মহান আল্লাহ সূরা আনফাল নাযিল করার জন্য এ মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশ বেছে নিয়েছেন। এ বিষয় দিয়ে যুদ্ধ সংক্রান্ত নিজের পর্যালোচনামূলক বক্তব্যের সূচনা করেছেন। প্রথম বাক্যটির মধ্যেই প্রশ্নের জবাব নিহিত ছিল। বলেছেনঃ “তোমার কাছে গনীমতের মাল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে?” মূল বক্তব্যে গনীমতের মালকে ‘আনফাল’ বলা হয়েছে। এ ‘আনফাল’ শব্দের মধ্যে মূল সমস্যার সমাধান নিহিত রয়ে গেছে। আনফাল বহুবচন। এর একবচন হচ্ছে “নাফল”। আরবী ভাষায় ওয়াজিব অথবা যথার্থ অধিকার ও মূল পাওনার অতিরিক্তকে নফল বলা হয়। এ ধরনের নফল যদি কোন অধীনের পক্ষ থেকে হয় তাহলে তার অর্থ হয়, গোলাম নিজের প্রভুর জন্য স্বেচ্ছাকৃতভাবে অবশ্য পালনীয় কর্তব্যের চাইতে বাড়তি কিছু কাজ করেছে। আর যখন তা মালিক বা কর্তার পক্ষ থেকে হয় তখন তার অর্থ হয়, এমন ধরনের দান বা পুরস্কার যা প্রভুর পক্ষ থেকে বান্দা বা গোলামকে তার যথার্থ পাওনা ও অধিকারের অতিরিক্ত বা বখশিস হিসেবে দেয়া হয়েছে। কাজেই এখানে এ বক্তব্যের অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর দেয়া পুরস্কার ও অনুগ্রহ সম্পর্কেই কি এ সমস্ত বাদানুবাদ, জিজ্ঞাসাবাদ ও কলহ-বিতর্ক চলেছে? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে তোমরা কবেই বা তার মালিক ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলে যে, তোমরা নিজেরাই তা বণ্টন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে? যিনি এ সম্পদ দান করেছেন তিনিই সিদ্ধান্ত দেবেন, কাকে দেয়া হবে, কাকে দেয়া হবে না এবং যাকে দেয়া হবে কতটুকু দেয়া হবে?
যুদ্ধ প্রসঙ্গে এটা ছিল একটা অনেক বড় ধরনের নৈতিক সংস্কার। মুসলমানদের যুদ্ধ দুনিয়ার বস্তুগত স্বার্থ ও সম্পদ লাভ করার জন্য নয় বরং সত্যের নীতি অনুযায়ী দুনিয়ার নৈতিক ও তামাদ্দুনিক বিকৃতির সংস্কার সাধন করার জন্যই তা হয়ে থাকে। আর এ যুদ্ধনীতি বাধ্য হয়ে তখনই অবলম্বন করা হয়, যখন প্রতিবন্ধক শক্তিগুলো স্বাভাবিক দাওয়াত ও প্রচার পদ্ধতির মাধ্যমে সংস্কার সাধনের সমস্ত পথ রুদ্ধ করে দেয়। কাজেই সংস্কারদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকতে হবে উদ্দেশ্যের প্রতি। উদ্দেশ্যের জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার হিসেবে যেসব সম্পদ লাভ করা হয়, সেদিকে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকা উচিত নয়। শুরুতেই যদি এসব স্বার্থ থেকে তাদের দৃষ্টি সরিয়ে না দেয়া হয়, তাহলে অতি দ্রুত তাদের মধ্যে নৈতিক অধঃপতন সূচিত হবে এবং তারা এসব স্বার্থলাভকে নিজেদের উদ্দেশ্য হিসেবে গণ্য করবে।
তাছাড়া এটা যুদ্ধ প্রসঙ্গে একটা বড় রকমের প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সংস্কারও ছিল। প্রাচীন যুগের পদ্ধতি ছিল, যুদ্ধে যে মালমাত্তা যার হস্তগত হতো সে-ই তার মালিক গণ্য হতো। অথবা বাদশাহ ও সেনাপতি সমস্ত গনীমতের মালের মালিক হয়ে বসতো। প্রথম অবস্থায় দেখা যেতো, প্রায়ই বিজয়ী সেনাদলের মধ্যে গনীমতের মাল নিয়ে প্রচণ্ড সংঘাত দেখা দিয়েছে। এমনকি অনেক সময় তাদের এ অভ্যন্তরীণ সংঘাত তাদের বিজয়কে পরাজয়ে রূপান্তরিত করে দিতো। দ্বিতীয় অবস্থায় সৈন্যরা চুরি করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়তো। তারা গনীমতের মাল লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করতো। কুরআন গনীমতের মালকে আল্লাহ ও রসূলের সম্পদ গণ্য করে প্রথমে এ নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে যে, সমস্ত গনীমতের মাল কোন রকম কমবেশী না করে পুরোপুরি ইমামের সামনে এনে রেখে দিতে হবে। তার মধ্য থেকে একটি সুঁইও লুকিয়ে রাখা যাবে না। তারপর সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে এ সম্পদ বন্টনের জন্য নিম্নোক্ত আইন প্রণয়ন করেছেঃ এ সম্পদের পাঁচ ভাগের এক ভাগ আল্লাহর কাজ ও তাঁর গরীব বান্দাদের সাহায্যের জন্য বায়তুল মালে জমা দিতে হবে। আর বাকি চার ভাগ যুদ্ধে যে সেনাদল শরীক হয়েছিল তাদের মধ্যে সমানভাগে ভাগ করে দিতে হবে। এভাবে জাহেলী যুগের পদ্ধতিতে যে দু’টি ত্রুটি ছিল তা দূর হয়ে গেছে।
এখানে আরো একটি সূক্ষ্ম তত্ত্বও জেনে রাখতে হবে। গনীমতেরমাল সম্পর্কে এখানে শুধুমাত্র এতটুকু কথা বলেই শেষ করে দেয়া হয়েছে যে, “এটা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের।” এ সম্পদ বন্টনের কোন প্রসঙ্গ এখানে উত্থাপন করা হয়নি। এর কারণ, প্রথমে স্বীকৃতি ও আনুগত্যের ভাবধারার পূর্ণতা লাভই ছিল উদ্দেশ্য। তারপর সামনের দিকে গিয়ে কয়েক রুকূ' পরে এ সম্পদ কিভাবে বণ্টন করতে হবে তা বলে দেয়া হয়েছে। তাই এখানে একে ‘আনফাল’ বলা হয়েছে এবং পঞ্চম রুকু'তে এ সম্পদ বণ্টন করার বিধান বর্ণনা প্রসঙ্গে একে ‘গানায়েম’ (গনীমতের বহুবচন) বলা হয়েছে।
সাধারণভাবে সীরাত ও যুদ্ধের বর্ণনা সংক্রান্ত ইতিহাস গ্রন্থসমূহে বদর যুদ্ধ প্রসঙ্গে যেসব বর্ণনা এসেছে, কুরআনের এ বক্তব্য পরোক্ষভাবে তার প্রতিবাদ করেছে। অর্থাৎ এসব গ্রন্থে বলা হয়েছে নবী ﷺ মু’মিনদের নিয়ে প্রথমে কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলা লুট করার উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে রওয়ানা হয়েছিলেন। তারপর কয়েক মনযিল পথ অতিক্রম করার পর যখন জানা গেলো মক্কা থেকে কুরাইশদের সেনাবাহিনী কাফেলার হেফাজত করার জন্য এগিয়ে আসছে তখন পরামর্শ করা হলো, কাফেলার ওপর আক্রমণ করা হবে না সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করা হবে? কিন্তু কুরআন এর সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলছে। কুরআন বলছে, নবী ﷺ যখন ঘর থেকে বের হয়েছিলেন, তখনই কুরাইশ সেনাদলের সাথে চূড়ান্ত যুদ্ধ করার বিষয়টি তাঁর সামনে ছিল। আর কাফেলা ও সেনাদল কোনটিকে আক্রমণ করা হবে, এ পরামর্শও তখনি করা হয়েছিল। সেনাদলের মোকাবিলা করা অপরিহার্য, এ সত্যটি মু’মিনদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে গেলেও তাদের মধ্য থেকে একদল লোক যুদ্ধের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য বিতর্ক করে চলছিল। তারপর সবশেষে যখন সেনাদলের দিকে অগ্রসর হবার বিষয়টি চূড়ান্তভাবে স্থিরীকৃত হয়ে গেলো তখন, এ দলটি মদীনা থেকে একথা মনে করেই বের হলো যে, তাদেরকে সোজা মৃত্যুর দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।