আল ওয়াকি’আ

৯৬ আয়াত

بِسْمِ ٱللّٰهِ ٱلرَّحْمَـٰنِ ٱلرَّحِيمِ
আয়াত
-
১ ) যখন সেই মহা ঘটনা সংঘটিত হবে
إِذَا وَقَعَتِ ٱلْوَاقِعَةُ ١ ⏸︎
২ ) তখন তার সংঘটিত হওয়াকে কেউ-ই মিথ্যা বলতে পারবে না।
لَيْسَ لِوَقْعَتِهَا كَاذِبَةٌ ٢ ⏸︎
৩ ) তা হবে উলট-পালটকারী মহা প্রলয়।
خَافِضَةٌ رَّافِعَةٌ ٣ ⏸︎
৪ ) পৃথিবীকে সে সময় অকস্মাত ভীষণভাবে আলোড়িত করা হবে
إِذَا رُجَّتِ ٱلْأَرْضُ رَجًّا ٤ ⏸︎
৫ ) এবং পাহাড়কে এমন টুকরো টুকরো করে দেয়া হবে
وَبُسَّتِ ٱلْجِبَالُ بَسًّا ٥ ⏸︎
৬ ) যে, তা বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত হবে।
فَكَانَتْ هَبَآءً مُّنۢبَثًّا ٦ ⏸︎
৭ ) সে সময় তোমরা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে যাবে। ডান দিকের লোক।
وَكُنتُمْ أَزْوَٰجًا ثَلَٰثَةً ٧ ⏸︎
৮ ) ডান দিকের লোকদের (সৌভাগ্যের) কথা আর কতটা বলা যাবে।
فَأَصْحَٰبُ ٱلْمَيْمَنَةِ مَآ أَصْحَٰبُ ٱلْمَيْمَنَةِ ٨ ⏸︎
৯ ) বাম দিকের লোক বাম দিকের লোকদের (দুর্ভাগ্যের) পরিণতি আর কি বলা যাবে।
وَأَصْحَٰبُ ٱلْمَشْـَٔمَةِ مَآ أَصْحَٰبُ ٱلْمَشْـَٔمَةِ ٩ ⏸︎
১০ ) আর অগ্রগামীরা তো অগ্রগামীই।
وَٱلسَّٰبِقُونَ ٱلسَّٰبِقُونَ ١٠ ⏸︎
১.
এ আয়াতাংশ দ্বারা বক্তব্য শুরু করা স্বতসিদ্ধভাবেই প্রমাণ করে যে, সে সময় কাফেরদের মজলিসসমূহে কিয়ামতের বিরুদ্ধে যেসব কাহিনী ফাঁদা হতো এবং গালগপ্প করা হতো, এটা তার জবাব। যখন মক্কার লোক রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ থেকে সবেমাত্র ইসলামের দাওয়াত শুনছে এটা ঠিক সেই সময়ের কথা। এর মধ্যে তাদের কাছে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশী অদ্ভূত, অযৌক্তিক ও অসম্ভব বলে মনে হতো তা হচ্ছে, এক দিন আসমান যমীনের এ ব্যবস্থাপনা ধ্বংস হয়ে যাবে এবং তারপর অন্য একটি জগত সৃষ্টি হবে যেখানে পূর্ববর্তী ও পরবর্তীকালের সমস্ত মৃত মানুষকে পুনরায় জীবিত করা হবে। একথা শুনে তাদের চোখ বিস্ময়ে বিস্ফোরিত হয়ে যেতো। তারা বলতোঃ এটা হওয়া একেবারেই অসম্ভব। তাহলে এ পৃথিবী, পাহাড়, পর্বত, সমুদ্র, চন্দ্র এবং সূর্য কোথায় যাবে। শত শত হাজার হাজার বছরের করবস্থ মৃতরা কিভাবে জীবিত হয়ে উঠবে? মৃত্যুর পরে পুনরায় জীবনলাভ, তারপর সেখানে থাকবে বেহেশতের বাগান ও দোযখের আগুন এসব স্বপ্নচারিতা ও আকাশ কুসুম কল্পনা মাত্র। বুদ্ধিবিবেক ও সুস্থ মস্তিষ্কে আমরা এসব কি করে মেনে নিতে পারি? মক্কার সর্বত্র তখন এই গালগপ্পকে কেন্দ্র করে আসর জমছিলো। এ পটভূমিতে বলা হয়েছে, যখন সে মহা ঘটনা সংঘটিত হবে তখন তা অস্বীকার করার মত কেউ থাকবে না।

এ বাণীর মধ্যে কিয়ামত বুঝাতে وَاقِعَةُ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে এর অর্থ যা অনিবার্য ও অবধারিত। অর্থাৎ তা এমন জিনিস যা অনিবার্যরূপেই সংঘটিত হতে হবে। এর সংঘটিত হওয়াকে আবার وقعة শব্দ দিয়ে বুঝানো হয়েছে। আরবী ভাষায় এ শব্দটি আকস্মিকভাবে কোন বড় দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়া বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। لَيْسَ لِوَقْعَتِهَا كَاذِبَةٌ কথাটির দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, এর সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা তিরোহিত হওয়া, আগমন থেমে যাওয়া কিংবা এর আগমন ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব হবে না। অন্য কথায়, এ বাস্তব ঘটনাকে অবাস্তব ও অস্তিত্বহীন বানিয়ে দেয়ার মত কেউ থাকবে না। দুই, কোন জীবন্ত সত্তাই তখন এ মিথ্যা কথা বলবে না যে, এ ঘটনা আদৌ সংঘটিত হয়নি।

২.
মূল আয়াতে ব্যবহৃত শব্দ হচ্ছে خَافِضَةٌ رَافِعَةٌ “নীচুকারী ও উঁচুকারী” এর একটি অর্থ হতে পারে সেই মহা ঘটনা সব কিছু উলট-পালট করে দেবে। নীচের জিনিস উপরে উঠে যাবে এবং উপরের জিনিস নীচে নেমে যাবে। আরেকটি অর্থ এও হতে পারে যে, তা নীচে পতিত মানুষদেরকে উপরে উঠিয়ে দেবে এবং উপরের মানুষদেরকে নীচে নামিয়ে দেবে। অর্থাৎ তা আসার পর মানুষের মধ্যে মর্যাদা ও অমর্যাদার ফায়সালা হবে সম্পূর্ণ আলাদা ভিত্তি ও দৃষ্টিকোণ থেকে। যারা পৃথিবীতে নিজেদেরকে অতি সম্মানিত বলে দাবী করে বেড়াতো তারা লাঞ্ছিত হবে আর যাদের নীচ ও হীন মনে করা হতো তারা মর্যাদা লাভ করবে।
৩.
অর্থাৎ তা কোন আঞ্চলিক সীমিত মাত্রার ভূমিকম্প হবে না। বরং যুগপৎ সমগ্র পৃথিবীকে গভীর আলোড়নে প্রকম্পিত করবে। পৃথিবী হঠাৎ করে এমন বিরাট ঝাঁকুনি খাবে যার ফলে তা লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে।
৪.
যাদেরকে এ বক্তব্য শুনানো হচ্ছিলো কিংবা এখন যারা তা পড়বে বা শুনবে, বাহ্যত কেবল তাদেরকে সম্বোধন করা হলেও প্রকৃতপক্ষে গোটা মানবজাতিকেই সম্বোধন করা হয়েছে। সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ সৃষ্টি হয়েছে তারা সবাই কিয়ামতের দিন তিন ভাগে বিভক্ত হবে।
৫.
মূল আয়াতে أَصْحَابُ الْمَيْمَنَةِ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আরবী ব্যাকরণ অনুসারে ميمنة শব্দটি يمين শব্দ থেকে গৃহীত হতে পারে--- যার অর্থ ডান হাত। আবার يمن শব্দ থেকেও গৃহিত হতে পারে যার অর্থ শুভ লক্ষণ। যদি ধরে নেয়া যায় যে, এ শব্দটির উৎপত্তি يمين শব্দ থেকে হয়েছে তাহলে أَصْحَابُ الْمَيْمَنَةِ এর অর্থ হবে, “ডান হাতের অধিকারী।” কিন্তু এখানে এর আভিধানিক অর্থ অভিপ্রেত নয়। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন লোক ডান হাতকে আরবের লোকেরা শক্তি, মহত্ব ও মর্যাদার প্রতীক বলে মনে করতো। যাকে মর্যাদা প্রদর্শন উদ্দেশ্য হতো মজলিসের মধ্যে তাকে ডান হাতের দিকে বসাতো। আমার কাছে অমুক ব্যক্তির অনেক সম্মান ও মর্যাদা একথা বুঝানোর প্রয়োজন হলে বলতোঃ فُلَانٌ مِنِّى بِالْيَمِيْن সে তো আমার ডান হাতের পাশে। আমাদের ভাষাতেও কাউকে কোন বিশিষ্ট ব্যক্তির ‘দক্ষিণ হস্ত’ বলার অর্থ সে তার ঘনিষ্ঠ জন। আর যদি ধরে নেয়া যায় যে, এর উৎপত্তি يمن শব্দ থেকে হয়েছে তাহলে أَصْحَابُ الْمَيْمَنَةِ এর অর্থ হবে, ‘খোশ নসীব’ ও সৌভাগ্যবান।
৬.
মূল ইবারতে “أَصْحَابُ الْمَشْأَمَةِ ” শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। مشئمة শব্দের উৎপত্তি হয়েছে شئوم থেকে। এর অর্থ, দুর্ভাগ্য, কুলক্ষণ, অশুভ লক্ষণ। আরবী ভাষায় বাঁ হাতকেও شومى বলা হয়। আরবরা شمال (বাঁ হাত) এবং شوم অশুভ লক্ষণ, শব্দ দু’টিকে সমার্থক বলে মনে করতো। তাদের কাছে বাঁ হাত দুর্বলতা ও লাঞ্ছনার প্রতীক। সফরে রওয়ানা হওয়ার সময় যদি পাখী তাদের বাঁ হাতের দিক দিয়ে উড়ে যেতো তাহলে তারা একে অশুভ লক্ষণ বলে মনে করতো। কাউকে বাঁ পাশে বসালে তার অর্থ হতো সে তাকে নীচু মর্যাদার লোক মনে করে। আমার কাছে তার কোন মর্যাদা নেই কারো সম্পর্কে যদি একথা বলতে হয় তাহলে বলা হয় فُلَانٌ مِنِّى بِالشِّمَال সে আমার বাঁ পাশের লোক। বাংলা ভাষাতেও খুব হালকা ও সহজ কাজ বুঝাতে বলা হয়, এটা আমার বাঁ হাতের খেলা। অতএব, أَصْحَابُ الْمَشْأَمَةِ অর্থ দুর্ভাগা লোক অথবা এমন লোক যারা আল্লাহর কাছে লাঞ্ছনার শিকার হবে এবং আল্লাহর দরবারে তাদেরকে বাঁ দিকে দাঁড় করানো হবে।
৭.
السَّابِقُينَ (অগ্রগামীগণ) অর্থ যারা সৎকাজ ও ন্যায়পরায়ণতায় সবাইকে অতিক্রম করেছে, প্রতিটি কল্যাণকর কাজে সবার আগে থেকেছে। আল্লাহ ও রসূলের আহবানে সবার আগে সাড়া দিয়েছে, জিহাদের ব্যাপারে হোক কিংবা আল্লাহর পথে খরচের ব্যাপারে হোক কিংবা জনসেবার কাজ হোক কিংবা কল্যাণের পথে দাওয়াত কিংবা সত্যের পথে দাওয়াতের কাজ হোক মোট কথা পৃথিবীতে কল্যাণের প্রসার এবং অকল্যাণের উচ্ছেদের জন্য ত্যাগ ও কুরবানী এবং শ্রমদান জীবনপনের যে সুযোগই এসেছে তাতে সে-ই অগ্রগামী হয়ে কাজ করেছে। এ কারণে আখেরাতেও তাদেরকেই সবার আগে রাখা হবে। অর্থাৎ আখেরাতে আল্লাহ তা’আলার দরবারের চিত্র হবে এই যে, ডানে থাকবে ‘সালেহীন’ বা (নেককারগণ, বাঁয়ে থাকবে ফাসেক বা পাপীরা এবং সবার আগে আল্লাহ তা’আলার দরবারের নিকটে থাকবেন ‘সাবেকীন’গণ। হাদীসে হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছ যে, রসূলুল্লাহ ﷺ লোকদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি জান কিয়ামতের দিন কারা সর্বপ্রথম পৌঁছবে এবং আল্লাহর ছায়ায় স্থান লাভ করবে? সবাই বললেনঃ আল্লাহ এবং আল্লাহর রসূলই ভাল জানেন। তিনি বললেনঃ

الَّذِينَ إِذَا أُعْطُوا الْحَقَّ قَبِلُوهُ وَإِذَا سُئِلُوهُ بَذَلُوهُ وَحَكَمُوا لِلنَّاسِ كَحُكْمِهِمْ لأَنْفُسِهِمْ-

“যাদের অবস্থা ছিল এই যে, তাদের সামনে যখনই সত্য পেশ করা হয়েছে, তা গ্রহণ করেছে। যখনই তাদের কাছে প্রাপ্য চাওয়া হয়েছে, তখনই তা দিয়ে দিয়েছে। আর তারা নিজেদের ব্যাপারে যে ফায়সালা করেছে অন্যদের ব্যাপারেও সেই ফায়সালা করেছে।” (মুসনাদে আহমাদ)।

অনুবাদ: