত করা হলোঃ
“আমরা সুদীর্ঘকাল এই দুর্গে এমন অবস্থায় অতিবাহিত করেছিলাম যখন অভাব অনটন থেকে আমাদের জীবন ছিল অনেক দূরে। আমাদের খালগুলো নদীর পানিতে ভরে থাকতো……… এবং আমাদের শাসকগণ এমন ধরনের বাদশাহ ছিলেন যারা ছিলেন অসৎ চিন্তা মুক্ত এবং দুস্কৃতকারী ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের প্রতি কঠোর মনোভাবাপন্ন। তারা হূদের শরীয়াত অনুযায়ী আমাদের ওপর শাসন কার্য পরিচালনা করতেন এবং উত্তম ফায়সালাসমূহ একটি কিতাবে লিপিবদ্ধ করে নিতেন। আমরা মুজিযা ও মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের প্রতি ঈমান রাখতাম।”
কুরআনে যে কথা বিধৃত হয়েছে যে, আদ জাতির প্রাচীন মহিমা, গৌরব ও সমৃদ্ধির উত্তরাধিকারী তারাই হয়েছিল যারা হূদ আলাইহিস সালামের প্রতি ঈমান এনেছিল, এ লিপিটি আজো এরই সত্যতা প্রমাণ করে যাচ্ছে।
৫৭.
এটি আরবের প্রাচীন জাতিগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় জাতি। আদের পরে এরাই সবচেয়ে বেশী খ্যাতি ও পরিচিত অর্জন করে। কুরআন নাযিলের পূর্বে এদের কাহিনী সাধারণ মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। জাহেলী যুগের কবিতা ও খুতবা সাহিত্যে এর ব্যাপক উল্লেখ পাওয়া যায়। আসিরিয়ার শিলালিপি, গ্রীস, ইসকানদারীয়া ও রোমের প্রাচীন ঐতিহাসিক ও ভুগোলবিদগণও এর উল্লেখ করেছেন। ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মের কিছুকাল পূর্বে ও এ জাতির কিছু লোক বেঁচে ছিল। রোমীয় ঐতিহাসিকগণের মতে, এরা রোমীয় সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়ে এদের শত্রু নিবতীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
উত্তর-পশ্চিম আরবের যে এলাকাটি আজো ‘আল হিজর’ নামে খ্যাত, সেখানেই ছিল এদের আবাস। আজকের সউদী আরবের অন্তর্গত মদীনা ও তাবুকের মাঝখানে হিজায রেলওয়ের একটি ষ্টেশন রয়েছে, তার নাম মাদায়েনে সালেহ। এটিই ছিল সামূদ জাতির কেন্দ্রীয় স্থান। প্রাচীনকালে এর নাম ছিল হিজর। সামূদ জাতির লোকেরা পাহাড় কেটে যে সব বিপুলায়তন ইমারত নির্মাণ করেছিল, এখনো হাজার হাজার একর এলাকা জুড়ে সেগুলো অবস্থান করছে। এ নিঝুম পুরীটি দেখে আন্দাজ করা যায় যে, এক সময়ে এ নগরীর জনসংখ্যা চার পাঁচ লাখের কম ছিল না। কুরআন নাযিল হওয়ার সময়কালে হেজাযের ব্যবসায়ী কাফেলা এ প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতো। তাবুক যুদ্ধের সময় নবী সাল্লাল্লাহু আল্লাইহি ওয়া সাল্লাম যখন এ এলাকা অতিক্রম করছিলেন, তখন তিনি মুসলমানদেরকে এ শিক্ষানীয় নিদর্শনগুলো দেখান এবং এমন শিক্ষা দান করেন যা এ ধরনের ধ্বংসাবশেষ থেকে একজন বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ব্যক্তির শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। এ জায়গায় তিনি একটি কুয়ার দিকে অংগুলি নির্দেশ করে বলেন, এ কুয়াটি থেকে হযরত সালেহের উটনী পানি পান করতো। তিনি মুসলমানদেরকে একমাত্র এ কুয়াটি থেকে পানি পান করতে বলেন এবং অন্য সমস্ত কুয়া থেকে পানি পান করতে নিষেধ করেন। একটি গিরিপথ দেখিয়ে তিনি বলেন, এ গিরিপথ দিয়ে হযরত সালেহের উটনীটি পানি পান করতে আসতো। তাই সেই স্থানটি আজো ‘ফাজ্জুন নাকাহ’ বা ‘উটনীর পথ’ নামে খ্যাত হয়ে আছে। তাদের ধ্বংসস্তূপগুলোর মধ্যে যেসব মুসলমান ঘোরাফেরা করছিল তাদেরকে একত্র করে তিনি একটি ভাষণ দেন। এ ভাষণে সামূদ জাতির ভয়াবহ পরিণাম থেকে তাদেরকে শিক্ষা গ্রহণের উপদেশ দিয়ে তিনি বলেন, এটি এমন একটি জাতির এলাকা যাদের ওপর আল্লাহর আযাব নাযিল হয়েছিল। কাজেই এ স্থানটি দ্রুত অতিক্রম করে চলে যাও। এটা ভ্রমনের জায়গা নয় বরং কান্নার জায়গা।
৫৮.
আয়াতটির আপাত বক্তব্য দৃষ্টে পরিষ্কার অনুভূত হয় যে, পূর্বের বাক্যটিতে আল্লাহর যে সুস্পষ্ট প্রমাণের কথা বলা হয়েছে, তা দ্বারা এ পরবর্তী বাক্যটিতে ‘নিদর্শন’ হিসেবে উল্লেখিত উটনীটিই বুঝানো হয়েছে। সূরা ‘শুআরা’র ৮ রুকূ’তে) সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে যে, সামূদ জাতির লোকেরা নিজেরাই হযরত সালেহের কাছে এমন একটি নিদর্শনের দাবী করেছিল যা তাঁর আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্তির দ্ব্যর্থহীন ও অকাট্য প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং এরই জবাবে হযরত সালেহ উটনীটি হাজির করেন। এ থেকে একথা চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয় যে, উটনীর আবির্ভাব হয়েছিল মুজিযা হিসেবে এবং কোন কোন নবী তাঁদের নবুওয়াতের প্রমাণ স্বরূপ নবুওয়াত অস্বীকারকারীদের দাবীর জবাবে যেসব মুজিযা পেশ করেছিলেন এটি ছিল সেই ধরনেরই একটি মুজিযা। তাছাড়া হযরত সালেহ এই উটনীটি হাজির করার পর যে বক্তব্য রেখেছিলেন তাও এর অলৌকিক জন্মের প্রমাণ। তিনি নবুওয়াত অস্বীকারকারীদেরকে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, এখন এ উটনীটির প্রাণের সাথে তোমাদের জীবন জড়িত হয়ে গেছে। উটনীটি স্বাধীনভাবে তোমাদের ক্ষেতে চরে বেড়াবে। একদিন সে একাই পানি পান করবে এবং অন্যদিন সমগ্রজাতির যত পশু আছে সবাই পানি পান করবে। আর যদি তোমরা তার গায়ে কোনভাবে হাত উঠাও তাহলে অকস্মাৎ তোমাদের ওপর আল্লাহর আযাব নেমে আসবে। বলা বাহুল্য, যে জিনিসটির অস্বাভাবিকতা লোকেরা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিল, একমাত্র সেই জিনিসটি সম্পর্কেই এভাবে কথা বলা সম্ভব। উপরন্তু এ কথাও প্রণিধানযোগ্য যে, দীর্ঘদিন ধরে সামূদ জাতির লোকেরা তার স্বাধীনভাবে চরে বেড়ানো এবং একদিন তার একাকী পানি পান করা, অন্যদিন সমগ্র জাতির সমস্ত পশুদের পানি পান করার বিষয়টি অনিচ্ছা সত্ত্বেও বরদাশত করে এসেছে। অবশেষে অনেক শলা-পরামর্শ ও ষড়যন্ত্রের পর তারা তাকে হত্যা করে। অথচ তাদের হযরত সালেহকে ভয় করার কিছুই ছিল না। কারণ তাঁর কোন ক্ষমতা বা প্রতাপ ছিল না। এ অকাট্য ও জ্বলন্ত সত্য দ্বারা আরো প্রমাণিত হচ্ছে যে, তারা এ উটনীর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত ছিল। তারা জানতো, এর পেছনে নিশ্চয়ই কোন শক্তি আছে, তারই জোরে সে তাদের মধ্যে দোর্দণ্ড প্রতাপে ঘুরে বেড়ায়। উটনীটি কেমন ছিল এবং কিভাবে জন্ম লাভ করলো, তার কোন বর্ণনা কুরআন দেয়নি। কোন নির্ভরযোগ্য সহীহ হাদীসেও এর বিস্তারিত কোন বিবরণ নেই। তাই এ উটনীটির জন্মবৃত্তান্ত সম্পর্কে যেসব বর্ণনা মুফাসসিরগণ উদ্ধৃত করেছেন তা মেনে নেয়া অপরিহার্য নয়। কিন্তু এর জন্ম যে, কোন না কোনভাবে মুজিযা ও অলৌকিক ঘটনার পর্যায়ভুক্ত তা অবশ্যি কুরআন থেকে প্রমাণিত।
৫৯.
সামূদদের এ গৃহ নির্মাণ শিল্পটি ছিল ভারতের ইলোরা, অজন্তা গূহা ও অন্যান্য স্থানে প্রাপ্ত পর্বত গাত্রের গৃহের ন্যায়। অর্থাৎ তারা পাহাড় কেটে তার মধ্যে বিরাট বিরাট ইমারত তৈরী করতো। মাদায়েনে সালেহ এলাকায় এখনো তাদের এসব ইমারত সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায় রয়ে গেছে। সেগুলো দেখে এ জাতি স্থাপত্য বিদ্যায় কেমন বিস্ময়কর উন্নতি সাধন করেছিল, তা অনুমান করা যায়।
৬০.
অর্থাৎ আদ জাতির পরিণাম থেকে শিক্ষা গ্রহণ করো। তোমরা যদি আদদের মতো বিপর্যয় সৃষ্টি করতে থাকো, তাহলে যে মহান আল্লাহর অসাধারণ ক্ষমতা এ বিপর্যয় সৃষ্টিকারী জাতিকে ধ্বংস করে দিয়ে তার জায়গায় তোমাদেরকে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিলেন, সেই মহা শক্তিধর আল্লাহই আবার তোমাদেরকে ধ্বংস করে দিয়ে অন্যদেরকে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করতে পারেন। (টীকা ৫২ দ্রষ্টব্য।)
৬১.
সূরা কামার ও সূরা শামস-এর বর্ণনা অনুযায়ী যদিও এক ব্যক্তিই মেরেছিল তবুও যেহেতু সমগ্র জাতি এ অপরাধীর পেছনে ইন্ধন যুগিয়েছিল এবং অপরাধী লোকটি ছিল নিছক তার জাতির ক্রীড়নক মাত্র, তাই অভিযোগ আনা হয়েছে সমগ্র জাতির বিরুদ্ধে। জাতির ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী যে সমস্ত গুনাহ করা হয় অথবা যে সমস্ত গুনাহ করার ব্যাপারে জাতির সম্মতি ও সমর্থন থাকে, কোন ব্যক্তিবিশেষ সেগুলো করলেও সেগুলো জাতীয় গুনাহেরই পর্যায়ভুক্ত। শুধু তাই নয়, কুরআন বলে, জাতীয় অঙ্গনে প্রকাশ্যে যে গুনাহ করা হয় এবং জাতি তা বরদাশত করে নেয় তাও জাতীয় পাপ হিসেবে বিবেচিত।
৬২.
এ দুর্যোগকে এখানে رجفة (প্রলয়ংকর ও ভূকম্পনের সাহায্যে মৃত্যুদানকারী) বলা হয়েছে। অন্য স্থানে এ জন্য صيحة (চীৎকার), صاعقة (বজ্রপাত) ও طاغية(বিকট শব্দ) শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়েছে।
৬৩.
বর্তমানে যে এলাকাটিকে ট্রান্স জর্ডান
(شرق اردن) বলা হয় সেখানেই ছিল এ জাতিটির বাস। ইরাক ও ফিলিস্তিনের মধ্যবর্তী স্থানে এ এলাকাটি অবস্থিত। বাইবেলে ‘সাদূম’ কে এ জাতির কেন্দ্রস্থল বলা হয়েছে। মৃত সাগরের (Dead sea) নিকটবর্তী কোথাও এর অবস্থান ছিল। তালমূদে বলা হয়েছে, সাদূম ছাড়া তাদের আরো চারটি বড় বড় শহর ছিল। এ শহরগুলোর মধ্যবর্তী এলাকাসমূহ এমনই শ্যামল সবুজে পরিপূর্ণ ছিল যে, মাইলের পর মাইল জুড়ে এ বিস্তৃত এলাকা যেন একটি বাগান মনে হতো। এ এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মানুষকে মুগ্ধ ও বিমোহিত করতো। কিন্তু আজ এ জাতির নাম-নিশানা দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এমনকি তাদের জনপদগুলো কোথায় কোথায় অবস্থিত ছিল তাও আজ সঠিকভাবে জানা যায় না। মৃত সাগরই তাদের একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে টিকে আছে। বর্তমানে এটি ‘লুত সাগর’ নামে পরিচিত।
হযরত লূত আলাইহিস সালাম ছিলেন ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ভাইপো। তিনি চাচার সাথে ইরাক থেকে বের হন এবং কিছু কাল সিরীয়া, ফিলিস্তিন ও মিসর সফর করে দাওয়াত ও তাবলীগের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে থাকেন। অতঃপর স্বতন্ত্রভাবে রিসালাতের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়ে এ পথ ভ্রষ্ট জাতিটির সংস্কার ও সংশোধনের দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত হন। সাদূমবাসীদের সাথে সম্ভবত তাঁর আত্মীয়তার সম্পর্কের কারণে তাদেরকে তার সম্প্রদায় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইহুদীদের হাতে বিকৃত বাইবেলে হযরত লূতের চরিত্রের বহুতর কলঙ্ক কালিমা লেপন করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, তিনি নাকি হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সাথে ঝগড়াঝাঁটি করে সাদূম এলাকায় চলে গিয়েছিলেন। (আদিপুস্তক ১৩: ১-১২) কিন্তু কুরআন এ মিথ্যাচারের প্রতিবাদ করছে। কুরআনের বক্তব্য মতে আল্লাহ তাকে রসূল নিযুক্ত করে এ জাতির কাছে পাঠান।