পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

১৫৯ আয়াত

৮৮ ) নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারে মত্ত গোত্রপতিরা তাকে বললোঃ “হে শো'আইব! আমরা তোমাকে ও তোমার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে আমাদের জনপদ থেকে বের করে দেবো। অন্যথায় তোমাদের ফিরে আসতে হবে আমাদের ধর্মে।” শো'আইব জবাব দিলোঃ “আমরা রাজি না হলেও কি আমাদের জোর করে ফিরিয়ে আনা হবে? তোমাদের ধর্ম থেকে আল্লাহ‌ আমাদের উদ্ধার করার পর আবার যদি আমরা তাতে ফিরে আসি তাহলে
۞ قَالَ ٱلْمَلَأُ ٱلَّذِينَ ٱسْتَكْبَرُوا۟ مِن قَوْمِهِۦ لَنُخْرِجَنَّكَ يَـٰشُعَيْبُ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ مَعَكَ مِن قَرْيَتِنَآ أَوْ لَتَعُودُنَّ فِى مِلَّتِنَا ۚ قَالَ أَوَلَوْ كُنَّا كَـٰرِهِينَ ٨٨
৮৯ ) আমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপকারী বিবেচিত হবো। আমাদের রব আল্লাহ‌ যদি না চান, তাহলে আমাদের পক্ষে সে দিকে ফিরে যাওয়া আর কোনক্রমেই সম্ভব নয়। ৭৩ আমাদের রবের জ্ঞান সমস্ত জিনিসকে ঘিরে আছে। আমরা তাঁরই ওপর নির্ভর করি। হে আমাদের রব! আমাদের ও আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে যথাযথভাবে ফায়সালা করে দাও এবং তুমি সবচেয়ে ভাল ফায়সালাকারী।”
قَدِ ٱفْتَرَيْنَا عَلَى ٱللَّهِ كَذِبًا إِنْ عُدْنَا فِى مِلَّتِكُم بَعْدَ إِذْ نَجَّىٰنَا ٱللَّهُ مِنْهَا ۚ وَمَا يَكُونُ لَنَآ أَن نَّعُودَ فِيهَآ إِلَّآ أَن يَشَآءَ ٱللَّهُ رَبُّنَا ۚ وَسِعَ رَبُّنَا كُلَّ شَىْءٍ عِلْمًا ۚ عَلَى ٱللَّهِ تَوَكَّلْنَا ۚ رَبَّنَا ٱفْتَحْ بَيْنَنَا وَبَيْنَ قَوْمِنَا بِٱلْحَقِّ وَأَنتَ خَيْرُ ٱلْفَـٰتِحِينَ ٨٩
৯০ ) তার সম্প্রদায়ের প্রধানরা, যারা তার কথা মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল, পরস্পরকে বললোঃ “যদি তোমরা শো'আইবের আনুগত্য মেনে নাও, তাহলে ধ্বংস হয়ে যাবে।” ৭৪
وَقَالَ ٱلْمَلَأُ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ مِن قَوْمِهِۦ لَئِنِ ٱتَّبَعْتُمْ شُعَيْبًا إِنَّكُمْ إِذًۭا لَّخَـٰسِرُونَ ٩٠
৯১ ) কিন্তু সহসা একটি প্রলয়ংকরী বিপদ তাদেরকে পাকড়াও করে এবং তারা নিজেদের ঘরের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে।
فَأَخَذَتْهُمُ ٱلرَّجْفَةُ فَأَصْبَحُوا۟ فِى دَارِهِمْ جَـٰثِمِينَ ٩١
৯২ ) যারা শো'আইবকে মিথ্যা বলেছিল তারা এমনভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় যেন সেই সব গৃহে কোনদিন তার বসবাসই করতো না। শো'আইবকে যারা মিথ্যা বলেছিল অবশেষে তারা ধ্বংস হয়ে যায়। ৭৫
ٱلَّذِينَ كَذَّبُوا۟ شُعَيْبًۭا كَأَن لَّمْ يَغْنَوْا۟ فِيهَا ۚ ٱلَّذِينَ كَذَّبُوا۟ شُعَيْبًۭا كَانُوا۟ هُمُ ٱلْخَـٰسِرِينَ ٩٢
৯৩ ) আর শো'আইব একথা বলতে বলতে তাদের জনপদ থেকে বের হয়ে যায়-“হে আমাদের জাতির লোকেরা! আমি আমার রবের বাণী তোমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছি এবং তোমাদের কল্যাণ কামনার হক আদায় করেছি। এখন আমি এমন জাতির জন্য দুঃখ করবো কেন, যারা সত্যকে মেনে নিতে অস্বীকার করে?” ৭৬
فَتَوَلَّىٰ عَنْهُمْ وَقَالَ يَـٰقَوْمِ لَقَدْ أَبْلَغْتُكُمْ رِسَـٰلَـٰتِ رَبِّى وَنَصَحْتُ لَكُمْ ۖ فَكَيْفَ ءَاسَىٰ عَلَىٰ قَوْمٍۢ كَـٰفِرِينَ ٩٣
৯৪ ) আমি যখনই কোন জনপদে নবী পাঠিয়েছি, সেখানকার লোকদেরকে প্রথমে অর্থকষ্ট ও দুঃখ-দুর্দশার সম্মুখীন করেছি, একথা ভেবে যে, হয়তো তারা বিনম্র হবে ও নতি স্বীকার করবে।
وَمَآ أَرْسَلْنَا فِى قَرْيَةٍۢ مِّن نَّبِىٍّ إِلَّآ أَخَذْنَآ أَهْلَهَا بِٱلْبَأْسَآءِ وَٱلضَّرَّآءِ لَعَلَّهُمْ يَضَّرَّعُونَ ٩٤
৯৫ ) তারপর তাদের দুরবস্থাকে সমৃদ্ধিতে ভরে দিয়েছি। ফলে তারা প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে এবং বলতে শুরু করেছে “আমাদের পূর্বপুরুষদের ওপরও দুর্দিন ও সুদিনের আনাগোনা চলতো।” অবশেষে আমি তাদেরকে সহসাই পাকড়াও করেছি। অথচ তারা জানতেও পারেনি। ৭৭
ثُمَّ بَدَّلْنَا مَكَانَ ٱلسَّيِّئَةِ ٱلْحَسَنَةَ حَتَّىٰ عَفَوا۟ وَّقَالُوا۟ قَدْ مَسَّ ءَابَآءَنَا ٱلضَّرَّآءُ وَٱلسَّرَّآءُ فَأَخَذْنَـٰهُم بَغْتَةًۭ وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ ٩٥
৯৬ ) যদি জনপদের লোকেরা ঈমান আনতো এবং তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করতো, তাহলে আমি তাদের জন্য আকাশ ও পৃথিবীর রবকতসমূহের দুয়ার খুলে দিতাম। কিন্তু তারা তো প্রত্যাখ্যান করেছে। কাজেই তারা যে অসৎকাজ করে যাচ্ছিলো তার জন্য আমি তাদেরকে পাকড়াও করেছি।
وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ ٱلْقُرَىٰٓ ءَامَنُوا۟ وَٱتَّقَوْا۟ لَفَتَحْنَا عَلَيْهِم بَرَكَـٰتٍۢ مِّنَ ٱلسَّمَآءِ وَٱلْأَرْضِ وَلَـٰكِن كَذَّبُوا۟ فَأَخَذْنَـٰهُم بِمَا كَانُوا۟ يَكْسِبُونَ ٩٦
৯৭ ) জনপদের লোকেরা কি এখন এ ব্যাপারে নির্ভয় হয়ে গেছে যে, আমার শাস্তি কখনো অকস্মাত রাত্রিকালে তাদের ওপর এসে পড়বে না, যখন তারা থাকবে নিদ্রামগ্ন?
أَفَأَمِنَ أَهْلُ ٱلْقُرَىٰٓ أَن يَأْتِيَهُم بَأْسُنَا بَيَـٰتًۭا وَهُمْ نَآئِمُونَ ٩٧
.
৭৩.
এ বাক্যটি ঠিক সেই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে যে অর্থে আমরা ইনশাআল্লাহ বলে থাকি এবং যে সম্পর্কে সূরা কাহাফে (আয়াত ২৩-২৪) বলা হয়েছেঃ কোন জিনিস সম্পর্কে দাবী সহকারে একথা বলো না, আমি এমনটি করবো বরং এভাবে বলো, যদি আল্লাহ‌ চান তাহলে আমি এমনটি করবো। কারণ যে মু’মিন আল্লাহর সর্বময় কর্তৃত্ব এবং নিজের দাসত্ব, অধীনতা ও বশ্যতা সম্পর্কে যথাযথ উপলব্ধির অধিকারী হয়, সে কখনো নিজের শক্তির ওপর ভরসা করে এ দাবী করতে পারে না-আমি অমুক কাজটি করেই ছাড়বো অথবা অমুক কাজটি কখনো করবোই না। বরং সে এভাবে বলবে, আমার এ কাজ করার বা না করার ইচ্ছা আছে কিন্তু আমরা এ ইচ্ছা পূর্ণ হওয়া তো আমার মালিকের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে, তিনি তাওফিক দান করলে আমি সফলকাম হবো অন্যথায় ব্যর্থ হয়ে যাবো।
.
৭৪.
এ ছোট বাক্যটির ওপর ভাসা ভাসা দৃষ্টি বুলিয়ে এগিয়ে যাওয়া উচিত নয়। এটি থমকে দাঁড়িয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার একটি স্থান। মাদ্ইয়ানের সরদাররা ও নেতারা আসলে যে কথা বলছিল এবং নিজের জাতিকেও বিশ্বাস করাতে চাইছিল তা এই যে, শো'আইব যে সততা ও ঈমানদারীর দাওয়াত দিচ্ছেন এবং মানুষকে নৈতিকতা ও বিশ্বস্ততার যেসব স্বতন্ত্র মূলনীতির অনুসারী করতে চাচ্ছেন, সেগুলো মেনে নিলে আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো। আমরা যদি পূর্ণ সততার সাথে ব্যবসা করতে থাকি এবং কোন প্রকার প্রতারণার আশ্রয় না নিয়ে ঈমানদারীর সাথে পন্য বেচাকেনা করতে থাকি তাহলে আমাদের ব্যবসা কেমন করে চলবে? আমরা দুনিয়ার দু’টি সবচেয়ে বড় বানিজ্যিক সড়কের সন্ধিস্থলে বাস করি এবং মিসর ও ইরাকের মতো দু’টি বিশাল সুসভ্য ও উন্নত রাষ্ট্রের সীমান্তে আমাদের জনপদ গড়ে উঠেছে। এমতাবস্থায় আমরা যদি বাণিজ্যিক কাফেলার মালপত্র ছিনতাই করা বন্ধ করে দিয়ে শান্তিপ্রিয় হয়ে যাই তাহলে বর্তমান ভৌগলিক অবস্থানের কারণে আমরা এতদিন যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধা লাভ করে আসছিলাম তা একদম বন্ধ হয়ে যাবে এবং আশেপাশের বিভিন্ন জাতির ওপর আমাদের যে প্রতাপ ও আধিপত্য কায়েম আছে তাও খতম হয়ে যাবে। এ ব্যাপারটি কেবল শো'আইব সম্প্রাদায়ের প্রধানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং প্রত্যেক যুগের পথভ্রষ্ট লোকেরা সত্য, ন্যায়, সততা ও বিশ্বস্ততার নীতি অবলম্বন করার মধ্যে এমনি ধরনের বিপদেরআশঙ্কা করেছে। প্রত্যেক যুগের নৈরাজ্যবাদীরা একথাই চিন্তা করেছে যে, ব্যবসায়-বাণিজ্য, রাজনীতি এবং অন্যান্য পার্থিব বিষয়াবলী মিথ্যা, বেঈমানী ও দুর্নীতি ছাড়া চলতে পারে না। প্রত্যেক জায়গায় সত্যের দাওয়াতের মোকাবিলায় যেসব বড় বড় অজুহাত পেশ করা হয়েছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে এই যে, যদি দুনিয়ার প্রচলিত পথ থেকে সরে গিয়ে এ দাওয়াতের অনুসরণ করা হয় তাহলে সমগ্র জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে।
.
৭৫.
মাদইয়ানের এ ধ্বংসলীলা দীর্ঘকাল পর্যন্ত আশেপাশের বিভিন্ন জাতির মধ্যে প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছিল। তাই দেখা যায়, দাউদ আলাইহিস সালামের ওপর অবতীর্ণ যবুরের এক স্থানে বলা হয়েছেঃ হে খোদা! অমুক অমুক জাতি তোমার বিরুদ্ধে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছে, কাজেই তুমি তাদের সাথে ঠিক তেমনি ব্যবহার করো, যেমন মিদিয়ানের সাথে করেছিল। (৮৩: ৫-৯) ইয়াসঈয়াহ নবী এক স্থানে বনী ইসরাঈলকে সান্তনা দিতে গিয়ে বলেন, আশূরীয়দেরকে ভয় করো না যদিও তারা তোমাদের জন্য মিসরীয়দের মতই জালেম হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বেশী দেরী হবে না, বাহিনীগণের প্রভু তাদের ওপর নিজের দণ্ড বর্ষণ করবেন এবং তাদের সেই একই পরিণতি হবে যেমন মিদিয়ানের হয়েছিল। (যিশাইয় ১০: ২২-২৬)।
৭৬.
এখানে যতগুলো কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে, সবগুলোতে আসলে একজনের ঘটনা বর্ণনা করে তার মধ্যে অন্যজনের চেহারা দেখানোর রীতি অবলম্বন করা হয়েছে। এখানকার প্রত্যেকটি কাহিনী সে সময় মুহাম্মাদ ﷺ ও তাঁর জাতির মধ্যে যা কিছু সংঘটিত হচ্ছিল তার সাথে পুরোপুরি সাদৃশ্যপূর্ণ। প্রত্যেকটি কাহিনী ও ঘটনার এক পক্ষে একজন নবী আছেন। তাঁর শিক্ষা, দাওয়াত, উপদেশ ও কল্যাণকামিতা এবং তাঁর সমস্ত কথাই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুরূপ। আর প্রত্যেকটি কাহিনীর দ্বিতীয় পক্ষে আছে সত্য প্রত্যাখানকারী, গোষ্ঠি, সম্প্রদায় ও জাতি। তাদের আকীদাগত বিভ্রান্তি, নৈতিক চরিত্রহীনতা, মূর্খতাজনিত হঠকারিতা, তাদের গোত্র প্রধানদের শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকা এবং সত্য অস্বীকারকারী লোকদের নিজেদের গোমরাহীর ব্যাপারে একগুয়েমী ইত্যাদি সবকিছুই ঠিক তেমনি যেমন কুরাইশদের মধ্যে পাওয়া যেতো। আবার প্রত্যেকটি কাহিনীতে সত্য অস্বীকারকারী জাতিগুলোর যে পরিণাম দেখানো হয়েছে তার মাধ্যমে আসলে কুরাইশদেরকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, যদি তোমরা আল্লাহর পাঠানো নবীদের কথা না মানো এবং চরিত্র সংশোধনের যে সুযোগ তোমাদের দেয়া হচ্ছে অন্ধ জিদ ও গোয়ার্তুমীরবশবর্তী হয়ে তা হেলায় হারিয়ে বসো, তাহলে চিরদিন গোমরাহী ও ফিতনা-ফাসাদের ক্ষেত্রে জিদ ধরে বিভিন্ন জাতি যেমন পতন ও ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে, তোমরাও তেমনি ধ্বংসের সম্মুখীন হবে।
.
৭৭.
এক একজন নবী ও এক একটি সম্প্রদায়ের ব্যাপার আলাদা আলাদা ভাবে বর্ণনা করার পর এবার একটি সাধারণ ও সর্বব্যাপী নিয়ম ও বিধান বর্ণনা করা হচ্ছে। প্রতি যুগে প্রত্যেক নবীকে প্রেরণ করার সময় মহান আল্লাহ‌ এ নিয়মটি অবলম্বন করেন। নিয়মটি হচ্ছে, যখনই কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন নবী পাঠানো হয়েছে, তখনই প্রথমে সেই সম্প্রদায়ের বাহ্যিক পরিবেশকে নবীর দাওয়াত গ্রহণের জন্য সর্বাধিক অনুকূল ও উপযোগী বানানো হয়েছে। অর্থাৎ তাদেরকে রকমারি দুর্যোগ দুর্বিপাক ও বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। দুর্ভিক্ষ, মহামারী, বানিজ্যিক, ক্ষয়ক্ষতি, সামরিক পরাজয় ও এ ধরনের আরো নানান দুর্ভোগ তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, যাতে তাদের মন নরম হয়ে যায়, অহংকার ও ঔদ্ধত্যে দৃপ্ত গ্রীবা নত হয়, শক্তিমদত্ততা ও ধনলিপ্সা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। নিজেদের উপায়-উপকরণ, শক্তি ও যোগ্যতার ওপর নির্ভরতা ভেঙ্গে পড়ে এবং তারা যাতে অনুভব করতে পারে যে ওপরে অন্য কোন শক্তিধর সত্তা আছে এবং তারই হাতে রয়েছে তাদের ভাগ্যের লাগাম। এভাবে উপদেশের বানী শোনার জন্য তাদের কান খুলে যাবে এবং নিজেদের প্রভু পরওয়ারদিগারের সামনে সবিনয়ে শির আনত করার জন্য তারা প্রস্তুত হয়ে যাবে। তারপর এ ধরনের উপযোগী পরিবেশেও তাদের মন সত্যকে গ্রহণ করতে উদ্যোগী না হলে সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের পরীক্ষার মধ্যে তাদেরকে ঠেলে দেয়া হয়। এখান থেকেই শুরু হয় তাদের ধ্বংসের প্রক্রিয়া। প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধির মধ্যে জীবন যাপন করার সময় তারা নিজেদের দুর্দিনের কথা ভুলে যায়। তাদের বিকৃত বিবেকবুদ্ধি সম্পন্ন নেতৃত্ববর্গ তাদের মনোজগতে ইতিহাসের এ নির্বোধ সুলভ ধারণা ঢুকিয়ে দেয় যে, জগতে যা কিছু উত্থান পতন ও ভাঙ্গা-গড়া চলছে, তা কোন বিচক্ষণ কুশলী সত্তার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় হচ্ছে না এবং কোন নৈতিক কারণেও হচ্ছে না। বরং একটি অচেতন ও অন্ধ প্রকৃতি, সম্পূর্ণ নীতি বিবর্জিত কার্যকরণের ভিত্তিতে কখনো ভালো ও কখনো মন্দ দিনের উদ্ভব ঘটাতে থাকে। কাজেই ঝড় ঝন্ঝা ও বিপদ-আপদের অবতারণা থেকে কোন নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করা এবং কোন শুভাকাংখীর সদুপদেশ মেনে নিয়ে আল্লাহর সামনে বিনীতভাবে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়া এক ধরনের মানসিক দুর্বলতা ছাড়া আর কিছুই নয়। নবী ﷺ এ নির্বোধসুলভ মানসিকতারই নকশা একেছেন নিম্নোক্ত হাদীসটিতে।

لاَ يَزَالُ الْبَلاَءُ بِالْمُؤْمِنِ ِ حَتَّى يَخْرُجَ نَقِيًّامِن ذُنُوبِه , وَالمُنَافِقُ مَثَلُهُ كَمَثَلِ الْحِمَارِ لاَيَدرِى فَيمَ رَبَطَهُ اَهلُهُ وَلاَ فِيمَ اَرسَلُوهُ-

“বিপদ-মুসিবত তো মু’মিনকে পর্যায়ক্রমে সংশোধন করতে থাকে, অবশেষে যখন সে এ চুল্লী থেকে বের হয়ে, তখন তার সমস্ত ভেজাল ও খাদ পুড়ে সে পরিচ্ছন্ন ও খাঁটি হয়ে বেরিয়ে আসে। কিন্তু মুনাফিকের অবস্থা হয় ঠিক গাধার মতো। সে কিছুই বোঝে না, তার মালিক কেন তাকে বেঁধে রেখেছিল আবার কেনইবা তাকে ছেড়ে দিল।”

কাজেই যখন কোন জাতির অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, বিপদেও তার হৃদয় আল্লাহর সামনে নত হয় না, আল্লাহর অপরিসীম অনুগ্রহে ও ধন-সম্পদের প্রাচুর্যেও তার হৃদয়ে কৃতজ্ঞতাবোধ জাগে না এবং কোন অবস্থায়ই সে সংশোধিত হয় না, তখন ধ্বংস তার মাথার ওপর এমনভাবে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে যেন তা যে কোন সময় তার ওপর নেমে আসবে। ঠিক যেমন সন্তান ধারণের সময় পূর্ণ হয়ে গেছে, এমন একজন গর্ভবতী নারীর যে কোন সময় সন্তান প্রসব হতে পারে।

এখানে আরো একটি কথাও জেনে নেয়া উচিত। এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ‌ নিজের যে নিয়মের কথা উল্লেখ করেছেন নবী (সা.) এর আবির্ভাবকালেও ঠিক সেই নিয়মটিই কার্যকর করা হয়। ভাগ্য বিড়ম্বিত জাতিগুলোর যেসব কর্মকাণ্ডের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, সূরা আ'রাফ অবতীর্ণ হওয়ার দিনগুলোতে মক্কার কুরাইশরা ঠিক সেই একই ধরনের কর্মকাণ্ডের প্রকাশ ঘটিয়ে চলছিল। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) ও আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) উভয়েই একযোগে রেওয়াত করেছেন যে, নবী (সা.) এর নবুওয়াত লাভের পর যখন কুরাইশরা তাঁর দাওয়াতের বিরুদ্ধে চরম উগ্র মনোভাব অবলম্বন করতে শুরু করে তখন নবী (সা.) দোয়া করেন, হে আল্লাহ! ইউসুফের যুগে যেমন সাত বছর দুর্ভিক্ষ হয়েছিল তেমনি ধরনের দুর্ভিক্ষের সাহায্যে এ লোকদের মোকাবিলা করার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করো। ফলে আল্লাহ‌ তাদেরকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন করেন। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, লোকেরা মৃত প্রাণীর গোশত খেতে শুরু করে, এমন কি চামড়া, হাড় ও পশম পর্যন্ত খেয়ে ফেলে। অবশেষে মক্কার লোকেরা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে নবী (সা.) এর কাছে তাদের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করার আবেদন জানায়। কিন্তু তাঁর দোয়ায় আল্লাহ‌ যখন সেই মহা সংকট থেকে তাদেরকে উদ্ধার করেন এবং লোকেরা আবার সুদিনের মুখ দেখে তখন তাদের বুক অহংকারে আগের চাইতে আরো বেশী স্ফীত হয়ে উঠে। তাদের মধ্যে থেকে যে গুটিকয় লোকের মন নরম হয়ে গিয়েছিল, দুষ্টলোকেরা তাদেরকেও এ বলে ঈমানের পথ থেকে ফিরিয়ে নিতে থাকেঃ আরে মিয়া! এসব তো সময়ের উত্থান পতন ও কালের আবর্তন ছাড়া আর কিছুই নয়। এর আগেও দুর্ভিক্ষ এসেছে। এবারের দুর্ভিক্ষ দীর্ঘ দিন স্থায়ী হয়েছে এটা কোন নতুন কথা নয়। কাজেই এসব ব্যাপারে প্রতারিত হয়ে মুহাম্মাদের ফাঁদে পা দিয়ো না। এ সূরা আ'রাফ যে সময় নাযিল হয় সে সময় মুশরিকরা এ বাগাড়ম্বর করে বেড়াচ্ছিল। কাজেই কুরআন মজীদের এসব আয়াত অত্যন্ত সময়োপযোগী ও চলতি ঘটনাবলীর সাথে সামঞ্জস্যশীল ছিল। এ পটভূমিকার আলোকে এ আয়াতগুলোর নিগূঢ় অর্থ ও তাৎপর্য পুরোপুরি অনুধাবন করা যেতে পারে। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, সূরা ইউনুস ২১ আয়াত, আন নহল ১১২ আয়াত, আল মু’মিনূন ৫ও ৭৬, আদ দুখান ৯-১৬)।

.
.
অনুবাদ: