আল ফাতিহা
৭ আয়াত
আল বাকারাহ
২৮৬ আয়াত
আলে ইমরান
২০০ আয়াত
আন্ নিসা
১৭৬ আয়াত
আল মায়েদাহ
১২০ আয়াত
আল আন'আম
১৬৫ আয়াত
আল আরাফ
২০৬ আয়াত
আল আনফাল
৭৫ আয়াত
আত তওবা
১২৯ আয়াত
১০
ইউনুস
১০৯ আয়াত
১১
হুদ
১২৩ আয়াত
১২
ইউসুফ
১১১ আয়াত
১৩
আর্ রাদ
৪৩ আয়াত
১৪
ইবরাহীম
৫২ আয়াত
১৫
আল হিজর
৯৯ আয়াত
১৬
আন্ নাহল
১২৮ আয়াত
১৭
বনী ইসরাঈল
১১১ আয়াত
১৮
আল কাহফ
১১০ আয়াত
১৯
মারয়াম
৯৮ আয়াত
২০
ত্বাহা
১৩৫ আয়াত
২১
আল আম্বিয়া
১১২ আয়াত
২২
আল হাজ্জ
৭৮ আয়াত
২৩
আল মুমিনূন
১১৮ আয়াত
২৪
আন্ নূর
৬৪ আয়াত
২৫
আল-ফুরকান
৭৭ আয়াত
২৬
আশ্-শু’আরা
২২৭ আয়াত
২৭
আন নামল
৯৩ আয়াত
২৮
আল কাসাস
৮৮ আয়াত
২৯
আল আনকাবূত
৬৯ আয়াত
৩০
আর রূম
৬০ আয়াত
৩১
লুকমান
৩৪ আয়াত
৩২
আস সাজদাহ
৩০ আয়াত
৩৩
আল আহযাব
৭৩ আয়াত
৩৪
আস সাবা
৫৪ আয়াত
৩৫
ফাতের
৪৫ আয়াত
৩৬
ইয়া-সীন
৮৩ আয়াত
৩৭
আস্ সা-ফফা-ত
১৮২ আয়াত
৩৮
সা-দ
৮৮ আয়াত
৩৯
আয যুমার
৭৫ আয়াত
৪০
আল মুমিন
৮৫ আয়াত
৪১
হা-মীম আস সাজদাহ
৫৪ আয়াত
৪২
আশ শূরা
৫৩ আয়াত
৪৩
আয্ যুখরুফ
৮৯ আয়াত
৪৪
আদ দুখান
৫৯ আয়াত
৪৫
আল জাসিয়াহ
৩৭ আয়াত
৪৬
আল আহক্বাফ
৩৫ আয়াত
৪৭
মুহাম্মদ
৩৮ আয়াত
৪৮
আল ফাতহ
২৯ আয়াত
৪৯
আল হুজুরাত
১৮ আয়াত
৫০
ক্বাফ
৪৫ আয়াত
৫১
আয যারিয়াত
৬০ আয়াত
৫২
আত তূর
৪৯ আয়াত
৫৩
আন নাজম
৬২ আয়াত
৫৪
আল ক্বামার
৫৫ আয়াত
৫৫
আর রহমান
৭৮ আয়াত
৫৬
আল ওয়াকি’আ
৯৬ আয়াত
৫৭
আল হাদীদ
২৯ আয়াত
৫৮
আল মুজাদালাহ
২২ আয়াত
৫৯
আল হাশর
২৪ আয়াত
৬০
আল মুমতাহিনা
১৩ আয়াত
৬১
আস সফ
১৪ আয়াত
৬২
আল জুমআ
১১ আয়াত
৬৩
আল মুনাফিকুন
১১ আয়াত
৬৪
আত তাগাবুন
১৮ আয়াত
৬৫
আত তালাক
১২ আয়াত
৬৬
আত তাহরীম
১২ আয়াত
৬৭
আল মুলক
৩০ আয়াত
৬৮
আল কলম
৫২ আয়াত
৬৯
আল হাককাহ
৫২ আয়াত
৭০
আল মাআরিজ
৪৪ আয়াত
৭১
নূহ
২৮ আয়াত
৭২
আল জিন
২৮ আয়াত
৭৩
আল মুযযাম্মিল
২০ আয়াত
৭৪
আল মুদ্দাস্সির
৫৬ আয়াত
৭৫
আল কিয়ামাহ
৪০ আয়াত
৭৬
আদ্ দাহর
৩১ আয়াত
৭৭
আল মুরসালাত
৫০ আয়াত
৭৮
আন নাবা
৪০ আয়াত
৭৯
আন নাযি’আত
৪৬ আয়াত
৮০
আবাসা
৪২ আয়াত
৮১
আত তাকবীর
২৯ আয়াত
৮২
আল ইনফিতার
১৯ আয়াত
৮৩
আল মুতাফফিফীন
৩৬ আয়াত
৮৪
আল ইনশিকাক
২৫ আয়াত
৮৫
আল বুরূজ
২২ আয়াত
৮৬
আত তারিক
১৭ আয়াত
৮৭
আল আ’লা
১৯ আয়াত
৮৮
আল গাশিয়াহ
২৬ আয়াত
৮৯
আল ফজর
৩০ আয়াত
৯০
আল বালাদ
২০ আয়াত
৯১
আশ শামস
১৫ আয়াত
৯২
আল লাইল
২১ আয়াত
৯৩
আদ দুহা
১১ আয়াত
৯৪
আলাম নাশরাহ
৮ আয়াত
৯৫
আত তীন
৮ আয়াত
৯৬
আল আলাক
১৯ আয়াত
৯৭
আল কাদ্‌র
৫ আয়াত
৯৮
আল বাইয়েনাহ
৮ আয়াত
৯৯
আল যিলযাল
৮ আয়াত
১০০
আল আদিয়াত
১১ আয়াত
১০১
আল কারি’আহ
১১ আয়াত
১০২
আত তাকাসুর
৮ আয়াত
১০৩
আল আসর
৩ আয়াত
১০৪
আল হুমাযা
৯ আয়াত
১০৫
আল ফীল
৫ আয়াত
১০৬
কুরাইশ
৪ আয়াত
১০৭
আল মাউন
৭ আয়াত
১০৮
আল কাউসার
৩ আয়াত
১০৯
আল কাফিরূন
৬ আয়াত
১১০
আন নসর
৩ আয়াত
১১১
আল লাহাব
৫ আয়াত
১১২
আল ইখলাস
৪ আয়াত
১১৩
আল ফালাক
৫ আয়াত
১১৪
আন নাস
৬ আয়াত

আল আনফাল

৭৫ আয়াত

আয়াত
-
১ ) লোকেরা তোমার কাছে গনীমতের মাল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে? বলে দাও, “এ গনীমতের মাল তো আল্লাহ‌ ও তাঁর রাসূলের। কাজেই তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, নিজেদের পারস্পরিক সম্পর্ক শুধরে নাও এবং আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করো, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাকো।”
يَسْـَٔلُونَكَ عَنِ ٱلْأَنفَالِ ۖ قُلِ ٱلْأَنفَالُ لِلَّهِ وَٱلرَّسُولِ ۖ فَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ وَأَصْلِحُوا۟ ذَاتَ بَيْنِكُمْ ۖ وَأَطِيعُوا۟ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ ١
২ ) সাচ্চা ঈমানদার তো তারাই, আল্লাহকে স্মরণ করা হলে যাদের হৃদয় কেঁপে ওঠে। আর আল্লাহর আয়াত যখন তাদের সামনে পড়া হয়, তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা নিজেদের রবের ওপর ভরসা করে।
إِنَّمَا ٱلْمُؤْمِنُونَ ٱلَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ ٱللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ ءَايَـٰتُهُۥ زَادَتْهُمْ إِيمَـٰنًۭا وَعَلَىٰ رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ ٢
৩ ) তারা নামায কায়েম করে এবং যা কিছু আমি তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে (আমার পথে) খরচ করে।
ٱلَّذِينَ يُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ وَمِمَّا رَزَقْنَـٰهُمْ يُنفِقُونَ ٣
৪ ) এ ধরনের লোকেরাই প্রকৃত মুমিন। তাদের জন্য তাদের রবের কাছে রয়েছে বিরাট মর্যাদা, ভুলত্রুটির ক্ষমা ও উত্তম রিযিক।
أُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْمُؤْمِنُونَ حَقًّۭا ۚ لَّهُمْ دَرَجَـٰتٌ عِندَ رَبِّهِمْ وَمَغْفِرَةٌۭ وَرِزْقٌۭ كَرِيمٌۭ ٤
৫ ) (এই গনীমতের মালের ব্যাপারে ঠিক তেমনি অবস্থা দেখা দিচ্ছে যেমন অবস্থা সে সময় দেখা দিয়েছিল যখন) তোমার রব তোমাকে সত্য সহকারে ঘর থেকে বের করে এনেছিলেন এবং মুমিনদের একটি দলের কাছে এটা ছিল বড়ই অসহনীয়।
كَمَآ أَخْرَجَكَ رَبُّكَ مِنۢ بَيْتِكَ بِٱلْحَقِّ وَإِنَّ فَرِيقًۭا مِّنَ ٱلْمُؤْمِنِينَ لَكَـٰرِهُونَ ٥
৬ ) তারা এ সত্যের ব্যাপারে তোমার সাথে ঝগড়া করছিল অথচ তা একেবারে পরিষ্কার হয়ে ভেসে উঠেছিল। তাদের অবস্থা এমন ছিল, যেন তারা দেখছিল তাদেরকে মৃত্যুর দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
يُجَـٰدِلُونَكَ فِى ٱلْحَقِّ بَعْدَ مَا تَبَيَّنَ كَأَنَّمَا يُسَاقُونَ إِلَى ٱلْمَوْتِ وَهُمْ يَنظُرُونَ ٦
৭ ) স্মরণ করো সেই সময়ের কথা যখন আল্লাহ‌ তোমাদের সাথে ওয়াদা করেছিলেন, দু’টি দলের মধ্য থেকে একটি তোমরা পেয়ে যাবে। তোমরা চাচ্ছিলে, তোমরা দুর্বল দলটি লাভ করবে। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল, নিজের বাণীসমূহের সাহায্যে তিনি সত্যকে সত্যরূপে প্রকাশিত করে দেখিয়ে দেবেন এবং কাফেরদের শিকড় কেটে দেবেন,
وَإِذْ يَعِدُكُمُ ٱللَّهُ إِحْدَى ٱلطَّآئِفَتَيْنِ أَنَّهَا لَكُمْ وَتَوَدُّونَ أَنَّ غَيْرَ ذَاتِ ٱلشَّوْكَةِ تَكُونُ لَكُمْ وَيُرِيدُ ٱللَّهُ أَن يُحِقَّ ٱلْحَقَّ بِكَلِمَـٰتِهِۦ وَيَقْطَعَ دَابِرَ ٱلْكَـٰفِرِينَ ٧
৮ ) যাতে সত্য সত্য রূপে এবং বাতিল বাতিল হিসেবে প্রমাণিত হয়ে যায়, অপরাধিদের কাছে তা যতই অসহনীয় হোক না কেন।
لِيُحِقَّ ٱلْحَقَّ وَيُبْطِلَ ٱلْبَـٰطِلَ وَلَوْ كَرِهَ ٱلْمُجْرِمُونَ ٨
৯ ) আর সেই সময়ের কথাও স্মরণ করো, যখন তোমরা তোমাদের রবের কাছে ফরিয়াদ করছিলে। জবাবে তিনি বললেন, তোমাদের সাহায্য করার জন্য আমি একের পর এক, এক হাজার ফেরেশতা পাঠাচ্ছি।
إِذْ تَسْتَغِيثُونَ رَبَّكُمْ فَٱسْتَجَابَ لَكُمْ أَنِّى مُمِدُّكُم بِأَلْفٍۢ مِّنَ ٱلْمَلَـٰٓئِكَةِ مُرْدِفِينَ ٩
১০ ) একথা আল্লাহ‌ তোমাদের শুধুমাত্র এ জন্য জানিয়ে দিলেন যাতে তোমরা সুখবর পাও এবং তোমাদের হৃদয় নিশ্চিন্ততা অনুভব করে। নয়তো সাহায্য যখনই আসে আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে। অবশ্যই আল্লাহ‌ মহাপরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী।
وَمَا جَعَلَهُ ٱللَّهُ إِلَّا بُشْرَىٰ وَلِتَطْمَئِنَّ بِهِۦ قُلُوبُكُمْ ۚ وَمَا ٱلنَّصْرُ إِلَّا مِنْ عِندِ ٱللَّهِ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ ١٠
১.
এক অদ্ভূত ধরনের ভূমিকা দিয়ে যুদ্ধের ঘটনাবলীর পর্যালোচনা শুরু করা হয়েছে। বদরের ময়দানে কুরাইশ সেনাদলের কাছ থেকে যে, গনীমতের মাল লাভ করা হয়েছিল, তা বণ্টন করার ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে বিবাদ দেখা দিয়েছিল। যেহেতু ইসলাম গ্রহণ করার পর এই প্রথমবার তারা ইসলামের পতাকাতলে লড়াই করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাই এ প্রসঙ্গে যুদ্ধ ও যুদ্ধজনিত বিষয়াদিতে ইসলামের বিধান কি তা তাদের জানা ছিল না। সূরা বাকারাহ ও সূরা মুহাম্মাদে কিছু প্রাথমিক নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তখনো কোন সামরিক কৃষ্টি, সভ্যতা ও রীতিনীতির ভিত্তি পত্তন করা হয়নি। আরো বহু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ের ন্যায় মুসলমানরা তখনো পর্যন্ত যুদ্ধের ব্যাপারেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরাতন জাহেলিয়াতের ধারণাই পোষণ করতো। এ কারণে বদরের যুদ্ধে কাফেরদের পরাজয়ের পর যে ব্যক্তি যে পরিমাণ গনীমতের মাল হস্তগত করেছিল, আরবের পুরাতন রীতি অনুযায়ী সে নিজেকে তার মালিক ভেবে নিয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় একটি দল গনীমতের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে কাফেরদের পিছনে ধাওয়া করেছিল। তারা এ সম্পদে নিজেদের সমান সমান অংশ দাবী করলো। কারণ তারা বললো, আমরা যদি শত্রুর পেছনে ধাওয়া করে তাদেরকে দূরে ভাগিয়ে দিয়ে না আসতাম এবং তোমাদের মত গনীমতের মাল আহরণ করতে লেগে যেতাম, তাহলে শত্রুদের ফিরে এসে পাল্টা হামলা চালিয়ে আমাদের বিজয়কে পরাজয়ে রূপান্তরিত করে দেবারও সম্ভাবনা ছিল। তৃতীয় একটি দল রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হেফাজতে নিয়োজিত ছিল। তারাও নিজেদের দাবী পেশ করলো। তারা বললো, এ যুদ্ধে আমরাই তো সবচেয়ে বেশী মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছি। আমরা যদি রসূল ﷺ এর চারদিকে মজবুত প্রাচীর গড়ে না তুলতাম এবং আল্লাহ‌ না করুণ! তাঁর ওপর যদি কোন আঘাত আসতো, তাহলে বিজয় লাভ করারই কোন প্রশ্ন উঠতো না। ফলে কোন গনীমতের মালও লাভ করা যেতো না এবং বণ্টন করারও সমস্যা দেখা দিত না। কিন্তু গনীমতের মাল কার্যত যাদের হাতে ছিল তাদের মালিকানার জন্য যেন কোন প্রমাণের প্রয়োজন ছিল না। একটি জ্বলজ্যান্ত সত্য যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে যাবে, যুক্তি প্রমাণের এ অধিকার মানতে তারা প্রস্তুত ছিল না। এভাবে অবশেষে এ বিবাদ তিক্ততার রূপ ধারণ করলো এবং কথাবার্তার তিক্ততা এক পর্যায়ে মনেও ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।

মহান আল্লাহ‌ সূরা আনফাল নাযিল করার জন্য এ মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশ বেছে নিয়েছেন। এ বিষয় দিয়ে যুদ্ধ সংক্রান্ত নিজের পর্যালোচনামূলক বক্তব্যের সূচনা করেছেন। প্রথম বাক্যটির মধ্যেই প্রশ্নের জবাব নিহিত ছিল। বলেছেনঃ “তোমার কাছে গনীমতের মাল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে?” মূল বক্তব্যে গনীমতের মালকে ‘আনফাল’ বলা হয়েছে। এ ‘আনফাল’ শব্দের মধ্যে মূল সমস্যার সমাধান নিহিত রয়ে গেছে। আনফাল বহুবচন। এর একবচন হচ্ছে “নাফল”। আরবী ভাষায় ওয়াজিব অথবা যথার্থ অধিকার ও মূল পাওনার অতিরিক্তকে নফল বলা হয়। এ ধরনের নফল যদি কোন অধীনের পক্ষ থেকে হয় তাহলে তার অর্থ হয়, গোলাম নিজের প্রভুর জন্য স্বেচ্ছাকৃতভাবে অবশ্য পালনীয় কর্তব্যের চাইতে বাড়তি কিছু কাজ করেছে। আর যখন তা মালিক বা কর্তার পক্ষ থেকে হয় তখন তার অর্থ হয়, এমন ধরনের দান বা পুরস্কার যা প্রভুর পক্ষ থেকে বান্দা বা গোলামকে তার যথার্থ পাওনা ও অধিকারের অতিরিক্ত বা বখশিস হিসেবে দেয়া হয়েছে। কাজেই এখানে এ বক্তব্যের অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর দেয়া পুরস্কার ও অনুগ্রহ সম্পর্কেই কি এ সমস্ত বাদানুবাদ, জিজ্ঞাসাবাদ ও কলহ-বিতর্ক চলেছে? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে তোমরা কবেই বা তার মালিক ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলে যে, তোমরা নিজেরাই তা বণ্টন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে? যিনি এ সম্পদ দান করেছেন তিনিই সিদ্ধান্ত দেবেন, কাকে দেয়া হবে, কাকে দেয়া হবে না এবং যাকে দেয়া হবে কতটুকু দেয়া হবে?

যুদ্ধ প্রসঙ্গে এটা ছিল একটা অনেক বড় ধরনের নৈতিক সংস্কার। মুসলমানদের যুদ্ধ দুনিয়ার বস্তুগত স্বার্থ ও সম্পদ লাভ করার জন্য নয় বরং সত্যের নীতি অনুযায়ী দুনিয়ার নৈতিক ও তামাদ্দুনিক বিকৃতির সংস্কার সাধন করার জন্যই তা হয়ে থাকে। আর এ যুদ্ধনীতি বাধ্য হয়ে তখনই অবলম্বন করা হয়, যখন প্রতিবন্ধক শক্তিগুলো স্বাভাবিক দাওয়াত ও প্রচার পদ্ধতির মাধ্যমে সংস্কার সাধনের সমস্ত পথ রুদ্ধ করে দেয়। কাজেই সংস্কারদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকতে হবে উদ্দেশ্যের প্রতি। উদ্দেশ্যের জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার হিসেবে যেসব সম্পদ লাভ করা হয়, সেদিকে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকা উচিত নয়। শুরুতেই যদি এসব স্বার্থ থেকে তাদের দৃষ্টি সরিয়ে না দেয়া হয়, তাহলে অতি দ্রুত তাদের মধ্যে নৈতিক অধঃপতন সূচিত হবে এবং তারা এসব স্বার্থলাভকে নিজেদের উদ্দেশ্য হিসেবে গণ্য করবে।

তাছাড়া এটা যুদ্ধ প্রসঙ্গে একটা বড় রকমের প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সংস্কারও ছিল। প্রাচীন যুগের পদ্ধতি ছিল, যুদ্ধে যে মালমাত্তা যার হস্তগত হতো সে-ই তার মালিক গণ্য হতো। অথবা বাদশাহ ও সেনাপতি সমস্ত গনীমতের মালের মালিক হয়ে বসতো। প্রথম অবস্থায় দেখা যেতো, প্রায়ই বিজয়ী সেনাদলের মধ্যে গনীমতের মাল নিয়ে প্রচণ্ড সংঘাত দেখা দিয়েছে। এমনকি অনেক সময় তাদের এ অভ্যন্তরীণ সংঘাত তাদের বিজয়কে পরাজয়ে রূপান্তরিত করে দিতো। দ্বিতীয় অবস্থায় সৈন্যরা চুরি করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়তো। তারা গনীমতের মাল লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করতো। কুরআন গনীমতের মালকে আল্লাহ‌ ও রসূলের সম্পদ গণ্য করে প্রথমে এ নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে যে, সমস্ত গনীমতের মাল কোন রকম কমবেশী না করে পুরোপুরি ইমামের সামনে এনে রেখে দিতে হবে। তার মধ্য থেকে একটি সুঁইও লুকিয়ে রাখা যাবে না। তারপর সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে এ সম্পদ বন্টনের জন্য নিম্নোক্ত আইন প্রণয়ন করেছেঃ এ সম্পদের পাঁচ ভাগের এক ভাগ আল্লাহর কাজ ও তাঁর গরীব বান্দাদের সাহায্যের জন্য বায়তুল মালে জমা দিতে হবে। আর বাকি চার ভাগ যুদ্ধে যে সেনাদল শরীক হয়েছিল তাদের মধ্যে সমানভাগে ভাগ করে দিতে হবে। এভাবে জাহেলী যুগের পদ্ধতিতে যে দু’টি ত্রুটি ছিল তা দূর হয়ে গেছে।

এখানে আরো একটি সূক্ষ্ম তত্ত্বও জেনে রাখতে হবে। গনীমতেরমাল সম্পর্কে এখানে শুধুমাত্র এতটুকু কথা বলেই শেষ করে দেয়া হয়েছে যে, “এটা আল্লাহ‌ ও তাঁর রাসূলের।” এ সম্পদ বন্টনের কোন প্রসঙ্গ এখানে উত্থাপন করা হয়নি। এর কারণ, প্রথমে স্বীকৃতি ও আনুগত্যের ভাবধারার পূর্ণতা লাভই ছিল উদ্দেশ্য। তারপর সামনের দিকে গিয়ে কয়েক রুকূ' পরে এ সম্পদ কিভাবে বণ্টন করতে হবে তা বলে দেয়া হয়েছে। তাই এখানে একে ‘আনফাল’ বলা হয়েছে এবং পঞ্চম রুকু'তে এ সম্পদ বণ্টন করার বিধান বর্ণনা প্রসঙ্গে একে ‘গানায়েম’ (গনীমতের বহুবচন) বলা হয়েছে।

২.
অর্থাৎ যখনই মানুষের সামনে আল্লাহর কোন হুকুম আসে এবং সে তার সত্যতা মেনে নিয়ে আনুগত্যের শির নত করে দেয়, তখনই তার ঈমান বেড়ে যায়। এ ধরনের প্রত্যেকটি অবস্থায় এমনটিই হয়ে থাকে। যখনই আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রসূলের হেদায়াতের মধ্যে মানুষ এমন কোন জিনিস দেখে, যা তার ইচ্ছা, আশা-আকাংখা, চিন্তা-ভাবনা মতবাদ, পরিচিত আচার-আচরণ, স্বার্থ, আরাম-আয়েশ, ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব বিরোধী হয় এবং সে তা মেনে নিয়ে আল্লাহ‌ ও রসূলের বিধান পরিবর্তন করার পরিবর্তে নিজেকে পরিবর্তিত করে ফেলে এবং তা গ্রহণ করতে গিয়ে কষ্ট স্বীকার করে নেয়, তখন মানুষের ঈমান তরতাজা ও পরিপুষ্ট হয়। পক্ষান্তরে, এমনটি করতে অস্বীকৃতি জানালে মানুষের ঈমানের প্রাণ শক্তি নিস্তেজ হয়ে যেতে থাকে। কাজেই জানা গেলো, ঈমান কোন অনড়, নিশ্চল ও স্থির জিনিসের নাম নয়। এটা শুধুমাত্র একবার মানা ও না মানার ব্যাপার নয়। একবার না মানলে শুধুমাত্র একবারই না মানা হলো এবং একবার মেনে নিলে কেবলমাত্র একবারই মেনে নেয়া হলো এমন নয়। বরং মানা ও না মানা উভয়ের মধ্যে হ্রাস-বৃদ্ধি রয়েছে। প্রত্যেকটি অস্বীকৃতির মাত্রা কমতেও পারে, বাড়তেও পারে। আবার এমনিভাবে প্রত্যেকটি স্বীকৃতি ও মেনে নেয়ার মাত্রাও বাড়তে কমতে পারে। তবে ফিকাহর বিধানের দিক দিয়ে তামাদ্দুনিক ব্যবস্থায় অধিকার ও মর্যাদা নির্দিষ্ট করার সময় মানা ও না মানার ব্যাপাটির একবারই গণ্য করা হয়। ইসলামী সমাজে সকল স্বীকৃতি দানকারীর (মু’মিন) আইনগত অধিকার ও মর্যাদা সমান। তাদের মধ্যে মানার (ঈমান) ব্যাপারে বহুতর পার্থক্য থাকতে পারে। তাতে কিছু আসে যায় না। আবার সকল অস্বীকৃতিদানকারী একই পর্যায়ের যিম্মী বা হরবী (যুদ্ধমান) অথবা চুক্তিবদ্ধ ও আশ্রিত গণ্য হয়, তাদের মধ্যে কুফরীর ব্যাপারে যতই পার্থক্য থাক না কেন।
৩.
বড় বড় ও উন্নত পর্যায়ের ঈমানদাররাও ভুল করতে পারে এবং তাদের ভুল হয়েছেও। যতদিন মানুষ মানুষ হিসেবে দুনিয়ার বুকে বেঁচে আছে, ততদিন তার আমলনামা শুধুমাত্র উৎকৃষ্ট মানের কার্যকলাপে ভর্তি থাকবে এবং দোষ-ত্রুটি ও ভুল-ভ্রান্তি থেকে পুরোপুরি মুক্ত থাকবে এমনটি হতে পারে না। কিন্তু মহান আল্লাহর একটি বড় রহমত হচ্ছে এই যে, যতদিন মানুষ বন্দেগীর অনিবার্য শর্তসমূহ পূর্ণ করে, ততদিন আল্লাহ‌ তার ভুল-ত্রুটি উপেক্ষা করতে থাকেন এবং তার কার্যাবলী যে ধরনের প্রতিদান লাভের যোগ্যতা সম্পন্ন হয়, নিজ অনুগ্রহে তার চেয়ে কিছু বেশী প্রতিদান তাকে দান করেন। নয়তো যদি প্রত্যেকটি ভুলের শাস্তি ও প্রত্যেকটি ভাল কাজের পুরস্কার আলাদাভাবে দেবার নিয়ম করা হতো, তাহলে কোন অতি বড় সৎলোকও শাস্তির হাত থেকে রেহাই পেতো না।
৪.
অর্থাৎ তারা সে সময় বিপদের মোকাবিলা করতে ভয় পাচ্ছিল, অথচ বিপদের মুখে এগিয়ে যাওয়াই তখন ছিল সত্যের দাবী। ঠিক তেমনি গনীমতের মাল হাতছাড়া করতে আজ তাদের কষ্ট হচ্ছে, অথচ তা পরিহার করে হুকুমের প্রতীক্ষা করাই আজ সত্যের দাবী। এর দ্বিতীয় অর্থ এ হতে পারে, যদি আল্লাহর আনুগত্য করো এবং নিজের নফসের খাহেশের পরিবর্তে রসূলের কথা মেনে নাও, তাহলে ঠিক তেমনি ভাল ফল দেখতে পারে, যেমন এখনি বদর যুদ্ধের সময় দেখেছো। কুরাইশদের সেনাদলের বিরুদ্ধে লড়াই করতে যাওয়া তোমাদের কাছে বড়ই দুঃসহনীয় মনে হয়েছিল এবং তাকে তোমরা ধ্বংসের বার্তাবহ মনে করেছিলে। কিন্তু যখন তোমরা আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ পালন করলে তখন এ বিপজ্জনক কাজটিই তোমাদের জন্য জীবনের সাফল্যের বার্তা বহন করে আনলো।

সাধারণভাবে সীরাত ও যুদ্ধের বর্ণনা সংক্রান্ত ইতিহাস গ্রন্থসমূহে বদর যুদ্ধ প্রসঙ্গে যেসব বর্ণনা এসেছে, কুরআনের এ বক্তব্য পরোক্ষভাবে তার প্রতিবাদ করেছে। অর্থাৎ এসব গ্রন্থে বলা হয়েছে নবী ﷺ মু’মিনদের নিয়ে প্রথমে কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলা লুট করার উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে রওয়ানা হয়েছিলেন। তারপর কয়েক মনযিল পথ অতিক্রম করার পর যখন জানা গেলো মক্কা থেকে কুরাইশদের সেনাবাহিনী কাফেলার হেফাজত করার জন্য এগিয়ে আসছে তখন পরামর্শ করা হলো, কাফেলার ওপর আক্রমণ করা হবে না সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করা হবে? কিন্তু কুরআন এর সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলছে। কুরআন বলছে, নবী ﷺ যখন ঘর থেকে বের হয়েছিলেন, তখনই কুরাইশ সেনাদলের সাথে চূড়ান্ত যুদ্ধ করার বিষয়টি তাঁর সামনে ছিল। আর কাফেলা ও সেনাদল কোনটিকে আক্রমণ করা হবে, এ পরামর্শও তখনি করা হয়েছিল। সেনাদলের মোকাবিলা করা অপরিহার্য, এ সত্যটি মু’মিনদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে গেলেও তাদের মধ্য থেকে একদল লোক যুদ্ধের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য বিতর্ক করে চলছিল। তারপর সবশেষে যখন সেনাদলের দিকে অগ্রসর হবার বিষয়টি চূড়ান্তভাবে স্থিরীকৃত হয়ে গেলো তখন, এ দলটি মদীনা থেকে একথা মনে করেই বের হলো যে, তাদেরকে সোজা মৃত্যুর দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

৫.
অর্থাৎ বাণিজ্য কাফেলা বা কুরাইশ সেনাদল।
৬ .
অর্থাৎ বাণিজ্য কাফেলা। তাদের সাথে মাত্র তিরিশ চল্লিশ জন রক্ষী ছিল।
৭.
এ থেকে অনুমান করা যায়, সে সময় কোন ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। এ সূরার ভূমিকায় আমি উল্লেখ করেছি, কুরাইশ সেনাদল অগ্রসর হবার পর মূলত প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল, ইসলামী দাওয়াত ও জাহেলী ব্যবস্থা এ দুয়ের মধ্যে আরব ভূখণ্ডে কার বেঁচে থাকার অধিকার আছে? যদি মুসলমানরা সে সময় সাহসের সাথে মোকাবিলা করতে এগিয়ে না আসতো, তাহলে এরপর ইসলামের জন্য আর বেঁচে থাকার কোন সুযোগ থাকতো না। পক্ষান্তরে, মুসলমানদের ঘর থেকে বের হয়ে পড়ার এবং প্রথম পদক্ষেপেই কুরাইশ শক্তির ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানার কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল, যার ফলে ইসলাম মজবুতভাবে পা রাখার জায়গা পেয়ে গিয়েছিল এবং এর পরের সমস্ত মোকাবিলায় জাহেলিয়াত একের পর এক পরাজয়বরণ করেছিল।
অনুবাদ: