পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

৫৬৪ আয়াত

৩ ) যাতে একেবারে সঠিক কথা লেখা আছে।
فِيهَا كُتُبٌۭ قَيِّمَةٌۭ ٣
৪ ) প্রথমে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে তো বিভেদ সৃষ্টি হলো তাদের কাছে (সত্য পথের) সুস্পষ্ট প্রমাণ এসে যাওয়ার পর।
وَمَا تَفَرَّقَ ٱلَّذِينَ أُوتُوا۟ ٱلْكِتَـٰبَ إِلَّا مِنۢ بَعْدِ مَا جَآءَتْهُمُ ٱلْبَيِّنَةُ ٤
৫ ) তাদেরকে তো এছাড়া আর কোন হুকুম দেয়া হয়নি যে, তারা নিজেদের দ্বীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদাত করবে, নামায কায়েম করবে ও যাকাত দেবে, এটিই যথার্থ সত্য ও সঠিক দ্বীন।
وَمَآ أُمِرُوٓا۟ إِلَّا لِيَعْبُدُوا۟ ٱللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ وَيُقِيمُوا۟ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤْتُوا۟ ٱلزَّكَوٰةَ ۚ وَذَٰلِكَ دِينُ ٱلْقَيِّمَةِ ٥
৬ ) আহলি কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা কুফরী করেছে তারা নিশ্চিতভাবে জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে। তারা সৃষ্টির অধম।
إِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ مِنْ أَهْلِ ٱلْكِتَـٰبِ وَٱلْمُشْرِكِينَ فِى نَارِ جَهَنَّمَ خَـٰلِدِينَ فِيهَآ ۚ أُو۟لَـٰٓئِكَ هُمْ شَرُّ ٱلْبَرِيَّةِ ٦
৭ ) যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তারা নিশ্চিত ভাবে সৃষ্টির সেরা। ১০
إِنَّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ أُو۟لَـٰٓئِكَ هُمْ خَيْرُ ٱلْبَرِيَّةِ ٧
৮ ) তাদের পুরস্কার রয়েছে তাদের রবের কাছে চিরস্থায়ী জান্নাত, যার নিম্নদেশে ঝরণাধারা প্রবাহিত। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আল্লাহ‌ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। এসব সে ব্যক্তির জন্য যে তার রবকে ভয় করে। ১১
جَزَآؤُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ جَنَّـٰتُ عَدْنٍۢ تَجْرِى مِن تَحْتِهَا ٱلْأَنْهَـٰرُ خَـٰلِدِينَ فِيهَآ أَبَدًۭا ۖ رَّضِىَ ٱللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا۟ عَنْهُ ۚ ذَٰلِكَ لِمَنْ خَشِىَ رَبَّهُۥ ٨
১ ) যখন পৃথিবীকে প্রবলবেগে ঝাঁকুনি দেয়া হবে।
إِذَا زُلْزِلَتِ ٱلْأَرْضُ زِلْزَالَهَا ١
২ ) পৃথিবী তার ভেতরের সমস্ত ভার বাইরে বের করে দেবে।
وَأَخْرَجَتِ ٱلْأَرْضُ أَثْقَالَهَا ٢
৩ ) আর মানুষ বলবে, এর কি হয়েছে?
وَقَالَ ٱلْإِنسَـٰنُ مَا لَهَا ٣
৪ ) সেদিন সে তার নিজের (ওপর যা কিছু ঘটেছে সেই) সব অবস্থা বর্ণনা করবে।
يَوْمَئِذٍۢ تُحَدِّثُ أَخْبَارَهَا ٤
.
৬.
অর্থাৎ ইতিপূর্বে আহলি কিতাবরা বিভিন্ন ভুল পথে পাড়ি জমিয়ে যেসব বিভিন্ন দল ও উপদলের উদ্ভব ঘটিয়ে ছিল তার কারণ এ ছিল না যে, মহান আল্লাহ‌ নিজের পক্ষ থেকে তাদেরকে পথ দেখাবার জন্য সুস্পষ্ট প্রমাণ পাঠাবার ব্যাপারে কোন ফাঁক রেখেছিলেন। বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে পথনির্দেশনা আসার পর তারা নিজেরাই এ কর্মনীতি অবলম্বন করেছিল। কাজেই নিজেদের গোমরাহীর জন্য তারা নিজেরাই দায়ী ছিল। কারণ তাদেরকে সঠিক পথ দেখাবার জন্য পূর্ণাংগ ব্যবস্থা অবলম্বন করে প্রমাণ পূর্ণ করা হয়েছিল। অনুরূপভাবে এখন যেহেতু তাদের সহীফাগুলো পাক-পবিত্র ছিল না এবং তাদের কিতাব গুলো একেবারে সত্য সঠিক, শিক্ষা সম্বলিত ছিল না, তাই মহান আল্লাহ‌ একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ হিসেবে নিজের একজন রসূল পাঠিয়ে এবং তাঁর মাধ্যমে পুরোপুরি শর্ত-সঠিক শিক্ষা সম্বলিত পাক পবিত্র সহীফা পেশ করে আবার তাদের ওপর প্রমাণ পূর্ণ করে দিলেন। ফলে এর পরেও যদি তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয় তাহলে এর দায়িত্ব তাদের ওপরই বর্তাবে। আল্লাহর মোকাবেলায় তারা কোন প্রমাণ পেশ করতে পারবে না। কুরআন মজীদের বহু জায়গায় একথা বলা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ দেখুন সূরা আল বাকারা ২১৩-২৫৩ আয়াত, আলে ইমরান ১৯ আয়াত, আল মায়েদাহ ৪৪-৫০ আয়াত, ইউসুফ ৯৩ আয়াত, আশ শূরা ১৩-১৫ আয়াত, আল জাসিয়াহ ১৬-১৮ আয়াত। এই সাথে তাফহীমুল কুরআনে এসব আয়াতের আমি যে ব্যাখ্যাগুলো লিখেছি সেগুলোর ওপরও যদি একবার নজর বুলানো যায় তাহলে বক্তব্যটি অনুধাবন করা আরো সহজ হবে।
৭.
অর্থাৎ মুহাম্মাদ ﷺ যে দ্বীনটি পেশ করছেন। আহলি কিতাবদের কাছে যেসব কিতাব নাযিল করা হয়েছিল এবং তাদের কাছে যেসব নবী এসেছিলেন তারাও তাদেরকে সেই একই দ্বীনের তালীম দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে যেসব বাতিল আকীদা-বিশ্বাস গ্রহণ করে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কাজ-কর্মের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল তার কোনটিরও হুকুম তারা দেননি। সবসময় সত্য ও সঠিক দ্বীন একটিই ছিল। আর সেটি হচ্ছেঃ একমাত্র আল্লাহর বন্দেগী করতে হবে। তাঁর বন্দেগীর সাথে আর কারো বন্দেগীর মিশ্রণ ঘটানো যাবে না। সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে এনে একমাত্র আল্লাহর পূজারী এবং তাঁর ফরমানের অনুগত হতে হবে। নামায কায়েম করতে হবে। যাকাত দিতে হবে। (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন আল আ’রাফ ১৯ টীকা, ইউনুস ১০০-১০৯ টীকা, আররূম ৪৩-৪৭ টীকা এবং আয যুমার ৩-৪টীকা। )

এই আয়াতে ‘দ্বীনুল কাইয়েমা’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কোন কোন মুফাসসির একে دِيْنُ المِلَّتِ الْقَيِّمَتٍ অর্থাৎ “সত্য-সঠিক পথাশ্রয়ী মিল্লাতের দ্বীন” অর্থে নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ একে বিশেষ্যের সাথে বিশেষণের সম্বন্ধ হিসেবে গণ্য করেছেন এবং قَيِّمَتٌ এর ه কে عَلَّامَهٌفَهَّامَه এর মতো অত্যধিক বৃদ্ধি অর্থে গ্রহণ করেছেন। আমি এখানে অনুবাদে যে অর্থ গ্রহণ করেছি তাদের মতে এর অর্থও তাই।

৮.
এখানে কুফরী মানে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মেনে নিতে অস্বীকার করা। অর্থাৎ মুশরিক ও আহলি কিতাবদের মধ্য থেকে যারা এই রসূলের নবুওয়াত লাভের পর তাঁকে মানেনি। অথচ তাঁর অস্তিত্বই একটি সুস্পষ্ট ও উজ্জ্বল প্রমাণ। তিনি সম্পূর্ণ ও নির্ভুল লিপি সম্বলিত মত পবিত্র সহীফা পাঠ করে তাদেরকে শুনাচ্ছেন। এ ধরনের লোকদের পরিণাম তাই হবে যা সামনের দিকে বর্ণনা করা হচ্ছে।
৯.
অর্থাৎ আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে তাদের চেয়ে নিকৃষ্ট সৃষ্টি আর নেই। এমন কি তারা পশুরও অধম। কারণ পশুর বুদ্ধি ও স্বাধীন চিন্তা ও কর্মশক্তি নেই। কিন্তু এরা বুদ্ধি ও স্বাধীন চিন্তা ও কর্মশক্তি সত্ত্বেও সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
১০.
অর্থাৎ তারা আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সবার এমনকি ফেরেশতাদেরও সেরা। কারণ ফেরেশতারা আল্লাহর নাফরমানি করার স্বাধীন ক্ষমতা রাখে না। আর মানুষ এই নাফরমানি করার স্বাধীন ক্ষমতা রাখা সত্ত্বেও আনুগত্যের পথ অবলম্বন করে।
১১.
অন্য কথায় যে ব্যক্তি আল্লাহর ব্যাপারে নির্ভীক এবং তাঁর মোকাবিলায় দুঃসাহসী ও বেপরোয়া হয়ে জীবন যাপন করে না। বরং দুনিয়ায় প্রতি পদে পদে আল্লাহকে ভয় করে জীবন যাপন করে। প্রতি পদক্ষেপে যে ব্যক্তি মনে করে, কোথাও আমি এমন কোনো কাজ তো করে বসিনি যার ফলে আল্লাহ‌ আমাকে পাকড়াও করে ফেলেন, তার জন্য আল্লাহর কাছে রয়েছে এই প্রতিদান ও পুরস্কার।
১.
মূল শব্দগুলো হচ্ছে, زُلْزِلَتِ الْأَرْضُ زِلْزَالَهَا ‘যালযালাহু’ মানে হচ্ছে, একাদিক্রমে পরপর জোরে জোরে ঝাড়া দেয়া। কাজেই زُلْزِلَتِ الْأَرْضُ বলতে ধাক্কার পর ধাক্কা দিয়ে এবং ভূমিকম্পের পর ভূমিকম্পের মাধ্যমে পৃথিবীকে ভীষণভাবে কাঁপিয়ে দেয়া হবে। আর যেহেতু পৃথিবীকে নাড়া দেবার কথা বলা হয়েছে তাই এ থেকে আপনা-আপনিই এই অর্থ বের হয়ে আসে যে, পৃথিবীর কোন একটি অংশ কোন একটি স্থান বা অঞ্চল নয় বরং সমগ্র পৃথিবীকে কম্পিত করে দেয়া হবে। তারপর এই নাড়া দেবার এই ভূকম্পনের ভয়াবহতা আরো বেশী করে প্রকাশ করার জন্য তার সাথে বাড়তি زِلْزَالَهَا শব্দটিও বসিয়ে দেয়া হয়েছে। এ শব্দটির শাব্দিক মানে হচ্ছে, “কম্পিত হওয়া।” অর্থাৎ তার মতো বিশাল ভূগোলককে যে ভাবে ঝাঁকানি দিলে কাঁপে অথবা যেভাবে ঝাঁকানি দিলে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে ভীষণভাবে কাঁপে ঠিক সেভাবে তাকে ঝাঁকানি দেয়া হবে। কোন কোন মুফাসসির এই কম্পনকে প্রথম কম্পন ধরে নিয়েছেন। তাদের মতে কিয়ামতের প্রথম পর্বের সূচনা হবে যে কম্পন থেকে এটি হচ্ছে সেই কম্পন। অর্থাৎ যে কম্পনের পর দুনিয়ার সব সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাবে এবং তার সমগ্র ব্যবস্থাপনা ওলট-পালট হয়ে যাবে। কিন্তু মুফাসসিরগণের একটি বড় দলের মতে যে কম্পনের মাধ্যমে কিয়ামতের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হবে অর্থাৎ যখন আগের পিছের সমস্ত মানুষ পুনর্বার জীবিত হয়ে উঠবে, এটি সেই কম্পন। এই দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি বেশী নির্ভুল। কারণ পরবর্তী সমস্ত আলোচনায় এই বিষয়টির প্রকাশ ঘটেছে।
২.
এই বিষয়টি সূরা ইনশিকাকের ৪ আয়াতে এভাবে বলা হয়েছে وَأَلْقَتْ مَا فِيهَا وَتَخَلَّتْ “আর যা কিছু তার মধ্যে রয়েছে তা বাইরে নিক্ষেপ করে দিয়ে খালি হয়ে যাবে।” এর কয়েকটি অর্থ হতে পারে। এক, মরা মানুষ মাটির বুকে যেখানে যে অবস্থায় যে আকৃতিতে আছে তাদের সবাইকে বের করে এনে সে বাইরে ফেলে দেবে। আর পরবর্তী বাক্য থেকে একথা প্রকাশ হচ্ছে যে, সে সময় তাদের সমস্ত শরীরের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অংশগুলো এক জায়গায় জমা হয়ে নতুন করে আবার সেই একই আকৃতি সহকারে জীবিত হয়ে উঠবে যেমন সে তার প্রথম জীবনের অবস্থায় ছিল। দুই, এর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, কেবলমাত্র মরা মানুষদেরকে সে বাইরে নিক্ষেপ করে ক্ষান্ত হবে না বরং তাদের প্রথম জীবনের সমস্ত কথা ও কাজ এবং যাবতীয় আচার-আচরণের রেকর্ড ও সাক্ষ্য-প্রমাণের যে বিশাল স্তূপ তার গর্ভে চাপা পড়ে আছে সেগুলোকেও বের করে বাইরে ফেলে দেবে। পরবর্তী বাক্যটিতে একথারই প্রকাশ ঘটেছে। তাতে বলা হয়েছে, যমীন তার ওপর যা কিছু ঘটেছে তা বর্ণনা করবে। তিন, কোন কোন মুফাসসির এর তৃতীয় একটি অর্থও বর্ণনা করেছেন। সেটি হচ্ছে, সোনা, রূপা, মণিমাণিক্য এবং অন্যান্য যেসব মূল্যবান সম্পদ ভূ-গর্ভে সঞ্চিত রয়েছে সেগুলোর বিশাল বিশাল স্তূপ ও সেদিন যমীন উগড়ে দেবে। মানুষ দেখবে, এগুলোর জন্য তারা দুনিয়ায় প্রাণ দিতো। এগুলো কবজা করার জন্য তারা পরস্পর হানাহানি ও কাটাকাটি করতো। হকদারদের হক মেরে নিতো। চুরি ডাকাতি করতো, জলে-স্থলে দস্যুতা করতো। যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হতো এবং এক একটি সম্প্রদায় ও জাতিকে ধ্বংস করে দিতো। আজ এসব কিছু তাদের সামনে উপস্থিত। অথচ এগুলো এখন আর তাদের কোনো কাজে লাগবে না বরং উল্টো তাদের জন্য আযাবের সরঞ্জাম হয়ে রয়েছে।
৩.
মানুষ অর্থ প্রত্যেকটি মানুষ হতে পারে। কারণ পুনরায় জীবন লাভ করে চেতনা ফিরে পাবার সাথে সাথেই প্রত্যেক ব্যক্তির প্রথম প্রতিক্রিয়া এটিই হবে যে, এসব কি হচ্ছে? এটা যে হাশরের দিন একথা সে পরে বুঝতে পারবে। আবার মানুষ অর্থ আখেরাত অস্বীকারকারী মানুষ ও হতে পারো। কারণ যে বিষয়কে অসম্ভব মনে করতো তা তার সামনে ঘটে যেতে থাকবে এবং সে এসব দেখে অবাক ও পেরেশান হবে। তবে ঈমানদারদের মনে এ ধরনের বিস্ময় ও পেরেশানি থাকবে না। কারণ তখন তাদের আকীদা-বিশ্বাস ও প্রত্যয় অনুযায়ীই সবকিছু হতে থাকবে। সূরা ইয়াসিনের ৫২ আয়াতটি এই দ্বিতীয় অর্থটি কতকটা সমর্থন করে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সে সময় আখেরাত অস্বীকারকারীরা বলবেঃ مَنْ بَعَثَنَا مِنْ مَرْقَدِنَا “কে আমাদের শয়নাগার থেকে আমাদের উঠালো? ” এর জবাব আসবেঃ هَذَا مَا وَعَدَ الرَّحْمَنُ وَصَدَقَ الْمُرْسَلُونَ “এটি সেই জিনিস যার ওয়াদা করুণাময় করেছিলেন এবং আল্লাহর পাঠানো রসূলগণ সত্য বলেছিলেন।” ঈমানদাররাই যে কাফেরদেরকে এই জবাব দেবে, এ ব্যাপারে এই আয়াতটি সুস্পষ্ট নয়। কারণ আয়াতে একথা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। তবে ঈমানদারদের পক্ষ থেকে তারা এই জবাব পাবে, এ সম্ভাবনা অবশ্যি এখানে আছে।
৪.
হযরত আবু হুরাইরা (রা.) রেওয়ায়াত করেছেন, রসূলুল্লাহ ﷺ এ আয়াতটি পড়ে জিজ্ঞেস করেনঃ “জানো তার সেই অবস্থা কি? ” লোকেরা জবাব দেয়, আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূল ভালো জানেন। রসূল ﷺ বলেনঃ “সেই অবস্থা হচ্ছে, যমীনের পিঠে প্রত্যেক মানব মানবী যে কাজ করবে সে তার সাক্ষ্য দেবে। সে বলবে, এই ব্যক্তি অমুক দিন অমুক কাজ করেছিল। এই হচ্ছে সেই অবস্থা, যা যমীন বর্ণনা করবে।” (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে জারীর, আবদ ইবনে হুমাইদ, ইবনুল মুনযির, হাকেম, ইবনে মারদুইয়া এবং বায়হাকী ফিশশু’আব) হযরত রাবআহ আল খারাশী রেওয়ায়াত করেছেন, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, “যমীন থেকে তোমরা নিজেদেরকে রক্ষা করে চলবে। কারণ এ হচ্ছে তোমাদের মূল ভিত্তি। আর এমনকোন ব্যক্তি নেই যে এর ওপর ভালো মন্দ কোনো কাজ করে এবং সে তার খবর দেয় না।” (মু ’জামুত তাবরানী) হযরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন যমীন এমন প্রতিটি কাজ নিয়ে আসবে। যা তার পিঠের ওপর করা হয়েছে।” তারপর তিনি এই আয়াতটি তেলাওয়াত করেন। (ইবনে মারদুইয়া, বায়হাকী) হযরত আলী (রা.) সংক্রান্ত জীবনীগ্রন্থে লিখিত হয়েছেঃ বায়তুলমালের সমুদয় সম্পদ যখন তিনি হকদারদের মধ্যে বণ্টন করে সব খালি করে দিতেন তখন সেখানে দু’রাকাত নফল নামায পড়তেন। তারপর বলতেনঃ “তোকে সাক্ষ্য দিতে হবে, আমি তোকে সত্য সহকারে ভরেছি এবং সত্য সহকারে খালি করেছি।”

যমীনের ওপর যা কিছু ঘটে গেছে তার সবকিছু সে কিয়ামতের দিন বলে দেবে, যমীন সম্পর্কে একথাটি প্রাচীন যুগে মানুষকে অবাক করে দিয়ে থাকবে, এতে সন্দেহ নেই। কারণ তারা মনে করে থাকবে, যমীন আবার কেমন করে কথা বলবে? কিন্তু আজ পদার্থবিদ্যা সংক্রান্ত নতুন নতুন জ্ঞান-গবেষণা, আবিষ্কার--উদ্ভাবন এবং সিনেমা, লাউড স্পীকার, রেডিও, টেলিভিশন, টেপ রেকর্ডার ও ইলেকট্রনিক্স ইত্যাদির আবিষ্কারের এ যুগে যমীন তার নিজের অবস্থা ও নিজের ওপর ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী কিভাবে বর্ণনা করবে একথা অনুধাবন করা মোটেই কঠিন নয়। মানুষ তার মুখ থেকে যা কিছু উচ্চারণ করে তার পূর্ণ অবয়ব বাতাসে, রেডিও তরঙ্গে, ঘরের দেয়ালে, মেঝে ও ছাদের প্রতি অণু-পরমাণুতে এবং কোন পথে, ময়দানে বা ক্ষেতে কোন কথা বলে থাকলে সেখানকার প্রতিটি অণু কণিকায় তা গেঁথে আছে। আল্লাহ‌ যখনি চাইবেন একথাগুলোকে এসব জিনিসের মাধ্যমে তখনই হুবহু ঠিক তেমনিভাবে শুনিয়ে দিতে পারবেন যেভাবে সেগুলো একদিন মানুষের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল। সে সময় মানুষ নিজের কানেই নিজের এই আওয়াজ শুনে নেবে। তার পরিচিতিজনেরাও তার এই আওয়াজ চিনে নেবে এবং তারা একে তারই কন্ঠধ্বনি ও বাকভঙ্গীমা বলে সনাক্ত করবে। তারপর মানুষ যমীনের যেখানেই যে অবস্থায় যেকোনো কাজ করেছে তার প্রতিটি নড়াচড়া ও অঙ্গভঙ্গীর প্রতিচ্ছবি তার চারপাশের সমস্ত বস্তুতে পড়েছে এবং সেগুলোর মধ্যে সেসব চিত্রায়িত হয়ে রয়েছে। একেবারে নিকষ কালো আঁধারের বুকে সে কোনো কাজ করে থাকলেও আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধীন এমনসব রশ্মি রয়েছে যেগুলোর কাছে আলো-আঁধার সমান, তারা সকল অবস্থায় তার ছবি তুলতে পারে। এসব ছবি কিয়ামতের দিন একটি সচল ফিল্মের মতো মানুষের সামনে এসে যাবে এবং সারাজীবন সে কোথায় কি করেছে তা তাকে দেখিয়ে দেবে।

আসলে প্রত্যেক মানুষের কর্মকাণ্ড আল্লাহ‌ সরাসরি জানলেও আখেরাতে যখন তিনি আদালত কায়েম করবেন তখন সেখানে যাকেই শাস্তি দেবেন ইনসাফ ও ন্যায়নীতির দাবী পুরোপুরি পালন করেই শাস্তি দেবেন। তাঁর আদালতে প্রত্যেকটি অপরাধী মানুষের বিরুদ্ধে যে মামলা দায়ের করা হবে তার সপক্ষে এমনসব অকুটিল সাক্ষ্য-প্রমাণ পেশ করা হবে যার ফলে তার অপরাধী হবার ব্যাপারে কারো কোন কথা বলার অবকাশ থাকবে না। সর্বপ্রথম পেশ করা হবে তার আমলনামা। সবসময় তার সাথে লেগে থাকা কেরামান কাতেবীন ফেরেশতাদ্বয় তার প্রত্যেকটি কথা ও কাজ রের্কড করছেন। (সূরা কাফ-১৭ আয়াত, সূরা ইনফিতার ১০-১২ আয়াত) এ আমলনামা তার হাতে দিয়ে দেয়া হবে। তাকে বলা হবে, তোমার জীবনের এই কার্যবিবরণী পড়ো। নিজের হিসেবে নেবার জন্য তুমি নিজেই যথেষ্ট। (বনি ইসরাঈল ১৪) মানুষ তা পড়ে অবাক হয়ে যাবে। কারণ ছোট বড় এমন কোন বিষয় নেই যা তাতে যথাযথভাবে সংযোজিত হয়নি। (আল কাহাফ ৪৯) এরপর হচ্ছে মানুষের নিজের শরীর। দুনিয়ায় এই শরীরের সাহায্যে সে সমস্ত কাজ করেছে। আল্লাহর আদালতে তার জিহবা সাক্ষ্য দেবে, সে দুনিয়ায় কি কি কথা বলে‌ছে, তার নিজের হাত পা সাক্ষ্য দেবে তাদেরকে দিয়ে সে কোন্‌ কোন্‌ কাজ করিয়েছে। (আন নূর ২৪) তার চোখজোড়া সাক্ষ্য দেবে। তার কান সাক্ষ্য দেবে, তার সাহায্যে সে কি কি কথা শুনেছে। তার শরীরের গায়ে লেপ্টে থাকা চামড়া তার যাবতীয় কাজের সাক্ষ্য দেবে। সে পেরেশান হয়ে নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বলবে, তোমরাও আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছো? তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জবাব দেবে, আজ যে আল্লাহর হুকুমে সমস্ত জিনিস চলছে তাঁরই হুকুমে আমরাও চলছি। (হা-মীম সাজদাহ ২০ থেকে ২২) এরপরে আছে আরো অতিরিক্ত সাক্ষ্য। এই সাক্ষ্যগুলো পেশ করা হবে যমীন ও তার চারপাশের সমগ্র পরিবেশ থেকে। সেখানে নিজের আওয়াজ মানুষ নিজের কানে শুনবে। নিজের প্রতিটি কাজকর্মের প্রতিচ্ছবি নিজের চোখেই দেখবে। এর চাইতেও অগ্রসর হয়ে দেখা যাবে, মানুষের মনে যেসব চিন্তা, ইচ্ছা, সংকল্প ও উদ্দেশ্য লুকিয়ে ছিল এবং যেসব নিয়তের মাধ্যমে সে নিজের সমস্ত কাজ করেছিল তাও সব সামনে এনে রেখে দেয়া হবে। যেমন সামনে সূরা আদিয়াতে এ বিষয়ে আলোচনা আসছে। এ কারণে এবং এ ধরনের চূড়ান্ত ও জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ সামনে এসে যাবার পর মানুষ অবাক ও নির্বাক হয়ে যাবে। নিজের পক্ষ থেকে ওজর পেশ করার কোন সুযোগই তার থাকবে না। (আল মুরসালাত ৩৫-৩৬)

অনুবাদ: