ঘটনা হলো, কুরাইশরা হুদাইবিয়ার সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করলে রসূলুল্লাহ ﷺ মক্কার ওপর আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন। কিন্তু কোথায় অভিযান পরিচালনা করতে চাচ্ছেন বিশিষ্ট কয়েকজন সাহাবা ছাড়া আর কাউকে তিনি তা বললেন না। ঘটনাক্রমে এই সময় মক্কা থেকে একজন মহিলা আসল। পূর্বে সে আবদুল মুত্তালিবের দাসী ছিল। কিন্তু পরে দাসত্ব শৃঙ্খল মুক্ত হয়ে গানবাদ্য করে বেড়াত। নবীর ﷺ কাছে এসে সে তার দারিদ্রের কথা বলল এবং কিছু অর্থ সাহায্য চাইল। তিনি বনী আবদুল মুত্তালিব এবং বনী মুত্তালিবের লোকদের কাছ থেকে কিছু অর্থ চেয়ে দিয়ে তার অভাব পূরণ করলেন। সে মক্কায় ফিরে যেতে উদ্যত হলে হযরত হাতেব ইবনে আবু বালতা’আ তার সাথে দেখা করলেন এবং মক্কার কয়েকজন নেতার নামে লেখা একখানা পত্র তাকে দিলেন। আর সে যাতে এই গোপনীয় বিষয়টি প্রকাশ না করে এবং গোপনে তাদের কাছে পৌঁছে দেয় সেজন্য তিনি তাকে দশটি দিনারও দিলেন। সে সবেমাত্র মদীনা থেকে রওয়ানা হয়েছিল। ইতিমধ্যে আল্লাহ তা’আলা বিষয়টি নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অবহিত করলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ হযরত আলী, হযরত যুবায়ের এবং হযরত মিকদাদ ইবনে আসওয়াদকে তার সন্ধানে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি নির্দেশ দিলেন, তোমরা দ্রুত অগ্রসর হও। রাওদায়ে খাখ নামক স্থানে (মদীনা থেকে মক্কার পথে ১২ মাইল দূরে) তোমরা এক মহিলার সাক্ষাৎ পাবে। তার কাছে মুশরিকদের নামে হাতেবের একটি পত্র আছে। যেভাবে হোক তার নিকট থেকে এ পত্রখানা নিয়ে এসো। সে যদি পত্রখানা দিয়ে দেয় তাহলে তাকে ছেড়ে দেবে। আর যদি না দেয় তাহলে তাকে হত্যা করবে। তাঁরা ঐ স্থানে পৌঁছে মহিলাকে দেখতে পেলেন। তাঁরা তার কাছে পত্রখানা চাইলেন। কিন্তু সে বললঃ আমার কাছে কোন পত্র নেই। তাঁরা তার দেহ তাল্লাশী করলেন। কিন্তু কোন পত্র পাওয়া গেল না। অবশেষে তারা বললেনঃ পত্রখানা আমাদের দিয়ে দাও তা না হলে আমরা তোমাকে উলঙ্গ করে তল্লাশী নেব। সে যখন বুঝতে পরলো রক্ষা পাওয়ার কোন উপায় নেই তখন সে তার চুলের খোপার ভেতর থেকে পত্রখানা বের করে তাদের দিল। আর তাঁরা তা নিয়ে নবীর ﷺ দরবারে হাজির হলেন। পত্র খুলে পড়া হলো। দেখা গেল তাতে কুরাইশদের অবগত করানো হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ ﷺ তোমাদের বিরুদ্ধে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। (বিভিন্ন বর্ণনায় পত্রের ভাষা ভিন্ন ভিন্ন বর্ণিত হয়েছে কিন্তু বিষয়বস্তু ছিল এটিই) নবী (সা.) হযরত হাতেবকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি একি করেছো? তিনি বললেনঃ আপনি আমার ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না। আমি যা করেছি তা এজন্য করি নাই যে, আমি কাফের বা মুরতাদ হয়ে গিয়েছি এবং ইসলামকে পরিত্যাগ করে এখন কুফরকে ভালবাসতে শুরু করেছি। প্রকৃত ব্যাপার হলো, আমার আপনজনেরা সব মক্কায় অবস্থান করছে। আমি কুরাইশ গোত্রের লোক নই। বরং কুরাইশদের কারো কারো পৃষ্ঠপোষকতা ও ছত্রছায়ায় আমি সেখানে বসতি স্থাপন করেছিলাম। অন্য যেসব মুহাজিরের পরিবার-পরিজন মক্কায় অবস্থান করছে তাদের গোত্র তাদের রক্ষা করবে। কিন্তু আমার পরিবার-পরিজনকে রক্ষা করার মত কেউই সেখানে নেই। তাই আমি এই পত্র লিখেছিলাম। আমি মনে করেছিলাম, এটা হবে কুরাইশদের প্রতি আমার একটা অনুগ্রহ। এই অনুগ্রহের কথা মনে করে তারা আমার সন্তানদের ওপর নির্যাতন চালাবে না। (হযরত হাতেবের পুত্র আবদুর রহমান বর্ণনা করেছেন যে, ঐ সময় হযরত হাতেবের সন্তান-সন্তুতি ও ভাই মক্কায় অবস্থান করছিল। তাছাড়া হযরত হাতেবের নিজের একটি বর্ণনা থেকে জানা যায় সেসময় তাঁর মাও সেখানে ছিল।) হাতেবের এই বক্তব্য শুনে রসূলুল্লাহ ﷺ উপস্থিত সবাইকে বললেনঃ قَدْ صَدَقَكُمْ হাতেব তোমাদের কাছে সত্য কথাই বলেছে। অর্থাৎ এটিই তার এ কাজের মূল কারণ। ইসলামকে পরিত্যাগ বা কুফরকে সহযোগিতা করার মানসিকতা এর চালিকাশক্তি নয়। হযরত উমর উঠে বললেনঃ হে আল্লাহর রসূল, আমাকে অনুমতি দিন এই মুনাফিকের শিরচ্ছেদ করি। সে আল্লাহ, তাঁর রসূল এবং মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। নবী (সা.) বললেন, এ ব্যক্তি তো বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। তোমরা তো জানো না, হয়তো আল্লাহ তা’আলা বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারীদের বিষয় বিবেচনা করে বলে দিয়েছেনঃ তোমরা যাই করো না কেন আল্লাহ তোমাদের মাফ করে দিয়েছেন। (শেষ বাক্যাংশটির ভাষা বিভিন্ন রেওয়ায়াতে বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। কোনটাতে আছে قَدْ غَفَرْتُ لَكُمْ ‘আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছি।’ কোনটাতে আছে انى غافر لكم ‘আমি তোমাদের মাফ করে দেব।’ আবার কোনটাতে আছে ساغفر لكم ‘আমি অচিরেই তোমাদের মাফ করে দেব’) একথা শুনে হযরত ‘উমর (রা.) কেঁদে ফেললেন এবং বললেনঃ আল্লাহ এবং তাঁর রসূলই সর্বাধিক জানেন। এ হলো বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে জারীর, তাবরী, ইবনে হিশাম, ইবনে হিব্বান এবং ইবনে আবী হাতেব কর্তৃক সহীহ সনদে বর্ণিত বহু সংখ্যক হাদীসের সার সংক্ষেপ। এসব বর্ণনার মধ্যে যে বর্ণনাটি হযরত আলীর নিজের মুখ থেকে তাঁর সেক্রেটারী উবায়দুল্লাহ ইবনে আবু রাফে শুনেছেন এবং তার নিকট থেকে হযরত আলীর (রা.) পৌত্র হাসান ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে হানাফীয়া শুনে পরবর্তী রাবীদের কাছে পৌঁছিয়েছেন সেটিই সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য। এসব বর্ণনার কোনটিতেই স্পষ্ট করে একথা বলা হয়নি যে, হযরত হাতেবের এই ওজর শোনার পর তাঁকে মাফ করে দেয়া হয়েছিল। আবার কোন সূত্র থেকে একথাও জানা যায় না যে, তাঁকে কোন শাস্তি দেয়া হয়েছিল। তাই আলেমগণ ধরে নিয়েছেন হযরত হাতেবের ওজর গ্রহণ করে তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল।
একঃ কাজ যিনি করেছেন তিনি কি নিয়ত করেছেন সে বিষয়টি বাদ দিলেও এ কাজটি ছিল স্পষ্টত গুপ্তচরবৃত্তি তাও আবার অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতিতে চরম বিপজ্জনক প্রকৃতির গুপ্তচরবৃত্তি। অর্থাৎ আক্রমণের ঠিক পূর্বক্ষণে বে-খবর শত্রুকে সাবধান করে দেয়া হয়েছিল। তাছাড়া ব্যাপারটা শুধু সন্দেহের পর্যায়ে ছিল না। অভিযুক্তের নিজ হাতে লেখা পত্রও ধরা পড়েছিল। তাই আর কোন প্রমাণেরও প্রয়োজন ছিল না তখন শান্তিকালীন অবস্থা ছিল না, যুদ্ধকালিন অবস্থা বিরাজ করেছিল। তা সত্ত্বেও নবী ﷺ হাতেবকে সাফাই ও নির্দোষিত প্রমাণ করার সুযোগ না দিয়ে গ্রেফতার করলেন না। আর কোন রুদ্ধদ্বার কক্ষে তাকে সাফাই পেশ করতে বলা হয়নি। বরং উন্মুক্ত আদালতে সবার সামনে সাফাই পেশ করতে দিয়েছেন। এ থেকে স্পষ্ট জানা যায়, ইসলামে এমন কোন আইন-কানুন ও নিয়ম-পদ্ধতির আদৌ কোন অবকাশ নেই যার ভিত্তিতে শাসক শুধু নিজের অবগতি ও সন্দেহের ওপর ভিত্তি করে কোন অবস্থায় কাউকে গ্রেফতার করার অধিকার রাখে। তাছাড়া বদ্ধ কামরায় গোপনপন্থায় কারো বিরুদ্ধে মোকাদ্দমা চালানোর কোন বিধানও ইসলামে নেই।
দুইঃ হযরত হাতেব শুধু মুহাজিরই ছিলেন না। তিনি বদর যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। সাহাবীদের মধ্যেও তার একটা বিশেষ মর্যাদা ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি এত বড় অপরাধ করে ফেলেছিলেন যে, আল্লাহ তা’আলা কুরআন মজীদে অত্যন্ত কঠোরভাবে তার সমালোচনা করেছেন যা উপরোল্লেখিত আয়াত থেকে জানা যেতে পারে। বিভিন্ন হাদীসেও তার এ কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে এবং তাফসীরকারদের মধ্যে এ ঘটনার উল্লেখ করেননি এমন তাফসীরকার নেই বললেই চলে। সাবাহায়ে কেরাম যে নির্ভুল ও নিষ্পাপ নন এটি তার বহু সংখ্যক প্রমাণের একটি। মানবীয় দুর্বলতার কারণে তাঁদের দ্বারাও ভুল-ত্রুটি হতে পারে এবং কার্যত হয়েছেও। আল্লাহ এবং তাঁর রসূল সাহাবীদের প্রতি সম্মান দেখানোর যে শিক্ষা দিয়েছেন তার দাবী কখনো এ নয় যে, তাদের কারো দ্বারা কোন ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকলে তার উল্লেখ করা যাবে না। তাই যদি হতো তাহলে আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কিতাবে তার উল্লেখ করতেন না এবং সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, মূফাস্সির এবং মুহাদ্দিসগণও তাদের রেওয়ায়াতেসমূহে তা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করতেন না।
তিনঃ হযরত হাতেবের ঘটনায় হযরত উমর (রা.) যে অভিমত ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন তা ছিল হযরত হাতেবের কাজের বাহ্যিক অবস্থার প্রেক্ষিতে। হযরত উমরের যুক্তি ছিল এটি এমন একটি কাজ যা সরাসরি আল্লাহ, আল্লাহর রসূল এবং মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। অতএব হাতেব মুনাফিক এবং হত্যার উপযুক্ত। কিন্তু রসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গী প্রত্যাখ্যান করলেন এবং ইসলামী শরীয়াতের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরে বললেনঃ কাজের বাহ্যিক অবস্থা বিচার করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত নয়। বরং এও দেখা উচিত যে, যে ব্যক্তির দ্বারা কাজটি সংঘটিত হয়েছে তার অতীত জীবন এবং সার্বিক স্বভাব-চরিত্র কেমন। তার চাল-চলন কিসের ইঙ্গিত দেয়। নিঃসন্দেহে কাজটির বাহ্যিক রূপ ছিল গুপ্তচরবৃত্তি। কিন্তু কাজটি যিনি করেছেন ইসলাম ও ইসলামের অনুসারীদের সাথে তার আজ পর্যন্তকার আচরণ কি একথাই বলে যে, এ ব্যক্তি আল্লাহ, তাঁর রসূল এবং মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার নিয়তে এ কাজ করতে পারে? যারা ঈমান রক্ষার কারনে হিজরাত করেছিলেন তিনি তাদের একজন। ঐকান্তিক নিষ্ঠা ছাড়া কি তিনি এত বড় ত্যাগ স্বীকার করতে পারতেন? বদর যুদ্ধের মত নাজুক পরিস্থিতিতেও যখন শত্রুর তিনগুণ এবং অনেক বেশী ও ব্যাপকভাবে অস্ত্রসজ্জিত শক্তির সাথে মোকাবিলা হতে যাচ্ছিল---তখন ঈমানের খাতিরে তিনি জীবন বাজী রেখেছিলেন। এমন ব্যক্তির নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা কি সন্দেহযুক্ত হতে পারে? অথবা তাঁর সম্পর্কে কি একথা বিশ্বাস করা যেতে পারে যে, তাঁর অন্তরে কুরাইশ কাফেরদের প্রতি সামান্যতম আকর্ষণ ও সহানুভূতি থাকতে পারে? তিনি অত্যন্ত স্পষ্টভাষায় তাঁর কাজের কারণ তুলে ধরেছেন এই বলে যে, মক্কায় তাঁর ছেলে-মেয়ের জন্য বংশ ও গোত্রের এমন কোন নিরাপত্তা ব্যুহ নেই যা অন্য মুহাজিরদের আছে। তাই যুদ্ধের সময় তাদেরকে শত্রুর নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি এ কাজ করেছেন। মক্কায় যে তাঁর কোন আপন গোত্র নেই, বাস্তব অবস্থাও তার প্রমাণ এবং একথাও সবার জানা যে, তাঁর সন্তান-সন্তুতি সেখানেই অবস্থান করছে। তাই তাঁর এ বক্তব্য মিথ্যা মনে করার কোন কারণ নেই। তাছাড়া তাঁর সম্পর্কে এ অভিমত পোষণ করা এবং তাঁর এ বক্তব্য যে তাঁর কাজটির মূল কারণ নয়, বরং তাঁর মধ্যে বিশ্বাসঘাতকতার উদ্দেশ্য কাজ করছিল, সেরূপ মনে করার কোন সঙ্গত যুক্তি নেই। তথাপি নিছক ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে শত্রুদেরকে মুসলমানদের সামরিক পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত করা সদুদ্দেশ্যে হলেও একজন নিষ্ঠাবান মুসলমানের জন্য এরূপ কাজ ও আচরণ জায়েজ নয়। কিন্তু সৎ ও নিষ্ঠাবান লোকের ত্রুটি এবং মুনাফিকের বিশ্বাসঘাতকতার মধ্যে বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান। শুধু কাজের ধরন ও প্রকৃতি দেখে উভয়ের একই শাস্তি হতে পারে না। আলোচ্য মোকাদ্দমায় এটি ছিল রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সিদ্ধান্ত। সূরা মুমতাহিনার এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা’আলা তাঁর উক্ত সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছেন। গভীর মনোনিবেশ সহকারে ওপরের তিনটি আয়াত পড়লে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, এসব আয়াতে হযরত হাতেবকে তিরষ্কার করা হয়েছে ঠিকই; তবে একজন মু’মিনকে তিরষ্কারের ধরন যা হয়ে থাকে এটা ঠিক সেই ধরনের তিরষ্কার। কোন মুনাফিকের জন্য যে ধরনের তিরষ্কার হয়ে থাকে এটা ঠিক তা নয়। তাছাড়া তাকে কোন আর্থিক বা শারীরিক শাস্তি দেয়া হয়নি। বরং প্রকাশ্যে কঠোর তিরষ্কার, সমালোচনা ও শাসনবাণী শুনিয়েই ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তার অর্থ, মুসলিম সমাজে একজন অপরাধী ঈমানদারের মর্যাদাহানি হওয়া এবং তার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়াও তার জন্য একটি বড় শাস্তি।
চারঃ বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদের মর্যাদা সম্পর্কে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উক্তিঃ তুমি তো জান না, আল্লাহ তা’আলা হয়তো বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ডেকে বলে দিয়েছেনঃ তোমরা যাই করো না কেন, আমি তোমাদের মাফ করে দিয়েছি”---এর অর্থ এ নয় যে, বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদের সাত খুন মাফ করে দেয়া হয়েছে এবং পৃথিবীতে যে গোনাহ ও অপরাধই তারা করতে চাইবে তা করার অবাধ স্বাধীনতা তাদের দেয়া হয়েছে। এসব অপরাধ ক্ষমা করার অগ্রিম নিশ্চয়তা তারা লাভ করেছেন তা বুঝাতে নবী (সা.) একথা বলেননি, কোন সাহাবীও কোন সময় একথার এ অর্থ গ্রহণ করেননি, এ সুসংবাদ শুনে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কোন সাহাবীও যেকোন গোনাহর কাজ করার ব্যাপারে নিজেকে স্বাধীন মনে করেননি এবং ইসলামী শরীয়াতও এর ভিত্তিতে এমন কোন ফর্মুলা তৈরী করেনি যে, বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কোন সাহাবীর দ্বারা যদি কোন অপরাধ সংঘটিত হয় তাহলে তাকে কোন শাস্তি দেয়া যাবে না। প্রকৃতপক্ষে যে ক্ষেত্র এ পরিবেশে কথাটা বলা হয়েছিল সেই ক্ষেত্র ও পরিবেশ এবং নবী (সা.) যে কথাটি বলেছিলেন সেই কথাটি সম্পর্কে যদি চিন্তা-ভাবনা ও পর্যালোচনা করা যায় তাহলে এর যে স্পষ্ট অর্থ বুঝা যায় তাহলো, বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীগণ আল্লাহ ও তাঁর দ্বীনের জন্য নিষ্ঠা, কুরবানী এবং বীরত্ব ও সাহসিকতার এত বড় কৃতিত্ব দেখিয়েছেন যার ভিত্তিতে আল্লাহ তা’আলা যদি তাদের আগের ও পরের সব গোনাহ মাফ করে দিয়ে থাকেন তাহলে তাঁদের এই খেদমত এবং আল্লাহ তা’আলার দয়া ও অনুকম্পার প্রতি লক্ষ্য করলে তা কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। অতএব বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এক সাহাবী সম্পর্কে বিশ্বাসঘাতকতা ও মুনাফিকীর সন্দেহ করো না। অপরাধের যে কারণ সে নিজে বর্ণনা করেছে তা গ্রহণ করো।
পাঁচঃ কুরআন মজীদ এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী থেকে একথাও স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কাফেরদের জন্য কোন মুসলমানের গোয়েন্দাগিরি করাটাই তার মুরতাদ, বেঈমান অথবা মুনাফিক হয়ে যাওয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য যথেষ্ট নয়। এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য যদি অন্য কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে তাহলে ভিন্ন কথা। তা নাহলে এটি নিছক একটি অপরাধমূলক কাজ, কুফরীমূলক কাজ নয়।
ছয়ঃ কুরআন মজীদের এই আয়াত থেকে এ বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, কাফেরদের পক্ষ হয়ে মুসলমানদের গোয়েন্দাগিরি করা কোন অবস্থায়ই জায়েজ নয়। এতে কারো নিজের কিংবা তার অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের প্রাণ ও সম্পত্তি যত কঠিন বিপদের মুখোমুখি হোক না কেন।
সাতঃ হযরত উমর (রা.) যখন হযরত হাতেবকে গোয়েন্দাগিরির অপরাধে হত্যা করার অনুমতি প্রার্থনা করলেন তখন তার জবাবে নবী (সা.) একথা বলেননি যে, এ ধরনের অপরাধ হত্যা যোগ্য অপরাধ নয়। বরং তিনি হত্যা করার অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানালেন এজন্য যে, বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা হাতেবের নিষ্ঠা ও সৎ নিয়তের স্পষ্ট প্রমাণ। তার এ বক্তব্যও সত্য যে, তিনি শত্রুদের কল্যাণ কামনায় নয়, বরং নিজের সন্তান-সন্তুতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এ কাজ করেছিলেন। এ ঘটনা থেকে একদল ফকীহ প্রমাণ পেশ করেছেন যে, মুসলিম গুপ্তচরদের হত্যা করাই হলো সাধারণ আইন। তবে যদি অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কারণ বর্তমান থাকে তাহলে তাকে ন্যূনতম শাস্তি দিয়ে কিংবা শুধু তিরষ্কার করে ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। এ ব্যাপারে ফকীহদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। ইমাম শাফেয়ী (র) এবং অপর কিছুসংখ্যক ফিকাহবিদদের মত হলো, মুসলিম গুপ্তচরদের তাযীর করতে হবে। কিন্তু তাকে হত্যা কারা জায়েয নয়। ইমাম আবু হানিফী (র) এবং ইমাম আওযায়ী বলেনঃ তাকে দৈহিক শাস্তি দিতে হবে এবং দীর্ঘদিন বন্দী করে রাখার শাস্তি দিতে হবে। ইমাম মালেক বলেনঃ তাকে হত্যা করতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে মালেকী ফকীহদের বক্তব্য ভিন্নরূপ। আশহাব বলেনঃ এ ব্যাপারে ইমাম ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী। অপরাধ এবং অপরাধীর অবস্থা বিবেচনা করে তিনি তাঁর ইজতিহাদের ভিত্তিতে কোন শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারেন। ইমাম মালেক (র) এবং ইবনুল কাসেমের একটি মতও তাই। ইবনুল মাজেশুন এবং আবদুল মালেক ইবনে হাবীব বলেন, গুপ্তচরবৃত্তি যদি অপরাধীর স্বভাবে পরিণত হয়ে থাকে তাহলে তাকে হত্যা করতে হবে। ইবনে ওয়াহাব বলেনঃ গুপ্তচরবৃত্তির শাস্তি মূলত মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু সে যদি এ কাজ থেকে তাওবা করে তাহলে তাকে মাফ করা যেতে পারে। সাহনূন বলেনঃ তাওবার ক্ষেত্রে তার তাওবা সত্যিকার তাওবা না ধোঁকাবাজি তা কিভাবে নিরূপণ করা যাবে? তাই তাকে হত্যা করাই উচিত। ইবনুল কাসেমের একটি মত এ বক্তব্যের সর্মথন করে। আসবাগ বলেনঃ হারবী বা যুদ্ধরত জাতির গুপ্তচরের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু মুসলিম ও যিম্মী গুপ্তচরকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে শাস্তি দিতে হবে। তবে সে যদি মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুদের খোলাখুলি সাহায্য করে তাহলে ভিন্ন কথা। (আহকামুল কোরআন-ইবনুল আরাবী, উমদাতুল কারী, ফাতহুল বারী)।
আটঃ উল্লেখিত হাদীস থেকে এ বিষয়ের বৈধতা লাভ করা যায় যে, অপরাধের তদন্ত বা অনুসন্ধানের জন্য প্রয়োজন হলে শুধু অভিযুক্ত পুরুষকেই নয়, স্ত্রীলোককেও উলঙ্গ করা যেতে পারে। হযরত আলী (রা.), হযরত যুবায়ের (রা.) এবং হযরত মিকদাদ (রা.) যদিও মহিলাটিকে উলঙ্গ করেননি, কিন্তু পত্র না দিলে তাঁরা তাকে তার কাপড় খুলে তল্লাশী চালাবেন বলে ভয় দেখিয়েছিলেন। এ কাজটি যদি বৈধ না হতো তাহলে এ তিনজন সম্মানিত সাহাবী এ কাজ করার ভয় দেখাতে পারতেন না। এক্ষেত্রে যুক্তির দাবী হলো, তারা ফিরে গিয়ে নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁদের অভিযানের কাহিনী অবশ্যই শুনিয়ে থাকবেন। নবী (সা.) তাদের এ কাজ অপছন্দ করে থাকলে বা এ কাজের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে থাকলে তা অবশ্যই বর্ণনা সূত্রে আমরা লাভ করতাম। এ কারণে ফকীহগণ এ ধরণের কাজ বৈধ বলে রায় দিয়েছেন। (উমদাতুল কারী)
فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا
“যে ব্যক্তি তাগুতের সাথে কুফরী করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণ করে সে এমন একটি মজবুত অবলম্বন আঁকড়ে ধরে যা ছিন্ন হবার নয়।” (আল বাকারাহ ২৫৬)
مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَى
“যত নিকট আত্মীয়ই হোক না কেন মুশরিকদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা কোন নবীর কাজ নয় এবং ঈমানদারদের জন্যও তা শোভনীয় নয়।”
তাই হযরত ইবরাহীম এ কাজ করেছিলেন এই যুক্তি দেখিয়ে কোন মুসলমানই তার কাফের নিকটাত্মীয়দের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারে না। এখন কথা হলো, হযরত ইবরাহীম (আ) নিজে কিভাবে এ কাজ করলেন? আর তিনি কি তাঁর এ নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন? এ প্রশ্নের বিস্তারিত জবাব আমরা কুরআন মজীদ থেকেই পেয়ে যাই। তাঁর বাপ যে সময় তাঁকে বাড়ী থেকে তাড়িয়ে দেন তখন বিদায় বেলায় তিনি বলেছিলেনঃ
سَلَامٌ عَلَيْكَ سَأَسْتَغْفِرُ لَكَ رَبِّي
“আপনার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আমি আমার রবের কাছে আপনার ক্ষমার জন্য প্রার্থনা করবো।” (মারয়াম, ৪৭)
এই প্রতিশ্রুতির কারণে তিনি দুইবার তাঁর পিতার জন্য দোয়া করেছেন। এর একটি দোয়ার উল্লেখ আছে সূরা ইবরাহীমে (আয়াত, ৪১) ঃ
رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ
“হে আমাদের প্রতিপালক যেদিন হিসেব নেয়া হবে সেদিন আমাকে, আমার পিতা মাতাকে এবং সমস্ত ঈমানদারকে মাফ করে দিও।”
দ্বিতীয়বার দোয়ার উল্লেখ আছে সূরা শু’আরাতে (আয়াত, ৮৬-৮৭)
وَاغْفِرْ لِأَبِي إِنَّهُ كَانَ مِنَ الضَّالِّينَ - وَلَا تُخْزِنِي يَوْمَ يُبْعَثُونَ
“আমার পিতাকে ক্ষমা করে দিন। সে তো পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত। আর যেদিন মানুষকে জীবিত করে উঠানো হবে সেদিন আমাকে লাঞ্ছিত করো না।”
কিন্তু পরে যখন তিনি বুঝতে পারলেন, যে পিতার ক্ষমা চেয়ে তিনি দোয়া করছেন সে আল্লাহর দুষমন তখন তিনি তার প্রতি বিমুখ হয়ে গেলেন এবং তার সাথে ভালবাসা ও সহানুভূতির সম্পর্কও ছিন্ন করলেন।
وَمَا كَانَ اسْتِغْفَارُ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ إِلَّا عَنْ مَوْعِدَةٍ وَعَدَهَا إِيَّاهُ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ أَنَّهُ عَدُوٌّ لِلَّهِ تَبَرَّأَ مِنْهُ إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لَأَوَّاهٌ حَلِيمٌ (التوبة : 114)
“আর ইবরাহীমের তার পিতার জন্য মাগফেরাতের দোয়া করার কারণ তার পিতাকে দেয়া একটি প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। অতঃপর তাঁর কাছে যখন স্পষ্ট হয়ে গেল যে, সে আল্লাহর শত্রু, তখন তার প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন। প্রকৃতপক্ষে ইবরাহীম অত্যন্ত কোমল হৃদয় ও নম্র স্বভাবের ছিলেন।”
এসব আয়াত সম্পর্কে চিন্তা করলে এ মৌলিক সত্যটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, নবীদের সেসব কাজই কেবল অনুসরণযোগ্য যার ওপরে তাঁরা শেষ পর্যন্ত বহাল ছিলেন। এরপর থাকে তাদের সেসব আমল বা তাঁরা পরবর্তী সময়ে ছেড়ে দিয়েছিলেন অথবা যেগুলোর ওপর আল্লাহ তা’আলা তাঁদের বহাল থাকতে দেননি অথবা আল্লাহর শরীয়াতে যেসব আমলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে, তা অনুসরণযোগ্য নয়। অমুক নবী এ কাজ করেছেন এ যুক্তি দেখিয়ে কেউ নবীদের এ ধরনের কাজকর্মের অনুসরণ করতে পারে না।
এখানে আরো একটি প্রশ্ন দেখা দেয় যা মানুষের মনে খটকা সৃষ্টি করতে পারে। আলোচ্য আয়াতে হযরত ইবরাহীমের (আ) যে কথাটিকে আল্লাহ তা’আলা অনুসরণযোগ্য হওয়া থেকে বাদ দিয়েছেন তার দু’টি অংশ আছে। একটি অংশ হলো, তিনি তাঁর বাপকে বলেছিলেনঃ আমি আপনার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করবো। দ্বিতীয় অংশটি হলো, আল্লাহর নিকট থেকে আপনাকে ক্ষমা নিয়েই দেব এ সাধ্য আমার নেই। এ দু’টি কথার মধ্যে প্রথম কথাটি অনুসরণযোগ্য না হওয়া বোধগম্য। কিন্তু দ্বিতীয় কথাটির মধ্যে কি এমন মন্দ দিক আছে যে, সেটিকে অনুসরণযোগ্য হওয়া থেকে বাদ দেয়া হয়েছে? অথচ তা নিতান্তই একটি সত্য কথা। এর জবাব হলো, হযরত ইবরাহীমের (আ) একথাটি বাদ পড়েছে এজন্য যে, কেউ যখন কোন কাজ করে দেয়ার জন্য কারো সাথে ওয়াদা করার পর বলে যে, তোমার জন্য এর অধিক আর কিছু করার ক্ষমতা আমার নেই। তখন আপনা থেকেই তার অর্থ দাঁড়ায়, যদি এর চেয়েও বেশী কিছু করার সাধ্য তার থাকতো তাহলে সে তার জন্য তাও করতো। একথাটি ঐ ব্যক্তির সাথে তার আরো গভীর সহানুভূতিমূলক সম্পর্ক প্রকাশ করে। এ কারণে হযরত ইবরাহীমের কথার দ্বিতীয় অংশটিও বাদ যাওয়ার উপযুক্ত। যদিও তার এ বিষয়বস্তু অতীব সত্য ও বাস্তব যে, আল্লাহর নিকট থেকে ক্ষমা বা মাগফিরাত নিয়ে দেয়া কোন নবীর ইখতিয়ার বহির্ভূত ব্যাপার। আল্লামা আলুসীও তাঁর তাফসীর গ্রন্থে রুহূল মায়া’নীতে এ প্রশ্নের এ জবাব দিয়েছেন।
এক্ষেত্রে হাদীসের শুধু ভাবার্থ বর্ণনা করার কারণে বড় রকমের একটা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে যার সমাধান হওয়া আবশ্যক। হুদাইবিয়ার সন্ধির শর্তাবলী সম্পর্কে হাদীসমূহে আমরা যেসব বর্ণনা দেখতে পাই তার অধিকাংশই ভাবার্থের বর্ণনা। আলোচ্য শর্ত সম্পর্কিত কোন বর্ণনার ভাষা হলোঃ
مَنْ جَاءَ مِنْكُمْ لَمْ نَرُدَّهُ عَلَيْكُمْ وَمَنْ جَاءَكُمْ مِنَّا رَدَدْتُمُوهُ عَلَيْنَا-
“তোমাদের মধ্যকার কোন ব্যক্তি যদি আমাদের কাছে চলে আসে তাকে আমরা ফেরত পাঠাব না। কিন্তু আমাদের মধ্য থেকে কেউ তোমাদের কাছে চলে গেলে তাকে তোমরা ফিরিয়ে দেবে।”
কোন বর্ণনার ভাষা হলোঃ
مَنْ أَتَى رَسُولَ اللَّهِ مِنْ أَصْحَابِهِ بِغَيْرِ إِذْنِ وَلِيِّهِ رَدَّهُ عَلَيْهِ-
“রসূলুল্লাহর ﷺ কাছে তাঁর সাহাবীদের কেউ যদি তার অভিভাবকের বিনা অনুমতিতে আসে তাহলে তিনি ফেরত পাঠাবেন।”
আবার কোন বর্ণনাতে আছেঃ
مَنْ أَتَى مُحَمَّدًا مِنْ قُرَيْشٍ بِغَيْرِ إِذْنِ وَلِيِّهِ رَدَّهُ عَلَيْهِ-
“কুরাইশদের কোন ব্যক্তি যদি তার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে চলে যায় তাহলে তিনি তাকে কুরাইশদের কাছে ফেরত পাঠাবেন।”
এসব রেওয়ায়াতের বর্ণনার ধরন থেকে আপনা আপনি এ কথা প্রকাশ পায় যে, মূলত চুক্তিতে সন্ধির শর্ত যে ভাষায় লেখা হয়েছিল এসব বর্ণনায় তা হুবহু উদ্ধৃত হয়নি। বরং বর্ণনাকারীগণ তার বিষয়বস্তু নিজের ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। আর বহু সংখ্যক রেওয়ায়াত যেহেতু এই প্রকৃতির তাই মুফাস্সির ও মুহাদ্দিসগণ বুঝে নিয়েছেন যে, চুক্তির মধ্যে সাধারণভাবে নারী ও পুরুষ উভয়ই অন্তর্ভুক্ত এবং চুক্তি অনুসারে নারীদের ফেরত পাঠানো কর্তব্য ছিল। কিন্তু পরক্ষণেই যখন তারা আল্লাহ তা’আলার এ নির্দেশ দেখতে পেলেন যে, ঈমানদার নারীদের ফেরত পাঠান যেন না হয়, তখন তাঁরা এর ব্যাখ্যা করলেন যে, এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা ঈমানদার নারীদের ক্ষেত্রে অন্তত চুক্তি ভঙ্গের ফায়সালা ও নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এটা সহজভাবে গ্রহণ করার মত কোন মামুলী বক্তব্য নয়। সন্ধি যদি প্রকৃতপক্ষে পুরুষ ও নারী নির্বিশেষে সবার জন্য সাধারণভাবে প্রযোজ্য হয়ে থাকে তাহলে একপক্ষ এক তরফাভাবে তাতে সংশোধনী যোগ করবে কিংবা নিজেদের পক্ষ থেকে তার কোন অংশ পরিবর্তন করে ফেলবে তা কি করে বৈধ হতে পারে? আর এরূপ করা হয়েছিল বলে যদি ধরেও নেয়া হয় তাহলে বড় বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই যে, কুরাইশরা এর কোন প্রতিবাদই করল না। কুরাইশরা তো রসূলুল্লাহ ﷺ এবং মুসলমানদের প্রতিটি কথার সমালোচনা করার জন্য সর্বদা এক পায়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তিনি সন্ধির শর্তাবলী স্পষ্ট লংঘন করেছেন এমন প্রমাণ পেশ করার সুযোগ পেলে তো তারা চিৎকার করে আসমান মাথায় তুলে নিত। কিন্তু কোন বর্ণনা থেকেই আমরা এ বিষয়ে আভাস পর্যন্ত পাই না যে, কুরআনের এই ফায়সালার বিরুদ্ধে তারা সামান্যতম আপত্তি ব প্রতিবাদ করেছে। এটি ছিল এমন একটি প্রশ্ন, যে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র চিন্তা করা হলেও চুক্তির মূল ভাষা অনুসন্ধান করে এই জটিলতার সমাধান পেশ করার চেষ্টা করা হতো। কিন্তু অনেকে এদিকে লক্ষ্যই করেননি। কেউ কেউ (যেমন কাযী আবু বকর ইবনে আরবী) লক্ষ্য করলেও তাঁরা কুরাইশদের আপত্তি ও প্রতিবাদ না করার কারণ হিসেবে এরূপ ব্যাখ্যা পর্যন্ত করতে দ্বিধা করেননি যে, আল্লাহ তা’আলা মু’জিযার মাধ্যমে এ ব্যাপারে কুরাইশদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এ ধরনের ব্যাখ্যার পেশ করে তাঁরা কিভাবে সন্তুষ্ট হতে পারলেন তা ভেবে বিস্মিত হতে হয়।
আসল কথা হলো, সন্ধি চুক্তির এই শর্তটি মুসলমাদের পক্ষ থেকে নয়, কুরাইশদের পক্ষ থেকে পেশ করা হয়েছিল। তাদের পক্ষ থেকে তাদের প্রতিনিধি সুহাইল ইবনে আমর চুক্তিপত্রে যে ভাষা লিপিবদ্ধ করেছিল তা ছিলঃ
عَلَى اَنْ لَايَاْتِيْكَ مِنَّا رَجُلٌ وَاِنْ كَانَ عَلَى ذِيْنِكَ اِلَّا رَدَّدْتَهُ اِلَيْنَا-
“আমাদের মধ্য থেকে তোমাদের কাছে কোন পুরুষও যদি আসে আর সে যদি তোমাদের ধর্মের অনুসারীও হয় তাহলেও তোমরা তাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেবে।”
চুক্তির এই ভাষা বুখারী “কিতাবুশ্ শুরুতে বাবুশ শুরুত ফিল জিহাদ ওয়াল মুসালাহ” অনুচ্ছেদে মজবুত সনদে উদ্ধৃত হয়েছে। সুহাইল হয়তো ‘রাজুল’ (رجل) শব্দটি ব্যক্তি অর্থে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু এটি তার চিন্তা ও মন-মস্তিষ্ক পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। চুক্তিপত্রে রাজুল শব্দটিই লেখা হয়েছিল আরবী ভাষায় যা পুরুষদের বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তাই উম্মে কুলসুম বিনতে উকবার প্রত্যার্পণের দাবী নিয়ে তার ভাই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসলে (ইমাম যুহরীর বর্ণনা অনুসারে) রসূলুল্লাহ ﷺ তাকে ফেরত পাঠাতে অস্বীকৃতি জানালেন। তিনি যুক্তি দেখিয়ে বললেনঃ كان الشرط فى الرجال دون النساء এ শর্ত শুধু পুরুষদের ব্যাপারে ছিল মেয়েদের ব্যাপারে ছিল না। (আহকামুল কুরআন---ইবনে আরাবী, তাফসীরে কাবীর-ইমাম রাযী) তখন পর্যন্ত খোদ কুরাইশরাও এই ভুল ধারণার মধ্যে ছিল যে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব ধরনের মুহাজিরদের বেলায় এ চুক্তি প্রযোজ্য। কিন্তু নবী (সা.) যখন চুক্তির এই ভাষার প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন তখন তারা হতবাক ও লা-জওয়াব হয়ে গেল এবং বাধ্য হয়েই তাদেরকে এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হলো।
যে কোন স্ত্রীলোক মক্কা ছেড়ে মদীনায় আসুক না কেন এবং যে উদ্দেশ্যেই আসুক না কেন চুক্তির এই শর্ত অনুসারে তাকে প্রত্যর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানানোর অধিকার মুসলমানদের ছিল। কিন্তু ইসলাম আগ্রহী ছিল কেবলমাত্র ঈমানদার নারীদের নিরাপত্তা দান করতে। পালিয়ে আসা সব রকম স্ত্রীলোকের জন্য মদীনাকে আশ্রয় কেন্দ্র বানানো ইসলামের উদ্দেশ্য ছিল না। তাই আল্লাহ তা’আলা নির্দেশ দিয়েছেন, যেসব স্ত্রীলোক হিজরত করে আসবে এবং তাদের ঈমানদার হওয়ার কথা প্রকাশ করবে তাদেরকে জিজ্ঞেসাবাদ করে এ বিষয়ে নিশ্চিত হও যে, প্রকৃতই তারা ঈমান গ্রহণ করে এখানে চলে এসেছে। এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর আর তাদেরকে ফেরত পাঠিয়ে দিও না। আল্লাহ তা’আলার এ নির্দেশ কার্যকরী করার জন্য যে নিয়ম পদ্ধতি রচনা করা হয়েছিল তা হলো, যেসব স্ত্রীলোক হিজরত করে মদীনায় চলে আসত তাদেরকে এ মর্মে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো যে, তারা সত্যিই আল্লাহর একত্ব এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতের প্রতি ঈমান পোষণ করে কিনা এবং কেবল আল্লাহ ও তাঁর রসূলের জন্যই হিজরত করেছে কিনা? ব্যাপারটা এমন নয়তো যে স্বামীর প্রতি বিরূপ ও বিরক্ত হয়ে রাগে বা অভিমানে ঘর ছেড়ে চলে এসেছে? কিংবা আমাদের এখানকার কোন পুরুষের প্রতি তার ভালবাসা ও অনুরাগ তাকে নিয়ে এসেছে? কিংবা অন্য কোন পার্থিব স্বার্থ তার এ কাজের চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে? যেসব স্ত্রীলোকেরা এসব প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দিতে পারত শুধু তাদেরকেই থাকতে দেয়া হতো এবং অবশিষ্ট সবাইকে ফিরিয়ে দেয়া হতো। (ইবনে জারীর---ইবনে আব্বাসের বর্ণনার বরাত দিয়ে কাতাদা, মুজাহিদ, ইকরিমা, ইবনে যায়েদ)।
এ আয়াতে সাক্ষ্যদান আইনেরও একটা মুলনীতি ও সূত্র বর্ণনা করা হয়েছে আর তা কার্যকারী করার জন্য রসূলুল্লাহ ﷺ যে কর্মপদ্ধতি ঠিক করে দিয়েছিলেন তা থেকে এর আরো স্পষ্ট ব্যাখ্যা হয়ে গিয়েছে। আয়াতটিতে তিনটি কথা বলা হয়েছে। এক, হিজরাতকারিনী যেসব স্ত্রীলোক নিজেদেরকে ঈমানাদার হিসেবে পেশ করবে তাদের ঈমানের বিষয়টি খোঁজ খবর নিয়ে দেখ। দুই, তাদের ঈমানের প্রকৃত অবস্থা কেবল আল্লাহ তা’আলাই জানেন। তারা প্রকৃতই ঈমান গ্রহণ করেছে কি না তা জানার কোন উপায় বা মাধ্যম তোমাদের কাছে নেই। তিন, যাঁচাই বাছাইয়ের মধ্যে যখন তোমরা জানতে পারবে যে, তারা ঈমানাদার, তাহলে তাদেরকে ফেরত পাঠাবে না। তাছাড়াও এই নির্দেশ অনুসারে ঐ সব স্ত্রীলোকদের ঈমান পরীক্ষা করার জন্য নবী (সা.) যে পদ্ধতি ঠিক করেছিলেন তা ছিল এই যে, সেসব মহিলাদের শপথভিত্তিক বক্তব্য বিশ্বাস করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে যে, তাদের হিজরত করার পেছনে উদ্বুদ্ধকারী শক্তি ঈমান ছাড়া অন্য কিছুই না। এ থেকে প্রথমত যে নীতিটি জানা গেল তাহলো মামলাসমূহের ফায়সালা করার জন্য প্রকৃত ঘটনা কি তা জানা থাকা আদালাতের জন্য জরুরী নয়। বরং সাক্ষ্যের মধ্যে অর্জিত জ্ঞানই এজন্য যথেষ্ট। দ্বিতীয়ত, যে কথাটি জানা গেল তা হলো, কোন ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার স্পষ্ট প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত আমরা তার শপথ ভিত্তিক বক্তব্যের ওপর বিশ্বাসস্থাপন করব। তৃতীয়ত, যে কথাটি জানা গেল, কোন ব্যক্তি তার আকীদা-বিশ্বাস ও ঈমান সম্পর্কে নিজে যে কথা বলছে আমরা তা গ্রহণ করব এবং সে যা বলছে তার আকীদা-বিশ্বাস সত্যিই তাই কি না তা খুঁজে বেড়াতে শুরু করব না। তবে তার বক্তব্যের বিপরীত কোন স্পষ্ট প্রমাণ যদি আমাদের সামনে প্রকাশ পায় তাহলে ভিন্ন কথা। আর চতুর্থ আরেকটি কথা হলো, কোন ব্যক্তির যেসব একান্ত ব্যক্তিগত কথা অন্য করো পক্ষে জানা সম্ভব নয় সেসব ব্যাপারে তার নিজের বক্তব্যের ওপর নির্ভর করা হবে। যেমনঃ তালাক ও ইদ্দতের ব্যাপারে এবং মেয়েদের মাসিক ও পবিত্রতার ব্যাপারে তার নিজের বক্তব্যই গ্রহণযোগ্য হবে। এক্ষেত্রে সে সত্য মিথ্যা যাই বলুক না কেন তাতে কিছু এসে যায় না। এ নীতি অনুসারে “ইলমে হাদীস” বা হাদীসশাস্ত্রের ক্ষেত্রেও সেসব বর্ণনা গ্রহণ করা হবে যার বর্ণনাকারীগণের বাহ্যিক অবস্থা তাদের সত্যবাদী হওয়ার প্রমাণ দেয় এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের কোন বর্ণনা গ্রহণযোগ্য হওয়ার পথে কোন প্রমাণ বা ইঙ্গিত বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায় ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের বর্ণনাসমূহ গ্রহণ করা হবে।
প্রথম নির্দেশটি হলো, যে স্ত্রীলোক মুসলমান হয়ে যায় সে তার কাফের স্বামীর জন্য হালাল থাকে না আর তার কাফের স্বামীও তার জন্য হালাল থাকে না।
দ্বিতীয় নির্দেশটি হলো, যে বিবাহিতা নারী মুসলমান হয়ে দারুল কুফর থেকে হিজরত করে দারুল ইসলামে আসে তার বিবাহ বন্ধন আপনা থেকেই ছিন্ন হয়ে যায় এবং ইচ্ছা করলে যে কোন মুসলমানই মোহরানা দিয়ে তাকে বিয়ে করতে পারে।
তৃতীয় নির্দেশটি হলো, কোন পুরুষ লোক মুসলমান হয়ে যাওয়ার পর তার স্ত্রী যদি কাফেরই থেকে যায় তাহলে ঐ স্ত্রীকে বিবাহ বন্ধনে আটকে রাখা তার জন্য জায়েয নয়।
চতুর্থ নির্দেশটি হলো, দারুল কুফর ও দারুল ইসলামের মধ্যে যদি সন্ধি চুক্তি বর্তমান থাকে তাহলে কাফেরদের যেসব বিবাহিত স্ত্রী হিজরত করে দারুল ইসলামে চলে এসেছে মুসলমানদের পক্ষ থেকে তাদের মোহরানা ফিরিয়ে দেয়া এবং মুসলমানদের সাথে বিবাহিত যেসব কাফের স্ত্রী দারুল কুফরে রয়ে গিয়েছে তাদেরকে প্রদত্ত মোহরানা কাফেরদের পক্ষ থেকে ফিরে পাওয়ার জন্য ইসলামী সরকারকে দারুল কুফরের সরকারের সাথে বিষয়টির ফায়সালা করার চেষ্টা করতে হবে।
এসব নির্দেশের ঐতিহাসিক পটভূমি হলো, ইসলামের প্রাথমিক যুগে এমন অনেক পুরুষ ছিল যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল কিন্তু তাদের স্ত্রীরা ইসলাম গ্রহণ করেনি। আবার এমন অনেক স্ত্রীলোকও ছিল যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল কিন্তু তাদের স্বামীরা ইসলাম গ্রহণ করেনি। খোদ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক মেয়ে হযরত যয়নবের (রা.) স্বামী আবুল আস ছিলেন অমুসলিম এবং কয়েক বছর পর্যন্ত অমুসলিমই রয়ে গিয়েছিলেন। মুসলমান নারীদের জন্য তাদের কাফের স্বামী এবং মুসলমান স্বামীদের জন্য তাদের মুশরিক স্ত্রী হালাল নয় এমন কোন নির্দেশও ইসলামের প্রাথমিক যুগে হয়নি। তাই তাদের মধ্যকার দাম্পত্য সম্পর্ক অব্যাহত ছিল। হিজরাতের পরেও কয়েক বছর পর্যন্ত এ অবস্থা বিদ্যমান ছিল। এ সময় বহু সংখ্যক নারী মুসলমান হওয়ার পর হিজরত করে চলে এসেছিল। কিন্তু তাদের কাফের স্বামীরা দারুল কুফরেই থেকে গিয়েছিল। আবার বহু সংখ্যক মুসলমান পুরুষ হিজরত করে চলে এসেছিল। কিন্তু তাদের কাফের স্ত্রীরা দারুল কুফরেই রয়ে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও তাদের বিবাহ বন্ধন অবশিষ্ট ছিল। এতে বিশেষভাবে মহিলাদের জন্য বড় ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছিল। কারণ, পুরুষ তো দ্বিতীয় বিয়েও করতে পারে। কিন্তু মহিলাদের জন্য তা সম্ভব ছিল না। পূর্ব স্বামীর সাথে তার বিয়ে বাতিল না হওয়া পর্যন্ত সে অন্য কারো সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারত না। হুদায়বিয়ার সন্ধির পর এসব আয়াত নাযিল হলে মুসলমান এবং কাফের ও মুশরিকদের মধ্যকার পূর্বের দাম্পত্য সম্পর্ক বাতিল করে দেয়া হয় এবং তাদের ভবিষ্যতের জন্য একটা অকাট্য ও সুস্পষ্ট আইন তৈরী করে দেয়া হয়। ফিকাহবিদগণ এ আইনটিকে চারটি বড় বড় অনুচ্ছদে সুসংবদ্ধ ও সুবিন্যস্ত করে দিয়েছেন।
একটি অবস্থা হলো, স্বামী-স্ত্রী উভয়েই যদি দারুল ইসলামে অবস্থানকারী হয় এবং তাদের একজন মুসলমান হয়ে যায় কিন্তু অপরজন কাফেরই থেকে যায়।
দ্বিতীয় অবস্থা হলো, স্বামী-স্ত্রী উভয়েই যদি দারুল কুফরে অবস্থানকারী হয় এবং তাদের একজন মুসলমান হয়ে যায় কিন্তু অপরজন কাফেরই থেকে যায়।
তৃতীয় অবস্থা হলো, স্বামী-স্ত্রীর কোন একজন যদি মুসলমান হয়ে দারুল ইসলামে হিজরত করে আসে এবং অপরজন দারুল কুফরে কাফের হিসেবেই থেকে যায়।
চতুর্থ অবস্থা হলো, মুসলমান স্বামী-স্ত্রী কোন একজন যদি মুরতাদ হয়ে যায়।
এই চারটি অবস্থা সম্পর্কে ফিকাহবিদগণের কার কি মত আমরা তা আলাদা আলাদাভাবে নীচে বর্ণনা করেছি।
একঃ প্রথম ক্ষেত্রে স্বামী যদি ইসলাম গ্রহণ করে আর স্ত্রী খৃস্টান কিংবা ইহুদী হয় এবং সে তার ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে তাহলে উভয়ের বিবাহ বন্ধন বহাল থাকবে। কারণ মুসলমান পুরুষের জন্য আহলে কিতাব স্ত্রী গ্রহণ করা বা থাকা জায়েজ। এ বিষয়ে সমস্ত ফিকাহবিদ একমত।
আর ইসলাম গ্রহণকারী পুরুষের স্ত্রী যদি আহলে কিতাব না হয় এবং সে তার ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে তাহলে সে সম্পর্কে হানাফিদের বক্তব্য হলোঃ স্ত্রীর কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করা হবে। সে যদি ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে বিয়ে বহাল থাকবে। আর যদি সে ইসলাম গ্রহণ না করে তাহলে তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটান হবে। এক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নির্জনবাস হয়ে থাকলে স্ত্রী মোহরানা লাভের অধিকারিনী হবে এবং নির্জনবাস না হয়ে থাকলে মোহরানা লাভের কোন অধিকার তার থাকবে না। কারণ তার অস্বীকৃতির কারণেই বিচ্ছেদ ঘটেছে। (আল মাবসূত, হিদায়া, ফাতহুল কাদীর) ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমাদ বলেনঃ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি নির্জনবাস না হয়ে থাকে তাহলে পুরুষের ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথে স্ত্রী তার বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। আর যদি নির্জনবাস হয়ে থাকে তাহলে তিনবার মাসিক আসা পর্যন্ত স্ত্রী তার বিবাহ বন্ধনে থাকবে। এ সময়ের মধ্যে সে যদি স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে বিয়ে বহাল থাকবে। অন্যথায়, তৃতীয় বার মাসিক থেকে পবিত্র হওয়ার সাথে সাথেই আপনা থেকেই বিবাহ বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে। ইমাম শাফেয়ী (র) একথাও বলেন যে, আমাদের পক্ষ থেকে যিম্মিদেরকে তাদের ধর্মীয় কাজে হস্তক্ষেপ না করার যে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে, তার ভিত্তিতে নারীর কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করাও ঠিক হবে না। কিন্তু বাস্তবে এটা একটা দুর্বল যুক্তি। কারণ একজন যিম্মী নারীকে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হলে তখনই কেবল তা তার ধর্ম মতে বাঁধা সৃষ্টি করা বলে গণ্য হবে। তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ কর তাহলে তোমার স্বামীর সাথে থাকতে পারবে অন্যথায় তোমাকে তার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে, শুধু এই কথাটি তাকে বলা তার ধর্মমতে কোন প্রকার অবৈধ হস্তক্ষেপ নয়। হযরত আলীর (রা.) খেলাফত কালে এ ধরনের একটি ঘটনার নজির পাওয়া যায়। তখন ইরাকের একজন অগ্নিপূজক জমিদার ইসলাম গ্রহণ করে। কিন্তু তার স্ত্রী কাফেরই থেকে যায়। হযরত আলী (রা) তার সামনে ইসলামের দাওয়াত পেশ করলেন। সে ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালে তিনি তাদের বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করে দিলেন। (আল মাবসূত) ইমাম মালেক (র) বলেনঃ যদি নির্জনবাস না হয়ে থাকে তাহলে পুরুষের ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথে তার কাফের স্ত্রী তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তবে যদি নির্জনবাস হয়ে থাকে তাহলে নারীর কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করা হবে। সে ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাবে (আল মুগনী ইবনে কুদামা)।
পক্ষান্তরে স্ত্রী যদি ইসলাম গ্রহণ করে এবং স্বামী কাফের থেকে যায় তাহলে সে আহলে কিতাব হোক বা না হোক এবং উভয়ের নির্জনবাস হয়ে থাক না থাক হানাফীদের মতে সর্বাবস্থায় স্বামীর কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করা হবে। সে ইসলাম গ্রহণ করলে নারী তার বিবাহ বন্ধনে বহাল থাকে এবং অস্বীকৃতি জানালে কাজী তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেবেন। ইসলামের দাওয়াত পেশ করার পর স্বামী যতক্ষণ পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণে অস্বীকৃতি না জানাবে ততক্ষণ পর্যন্ত নারী তার স্ত্রী থাকবে ঠিকই কিন্তু স্ত্রীর সান্নিধ্য লাভের অধিকার তার থাকবে না। স্বামীর অস্বীকৃতির ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে যে বিচ্ছেদ ঘটবে তা হবে বায়েন তালাক হিসেবে। এমতাবস্থায় নির্জনবাস না হয়ে থাকলে নারী নির্ধারিত মোহরানার অর্ধেক পাওয়ার অধিকারী হবে। আর নির্জনবাস হয়ে থাকলে সম্পূর্ণ মোহরানা লাভের অধিকারী হওয়ার সাথে সাথে ইদ্দতকালীন খোরপোষ লাভেরও অধিকারী হবে। (আল মাবসূত, হিদায়া, ফাতহুল কাদীর) ইমাম শাফেয়ীর (র) মতে, নির্জনবাস না হওয়ার ক্ষেত্রে স্ত্রীর ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথে বিবাহ বাতিল হয়ে যাবে এবং নির্জনবাস হওয়ার ক্ষেত্রে ইদ্দত শেষ হওয়া পর্যন্ত স্ত্রী স্বামীর বিবাহ বন্ধনে বহাল থাকবে। এই সময়ের মধ্যে যদি সে ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে বিবাহ বহাল থাকবে অন্যথায় ইদ্দত পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাবে। কিন্তু নারীর বেলায় ইমাম শাফেয়ীর (র) যে মত ওপরে উদ্ধৃত হয়েছে পুরুষের বেলায়ও তিনি সেই একই মত প্রকাশ করেছেন। অর্থাৎ তার সামনে ইসলামের দাওয়াত পেশ করা জায়েজ নয়। তবে এ মতটি অত্যন্ত দুর্বল। হযরত উমরের (রা.) খিলাফতকালে এ ধরনের বেশ কিছু সংখ্যক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। অর্থাৎ নারী ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং পুরুষকে ইসলামের দাওয়াত পেশ করা হয়েছে আর যখন সে ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে তখন দু’জনের মধ্য বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেয়া হলো। যেমনঃ বনী তাগলেব গোত্রের জনৈকা খৃস্টান স্ত্রীলোকের ব্যাপারটি তার সামনে পেশ করা হলে তিনি স্বামীকে বললেনঃ তুমি ইসলাম গ্রহণ কর। তা নাহলে আমি তোমাদের দু’জনকে পরস্পর বিছিন্ন করে দেব। সে ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করলে তিনি তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের ডিক্রি দিয়ে দিলেন। বাহযুল মালিকের এক নওমুসলিম জামিদারনীর মামলা তাঁর কাছে পাঠান হলে এ মামালাতেও তিনি নির্দেশ দিলেন যে, তার স্বামীর সামনে ইসলামের দাওয়াত পেশ করা হোক। যদি সে ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে ভাল কথা। অন্যথায় দু’জনের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটান হোক। সাহাবায়ে কেরামের সামনেই এসব ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু কেউ ভিন্নমত পোষণ করেছেন বলে উল্লেখ নেই। (আহকামুল কুরআন জাস্সাস, আল মাবসূত, ফাতহুল কাদীর) এ ব্যাপারে ইমাম মালেকের (র) রায় হলো, স্ত্রী যদি নির্জনবাসের পূর্বেই মুসলমান হয়ে যায় তাহলে স্বামীর সামনে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত পেশ করতে হবে। সে যদি দাওয়াত গ্রহণ করে তাহলে উত্তম। অন্যথায় অবিলম্বে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। কিন্তু যদি নির্জনবাস হওয়ার পরে স্ত্রীলোকটি ইসলাম গ্রহণ করে থাকে তাহলে ইদ্দতের সময় শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এই সময়ের মধ্যে স্বামী ইসলাম গ্রহণ করলে বিবাহ বন্ধন ঠিকই থাকবে। অন্যথায় ইদ্দতের সময় শেষ হওয়ার সাথে সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাবে। ইমাম আহমাদের (র) একটি মত ইমাম শাফেয়ীর (র) মতকে সমর্থন করে। তাঁর দ্বিতীয় মত হলো, নির্জনবাস হোক বা না হোক স্বামী এবং স্ত্রীর দ্বীন বা ধর্ম ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যাওয়ার সর্বাবস্থায় তাৎক্ষণিক বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ বলে গণ্য হবে। (আল মুগনী)
দুইঃ স্ত্রী যদি দারুল কুফরে ইসলাম গ্রহণ করে এবং স্বামী কাফের থেকে যায় অথবা স্বামী ইসলাম গ্রহণ করে এবং স্ত্রী (যে খৃস্টান বা ইহুদী বরং আহলে কিতাব নয় এমন ধর্মের অনুসারী হয়) তার ধর্ম আঁকড়ে ধরে থাকে এমতাবস্থায় হানাফীদের মতে তাদের নির্জনবাস হোক বা না হোক স্ত্রীর তিনবার মাসিক না হওয়া কিংবা মাসিক রহিতা হয়ে থাকলে তিন মাস অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত বিচ্ছেদ ঘটবে না। এ সময়ের মধ্যে অপরজনও মুসলমান হয়ে গেলে বিবাহ বন্ধন ঠিক থাকবে। অন্যথায় এ সময় শেষ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই বিবাহ বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে। এক্ষেত্রেও ইমাম শাফেয়ী (র) নির্জনবাস হওয়া এবং না হওয়ার ক্ষেত্রে পার্থক্য করেন। তাঁর রায় হলো, নির্জনবাস যদি না হয়ে থাকে তাহলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ধর্মের ভিন্নতা সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে বিচ্ছেদ সংঘটিত হবে। আর যদি নির্জনবাস হওয়ার পরে ধর্মের ভিন্নতা দেখা দিয়ে থাকে তাহলে ইদ্দতের সময় শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে বহাল থাকবে। এ সময়ের মধ্যে যদি অপরজন ইসলাম গ্রহণ না করে তাহলে ইদ্দত শেষ হওয়ার সাথে সাথে বিয়েও বাতিল হয়ে যাবে। (আল মাবসূত, ফাতহুল কাদীর, আহকামুল কুরআন জাস্সাস)
তিনঃ যে ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ধর্মের ভিন্নতা হওয়ার সাথে সাথে দেশও ভিন্ন হয়ে যায় অর্থাৎ তাদের কোন একজন কাফের অবস্থায় দারুল কুফরে থেকে যায় এবং অপরজন হিজরত করে দারুল ইসলামে চলে আসে তাদের সম্পর্কে হানাফীদের বক্তব্য হলো তাদের বিবাহ বন্ধন আপনা থেকেই ছিন্ন হয়ে যাবে। হিজরত করে আগমনকারী যদি নারী হয় তাহলে তার তখনই দ্বিতীয়বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অধিকার থাকে। তাকে কোন ইদ্দত পালন করতে হবে না। তবে স্ত্রীর সাহচর্য লাভ করতে হলে তার গর্ভে সন্তান আছে কিনা তা জানার জন্য একবার মাসিক আসা পর্যন্ত স্বামীকে অপেক্ষা করতে হবে। আর সে যদি গর্ভবতীও হয় তবুও বিয়ে হতে পারবে। তবে একান্ত নৈকট্য লাভের জন্য সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এ মাসায়ালায় ইমাম আবু ইউসূফ ও ইমাম মুহাম্মাদ ইমাম আবু হানীফার সাথে শুধু এতটুকু ভিন্ন মত পোষণ করেছেন যে, নারীকে ইদ্দত পালন করতে হবে এবং গর্ভবতী হলে সন্তান ভূমিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে হতে পারবে না। (আল মাবসূত, হিদায়া, আহকামূল কুরআন জাসসাস) ইমাম শাফেয়ী (র) ইমাম আহমাদ (র) এবং ইমাম মালেক বলেনঃ এক্ষেত্রে দেশ ভিন্ন ভিন্ন হওয়াতে কিছুই এসে যায় না। বরং এক্ষেত্রে মূল জিনিস হলো ধর্মের ভিন্নতা। যদি স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে ধর্মের এই ভিন্নতা সৃষ্টি হয় তাহলে দারুল ইসলামের ধর্মের ভিন্নতা সৃষ্টি হওয়ার ক্ষেত্রে যে বিধান প্রযোজ্য এক্ষেত্রেও সেই একই বিধান প্রযোজ্য হবে। (আল মুগনী)।
হিজরাতকারিনী মুসলমান নারী সম্পর্কে ইমাম শাফেয়ী (র) তাঁর পূর্বোল্লেখিত মতের সাথে সাথে এ মতও প্রকাশ করেন যে, সে যদি তার কাফের স্বামীর সাথে ঝগড়া-বিবাদ করে তার স্বামীত্বের অধিকার রহিত করার উদ্দেশ্যে এসে থাকে তাহলে দেশ ভিন্ন হওয়ার কারণে নয় বরং তার এই সংকল্প ও ইচ্ছার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটবে। (আল মাবসূত, হিদায়া)।
কিন্তু কুরআন মজীদের আলোচ্য আয়াতটি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, এ বিষয়ে ইমাম আবু হানীফার মতই সর্বাধিক বিশুদ্ধ। আল্লাহ তা’আলা এ আয়াতটি হিজরত করে আগমনকারী ঈমানদার নারীদের সম্পর্কে নাযিল করেছিলেন এবং তাদের ব্যাপারেই বলেছেন যে, তারা তাদের দারুল কুফরে ছেড়ে আসা কাফের স্বামীদের জন্য এখন আর হালাল নয়। আর মোহরানা দিয়ে তাদেরকে বিয়ে করার জন্য দারুল ইসলামের মুসলমানদের অনুমতি দেয়া হয়েছে। অপরদিকে মুহাজির মুসলমানদের সম্বোধন করে বলা হয়েছে যে, তোমাদের যেসব কাফের স্ত্রী দারুল কুফরে রয়ে গিয়েছে তাদেরকে তোমাদের বিবাহ বন্ধনে আটকে রেখ না। ঐ সব স্ত্রীদেরকে তোমরা যে মোহরানা দিয়েছ কাফেরদের থেকে তা চেয়ে নাও। এটা স্পষ্ট যে, শুধু দ্বীন বা ধর্মের ভিন্নতার কারণে এ নির্দেশ দেয়া হয়নি। বরং যে অবস্থা ও পরিবেশ এসব হুকুমকে বিশেষ রূপ দান করেছে তাহলো দেশের ভিন্নতা। হিজরাতের কারণে কাফের স্বামীদের সাথে মুসলমান মেয়েদের বিবাহ বন্ধন ছিন্ন না হয়ে থাকলে তাদেরকে বিয়ে করার অনুমতি মুসলমানদের কি করে দেয়া যেতে পারে। তাও আবার এমনভাবে যে, এ অনুমতির ক্ষেত্রে ইদ্দত পালনের কোন ইঙ্গিত পর্যন্ত নেই। অনুরূপ لاتمسكوا بعصم الكوافر এর নির্দেশ আসার পরও যদি মুসলমান মুহাজিরদের কাফের স্ত্রীরা তাদের বিবাহ বন্ধনের মধ্যেই থাকত তাহলে সঙ্গে সঙ্গে এ হুকুমও দেয়া হতো যে, তাদের তালাক দিয়ে দাও। কিন্তু এখানে সেদিকেও কোন ইঙ্গিত দেয়া হয়নি। একথা নিঃসন্দেহে ঠিক যে, এ আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর হযরত উমর (রা.), হযরত তালহা এবং আরো কিছু সংখ্যক মুহাজির তাদের স্ত্রীদের তালাক দিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এর দ্বারা প্রমাণিত হয় না যে, এরূপ করা তাদের জন্য জরুরী হয়ে পড়েছিল এবং তাদের স্ত্রীদের সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া না হওয়া তালাক দেয়ার ওপরেই নির্ভর করেছিল। আর তারা তালাক না দিলে ঐসব স্ত্রী তাদের স্ত্রীই থেকে যেত।
এর জবাবে নবীর (সা.) যুগের তিনটি ঘটনাকে নজীর হিসেবে পেশ করা হয়। এ আয়াতগুলো নাযিল হওয়ার পরও নবী ﷺ দেশের ভিন্নতার কারণে মু’মিন ও কাফের স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ বন্ধন যে ঠিক রেখেছেন এসব ঘটনাকে তার প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়। প্রথম ঘটনাটি হলো, মক্কা বিজয়ের কিছু পূর্বে আবু সুফিয়ান মাররুয, যাহরান (বর্তমান ওয়াদীয়ে ফাতেমা) নামক স্থানে মুসলিম সেনাদলের কাছে এসে সেখানে ইসলাম গ্রহণ করেন। আর তাঁর স্ত্রী হিন্দ কাফের হিসেবে মক্কায়ই থেকে যায়। মক্কা বিজয়ের পর হিন্দ ইসলাহ গ্রহণ করে। আর বিয়ে নবায়ন না করে নবী ﷺ তাদের পূর্বের বিয়ে বহাল রাখেন। দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো, মক্কা বিজয়ের পর ইকরিমা ইবনে আবু জাহল এবং হাকীম ইবনে হিযাম মক্কা থেকে পালিয়ে যান। কিন্তু তাঁদের উভয়ের স্ত্রী তাদের চলে যাওয়ার পর মুসলমান হয়ে যান। এরপর তারা নবীর (সা.) নিকট থেকে তাদের স্বামীর জন্য নিরাপত্তা নেন এবং গিয়ে তাদের নিয়ে আসেন। উভয়েই ফিরে এসে ইসলাম গ্রহণ করলেন। নবী ﷺ তাদেরও পূর্ব বিয়ে বহাল রাখলেন। তৃতীয় ঘটনাটি নবীর (সা.) নিজের মেয়ে হযরত যয়নাবের (রা.)। হযরত যয়নাব (রা.) হিজরত করে মদীনায় চলে এসেছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বামী আবুল আস কাফের হিসেবে মক্কায়ই থেকে গিয়েছিলেন। তাঁর সম্পর্কে মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী ও ইবনে মাজাতে ইবনে আব্বাসের রেওয়ায়াত হলো, তিনি ৮ম হিজরীতে মদীনায় এসে ইসলাহ গ্রহণ করেন। নবী (সা.) তাদের বিয়েও নবায়ন করেননি বরং পূর্বের বিয়ের ভিত্তিতে নিজের মেয়েকে আবুল আসের স্ত্রী হিসেবে থাকতে দিয়েছেন। এসব ঘটনার মধ্যে প্রথম দু’টি ঘটনা প্রকৃতপক্ষে দেশ ভিন্ন হওয়ার পর্যায়ভুক্ত নয়। কারণ সাময়িকভাবে এক ব্যক্তির একদেশ থেকে অন্য দেশে চলে যাওয়া বা পালিয়ে যাওয়া দেশের ভিন্নতা নয়। কেবল সেই ক্ষেত্রেই দেশের ভিন্নতা হয় যখন কোন ব্যক্তি একদেশ ছেড়ে অন্য কোন দেশে গিয়ে বসতি স্থাপন করে এবং তার ও তার স্ত্রীর মধ্যে বর্তমান কালের পরিভাষা অনুসারে জাতীয়তার (Nationality) পার্থক্য দেখা দেয়। এরপর থাকে কেবল সাইয়েদা যয়নাব রাদিয়াল্লাহ আনহার ব্যাপারটি। এ ব্যাপারে দু’টি রেওয়ায়াত আছে। একটি হযরত ইবনে আব্বাসের রেওয়ায়াত। ওপরে যার বরাত দেয়া হয়েছে। আর দ্বিতীয়টি হযরত আবদুল্লাহ আবনে ‘আমর ইবনে আসের রেওয়ায়াত। ইমাম আহমাদ, তিরমিযী ও ইবনে মাজা এটি উদ্ধৃত করেছেন। দ্বিতীয় এই রেওয়ায়াতটিতে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী ﷺ পুনরায় মোহরানা নির্ধারণ করে নতুনভাবে মেয়েকে আবুল আসের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। যারা স্বামী ও স্ত্রীর দেশ ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার আইনগত প্রভাব অস্বীকার করেন রেওয়ায়াতের এই পার্থক্যের ক্ষেত্রে এই নজীরটি তাদের জন্য প্রথমত অকাট্য দলীল হতে পারে না। দ্বিতীয়ত তারা যদি ইবনে আব্বাসের রেওয়ায়াতকেই বিশুদ্ধ বলে গুরুত্ব দেন তাহলে তা তাদের নিজেদেরই মতের বিরুদ্ধে চলে যায়। কারণ তাদের মতানুসারে যেসব স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ধর্মের ভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে যদি তাদের নির্জনবাস হয়ে থাকে তাহলে স্ত্রীর তিনবার মাসিক হওয়া পর্যন্ত তাদের বিয়ে অক্ষুন্ন থাকে। এই সময়ের মধ্যে অপরজনও ইসলাম গ্রহণ করলে বিবাহ বন্ধন ঠিক থাকে। অন্যথায় তৃতীয় মাসিক আসলে বিবাহ বন্ধন আপনা থেকেই ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু হযরত যয়নাবের যে ঘটনাকে তারা দলীল হিসেবে পেশ করেন তাতে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে ধর্মের ভিন্নতা সৃষ্টি হওয়ার পর কয়েক বছর অতিক্রান্ত হয়েছিল। হযরত যয়নাবের হিজরাতের ছয় বছর পর আবুল আস ঈমান গ্রহণ করেছিলেন এবং কুরআনের যে নির্দেশ অনুসারে মুসলমান নারীদেরকে মুশরিকদের জন্য হারাম করে দেয়া হয়েছিল তা তাঁর ঈমান গ্রহণের অন্তত দুই বছর পূর্বে নাযিল হয়েছিল।
চারঃ চতুর্থ বিষয়টি মুরতাদ হওয়া সম্পর্কিত। এর একটি অবস্থা হলো স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই মুরতাদ হয়ে যাওয়া এবং দ্বিতীয় অবস্থা হলো তাদের কোন একজনের মুরতাদ হয়ে যাওয়া আর অপরজনের মুসলমান থাকা।
স্বামী এবং স্ত্রী উভয়ে যদি একই সাথে মুরতাদ হয়ে যায় তাহলে শাফেয়ী এবং হাম্বলী উলামাদের মতে নির্জনবাসের পূর্বে এরূপ হলে তৎক্ষণাৎ আর নির্জনবাসের পরে হলে ইদ্দতের সময় শেষ হওয়া মাত্র মুসলিম থাকা অবস্থায় যে বিয়ে হয়েছিল তার বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে হানাফীদের মতে, যদিও তাদের বিবাহ বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাওয়াই সাধারণ বিবেক-বুদ্ধি ও যুক্তির দাবী কিন্তু হযরত আবু বকরের খিলাফতকালে মুরতাদ হওয়ার যে ব্যাপক ফিতনা দেখা দিয়েছিল তাতে হাজার হাজার মানুষ মুরতাদ হওয়ার পর আবার মুসলমান হয়েছিল। সাহাবায়ে কেরাম তাদের কাউকেই বিয়ে নবায়নের জন্য নির্দেশ দেননি। তাই আমরা সাহাবীদের ঐকমত্য ভিত্তিক এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সাধারণ যুক্তি ও বুদ্ধির বিপক্ষে একথা মেনে নিচ্ছি যে, স্বামী-স্ত্রীর এক সাথে মুরতাদ হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের বিবাহ বন্ধন ছিন্ন হয় না। (আল মাবসূত, হিদায়া, ফাতহুল কাদীর, আল ফিকহু আলাল মাযাহিবিল আরবায়া)
স্বামী যদি মুরতাদ হয়ে যায় এবং স্ত্রী মুসলমান থাকে এমতাবস্থায় ইতিপূর্বে তাদের মধ্যে নির্জনবাস হয়ে থাক বা না থাক হানাফী ও মালেকীদের মতে তখনই বিবাহ বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে। কিন্তু শাফেয়ী এবং হাম্বলীগণ এক্ষেত্রে নির্জনবাসের পূর্বের ও পরের অবস্থার মধ্যে পার্থক্য করে থাকেন। তাদের মতে, নির্জনবাসের পূর্বে যদি এরূপ হয়ে থাকে তাহলে বিবাহ বন্ধন তৎক্ষণাৎ ছিন্ন হয়ে যাবে। আর যদি নির্জনবাসের পরে হয়ে থাকে তাহলে বিবাহ বন্ধন ইদ্দতের সময়-কাল পর্যন্ত অক্ষুন্ন থাকবে। সে যদি এ সময়ের মধ্যে মুসলমান হয়ে যায় তাহলে বিবাহ ঠিক থাকবে। অন্যথায় ইদ্দতের সময় শেষ হওয়ার সাথে সাথে তার মুরতাদ হওয়ার সময় থেকে বিয়ে বাতিল ধরে নেয়া হবে। অর্থাৎ স্ত্রীকে নতুন করে আর কোন ইদ্দত পালন করতে হবে না। চারটি মাযহাবের ফকীহগণ এ বিষয়ে একমত যে, নির্জনবাসের পূর্বে এ ঘটনা ঘটে থাকলে স্ত্রী অর্ধেক মোহরানা এবং নির্জনবাসের পরে ঘটে থাকলে সম্পূর্ণ মোহরানা লাভের অধিকারী হবে।
আর স্ত্রী যদি মুরতাদ হয়ে যায় তাহলে সেক্ষেত্রে হানাফীদের পুরানো ফতোয়া হলো, বিয়ে তৎক্ষনাৎ বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু পরবর্তীকালে বলখ ও সমরখন্দের আলেমগণ ফতোয়া দিয়েছেন যে, স্ত্রী মুরতাদ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয় না। স্বামীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য বা তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য স্ত্রীরা যাতে মুরতাদ হওয়ার পথ অনুসরণ না করেন সেজন্যই তারা এ পন্থার সাহায্য নিয়েছেন। মালিকীদের ফতোয়াও অনেকটা এরূপ। তাঁরা বলেনঃ যদি এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, স্ত্রী কেবলমাত্র স্বামী থেকে বিছিন্ন হওয়ার পন্থা হিসেবে মুরতাদ হয়েছে তাহলে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন হবে না। শাফেয়ী ও হাম্বলী মাযহাবের মতে স্বামীর মুরতাদ হওয়ার ক্ষেত্রে যে আইন প্রযোজ্য স্ত্রীর মুরতাদ হওয়ার ক্ষেত্রেও সেই একই আইন প্রযোজ্য। অর্থাৎ নির্জনবাসের পূর্বে মুরতাদ হলে বিয়ে তৎক্ষনাৎ বাতিল হয়ে যাবে। আর নির্জনবাসের পরে মুরতাদ হলে ইদ্দতের সময় অতিক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে ঠিক থাকবে। এ সময়ের মধ্যে সে মুসলমান হয়ে গেলে দাম্পত্য বন্ধন অক্ষুন্ন থাকবে। তা নাহলে ইদ্দতকাল শেষ হওয়ার সাথে সাথে মুরতাদ হওয়ার সময় থেকে বিয়ে বাতিল বলে গণ্য হবে। মোহরানা ক্ষেত্রে এ বিষয়ে সবাই একমত যে, স্ত্রী যদি নির্জনবাসের পূর্বে মুরতাদ হয়ে যায় তাহলে সে মোহরানা আদৌ পাবে না। তবে সে যদি নির্জনবাসের পরে মুরতাদ হয়ে থাকে তাহলে সম্পূর্ণ মোহরানা লাভ করবে। (আল মাবসূত, হিদায়া, ফাতহুল কাদীর, আল মুগনী, আল ফিকহু আলাল মাযাহিবিল আরাবায়া)।