পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

৫৬৪ আয়াত

৫ ) কারণ তোমার রব তাকে (এমনটি করার) হুকুম দিয়ে থাকবেন।
بِأَنَّ رَبَّكَ أَوْحَىٰ لَهَا ٥
৬ ) সেদিন লোকেরা ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় ফিরে আসবে, যাতে তাদের কৃতকর্ম তাদেরকে দেখানো যায়।
يَوْمَئِذٍۢ يَصْدُرُ ٱلنَّاسُ أَشْتَاتًۭا لِّيُرَوْا۟ أَعْمَـٰلَهُمْ ٦
৭ ) তারপর যে অতি অল্প পরিমাণ ভালো কাজ করবে সে তা দেখে নেবে
فَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًۭا يَرَهُۥ ٧
৮ ) এবং যে অতি অল্প পরিমাণ খারাপ কাজ করবে সে তা দেখে নেবে।
وَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍۢ شَرًّۭا يَرَهُۥ ٨
১ ) কসম সেই (ঘোড়া) গুলোর যারা হ্রেষারব সহকারে দৌড়ায়।
وَٱلْعَـٰدِيَـٰتِ ضَبْحًۭا ١
২ ) তারপর (খুরের আঘাতে) আগুনের ফুলকি ঝরায়।
فَٱلْمُورِيَـٰتِ قَدْحًۭا ٢
৩ ) তারপর অতর্কিত আক্রমণ চালায় প্রভাতকালে।
فَٱلْمُغِيرَٰتِ صُبْحًۭا ٣
৪ ) তারপর এ সময় ধূলা উড়ায়
فَأَثَرْنَ بِهِۦ نَقْعًۭا ٤
৫ ) এবং এ অবস্থায় কোন জনপদের ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে।
فَوَسَطْنَ بِهِۦ جَمْعًا ٥
৬ ) আসলে মানুষ তার রবের প্রতি বড়ই অকৃতজ্ঞ।
إِنَّ ٱلْإِنسَـٰنَ لِرَبِّهِۦ لَكَنُودٌۭ ٦
.
৫.
এর দু’টো অর্থ হতে পারে। এক, প্রত্যেক ব্যক্তি একাকী তার ব্যক্তিগত অবস্থায় অবস্থান করবে। পরিবার, গোষ্ঠী, জোট, দল, সম্প্রদায় ও জাতি সব ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। কুরআন মজীদের অন্যান্য স্থানেও একথা বলা হয়েছে। যেমন সূরা আন’আমে রয়েছে, সেদিন মহান আল্লাহ‌ লোকদের বলবেনঃ “নাও, এখন তুমি এমনিতেই একাকী আমার সামনে হাজির হয়ে গেছো, যেমন আমি প্রথমবার তোমাকে সৃষ্টি করেছিলাম।” (৯৪ আয়াত) আর সূরা মারয়ামে বলা হয়েছেঃ “একাকী আমার কাছে আসবে।” (৮০ আয়াত) আরো বলা হয়েছেঃ “তাদের মধ্য থেকে প্রত্যেকে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে একাকী হাযির হবে।” (৯৫ আয়াত) দুই, এর দ্বিতীয় অর্থ হতে পারে, বিগত হাজার হাজার বছরে সমস্ত মানুষ যে যেখানে মরেছিল সেখান থেকে অর্থাৎ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে দলে দলে চলে আসতে থাকবে। যেমন সূরা নাবায় বলা হয়েছেঃ “যে দিন শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে, তোমার দলে দলে এসে যাবে। (১৮ আয়াত) এছাড়া বিভিন্ন তাফসীরকার এর যে অর্থ বর্ণনা করেছেন তার অবকাশ এখানে উল্লেখিত “আশতাতান” (أَشْتَاتًا) শব্দের মধ্যে নেই। তাই আমার মতে সেগুলো এই শব্দটির অর্থগত সীমাচৌহদ্দীর বাইরে অবস্থান করছে। যদিও বক্তব্য হিসেবে সেগুলো সঠিক এবং কুরআন ও হাদীস বর্ণিত কিয়ামতের অবস্থা ও ঘটনাবলীর সাথে সামঞ্জস্য রাখে।
৬.
এর দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, তাদের আমল তাদেরকে দেখানো হবে। অর্থাৎ প্রত্যেকে দুনিয়ায় কি কাজ করে এসেছে তা তাকে বলা হবে। দুই, তাদেরকে তাদের কাজের প্রতিফল দেখানো হবে। যদিও لِيُرَوْا أَعْمَالَهُمْ বাক্যটির জন্য এই দ্বিতীয় অর্থটি গ্রহণ করা যেতে পারে তবুও যেহেতু আল্লাহ‌ এখানে لِيُرَوْا جزاء أَعْمَالَهُمْ (তাদের কাজের প্রতিফল দেখাবার জন্য) না বলে বলেছেন لِيُرَوْا أَعْمَالَهُمْ (তাদের কাজগুলো দেখানো হবে) তাই সঙ্গতভাবেই প্রথম অর্থটি এখানে অগ্রাধিকার পাবে। বিশেষ করে যখন কুরআন মজীদের বিভিন্নস্থানে একথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, কাফের ও মু’মিন, সৎকর্মশীল ও ফাসেক, আল্লাহর হুকুমের অনুগত ও নাফরমান সবাইকে অবশ্যি তাদের আমলনামা দেয়া হবে। (উদাহরণস্বরূপ দেখুন সূরা আল হাক্কার ১৯ ও ২৫ এবং সূরা আল ইনশিকাকের ৭-১০ আয়াত) একথা সুস্পষ্ট, কাউকে তার কার্যাবলী দেখিয়ে দেয়া এবং তার আমলনামা তার নিজের হাতে সোপর্দ করার মধ্যে কোন তফাত নেই। তাছাড়া যমীন যখন তার ওপর অনুষ্ঠিত ঘটনাবলী পেশ করবে তখন হক ও বাতিলের যে দ্বন্দ্ব ও বিরোধ শুরু থেকে চলে আসছিল এবং কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে, তার সম্পূর্ণ চিত্রও সবার সামনে এসে যাবে। সেখানে সবাই দেখবে, সত্যের জন্য যারা কাজ করেছিল তারা কি কি কাজ করেছে এবং মিথ্যার সমর্থকরা তাদের মোকাবেলায় কি কি কাজ করেছে। হিদায়াতের পথে আহ্বানকারী ও গোমরাহী বিস্তারকারীদের সমস্ত শুনবে, এটা কোন অসম্ভব কথা নয়। উভয় পক্ষের সমগ্র রচনা ও সাহিত্যের রেকর্ড অবিকল সবার সামনে এনে রেখে দেয়া হবে। হকপন্থীদের ওপর বাতিল পন্থীদের জুলুম এবং উভয় পক্ষের মধ্যে অনুষ্ঠিত দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সমূহের দৃশ্যাবলী হাশরের ময়দানে উপস্থিত লোকেরা নিজেদের চোখেই দেখে নেবে।
.
৭.
এটি হচ্ছে এর একটি সহজ-সরল অর্থ। আবার একথা সম্পূর্ণ সত্য যে, মানুষের অনু পরিমাণ নেকী বা পাপ এমন হবে না যা তার আমলনামায় লিখিত হবে না। তাকে সে অবশ্য দেখে নেবে। কিন্তু দেখে নেবার মানে যদি এই হয় যে, তার পুরস্কার ও শাস্তি দেখে নেবে, তাহলে এর এ অর্থ নেয়া ভুল হবে যে আখেরাতে প্রত্যেকটি সামান্যতম নেকীর পুরস্কার এবং প্রত্যেকটি সামান্যতম পাপের শাস্তি প্রত্যেক ব্যক্তিকে দেয়া হবে। আর কোন ব্যক্তিও সেখানে নিজের কোন নেকীর পুরস্কার থেকে বঞ্চিত এবং পাপের শাস্তি থেকে রক্ষা পাবে না। কারণ তাই যদি হয় তাহলে প্রথমত এর মানে হবে, প্রত্যেকটি খারাপ কাজের শাস্তি এবং প্রত্যেকটি ভালো কাজের পুরস্কার আলাদা আলাদা দেয়া হবে। দ্বিতীয়ত এর মানে এও হবে, কোন উচ্চ পর্যায়ের সৎ ও মু’মিন কোন ক্ষুদ্রতম গোনাহর শাস্তি থেকে রক্ষা পাবে না। আর কোন জঘন্যতম কাফের, জালেম এবং পাপীও কোন ক্ষুদ্রতম সৎকাজের পুরস্কার না পেয়ে যাবে না। এ দু’টি অর্থ কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট বক্তব্য বিরোধী এবং বুদ্ধিও একে ইনসাফের দাবী বলে মেনে নিতে পারে না। বুদ্ধির দৃষ্টিতে বিচার করলে একথা কেমন করে বোধগম্য হতে পারে যে, আপনার একজন কর্মচারী আপনার একান্ত অনুগত, বিশ্বস্ত ও নিবেদিত প্রাণ কিন্তু তার কোন সামান্যতম ত্রুটির আপনি মাফ করেন না? তার প্রতিটি সেবা-কর্মের পুরস্কার দেবার সাথে সাথে তার প্রতিটি ত্রুটির জন্যও আপনে গুণে গুণে তাকে শাস্তিও দেবেন? ঠিক তেমনি বুদ্ধির দৃষ্টিতে একথাও দুর্বোধ্য যে, আপনার অর্থ ও সাহায্য-সহযোগীতায় লালিত পালিত কোন ব্যক্তি যার প্রতি রয়েছে আপনার অসংখ্য অনুগ্রহ, সে আপনার সাথে বেঈমানী ও বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং অনুগ্রহের জবাবে হামেশা নিমকহারামী করতে থাকে। কিন্তু আপনি তার সামগ্রিক কার্যক্রম ও দৃষ্টিভঙ্গী উপেক্ষা করে তার প্রতিটি বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য তাকে পৃথক শাস্তি এবং তার ছোট-খাটো কোন সেবামূলক কাজের জন্য হয়তো সে কখনো আপনাকে খাবার জন্য এক গ্লাস পানি এনে দিয়েছিল বা কখনো আপনাকে পাখা দিয়ে বাতাস করে ছিল---আপনি তাকে আলাদাভাবে পুরস্কৃত করবেন আর কুরআন ও হাদীসের ব্যাপারে বলা যেতে পারে, সেখানে সুস্পষ্টভাবে মু’মিন, মোনাফেক, কাফের, সৎ মু’মিন, গোনাহগার মু’মিন, জালেম ও ফাসেক মু’মিন, নিছক কাফের এবং জালেম ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কাফের ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের লোকদের পুরস্কার ও শাস্তির জন্য একটি বিস্তারিত আইন বর্ণনা করা হয়েছে। আর এই পুরস্কার ও শাস্তি মানুষের সমগ্র জীবনের ওপর পরিব্যাপ্ত।

এ প্রসঙ্গে কুরআন মজীদ নীতিগতভাবে কয়েকটি কথা দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বর্ণনা করেঃ

একঃ কাফের, মুশরিক ও মোনাফেকের কর্মকাণ্ড (অর্থাৎ এমনসব কর্মকাণ্ড যেগুলোকে নেকী মনে করা হয়) নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। আখেরাতে তারা এর কোন প্রতিদান পাবে না। এগুলোর যা প্রতিদান, তা তারা দুনিয়াতেই পেয়ে যাবে। এ জন্য উদাহরণস্বরূপ দেখুন আল আরাফ ১৪৭, আত তাওবা ১৭, ৬৭-৬৯, হুদ ১৫-১৬, ইবরাহীম ১৮, আল কাহফ ১০৪-১০৫, আন নূর ৩৯, আল ফুরকান ২৩, আল আহযাব ১৯, আয যুমার ৬৫ এবং আল আহকাফ ২০ আয়াত)

দুইঃ পাপের শাস্তি ততটুকু দেয়া হবে যতটুকু পাপ করা হয়। কিন্তু নেকীর পুরস্কার মূল কাজের তুলনায় বেশী দেয়া হবে। বরং কোথাও বলা হয়েছে, আল্লাহ‌ নিজের ইচ্ছেমতো নেকীর প্রতিদান বাড়িয়ে দেবেন। দেখুন আল বাকারাহ ২৬১, আল আনআম ১৬০, ইউনুস ২৬-২৭, আন নূর ৩৮, আল কাসাস ৮৪, সাবা ৩৭ এবং আল মু’মিন ৪০ আয়াত।

তিনঃ মু’মিন যদি বড় বড় গোনাহ থেকে দূরে থাকে তাহলে তার ছোট গোনাহগুলো মাফ করে দেয়া হবে। দেখুন আন নিসা ৩১, আশ শূরা ৩৭ এবং আন নাজম ৩২ আয়াত।

চারঃ সৎ মু’মিনের কাছ থেকে হালকা হিসেব নেয়া হবে। তার গোনাহগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া হবে। তার ভালো ও উত্তম আমলগুলোর দৃষ্টিতে বিচার করে তাকে প্রতিদান দেয়া হবে। দেখুন আনকাবুত ৭, আযযুমার ৩৫, আল আহকাফ ১৬ এবং আল ইনশিকাক ৮ আয়াত।

হাদীসের বক্তব্য এ বিষয়টিকে একেবারে পরিষ্কার করে দেয়। ইতিপূর্বে সূরা ইনশিকাকের ব্যাখ্যার কিছু হাদীস উল্লেখ করেছি। কিয়ামতের দিন হালকা ও কড়া হিসেবের বিষয়টিকে বুঝাবার জন্য রসূলুল্লাহ ﷺ এর ব্যাখ্যা করেছেন। (এ জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল ইনশিকাক ৬ টীকা) হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আহার করেছিলেন এমন সময় এই আয়াতটি নাযিল হয়। হযরত আবু বকর (রা.) খাবার থেকে হাত গুঁটিয়ে নেন। তিনি বলেনঃ “হে আল্লাহর রসূল! যে অণু পরিমাণ খারাপ কাজ আমি করেছি তার ফলও কি আমি দেখে নেবো? ” জবাব দেনঃ “হে আবু বকর! দুনিয়ায় যেসব বিষয়েরই তুমি সম্মুখীন হও তার মধ্যে যেগুলো তোমার অপছন্দনীয় ও অপ্রীতিকর ঠেকে সেগুলোই তুমি যেসব অণু পরিমাণ অসৎকাজ করেছো তার বদলা এবং সেসব অণু পরিমাণ নেকীর কাজই তুমি করো সেগুলো আল্লাহ‌ আখেরাতে তোমার জন্য সংরক্ষণ করে রাখছেন।” (ইবনে জারীর, ইবনে আবী হতেম, তাবারনী ফিল আওসাত, বাইহাকী ফিশ শু’আব, ইবনুল মুনযির, হাকেম, ইবনে মারদুইয়া ও আবদ ইবনে হুমাইদ) এই আয়াতটি সম্পর্কে রসূলুল্লাহ ﷺ হযরত আবু আইউব আনসারীকেও বলেছিলেনঃ “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই নেকী করবে তার পুরস্কার সে পাবে আখেরাতে। আর যে ব্যক্তি কোন খারাপ কাজ করবে বিপদ-আপদ ও রোগের আকারে এই দুনিয়ায় তার শাস্তি পেয়ে যাবে।” (ইবনে মারদুইয়া)। কাতাদাহ হযরত আনাসের (রা.) বরাত দিয়ে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিম্নোক্ত বাণীটি উদ্ধৃত করেছেনঃ “আল্লাহ মু’মিনের প্রতি জুলুম করেন না। দুনিয়ায় তার নেকীর প্রতিদানে তাকে রিযিক দান করেন এবং আখেরাতে আবার এর পুরস্কার দেবেন। আর কাফেরের ব্যাপারে দুনিয়ায় তার সৎকাজের প্রতিদান দিয়ে দেন, তারপর যখন কিয়ামত হবে তখন তার খাতায় কোন নেকী লেখা থাকবে না।” (ইবনে জারীর) মাসরূক হযরত আয়েশা (রা.) থেকে রেওয়ায়াত করেছেনঃ তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করেন, “আবদুল্লাহ ইবনে জুদ’আন জাহেলীযুগে আত্মীয়দের সাথে সদ্ব্যবহার করতো, মিসকিনকে আহার করাতো, মেহমানদের আপ্যায়ন করাতো, বন্দিদের মুক্তি দান করতো। আখেরাতে এগুলো কি তার জন্য উপকারী হবে? ”রসূলুল্লাহ ﷺ জবাব দেন “না, সে মরার সময় পর্যন্ত একবারও বলেনি, رَبِّ اغْفِرْلِى خَطِيْئَتِىْ يَوْمَ الدِّيْنِ (হে আমার রব! শেষ বিচারের দিন আমার ভুল ত্রুটিগুলো মাফ করে দিয়ো।)”(ইবনে জারীর) অন্যান্য আরো কিছু লোকের ব্যাপারেও রসূলুল্লাহ ﷺ এই একই জবাব দেন। তারা জাহেলী যুগে সৎকাজ করতো কিন্তু কাফের ও মুশরিক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন কোন বাণী থেকে জানা যায়, কাফেরের সৎকাজ তাকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করতে পারবে না ঠিকই তবে জালেম ফাসেক ব্যভিচারী কাফেরকে জাহান্নামে যে ধরনের কঠিন শাস্তি দেয়া হবে তার শাস্তি তেমনি পর্যায়ের হবে না। যেমন হাদীসে বলা হয়েছেঃ হাতেম তাঈ এর দানশীলতার কারণে তাকে হালকা আযাব দেয়া হবে। (রূহুল মা’আনী)

তবুও এ আয়াতটি মানুষকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্যের ব্যাপারে সজাগ করে দেয়। সেটি হচ্ছে, প্রত্যেকটি সামান্যতম ও নগণ্যতম সৎকাজেরও একটি ওজন ও মূল্য রয়েছে এবং অনুরূপ অবস্থা অসৎকাজেরও। অর্থাৎ অসৎকাজ যত ছোটই হোক না কেন অবশ্যি তার হিসেব হবে এবং তা কোন ক্রমেই উপেক্ষা করার মতো নয়। তাই কোন ছোট সৎকাজকে ছোট মনে না করা উচিত। কারণ এই ধরনের অনেকগুলো ছোট গোনাহ একত্র হয়ে একটি বিরাট গোনাহের স্তূপ জমে উঠতে পারে। একথাটিই রসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর হাদীসে ব্যক্ত করেছেন। বুখারী ও মুসলিমে হযরত আদী ইবনে হাতেম (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ “জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচো-তা এক টুকরা খেজুর দান করার বা একটি ভালো কথা বলার বিনিময়েই হোক না কেন।” হযরত আদী ইবনে হাতেম থেকে সহীহ রেওয়ায়াতের মাধ্যমে আরো বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ “কোন সৎকাজকেও সামান্য ও নগণ্য মনে করো না, যদিও তা কোন পানি পানেচ্ছু ব্যক্তির পাত্রে এক মগ পানি ঢেলে দেয়াই হয় অথবা তোমার কোন ভাইয়ের সাথে হাসি মুখে সাক্ষাত করাই হয়।” বুখারী শরীফে হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে একটি রেওয়ায়াত বর্ণিত হয়েছে। তাতে রসূলুল্লাহ ﷺ মেয়েদেরকে সম্বোধন করে বলেছেনঃ “হে মুসলিম মেয়েরা! কোন প্রতিবেশী তার প্রতিবেশীনীর বাড়িতে কোন জিনিস পাঠানোকে সামান্য ও নগণ্য মনে করো না, তা ছাগলের পায়ের একটি খুর হলেও।” মুসনাদে আহমাদ, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ-এ হযরত আয়েশার (রা.) একটি রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে। রসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ “হে আয়েশা! যেসব গোনাহকে ছোট মনে করা হয় সেগুলো থেকে দূরে থাকো। কারণ আল্লাহর দরবারে সেগুলো সম্পর্কেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।” মুসনাদে আহমাদে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের (রা.) বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে রসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ “সাবধান, ছোট গোনাহসমূহ থেকে নিজেকে রক্ষা কর। কারণ সেগুলো সব মানুষের ওপর একত্র হয়ে তাকে ধ্বংস করে দেবে।” (গোনাহ কবীরা ও গোনাহ সগীরার পার্থক্য বুঝার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আন নিসা ৫৩ টীকা ও আন নাজম ৩২ টীকা)।

১.
দৌড়ায় শব্দের মাধ্যমে যে এখানে ঘোড়া বুঝানো হয়েছে আয়াতে শব্দগুলো থেকে একথা মোটেই স্পষ্ট নয়। বরং এখানে শুধু বলা হয়েছে (وَالۡعٰدِيٰتِ ) অর্থাৎ “কসম তাদের যারা দৌড়ায়।” এ কারণে কারা দৌড়ায় এর ব্যাপারে মুফাসসিরগণের মধ্যে বিভিন্ন মতের সৃষ্টি হয়েছে। সাহাবী ও তাবেঈগণের একটি দল বলেছেন, ঘোড়া এবং অন্য একটি দল বলেছেন উট। কিন্তু যেহেতু দৌড়াবার সময় বিশেষ আওয়াজ, যাকে (ضَبۡح) (হ্রেষারব) বলা হয়, একমাত্র ঘোড়ার মুখ দিয়েই দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস চলার কারণে বের হয় এবং পরের আয়াতগুলোতে অগ্নিষ্ফুলিংগ ঝরাবার, খুব সকালে কোন জনপদে অতর্কিত আক্রমণ চালাবার এবং সেখানে ধূলা উড়াবার কথা বলা হয়েছে, আর এগুলো একমাত্র ঘোড়ার সাথেই খাপ খায়, তাই অধিকাংশ গবেষক একে ঘোড়ার সাথে সংশ্লিষ্ট করেছেন। ইবনে জারীর বলেন, “এ ব্যাপারে যে দু’টি বক্তব্য পাওয়া যায় তার মধ্যে ঘোড়া দৌড়ায় এই বক্তব্যটি অগ্রাধিকার লাভের যোগ্য। কারণ উট হ্রেষারব করে না, ঘোড়া হ্রেষারব করে। আর আল্লাহ‌ বলেছেন, যারা হ্রেষারব করে দৌড়ায় তাদের কসম।” ইমাম রাজী বলেন, “এই আয়াতগুলোর বিভিন্ন শব্দ চিৎকার করে চলছে, এখানে ঘোড়ার কথা বলা হয়েছে। কারণ ঘোড়া ছাড়া আর কেউ হ্রেষারব করে না। আর আগুনের ষ্ফুলিংগ ঝরাবার কাজটিও পাথরের ওপর ঘোড়ার খুরের আঘাতেই সম্পন্ন হয়। এ ছাড়া অন্যকোন ভাবেই তা হতে পারে না। অন্যদিকে খুব সকালে আক্রমণ চালাবার কাজটিও অন্য কোন প্রাণীর তুলনায় ঘোড়ার সাহায্যে সম্পন্ন করাই সহজতর হয়।”
২.
আগুনের ফুলকি ঝরায় ইত্যাকার শব্দগুলো একথাই প্রকাশ করে যে, রাত্রিকালে ঘোড়া দৌড়ায়। কারণ তাদের পায়ের খুর থেকে যে আগুনের ফুলকি ঝরে তার রাতের বেলায়ই দেখতে পাওয়া যায়।
৩.
আরববাসীদের নিয়ম ছিল, কোন জনপদে অতর্কিত আক্রমণে করতে হলে তারা রাতের আঁধারে বের হয়ে পড়তো। এর ফলে শত্রু পক্ষ পূর্বাহ্নে সতর্ক হতে পারতো না। এভাবে একেবারে খুব সকালে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। প্রভাতে আলো যেটুকু ছড়িয়ে পড়তো তাতে তারা সবকিছু দেখতে পেতো। আবার দিনের আলো খুব বেশী উজ্জ্বল না হবার কারণে প্রতিপক্ষ দূর থেকে তাদের আগমন দেখতে পেতো না। ফলে তারা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতিও গ্রহণ করতে পারতো না।
.
.
৪.
রাতের বেলা হ্রেষারব করে আগুনের ফুলকি ঝরাতে ঝরাতে যেসব ঘোড়া দৌড়ায়, তারপর খুব সকালে ধূলি উড়িয়ে কোন জনপদে চড়াও হয় এবং প্রতিরোধকারীদের ভীড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে, সেসব ঘোড়ার কসম খাওয়া হয়েছে যে কথাটি বলার জন্য এটিই সেই কথা। অধিকাংশ তফসীরকার এই ঘোড়া বলতে যে ঘোড়া বুঝিয়েছেন তা দেখে অবাক হতে হয়। জিহাদকারী গাজীদের ঘোড়াকে তারা এই ঘোড়া বলে চিহ্নিত করেছেন এবং যে ভীড়ের এই ঘোড়া মধ্যে এই ঘোড়া প্রবেশ করে তাকে তারা কাফেরদের সমাবেশ মনে করেছেন। অথচ “মানুষ তার রবের প্রতি বড়ই অকৃতজ্ঞ” এ কথাটির ওপরই কসম খাওয়া হয়েছে। একথা সুস্পষ্ট, আল্লাহর পথে জিহাদকারী গাজীদের ঘোড়ার দৌড়াদৌড়ি এবং কাফেরদের কোন দলের ওপর তাদের ঝাঁপিয়ে পড়ায় একথা বুঝায় না যে মানুষ তার রবের প্রতি অকৃতজ্ঞ। আর মানুষ নিজেই তার এই অকৃতজ্ঞতার সাক্ষী এবং সে ধন দৌলতের মোহে বিপুলভাবে আক্রান্ত এই পরবর্তী বাক্যগুলোও এমন সব লোকদের সাথে খাপ খায় না যারা আল্লাহর পথে জিহাদ করতে বের হয়। তাই নিশ্চিতভাবে একথা মেনে নিতে হবে যে, এই সূরার প্রথম পাঁচটি আয়াতে যে কসম খাওয়া হয়েছে তা সে সময়ের আরবে সাধারণভাবে যে লুটতরাজ, হত্যাকাণ্ড ও রক্তপাত চলছিল সেদিকেই ইঙ্গিত করছে। জাহেলী যুগে রাতগুলো হতো বড়ই ভয়াবহ। প্রত্যেক গোত্র ও জনপদের লোকেরাআশঙ্কা করতো, না জানি রাতের আঁধারে তাদের ওপর কোন দুশমন চড়াও হবার জন্য ছুটে আসছে। আর দিনের আলো প্রকাশিত হবার সাথে সাথে তারা নিশ্চিন্ত হতো। কারণ রাতটা নির্ঝঞ্জাটে ও ভালোয় ভালোয় কেটে গেছে। সেখানে গোত্রে গোত্রে কেবলমাত্র প্রতিশোধমূলক লড়াই হতো না। বরং এক গোত্র আর এক গোত্রের ওপর আক্রমণ চালাতো তার ধন-দৌলত লুটে নেবার, তার উট, ভেড়া ইত্যাদি পশু কেড়ে নেবার এবং তার মেয়েদের ও শিশুদের গোলাম বানাবার জন্য। এসব লুটতরাজ ও জুলুম নিপীড়ন করা হতো সাধারণত ঘোড়ায় চড়ে। মানুষ যে তার রবের প্রতি বড়ই অকৃতজ্ঞ এই বক্তব্যের সপক্ষে এ বিষয়গুলোকে আল্লাহ‌ প্রমাণ হিসেবে পেশ করেছেন। অর্থাৎ যে শক্তিকে তারা ব্যয় করছে লুটতরাজ, হানাহানি, খুন-খারাবি ও যুদ্ধ-বিগ্রহের জন্য সে শক্তি তো আল্লাহ‌ তাদেরকে মূলত এ কাজে ব্যয় করার জন্য দেননি। কাজেই আল্লাহর দেয়া এ উপকরণ ও শক্তিগুলোকে আল্লাহর সবচেয়ে বেশী অপ্রিয়, যে দুনিয়ায় বিপর্যয় সৃষ্টি করা তার পিছনে ব্যয় করা তাঁর প্রতি সবচেয়ে বড় অকৃতজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
অনুবাদ: