নবী ﷺ নিজের জন্য যে জিনিসটি হারাম করে নিয়েছিলেন সেটি কি ছিল কুরআন মজীদে যদিও তা বলা হয়নি কিন্তু মুহাদ্দিস ও মুফাসসিরগণ এ আয়াত নাযিলের কারণ হিসেবে দু’টি ভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করেছেন। একটি ঘটনা হযরত মারিয়া কিবতিয়া (রাঃ) সম্পর্কিত এবং অপর ঘটনাটি হলো নবী ﷺ মধু পান না করার শপথ করেছিলেন।
হযরত মারিয়ার (রাঃ) ঘটনা হলো, হুদায়বিয়ার সন্ধির পর রসূলুল্লাহ ﷺ আশপাশের বাদশাহদের কাছে যেসব পত্র দিয়েছিলেন তার মধ্যে আলোকজান্দ্রিয়ার রোমান খৃস্টান ধর্মযাজকের (Patriarch) কাছেও একটি পত্র দিয়েছিলেন। আরবরা তাকে মুকাওকিস বলে অভিহিত করত। হযরত হাতেব ইবনে আবী বালতা’আ এই মহামূল্যবান পত্রখানা নিয়ে তার কাছে পৌঁছলে তিনি ইসলাম কবুল করেননি কিন্তু তাঁর সাথে ভাল ব্যবহার করলেন এবং পত্রের উত্তরে লিখলেনঃ “আমি জানি আরো একজন নবী আসতে এখনো বাকী। তবে আমার ধারণা ছিল তিনি সিরিয়ায় আসবেন। তা সত্ত্বেও আমি আপনার দূতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছি এবং কিবতীদের মধ্যে অত্যন্ত মর্যাদার অধিকারী দু’টি মেয়েকে পাঠাচ্ছি।” (ইবনে সা’দ) মেয়ে দু’টির মধ্যে একজনের নাম সিরীন এবং অপরজনের নাম মারিয়া। (খৃস্টানরা হযরত মারিয়ামকে মারিয়া MARY বলে থাকে) মিসর থেকে ফেরার পথে হযরত হাতিব তাদের উভয়কে ইসলাম গ্রহণের আহবান জানালে তারা ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে হাজির হলে তিনি সিরীনকে হযরত হাসসান (রাঃ) ইবনে সাবেতের মালিকানায় দিয়ে দেন এবং মারিয়াকে তাঁর হারামের অন্তর্ভুক্ত করেন। ৮ হিজরীর যুলহাজ্জ মাসে তাঁর গর্ভে নবীর ﷺ পুত্র ইবরাহীম জন্মলাভ করেন (আল ইসতিয়াব-আল ইসাবা)। এই মহিলা ছিলেন অত্যন্ত সুন্দরী। হাফেজ ইবনে হাজার তাঁর আল ইসাবা গ্রন্থে তাঁর সম্পর্কে হযরত আয়েশার (রাঃ) এ উক্তিটি উদ্ধৃত করেছেন। মারিয়ার আগমণ আমার কাছে যতটা অপছন্দনীয় হয়েছে অন্য কোন মহিলার আগমণ ততটা অপছন্দনীয় হয়নি। কারণ, তিনি ছিলেন অতীব সুন্দরী এবং নবী ﷺ তাঁকে খুব পছন্দ করেছিলেন। বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হাদীসসমূহে তাঁর সম্পর্কে যে কাহিনী উদ্ধৃত হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছে, নবী ﷺ একদিন হযরত হাফসার ঘরে গেলে তিনি সেখানে ছিলেন না। সেই সময় হযরত মারিয়া সেখানে তাঁর কাছে আসেন এবং তাঁর সাথে নির্জনে কাটান। হযরত হাফসা তা অপছন্দ করলেন এবং তিনি এ বিষয়ে কঠোর ভাষায় নবীর ﷺ কাছে অভিযোগ করলেন। তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য নবী ﷺ তাঁর কাছে ওয়াদা করলেন যে, তিনি ভবিষ্যতে মারিয়ার সাথে কোন প্রকার দাম্পত্য রাখবেন না। কিছু সংখ্যক রেওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি মারিয়াকে নিজের জন্য হারাম করে নিলেন। আবার কোন কোন রেওয়ায়াতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, এ ব্যাপারে তিনি শপথও করেছিলেন। এসব হাদীস বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে তাবেয়ীদের থেকে ‘মুরসাল’ হাদীস হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে কিছু সংখ্যক হাদীস হযরত উমর (রাঃ), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস এবং হযরত আবু হুরাইরা থেকেও বর্ণিত হয়েছে। এসব হাদীসের সনদের আধিক্য দেখে এর কোন না কোন ভিত্তি আছে বলে হাফেজ ইবনে হাজার ফাতহুল বারীতে ধারণা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সিহাহ সিত্তার কোন গ্রন্থেই এ কাহিনী উদ্ধৃত হয়নি। নাসায়ীতে হযরত আনাস থেকে শুধু এতটুকু উদ্ধৃত হয়েছে যে, নবীর ﷺ একটি দাসী ছিল যার সাথে তিনি দাম্পত্য সম্পর্ক রাখতেন। এই ঘটনার পর হযরত হাফসা (রাঃ) এবং হযরত আয়েশা (রাঃ) তাঁর পিছে লাগলেন। যার কারণে নবী ﷺ তাকে নিজের জন্য হারাম করে নিলেন। এ কারণে এ আয়াত নাযিল হয়ঃ হে নবী, আল্লাহ যে জিনিস তোমার জন্য হালাল করেছেন তা তুমি হারাম করে নিচ্ছ কেন?
দ্বিতীয় ঘটনাটি বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী এবং অপর কিছু সংখ্যক হাদীস গ্রন্থে স্বয়ং হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে তার সারসংক্ষেপ এই যে, রসূলুল্লাহ ﷺ সাধারণত প্রতিদিন আসরের পর পবিত্র স্ত্রীগণের সবার কাছে যেতেন। একবার তিনি যয়নাব বিনতে জাহাশের কাছে গিয়ে অনেকক্ষণ পর্যন্ত বসলেন। কারণ, কোথাও থেকে তাঁর কাছে মধু পাঠানো হয়েছিল। আর নবী ﷺ মিষ্টি খুব ভালবাসতেন। তাই তিনি তাঁর কাছে মধুর শরবত পান করতেন।
হযরত আয়েশা বর্ণনা করেন, এ কারণে খুব হিংসা হলো এবং আমি হযরত হাফসা (রাঃ), হযরত সওদা (রাঃ) ও হযরত সাফিয়ার সাথে মিলিত হয়ে এ মর্মে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, নবী ﷺ আমাদের যার কাছেই আসবেন সেই তাঁকে বলবে, আপনার মুখ থেকে মাগাফিরের গন্ধ আসছে। মাগাফির এক প্রকার ফুল যার মধ্যে কিছুটা দুর্গন্ধ থাকে। মৌমাছি উক্ত ফুল থেকে মধু আহরণ করলে তার মধ্যেও ঐ দুর্গন্ধের কিছুটা লেশ বর্তমান থাকে। এ কথা সবাই জানতেন যে, নবী ﷺ অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ও রুচিশীল ছিলেন। তাঁর শরীর থেকে কোন প্রকার দুর্গন্ধ আসুক তিনি তা একেবারেই অপছন্দ করতেন। তাই হযরত যয়নাবের কাছে তাঁর দীর্ঘ অবস্থানকে বন্ধ করার জন্য এই কৌশল অবলম্বন করা হলো এবং তা ফলবতী হলো। যখন কয়েকজন স্ত্রী তাঁকে বললেন যে, তাঁর মুখ থেকে মাগাফিরের গন্ধ আসে তখন তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন যে, আর কখনো তিনি মধু পান করবেন না। একটি হাদীসে তাঁর বক্তব্যের ভাষা উদ্ধৃত হয়েছে এরূপঃ فَلَنْ أَعُودَ لَهُ وَقَدْ حَلَفْتُ “আমি আর কখনো এ জিনিস পান করবো না, আমি শপথ করেছি।” অপর একটি হাদীসে শুধু فَلَنْ أَعُودَ لَهُ কথাটি আছে وَقَدْ حَلَفْتُ কথাটির উল্লেখ নেই। ইবনে আব্বাস থেকে যে হাদীসটি ইবনুল মুনযির। ইবনে আবী হাতেম, তাবারানী এবং ইবনে মারদুয়া বর্ণনা করেছেন তাতে বক্তব্যের ভাষা হলোঃ والله لااشربه আল্লাহর কসম, আমি আর তা পান করবো না।
বড় বড় মনীষী এই দু’টি কাহিনীর মধ্যে দ্বিতীয় কাহিনীটিকে সঠিক বলে মেনে নিয়েছেন এবং প্রথম কাহিনীটিকে অনির্ভরযোগ্য বলে সাব্যস্ত করেছেন। ইমাম নাসায়ী বলেনঃ “মধুর ঘটনা সম্পর্কিত ব্যাপারে হযরত আয়েশার (রাঃ) বর্ণিত হাদীস বিশুদ্ধ এবং হযরত মারিয়াকে (রাঃ) হারাম করে নেয়ার ঘটনা কোন উত্তম সনদে বর্ণিত হয়নি।” কাজী আয়াজ বলেনঃ “নির্ভুল কথা এই যে, এ আয়াতটি হযরত মারিয়ার (রাঃ) ব্যাপারে নয়, বরং মধু সম্পর্কিত ব্যাপারে নাযিল হয়েছে।” কাজী আবু বকর ইবনুল আরাবীও মধু সম্পর্কিত কাহিনীকেই বিশুদ্ধ বলে মনে করেন এবং ইমাম নববী ও হাফেজ বদরুদ্দীন আইনীও এই মতটিই পোষণ করেন। ফাতহুল কাদির নামক ফিকাহ গ্রন্থে ইমাম ইবনে হুমাম বলেনঃ মধু হারাম করে নেয়ার কাহিনী বুখারী ও মুসলিম হাদিস গ্রন্থে হযরত আয়েশা (রাঃ) নিজে বর্ণনা করেছেন যাঁকে নিয়ে এ ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল। সুতরাং এ বর্ণনাটিই অধিক নির্ভরযোগ্য। হাফেজ ইবনে কাসীর বলেনঃ সঠিক কথা হলো, নিজের জন্য মধু পান হারাম করে নেয়া সম্পর্কে এ আয়াতটি নাযিল হয়েছে।
একদল ফিকাহবিদ বলেনঃ শুধু হারাম করে নেয়া কসম নয়। কেউ যদি কোন জিনিসকে তা স্ত্রী হোক বা অন্য কোন হালাল বস্তু হোক কসম করা ছাড়াই নিজের জন্য হারাম করে নেয় তাহলে তা হবে একটি অনর্থক কাজ। এজন্য কোন কাফ্ফারা দিতে হবে না। বরং সে যে জিনিস হারাম করে নিয়েছে কাফ্ফারা না দিয়েই তা ব্যবহার করতে পারবে। মাসরূক, শা’বী, রাবী’আ এবং আবু সালামা এমত পোষণ করেছেন। ইবনে জারীর এবং জাহেরীগণ এ মতটিই অবলম্বন করেছেন। তাদের মধ্যে তাহরীম বা হারাম করে নেয়া কেবল তখনই কসম বলে গণ্য হবে যখন কেউ কোন বস্তুতে নিজের জন্য হারাম করে নেয়ার সময় কসমের ভাষা ব্যবহার করবে। এক্ষেত্রে তাঁদের যুক্তি হলো, বিভিন্ন রেওয়ায়াত অনুসারে রসূলুল্লাহ ﷺ যেহেতু হালাল জিনিসকে নিজের জন্য হারাম করে নেয়ার সাথে কসমও করেছিলেন তাই আল্লাহ তা’আলা তাঁকে বলেছেনঃ আমি কসমের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হওয়ার যে পন্থা নির্ধারিত করে দিয়েছি আপনি তদানুযায়ী কাজ করুন।
অপর একদলের মতে, কসমের শব্দ ও ভাষা প্রয়োগ করা ছাড়া কোন জিনিসকে হারাম করে নেয়া কসম নয় বটে, তবে স্ত্রীর ক্ষেত্রে তা ব্যতিক্রম। অন্যান্য বস্তু যেমন কাপড়চোপড় বা খাদ্য দ্রব্যকে কেউ যদি নিজের জন্য হারাম করে নেয় তাহলে তা একটি অর্থহীন কাজ। কোন কাফ্ফারা দেয়া ছাড়াই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তা ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু স্ত্রী বা দাসী সম্পর্কে সে যদি বলে যে, তার সাথে সহবাস করা আমার জন্য হারাম তাহলে তা হারাম হবে না বটে, কিন্তু তার কাছে যাওয়ার পূর্বে কসমের কাফ্ফারা অবশ্যই দিতে হবে। এ সিদ্ধান্ত শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারীদের। (মুগনিউল মুহতাজ) মালেকী মাযহাবের অনুসারীগণও অনেকটা অনুরূপ মত অনুসরণ করে থাকেন। (আহকামুল কুরআন লি ইবনিল আরাবী)
তৃতীয় আরেকটি দলের মত হলো, কসমের বাক্য ব্যবহার করা হোক বা না হোক তাহরীমের কাজটাই কসম বলে গণ্য হবে। এটি হযরত আবু বকর সিদ্দীক, হযরত আয়েশা, হযরত উমর, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর, হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমের মত। যদিও বুখারীতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের (রাঃ) আরো একটি মত বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেনঃ إِذَا حَرَّمَ امْرَأَتَهُ لَيْسَ بِشَىْءٍ কেউ যদি তার স্ত্রীকে হারাম করে নেয় তাহলে তা কিছুই না। কিন্তু এ কথার ব্যাখ্যা করা হয়েছে এই যে, তাঁর মতে এটা তালাক বলে গণ্য হবে না। বরং কসম বলে গণ্য হবে এবং তাকে কাফ্ফারা দিতে হবে। কারণ, বুখারী, মুসলিম ও ইবনে মাজায় ইবনে আব্বাসের (রঃ) এ উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে যে, হারাম বলে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কাফ্ফারা দিতে হবে। নাসায়ীতে বর্ণিত হয়েছে যে, এ বিষয়ে ইবনে আব্বাসকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেনঃ সে তোমার জন্য হারাম হয়ে যায়নি তবে তোমার জন্য কাফ্ফারা দেয়া অপরিহার্য। ইবনে জারীরের রেওয়ায়াতে ইবনে আব্বাসের (রাঃ) বক্তব্যের ভাষা হলোঃ আল্লাহ তা’আলা যা হালাল করেছেন তা যদি মানুষ নিজের জন্য হারাম করে থাকে তাহলে নিজের কসমের কাফ্ফারা আদায় করা তার জন্য অপরিহার্য। হাসান বসরী, আতা, তাউস, সুলায়মান ইবনে ইয়াসার, ইবনে জুবায়ের এবং কাতাদা প্রমূখ এ মত পোষণ করেছেন। আর হানাফিরা এ মতটি গ্রহণ করেছেন। ইমাম আবু বরক জাসসাস বলেনঃ لِمَ تُحَرِّمُ مَا أَحَلَّ اللَّهُ لَكَ আয়াতটির শব্দাবলী এ কথা বুঝায় না যে, রসুলুল্লাহ ﷺ হারাম করে নেয়ার সাথে সাথে কসমও করেছিলেন। তাই একথা স্বীকার করতেই হবে যে, ‘তাহরীম’ বা হারাম করে নেয়াটাই কসম। কারণ আল্লাহ তা’আলা পরে এই তাহরীমের ব্যাপারেই কসমের কাফ্ফারা ওয়াজিব করে দিয়েছেন। আরো একটু অগ্রসর হয়ে তিনি বলেছেনঃ আমাদের মনীষীগণ (অর্থাৎ হানাফী মনীষীগণ) তাহরীমকে কেবল সেই ক্ষেত্রে কসম বলে গণ্য করেছেন যেক্ষেত্রে তালাকের নিয়ত থাকবে না। কেউ যদি তার স্ত্রীকে হারাম বলে তাহলে সে যেন প্রকারান্তরে বলে যে, আল্লাহর শপথ, আমি তোমার কাছে আসবো না। অতএব সে ঈলা বা কসম করে বসলো। আর সে যদি পানাহারের কোন বস্তু নিজের জন্য হারাম করে নিয়ে থাকে তাহলে প্রকারান্তরে সে যেন বললো, আল্লাহর শপথ, আমি ঐ জিনিস ব্যবহার করবো না। কারণ, আল্লাহ তা’আলা প্রথম বলেছেনঃ আল্লাহ আপনার জন্য যে জিনিস হালাল করে দিয়েছেন তা আপনি হারাম করছেন কেন? তারপরে বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা তোমাদের জন্য কসমের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হওয়ার পন্থা নিরূপণ করে দিয়েছেন। এভাবে আল্লাহ তা’আলা তাহরীমকে কসম বলে গণ্য করেছেন এবং ‘তাহরীম’ শব্দটি অর্থগত ও শরয়ী হুকুমের দিক দিয়ে কসমের সমার্থক হয়ে গিয়েছে।
স্ত্রীকে হারাম করে নেয়া এবং স্ত্রী ছাড়া অন্য সব জিনিস হারাম করে নেয়ার ব্যাপারে ফিকাহবিদদের দৃষ্টিতে শরয়ী হুকুম কি, সর্বসাধারণের উপকারার্থে এখানে সে বিষয়টি বলে দেয়াও যথোপযুক্ত হবে বলে মনে হয়।
হানাফী ফিকাহবিদদের মতে, কেউ যদি তালাকের নিয়ত ছাড়াই স্ত্রীকে নিজের জন্য হারাম করে নেয় অথবা এ মর্মে শপথ করে যে, সে আর তার কাছে যাবে না তাহলে তা ঈলা বলে গণ্য হবে এবং সেক্ষেত্রে স্ত্রীর সান্নিধ্যে যাওয়ার আগে তাকে কসমের কাফফারা দিতে হবে। কিন্তু সে যদি তালাকের নিয়তে এ কথা বলে থাকে, তুমি আমার জন্য হারাম তাহলে কি উদ্দেশ্যে তা বলেছে তা জেনে নিতে হবে। এক্ষেত্রে সে যদি তিন তালাকের নিয়ত করে থাকে তাহলে তিন তালাক হয়ে যাবে। আর যদি এর চেয়ে কম সংখ্যক তালাকের নিয়ত করে থাকে, তা এক তালাকের নিয়ত হোক বা দুই তালাকের নিয়ত হোক উভয় অবস্থায় এক তালাক মাত্র কার্যকর হবে। আর কেউ যদি বলে আমার জন্য যা হালাল ছিল তা হারাম হয়ে গিয়েছে তাহলে স্ত্রীকে হারাম করার নিয়তে এ কথা না বলা পর্যন্ত স্ত্রীর জন্য তা প্রযোজ্য হবে না। স্ত্রী ছাড়া অন্য কোন জিনিস হারাম করে নেয়ার ক্ষেত্রে কসমের কাফফারা না দেয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ঐ জিনিস ব্যবহার করতে পারবে না (বাদায়েউস সানায়ে, হিদায়া, ফাতহুল কাদীর, আহকামূল কুরআন-জাস্সাস)।
শাফেয়ী ফিকাহবিদদের মতে, স্ত্রীকে যদি তালাক কিংবা যিহারের নিয়তে হারাম করা হয়ে থাকে তাহলে যে বিষয়ের নিয়ত করা হবে সেটিই কার্যকর হবে। রিজয়ী তালাকের নিয়ত করলে রিজয়ী তালাক হবে, বায়েন তালাকের নিয়ত করলে বায়েন তালাক হবে এবং যিহারের নিয়ত করলে যিহার হবে। কেউ যদি তালাক ও যিহার উভয়টি নিয়ত করে তাহরীমের শব্দ ব্যবহার করে থাকে তাহলে তাকে দু’টির মধ্যে যে কোন একটি গ্রহণ করতে বলা হবে। কারণ, তালাক ও যিহার একই সাথে কার্যকরী হতে পারে না। তালাক দ্বারা বিবাহ বন্ধন নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু যিহারের ক্ষেত্রে তা অবশিষ্ট থাকে। কোন নিয়ত ছাড়াই যদি স্ত্রীকে হারাম করে নেয়া হয়ে থাকে তাহলে সে হারাম হবে না। তবে কসমের জন্য অবশ্যই কাফফারা দিতে হবে। আর যদি স্ত্রী ছাড়া অন্য কোন জিনিস হারাম করে থাকে তাহলে তা একটি অনর্থক কাজ হিসেবে গণ্য হবে। সেজন্য তাকে কোন কাফফারা দিতে হবে না। (মুগনিউল মুহতাজ)
মালেকী ফিকাহবিদদের মতে, কেউ যদি স্ত্রী ছাড়া অন্য কোন জিনিস হারাম করে নেয় তাহলে তা হারামও হয় না এবং তা ব্যবহার করার পূর্বে কোন কাফফারা দেয়াও আবশ্যক নয়। তবে কেউ যদি স্ত্রীকে বলে, তুমি হারাম অথবা আমার জন্য হারাম অথবা আমি তোমার জন্য হারাম, সেক্ষেত্রে সে ঐ স্ত্রীর সাথে যৌন মিলন করে থাক বা না থাক সর্বাবস্থায় তিন তালাক বলে গণ্য হবে। তবে সে যদি তিনের কম সংখ্যক তালাকের নিয়ত করে থাকে তাহলে ভিন্ন কথা। আসবাগ বলেছেন, কেউ যদি এভাবে বলে, আমার জন্য যা হালাল ছিল তা হারাম তাহলে স্ত্রীকে উল্লেখ করে বাদ না দেয়া পর্যন্ত এ কথা দ্বারা অবশ্যই স্ত্রীকে হারাম করে নেয়া বুঝাবে। আল মুদাওয়ানা গ্রন্থে এ ব্যাপারে যৌন মিলন হওয়া এবং যৌন মিলন না হওয়া স্ত্রীর মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে। সহবাসকৃত স্ত্রীকে হারাম বলে দেয়ার নিয়ত যাই থাক না কেন তিন তালাকই হয়ে যাবে। কিন্তু যে স্ত্রীর সাথে সে সহবাস করেনি, তার ক্ষেত্রে কম সংখ্যক তালাকের নিয়ত করা হয়ে থাকলে যে কয়টি তালাকের নিয়ত করা হয়েছে সেই কয়টি তালাকই হবে। আর যদি কোন নির্দিষ্ট সংখ্যক তালাকের নিয়ত না থাকে তাহলে তিন তালাক হয়ে যাবে। (হাশিয়াতুদ দুসুকী) কাজী ইবনুল আরাবী আহকামুল কুরআন গ্রন্থে এ বিষয়ে ইমাম মালেকের (রঃ) তিনটি উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। এক, স্ত্রীকে তাহরীম করলে তা এক তালাক বায়েন হয়। দুই, এতে তিন তালাক হয়ে যায়। তিন, সহবাসকৃত স্ত্রীর বেলায় তাহরীম সর্বাবস্থায় তিন তালাক বলে গণ্য হবে। তবে যে স্ত্রীর সাথে সহবাস হয়নি তার বেলায় এক তালাকের নিয়ত থাকলে এক তালাক হবে। তিনি আরো বলেনঃ সঠিক কথা হলো, স্ত্রীকে তাহরীম করলে শুধু এক তালাক হবে। কারণ, কেউ কেউ যদি হারাম বলার পরিবর্তে তালাক শব্দ ব্যবহার করে এবং কোন সংখ্যার উল্লেখ না করে তাহলেও শুধু এক তালাক হবে।
এ বিষয়ে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রঃ) থেকে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে। এক, স্ত্রীকে তাহরীম করা অথবা হালালকে নিজের জন্য কেবল হারাম বলে গণ্য করা যিহার। এক্ষেত্রে যিহারের নিয়ত থাক বা না থাক তাতে কিছু এসে যায় না। দুই, এটা স্পষ্ট তালাকের ইঙ্গিত। এক্ষেত্রে এক তালাকের নিয়ত থাকলেও তিন তালাক হয়ে যাবে। তিন, এটা কসম বলে গণ্য হবে। তবে সে যদি তালাক অথবা যিহারের মধ্যেকার যে কোন একটির নিয়ত করে তাহলে ভিন্ন কথা। কারণ, সেক্ষেত্রে যেটির নিয়ত করবে সেটিই কার্যকর হবে। এসব উক্তির মধ্যে প্রথম উক্তটিই হাম্বলী মাযহাবের রায় বলে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। (আল ইনসাফ)
مَالَتْ عَنِ الْوَاجِبِ مِنْ مُوَافِقَتِهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم يَحِبُّ مَا يُحِبُّهُ وَكِرَاهَةَ مَايَكْرَهُهُ اِلَى مُخَالِفَتِهِ-
অর্থাৎ রসূলুল্লাহ ﷺ যা পছন্দ করেন তা পছন্দ করা এবং যা অপছন্দ করেন তা অপছন্দ করার ব্যাপারে তাঁর সাথে মিল রেখে চলা তোমাদের জন্য অবশ্য করণীয়। কিন্তু এ ব্যাপারে তোমাদের মন তাঁর সাথে সাজুয্য রক্ষা করে চলা থেকে বিচ্যুত হয়ে তাঁর বিরোধিতা করার দিকে বেঁকে গিয়েছে।
আয়াতে স্পষ্টভাবে দুই জন মহিলাকে সম্বোধন করা হয়েছে। আয়াতের পূর্বাপর প্রসঙ্গ থেকে জানা যায় যে, ঐ দু’জন মহিলা ছিলেন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র স্ত্রীদের অন্তর্ভুক্ত। কেননা এই সূরার প্রথম আয়াত থেকে পঞ্চম আয়াত পর্যন্ত একাদিক্রমে নবীর ﷺ পবিত্র স্ত্রীদের বিষয়াদিই আলোচিত হয়েছে। কুরআন মজীদের বাচনভঙ্গি থেকে এতটুকু বিষয় প্রকাশ পাচ্ছে। এখন প্রশ্ন ঐ দু’জন স্ত্রী ছিলেন কে কে? আর যে কারণে এ তিরস্কার করা হলো সেই বিষয়টিই বা কি ছিল। এ বিষয়ের বিস্তারিত বর্ণনা আমরা হাদীস শরীফে দেখতে পাই। মুসনাদে আহমাদ, বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী ও নাসায়ী হাদীস গ্রন্থে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস কর্তৃক একটি বিস্তারিত বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে যাতে কিছুটা শাব্দিক তারতম্য সহ এ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহ আনহু বলেনঃ
আমি অনেক দিন থেকে মনে করছিলাম হযরত উমরকে (রাঃ) জিজ্ঞেস করবো, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীদের মধ্যে যে দু’জন তাঁর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়েছিলেন এবং যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করেছিলেন إِنْ تَتُوبَا إِلَى اللَّهِ فَقَدْ صَغَتْ قُلُوبُكُمَا তারা কে? কিন্তু তার ভয়াল ব্যক্তিত্বের কারণে আমার সে সাহস হতো না। শেষ পর্যন্ত হজ্জ্বে গেলে আমিও তাঁর সাথে গেলাম। ফিরে আসার সময় পথিমধ্যে এক জায়গায় তাঁকে অযু করানোর সময় আমি সুযোগ পেয়ে গেলাম এবং বিষয়টি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। জবাবে তিনি বললেনঃ তাঁরা ছিলেন হযরত আয়েশা (রাঃ) এবং হাফসা (রাঃ)। তারপর তিনি বলতে শুরু করলেন, আমরা কুরাইশীরা আমাদের স্ত্রীদের দমিয়ে রাখতে অভ্যস্ত ছিলাম। আমরা মদীনায় আসলে এখানে এমন অনেক লোক পেলাম যাদের স্ত্রীরা তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে ছিল। ফলে আমাদের স্ত্রীরাও তাদের থেকে এ শিক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করলো। একদিন আমি আমার স্ত্রীর প্রতি অসন্তুষ্ট হলে বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলাম যে, সে-ও আমাকে পাল্টা জবাব দিচ্ছে (মুল ভাষা হচ্ছে فاذا هى تراجعنى )। সে আমার কথার প্রত্যুত্তর করলো---এটা আমার অত্যন্ত খারাপ লাগলো। সে বললোঃ আমি আপনার কথার প্রত্যুত্তর করছি তাতে আপনি রাগান্বিত হচ্ছেন কেন? আল্লাহর শপথ! রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীগণ তো তাঁকে কথায় কথায় জবাব দিয়ে থাকেন (মুল ভাষা হচ্ছে ليراجعنه )। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার নবীর ﷺ প্রতি সারা দিন অসন্তুষ্ট থাকেন (বুখারীর বর্ণনায় আছে নবী ﷺ সারা দিন তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট থাকেন)। এ কথা শুনে আমি বাড়ী থেকে বের হলাম এবং হাফসার (রাঃ) কাছে গেলাম। [হযরত উমরের (রা) কন্যা এবং নবীর ﷺ স্ত্রী।] আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলামঃ তুমি কি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথার প্রত্যুত্তর করো? সে বললোঃ হাঁ। আমি আরো জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের মধ্যে কেউ কি সারাদিন নবীর ﷺ প্রতি অসন্তুষ্ট থাকে? [বুখারীর বর্ণনা হচ্ছে, নবী ﷺ সারা দিন তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট থাকেন।] সে বললোঃ হাঁ। আমি বললামঃ তোমাদের মধ্য থেকে যে মহিলা এরূপ করে সে ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তোমাদের মন থেকে কি এ ভয় দূর হয়ে গিয়েছে যে, আল্লাহর রসূলের অসন্তুষ্টির কারণে আল্লাহও তার প্রতি অসন্তুষ্টি হবেন এবং সে ধ্বংসের মধ্যে নিপতিত হবে? কখনো রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথার প্রত্যুত্তর করবে না। (এখানেও একই শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে لاتراجعى এবং তাঁর কাছে কোন জিনিসের দাবীও করবে না। আমার সম্পদ থেকে যা ইচ্ছা তুমি চেয়ে নিও। তোমার সতীন [অর্থাৎ হযরত আয়েশা (রাঃ)] তোমার চাইতে অধিক সুন্দরী এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে অধিক প্রিয়। তাঁর কারণে তুমি আত্মপ্রতারিত হয়ো না। এরপর আমি সেখান থেকে বের হয়ে উম্মে সালামার (রাঃ) কাছে গেলাম এবং এ ব্যাপারে তাঁর সাথে কথা বললাম। তিনি ছিলেন আমার আত্মীয়া। তিনি আমাকে বললেনঃ খাত্তাবের বেটা; তুমি তো দেখছি অদ্ভূত লোক! প্রত্যেক ব্যাপারে তুমি হস্তক্ষেপ করছ! এমন কি এখন রসূলুল্লাহ ﷺ এবং তাঁর স্ত্রীদের ব্যাপারেও হস্তক্ষেপ করতে চলেছ। তাঁর এই কথায় আমি সাহস হারিয়ে ফেললাম। এরপর হঠাৎ আমার এক আনসার প্রতিবেশী রাত্রি বেলায় আমার বাড়ীতে এসে আমাকে ডাকলেন। আমরা দু’জন পালা করে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিসে হাজির হতাম এবং যার পালার দিন যে কথা হতো তা একে অপরকে বলতাম। এই সময়টা ছিল এমন যখন আমাদের বিরুদ্ধে গাসসানীদের আক্রমনের বিপদাশংকা দেখা দিয়েছিল। তার আহবানে আমি বের হলে সে বললঃ একটি মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ গাসসানীরা কি আক্রমণ করে বসেছে? সে বললঃ না তার চেয়েও বড় ঘটনা ঘটেছে। রসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর স্ত্রীদের তালাক দিয়েছেন। আমি বললামঃ হাফসা ব্যর্থ ও ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। বুখারীর ভাষা হচ্ছেঃ رَغَمَ أَنْفُ حَفْصَةَ وَعَائِشَةَ এমনটা ঘটবে আমি প্রথমেই আশঙ্কা করেছিলাম।
কাহিনীর পরবর্তী অংশ আমরা উল্লেখ করলাম না। এ অংশে হযরত উমর (রাঃ) বলেছেনঃ তিনি পরদিন সকালে নবীর ﷺ খেদমতে হাজির হয়ে কিভাবে তাঁর ক্রোধ নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছেন। আমরা মুসনাদে আহমাদ ও বুখারীর বর্ণিত হাদীসসমূহ একত্রিত করে এ কাহিনী বিন্যস্ত করেছি। এতে হযরত উমর (রাঃ) যে مراجعت শব্দ ব্যবহার করেছেন এখানে তার আভিধানিক অর্থ গ্রহণ করা যেতে পারে না। বরং পূর্বাপর বিষয় থেকে আপনা আপনি প্রকাশ পায় যে, এ শব্দটি প্রতি উত্তর বা কথার পৃষ্ঠে কথা বলা অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে এবং হযরত উমরের (রাঃ) তাঁর কন্যাকে لاتراجعى رسول الله বলাটা স্পষ্টতঃ এ অর্থে বলা হয়েছে যে, নবীর ﷺ সাথে বাদানুবাদ করো না। কেউ কেউ এই অনুবাদকে ভুল বলে থাকেন। তাদের আপত্তি হচ্ছে, مراجعت শব্দের অর্থ পাল্টা জবাব দেয়া অথবা কথার পৃষ্ঠে কথা বলা ঠিক, কিন্তু বাদানুবাদ করা ঠিক নয়। কিন্তু আপত্তিকারী এ ব্যক্তিবর্গ এ বিষয়টি উপলব্ধি করেন না যে, কম মর্যাদার লোক যদি তার চেয়ে বড় মর্যাদার ব্যক্তিকে পাল্টা জবাব দেয় কিংবা কথার পৃষ্ঠে কথা বলে তাহলে তাকেই বাদানুবাদ করা বলে। উহাদরণস্বরূপ, বাপ যদি ছেলেকে কোন কারণে তিরস্কার বা শাসন করে অথবা তাঁর কোন কাজে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে আর ছেলে যদি তাতে আদবের সাথে চুপ থাকা বা ওজর পেশ করার পরিবর্তে পাল্টা জবাব দিতে থাকে, তাহলে একে বাদানুবাদ ছাড়া আর কিছু বলা যেতে পারে না। কিন্তু ব্যাপারটা যখন বাপ এবং ছেলের মধ্যেকার না হয়ে বরং আল্লাহর রসূল এবং তাঁর উম্মাতের কোন লোকের মধ্যেকার ব্যাপার হয় তাহলে একজন নির্বোধই কেবল এ কথা বলতে পারে যে, এটা বাদানুবাদ নয়।
আমাদের এই অনুবাদকে কিছু লোক বেআদবী বা অশিষ্টতা বলে আখ্যায়িত করে। অথচ তা বেআদবী কেবল তখনই হতো যদি আমরা হযরত হাফসা (রাঃ) সম্পর্কে নিজের পক্ষ থেকে এ ধরনের ভাষা প্রয়োগ করার দুঃসাহস দেখাতাম। আমরা তো হযরত উমরের (রাঃ) কথার সঠিক অর্থ তুলে ধরেছি। আর তিনি তাঁর মেয়েকে তার ত্রুটির জন্য তিরস্কার করতে গিয়ে এ কথাটি বলেছেন। একে বেআদবী বলার অর্থ হচ্ছে, হয় পিতাও তার নিজের মেয়েকে শাসন বা তিরস্কারের সময় আদবের সাথে কথা বলবে অথবা তার তিরস্কার মিশ্রিত ভাষার অনুবাদকারীর নিজের পক্ষ থেকে মার্জিত ও শিষ্ট ভাষা বানিয়ে দেবে।
এক্ষেত্রে সত্যিকার ভেবে দেখার বিষয় হচ্ছে, ব্যাপারটা যদি এ রকম হালকা ও মামুলী ধরনের হতো যে, নবী ﷺ তাঁর স্ত্রীদের কিছু বললে তাঁরা পাল্টা জবাব দিতেন, তাহলে তাকে এতো গুরুত্ব কেন দেয়া হলো যে, কুরআন মজীদে আল্লাহ তা’আলা নিজে সরাসরি নবীর ﷺ ঐ স্ত্রীদেরকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিলেন? আর হযরত উমরই (রাঃ) বা এ বিষয়টিকে এত মারাত্মক মনে করলেন কেন যে, প্রথমে নিজের মেয়েকে তিরস্কার করলেন এবং তারপর এক এক করে নবীর ﷺ পবিত্র স্ত্রীগণের প্রত্যেকের ঘরে গিয়ে তাঁদেরকে আল্লাহর অসন্তুষ্টির ভয় দেখিয়ে সাবধান করলেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তাঁর মতে রসূলুল্লাহ ﷺ কি এমন চড়া মেজাজের ছিলেন যে, অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যাপারেও স্ত্রীদের প্রতি অসন্তুষ্ট হতেন? তাছাড়া (মা’য়াযাল্লাহ) তাঁর দৃষ্টিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেজাজ এতই কঠোর ছিল যে, এ ধরনের কথায় অসন্তুষ্ট হয়ে তিনি একবার সব স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তার নিজের কুঠরিতে নির্জন জীবন গ্রহণ করেছিলেন, কেউ যদি এসব প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে তাহলে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় সে অবশ্যই দু’টি পথের যে কোন একটি গ্রহণ করতে বাধ্য হবে। হয় তার কাছে নবীর ﷺ পবিত্র স্ত্রীদের সম্মান ও মর্যাদার বিষয় এত বড় হয়ে দেখা দেবে যে, সে এজন্য আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দোষ-ত্রুটিরও পরোয়া করবে না। অথবা সোজাসুজি এ কথা মেনে নিতে হবে যে, সেই সময় নবীর ﷺ ঐসব পবিত্র স্ত্রীদের আচরণ প্রকৃতই এমন আপত্তিকর হয়ে গিয়েছিল যে, তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হওয়ার ব্যাপারে রসূলের ভূমিকা ন্যায়সঙ্গত ছিল এবং তাঁর চেয়ে অধিক ন্যায়সঙ্গত ছিল আল্লাহ তা’আলার ভূমিকা যে কারণে নবীর ﷺ পবিত্র স্ত্রীদের এই আচরণ সম্পর্কে কঠোর সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেছেন।
বুখারীতে হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত উমর (রাঃ) বলেছেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীদের পারস্পরিক ঈর্ষা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা নবীকে ﷺ অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। হাদীসের মূল ভাষা হচ্ছেঃ اجْتَمَعَ نِسَاءُ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فِى الْغَيْرَةِ عَلَيْهِ তাই আমি তাঁদের বললামঃ নবী ﷺ যদি তোমাদের তালাক দিয়ে দেন তাহলে আল্লাহ তা’আলা তাঁকে তোমাদের চেয়ে উত্তম স্ত্রী দান করা অসম্ভব নয়। হযরত আনাসের (রাঃ) বরাত দিয়ে ইবনে আবী হাতেম হযরত উমরের (রাঃ) বর্ণনা নিম্নোক্ত ভাষায় উদ্ধৃত করেছেনঃ আমার কাছে এ মর্মে খবর পৌঁছল যে, নবী ﷺ ও উম্মুল মু’মিনীনদের মধ্যে কিছুটা তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে। এ কথা শুনে আমি তাদের প্রত্যেকের কাছে গিয়ে বললামঃ তোমরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অতিষ্ঠ করা থেকে বিরত থাক। তা না হলে আল্লাহ তা’আলা নবীকে ﷺ তোমাদের পরিবর্তে উত্তম স্ত্রী দান করবেন। এমনকি আমি যখন উম্মুল মু’মিনীনদের মধ্যে শেষ জনের কাছে গেলাম [বুখারীর একটি হাদীসের বর্ণনা অনুসারে তিনি ছিলেন হযরত উম্মে সালামা (রাঃ)।] তখন তিনি আমাকে বললেনঃ হে উমর! রসূলুল্লাহ কি স্ত্রীদেরকে উপদেশ দেয়ার জন্য যথেষ্ট নন যে, তুমি তাঁদেরকে উপদেশ দিতে চলেছ? এতে আমি চুপ হয়ে গেলাম। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা এই আয়াত নাযিল করলেন।
মুসলিমে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, হযরত উমর (রাঃ) তাঁর কাছে বর্ণনা করেছেন যে, নবী যখন সাময়িকভাবে তাঁর স্ত্রীদের সাথে মেলামেশা বন্ধ করলেন তখন আমি মসজিদে নববীতে পৌঁছে দেখলাম লোকজন চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে বসে নুড়ি পাথর তুলছে এবং নিক্ষেপ করেছে এবং পরস্পর বলাবলি করছে যে, রসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর স্ত্রীদের তালাক দিয়েছেন। এরপর হযরত উমর (রাঃ) হযরত আয়েশা ও হাফসার কাছে তাঁর যাওয়ার এবং তাঁদের উপদেশ দেয়ার কথা উল্লেখ করলেন। তারপর বললেনঃ আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাজির হয়ে আরজ করলাম, স্ত্রীদের ব্যাপারে আপনি চিন্তিত হচ্ছেন কেন? আপনি যদি তাঁদের তালাক দেন তাহলে আল্লাহ তা’আলা আপনার সাথে আছেন, সমস্ত ফেরেশতা, জিবরাঈল ও মিকাঈল আপনার সাথে আছেন, আর আমি, আবু বকর এবং সমস্ত ঈমানদার আপনার সাথে আছি। আমি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। কারণ খুব কমই এ রকম হয়েছে যে, আমি কোন কথা বলেছি এবং আল্লাহ তা’আলা তা সত্যয়ন ও সমর্থন করবেন বলে আশা করি নাই। বস্তুত এরপর সূরা তাহরীমের এ আয়াতগুলো নাযিল হয়। এরপর আমি নবীকে ﷺ জিজ্ঞেস করলাম। আপনি স্ত্রীদের তালাক দিয়েছেন? তিনি বললেন, না। এ কথা শুনে মসজিদে নববীর দরজায় দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে ঘোষণা করলাম যে, নবী ﷺ তাঁর স্ত্রীদের তালাক দেন নাই।
বুখারীতে হযরত আনাস (রাঃ) থেকে এবং মুসনাদে আহমাদে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত আয়েশা (রাঃ) এবং হযরত আবু হুরাইরা থেকে এ বিষয়ে বহু সংখ্যক হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, নবী ﷺ এক মাস পর্যন্ত তাঁর স্ত্রীদের থেকে আলাদা থাকার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন এবং নিজের কুঠরিতে অবস্থান করতে শুরু করেছিলেন। ২৯ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এসে বললেনঃ আপনার কসম পূরণ হয়েছে, মাস পূর্ণ হয়ে গিয়েছে।
হাফেজ বদরুদ্দীন আইনী উমদাতুল কারী গ্রন্থে হযরত আয়েশা (রাঃ) বরাত দিয়ে বর্ণনা করেছেন যে, নবীর ﷺ পবিত্র স্ত্রীগণের মধ্যে দু’টি দলের সৃষ্টি হয়েছিল। একটিতে ছিলেন হযরত আয়েশা (রাঃ), হযরত হাফসা (রাঃ), হযরত সাওদা (রাঃ) ও হযরত সাফিয়া (রাঃ)। আর অপরটিতে ছিলেন হযরত যয়নাব (রাঃ), হযরত উম্মে সালামা (রাঃ) এবং অবশিষ্ট উম্মুল মু’মিনীনগণ।
ঐ সময় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পারিবারিক জীবনে কি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল এসব বর্ণনা থেকে তা কিছুটা আন্দাজ করা যেতে পারে। তাই আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে হস্তক্ষেপ করে নবীর ﷺ স্ত্রীদের কর্মপদ্ধতি ও আচরণ সংশোধন করা জরুরী হয়ে পড়েছিল। নবীর ﷺ স্ত্রীগণ যদিও সমাজের মহিলাদের মধ্যে সর্বোত্তম মহিলা ছিলেন, তথাপি তাঁরা ছিলেন মানুষ। তাই তাঁরা মানসিক চাহিদা ও দুর্বলতা থেকে মুক্ত ছিলেন না। নিরবচ্ছিন্নভাবে কষ্টকর জীবন যাপন কোন কোন সময় তাঁদের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়াত। তাই তাঁরা অধৈর্য হয়ে নবীর ﷺ কাছে খোরপোষের দাবী করতে শুরু করতেন। এ অবস্থায় সূরা আহযাবের ২৮-২৯ আয়াত নাযিল করে আল্লাহ তা’আলা তাঁদের উপদেশ দিয়েছেন যে, পার্থিব স্বাচ্ছন্দই যদি তোমাদের কাম্য হয়ে থাকে তাহলে আমার রসূল তোমাদেরকে উত্তম পন্থায় বিদায় দিয়ে দেবেন। আর যদি তোমরা আল্লাহ, তাঁর রসূল এবং আখেরাতের জীবন কামনা করো তাহলে রসূলের সাহচর্যে থাকার কারণে যেসব দুঃখ-কষ্ট আসবে তা বরদাশত করো (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সুরা আল আহযাব, টীকা ৪১ এবং সূরা আহযাবের ভূমিকা)। তাছাড়া কোন কোন সময় নারী প্রকৃতির কারণে তাদের থেকে স্বভাবতই এমনসব বিষয় প্রকাশ পেত যা সাধারণ মানবীয় বৈশিষ্ট্যের পরিপন্থী ছিল না। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা তাঁদেরকে যে ঘরের স্ত্রী হওয়ার মর্যাদা দান করেছিলেন তার মর্যাদা ও গৌরব এবং মহান দায়িত্ব ও কর্তব্যের সাথে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। এসব কারণে যখন এ আশঙ্কা দেখা দিল যে, তা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পারিবারিক জীবনকে বিষিয়ে তুলতে পারে এবং আল্লাহ তা’আলা নবীর ﷺ দ্বারা যে মহৎ কাজ আঞ্জাম দিচ্ছিলেন তার ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে, তাই কুরআন মজীদের এ আয়াত নাযিল করে তাঁদের সংশোধন করলেন। যাতে তাঁর পবিত্র স্ত্রীদের মধ্যে সেই মর্যাদা ও দায়িত্বানুভূতি সৃষ্টি হয় যা তাঁরা আল্লাহর সর্বশেষ রসূলের জীবন সঙ্গীনি হওয়ার কারণে লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। আর তাঁরা যেন নিজেদেরকে সাধারণ নারীদের মত এবং নিজেদের পারিবারকে সাধারণ পরিবারসমূহের মতো মনে করে না বসেন। এ আয়াতের প্রথম অংশটিই এমন যা শুনে হয়তো নবীর ﷺ পবিত্র স্ত্রীদের হৃদয়-মন কেঁপে উঠে থাকবে। তাঁদের জন্য এ কথাটির চেয়ে বড় হুঁশিয়ারী আর কি হবে যে, নবী যদি তোমাদের তালাক দেন তাহলে আল্লাহর তাঁকে তোমাদের পরিবর্তে উত্তম স্ত্রী দান করাটা অসম্ভব নয়। প্রথমত, নবীর ﷺ কাছে থেকে তালাক পাওয়ার চিন্তা বা কল্পনাই তাদের কাছে অসহনীয় ব্যাপার। তাছাড়া আরো বলা হয়েছে যে, উম্মুল মু’মিনীন হওয়ার মর্যাদা তোমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে এবং অন্য যেসব নারীকে আল্লাহ তা’আলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রী হিসেবে আনবেন তারা তোমাদের চেয়ে উত্তম হবেন। এরপরে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে তিরস্কারযোগ্য হতে পারে এমন কোন কাজ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র স্ত্রীদের দ্বারা সংঘটিত হওয়া সম্ভবই ছিল না। এ কারণে আমরা কুরআন মজীদে শুধু দু’টি জায়গায় এমন দেখতে পাই যেখানে মহা সম্মানিত এই নারীদেরকে হুঁশিয়ারী দেয়া হয়েছে। উক্ত জায়গা দু’টির একটি সূরা আহযাবে এবং অপরটি সূরা তাহরীমে।
“নবী ﷺ যদি তোমাদের তালাক দেন তাহলে আল্লাহ তা’আলা তোমাদের পরিবর্তে তাঁকে এমনসব স্ত্রী দান করবেন যাদের মধ্যে অমুক অমুক গুণাবলী থাকবে।” নবীর ﷺ পবিত্র স্ত্রীগণকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তা’আলার এ কথা বলার অর্থ এ নয় যে, তাদের মধ্যে এসব গুণাবলী ছিল না। বরং এর অর্থ হলো, তোমাদের ত্রুটিপূর্ণ আচরণের কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে কষ্ট হচ্ছে তোমরা তা পরিত্যাগ করো এবং তার পরিবর্তে তোমাদের মধ্যে এসব গুণাবলী পূর্ণাঙ্গরূপে সৃষ্টির জন্য একান্তভাবে মনোনিবেশ করো।
পাথর হবে জাহান্নামের জ্বালানী। এর অর্থ পাথরের কয়লা। [ইবনে মাসউদ (রা.), ইবনে আব্বাস (রা.), মুজাহিদ (রা.), ইমাম বাকের (র) ও সুদ্দীর মতে, এর অর্থ গন্ধকের পাথর।]
তাওবা সম্পর্কিত বিষয়ে আরো কয়েকটি জিনিস ভালভাবে বুঝে নেয়া দরকার। প্রথমত, প্রকৃতপক্ষে তাওবা হচ্ছে কোন গোনাহের কারণে এজন্য লজ্জিত হওয়া যে, তা আল্লাহর নাফরমানী। কোন গোনাহর কাজ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অথবা বদনামের কারণ অথবা আর্থিক ক্ষতির কারণ হওয়ায় তা থেকে বিরত থাকার সংকল্প করা তাওবার সংজ্ঞায় পড়ে না। দ্বিতীয়ত, যখনই কেউ বুঝতে পারবে যে, তার দ্বারা আল্লাহর নাফরমানী হয়েছে, তার উচিত তৎক্ষনাৎ তাওবা করা এবং যেভাবেই হোক অবিলম্বে তার ক্ষতিপূরণ করা কর্তব্য, তা এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। তৃতীয়ত, তাওবা করে বারবার তা ভঙ্গ করা, তাওবাকে খেলার বস্তু বানিয়ে নেয়া এবং যে গোনাহ থেকে তাওবা করা হয়েছে বার বার তা করতে থাকা তাওবা মিথ্যা হওয়ার প্রমাণ। কেননা, তাওবার প্রাণ সত্তা হচ্ছে, কৃত গোনাহ সম্পর্কে লজ্জিত হওয়া। কিন্তু বার বার তাওবা ভঙ্গ করা প্রমাণ করে যে, তার মধ্যে লজ্জার অনুভূতি নেই। চতুর্থত, যে ব্যক্তি সরল মনে তাওবা করে পুনরায় ঐ গোনাহ না করার সংকল্প করেছে মানবিক দুর্বলতার কারণে যদি পুনরায় তার দ্বারা সেই গোনাহর পুনরাবৃত্তি ঘটে তাহলে এক্ষেত্রে পূর্বের গোনাহ পুনরুজ্জীবিত হবে না তবে পরবর্তী গোনাহর জন্য তার পুনরায় তাওবা করা উচিত। পঞ্চমত, যখনই গোনাহর কথা মনে পড়বে তখনই নতুন করে তাওবা করা আবশ্যক নয়। কিন্তু তার প্রবৃত্তি যদি পূর্বের পাপময় জীবনের স্মৃতিচারণ করে আনন্দ পায় তাহলে গোনাহর স্মৃতিচারণ তাকে আনন্দ দেয়ার পরিবর্তে লজ্জাবোধ সৃষ্টির কারণ না হওয়া পর্যন্ত তার বার বার তাওবা করা উচিত। কারণ, যে ব্যক্তি সত্যিই আল্লাহর ভয়ে গোনাহ থেকে তাওবা করেছে সে অতীতে আল্লাহর নাফরমানী করেছে এই চিন্তা করে কখনো আনন্দ অনুভব করতে পারে না। তা থেকে মজা পাওয়া ও আনন্দ অনুভব করা প্রমাণ করে যে, তার মনে আল্লাহর ভয় শিকড় গাড়তে পারেনি।