২ ) বিজ্ঞানময় কুরআনের কসম,
وَٱلْقُرْءَانِ ٱلْحَكِيمِ ٢
৩ ) তুমি নিঃসন্দেহে রসূলদের অন্তর্ভুক্ত, ২
إِنَّكَ لَمِنَ ٱلْمُرْسَلِينَ ٣
৪ ) সরল-সোজা পথ অবলম্বনকারী
عَلَىٰ صِرَٰطٍۢ مُّسْتَقِيمٍۢ ٤
৫ ) (এবং এ কুরআন) প্রবল পরাক্রমশালী ও করুণাময় সত্তার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত, ৩
تَنزِيلَ ٱلْعَزِيزِ ٱلرَّحِيمِ ٥
৬ ) যাতে তুমি সতর্ক করে দাও এমন এক জাতিকে যার বাপ-দাদাকে সতর্ক করা হয়নি এবং এ কারণে তারা গাফলতিতে ডুবে আছে। ৪
لِتُنذِرَ قَوْمًۭا مَّآ أُنذِرَ ءَابَآؤُهُمْ فَهُمْ غَـٰفِلُونَ ٦
৭ ) তাদের অধিকাংশই শাস্তি লাভের ফায়সালার হকদার হয়ে গেছে, এজন্যই তারা ঈমান আনে না। ৫
لَقَدْ حَقَّ ٱلْقَوْلُ عَلَىٰٓ أَكْثَرِهِمْ فَهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ ٧
৮ ) আমি তাদের গলায় বেড়ি পরিয়ে দিয়েছি, যাতে তাদের চিবুক পর্যন্ত জড়িয়ে গেছে, তাই তারা মাথা উঠিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ৬
إِنَّا جَعَلْنَا فِىٓ أَعْنَـٰقِهِمْ أَغْلَـٰلًۭا فَهِىَ إِلَى ٱلْأَذْقَانِ فَهُم مُّقْمَحُونَ ٨
৯ ) আমি তাদের সামনে একটি দেয়াল এবং পেছনে একটি দেয়াল দাঁড় করিয়ে দিয়েছি। আমি তাদেরকে ঢেকে দিয়েছি, এখন তারা কিছুই দেখতে পায় না। ৭
وَجَعَلْنَا مِنۢ بَيْنِ أَيْدِيهِمْ سَدًّۭا وَمِنْ خَلْفِهِمْ سَدًّۭا فَأَغْشَيْنَـٰهُمْ فَهُمْ لَا يُبْصِرُونَ ٩
১০ ) তুমি তাদেরকে সতর্ক করো বা না করো তা তাদের জন্য সমান, তারা মানবে না। ৮
وَسَوَآءٌ عَلَيْهِمْ ءَأَنذَرْتَهُمْ أَمْ لَمْ تُنذِرْهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ ١٠
১.
ইবনে আব্বাস, ইকরামা, দ্বাহ্হাক, হাসান বসরী ও সুফিয়ান ইবনে উয়াইনার বক্তব্য মতে এর অর্থ হচ্ছে, “হে মানুষ” অথবা “ওহে লোক” এবং কোন কোন মুফাস্সির একে “ইয়া সাইয়েদ” এর সংক্ষিপ্ত উচ্চারণও গণ্য করেন। এ ব্যাখ্যার প্রেক্ষিতে ধরা যায় নবী ﷺ কে উদ্দেশ্য করে এ শব্দগুলো বলা হয়েছে।
২.
এভাবে বক্তব্য শুরু করার কারণ নাউযুবিল্লাহ এ নয় যে, নবী ﷺ তাঁর নবুওয়াতের ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দিহান ছিলেন এবং তাঁকে নিশ্চয়তা দান করার জন্য আল্লাহর একথা বলার প্রয়োজন হয়েছিল। বরং এর কারণ হচ্ছে এই যে, সে সময় কুরাঈশ বংশীয় কাফেররা অত্যন্ত জোরেশোরে নবী করীমের ﷺ নবুওয়াত অস্বীকার করছিল। তাই আল্লাহ কোন প্রকার ভূমিকা ছাড়াই তাঁর ভাষণ শুরুই করেছেন এ বাক্য দিয়ে যে, “তুমি নিশ্চয়ই রসূলদের অন্তর্ভুক্ত।” অর্থাৎ যারা তোমার নবুওয়াত অস্বীকার করছে তারা বিরাট ভুল করছে। তারপর একথার ওপর কুরআনের কসম খাওয়া হয়েছে এবং কুরআনের গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে “বিজ্ঞানময়” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে এই যে, তোমার নবী হবার সুস্পষ্ট প্রমাণ হচ্ছে এ কুরআন যা পুরোপুরি জ্ঞানে পরিপূর্ণ। এ জিনিসটি নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, যে ব্যক্তি এমন জ্ঞানপূর্ণ বাণী উপস্থাপন করছেন তিনি নিঃসন্দেহে আল্লাহর রসূল। কোন মানুষ এমন ধরনের বাণী রচনা করার ক্ষমতা রাখে না। আর মুহাম্মাদ ﷺ কে যারা জানতো তাদের পক্ষে কোনক্রমেই এ বিভ্রান্তির শিকার হওয়া সম্ভব ছিল না যে, এ বাণী তিনি নিজে রচনা করে আনছেন অথবা অন্য কোন মানুষের কাছ থেকে শিখে এসে শুনাচ্ছেন। (এ বিষয়বস্তু বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা ইউনুস, ২০, ২১, ২২, ৪৪, ৪৫; বনী ইসরাঈল, ১০৪, ১০৫, টীকা; সূরা নূরের ভূমিকা; সূরা আশ্ শূআরা ১; আন নামল, ৯২; আল কাসাস ৬২, ৬৩, ৬৪, ১০২-১০৯; আল আনকাবুত, ৮৮-৯১ টীকা এবং আর রুমের ঐতিহাসিক পটভূমি ও ১, ২, ৩ টীকা।)
৩.
এখানে কুরআন নাযিলকারীর দু’টি গুণের কথা বলা হয়েছে। এক, তিনি প্রবল ও পরাক্রান্ত। দুই, তিনি করুণাময়। প্রথম গুণটি বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে এ সত্যটি সম্পর্কে সতর্ক করা যে, এ কুরআন কোন অক্ষম উপদেষ্টার উপদেশ নয় যে, একে উপেক্ষা করলে তোমাদের কোন ক্ষতি হবে না। বরং এটি এমন বিশ্ব-জাহানের মালিকের ফরমান যিনি সবার ওপর প্রবল পরাক্রান্ত, যাঁর ফায়সালাসমূহ প্রয়োগ করার পথে কোন শক্তি বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে না এবং যাঁর পাকড়াও থেকে রেহাই পাবার ক্ষমতা করো নেই। আর দ্বিতীয় গুণটি বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে এ অনুভূতি সৃষ্টি করা যে, তিনি নিছক দয়াপরবশ হয়ে তোমাদের হিদায়াত ও পথ দেখাবার জন্য নিজের রসূল পাঠিয়েছেন এবং এ মহান কিতাবটি নাযিল করেছেন, যাতে তোমরা গোমরাহী মুক্ত হয়ে এমন সরল সঠিক পথে চলতে পারো যে পথে চলে তোমরা দুনিয়া ও আখেরাতের সাফল্য লাভ করতে পারবে।
৪.
এ আয়াতের দু’টি অনুবাদ হতে পারে। এর একটি অনুবাদ ওপরে করা হয়েছে। আর দ্বিতীয়টি এও হতে পারে যে, “একটি জাতির লোকদেরকে তুমি সে জিনিসের ভয় দেখাও যার ভয় তাদের বাপ-দাদাদেরকেও দেখানো হয়েছিল, কারণ তারা গাফলতিতে ডুবে আছে।” প্রথম অর্থটি গ্রহণ করলে বাপ-দাদা বলতে নিকট অতীতে অতিক্রান্ত বাপ-দাদাদের কথা বুঝানো হবে। কারণ দূর অতীতে আরব ভূখণ্ডে বহু নবী-রসূল এসেছিলেন। আর দ্বিতীয় অর্থ গ্রহণ করলে এর অর্থ দাঁড়াবে প্রাচীনকালে এ জাতির পূবর্পুরুষদের কাছে নবীদের মাধ্যমে যে পয়গাম এসেছিল এখন তাকে পুনরুজ্জীবিত করো। কারণ এরা তা ভুলে গেছে। এদিক দিয়ে দু’টি অনুবাদের মধ্যে আসলে কোন বৈপরীত্য নেই এবং অর্থের দিক দিয়ে উভয় অনুবাদ সঠিক ও অর্থবহ।
এ জায়গায় সন্দেহ জাগে যে, এ জাতির পূর্ববর্তী লোকেরা এমন একটি যুগ অতিক্রম করেছিল যখন তাদের কাছে কোন নবী আসেনি, এ সময়ে নিজেদের গোমরাহীর জন্য তারা নিজেরা কেমন করে দায়ী হতে পারে? এর জবাব হচ্ছে, আল্লাহ যখনই দুনিয়ায় কোন নবী পাঠান তখনই তাঁর শিক্ষা ও হিদায়াতের প্রভাব দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং বংশ পরম্পরায় এ প্রভাব বিস্তার লাভ করতে থাকে। এ প্রভাব যতদিন টিকে থাকে এবং নবীর অনুসারীদের মধ্যে যতদিন পর্যন্ত এমনসব লোকের আবির্ভাব ঘটতে থাকে যারা হিদায়াতের প্রদীপ উজ্জ্বল করে যেতে থাকেন ততদিন পর্যন্তকার সময়কে হিদায়াতবিহীন গণ্য করা যেতে পারে না। আর যখন এ নবী শিক্ষার প্রভাব একদম নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় অথবা তা পুরোপুরি বিকৃত হয়ে যায় তখন সেখানে নতুন নবীর আবির্ভাব অপরিহার্য হয়ে ওঠে। নবী ﷺ এর আগমনের পূর্বে আরবে হযরত ইবরাহীম, ইসমাঈল, শো'আইব, মূসা ও ঈসা আলাইহিমুস সালামের শিক্ষার প্রভাব চতুর্দিকে ছড়িয়েছিল। আর মাঝে মাঝে এ জাতির মধ্যে এমনসব লোকের আবির্ভাব ঘটতো অথবা বাইর থেকে আগমন হতে থাকতো যারা এ প্রভাবগুলোকে তরতাজা করে তুলতেন। যখন এ প্রভাবগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার কাছাকাছি পৌঁছে যায় এবং আসল শিক্ষাও বিকৃত হয়ে যায় তখন মহান আল্লাহ নবী ﷺ কে পাঠান এবং এমন ব্যবস্থা অবলম্বন করেন যার ফলে তাঁর হিদায়াতের প্রভাব নিশ্চিহ্ন হতে পারবে না এবং তা বিকৃত হতেও পারবে না। (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন সূরা সাবা, ৫ টীকা)।
৫.
যারা নবী ﷺ এর দাওয়াতের মোকাবিলায় জিদ ও গোয়ার্তুমির পথ অবলম্বন করেছিল এবং তাঁর কথা কোনভাবেই মানবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এখানে তাদের কথা বলা হয়েছে। তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, “তারা শাস্তি লাভের ফায়সালার হকদার হয়ে গেছে, তাই তারা ঈমান আনছে না।" এর অর্থ হচ্ছে, যারা উপদেশে কান দেয় না এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে নবীদের মাধ্যমে প্রমাণ পুরোপুরি উপস্থাপিত হবার পরও সত্য অস্বীকার ও সত্যের সাথে শত্রুতার নীতি অবলম্বন করে চলতেই থাকে তাদের ওপর তাদের নিজেদেরই কৃতকর্মের দুর্ভোগ চাপিয়ে দেয়া হয় এবং তারপর তাদের ঈমান লাভের সৌভাগ্য হয় না। এ বিষয়বস্তুকে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে এ বাক্যের মধ্যে প্রবেশ করে দেয়া হয়েছে যে, “তুমি তো এমন ব্যক্তিকেই সতর্ক করতে পারো যে উপদেশ মেনে চলে এবং না দেখে দয়াময় আল্লাহকে ভয় করে।”
৬.
এ আয়াতে বেড়ি মানে হচ্ছে তাদের নিজেদের হঠকারিতা। তাদের জন্য সত্য গ্রহণ করার পথে এটি প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। “চিবুক পযর্ন্ত জড়িয়ে গেছে” এবং “মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে”-এর অর্থ হচ্ছে, অহংকারবশতঃ ঘাড় তেড়া করে দাঁড়িয়ে থাকা। আল্লাহ বলছেন, তাদের জিদ ও হঠকারিতাকে আমি তাদের ঘাড়ের বেড়িতে পরিণত করে দিয়েছি এবং যে অহংকার ও আত্মম্ভরিতায় তারা লিপ্ত রয়েছে তার ফলে তাদের ঘাড় এমনভাবে বাঁকা হয়ে গেছে যে, কোন উজ্জ্বলতর সত্য তাদের সামনে এসে গেলেও তারা সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করবে না।
৭.
সামনে একটি দেয়াল ও পেছনে একটি দেয়াল দাঁড় করিয়ে দেবার অর্থ হচ্ছে এই যে, এ হঠকারিতা ও অহংকারের স্বাভাবিক ফলশ্রুতিতে তারা পূর্বের ইতিহাস থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ করে না এবং ভবিষ্যত পরিণামের কথাও চিন্তা করে না। তাদের অন্ধ স্বার্থপ্রীতি তাদেরকে এমনভাবে চারদিক থেকে ঢেকে নিয়েছে এবং তাদের বিভ্রান্তি এমনভাবে তাদের চোখের ওপর আচ্ছাদন টেনে দিয়েছেন যার ফলে প্রত্যেক সুস্থবোধ সম্পন্ন ও অন্ধ স্বার্থপ্রীতিহীন মানুষ যে উন্মুক্ত সত্য দেখতে পায় তা তারা দেখতে পায় না।
৮.
এর অর্থ এ নয় যে, এ অবস্থায় সত্যদ্বীনের কথা প্রচার করা অর্থহীন। বরং এর অর্থ হচ্ছে, তোমার সাধারণ প্রচার সব ধরনের মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। তাদের মধ্য থেকে কিছু লোকের কথা ওপরে বর্ণনা করা হয়েছে এবং কিছু লোকের কথা সামনের দিকের আয়াতে আসছে। প্রথম ধরনের লোকদের মুখোমুখি হয়ে যখন দেখবে তারা অস্বীকার, অহংকার, বিদ্বেষ ও বিরোধিতার ওপর স্থির হয়ে আছে তখন তাদের পেছনে লেগে থাকার দরকার নেই। কিন্তু তাদের এ আচরণে হতাশ হয়েও মনোবল হারিয়ে নিজের কাজ ছেড়ে দিয়ে বসে পড়ো না। কারণ, তুমি জানো না, মানুষের এ ভীড়ের মধ্যে আল্লাহর এমন বান্দা কোথায় আছে যে উপদেশ গ্রহণ করবে এবং আল্লাহকে ভয় করে সরল-সঠিক পথে চলে আসবে। তোমার সত্য প্রচারের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে এ দ্বিতীয় ধরনের লোকদের সন্ধান করা এবং তাদেরকে ছাঁটাই বাছাই করে বের করে আনা। একদিকে হঠকারীদেরকে ত্যাগ করে যেতে হবে এবং অন্যদিকে এ মূল্যবান সম্পদ হস্তগত করতে হবে।