একঃ মহা অনুগ্রহকারী ও সর্বজ্ঞ। কারণ, তিনি নিজের বান্দাকে ফুরকানের মহান নিয়ামত দান করে সারা দুনিয়াকে জানিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছেন।
দুইঃ বড়ই মর্যাদাশালী ও সম্মানীয়। কারণ, পৃথিবী ও আকাশে তাঁরই রাজত্ব চলছে।
তিনঃ বড়ই পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন। কারণ, তাঁর সত্তা সকল প্রকার শিরকের গন্ধমুক্ত। তাঁর সমজাতীয় কেউ নেই। ফলে আল্লাহর সত্তার সার্বভৌমত্বে তাঁর কোন নজির ও সমকক্ষ নেই। তাঁর কোন ধ্বংস ও পরিবর্তন নেই। কাজেই তাঁর স্থলাভিষিক্তের জন্য কোন পুত্রের প্রয়োজন নেই।
চারঃ বড়ই উন্নত ও শ্রেষ্ঠ। কারণ, সমগ্র রাজত্ব তাঁরই কতৃর্ত্বাধীন। তাঁর ক্ষমতায় অংশীদার হবার যোগ্যতা ও মর্যাদা কারো নেই।
পাঁচঃ শক্তির পূর্ণতার দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ। কারণ, তিনি বিশ্ব-জাহানের প্রত্যেকটি জিনিস সৃষ্টিকারী ও তার ক্ষমতা নির্ধারণকারী। (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আল মু'মিনূন ১৪ ও আল ফুরকান ১৯ নং টীকা।)
এ বিষয়বস্তুটিকে আরো সুস্পষ্টভাবে নবী ﷺ হাদীসে বার বার বর্ণনা করেছেনঃ بعثت الى الاحمر والاسود “আমাকে সাদা-কালো সবার কাছে পাঠানো হয়েছে।” كَانَ النَّبِىُّ يُبْعَثُ إِلَى قَوْمِهِ خَاصَّةً ، وَبُعِثْتُ إِلَى النَّاسِ عَامَّةً “প্রথমে একজন নবীকে বিশেষ করে তাঁর নিজেরই জাতির কাছে পাঠানো হতো এবং আমাকে সাধারণভাবে সমগ্র মানবজাতির কাছে পাঠানো হয়েছে।” (বুখারী ও মুসলিম) وَأُرْسِلْتُ إِلَى الْخَلْقِ كَافَّةً، وَخُتِمَ بِيَ النَّبِيُّونَ “আমাকে সমস্ত সৃষ্টির কাছে পাঠানো হয়েছে এবং আমার আগমনে নবীদের ধারাবাহিক আগমন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।” (মুসলিম)
তাওহীদের সমগ্র শিক্ষা এ একটি আয়াতের মধ্যেই ভরে দেয়া হয়েছে। এটি কুরআন মজীদের সর্বাত্মক তাৎপর্যবহ আয়াতগুলোর মধ্যে একটি মহান মর্যাদাপূর্ণ আয়াত। এর মাত্র কয়েকটি শব্দের মধ্যে এত বিশাল বিষয়বস্তু ভরে দেয়া হয়েছে যে, এর ব্যাপ্তি পরিবেষ্টন করার জন্য পুরোপুরি একটি কিতাব যথেষ্ট বিবেচিত হতে পারে না। হাদীসে বলা হয়েছেঃ كان النبى صلى الله عليه وسلم اذا افصح الغلام من بنى عبد المطلب علمه هذه الاية – “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিয়ম ছিল, তাঁর বংশের কোন শিশু যখন কথা বলা শুরু করতো তখন তিনি তাকে এ আয়াতটি শিখিয়ে দিতেন।” (মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক ও মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবাহ। আমর ইবনে শু'আইব তাঁর পিতা থেকে এবং তিনি তাঁর পিতা থেকে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)
এ থেকে জানা যায় মানুষের মনে তাওহীদের পুরোপুরি ধারণা বসিয়ে দেবার জন্য এ আয়াতটি একটি উত্তম মাধ্যম। প্রত্যেক মুসলমানের সন্তানের শৈশবে যখন বুদ্ধির প্রাথমিক উন্মেষ ঘটে তখনই তার মন-মগজে শুরুতেই এ নকশাটি বসিয়ে দেয়া উচিত।
আপাতদৃষ্টিতে এটা বড়ই শক্তিশালী অভিযোগ মনে হয়। অহীর দাবী নাকচ করার জন্য নবী কোথা থেকে জ্ঞান অর্জন করেন তা চিহ্নিত করার চাইতে বড় ওজনদার আপত্তি আর কি হতে পারে। কিন্তু প্রথম দৃষ্টিতে মানুষ এ ব্যাপারটি দেখে অবাক হয়ে যায় যে, এর জবাবে আদৌ কোন যুক্তিই পেশ করা হয়নি বরং কেবলমাত্র একথা বলেই শেষ করে দেয়া হয়েছে যে, তোমরা সত্যের প্রতি জুলুম করছো, পরিষ্কার বে-ইনসাফীর কথা বলছো, ডাহা মিথ্যার বেসাতি করছো। এতো এমন আল্লাহর কালাম যিনি আকাশ ও পৃথিবীর গোপন রহস্য জানেন। এ ধরনের কঠোর বিরোধিতার পরিবেশে এমনইতর কঠিন অভিযোগ পেশ করা হয় এবং তাকে এভাবে তাচ্ছিল্য ভরে রদ করে দেয়া হয়, এটা কি বিস্ময়কর নয়? সত্যিই কি এটা এমনি ধরনের তুচ্ছ ও নগণ্য অভিযোগ ছিল? এ জবাবে কি শুধু মাত্র “মিথ্যা ও জুলুম” বলে দেয়াই যথেষ্ট ছিল? এ সংক্ষিপ্ত জবাবের পর সাধারণ মানুষ আর কোন বিস্তারিত ও সুস্পষ্ট জবাবের দাবী করেনি, নতুন মু’মিনদের মনেও কোন সন্দেহ দেখা দেয় নি এবং বিরোধীদের কেউও একথা বলার হিম্মত করেনি যে, দেখো, আমাদের এ শক্তিশালী অভিযোগের জবাব দিতে পারছে না, নিছক “মিথ্যা ও জুলুম” বলে একে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা চালানো হচ্ছে, এর কারণ কি?
ইসলাম বিরোধীরা যে পরিবেশে এ অভিযোগ করেছিল সেখানেই আমরা এ সমস্যার সমাধান পেয়ে যাবোঃ
প্রথম কথা ছিল, মক্কার যেসব জালেম সরদার মুসলমানদের মারপিট করছিল ও কষ্ট দিচ্ছিল তারা যেসব লোক সম্পর্কে বলতো যে, তারা পুরাতন কিতাব থেকে অনুবাদ করে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মুখস্থ করাচ্ছে তাদের গৃহ এবং নবীর ﷺ গৃহ অবরোধ করে তাদের নিজেদের কথামত এ কাজের জন্য যেসব বই ও কাগজপত্র জমা করা হয়েছিল সেসব আটক করা তাদের পক্ষে মোটেই কঠিন ব্যাপার ছিল না। ঠিক যে সময় এ কাজ করা হচ্ছিল তখনই তারা সেখানে অতর্কিত হামলা চালিয়ে মূল প্রমাণপত্র লোকদের দেখাতে পারতো এবং বলতে পারতো, দেখো, এ তোমাদের নবুওয়াতের প্রস্তুতি চলছে। বেলালকে যারা মরুভূমির তপ্ত বালুর বুকে পায়ে দড়ি বেঁধে টেনে ফিরছিল তাদের পক্ষে এ কাজ করার পথে কোন নিয়ম ও আইন-কানুন বাধ্য ছিল না। এ পদক্ষেপ গ্রহণ করে তারা চিরকালের জন্য মুহাম্মাদী নবুওয়াতের বিপদ দূর করতে পারতো। কিন্তু তারা কেবল মুখেই অভিযোগ করে থাকে। কোনদিনও এ ধরনের চূড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণে এগিয়ে আসেনি।
দ্বিতীয় কথা ছিল, এ প্রসঙ্গে তারা যেসব লোকের নাম নিতো তারা কেউ বাইরের লোক ছিল না। সবাই ছিল এ মক্কা শহরেরই বাসিন্দা। তাদের যোগ্যতা গোপন ছিল না। সামান্য বুদ্ধি-বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তিও দেখতে পারতো যে, মুহাম্মাদ ﷺ যা পেশ করছেন তা কোন্ পর্যায়ের, তার ভাষা কত উচ্চ পর্যায়ের, সাহিত্য মর্যাদা কত উন্নত, শব্দ ও বাক্য কেমন শিল্পসমৃদ্ধ এবং সেখানে কত উন্নত পর্যায়ের চিন্তা ও বিষয়বস্তুর সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। অন্যদিকে মুহাম্মাদ ﷺ যাদের থেকে এসব কিছু হাসিল করছেন বলে তারা দাবী করছে তারা কোন পর্যায়ের লোক। এ কারণে এ অভিযোগকে কেউই এক কানাকড়ি গুরুত্ব দেয়নি। প্রত্যেক ব্যক্তি মনে করতো, এসব কথায় মনের জ্বালা মেটানো হচ্ছে, নয়তো এ কথার মধ্যে সন্দেহ করার মতো একটুও প্রাণশক্তি নেই। যারা এসব লোককে জানত না তারাও শেষমেষ এতটুকুন কথাও চিন্তা করতে পারতো যে, যদি তারা এতই যোগ্যতা সম্পন্ন হয়ে থাকতো, তাহলে তারা নিজেরাই নিজেদের পাণ্ডিতের প্রদীপ জ্বালালো না কেন? অন্য এক জনের প্রদীপে তেল যোগান দেবার কি প্রয়োজন তাদের পড়েছিল? তাও আবার চুপিসারে, যাতে এ কাজের খ্যাতির সামান্যতম অংশও তাদের ভাগে না পড়ে?
তৃতীয় কথা ছিল, এ প্রসঙ্গে যেসব লোকের নাম নেয়া হচ্ছিল তারা সবাই ছিল বিদেশাগত গোলাম। তাদের মালিকরা তাদেরকে স্বাধীন করে দিয়েছিল। সেকালের আরবের গোত্রীয় জীবনে কোন ব্যক্তিও কোন শক্তিশালী গোত্রের সাহায্য-সমর্থন ছাড়া বাঁচতে পারতো না। কোন সচেতন বুদ্ধিমান ব্যক্তি কি একথা চিন্তা করতো পারতো যে, এরা নিজেদের পৃষ্ঠপোষকদেরকে নারাজ করে দিয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে এ ষড়যন্ত্রে শরীক হয়ে গিয়ে থাকবে? কি এমন লোভ হতে পারতো যেজন্য তারা সমগ্র জাতির ক্রোধ ও তিরস্কারের লক্ষ্যবস্তু এবং সমগ্র জাতি যাকে শত্রু বলে চিহ্নিত করেছে তার সাথে সহযোগিতা করতো এবং এ ধরনের বিপদগ্রস্ত লোকের কাছ থেকে কোন্ লাভের আশায় নিজের পৃষ্ঠপোষকদের থেকে বিছিন্ন হয়ে যাওয়ার ক্ষতি বরদাশত করতো? তারপর তাদের মারধর করে ঐ ব্যক্তির সাথে তাদের ষড়যন্ত্রের স্বীকারোক্তি আদায় করার সুযোগ তাদের পৃষ্ঠপোষকদের তো ছিলই, এটাও চিন্তা করার ব্যাপার ছিল। তারা এ সুযোগ ব্যবহার করেনি কেন? কেনই বা তারা সমগ্র জাতির সামনে তাদের নিজেদের মুখে এ স্বীকৃতি প্রকাশ করেনি যে, তাদের কাছ থেকে শিখে ও জ্ঞান নিয়ে নবুওয়াতের এ দোকান জমজমাট করা হচ্ছে?
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল এই যে, তারা সবাই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ঈমান আনে এবং সাহাবায়ে কেরাম রসূলের পবিত্র সত্তার প্রতি যে নজিরবিহীন ভক্তি-শ্রদ্ধা পোষণ করতেন তারাও তার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। বানোয়াট ও ষড়যন্ত্রমূলক নবুওয়াত তৈরীর পেছনে যারা নিজেরাই মাল-মশলা যুগিয়েছে তারাই আবার তাঁর প্রতি ঈমান আনবে এবং প্রাণঢালা শ্রদ্ধা সহকারে ঈমান আনবে এটা কি সম্ভব? আর ধরে নেয়া যাক যদি এটা সম্ভব হয়ে থেকেও থাকে, তাহলে মু'মিনদের জামায়াতে তাদের তো কোন উল্লেখযোগ্য মর্যাদা লাভ করা উচিত ছিল? আদ্দাস, ইয়াসার ও জাবরের শক্তির উপর নির্ভর করে নবুওয়াতের কাজ-কারবার চলবে আর নবীর দক্ষিণ হস্ত হবেন আবু বকর, উমর ও আবু উবাইদাহ, এটা কেমন করে সম্ভব হলো?
অনুরূপভাবে এ ব্যাপারটিও ছিল বড়ই অবাক করার মতো, যদি কয়েকজন লোকের সহায়তায় রাতের বেলা বসে নবুওয়াতের এ ব্যবসায়ের কাগজ-পত্র তৈরী করা সম্ভব হয়ে থাকে তাহলে যায়েদ ইবনে হারেসা, আলী ইবনে আবু তালেব, আবু বকর সিদ্দীক ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিবারাত্রের সহযোগী অন্যান্য লোকদের থেকে তা কিভাবে গোপন থাকতে পারতো? এ অভিযোগের মধ্যে যদি সত্যের সামান্যতম গন্ধও থাকতো, তাহলে এ লোকগুলো কেমন করে এ ধরনের আন্তরিকতা সহকারে নবীর প্রতি ঈমান আনলো এবং তাঁর সমর্থনে সব ধরনের বিপদ-আপদ ও ক্ষতি কিভাবে বরদাশত করলো? এটা কি কোনক্রমেই সম্ভব ছিল? এসব কারণে প্রত্যেক শ্রোতার কাছে এ অভিযোগ এমনিতেই ছিল অর্থহীন ও অযৌক্তিক। তাই কোন গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগের জবাব দেবার জন্য কুরআনে একে উদ্ধৃত করা হয়নি বরং একথা বলার জন্য উদ্ধৃত করা হয়েছে যে, দেখো সত্যের বিরুদ্ধাচরণ করার ক্ষেত্রে এরা কেমন অন্ধ হয়ে গেছে এবং কেমন ডাহা মিথ্যা, অন্যায় ও বে-ইনসাফির আশ্রয় নিয়েছে।
(আরো বেশি ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কোরআন, আল মু’মিনূন, ২৬ টীকা)