আল ফাতিহা
৭ আয়াত
আল বাকারাহ
২৮৬ আয়াত
আলে ইমরান
২০০ আয়াত
আন্ নিসা
১৭৬ আয়াত
আল মায়েদাহ
১২০ আয়াত
আল আন'আম
১৬৫ আয়াত
আল আরাফ
২০৬ আয়াত
আল আনফাল
৭৫ আয়াত
আত তওবা
১২৯ আয়াত
১০
ইউনুস
১০৯ আয়াত
১১
হুদ
১২৩ আয়াত
১২
ইউসুফ
১১১ আয়াত
১৩
আর্ রাদ
৪৩ আয়াত
১৪
ইবরাহীম
৫২ আয়াত
১৫
আল হিজর
৯৯ আয়াত
১৬
আন্ নাহল
১২৮ আয়াত
১৭
বনী ইসরাঈল
১১১ আয়াত
১৮
আল কাহফ
১১০ আয়াত
১৯
মারয়াম
৯৮ আয়াত
২০
ত্বাহা
১৩৫ আয়াত
২১
আল আম্বিয়া
১১২ আয়াত
২২
আল হাজ্জ
৭৮ আয়াত
২৩
আল মুমিনূন
১১৮ আয়াত
২৪
আন্ নূর
৬৪ আয়াত
২৫
আল-ফুরকান
৭৭ আয়াত
২৬
আশ্-শু’আরা
২২৭ আয়াত
২৭
আন নামল
৯৩ আয়াত
২৮
আল কাসাস
৮৮ আয়াত
২৯
আল আনকাবূত
৬৯ আয়াত
৩০
আর রূম
৬০ আয়াত
৩১
লুকমান
৩৪ আয়াত
৩২
আস সাজদাহ
৩০ আয়াত
৩৩
আল আহযাব
৭৩ আয়াত
৩৪
আস সাবা
৫৪ আয়াত
৩৫
ফাতের
৪৫ আয়াত
৩৬
ইয়া-সীন
৮৩ আয়াত
৩৭
আস্ সা-ফফা-ত
১৮২ আয়াত
৩৮
সা-দ
৮৮ আয়াত
৩৯
আয যুমার
৭৫ আয়াত
৪০
আল মুমিন
৮৫ আয়াত
৪১
হা-মীম আস সাজদাহ
৫৪ আয়াত
৪২
আশ শূরা
৫৩ আয়াত
৪৩
আয্ যুখরুফ
৮৯ আয়াত
৪৪
আদ দুখান
৫৯ আয়াত
৪৫
আল জাসিয়াহ
৩৭ আয়াত
৪৬
আল আহক্বাফ
৩৫ আয়াত
৪৭
মুহাম্মদ
৩৮ আয়াত
৪৮
আল ফাতহ
২৯ আয়াত
৪৯
আল হুজুরাত
১৮ আয়াত
৫০
ক্বাফ
৪৫ আয়াত
৫১
আয যারিয়াত
৬০ আয়াত
৫২
আত তূর
৪৯ আয়াত
৫৩
আন নাজম
৬২ আয়াত
৫৪
আল ক্বামার
৫৫ আয়াত
৫৫
আর রহমান
৭৮ আয়াত
৫৬
আল ওয়াকি’আ
৯৬ আয়াত
৫৭
আল হাদীদ
২৯ আয়াত
৫৮
আল মুজাদালাহ
২২ আয়াত
৫৯
আল হাশর
২৪ আয়াত
৬০
আল মুমতাহিনা
১৩ আয়াত
৬১
আস সফ
১৪ আয়াত
৬২
আল জুমআ
১১ আয়াত
৬৩
আল মুনাফিকুন
১১ আয়াত
৬৪
আত তাগাবুন
১৮ আয়াত
৬৫
আত তালাক
১২ আয়াত
৬৬
আত তাহরীম
১২ আয়াত
৬৭
আল মুলক
৩০ আয়াত
৬৮
আল কলম
৫২ আয়াত
৬৯
আল হাককাহ
৫২ আয়াত
৭০
আল মাআরিজ
৪৪ আয়াত
৭১
নূহ
২৮ আয়াত
৭২
আল জিন
২৮ আয়াত
৭৩
আল মুযযাম্মিল
২০ আয়াত
৭৪
আল মুদ্দাস্সির
৫৬ আয়াত
৭৫
আল কিয়ামাহ
৪০ আয়াত
৭৬
আদ্ দাহর
৩১ আয়াত
৭৭
আল মুরসালাত
৫০ আয়াত
৭৮
আন নাবা
৪০ আয়াত
৭৯
আন নাযি’আত
৪৬ আয়াত
৮০
আবাসা
৪২ আয়াত
৮১
আত তাকবীর
২৯ আয়াত
৮২
আল ইনফিতার
১৯ আয়াত
৮৩
আল মুতাফফিফীন
৩৬ আয়াত
৮৪
আল ইনশিকাক
২৫ আয়াত
৮৫
আল বুরূজ
২২ আয়াত
৮৬
আত তারিক
১৭ আয়াত
৮৭
আল আ’লা
১৯ আয়াত
৮৮
আল গাশিয়াহ
২৬ আয়াত
৮৯
আল ফজর
৩০ আয়াত
৯০
আল বালাদ
২০ আয়াত
৯১
আশ শামস
১৫ আয়াত
৯২
আল লাইল
২১ আয়াত
৯৩
আদ দুহা
১১ আয়াত
৯৪
আলাম নাশরাহ
৮ আয়াত
৯৫
আত তীন
৮ আয়াত
৯৬
আল আলাক
১৯ আয়াত
৯৭
আল কাদ্‌র
৫ আয়াত
৯৮
আল বাইয়েনাহ
৮ আয়াত
৯৯
আল যিলযাল
৮ আয়াত
১০০
আল আদিয়াত
১১ আয়াত
১০১
আল কারি’আহ
১১ আয়াত
১০২
আত তাকাসুর
৮ আয়াত
১০৩
আল আসর
৩ আয়াত
১০৪
আল হুমাযা
৯ আয়াত
১০৫
আল ফীল
৫ আয়াত
১০৬
কুরাইশ
৪ আয়াত
১০৭
আল মাউন
৭ আয়াত
১০৮
আল কাউসার
৩ আয়াত
১০৯
আল কাফিরূন
৬ আয়াত
১১০
আন নসর
৩ আয়াত
১১১
আল লাহাব
৫ আয়াত
১১২
আল ইখলাস
৪ আয়াত
১১৩
আল ফালাক
৫ আয়াত
১১৪
আন নাস
৬ আয়াত

আত তূর

৪৯ আয়াত

আয়াত
-
১ ) তূরের শপথ
وَٱلطُّورِ ١
২ ) এবং এমন একখানা খোলা গ্রন্থের শপথ
وَكِتَـٰبٍۢ مَّسْطُورٍۢ ٢
৩ ) যা সূক্ষ্ম চামড়ার ওপর লিখিত।
فِى رَقٍّۢ مَّنشُورٍۢ ٣
৪ ) আর শপথ আবাদ ঘরের,
وَٱلْبَيْتِ ٱلْمَعْمُورِ ٤
৫ ) সুউচ্চ ছাদের
وَٱلسَّقْفِ ٱلْمَرْفُوعِ ٥
৬ ) এবং তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের।
وَٱلْبَحْرِ ٱلْمَسْجُورِ ٦
৭ ) তোমার রবের আযাব অবশ্যই আপতিত হবে
إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ لَوَٰقِعٌۭ ٧
৮ ) যার রোধকারী কেউ নেই।
مَّا لَهُۥ مِن دَافِعٍۢ ٨
৯ ) তা ঘটবে সেদিন, যেদিন আসমান প্রচণ্ডভাবে দুলিত হবে
يَوْمَ تَمُورُ ٱلسَّمَآءُ مَوْرًۭا ٩
১০ ) এবং পাহাড় শূন্যে উড়তে থাকবে।
وَتَسِيرُ ٱلْجِبَالُ سَيْرًۭا ١٠
১.
তূর শব্দের প্রকৃত অর্থ পাহাড়। আর الطُّور শব্দের অর্থ সেই বিশেষ পাহাড় যার ওপরে আল্লাহ‌ তা’আলা হযরত মূসাকে নবুওয়াত দানে সম্মানিত করেছিলেন।
২.
প্রাচীনকালে যেসব গ্রন্থ ও লিখিত বস্তুকে দীর্ঘকাল পর্যন্ত সংরক্ষিত রাখার প্রয়োজন হতো সেগুলোকে কাগজের পরিবর্তে হরিণের চামড়ায় লেখা হতো। বিশেষত এসব চামড়া লেখার জন্য পাতলা অথবা ঝিল্লির আকারে তৈরী করা হতো এবং পরিভাষায় একেই رق বলা হতো। আহলে কিতাবগণ সাধারণত এই رق এর ওপরেই তাওরাত, যাবুর, ইনযীল এবং নবীদের সহীফাসমূহ লিখে রাখতো যাতে তা দীর্ঘ দিনের জন্য সংরক্ষিত থাকতে পারে। এখানে খোলা গ্রন্থ অর্থ আহলে কিতাবের কাছে বর্তমান পবিত্র গ্রন্থসমূহের এ সমষ্টি। একে উন্মুক্ত কিতাব বলার কারণ হচ্ছে তা দুষ্প্রাপ্য ছিল না, বরং পাঠ করা হতো এবং তাতে কি লিপিবদ্ধ ছিল তা সহজেই অবহিত হওয়া যেতো।
৩.
হযরত হাসান বাসরীর মতে ‘আবাদ ঘর’ অর্থ খানায়ে কা’বা যা কোন সময়ই হজ্জ, উমরা এবং তাওয়াফ ও যিয়ারতকারী থেকে শূন্য থাকে না। কিন্তু হযরত আলী, ইবনে আব্বাস, ইকরিমা, মুজাহিদ, কাতাদা, দাহ্হাক, ইবনে যায়েদ ও অন্য সব মুফাসসিরদের মতে এর অর্থ বায়তুল মা’মূর যার উল্লেখ মি’রাজের প্রসঙ্গে নবী ﷺ করেছিলেন এবং যার দেয়াল গাত্রে তিনি হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সাল্লামকে হেলান দিয়ে থাকতে দেখেছিলেন। মুজাহিদ, কাতাদা ও ইবনে যায়েদ বলেন, পৃথিবীবাসীদের জন্য খানায়ে কা’বা যেমন আল্লাহ পরস্তদের কেন্দ্র তেমনি প্রত্যেক আসমানে তার বাসিন্দাদের জন্য একটি করে কা’বা আছে যা আল্লাহর ইবাদতকারীদের জন্য অনুরূপ কেন্দ্রের মর্যাদা রাখে। মি’রাজের সময় নবী ﷺ ঐ সব কা’বার একটি দেয়ালে হযরত ইবরাহীমকে হেলান দিয়ে থাকতে দেখেছিলেন। এর সাথে হযরত ইবরাহীমের সম্পর্ক থাকা অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। কারণ তিনিই ছিলেন পৃথিবীর কা’বার প্রতিষ্ঠাতা। এ ব্যাখ্যাটি সামনে রেখে বিবেচনা করলে তা হযরত হাসান বাসরীর ব্যাখ্যার পরিপন্থী হবে না। বরং দু’টি ব্যাখ্যা মিলিয়ে আমরা এভাবে বুঝতে পারি যে, এখানে কেবল পৃথিবীর কা’বার শপথ করা হয়নি বরং বিশ্ব-জাহানে বর্তমান সমস্ত কা’বার শপথ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে।
৪.
উঁচু ছাদ অর্থ আসমান, যা পৃথিবীকে একটি গম্বুজের মত আচ্ছাদিত করে আছে বলে মনে হয়। এখানে এ শব্দটি গোটা ঊর্ধ্বজগতকে বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা ক্বাফ, টীকা ৭)।
৫.
মূল আয়াতে الْبَحْرِ الْمَسْجُورِ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর কয়েকটি অর্থ বর্ণনা করা হয়েছে। কোন কোন মুফাস্সির একে ‘আগুনে ভর্তি’ অর্থে গ্রহণ করেছেন। কেউ কেউ একে শূন্য ও খালি অর্থে গ্রহণ করেন যার পানি মাটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ একে আবদ্ধ বা আটকিয়ে রাখা অর্থে গ্রহণ করেন। তাদের মতে এর অর্থ হচ্ছে, সমুদ্রকে আটিকিয়ে বা থামিয়ে রাখা হয়েছে যাতে তার পানি মাটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে হারিয়ে না যায় এবং স্থলভাগকে প্লাবিত করে না ফেলে এবং পৃথীবীর সব অধিবাসী তাতে ডুবে না মরে। কেউ কেউ একে মিশ্রিত অর্থে গ্রহণ করে থাকেন। অর্থাৎ এর মধ্যে মিঠা ও লবনাক্ত পানি এবং গরম ও ঠাণ্ডা সব রকম পানি এসে মিশ্রিত হয়। আর কেউ কেউ একে কানায় কানায় ভরা ও তরংগ বিক্ষুব্ধ অর্থে গ্রহণ করেন। এসব অর্থের মধ্যে প্রথম দু’টি অর্থের পরিবেশ ও অবস্থার সাথে কোন মিল নেই। সমুদ্রের এ দু’টি অবস্থা, অর্থাৎ এর তলদেশ ফেটে সমস্ত পানি মাটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং তা আগুনে পূর্ণ হয়ে যাবে---কিয়ামতের সময় প্রকাশ পাবে। যা সূরা তাকভীরের ৬ আয়াত এবং সূরা ইনফিতারের ৩ আয়াতেও বর্ণিত হয়েছে। এ অবস্থা এখন বর্তমান নেই, ভবিষ্যতে সংঘঠিত হবে। তাই এ ঘটনার শপথ করে বর্তমান কালের লোকজনকে আখেরাত সংঘটিত হওয়ার কথা কি করে বিশ্বাস করানো যেতে পারে? তাই এ দু’টি অর্থ বাতিল করে الْبَحْرِ الْمَسْجُورِ অর্থ আবদ্ধ, মিশ্রিত, পূর্ণ ও তরংগ বিক্ষুদ্ধ অর্থে গ্রহণ করা যেতে পারে।
৬.
এটি সেই মহাসত্য যার জন্য এ পাঁচটি জিনিসের শপথ করা হয়েছে। রবের শাস্তি অর্থে আখেরাত। যেহেতু এখানে আখেরাত বিশ্বাসকারীদের সম্বোধন না করে আখেরাত অবিশ্বাসকারীদের সম্বোধন করা হয়েছে আর তাদের জন্য আখেরাত আসার অর্থই হচ্ছে আযাব আসা তাই তাকে কিয়ামত, আখেরাত কিংবা প্রতিফল দিবস বলার পরিবর্তে “রবের আযাব” বলা হয়েছে। কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার কথা বলে যে পাঁচটি জিনিসের শপথ করা হয়েছে তা কিভাবে কিয়ামতের সংঘটিত হওয়া প্রতিপাদন করে এখন একটু গভীরভাবে তা ভেবে দেখুন।

তূর এমন একটি জায়গা যেখানে একটি অবদমিত ও নিষ্পেষিত জাতির উত্থান ঘটানো এবং একটি বিজয়ী ও জালেম জাতির পতন ঘটানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। আর এ সিদ্ধান্ত প্রাকৃতিক বিধানের (Physical law) ভিত্তিতে ছিল না বরং নৈতিক বিধান (Moral law) ও প্রতিফল বিধানের ভিত্তিতে ছিল। তাই আখেরাতের পক্ষে ঐতিহাসিক প্রমাণ হিসেবে তূরকে একটি উদাহরণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে। অর্থাৎ বনী ইসরাঈলের মত একটি অসহায় জাতির উত্থান ঘটানো এবং ফেরাউনের মত এক জবরদস্ত শাসককে সেনাবাহিনীসহ ডুবিয়ে দেয়া---যার ফায়সালা এক নিঝুম রাতে তূর পর্বতে গৃহীত হয়েছিল---এ ব্যাপারে মানবেতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত যে বিশ্ব-জাহানের বিশাল সাম্রাজ্যের স্বভাবসুলভ দাবী এই যে, মানুষের মত একটি বুদ্ধিমান ও স্বাধীন সৃষ্টির নৈতিক জবাবদিহি ও কর্মফল বিধানের আওতায় থাকা উচিত। আর এ দাবীর পূর্ণতা সাধনের জন্যই এমন একটি হিসেবের দিন আবশ্যক যেদিন গোটা মানবজাতিকে একত্রিত করে তার হিসেব নেয়া হবে। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা যারিয়াত টীকা, ২১)।

পবিত্র আসমানী গ্রন্থসমূহের শপথ করার কারণ হচ্ছে, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়ায় যত নবী-রসূল এসেছেন এবং তাঁরা যেসব কিতাব এনেছেন, প্রতি যুগে তাঁরা সেই একটি মাত্র খবরই দিয়েছেন, যা আজ মুহাম্মাদ ﷺ দিচ্ছেন। অর্থাৎ পূর্বের ও পরের সমস্ত মানুষকে জীবিত হয়ে একদিন আল্লাহর সামনে হাজির হতে হবে এবং নিজের কৃতকর্ম অনুসারে পুরস্কার বা শাস্তি পেতে হবে। এমন কোন আসমানী কিতাব কখনো আসেনি যাতে এ খবর দেয়া হয়নি। কিংবা উল্টা মানুষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এ দুনিয়ার জীবনই জীবন। মৃত্যুর পরে তো মানুষ মাটিতে পরিণত হবে। সুতরাং এ জীবনের পরে কোন হিসেব-নিকেশর বালাই নেই।

বায়তুল মা’মূরের শপথ করার কারণ হলো, সে যুগে বিশেষভাবে আরবের লোকদের জন্য কা’বা ঘরের ইমারত এমন একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল যা আল্লাহর নবী-রসূলদের সত্যবাদিতার স্পষ্ট প্রমাণ পেশ করছিল এবং মহান আল্লাহর পরিপূর্ণ হিকমত এবং চরম শক্তিমত্তা যে তাদের পৃষ্ঠপোষক সে সাক্ষ্যও পেশ করেছিল। এসব আয়াত নাযিলের আড়াই হাজার বছর পূর্বে উষর ও জনবসতিহীন পাহাড়সমূহের মধ্যে কোন লোক-লস্কর ও সাজ-সরঞ্জাম ছাড়াই এক ব্যক্তি আসেন এবং তাঁর স্ত্রী ও দুগ্ধপোষ্য সন্তানকে সম্পূর্ণ অসহায়ভাবে রেখে চলে যান। কিছুদিন পর সে ব্যক্তি পুনরায় সেখানে আসেন। এই জনহীন স্থানটিতে আল্লাহর ইবাদতের জন্য একটি ঘর নির্মাণ করেন এবং লোকজনের প্রতি এ বলে আহবান জানান, হে লোকজন, এখানে আস এবং এ ঘরে হজ্জ আদায় করো। এ নির্মাণ কাজ ও আহবান এমন বিস্ময়কর জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, ঐ ঘরটিই সমগ্র আরববাসীর কেন্দ্রে পরিণত হয়। এ আহবানে সাড়া দিয়ে মানুষ আরবের প্রত্যেক প্রান্ত থেকে লাব্বায়কা লাব্বায়কা বলে ছুটে আসে। আড়াই হাজার বছর পর্যন্ত এ ঘর এমন শান্তির আস্তানা হয়ে থাকে যে, এর চারদিকে গোটা দেশময় খুনখারাবি চলতে থাকলেও এ ঘরের সীমানায় এসে কারো গায়ে হাত তোলার দুঃসাহস কারো হয়না। তাছাড়া এ ঘরের কল্যাণেই আবর ভূমি প্রতি বছর চার মাসের জন্য এমন নিরাপত্তা লাভ করে যে, কাফেলাসমূহ তখন নিঃশঙ্কচিত্তে ভ্রমণ করে, ব্যবসা-বাণিজ্য, জমে ওঠে এবং ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য বাজার বসতে থাকে। তাছাড়া এ ঘরের এমন প্রভাব বজায় থাকে যে, পুরো এ সময়কালে অতি বড় কোন জালেমও সেদিকে চোখ তুলে তাকাতে পারেনি। আর যে এরূপ দুঃসাহস করেছে সে আল্লাহর এমন গযবের শিকার হয়েছে যে শিক্ষণীয় দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে। এসব আয়াত নাযিল হওয়ার মাত্র ৪৫ বছর পূর্বে লোকজন এ রকম একটি মজার ঘটনা নিজ চোখে দেখেছিল এবং তা দর্শনকারী বহু লোক সে সময় মক্কায় জীবিতও ছিল। এমন পরিস্থিতিতেই এ আয়াতগুলো তাদের শোনানো হচ্ছিলো। আল্লাহর নবী যে ফাঁকা বুলি আওড়ান না এর চেয়ে তার বড় প্রমাণ আর কি হতে পারতো? আল্লাহর নবীদের চোখ এমন কিছু দেখতে পান যা অন্যদের দৃষ্টিগোচর হয় না, তাদের মুখ থেকে এমন সব মহাসত্য বেরিয়ে আসে সাধারণ মানুষের বিবেক-বুদ্ধি যার ধারে কাছেও যেতে পারে না। তারা বাহ্যত এমন অনেক কাজ করেন যা দেখে এক যুগের লোক পাগলামী মনে করে বসে। কিন্তু তা দেখেই শত শত বছরের পরের লোকজন তাদের দূরদৃষ্টিতে বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়ে। এ ধরনের মহান ব্যক্তিগণ সর্বসম্মতভাবে প্রতি যুগেই যখন এ খবর দেন যে, কিয়ামত সংঘটিত হবে এবং এক ‘হাশর নাশর’ অনুষ্ঠিত হবে, তখন তাকে পাগলের প্রলাপ মনে করাটাই পাগলামি।

সুউচ্চ ছাদ (আসমানী) এবং তরঙ্গবিক্ষুদ্ধ সমুদ্রের শপথ করার কারণ হলো, এ দু’টি জিনিস আল্লাহর হিকমত এবং ক্ষমতার প্রতি ইঙ্গিত করে। তাছাড়া এ হিকমত ও ক্ষমতা দ্বারাই আখেরাতের সম্ভাব্যতা, অনিবার্যতা ও সংঘটিত হওয়া প্রমাণিত হয়। আসমান কিভাবে এ বিষয়ে ইঙ্গিত করে সে সম্পর্কে আমরা ইতিপূর্বে সূরা ক্বাফের ব্যাখ্যায় ৭নং টীকায় আলোচনা করেছি। বাকী থাকে শুধু সমুদ্রের বিষয়টি। তবে যে ব্যক্তি মুক্ত মনে ও অস্বীকার করার আগাম হঠকারী সিদ্ধান্ত ছাড়া সমুদ্র সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করবে, তার মন সাক্ষ্য দিতে বাধ্য যে, পৃথিবীর বুকে পানির এত বড় ভাণ্ডারের ব্যবস্থা হয়ে যাওয়াটাই এমন এক কারিগরী যা কোন আকস্মিক দুর্ঘটনার ফল হতে পারে না। তাছাড়া এর সাথে এত বেশী যৌক্তিক বিষয় তত্ত্ব সংশ্লিষ্ট আছে যে, আকস্মিকভাবে এরূপ জ্ঞানগর্ভ ও যুক্তিসঙ্গত ব্যবস্থা চালু হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সমুদ্রে অসংখ্য জীবজন্তু সৃষ্টি করা হয়েছে এবং এর প্রত্যেকটি প্রজাতিকে সমুদ্রের যে গভীরতায় বসবাসের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে তার দৈহিক ব্যবস্থাপনাও সেই গভীরতার উপযোগী করে সৃষ্টি করা হয়েছে। সমুদ্রের মধ্যে প্রতিদান কোটি কোটি জীবজন্তুর মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। এসব জীবজন্তুর দেহ যাতে পচে গলে না যায় সেজন্য এর পানি লবণাক্ত বানানো হয়েছে। সমুদ্রের পানি একটি নির্দিষ্ট সীমায় থামিয়ে রাখা হয়েছে। পৃথিবীর ফাটলের মধ্যে প্রবেশ করে তা তার অভ্যন্তরে নেমে যায় না কিংবা স্থলভাগে উঠে তা প্লাবিত করে দেয় না। লাখ লাখ ও কোটি কোটি বছর ধরে তা এ সীমার মধ্যেই থেমে আছে। পানির এ বিশাল ভাণ্ডার বহাল থাকার কারণেই পৃথিবীর স্থলভাগে বৃষ্টির ব্যবস্থা হয়। সূর্যের তাপ এবং বায়ু প্রবাহ সম্পূর্ণ নিয়মিতভাবে এ ব্যবস্থাকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। প্রাণীশূন্য না হওয়ার এবং এর মধ্যে নানা রকমের জীবজন্তু সৃষ্টি হওয়ার সুফল হয়েছে এই যে, মানুষ সমুদ্র থেকে ব্যাপক পরিমাণে তার খাদ্য এবং প্রয়োজনীয় বহু জিনিস লাভ করেছে। একটি নির্দিষ্ট সীমায় থেমে থাকার কারণে মহাদেশে ও দ্বীপগুলো টিকে আছে, যেখানে মানুষ বাস করছে। তা কতকগুলো অলংঘনীয় নিয়ম মেনে চলার কারণে সেখানে মানুষের জাহাজ চালানো সম্ভব হয়েছে। মহাজ্ঞানী ও মহাক্ষমতাধরের ক্ষমতা ছাড়া এ সুব্যবস্থাপনার কল্পনাও করা যেতে পারে না এবং এ ধারণাও পোষণ করা যায় না যে, মানুষ এবং পৃথিবীর অন্যান্য সৃষ্টির কল্যাণের সাথে সম্পৃক্ত সমুদ্রের এ সুশৃংখল ব্যবস্থাপনার যে সম্পর্ক তা আকস্মিক ও এলোপাতাড়িভাবে সৃষ্টি হয়েছে। এটা যদি এ বিষয়ের অনস্বীকার্য প্রমাণ হয় যে, এক মহাজ্ঞানী ও মহাশক্তিধর আল্লাহ পৃথিবীর বুকে মানুষকে আবাদ করার জন্য আরো অসংখ্য ব্যবস্থাপনার সাথে সাথে বিশাল এ লবণাক্ত সমুদ্র সৃষ্টি করেছেন তাহলে সে ব্যক্তি হবে চরম আহামক, যে মহাজ্ঞানী সেই আল্লাহ থেকে এমন মূর্খতা প্রত্যাশা করে যে, তিনি এ সমুদ্র থেকে মানুষের শস্য ক্ষেতসমূহ সিক্ত করে তার মাধ্যমে মানুষকে রিযিক দানের ব্যবস্থা করে দিবেন কিন্তু কখনো তাকে জিজ্ঞেস করবেন না যে, তুমি আমার রিযিক খেয়ে কিভাবে তার হক আদায় করেছো? তাছাড়া তিনি এ সমুদ্রের বুকে মানুষকে জাহাজ চালানোর ক্ষমতা দিবেন কিন্তু একথা কখনো জিজ্ঞেস করবেন না যে, তুমি ন্যায় ও সত্যের আনুগত্য করে জাহাজ চালিয়েছো না তার সাহায্যে সারা বিশ্বে ডাকাতি করে বেড়িয়েছো? অনুরূপভাবে যে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ক্ষমতার একটি নগণ্য বিস্ময়কর নমুনা এ বিশাল সমুদ্রের সৃষ্টি, যিনি মহাশূন্যে আবর্তনকারী ঝুলন্ত এ গ্রহ পৃষ্ঠে পানির এত বড় ভাণ্ডার ধরে রেখেছেন, যিনি তার মধ্যে এমন বিশাল পরিমাণ লবণ গুলিয়ে দিয়েছেন, যিনি এর মধ্যে নানা রকমের অসংখ্য প্রাণী ও উদ্ভিদ সৃষ্টি করেছেন এবং এর মধ্য থেকেই তাদের রিযিকের ব্যবস্থা করেছেন, যিনি প্রতি বছর সেখান থেকে শত শত কোটি টন পানি উঠিয়ে বাতাসের কাঁধে তুলে নিয়ে যান এবং কোটি কোটি বর্গমাইল ব্যাপী শুষ্ক অঞ্চলে নিয়মিতভাবে বর্ষণ করে চলেছেন তাঁর সম্পর্কে এ ধারণা পোষণ করাও চরম মূর্খতা ছাড়া কিছুই নয় যে, তিনি মানুষকে একবার সৃষ্টির করার পর এমন অক্ষম হয়ে যান যে, পুনরায় তাকে সৃষ্টি করতে চাইলেও করতে পারেন না।

৭.
মূল আয়াতাংশ হলো تَمُورُ السَّمَاءُ مَوْرًا । আরবী ভাষায় مور আবর্তিত হওয়া, কেঁপে কেঁপে ওঠা, ঘুরপাক খাওয়া এবং বারবার সামনে ও পেছনে চলা বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। কিয়ামতের দিন আসমানের যে অবস্থা হবে একথাটির মাধ্যমে তা বর্ণনা করে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যে, সেদিন ঊর্ধ্বজগতের সমস্ত ব্যবস্থাপনা ধ্বংস হয়ে যাবে এবং কেউ যদি সেদিন আকাশের দিকে তাকায় তবে দেখবে যে, সেই সুশোভিত নকশা বিকৃত হয়ে গিয়েছে যা সবসময় একই রকম দেখা যেতো আর চারদিকে একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে।
৮.
অন্য কথায় ভূপৃষ্ঠের আকর্ষণ ও বন্ধন পাহাড়াকে আটকে রেখেছিল তা শিথিল হয়ে যাবে এবং তা সমূলে উৎপাটিত হয়ে এমনভাবে শূন্যে উড়তে থাকবে যেন মেঘমালা ভেসে বেড়াচ্ছে।
অনুবাদ: