১ ) হে মানব জাতি! তোমাদের রবকে ভয় করো। তিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন একটি প্রাণ থেকে। আর সেই একই প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন তার জোড়া। তারপর তাদের দু’জনার থেকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। ১ সেই আল্লাহকে ভয় করো যার দোহাই দিয়ে তোমরা পরস্পরের কাছ থেকে নিজেদের হক আদায় করে থাকো এবং আত্মীয়তা ও নিকট সম্পর্ক বিনষ্ট করা থেকে বিরত থাকো। নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো, আল্লাহ তোমাদের ওপর কড়া নজর রেখেছেন।
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱتَّقُوا۟ رَبَّكُمُ ٱلَّذِى خَلَقَكُم مِّن نَّفْسٍۢ وَٰحِدَةٍۢ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًۭا كَثِيرًۭا وَنِسَآءًۭ ۚ وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ ٱلَّذِى تَسَآءَلُونَ بِهِۦ وَٱلْأَرْحَامَ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًۭا ١
২ ) এতিমদেরকে তাদের ধন-সম্পদ ফিরিয়ে দাও। ২ ভালো সম্পদের সাথে মন্দ সম্পদ বদল করো না। ৩ আর তাদের সম্পদ তোমাদের সম্পদের সাথে মিশিয়ে গ্রাস করো না। এটা মহাপাপ।
وَءَاتُوا۟ ٱلْيَتَـٰمَىٰٓ أَمْوَٰلَهُمْ ۖ وَلَا تَتَبَدَّلُوا۟ ٱلْخَبِيثَ بِٱلطَّيِّبِ ۖ وَلَا تَأْكُلُوٓا۟ أَمْوَٰلَهُمْ إِلَىٰٓ أَمْوَٰلِكُمْ ۚ إِنَّهُۥ كَانَ حُوبًۭا كَبِيرًۭا ٢
৩ ) আর যদি তোমরা এতিমদের (মেয়েদের) সাথে বে-ইনসাফী করার ব্যাপারে ভয় করো, তাহলে যেসব মেয়েদের তোমরা পছন্দ করো তাদের মধ্য থেকে দুই, তিন বা চারজনকে বিয়ে করো। ৪ কিন্তু যদি তোমরা তাদের সাথে ইনসাফ করতে পারবে না বলে আশঙ্কা করো, তাহলে একজনকেই বিয়ে করো। ৫ অথবা তোমাদের অধিকারে সেসব মেয়ে আছে তাদেরকে বিয়ে করো। ৬ বে-ইনসাফীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এটিই অধিকতর সঠিক পদ্ধতি।
وَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تُقْسِطُوا۟ فِى ٱلْيَتَـٰمَىٰ فَٱنكِحُوا۟ مَا طَابَ لَكُم مِّنَ ٱلنِّسَآءِ مَثْنَىٰ وَثُلَـٰثَ وَرُبَـٰعَ ۖ فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تَعْدِلُوا۟ فَوَٰحِدَةً أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَـٰنُكُمْ ۚ ذَٰلِكَ أَدْنَىٰٓ أَلَّا تَعُولُوا۟ ٣
৪ ) আর আনন্দের সাথে (ফরয মনে করে) স্ত্রীদের মোহরানা আদায় করে দাও। তবে যদি তারা নিজেরাই নিজেদের ইচ্ছায় মোহরানার কিছু অংশ মাফ করে দেয়, তাহলে তোমরা সানন্দে তা খেতে পারো। ৭
وَءَاتُوا۟ ٱلنِّسَآءَ صَدُقَـٰتِهِنَّ نِحْلَةًۭ ۚ فَإِن طِبْنَ لَكُمْ عَن شَىْءٍۢ مِّنْهُ نَفْسًۭا فَكُلُوهُ هَنِيٓـًۭٔا مَّرِيٓـًۭٔا ٤
৫ ) আর তোমাদের যে ধন–সম্পদকে আল্লাহ তোমাদের জীবন ধারণের মাধ্যমে পরিণত করেছেন, তা নির্বোধদের হাতে তুলে দিয়ো না। তবে তাদের খাওয়া পরার ব্যবস্থা করো এবং সদুপদেশ দাও। ৮
وَلَا تُؤْتُوا۟ ٱلسُّفَهَآءَ أَمْوَٰلَكُمُ ٱلَّتِى جَعَلَ ٱللَّهُ لَكُمْ قِيَـٰمًۭا وَٱرْزُقُوهُمْ فِيهَا وَٱكْسُوهُمْ وَقُولُوا۟ لَهُمْ قَوْلًۭا مَّعْرُوفًۭا ٥
৬ ) আর এতিমদের পরীক্ষা করতে থাকো, যতদিন না তারা বিবাহযোগ্য বয়সে পৌঁছে যায়। ৯ তারপর যদি তোমরা তাদের মধ্যে যোগ্যতার সন্ধান পাও, তাহলে তাদের সম্পদ তাদের হাতে সোপর্দ করে দাও। ১০ তারা বড় হয়ে নিজেদের অধিকার দাবী করবে, এ ভয়ে কখনো ইনসাফের সীমানা অতিক্রম করে তাদের সম্পদ তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেলো না। এতিমদের যে অভিভাবক সম্পদশালী হবে সে যেন পরহেজগারী অবলম্বন করে (অর্থাৎ অর্থ গ্রহণ না করে) আর যে গরীব হবে সে যেন প্রচলিত পদ্ধতিতে খায়। ১১ তারপর তাদের সম্পদ যখন তাদের হাতে সোপর্দ করতে যাবে তখন তাতে লোকদেরকে সাক্ষী বানাও। আর হিসেব নেবার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।
وَٱبْتَلُوا۟ ٱلْيَتَـٰمَىٰ حَتَّىٰٓ إِذَا بَلَغُوا۟ ٱلنِّكَاحَ فَإِنْ ءَانَسْتُم مِّنْهُمْ رُشْدًۭا فَٱدْفَعُوٓا۟ إِلَيْهِمْ أَمْوَٰلَهُمْ ۖ وَلَا تَأْكُلُوهَآ إِسْرَافًۭا وَبِدَارًا أَن يَكْبَرُوا۟ ۚ وَمَن كَانَ غَنِيًّۭا فَلْيَسْتَعْفِفْ ۖ وَمَن كَانَ فَقِيرًۭا فَلْيَأْكُلْ بِٱلْمَعْرُوفِ ۚ فَإِذَا دَفَعْتُمْ إِلَيْهِمْ أَمْوَٰلَهُمْ فَأَشْهِدُوا۟ عَلَيْهِمْ ۚ وَكَفَىٰ بِٱللَّهِ حَسِيبًۭا ٦
৭ ) মা–বাপ ও আত্মীয়-স্বজনরা যে ধন-সম্পত্তি রেখে গেছে তাতে পুরুষদের অংশ রয়েছে। আর মেয়েদেরও অংশ রয়েছে সেই ধন-সম্পত্তিতে, যা মা-বাপ ও আত্মীয়-স্বজনরা রেখে গেছে, তা সামান্য হোক বা বেশী ১২ এবং এ অংশ (আল্লাহর পক্ষ থেকে) নির্ধারিত।
لِّلرِّجَالِ نَصِيبٌۭ مِّمَّا تَرَكَ ٱلْوَٰلِدَانِ وَٱلْأَقْرَبُونَ وَلِلنِّسَآءِ نَصِيبٌۭ مِّمَّا تَرَكَ ٱلْوَٰلِدَانِ وَٱلْأَقْرَبُونَ مِمَّا قَلَّ مِنْهُ أَوْ كَثُرَ ۚ نَصِيبًۭا مَّفْرُوضًۭا ٧
৮ ) ধন-সম্পত্তি ভাগ-বাঁটোয়ারার সময় আত্মীয়–স্বজন, এতিম ও মিসকিনরা এলে তাদেরকেও ঐ সম্পদ থেকে কিছু দিয়ে দাও এবং তাদের সাথে ভালোভাবে কথা বলো। ১৩
وَإِذَا حَضَرَ ٱلْقِسْمَةَ أُو۟لُوا۟ ٱلْقُرْبَىٰ وَٱلْيَتَـٰمَىٰ وَٱلْمَسَـٰكِينُ فَٱرْزُقُوهُم مِّنْهُ وَقُولُوا۟ لَهُمْ قَوْلًۭا مَّعْرُوفًۭا ٨
৯ ) লোকদের একথা মনে করে ভয় করা উচিত, যদি তারা অসহায় সন্তান পিছনে ছেড়ে রেখে যেতো, তাহলে মরার সময় নিজেদের সন্তানদের ব্যাপারে তাদের কতই না আশঙ্কা হতো! কাজেই তাদের আল্লাহকে ভয় করা ও ন্যায়সঙ্গত কথা বলা উচিত।
وَلْيَخْشَ ٱلَّذِينَ لَوْ تَرَكُوا۟ مِنْ خَلْفِهِمْ ذُرِّيَّةًۭ ضِعَـٰفًا خَافُوا۟ عَلَيْهِمْ فَلْيَتَّقُوا۟ ٱللَّهَ وَلْيَقُولُوا۟ قَوْلًۭا سَدِيدًا ٩
১০ ) যারা এতিমদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খায়, তারা আগুন দিয়ে নিজেদের পেট পূর্ণ করে এবং তাদেরকে অবশ্যি জাহান্নামের জ্বলন্ত আগুনে ফেলে দেয়া হবে। ১৪
إِنَّ ٱلَّذِينَ يَأْكُلُونَ أَمْوَٰلَ ٱلْيَتَـٰمَىٰ ظُلْمًا إِنَّمَا يَأْكُلُونَ فِى بُطُونِهِمْ نَارًۭا ۖ وَسَيَصْلَوْنَ سَعِيرًۭا ١٠
১.
যেহেতু সামনের দিকের আয়াতগুলোতে মানুষের পারস্পরিক অধিকারের কথা আলোচনা করা হবে, বিশেষ করে পারিবারিক ব্যবস্থাপনাকে উন্নত ও সুগঠিত করার জন্য প্রয়োজনীয় আইন-কানুন বর্ণনা করা হবে, তাই এভাবে ভূমিকা ফাঁদা হয়েছেঃ একদিকে আল্লাহকে ভয় করার ও তাঁর অসন্তোষ থেকে আত্মরক্ষার জন্য জোর তাগীদ করা হয়েছে এবং অন্যদিকে একথা মনের মধ্যে গেঁথে দেয়া হয়েছে যে, একজন মানুষ থেকে সমস্ত মানুষের উৎপত্তি এবং রক্ত-মাংস ও শারীরিক উপাদানের দিক দিয়ে তারা প্রত্যেকে প্রত্যেকের অংশ।
“তোমাদের একটি প্রাণ থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।” অর্থাৎ প্রথমে এক ব্যক্তি থেকে মানব জাতির সৃষ্টি করেন। অন্যত্র কুরআন নিজেই এর ব্যাখ্যা করে বলেছে যে, সেই প্রথম ব্যক্তি ছিলেন হযরত আদম আলাইহিস সালাম। তাঁর থেকেই এ দুনিয়ায় মানব বংশ বিস্তার লাভ করে।
“সেই একই প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন তার জোড়া।” এ বিষয়টির বিস্তারিত জ্ঞান আমাদের কাছে নেই। সাধারণভাবে কুরআনের তাফসীরকারগণ যা বর্ণনা করেন এবং বাইবেলে যা বিবৃত হয়েছে তা হচ্ছে নিম্নরূপঃ আদমের পাঁজর থেকে হাওয়াকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তালমুদে আর একটু বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছেঃ ডান দিকের ত্রয়োদশ হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু কুরআন মজীদ এ ব্যাপারে নীরব। আর এর সপক্ষে যে হাদীসটি পেশ করা হয় তার অর্থ লোকেরা যা মনে করে নিয়েছে তা নয়। কাজেই কথাটিকে আল্লাহ যেভাবে সংক্ষিপ্ত ও অস্পষ্ট রেখেছেন তেমনি রেখে এর বিস্তারিত অবস্থান জানার জন্য সময় নষ্ট না করাই ভালো।
২.
অর্থাৎ যতদিন তারা শিশু ও নাবালেগ থাকে ততদিন তাদের ধন-সম্পদ তাদের স্বার্থে ব্যয় করো। আর প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে যাবার পর তাদের হক তাদের কাছে ফিরিয়ে দাও।
৩.
একটি ব্যাপক অর্থবোধক বাক্য। এর একটি অর্থ হচ্ছে, হালালের পরিবর্তে হারাম উপার্জন করো না এবং দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে, এতিমদের ভালো সম্পদের সাথে নিজেদের খারাপ সম্পদ বদল করো না।
৪.
মুফাস্সিরগণ এর তিনটি অর্থ বর্ণনা করেছেনঃ
একঃ হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা এর ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ জাহেলী যুগে যেসব এতিম মেয়ে লোকদের অভিভাবকত্বাধীন থাকতো তাদের সম্পদ ও সৌন্দর্যের কারণে অথবা তাদের ব্যাপারে তো উচ্চবাচ্য করার কেউ নেই, যেভাবে ইচ্ছা তাদের দাবিয়ে রাখা যাবে- এই ধারণার বশবর্তী হয়ে অনেক অভিভাবক নিজেরাই তাদেরকে বিয়ে করতো, তারপর তাদের ওপর জুলুম করতে থাকতো। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয়েছে, তোমরা যদি আশঙ্কা করো যে তাদের সাথে ইনসাফ করতে পারবে না, তাহলে সমাজে আরো অনেক মেয়ে আছে, তাদের মধ্যে থেকে নিজের পছন্দমতো মেয়েদেরকে বিয়ে করো। এ সূরার ১৯ রুকূর প্রথম আয়াতটি এ ব্যাখ্যা সমর্থন করে।
দুইঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁর ছাত্র ইকরামা এর ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ জাহেলী যুগে স্ত্রী গ্রহণের ব্যাপারে কোন নির্ধারিত সীমা ছিল না। এক একজন লোক দশ দশটি বিয়ে করতো। স্ত্রীদের সংখ্যাধিক্যের কারণে সংসার খরচ বেড়ে যেতো। তখন বাধ্য হয়ে তারা নিজেদের এতিম ভাইঝি ও ভাগ্নীদের এবং অন্যান্য অসহায় আত্মীয়াদের অধিকারের দিকে হাত বাড়াতো। এ কারণে আল্লাহ বিয়ের জন্য চারটির সীমা নির্ধারিত করে দিয়েছেন। জুলুম ও বে-ইনসাফী থেকে বাঁচার পন্থা এই যে, এক থেকে চারটি পর্যন্ত স্ত্রী গ্রহণ করবে যাতে তাদের সাথে সুবিচার করতে পার।
তিনঃ সাঈদ ইবনে জুবাইর, কাতাদাহ এবং অন্যান্য কোন কোন মুফাস্সির বলেনঃ এতিমদের সাথে বে-ইনসাফী করাকে জাহেলী যুগের লোকেরাও সুনজরে দেখতো না। কিন্তু মেয়েদের ব্যাপারে ইনসাফ ও ন্যায়নীতির কোন ধারণাই তাদের মনে স্থান পায়নি। তারা যতগুলো ইচ্ছা বিয়ে করতো। তারপর তাদের ওপর জুলুম-অত্যাচার চালাতো ইচ্ছে মতো। তাদের এ ব্যবহারের প্রেক্ষিতে বলা হয়েছে, যদি তোমরা এতিমদের ওপর জলুম ও বে-ইনসাফী করতে ভয় করে থাকো, তাহলে মেয়েদের সাথেও বে-ইনসাফী করার ব্যাপারে ভয় করো। প্রথমত চারটির বেশী বিয়েই করো না। আর চারের সংখ্যার মধ্যেও সেই ক’জনকে স্ত্রী হিসেব গ্রহণ করতে পারবে যাদের সাথে ইনসাফ করতে পারবে।
আয়াতের শব্দাবলী এমনভাবে গ্রথিত হয়েছে, যার ফলে সেখান থেকে এ তিনটি ব্যাখ্যারই সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি একই সঙ্গে আয়াতটির এ তিনটি অর্থই যদি এখানে উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। এছাড়া এর আর একটা অর্থও হতে পারে। অর্থাৎ এতিমদের সাথে যদি এভাবে ইনসাফ না করতে পারো তাহলে যেসব মেয়ের সাথে এতিম শিশু সন্তান রয়েছে তাদেরকে বিয়ে করো।
৫.
এ আয়াতের ওপর মুসলিম ফকীহগণের ‘ইজমা’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাঁরা বলেন, এ আয়াতের মাধ্যমে স্ত্রীর সংখ্যা সীমিত করে দেয়া হয়েছে এবং একই সঙ্গে এক ব্যক্তির চারজনের বেশী স্ত্রী রাখা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। হাদীস থেকেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। হাদীস বলা হয়েছেঃ তায়েফ প্রধান গাইলানের ইসলাম গ্রহণকালে নয়জন স্ত্রী ছিল। নবী ﷺ তাঁকে চারজন স্ত্রী রেখে দিয়ে বাকি পাঁচজনকে তালাক দেবার নির্দেশ দেন। এভাবে আর এক ব্যক্তির (নওফল ইবনে মুআবীয়া) ছিল পাঁচজন স্ত্রী। নবী ﷺ তার এক স্ত্রীকে তালাক দেবার হুকম দেন।
এছাড়াও এ আয়াতে একাধিক স্ত্রী রাখার বৈধতাকে ইনসাফ ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যবহারের শর্ত সাপেক্ষ করা হয়েছে। যে ব্যক্তি ইনসাফ ও ন্যায়নিষ্ঠতার শর্ত পূরণ না করে একাধিক স্ত্রী রাখার বৈধতার সুযোগ ব্যবহার করে সে মূলত আল্লাহর সাথে প্রতারণা করে। যে স্ত্রী বা যেসব স্ত্রীর সাথে সে ইনসাফ করে না ইসলামী সরকারের আদালতসমূহ তাদের অভিযোগ শুনে সে ব্যাপারে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।
কোন কোন লোক পাশ্চাত্যবাসীদের খৃস্টবাদী ধ্যান-ধারণার প্রভাবে আড়ষ্ট ও পরাজিত মনোভাব নিয়ে একথা প্রমাণ করার চেষ্টা করে থাকে যে, একাধিক বিয়ের পদ্ধতি (যা আসলে পাশ্চাত্যের দৃষ্টিতে একটি খারাপ পদ্ধতি) বিলুপ্ত করে দেয়াই কুরআনের আসল উদ্দেশ্য। কিন্তু সমাজে এ পদ্ধতির খুব বেশী প্রচলনের কারণে এর ওপর কেবলমাত্র বিধি-নিষেধ আরোপ করেই ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এ ধরনের কথাবার্তা মূলত নিছক মানসিক দাসত্বের ফলশ্রুতি ছাড়া আর কিছুই নয়। একাধিক স্ত্রী গ্রহণকে মূলগতভাবে অনিষ্টকর মনে করা কোনক্রমেই সঠিক হতে পারে না। কারণ কোন কোন অবস্থায় এটি একটি নৈতিক ও তামাদ্দুনিক প্রয়োজনে পরিণত হয়। যদি এর অনুমতি না থাকে তাহলে যারা এক স্ত্রীতে তুষ্ট হতে পারে না, তারা বিয়ের সীমানার বাইরে এসে যৌন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে তৎপর হবে। এর ফলে সমাজ-সংস্কৃতি-নৈতিকতার মধ্যে যে অনিষ্ট সাধিত হবে তা হবে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনিষ্টকারিতার চাইতে অনেক বেশী। তাই যারা এর প্রয়োজন অনুভব করে কুরআন তাদেরকে এর অনুমতি দিয়েছে। তবুও যারা মুলগতভাবে একাধিক বিয়েকে একটি অনিষ্টকারিতা মনে করেন, তাদেরকে অবশ্যি এ ইখতিয়ার দেয়া হয়েছে যে, তারা কুরআনের রায়ের বিরুদ্ধে এ মতবাদের নিন্দা করতে পারেন এবং একে রহিত করারও পরামর্শ দিতে পারেন কিন্তু নিজেদের মনগড়া রায়কে অনর্থক কুরআনের রায় বলে ঘোষণা করার কোন অধিকার তাদের নেই। কারণ কুরআন সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় একে বৈধ ঘোষণা করেছে। ইশারা ইঙ্গিতেও এর নিন্দায় এমন একটি শব্দ ব্যবহার করেনি, যা থেকে বুঝা যায় যে, সে এর পথ বন্ধ করতে চায়। (আরো বেশী জানার জন্য আমার “সুন্নাতের আইনগত মর্যাদা” গ্রন্থটি পড়ুন)
৬.
এখানে ক্রীতদাসী বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যেসব নারী যুদ্ধবন্দিনী হিসেবে আসে এবং সরকারের পক্ষ থেকে তাদেরকে জনগণের মধ্যে বিতরণ করা হয়। একথা বলার অর্থ হচ্ছে এই যে, একজন সম্ভ্রান্ত পরিবারের স্বাধীন মহিলাকে বিয়ে করার দায়িত্ব পালন করতে না পারলে একজন যুদ্ধবন্দিনী হিসেবে আনীত বাঁদীকে বিয়ে করো। সামনের দিকে চতুর্থ রুকূ’তে একথাই বলা হয়েছে। অথবা যদি তোমাদের একাধিক স্ত্রীর প্রয়োজন হয়ে পড়ে এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের স্বাধীন মেয়েদের বিয়ে করলে তাদের মধ্যে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা তোমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে থাকে, তাহলে ক্রীতদাসীদেরকে গ্রহণ করো। কারণ তাদের ব্যাপারে তোমাদের ওপর তুলনামূলকভাবে কম দায়িত্ব আসবে। (সামনের দিকে ৪৪ টীকায় ক্রীতদাসীদের বিধান সম্পর্কে আরো বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে)।
৭.
হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও কাযী শুরাইহর ফয়সালা হচ্ছেঃ যদি কোন স্ত্রী তার স্বামীকে সম্পূর্ণ মোহরানা বা তার অংশবিশেষ মাফ করে দেয় এবং তারপর আবার তা দাবী করে, তাহলে তা আদায় করার জন্য স্বামীকে বাধ্য করা হবে। কেননা তার দাবী করাই একথা প্রমাণ করে যে, সে নিজের ইচ্ছায় মোহরানার সমুদয় অর্থ বা তার অংশবিশেষ ছাড়তে রাজী নয়। (এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য আমার “স্বামী-স্ত্রীর অধিকার” বইটির ‘মোহরানা’ অধ্যায়টি পড়ুন)।
৮.
এ আয়াতটি ব্যাপক অর্থবোধক। এর মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহকে একটি পরিপূর্ণ বিধান দেয়া হয়েছে। তাদেরকে বলা হয়েছেঃ অর্থ জীবন যাপনের একটি মাধ্যম। যে কোন অবস্থায়ই তা এমন ধরনের অজ্ঞ ও নির্বোধ লোকদের হাতে তুলে দেয়া উচিত নয়, যারা এ অর্থ-সম্পদের ত্রুটিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে তামাদ্দুনিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে এবং শেষ পর্যন্ত নৈতিক ব্যবস্থাকেও ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।কোন ব্যক্তির নিজের সম্পদের ওপর তার মালিকানা অধিকার থাকে ঠিকই। কিন্তু তা এত বেশী সীমাহীন নয় যে, যদি সে ঐ সমস্ত অধিকার সঠিকভাবে ব্যবহার করার যোগ্যতা না রাখে এবং তার ত্রুটিপূর্ণ ব্যবহারের কারণে সামাজিক বিপর্যয় দেখা দেয় তারপরও তার কাছ থেকে ঐ অধিকার হরণ করা যাবে না। মানুষের জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর চাহিদা অবশ্যি পূর্ণ হতে হবে। তবে মালিকানা অধিকারের অবাধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যি এ বিধি-নিষেধ আরোপিত হওয়া উচিত যে, এ ব্যবহার নৈতিক ও তামাদ্দুনিক জীবন এবং সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য সুস্পষ্টভাবে ক্ষতিকর হতে পারবে না। এ বিধান অনুযায়ী প্রত্যেক সম্পদ-সম্পত্তির মালিককে ক্ষুদ্র পরিসরে এদিকে অবশ্যি নজর রাখতে হবে যে, নিজের সম্পদ সে যার হাতে সোপর্দ করছে সে তা ব্যবহারের যোগ্যতা রাখে কিনা। আর বৃহত্তর পরিসরে এটা ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে যে, যারা নিজেদের সম্পদ ব্যবহারের যোগ্যতা রাখে না অথবা যারা অসৎপথে নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যবহার করছে, তাদের ধন-সম্পত্তি সে নিজের পরিচালনাধীনে নিয়ে নেবে এবং তাদের জীবন নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যবস্থা করে দেবে।
৯.
অর্থাৎ যখন তারা সাবালক হয়ে যেতে থাকে তখন তাদের বুদ্ধি-জ্ঞান কি পর্যায়ে বিকশিত হয়েছে তা দেখতে হবে এবং তারা নিজেদের বিষয়াদি আপন দায়িত্বে পরিচালনা করার যোগ্যতা কতটুকু অর্জন করেছে সে দিকেও তীক্ষ্ম পর্যালোচনার দৃষ্টিতে নজর রাখতে হবে।
১০.
ধন-সম্পদ তাদের হাতে সোপর্দ করার জন্য দু’টি শর্ত আরোপ করা হয়েছে। একটি হচ্ছে, সাবালকত্ব আর দ্বিতীয়টি যোগ্যতা, অর্থাৎ অর্থ-সম্পদ সঠিকভাবে ব্যবহার করার যোগ্যতা। প্রথম শর্তটির ব্যাপারে উম্মতের ফকীহগণ একমত। দ্বিতীয় শর্তটির ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহু আলাইহির মত হচ্ছে এই যে, সাবালক হবার পরও যদি এতিমের মধ্যে ‘যোগ্যতা’ না পাওয়া যায়, তাহলে তার অভিভাবককে সর্বাধিক আরো সাত বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তারপর ‘যোগ্যতা’ পাওয়া যাক বা না যাক সর্বাবস্থায় এতিমকে তার ধন-সম্পদের দায়িত্ব দিতে হবে। ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মাদ ও ইমাম শাফেঈ রাহেমাহুমুল্লাহর মতে ধন-সম্পদ এতিমের হাতে সোপর্দ করার জন্য অবশ্যি ‘যোগ্যতা’ একটি অপরিহার্য শর্ত। সম্ভবত এঁদের মতে এ ব্যাপারে শরীয়াতের বিষয়সমূহের ফায়সালাকারী কাযীর শরণাপন্ন হওয়াই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। যদি কাযীর সামনে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, সংশ্লিষ্ট এতিমের মধ্যে যোগ্যতা পাওয়া যাচ্ছে না, তাহলে তার বিষয় সম্পত্তি দেখাশুনার জন্য তিনি নিজেই কোন ভালো ব্যবস্থা করবেন।
১১.
অর্থাৎ সম্পত্তি দেখাশুনার বিনিময়ে নিজের পারিশ্রমিক ঠিক ততটুকু পরিমাণ গ্রহণ করতে পারে যতটুকু গ্রহণ করাকে একজন নিরপেক্ষ ও সুবিবেচক ব্যক্তি সঙ্গত বলে মনে করতে পারে। তাছাড়া নিজের পারিশ্রমিক হিসেবে সে যতটুকু গ্রহণ করবে, তা গোপনে গ্রহণ করবে না বরং প্রকাশ্যে নির্ধারিত করে গ্রহণ করবে এবং তার হিসেব রাখবে।
১২.
আয়াতে সুস্পষ্টভাবে পাঁচটি আইনগত নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এক, মীরাস কেবল পুরুষদের নয়, মেয়েদেরও অধিকার। দুই, যত কমই হোক না কেন মীরাস অবশ্যি বন্টিত হতে হবে। এমন কি মৃত ব্যক্তি যদি এক গজ কাপড় রেখে গিয়ে থাকে এবং তার দশজন ওয়ারিস থাকে, তাহলেও তা ওয়ারিসদের মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে। একজন ওয়ারিস অন্যজনের থেকে যদি তার অংশ কিনে নেয় তাহলে তা আলাদা কথা। তিন, এ আয়াত থেকে একথাও সুস্পষ্ট হয়েছে যে, মীরাসের বিধান স্থাবর-অস্থাবর, কৃষি-শিল্প বা অন্য যে কোন্ ধরনের সম্পত্তি হোক না কেন সব ক্ষেত্রে জারী হবে। চার, এ থেকে জানা যায় যে, মীরাসের অধিকার তখনই সৃষ্টি হয় যখন মৃত ব্যক্তি কোন সম্পদ রেখে মারা যায়। পাঁচ, এ থেকে এ বিধানও নির্দিষ্ট হয় যে, নিকটতম আত্মীয়ের উপস্থিতিতে দূরতম আত্মীয় মীরাস লাভ করবে না।
১৩.
এখানে মৃত ব্যক্তির ওয়ারিসদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছেঃ মীরাস বন্টনের সময় নিকট ও দূরের আত্মীয়রা, নিজের গোত্রের ও পরিবারের গরীব মিসিকন লোকেরা এবং এতিম ছেলেমেয়ে যারা সেখানে উপস্থিত থাকে, তাদের সাথে হৃদয়হীন ব্যবহার করো না। শরীয়াতের বিধান মতে মীরাসে তাদের অংশ নেই ঠিকই কিন্তু একটু ঔদার্যের পরিচয় দিয়ে পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে তাদেরকেও কিছু দিয়ে দাও। সাধারণভাবে এহেন অবস্থায় সংকীর্ণমনা লোকেরা যে ধরনের হৃদয়বিদারক আচরণ করে ও নির্মম কথাবার্তা বলে, তাদের সাথে তেমনটি করো না।
১৪.
হাদীসে বর্ণিত হয়েছে ওহোদ যুদ্ধের পর হযরত সা’দ ইবনে রুবী’র স্ত্রী তাঁর দু’টি শিশু সন্তানকে নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাযির হন। তিনি বলেন, “হে আল্লাহর রসূল! এরা সা’দের মেয়ে। এদের বাপ আপনার সাথে ওহোদের যুদ্ধে গিয়ে শহীদ হয়ে গেছেন। এদের চাচা তার সমস্ত সম্পত্তি নিজের আয়ত্বাধীন করে নিয়েছে। এদের জন্য একটি দানাও রাখেনি। এখন বলুন, কে এ (সহায় সম্পত্তিহীনা) মেয়েদেরকে বিয়ে করবে? ” তার এ বক্তব্যের প্রেক্ষিতে এ আয়াত নাযিল হয়।