আল ফাতিহা
৭ আয়াত
আল বাকারাহ
২৮৬ আয়াত
আলে ইমরান
২০০ আয়াত
আন্ নিসা
১৭৬ আয়াত
আল মায়েদাহ
১২০ আয়াত
আল আন'আম
১৬৫ আয়াত
আল আরাফ
২০৬ আয়াত
আল আনফাল
৭৫ আয়াত
আত তওবা
১২৯ আয়াত
১০
ইউনুস
১০৯ আয়াত
১১
হুদ
১২৩ আয়াত
১২
ইউসুফ
১১১ আয়াত
১৩
আর্ রাদ
৪৩ আয়াত
১৪
ইবরাহীম
৫২ আয়াত
১৫
আল হিজর
৯৯ আয়াত
১৬
আন্ নাহল
১২৮ আয়াত
১৭
বনী ইসরাঈল
১১১ আয়াত
১৮
আল কাহফ
১১০ আয়াত
১৯
মারয়াম
৯৮ আয়াত
২০
ত্বাহা
১৩৫ আয়াত
২১
আল আম্বিয়া
১১২ আয়াত
২২
আল হাজ্জ
৭৮ আয়াত
২৩
আল মুমিনূন
১১৮ আয়াত
২৪
আন্ নূর
৬৪ আয়াত
২৫
আল-ফুরকান
৭৭ আয়াত
২৬
আশ্-শু’আরা
২২৭ আয়াত
২৭
আন নামল
৯৩ আয়াত
২৮
আল কাসাস
৮৮ আয়াত
২৯
আল আনকাবূত
৬৯ আয়াত
৩০
আর রূম
৬০ আয়াত
৩১
লুকমান
৩৪ আয়াত
৩২
আস সাজদাহ
৩০ আয়াত
৩৩
আল আহযাব
৭৩ আয়াত
৩৪
আস সাবা
৫৪ আয়াত
৩৫
ফাতের
৪৫ আয়াত
৩৬
ইয়া-সীন
৮৩ আয়াত
৩৭
আস্ সা-ফফা-ত
১৮২ আয়াত
৩৮
সা-দ
৮৮ আয়াত
৩৯
আয যুমার
৭৫ আয়াত
৪০
আল মুমিন
৮৫ আয়াত
৪১
হা-মীম আস সাজদাহ
৫৪ আয়াত
৪২
আশ শূরা
৫৩ আয়াত
৪৩
আয্ যুখরুফ
৮৯ আয়াত
৪৪
আদ দুখান
৫৯ আয়াত
৪৫
আল জাসিয়াহ
৩৭ আয়াত
৪৬
আল আহক্বাফ
৩৫ আয়াত
৪৭
মুহাম্মদ
৩৮ আয়াত
৪৮
আল ফাতহ
২৯ আয়াত
৪৯
আল হুজুরাত
১৮ আয়াত
৫০
ক্বাফ
৪৫ আয়াত
৫১
আয যারিয়াত
৬০ আয়াত
৫২
আত তূর
৪৯ আয়াত
৫৩
আন নাজম
৬২ আয়াত
৫৪
আল ক্বামার
৫৫ আয়াত
৫৫
আর রহমান
৭৮ আয়াত
৫৬
আল ওয়াকি’আ
৯৬ আয়াত
৫৭
আল হাদীদ
২৯ আয়াত
৫৮
আল মুজাদালাহ
২২ আয়াত
৫৯
আল হাশর
২৪ আয়াত
৬০
আল মুমতাহিনা
১৩ আয়াত
৬১
আস সফ
১৪ আয়াত
৬২
আল জুমআ
১১ আয়াত
৬৩
আল মুনাফিকুন
১১ আয়াত
৬৪
আত তাগাবুন
১৮ আয়াত
৬৫
আত তালাক
১২ আয়াত
৬৬
আত তাহরীম
১২ আয়াত
৬৭
আল মুলক
৩০ আয়াত
৬৮
আল কলম
৫২ আয়াত
৬৯
আল হাককাহ
৫২ আয়াত
৭০
আল মাআরিজ
৪৪ আয়াত
৭১
নূহ
২৮ আয়াত
৭২
আল জিন
২৮ আয়াত
৭৩
আল মুযযাম্মিল
২০ আয়াত
৭৪
আল মুদ্দাস্সির
৫৬ আয়াত
৭৫
আল কিয়ামাহ
৪০ আয়াত
৭৬
আদ্ দাহর
৩১ আয়াত
৭৭
আল মুরসালাত
৫০ আয়াত
৭৮
আন নাবা
৪০ আয়াত
৭৯
আন নাযি’আত
৪৬ আয়াত
৮০
আবাসা
৪২ আয়াত
৮১
আত তাকবীর
২৯ আয়াত
৮২
আল ইনফিতার
১৯ আয়াত
৮৩
আল মুতাফফিফীন
৩৬ আয়াত
৮৪
আল ইনশিকাক
২৫ আয়াত
৮৫
আল বুরূজ
২২ আয়াত
৮৬
আত তারিক
১৭ আয়াত
৮৭
আল আ’লা
১৯ আয়াত
৮৮
আল গাশিয়াহ
২৬ আয়াত
৮৯
আল ফজর
৩০ আয়াত
৯০
আল বালাদ
২০ আয়াত
৯১
আশ শামস
১৫ আয়াত
৯২
আল লাইল
২১ আয়াত
৯৩
আদ দুহা
১১ আয়াত
৯৪
আলাম নাশরাহ
৮ আয়াত
৯৫
আত তীন
৮ আয়াত
৯৬
আল আলাক
১৯ আয়াত
৯৭
আল কাদ্‌র
৫ আয়াত
৯৮
আল বাইয়েনাহ
৮ আয়াত
৯৯
আল যিলযাল
৮ আয়াত
১০০
আল আদিয়াত
১১ আয়াত
১০১
আল কারি’আহ
১১ আয়াত
১০২
আত তাকাসুর
৮ আয়াত
১০৩
আল আসর
৩ আয়াত
১০৪
আল হুমাযা
৯ আয়াত
১০৫
আল ফীল
৫ আয়াত
১০৬
কুরাইশ
৪ আয়াত
১০৭
আল মাউন
৭ আয়াত
১০৮
আল কাউসার
৩ আয়াত
১০৯
আল কাফিরূন
৬ আয়াত
১১০
আন নসর
৩ আয়াত
১১১
আল লাহাব
৫ আয়াত
১১২
আল ইখলাস
৪ আয়াত
১১৩
আল ফালাক
৫ আয়াত
১১৪
আন নাস
৬ আয়াত

আল বুরূজ

২২ আয়াত

আয়াত
-
১ ) কসম মজবুত দুর্গ বিশিষ্ট আকাশের
وَٱلسَّمَآءِ ذَاتِ ٱلْبُرُوجِ ١
২ ) এবং সেই দিনের যার ওয়াদা করা হয়েছে
وَٱلْيَوْمِ ٱلْمَوْعُودِ ٢
৩ ) আর যে দেখে তার এবং সেই জিনিসের যা দেখা যায়।
وَشَاهِدٍۢ وَمَشْهُودٍۢ ٣
৪ ) মারা পড়েছে গর্তওয়ালারা যে গর্তে দাউ দাউ করে জ্বলা জ্বালানীর আগুন ছিল,
قُتِلَ أَصْحَـٰبُ ٱلْأُخْدُودِ ٤
৫ ) যখন তারা সেই গর্তের কিনারে বসেছিল
ٱلنَّارِ ذَاتِ ٱلْوَقُودِ ٥
৬ ) এবং ঈমানদারদের সাথে
إِذْ هُمْ عَلَيْهَا قُعُودٌۭ ٦
৭ ) তারা সবকিছু করছিল তা দেখছিল।
وَهُمْ عَلَىٰ مَا يَفْعَلُونَ بِٱلْمُؤْمِنِينَ شُهُودٌۭ ٧
৮ ) ওই ঈমানদারদের সাথে তাদের শত্রুতার এছাড়া আর কোন কারণ ছিল না যে, তারা সেই আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছিল
وَمَا نَقَمُوا۟ مِنْهُمْ إِلَّآ أَن يُؤْمِنُوا۟ بِٱللَّهِ ٱلْعَزِيزِ ٱلْحَمِيدِ ٨
৯ ) যিনি মহাপরাক্রমশালী এবং নিজের সত্তায় নিজেই প্রশংসিত, যিনি আকাশ ও পৃথিবীর রাজত্বের অধিকারী। আর সে আল্লাহ‌ সবকিছু দেখছেন।
ٱلَّذِى لَهُۥ مُلْكُ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ ۚ وَٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَىْءٍۢ شَهِيدٌ ٩
১০ ) যারা মু’মিন পুরুষ ও নারীদের ওপর জুলুম-নিপীড়ন চালিয়েছে, তারপর তা থেকে তওবা করেনি, নিশ্চিতভাবেই তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আযাব এবং জ্বালা-পোড়ার শাস্তি।
إِنَّ ٱلَّذِينَ فَتَنُوا۟ ٱلْمُؤْمِنِينَ وَٱلْمُؤْمِنَـٰتِ ثُمَّ لَمْ يَتُوبُوا۟ فَلَهُمْ عَذَابُ جَهَنَّمَ وَلَهُمْ عَذَابُ ٱلْحَرِيقِ ١٠
১.
মূলে دَاتِ البُرُوْج বলা হয়েছে। অর্থাৎ বুর্জ বিশিষ্ট আকাশ। প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা অনুযায়ী মুফাসসিরগণের কেউ কেউ এ থেকে আকাশের বারটি বুর্জ অর্থ করেছেন। অন্যদিকে ইবনে আব্বাস (রা.), মুজাহিদ, কাতাদাহ, হাসান বসরী, যাহহাক ও সুদ্দীর মতে এর অর্থ হচ্ছে, আকাশের বিশাল গ্রহ ও তারকাসমূহ।
২.
অর্থাৎ কিয়ামতের দিন।
৩.
যে দেখে এবং যা দেখা যায়--- এ ব্যাপারে মুফাসসিরগণের বিভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যায়। কিন্তু আমার মতে বক্তব্যের ধারাবাহিকতার সাথে যে কথাটি সম্পর্ক রাখে সেটি হচ্ছে, যে দেখে বলতে এখানে কিয়ামতের দিন উপস্থিত প্রত্যেক ব্যক্তিকে এবং যা দেখা যায় বলতে কিয়ামতকেই বুঝানো হয়েছে। কিয়ামতের ভয়াবহ ও লোমহর্ষক ঘটনাবলী সেদিন যারা দেখে তারা প্রত্যেকেই দেখবে। এটি মুজাহিদ, ইকরামা, যাহহকা, ইবনে নুজাইহ্ এবং অন্যান্য কতিপয় মুফাসসিরের বক্তব্য।
৪.
যারা বড় বড় গর্তের মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে ঈমানদারদেরকে তার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল এবং তাদের জ্বলে পুড়ে মরার বীভৎস দৃশ্য নিজেদের চোখে দেখেছিল তাদেরকে এখানে গর্তওয়ালা বলা হয়েছে। মারা পড়েছে অর্থ তাদের ওপর আল্লাহর লানত পড়েছে এবং তারা আল্লাহর আযাবের অধিকারী হয়েছে। এ বিষয়টির জন্য তিনটি জিনিসের কসম খাওয়া হয়েছে। প্রথম বুর্জ বিশিষ্ট আকাশের, দ্বিতীয় কিয়ামতের দিনের, যার ওয়াদা করা হয়েছে। তৃতীয় কিয়ামতের ভয়াবহ ও লোমহর্ষক দৃশ্যাবলীর এবং সেই সমস্ত সৃষ্টির যারা এ দৃশ্যাবলী প্রত্যক্ষ করবে। প্রথম জিনিসটি সাক্ষ্য দিচ্ছে, যে সর্বময় ক্ষমতাসম্পন্ন মহাশক্তিধর সত্ত্বা বিশ্ব-জাহানের বিশাল তারকা ও গ্রহরাজির ওপর কর্তৃত্ব করছেন তাঁর পাকড়াও থেকে এ তুচ্ছ নগণ্য মানুষ কেমন করে বাঁচতে পারে? দ্বিতীয় জিনিসটির কসম এজন্য খাওয়া হয়েছে যে, দুনিয়ায় তারা ইচ্ছামতো জুলুম করেছে কিন্তু এমন একটি দিন অবশ্যি আসবে যেদিনটি সম্পর্কে সমস্ত মানুষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে সেদিন প্রত্যেক মজলুমের বদলা দেয়া হবে এবং প্রত্যেক জালেমকে পাকড়াও করা হবে। তৃতীয় জিনিসটির কসম খাওয়ার কারণ হচ্ছে এই যে, এ জালেমরা যেভাবে ওই ঈমানদারদের জ্বলে পুড়ে মরার দৃশ্য দেখেছে ঠিক তেমনি কিয়ামতের দিন এদের শাস্তি দেয়ার দৃশ্য সমগ্র সৃষ্টি প্রত্যক্ষ করবে।

গর্তে আগুন জ্বালিয়ে ঈমানদারদেরকে তার মধ্যে নিক্ষেপ করার একাধিক ঘটনা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এ থেকে জানা যায়, এ ধরণের জুলুম ও নিপীড়নমূলক ঘটনা দুনিয়ায় কয়েকবার ঘটেছে।

হযরত সুহাইব রুমী (রা) এ ধরণের একটি ঘটনা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন। ঘটনাটি হচ্ছেঃ এক বাদশার কাছে একজন যাদুকর ছিল। বৃদ্ধ বয়সে সে বাদশাকে বললো, একটি ছেলেকে আমার কাছে নিযুক্ত করো, সে আমার কাছ থেকে এ যাদু শিখে নেবে। বাদশাহ যাদু শেখার জন্য যাদুকরের কাছে একটি ছেলেকে নিযুক্ত করলো। কিন্তু সেই ছেলেটি যাদুকরের কাছে আসা যাওয়ার পথে একজন রাহেবের (যিনি সম্ভবত হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের দ্বীনের অনুসারী একজন সাধক ছিলেন) সাক্ষাত করতে লাগলো। তাঁর কথায় প্রভাবিত হয়ে সে ঈমান আনলো। এমন কি তাঁর শিক্ষার গুণে সে অলৌকিক শক্তির অধিকারীও হয়ে গেলো। সে অন্ধদের দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দিতে এবং কুষ্ঠরোগ নিরাময় করতে লাগলো। ছেলেটি তাওহীদের প্রতি ঈমান এনেছে, একথা জানতে পেরে বাদশাহ প্রথমে রাহেবকে হত্যা করলো তারপর ছেলেটিকে হত্যা করতে চাইলো। কিন্তু কোন অস্ত্র দিয়েই এবং কোনভাবেই তাকে হত্যা করতে পারলো না। শেষে ছেলেটি বললো, যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে চাও তাহলে প্রকাশ্য জনসমাবেশে بِاسْمِ رَبِّ الْغُلَمِ “বিসমি রব্বিল গুলাম” (অর্থাৎ এই ছেলেটির রবের নামে) বাক্য উচ্চারণ করে আমাকে তীর মারো, তাতেই আমি মারা যাবো। বাদশাহ তাই করলো। ফলে ছেলেটি মারা গেলো। এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করে লোকেরা চীৎকার করে উঠলো, আমরা এই ছেলেটির রবের প্রতি ঈমান আনলাম। বাদশাহর সভাসদরা তাকে বললো, এখন তো তাই হয়ে গেলো যা থেকে আপনি বাঁচতে চাচ্ছিলেন। লোকেরা আপনার ধর্ম ত্যাগ করে এ ছেলেটির ধর্মগ্রহণ করেছে। এ অবস্থা দেখে বাদশাহ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলো। সে রাস্তার পাশে গর্ত খনন করালো। তাতে আগুন জ্বালালো। যারা ঈমান ত্যাগ করতে রাজী হলো না তাদের সবাইকে তার মধ্যে নিক্ষেপ করলো। (মুসনাদে আহমাদ, মুসলিম, নাসায়ী, তিরমিযী, ইবনে জারীর, আবদুর রাজ্জাক, ইবনে আবী শাইবা, তাবারানী, আবদ ইবনে হুমাইদ)

দ্বিতীয় ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু। তিনি বলেন, ইরানের এক বাদশাহ শরাব পান করে নিজের বোনের সাথে ব্যভিচার করে এবং উভয়ের মধ্যে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যায়। কথাটি প্রকাশ হয়ে গেলে বাদশাহ জনসম্মুখে ঘোষণা করে দেয় যে, আল্লাহ‌ বোনের সাথে বিয়ে হালাল করে দিয়েছেন। লোকেরা তার একথা মানতে প্রস্তুত হয় না। ফলে সে নানান ধরণের শাস্তি দিয়ে লোকদের একথা মানতে বাধ্য করতে থাকে। এমনকি সে অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে যে ব্যক্তি তার একথা মানতে প্রস্তুত হয়নি তাকে তার মধ্যে নিক্ষেপ করতে থাকে। হযরত আলী (রা.) বলেন, সে সময় থেকেই অগ্নি উপাসকদের মধ্যে রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়কে বিয়ে করার পদ্ধতি প্রচলিত হয়। (ইবনে জারীর)

তৃতীয় ঘটনাটি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) সম্ভবত ইসরাঈলী বর্ণনা থেকে উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেনঃ বেবিলনের অধিবাসীরা বনী ইসরাঈলকে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের দ্বীন থেকে বিচ্যূত করতে বাধ্য করেছিল। এমন কি যারা তাদের কথা মানতে অস্বীকার করতো তাদেরকে জ্বলন্ত ভরা গর্তে নিক্ষেপ করতো। (ইবনে জারীর, আবদ ইবনে হুমাইদ)

নাজরানের ঘটনাটিই সবচেয়ে বেশী প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। ইবনে হিশাম, তাবারী, ইবনে খালদূন, মু’জামুল বুলদান গ্রন্থ প্রণেতা ইত্যাদি মুসলিম ঐতিহাসিকগণ এ ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। এর সংক্ষিপ্তসার হচ্ছেঃ হিময়ারের (ইয়ামন) বাদশাহ তুবান আসয়াদ আবু কারিবা একবার ইয়াসরিবে যায়। সেখানে ইহুদিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করে এবং বনি কুরাইযার দু’জন ইহুদি আলেমকে সঙ্গে করে ইয়ামনে নিয়ে যায়। সেখানে সে ব্যাপকভাবে ইহুদি ধর্মের প্রচার চালায়। তারপর তার ছেলে যু-নুওয়াস তার উত্তরাধিকারী হয়। সে দক্ষিণ আরবে ঈসায়ীদের কেন্দ্রস্থল নাজরান আক্রমণ করে। সেখান থেকে ঈসায়ী ধর্মকে উৎখাত করা এবং সেখানকার অধিবাসীদেরকে জোরপূর্বক ইহুদি ধর্মে দীক্ষিত করাই ছিল তার লক্ষ্য। (ইবনে হিশাম বলেন, নাজরানবাসীরা হযরত ঈসার আসল দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।) নাজরান পৌঁছে সে লোকদেরকে ইহুদি ধর্মগ্রহণ করার আহবান জানায়। লোকেরা অস্বীকার করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সে বিপুল সংখ্যক লোককে দাউ দাউ করে জ্বলা আগুনের কুয়ায় নিক্ষেপ করে জ্বালিয়ে দেয় এবং অনেককে হত্যা করে। এভাবে মোট বিশ হাজার লোক নিহত হয়। নাজরানবাসীদের মধ্য থেকে দাউস যু-সা’লাবান নামক এক ব্যক্তি কোনক্রমে প্রাণ রক্ষা করে পালিয়ে যায়। এক বর্ণনা মতে, সে রোমের কায়সারের দরবারে চলে যায় এবং অন্য একটি বর্ণনা মতে সে চলে যায় হাবশার (ইথিওপিয়া) বাদশাহ নাজ্জাসীর দরবারে। সেখানে সে এই জুলুমের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। প্রথম বর্ণনা অনুযায়ী রোমের কায়সার হাবশার বাদশাকে লেখেন এবং দ্বিতীয় বর্ণনা অনুযায়ী নাজ্জাশী কায়সারে কাছে নৌবাহিনীর জাহাজ সরবরাহের আবেদন জানান। যাহোক সবশেষে হাবশার সত্তর হাজার সৈন্য আরইয়াত নামক একজন সেনাপতির পরিচালনাধীনে ইয়ামন আক্রমণ করে। যু-নুওয়াস নিহত হয়। ইহুদি রাষ্ট্রের পতন ঘটে। ইয়ামন হাবশার ঈসায়ী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়।

অন্যান্য ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণাদি থেকে মুসলিম ঐতিহাসিকদের এ বর্ণনার কেবল সত্যতাই প্রমাণিত হয় না বরং এ সম্পর্কিত আরো বিস্তারিত তথ্যাদিও জানা যায়। সর্বপ্রথম ৩৪০ খৃস্টাব্দে ইয়ামন হাবশার ঈসায়ীদের দখলে আসে। ৩৭৮ খৃঃ পর্যন্ত সেখানে তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকে। এ সময় ঈসায়ী মিশনারীরা ইয়ামনে প্রবেশ করতে শুরু করে। এরই নিকটবর্তী সময়ে ফেমিউন (Faymiyun) নামক একজন সংসার ত্যাগী সাধক পুরুষ, কাশফ ও কারামতের অধিকারী ঈসায়ী পর্যটক নাজরানে আসেন। তিনি স্থানীয় লোকদেরকে মূর্তি পূজার গলদ বুঝাতে থাকেন। তার প্রচার গুণে নাজরানবাসীরা ঈসায়ী ধর্মে দীক্ষিত হয়। সে সময় তিনজন সরদার তাদের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করতেন। তাদের একজনকে বলা হতো সাইয়েদ। তিনি উপজাতীয় সরদারদের মতো একজন বড় সরদার ছিলেন। বিদেশ সংক্রান্ত বিষয়াবলী, সন্ধি চুক্তি এবং সেনাবাহিনী পরিচালনা তার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। দ্বিতীয় জনকে বলা হতো আকেব। তিনি আভ্যন্তরীণ বিষয়াবলী দেখাশুনা করতেন। তৃতীয় জনকে বলা হতো উসকুফ (বিশপ)। তিনি ছিলেন ধর্মীয় নেতা। দক্ষিণ আরবে নাজরান ছিল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এটি ছিল একটি বৃহত্তম বাণিজ্য ও শিল্প কেন্দ্র। এখানে তসর, চামড়া ও অস্ত্র নির্মাণ শিল্প উন্নতি লাভ করেছিল। প্রসিদ্ধ ইয়ামনী বর্মও এখানে নির্মিত হতো। এ কারণে নিছক ধর্মীয় কারণেই নয় বরং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণেও যু-নুওয়াস এ গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি আক্রমণ করে। নাজরানের সাইয়েদ হারেশাকে, সুরিয়ানী ঐতিহাসিকগণ যাকে Arethas বলেছেন, হত্যা করে। তার স্ত্রী রুমার সামনে তার দুই কন্যাকে হত্যা করে এবং তাদের রক্ত পান করতে তাকে বাধ্য করে। তারপর তাকেও হত্যা করে। উসকুফ বিশপ পলের (Paul) শুকনো হাড় কবর থেকে বের করে এনে জ্বালিয়ে দেয়। আগুন ভরা গর্তসমূহে নারী, পুরুষ, শিশু, যুবা, বৃদ্ধ, পাদরী, রাহেব সবাইকে নিক্ষেপ করে। সামগ্রিকভাবে ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার লোক নিহত হয়েছিল বলা হয়। ৫২৩ খৃস্টাব্দে এ ঘটনা ঘটে। অবশেষে ৫২৫ খৃস্টাব্দে হাবশীরা ইয়ামন আক্রমণ করে যু-নুওয়াস ও তার হিমইয়ারী রাজত্বের পতন ঘটায়। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকগণ ইয়ামন হিসনে গুরাবের যে শিলালিপি উদ্ধার করেছেন তা থেকেও এর সত্যতা প্রমাণিত হয়।

খৃস্টীয় ষষ্ঠ শতকে ঈসায়ী লেখকদের বিভিন্ন লেখায় গর্তওয়ালাদের এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। এর মধ্যে মূল ঘটনার সময় এবং এ ঘটনা যারা প্রত্যক্ষ করেছিল তাদের বিবরণ সহকারে লিখিত বেশ কিছু গ্রন্থ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে তিনটি গ্রন্থের রচয়িতারা এই ঘটনার সমসাময়িক। তাদের একজন হচ্ছেনঃ প্রকোপিউস দ্বিতীয় জন কসমস ইনডিকোপ্লিউসটিস (Cosmos Indicopleustis) তিনি নাজ্জাশী এলিস বুয়ানের (Elesboan) নির্দেশে সে সময় বাতলিমুসের গ্রীক ভাষায় লিখিত বইগুলোর অনুবাদ করছিলেন। এ সময় তিনি হাবশার সমুদ্রোপকূলবর্তী এডোলিশ (Adolis) শহরে অবস্থান করছিলেন। তৃতীয় জন হচ্ছেন জোহান্নাস মালালা (Johnnes Malala)। পরবর্তী বহু ঐতিহাসিক তাঁর রচনা থেকে ঘটনাটি উদ্ধৃতি করেছেন। এদের পর এফেসুসের জোহান্নাসের (Johannes of Ephesus) নাম করা যায়। তিনি ৫৮৫ খৃস্টাব্দে মারা যান। তাঁর গীর্জার ইতিহাস গ্রন্থে নাজরানের ঈসায়ী সম্প্রদায়ের ওপর এই নিপীড়নের কাহিনী এ ঘটনার সমসাময়িক বর্ণনাকারী বিশপ শিমউনের (Simeon) একটি পত্র থেকে উদ্ধৃত করেছেন। এ পত্রটি লিখিত হয় জাবলা ধর্ম মন্দিরের প্রধানের (Abbot Von Gabula) নামে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বিভিন্ন ইয়ামনবাসীর বর্ণনার মাধ্যমে শিমউন তাঁর এই পত্রটি তৈরি করেন। এ পত্রটি ১৮৮১ খৃস্টাব্দে রোম থেকে এবং ১৮৮০ খৃস্টাব্দে ঈসায়ী শহীদানের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে প্রকাশিত হয়।

ইয়াকূবী পত্রিয়ার্ক ডিউনিসিউস (Patriarch Dionysius) ও জাকারিয়া সিদলিনি (Zacharia of Mitylene) তাদের সুরিয়ানী ইতিহাসেও এ ঘটনাটি উদ্ধৃত করেছেন। নাজরানের ঈসায়ী সমাজ সম্পর্কিত ইয়াকূব সুরুজীর গ্রন্থেও এর উল্লেখ রয়েছে। আর রাহা (Edessa) এর বিশপ পোলাস (PULUS) নাজরানের নিহতদের উদ্দেশ্যে শোকগীতি লিখেছেন। এটি এখনো পাওয়া যায়। সুরিয়ানী ভাষার বই “আল হিময়ারীন” এর ইংরেজী অনুবাদ (Book of the Himyarites) ১৯২৪ সালে লণ্ডন থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এ বইটি মুসলিম ঐতিহাসিকদের বর্ণনার সত্যতা প্রমাণ করে। বৃটিশ মিউজিয়ামে সেই আমলের এবং তার নিকটবর্তী আমলের কিছু ইথিয়োপীয় শিলালিপি সংরক্ষিত রয়েছে। এগুলো থেকেও এই ঘটনার সমর্থন পাওয়া যায়। কিলবি তাঁর Arabian Highlands নামক সফরনামায় লিখেছেনঃ গর্তওয়ালাদের ঘটনা যেখানে সংঘটিত হয়েছিল সে জায়গাটি আজও নাজরানবাসীদের কাছে সুস্পষ্ট। ‘উম্মু খারাক’ ---এর কাছে এক জায়গায় পাথরের গায়ে খোদিত কিছু চিত্রও পাওয়া যায়। আর নাজরানের কাবা যেখানে প্রতিষ্ঠিত ছিল বর্তমান নাজরানবাসীরা সে জায়গাটিও জানে।

হাবশার ঈসায়ীরা নাজরান অধিকার করার পর সেখানে কাবার আকৃতিতে একটি ইমারত তৈরি করে। মক্কার কাবার মোকাবিলায় এই ঘরটিকে তারা কেন্দ্রীয় মর্যাদা দিতে চাচ্ছিল। এখানকার বিশপরা মাথায় পাগড়ী বাঁধতেন। এই ঘরকে তারা হারাম শরীফ গণ্য করেন। রোমান সম্রাটের পক্ষ থেকেও এই কাবাঘরের জন্য আর্থিক সাহায্য পাঠানো হতো। এই নাজরানের কাবার পাদরী তাঁর সাইয়েদ, আকেব ও উসকুফের নেতৃত্বে ‘মুনাযিয়া’ (বিতর্ক) করার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাযির হয়েছিলেন। সেখানে যে বিখ্যাত ‘মুবাহিলা’র ঘটনা অনুষ্ঠিত হয় সূরা আলে ইমরানের ৬১ আয়াতে তা উল্লেখিত হয়েছে। (দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আল ইমরান ২৯ ও ৫৫ টীকা)

৫.
এ আয়াতগুলোতে মহান আল্লাহর এমন সব গুণাবলীর উল্লেখ করা হয়েছে যেগুলোর মাধ্যমে তাঁর প্রতি ঈমান আনার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আবার অন্যদিকে এগুলোর প্রতি ঈমান আনার কারণে যারা অসন্তুষ্ট ও বিক্ষুব্ধ হয় তারা জালেম।
৬.
জাহান্নামের আযাব থেকে আবার আলাদাভাবে জ্বালা-পোড়ার শাস্তির উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে এই যে, তারা মজলুমদেরকে আগুনে ভরা গর্তে নিক্ষেপ করে জীবন্ত পুড়িয়েছিল। সম্ভবত এটা জাহান্নামের সাধারণ আগুন থেকে ভিন্ন ধরণের এবং তার চেয়ে বেশী তীব্র কোন আগুন হবে এ বিশেষ আগুনে তাদেরকে জ্বালানো হবে।
অনুবাদ: