পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

১৪৯ আয়াত

৮২ ) ঈমানদারদের সাথে শত্রুতার ক্ষেত্রে তুমি ইহুদী ও মুশরিকদের পাবে সবচেয়ে বেশী উগ্র। আর ঈমানদারদের সাথে বন্ধুত্বের ব্যাপারে নিকটতম পাবে তাদেরকে যারা বলেছিল আমরা আল্লাহর সাহায্যকারী। এর কারণ হচ্ছে, তাদের মধ্যে ইবাদাতকারী আলেম, সংসার বিরাগী দরবেশ পাওয়া যায়, আর তাদের মধ্যে আত্মগরিমা নেই।
۞ لَتَجِدَنَّ أَشَدَّ ٱلنَّاسِ عَدَٰوَةًۭ لِّلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ ٱلْيَهُودَ وَٱلَّذِينَ أَشْرَكُوا۟ ۖ وَلَتَجِدَنَّ أَقْرَبَهُم مَّوَدَّةًۭ لِّلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ ٱلَّذِينَ قَالُوٓا۟ إِنَّا نَصَـٰرَىٰ ۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّ مِنْهُمْ قِسِّيسِينَ وَرُهْبَانًۭا وَأَنَّهُمْ لَا يَسْتَكْبِرُونَ ٨٢
৮৩ ) যখন তারা এ কালাম শোনে, যা রসূলের ওপর নাযিল হয়েছে, তোমরা দেখতে পাও, সত্যকে চিনতে পারার কারণে তাদের চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। তারা বলে ওঠে, “হে আমাদের রব! আমরা ঈমান এনেছি, সাক্ষ্যদাতাদের মধ্যে আমাদের নাম লিখে নাও।”
وَإِذَا سَمِعُوا۟ مَآ أُنزِلَ إِلَى ٱلرَّسُولِ تَرَىٰٓ أَعْيُنَهُمْ تَفِيضُ مِنَ ٱلدَّمْعِ مِمَّا عَرَفُوا۟ مِنَ ٱلْحَقِّ ۖ يَقُولُونَ رَبَّنَآ ءَامَنَّا فَٱكْتُبْنَا مَعَ ٱلشَّـٰهِدِينَ ٨٣
৮৪ ) আর তারা আরো বলে, “আমরা আল্লাহর ওপর ঈমান কেন আনবো না এবং যে সত্য আমাদের কাছে এসেছে তাকে কেন মেনে নেবো না-যখন আমরা এ ইচ্ছা পোষণ করে থাকি যে, আমাদের রব যেন আমাদের সৎ ও সত্যনিষ্ঠ লোকদের অন্তর্ভুক্ত করেন।”
وَمَا لَنَا لَا نُؤْمِنُ بِٱللَّهِ وَمَا جَآءَنَا مِنَ ٱلْحَقِّ وَنَطْمَعُ أَن يُدْخِلَنَا رَبُّنَا مَعَ ٱلْقَوْمِ ٱلصَّـٰلِحِينَ ٨٤
৮৫ ) তাদের এ উক্তির কারণে আল্লাহ তাদেরকে এমনসব জান্নাত দান করেছেন যার নিম্নদেশ দিয়ে ঝরণাধারা প্রবাহিত হয় এবং তারা সেখানে থাকবে চিরকালের জন্য। সৎ-কর্মনীতি অবলম্বনকারীদের জন্য এ প্রতিদান।
فَأَثَـٰبَهُمُ ٱللَّهُ بِمَا قَالُوا۟ جَنَّـٰتٍۢ تَجْرِى مِن تَحْتِهَا ٱلْأَنْهَـٰرُ خَـٰلِدِينَ فِيهَا ۚ وَذَٰلِكَ جَزَآءُ ٱلْمُحْسِنِينَ ٨٥
৮৬ ) আর যারা আমার আয়াত মানতে অস্বীকার করেছে ও সেগুলোকে মিথ্যা বলেছে, তারা জাহান্নামের অধিবাসী হবে।
وَٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ وَكَذَّبُوا۟ بِـَٔايَـٰتِنَآ أُو۟لَـٰٓئِكَ أَصْحَـٰبُ ٱلْجَحِيمِ ٨٦
৮৭ ) হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ‌ তোমাদের জন্য যেসব পবিত্র জিনিস হালাল করেছেন সেগুলো হারাম করে নিয়ো না। ১০৪ আর সীমালংঘন করো না। ১০৫ সীমা-লংঘনকরীদেরকে আল্লাহ‌ ভীষণভাবে অপছন্দ করেন।
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا تُحَرِّمُوا۟ طَيِّبَـٰتِ مَآ أَحَلَّ ٱللَّهُ لَكُمْ وَلَا تَعْتَدُوٓا۟ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ ٱلْمُعْتَدِينَ ٨٧
৮৮ ) আল্লাহ তোমাদের যে হালাল ও পবিত্র রিযিক দিয়েছেন তা থেকে পানাহার করো এবং সেই আল্লাহর নাফরমানী থেকে দূরে থাকো যার ওপর তোমরা ঈমান এনেছো।
وَكُلُوا۟ مِمَّا رَزَقَكُمُ ٱللَّهُ حَلَـٰلًۭا طَيِّبًۭا ۚ وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ ٱلَّذِىٓ أَنتُم بِهِۦ مُؤْمِنُونَ ٨٨
৮৯ ) তোমরা যে সমস্ত অর্থহীন কসম খেয়ে ফেলো। সে সবের জন্য আল্লাহ‌ তোমাদের পাকড়াও করেন না। কিন্তু তোমরা জেনে বুঝে যেসব কসম খাও সেগুলোর ওপর তিনি অবশ্যি তোমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। (এ ধরনের কসম ভেঙে ফেলার) কাফ্‌ফারা হচ্ছে, দশ জন মিসকিনকে এমন মধ্যম পর্যায়ের আহার দান করো যা তোমরা নিজেদের সন্তানদের খেতে দাও অথবা তাদেরকে কাপড় পরাও বা একটি গোলামকে মুক্ত করে দাও। আর যে ব্যক্তি এর সামর্থ্য রাখে না সে যেন তিন দিন রোযা রাখে। এ হচ্ছে তোমাদের কসমের কাফ্‌ফারা যখন তোমরা কসম খেয়ে তা ভেঙে ফেলো। ১০৬ তোমাদের কসমসমূহ সংরক্ষণ করো। ১০৭ এভাবে আল্লাহ‌ নিজের বিধান তোমাদের জন্য সুস্পষ্ট করেন, হয়তো তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।
لَا يُؤَاخِذُكُمُ ٱللَّهُ بِٱللَّغْوِ فِىٓ أَيْمَـٰنِكُمْ وَلَـٰكِن يُؤَاخِذُكُم بِمَا عَقَّدتُّمُ ٱلْأَيْمَـٰنَ ۖ فَكَفَّـٰرَتُهُۥٓ إِطْعَامُ عَشَرَةِ مَسَـٰكِينَ مِنْ أَوْسَطِ مَا تُطْعِمُونَ أَهْلِيكُمْ أَوْ كِسْوَتُهُمْ أَوْ تَحْرِيرُ رَقَبَةٍۢ ۖ فَمَن لَّمْ يَجِدْ فَصِيَامُ ثَلَـٰثَةِ أَيَّامٍۢ ۚ ذَٰلِكَ كَفَّـٰرَةُ أَيْمَـٰنِكُمْ إِذَا حَلَفْتُمْ ۚ وَٱحْفَظُوٓا۟ أَيْمَـٰنَكُمْ ۚ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ ٱللَّهُ لَكُمْ ءَايَـٰتِهِۦ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ ٨٩
৯০ ) হে ঈমানদারগণ! এ মদ, জুয়া, মূর্তি পূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শরসমূহ ১০৮ এ সমস্তই হচ্ছে ঘৃণ্য শয়তানী কার্যকলাপ। এগুলো থেকে দূরে থাকো, আশা করা যায় তোমরা সফলতা লাভ করবে। ১০৯
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓا۟ إِنَّمَا ٱلْخَمْرُ وَٱلْمَيْسِرُ وَٱلْأَنصَابُ وَٱلْأَزْلَـٰمُ رِجْسٌۭ مِّنْ عَمَلِ ٱلشَّيْطَـٰنِ فَٱجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ٩٠
৯১ ) শয়তান তো চায় মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও নামায থেকে তোমাদের বিরত রাখতে। তাহলে তোমরা কি এসব থেকে বিরত থাকবে?
إِنَّمَا يُرِيدُ ٱلشَّيْطَـٰنُ أَن يُوقِعَ بَيْنَكُمُ ٱلْعَدَٰوَةَ وَٱلْبَغْضَآءَ فِى ٱلْخَمْرِ وَٱلْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَن ذِكْرِ ٱللَّهِ وَعَنِ ٱلصَّلَوٰةِ ۖ فَهَلْ أَنتُم مُّنتَهُونَ ٩١
.
.
.
.
.
১০৪.
এ আয়াতে দু’টি কথা বলা হয়েছে। এক, তোমরা নিজেরাই কোন জিনিস হালাল ও হারাম গণ্য করার অধিকারী হয়ে বসো না। আল্লাহ যেটি হালাল করেছেন সেটি হালাল এবং আল্লাহ যেটি হারাম করেছেন সেটি হারাম। নিজেদের ক্ষমতা বলে তোমরা নিজেরা যদি কোন হালালকে হারাম করে ফেলো তাহলে আল্লাহর আইনের পরিবর্তে তোমরা নফসের ও প্রবৃত্তির আইনের অনুগত গণ্য হবে। দুই, খৃস্টীয় সন্ন্যাসী, হিন্দু যোগী, বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ইশরাকী তাসাউফ পন্থীদের মতো বৈরাগ্য, সংসার বিমুখতা ও দুনিয়ার বৈধ স্বাধ আস্বাদন পরিহার করার পদ্ধতি অবলম্বন করো না। ধর্মীয় মানসিকতার অধিকারী সৎস্বভাব সম্পন্ন লোকদের মধ্যে সাধারণভাবে এ প্রবণতা দেখা গেছে যে, শরীর ও প্রবৃত্তির অধিকার আদায় ও চাহিদা পূরণ করাকে তারা আধ্যাত্মিক উন্নতির অন্তরায় মনে করে থাকেন। তাদের ধারণা, নিজেকে কষ্টের মধ্যে নিক্ষেপ করা, নিজের প্রবৃত্তিকে পার্থিব ভোগ ও আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা এবং দুনিয়ার জীবন যাপনের বিভিন্ন উপায়-উপকরণের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করা মূলত একটি মহৎ কাজ এবং এছাড়া আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যেতে পারে না। সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যেও কেউ কেউ এ মানসিকতার অধিকারী ছিলেন। একবার নবী ﷺ জানতে পারলেন, কোন কোন সাহাবী অঙ্গীকার করেছেনঃ তারা সর্বক্ষণ রোযা রাখবেন, রাতে বিছানায় ঘুমাবেন না বরং সারা রাত জেগে ইবাদাত করবেন, গোশত, তেল, চর্বি, ঘি, ইত্যাদি ব্যবহার করবেন না, নারীদের সাথে সম্পর্ক রাখবেন না। একথা শুনে তিনি একটি ভাষণ দিলেন। তিনি বললেনঃ “আমাকে এ ধরনের কাজ করার হুকুম দেয়া হয়নি। তোমাদের প্রবৃত্তিরও তোমাদের ওপর অধিকার আছে। রোযা রাখো আবার পানাহারও করো। রাতে জেগে ইবাদাত করো আবার নিদ্রাও যাও। আমাকে দেখো। আমি ঘুমাই আবার রাত জেগে ইবাদাতও করি। রোযা রাখি আবার কখনো রাখিও না। গোশতও খাই আবার ঘিও খাই। কাজেই যে ব্যক্তি আমার রীতিনীতি পছন্দ করে না সে আমার অন্তর্ভুক্ত নয়।” তারপর আবার বললেনঃ “লোকদের কি হয়ে গেছে, তারা নারী, ভাল খাবার, সুগন্ধি, নিদ্রা ও দুনিয়ার স্বাদ আনন্দ নিজেদের জন্য হারাম করে নিয়েছে? আমি তোমাদের পাদ্রী ও সংসার ত্যাগী হয়ে যাবার শিক্ষা দেইনি। আমি যে দ্বীনের প্রচলন করেছি তাতে নারী ও গোশত থেকে দূরে থাকার কোন অবকাশ নেই এবং সেখানে সংসার ত্যাগ করে বৈরাগ্যবাদী জীবন যাপনেরও কোন সুযোগ নেই আত্মসংযমের জন্য আমার এখানে আছে রোযা। সংসার ত্যাগী জীবনের সমস্ত ফায়দা এখানে লাভ করা হয় জিহাদের মাধ্যমে। আল্লাহর বন্দেগী করো। তার সাথে কাউকে শরীক করো না। হজ্জ ও উমরাহ করো। নামায কায়েম করো, যাকাত দাও ও রমযানের রোযা রাখো। তোমাদের আগে যারা ধ্বংস হয়েছে তারা এ জন্য ধ্বংস হয়েছে যে, তারা নিজেদের ওপর কঠোরতা আরোপ করেছিল। আর যখন তারা নিজেরা নিজেদের ওপর কঠোরতা আরোপ করলো তখন আল্লাহও তাদের ওপর কঠোরতা আরোপ করলেন। তোমরা গীর্জায় ও খানকাহে যাদেরকে দেখছো এরা হচ্ছে তাদেরই অবশিষ্ট উত্তরসূরী।”

এ প্রসঙ্গে কোন কোন রেওয়ায়াত থেকে এতদূরও জানা যায় যে, একজন সাহাবীর ব্যাপারে নবী ﷺ জানতে পারলেন, তিনি দীর্ঘদিন থেকে নিজের স্ত্রী সান্নিধ্য যাচ্ছেন না এবং রাত দিন ইবাদাতে মশগুল থাকছেন। তিনি তাকে ডেকে হুকুম দিলেন, এখনি তোমার স্ত্রীর কাছে যাও। সাহাবী জবাব দিলেন, আমি রোযা রেখেছি। জবাব দিলেন, রোযা ভেঙ্গে ফেলো এবং স্ত্রীর কাছে যাও। হযরত উমরের আমলে জনৈকা মহিলা অভিযোগ করলেন, আমার স্বামী সারাদিন রোযা রাখেন, রাতে ইবাদাত করেন এবং আমার সাথে কোন সম্পর্ক রাখেন না। হযরত উমর (রা.) তার মামলার নিষ্পত্তির জন্য প্রখ্যাত তাবেঈ বুযর্গ কা’ব ইবনে সাওরুল আযদিকে নিযুক্ত করলেন। তিনি ফায়সালা দিলেন, এ মহিলার স্বামী তিন রাত ইচ্ছা মতো ইবাদাত করতে পারেন কিন্তু চতুর্থ রাতে অবশ্যি তার স্ত্রীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

১০৫.
সীমালংঘন করার অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক। হালালকে হারাম করা এবং আল্লাহর নির্ধারিত পাক-পবিত্র জিনিসগুলো থেকে এমনভাবে দূরে সরে থাকা যেন সেগুলো নাপাক, এটাও এক ধরনের বাড়াবাড়ি। তারপর পাক পবিত্র জিনিসগুলো অযথা ও অপ্রয়োজনে ব্যয় করা, অপচয় ও অপব্যয় করা এবং প্রয়োজনের তুলনায় বেশী ও প্রচুর পরিমাণে ব্যয় করাও এক ধরনের বাড়াবাড়ি। আবার হালালের সীমা পেরিয়ে হারামের সীমানায় প্রবেশ করাও বাড়াবাড়ি। এ তিনটি কাজই আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয়।
.
.
১০৬.
যেহেতু কোন কোন লোক হালাল জিনিসগুলো নিজেদের ওপর হারাম করে নেবার কসম খেয়েছিল তাই এ প্রসঙ্গে আল্লাহ‌ এ কসমের বিধানও বর্ণনা করে দিয়েছেন। সে বিধান হচ্ছে নিম্নরূপঃ যদি কোন ব্যক্তির মুখ থেকে অনিচ্ছকৃতভাবে কসম শব্দ বের হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে তা পূর্ণ করার তেমন কোন প্রয়োজন নেই। কারণ এ ধরনের কসমের জন্য পাকড়াও করা হবে না। আর যদি কেউ জেনে বুঝে কসম খেয়ে থাকে...... সে যেন তা ভেঙে ফেলে এবং এ জন্য কাফফারা আদায় করে। কারণ যে ব্যক্তি কোন গুনাহের কাজ করার কসম খেয়ে বসে তার নিজের কসম পূর্ণ করা উচিত নয়। (দেখুন, সূরা বাকারা, টীকা ২৪৩, ২৪৪। এছাড়া কাফ্‌ফরার ব্যাখ্যার জন্য দেখুন সূরা আন নিসা, টীকা ১২৫)
১০৭.
কসম সংরক্ষণ করার কয়েকটি অর্থ হয়। এক, কসমকে সঠিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে। আজে বাজে অর্থহীন কথায় ও গুনাহের কাজে কসম খাওয়া যাবে না। দুই, কোন বিষয় কসম খেলে সেটা মনে রাখতে হবে, নিজের গাফলতির কারণে তা ভুলে গিয়ে তার বিরুদ্ধাচরণ করা যাবে না। তিন, কোন সঠিক বিষয়ে জেনে বুঝে ইচ্ছাকৃতভাবে কসম খেলে তা অবশ্যি পূর্ণ করতে হবে। এক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধাচরণ করা হলে অবশ্যি কাফফারা আদায় করতে হবে।
.
১০৮.
মূর্তি পূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শরের ব্যাখ্যার জন্য সূরা মায়েদার ১২ ও ১৪ টীকা দেখুন। এ প্রসঙ্গে জুয়ার ব্যাখ্যাও ১৪ টীকায় পাওয়া যাবে। যদিও ভাগ্য নির্ণায়ক শর (আযলাম) স্বভাবতই এক ধরনের জুয়া তুবও তাদের উভয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। পার্থক্যটি হচ্ছে আরবী ভাষায় ‘আযলাম’ বলা হয় এমন ধরনের ফাল গ্রহণ ও শর নিক্ষেপ করাকে যার সাথে মুশরিকী আকীদা-বিশ্বাস ও কুসংস্কার জড়িত থাকে। আর ‘মাইসির’(জুয়া) শব্দটি এমন সব খেলা ও কাজের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় যেখানে আকস্মিক ঘটনাকে অর্থোপার্জন, ভাগ্য পরীক্ষা এবং অর্থ ও দ্রব্যসামগ্রী বন্টনের মাধ্যমে পরিণত করা হয়।
১০৯.
এ আয়াতে চারটি জিনিস চূড়ান্তভাবে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এক, মদ। দুই, জুয়া। তিন, এমন সব জায়গা যেগুলোকে আল্লাহ ছাড়া আর কারোর ইবাদাত করার অথবা আল্লাহ ছাড়া আর কারো জন্য কুরবানী করার ও নজরানা দেবার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। চার, ভাগ্য নির্ণায়ক শর। শেষের তিনটি ব্যাখ্যা ইতিপূর্বে করা হয়েছে। মদ সম্পর্কে বিস্তারিত বিধান নীচে দেয়া হলোঃ

মদ হারাম হওয়া প্রসঙ্গে ইতিপূর্বে আরো দু’টি নির্দেশ এসেছিল। সে দু’টি আলোচিত হয়েছে সূরা বাকারার ২১৯ আয়াতে এবং সূরা আন নিসার ৪৩ আয়াতে। এরপর এ তৃতীয় নির্দেশটি আসার আগে নবী ﷺ তাঁর এক ভাষণে লোকদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলেনঃ মহান আল্লাহ মদ অত্যন্ত অপছন্দ করেন। মদ চিরতরে হারাম হয়ে যাবার নির্দেশ জারি হওয়া মোটেই বিচিত্র নয়। কাজেই যাদের কাছে মদ আছে তাদের তা বিক্রি করে দেয়া উচিত। এর কিছুদিন পর এ আয়াত নাযিল হয়। এবার তিনি ঘোষণা করেন, এখন যাদের কাছে মদ আছে তারা তা পান করতে পারবে না এবং বিক্রিও করতে পারবে না বরং তা নষ্ট করে দিতে হবে। কাজেই তখনই মদীনার সমস্ত গলিতে মদ ঢেলে দেয়া হয়। অনেকে জিজ্ঞেস করেন, এগুলো ফেলে না দিয়ে আমরা ইহুদীদেরকে তোহফা হিসেবে দিই না কেন? জবাবে নবী করী (স) বলেন, “যিনি একে হারাম করেছেন তিনি একে তোহফা হিসেবে দিতেও নিষেধ করেছেন।” কেউ কেউ জিজ্ঞেস করেন, আমরা মদকে সিরকায় পরিবর্তিত করে দিই না কেন? তিনি এটিও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং নির্দেশ দেনঃ “না ওগুলো ঢেলে দাও।” এক ব্যক্তি অত্যন্ত জোর দিয়ে জিজ্ঞেস করেন ওষুধ হিসেবে ব্যবহারের নিশ্চয়ই অনুমতি আছে? জবাব দেনঃ “না, এটা ওষুধ নয় বরং রোগ।” আর একজন আরয করেন, “হে আল্লাহর রসূল! আমরা এমন এক এলাকার অধিবাসী যেখানে শীত অত্যন্ত বেশী এবং আমাদের পরিশ্রমও অনেক বেশী করতে হবে। আমরা মদের সাহায্যে ক্লান্তি ও শীতের মোকাবিলা করি। তিনি জিজ্ঞেস করেন, তোমরা যা পান করো তা কি নেশা সৃষ্টি করে? লোকটি ইতিবাচক জবাব দেন। তখন তিনি বলেন, তাহলে তা থেকে দূরে থাকো। লোকটি তবুও বলেন, কিন্তু এটা তো আমাদের এলাকার লোকেরা মানবে না। জবাব দেন, “তারা না মানলে তাদের সাথে যুদ্ধ করো।”

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) রেওয়ায়াত করেছেন, নবী ﷺ বলেনঃ

لَعَنَ اللَّهُ الْخَمْرَ وَشَارِبَهَا وَسَاقِيَهَا وَبَائِعَهَا وَمُبْتَاعَهَا وَعَاصِرَهَا وَمُعْتَصِرَهَا وَحَامِلَهَا وَالْمَحْمُولَةَ إِلَيْهِ-

“আল্লাহ লানত বর্ষণ করেছেন (১) মদের ওপর, (২) মদ পানকারীর ওপর, (৩) মদ পরিবেশনকারীর ওপর, (৪) মদ বিক্রতার ওপর, (৫) মদ ক্রয়কারীর ওপর, (৬) মদ উৎপাদন ও শোধনকারীর ওপর, (৭) মদ উৎপাদন ও শোধনের ব্যবস্থাপকের ওপর, (৮) মদ বহনকারীর ওপর এবং (৯) মদ যার কাছে বহন করে নিয়ে যাওয়া হয় তার ওপর।”

অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে, নবী ﷺ এমন দস্তরখানে আহার করতে নিষেধ করেছেন যেখানে মদ পান করা হচ্ছে। প্রথম দিকে তিনি যেসব পাত্রে মদ তৈরী ও পান করা হতো সেগুলোর ব্যবহারও নিষিদ্ধ করে দেন। পরে মদ হারাম হবার হুকুমটি পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তিনি পাত্রগুলো ব্যবহার করার অনুমতি দেন।

‘খামর’ শব্দটি আরবীতে মূলত আংগুর থেকে তৈরী মদের জন্য ব্যবহৃত হতো পরোক্ষ অর্থে গম, যব, কিসমিস, খেজুর ও মধু থেকে উৎপাদিত মদকেও খামর বলা হতো। কিন্তু নবী ﷺ তাঁর এ নির্দেশকে নেশা সৃষ্টিকারী প্রত্যেকটি জিনিসের ওপর ব্যাপ্ত করে দিয়েছেন। তিনি হাদীসে স্পষ্ট বলেছেনঃ كُلُّ مُسْكِرٍ خَمْرٌ وَكُلُّ مُسْكِرٍ حَرَامٌ “প্রত্যেকটি নেশা সৃষ্টিকারী জিনিস মদ এবং প্রত্যেকটি নেশা সৃষ্টিকারী বস্তু হারাম।” তিনি আরো বলেছেনঃ

كُلُّ شَرَابٍ أَسْكَرَ , فَهُوَ حَرَامٌ

“যে কোন পানীয় নেশা সৃষ্টি করলে তা হারাম।”

তিনি আরো বলেনঃ وَأَنَا نَهَى مِن كُلِّ مُسْكِرٍ “আর আমি প্রত্যেকটি নেশা সৃষ্টিকারী জিনিস ব্যবহার করতে নিষেধ করছি।”

হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু জুমার খুতবায় মদের সংজ্ঞা এভাবে দেনঃ الخمر ما خامر العقل “মদ বলতে এমন সব জিনিসকে বুঝায় যা বুদ্ধিকে বিকৃত করে ফেলে।”

এ ছাড়াও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা ও মূলনীতি বর্ণনা করেছেনঃ مَا أَسْكَرَ كَثِيرُهُ فَقَلِيلُهُ حَرَامٌ “যে জিনিসের বেশী পরিমাণ নেশা সৃষ্টি করে তার সামান্য পরিমাণও হারাম।” তিনি আরো বলেছেনঃ

مَا أَسْكَرَ الْفَرَقُ مِنْهُ فَمِلْءُ الْكَفِّ مِنْهُ حَرَامٌ

“যে জিনিসের বড় এক পাত্র পরিমাণ পান করলে নেশা হয় তা ক্ষুদ্র পরিমাণ পান করাও হারাম।”

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে মদ পানকারীর জন্য বিশেষ কোন শাস্তি নির্ধারিত ছিল না। যে ব্যক্তিকে এ অপরাধে গ্রেফতার করে নিয়ে আসা হতো তাকে কিল থাপ্প্ড়, জুতা, লাথি গিঁট বাঁধা পাকানো কাপড় ও খেজুরের ছড়া দিয়ে পেটানো হতো। রসূলের আমলে এ অপরাধে বড় জোর চল্লিশ ঘা মারা হতো। হযরত আবু বকরের (রা.) আমলে ৪০ ঘা বেত্রাঘাত করা হতো। হযরত উমরের (রা.) আমলেও শুরুতে ৪০ ঘা বেত মারা হতো। কিন্তু যখন তিনি দেখলেন লোকেরা এ অপরাধ অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকছে না তখন তিনি সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শক্রমে এ অপরাধের দণ্ড হিসেবে ৮০ টি বেত্রাঘাত নির্ধারণ করেন। ইমাম মালেক, আবু হানীফা এবং একটি বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম শাফেঈও এ শাস্তিকেই মদ পানের দণ্ড হিসেবে গণ্য করেছেন। কিন্তু ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এবং অন্য একটি বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম শাফেঈ ৪০ বেত্রাঘাতকেই এর শাস্তি হিসেবে মেনে নিয়েছেন। হযরত আলীও (রা.) এটিই পছন্দ করেছেন।

শরীয়াতের দৃষ্টিতে মদের প্রতি নিষেধাজ্ঞার এ বিধানটিকে শক্তি প্রয়োগ করে প্রতিষ্ঠিত করা ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। হযরত উমরের শাসনামলে নবী মাকীফের রুয়াইশিদ নামক এক ব্যক্তির একটি দোকান পুড়িয়ে দেয়া হয়। কারণ সে লুকিয়ে লুকিয়ে মদ বিক্রি করতো। আর একবার হযরত উমরের হুকুমে পুরো একটি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়। কারণ সেই গ্রামে গোপনে মদ উৎপাদন ও চোলাই করা হতো এবং মদ বেচাকেনার কারবারও সেখানে চলতো।

.
অনুবাদ: