পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

১২৪ আয়াত

২৪ ) আর (যুদ্ধের মাধ্যমে) তোমাদের অধিকারভুক্ত হয়েছে এমন সব মেয়ে ছাড়া বাকি সমস্ত সধবাই তোমাদের জন্য হারাম। ৪৪ এ হচ্ছে আল্লাহর আইন। এ আইন মেনে চলা তোমাদের জন্য অপরিহার্য গণ্য করা হয়েছে। এদের ছাড়া বাদ বাকি সমস্ত মহিলাকে অর্থ-সম্পদের মাধ্যমে লাভ করা তোমাদের জন্য হালাল গণ্য করা হয়েছে। তবে শর্ত হচ্ছে এই যে, তাদেরকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করতে হবে, অবাধ যৌন লালসা তৃপ্ত করতে পারবে না। তারপর যে দাম্পত্য জীবনের স্বাদ তোমরা তাদের মাধ্যমে গ্রহণ করো, তার বদলে তাদের মোহরানা ফরয হিসেবে আদায় করো। তবে মোহরানার চুক্তি হয়ে যাবার পর পারস্পরিক রেজামন্দির মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে যদি কোন সমঝোতা হয়ে যায় তাহলে তাতে কোন ক্ষতি নেই। আল্লাহ‌ সর্বজ্ঞ ও জ্ঞানী।
۞ وَٱلْمُحْصَنَـٰتُ مِنَ ٱلنِّسَآءِ إِلَّا مَا مَلَكَتْ أَيْمَـٰنُكُمْ ۖ كِتَـٰبَ ٱللَّهِ عَلَيْكُمْ ۚ وَأُحِلَّ لَكُم مَّا وَرَآءَ ذَٰلِكُمْ أَن تَبْتَغُوا۟ بِأَمْوَٰلِكُم مُّحْصِنِينَ غَيْرَ مُسَـٰفِحِينَ ۚ فَمَا ٱسْتَمْتَعْتُم بِهِۦ مِنْهُنَّ فَـَٔاتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ فَرِيضَةًۭ ۚ وَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِيمَا تَرَٰضَيْتُم بِهِۦ مِنۢ بَعْدِ ٱلْفَرِيضَةِ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًۭا ٢٤
২৫ ) আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তির সম্ভ্রান্ত পরিবারের মুসলিম মেয়েদের বিয়ে করার সামর্থ নেই তার তোমাদের অধিকারভুক্ত মুমিন দাসীদের মধ্য থেকে কাউকে বিয়ে করে নেয়া উচিত। আল্লাহ‌ তোমাদের ঈমানের অবস্থা খুব ভালোভাবেই জানেন। তোমরা সবাই একই দলের অন্তর্ভুক্ত। ৪৫ কাজেই তাদের অভিভাবকদের অনুমতিক্রমে তাদেরকে বিয়ে করো এবং প্রচলিত তাদের মোহরানা আদায় করো, যাতে তারা বিয়ের আবেষ্টনীর মধ্যে সংরক্ষিত থাকে, অবাধ যৌন লালসা পরিতৃপ্ত করতে উদ্যোগী না হয় এবং লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম না করে বেড়াই। তারপর যখন তারা বিয়ের আবেষ্টনীর মধ্যে সংরক্ষিত হয়ে যায় এবং এরপর কোন ব্যভিচার করে তখন তাদের জন্য সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েদের জন্য নির্ধারিত শাস্তির অর্ধেক শাস্তি দিতে হবে। ৪৬ তোমাদের মধ্য থেকে সেইসব লোকের জন্য এ সুবিধা ৪৭ সৃষ্টি করা হয়েছে, যাদের বিয়ে না করলে তাকওয়া বাঁধ ভেঙে পড়ার আশঙ্কা থাকে। তবে সবর করলে তা তোমাদের জন্য ভালো। আর আল্লাহ‌ ক্ষমাশীল ও করুণাময়।
وَمَن لَّمْ يَسْتَطِعْ مِنكُمْ طَوْلًا أَن يَنكِحَ ٱلْمُحْصَنَـٰتِ ٱلْمُؤْمِنَـٰتِ فَمِن مَّا مَلَكَتْ أَيْمَـٰنُكُم مِّن فَتَيَـٰتِكُمُ ٱلْمُؤْمِنَـٰتِ ۚ وَٱللَّهُ أَعْلَمُ بِإِيمَـٰنِكُم ۚ بَعْضُكُم مِّنۢ بَعْضٍۢ ۚ فَٱنكِحُوهُنَّ بِإِذْنِ أَهْلِهِنَّ وَءَاتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ بِٱلْمَعْرُوفِ مُحْصَنَـٰتٍ غَيْرَ مُسَـٰفِحَـٰتٍۢ وَلَا مُتَّخِذَٰتِ أَخْدَانٍۢ ۚ فَإِذَآ أُحْصِنَّ فَإِنْ أَتَيْنَ بِفَـٰحِشَةٍۢ فَعَلَيْهِنَّ نِصْفُ مَا عَلَى ٱلْمُحْصَنَـٰتِ مِنَ ٱلْعَذَابِ ۚ ذَٰلِكَ لِمَنْ خَشِىَ ٱلْعَنَتَ مِنكُمْ ۚ وَأَن تَصْبِرُوا۟ خَيْرٌۭ لَّكُمْ ۗ وَٱللَّهُ غَفُورٌۭ رَّحِيمٌۭ ٢٥
২৬ ) তোমাদের আগে যেসব সৎলোক চলে গেছে, তারা যেসব পদ্ধতির অনুসরণ করতো, আল্লাহ‌ তোমাদের সামনে সেই পদ্ধতিগুলো সুস্পষ্ট করে দিতে এবং সেই সব পদ্ধতিতে তোমাদের চালাতে চান। তিনি নিজের রহমত সহকারে তোমাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে চান। আর তিনি সর্বজ্ঞ ও জ্ঞানময়। ৪৮
يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيُبَيِّنَ لَكُمْ وَيَهْدِيَكُمْ سُنَنَ ٱلَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ وَيَتُوبَ عَلَيْكُمْ ۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌۭ ٢٦
২৭ ) হ্যাঁ, আল্লাহ‌ তো রহমত সহকারে তোমাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে চান। কিন্তু যারা নিজেদের প্রবৃত্তির লালসার অনুসরণ করছে তারা চায় তোমরা ন্যায় ও সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে দূরে চলে যাও। ৪৯
وَٱللَّهُ يُرِيدُ أَن يَتُوبَ عَلَيْكُمْ وَيُرِيدُ ٱلَّذِينَ يَتَّبِعُونَ ٱلشَّهَوَٰتِ أَن تَمِيلُوا۟ مَيْلًا عَظِيمًۭا ٢٧
২৮ ) আল্লাহ তোমাদের ওপর থেকে বিধি-নিষেধ হাল্‌কা করতে চান। কারণ মানুষকে দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে।
يُرِيدُ ٱللَّهُ أَن يُخَفِّفَ عَنكُمْ ۚ وَخُلِقَ ٱلْإِنسَـٰنُ ضَعِيفًۭا ٢٨
২৯ ) হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরস্পরের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ে ফেলো না। লেনদেন হতে হবে পারস্পরিক রেজামন্দির ভিত্তিতে। ৫০ আর নিজেকে হত্যা করো না। ৫১ নিশ্চিত জানো, আল্লাহ‌ তোমাদের প্রতি মেহেরবান। ৫২
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا تَأْكُلُوٓا۟ أَمْوَٰلَكُم بَيْنَكُم بِٱلْبَـٰطِلِ إِلَّآ أَن تَكُونَ تِجَـٰرَةً عَن تَرَاضٍۢ مِّنكُمْ ۚ وَلَا تَقْتُلُوٓا۟ أَنفُسَكُمْ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًۭا ٢٩
৩০ ) যে ব্যক্তি জুলুম ও অন্যায় বাড়াবাড়ি করে এমনটি করবে তাকে আমি অবশ্যি আগুনে নিক্ষেপ করবো। আর আল্লাহর জন্য এটা কোন কঠিন কাজ নয়।
وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ عُدْوَٰنًۭا وَظُلْمًۭا فَسَوْفَ نُصْلِيهِ نَارًۭا ۚ وَكَانَ ذَٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرًا ٣٠
৩১ ) তোমরা যদি বড় বড় গোনাহ থেকে দূরে থাকো, যা থেকে দূরে থাকার জন্য তোমাদের বলা হচ্ছে, তাহলে তোমাদের ছোট-খাটো খারাপ কাজগুলো আমি তোমাদের হিসেব থেকে বাদ দিয়ে দেবো ৫৩ এবং তোমাদের সম্মান ও মর্যাদার জায়গায় প্রবেশ করিয়ে দেবো।
إِن تَجْتَنِبُوا۟ كَبَآئِرَ مَا تُنْهَوْنَ عَنْهُ نُكَفِّرْ عَنكُمْ سَيِّـَٔاتِكُمْ وَنُدْخِلْكُم مُّدْخَلًۭا كَرِيمًۭا ٣١
৩২ ) আর যা কিছু আল্লাহ‌ তোমাদের কাউকে অন্যদের মোকাবিলায় বেশী দিয়েছেন তার আকাংখা করো না। যা কিছু পুরুষেরা উপার্জন করেছে তাদের অংশ হবে সেই অনুযায়ী। আর যা কিছু মেয়েরা উপার্জন করেছে তাদের অংশ হবে সেই অনুযায়ী। হ্যাঁ, আল্লাহর কাছে তাঁর ফযল ও মেহেরবানীর জন্য দোয়া করতে থাকো। নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ‌ সমস্ত জিনিসের জ্ঞান রাখেন। ৫৪
وَلَا تَتَمَنَّوْا۟ مَا فَضَّلَ ٱللَّهُ بِهِۦ بَعْضَكُمْ عَلَىٰ بَعْضٍۢ ۚ لِّلرِّجَالِ نَصِيبٌۭ مِّمَّا ٱكْتَسَبُوا۟ ۖ وَلِلنِّسَآءِ نَصِيبٌۭ مِّمَّا ٱكْتَسَبْنَ ۚ وَسْـَٔلُوا۟ ٱللَّهَ مِن فَضْلِهِۦٓ ۗ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ بِكُلِّ شَىْءٍ عَلِيمًۭا ٣٢
৩৩ ) আর বাপ-মা ও আত্মীয়-স্বজনদের পরিত্যক্ত ধন-সম্পত্তিতে আমি তাদের হকদার নির্ধারিত করে দিয়েছি। এখন থাকে তারা, যাদের সাথে তোমাদের চুক্তি ও অঙ্গীকার আছে, তাদের অংশ তাদেরকে দিয়ে দাও। নিশ্চিত জেনে রাখো আল্লাহ‌ সব জিনিসের রক্ষণাবেক্ষণকারী। ৫৫
وَلِكُلٍّۢ جَعَلْنَا مَوَٰلِىَ مِمَّا تَرَكَ ٱلْوَٰلِدَانِ وَٱلْأَقْرَبُونَ ۚ وَٱلَّذِينَ عَقَدَتْ أَيْمَـٰنُكُمْ فَـَٔاتُوهُمْ نَصِيبَهُمْ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلَىٰ كُلِّ شَىْءٍۢ شَهِيدًا ٣٣
৪৪.
অর্থাৎ যেসব মেয়ে যুদ্ধ বন্দিনী হয়ে এসেছে এবং তাদের স্বামীরা দারুল হার্‌বে (ইসলাম বিরোধী ও ইসলামের শত্রুদের শাসিত দেশ) রয়ে গেছে তারা হারাম নয়। কারণ দারুল হার্‌ব থেকে দারুল ইসলামে আসার পর তাদের বিয়ে ভেঙে গেছে। এই ধরনের মেয়েদের বিয়েও করা যায় আবার যাদের মালিকানায় তারা আছে তারা তাদের সাথে সঙ্গমও করতে পারে। তবে স্বামী-স্ত্রী যদি একই সাথে বন্দী হয়ে আসে, তাহলে এক্ষেত্রে কোন্ ধরনের বিধান গৃহীত হবে, এ ব্যাপারে ফকীহগণের মধ্যে মতবিরোধ আছে। ইমাম্ আবু হানীফা ও তাঁর সাথীগণের মতে, তাদের বিয়ে অপরিবর্তিত থাকবে। অন্যদিকে ইমাম মালেক ও ইমাম শাফেঈর মতে তাদের বিয়ে অটুট থাকবে না।

যুদ্ধ বন্দিনী দাসীদের সাথে সঙ্গম করার ব্যাপারে বহু রকমের বিভ্রান্তি লোকদের মধ্যে পাওয়া যায়। তাই এ প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো ভালো করে বুঝে নেয়া দরকার।

একঃ যে সমস্ত মেয়ে যুদ্ধে বন্দী হয়, তাদেরকে বন্দী করার সাথে সাথেই যে কোন সৈনিক তাদের সাথে সঙ্গম করার অধিকার লাভ করে না। বরং ইসলামী আইন অনুযায়ী এই ধরনের মেয়েদেরকে সরকারের হাতে সোপর্দ করে দেয়া হবে। সরকার চাইলে তাদেরকে বিনা শর্তে মুক্ত করে দিতে পারে, তাদের থেকে মুক্তিপণ গ্রহণ করতে পারে, শত্রুর হাতে যেসব মুসলমান বন্দী হয়েছে তাদের সাথে এদের বিনিময়ও করতে পারে এবং চাইলে তাদেরকে সৈন্যদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেও পারে। এ ব্যাপারে সরকারের পূর্ণ ইখতিয়ার রয়েছে। একজন সৈনিক কেবলমাত্র সরকারের পক্ষ থেকে তাকে যে যুদ্ধ বন্দিনীটি দেয়া হয় তার সাথেই সঙ্গম করতে পারে।

দুইঃ যে মেয়েটিকে এভাবে কারো মালিকানায় দেয়া হয়, যতক্ষণ না তার একবার মাসিক ঋতুস্রাব হয় এবং এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় যে, সে গর্ভবতী নয় ততক্ষণ তার সাথে সঙ্গম করা যেতে পারে না। এর আগে তার সাথে সঙ্গম করা হারাম। আর যদি সে গর্ভবতী হয়, তাহলে সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার আগেও তার সাথে সঙ্গম করা অবৈধ।

তিনঃ যুদ্ধ বন্দিনীদের সাথে সঙ্গম করার ব্যাপারে তাদের অবশ্যি আহ্‌লি কিতাব হতে হবে এমন কোন শর্ত নেই। তাদের ধর্ম যাই হোক না কেন, যাদের মধ্যে তাদেরকে ভাগ করে দেয়া হবে তারা তাদের সাথে সঙ্গম করতে পারবে।

চারঃ যে মেয়েকে যার ভাগে দেয়া হবে একমাত্র সেই তার সাথে সঙ্গম করতে পারবে। অন্য কারো তার গায়ে হাত দেবার অধিকার নেই। সেই মেয়ের গর্ভে যে সন্তান জন্মাবে সে তার মালিকের বৈধ সন্তান হিসেবে গণ্য হবে। শরীয়াতে আপন ঔরসজাত সন্তানের যে অধিকার নির্ধারিত হয়েছে এই সন্তানের আইনগত অধিকারও তাই হবে। সন্তানের জননী হয়ে যাবার পর এই মেয়েকে আর বিক্রি করা যাবে না এবং মালিক মরে যাওয়ার সাথে সাথেই সে মুক্ত হয়ে যাবে।

পাঁচঃ যে মেয়েটি এভাবে কোন ব্যক্তির মালিকানাধীন হয়, তাকে তার মালিক যদি দ্বিতীয় কোন ব্যক্তির সাথে বিয়ে দিয়ে দেয় তাহলে মালিক তার থেকে অন্য সমস্ত খেদমত নিতে পারবে কিন্তু তার সাথে যৌন সম্পর্ক রাখার অধিকার তার থাকবে না।

ছয়ঃ শরীয়াত স্ত্রীদের সংখ্যার ব্যাপারে যেমন চারজনের সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে, দাসীদের ব্যাপারে তেমন কোন সংখ্যা নির্ধারণ করে দেয়নি। ধনী লোকেরা বেশুমার বাঁদী কিনে কিনে মহল ভরে ফেলবে এবং বিলাসিতার সাগরে গা ভাসিয়ে দেবে, এটা শরীয়াতের উদ্দেশ্য ছিল ন। বরং আসলে যুদ্ধের অনিশ্চিত অবস্থাই ছিল এ ব্যাপারে সীমা নির্ধারণ না করার মূলীভূত কারন।

সাতঃ সরকার আইনগতভাবে কোন ব্যক্তিকে যুদ্ধবন্দীদের ওপর যে মালিকানা অধিকার দান করেছে মালিকানার অন্যান্য অধিকারের ন্যায় এটিও স্থানান্তর যোগ্য।

আটঃ বিয়ে যেমন একটি আইনসঙ্গত কাজ তেমনি সরকারের পক্ষ থেকে কাউকে যথারীতি মালিকানা অধিকার দান করাও একটি আইনসঙ্গত কাজ। কাজেই যে ব্যক্তি বিয়ের মধ্যে কোনো প্রকার অন্যায় ও অপ্রীতির ব্যাপার দেখে না, তার ক্রীতদাসীর সাথে সঙ্গম করার মধ্যে খামাখা কোন অন্যায় ও অপ্রীতিকর বিষয় অনুভব করার পেছনে কোন ন্যায়সঙ্গত কারণ নেই।

নয়ঃ যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে থেকে কোন মেয়েকে কারো মালিকানায় দিয়ে দেবার পর পুনর্বার সরকার তাকে ফেরত নেবার অধিকার রাখে না, ঠিক যেমন কোন মেয়ের অভিভাবক তাকে কারো সাথে বিয়ে দেবার পর আবার তাকে ফিরিয়ে নেবার অধিকার হারিয়ে ফেলে।

দশঃ কোন সেনাপতি যদি নিছক সাময়িকভাবে তার সৈন্যদেরকে বন্দিনী মেয়েদের মাধ্যমে নিজেদের যৌন তৃষ্ণা মিটাবার অনুমতি দেয় এবং তাদেরকে সৈন্যদের মধ্যে ভাগ করে দেয়, তাহলে ইসলামী আইনের দৃষ্টিতে এটা হবে সম্পূর্ণ একটি অবৈধ কাজ। যিনার সাথে এর কোন পার্থক্য নেই। আর যিনা ইসলামী আইন অনুযায়ী একটি অপরাধ। (বিস্তারিত জানার জন্য আমার ‘তাফহীমাত’ ২য় খণ্ড ও ‘রাসায়েল ও মাসায়েল’ ১ম খণ্ড দেখুন।)

.
৪৫.
অর্থাৎ সমাজ জীবনে মানুষের মধ্যে মর্যাদার যে পার্থক্য দেখা যায় তা নিছক আপেক্ষিক। নয়তো আসলে সব মুসলমান সমান। তাদের মধ্যে যথার্থই পার্থক্য করার মত যদি কোন বিষয় থাকে তাহলে সেটি হচ্ছে ঈমান। আর ঈমান কোন উঁচু ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। একজন ক্রীতদাসীও ঈমান ও নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে একজন সম্ভ্রান্ত মহিলার চাইতেও ভালো হতে পারে।
৪৬.
আপাত দৃষ্টিতে এখানে একটি জটিলতা দেখা দেয়। খারেজী ও ‌‘রজম’ তথা প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুর শাস্তি অস্বীকারকারী অন্যান্য লোকেরা এ থেকে সুযোগ গ্রহণ করেছে। তারা বলেঃ স্বাধীন বিবাহিতা মেয়েদের যিনার শাস্তি ইসলামী শরীয়াতে যদি ‘রজম’ হয়ে থাকে, তাহলে এর অর্ধেক শাস্তি যা ক্রীতদাসীদেরকে দেয়া হবে, তা কি হতে পারে? কাজেই এই আয়াত একথার চূড়ান্ত সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, ইসলামে রজমের শাস্তিই নেই। কিন্তু তারা আসলে কুরআনের শব্দাবলীর ওপর গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করেনি। এই রুকূ’তে ‘মুহসানাত’ (সংরক্ষিত মহিলা) শব্দটি দু’টি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। একটি হচ্ছে, “বিবাহিতা মহিলা”, যারা স্বামীর সংরক্ষণ ব্যবস্থা লাভ করে এবং অন্যটি “সম্ভ্রান্ত মহিলা”, যারা বিবাহিতা না হলেও পরিবারের সংরক্ষণ লাভ করে। আলোচ্য আয়াতে ‘মুহসানাত’ শব্দটি ক্রীতদাসীর মোকাবিলায় সম্ভ্রান্ত মহিলাদের জন্য দ্বিতীয় অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, প্রথম অর্থে নয়। আয়াতে উল্লেখিত বিষয়বস্তু থেকে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে, বিপরীতপক্ষে ক্রীতদাসীদের জন্য ‘মুহসানাত’ শব্দটি প্রথম অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, যখন তারা বিয়ের সংরক্ষণ ব্যবস্থা লাভ করবে। (فاذا احصن) কেবলমাত্র তখনই তাদের জন্য যিনা করলে উল্লেখিত শাস্তির ব্যবস্থা দেয়া হয়েছে। এখন গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলে একথা একেবারেই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সম্ভ্রান্ত মহিলারা দু’টি সংরক্ষণ ব্যবস্থা লাভ করে। একটি হচ্ছে, পরিবারের সংরক্ষণ ব্যবস্থা। এর কারণে তারা বিবাহিতা না হয়েও ‘মুহসিনা’ অর্থাৎ সংরক্ষিত হয়ে যায়। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, স্বামীর সংরক্ষণ ব্যবস্থা। এর ফলে তারা পরিবারের সংরক্ষণের ওপর আর একটা বাড়তি সংরক্ষণ ব্যবস্থা লাভ করে। বিপরীত পক্ষে ক্রীতদাসী যতদিন ক্রীতদাসী অবস্থায় থাকে ততদিন সে ‘মুহসিনা’ নয়। কারণ সে কোন পরিবারের সংরক্ষণ ব্যবস্থা লাভ করেনি। তবে হ্যাঁ, বিয়ে হবার পর সে কেবল স্বামীর সংরক্ষণ ব্যবস্থা লাভ করে এবং তাও অসম্পূর্ণ। কারণ স্বামীর সংরক্ষণ ব্যবস্থার আওতায় আসার পরও তারা মালিকের সেবা ও চাকরী থেকে মুক্তি লাভ করেনা এবং সম্ভ্রান্ত মহিলারা সমাজে যে মর্যাদা লাভ সে ধরনের মর্যাদাও তারা লাভ করেনা। কাজেই তাদেরকে যে শাস্তি দেয়া হবে তা হবে সম্ভ্রান্ত পরিবারের অবিবাহিতা মেয়েদের শাস্তির অর্ধাংশ, সম্ভ্রান্ত পরিবারের বিবাহিতা মেয়েদের শাস্তির অর্ধাংশ নয়। এছাড়াও এখান থেকে একথাও জানা গেছে যে, সূরা নূর-এর আয়াতে কেবলমাত্র অবিবাহিতা সম্ভ্রান্ত মহিলাদের যিনার শাস্তির কথা উল্লেখিত হয়েছে এবং এর মোকাবিলায় এখানে বিবাহিতা ক্রীতদাসীদের শাস্তি অর্ধেক বলা হয়েছে। আর বিবাহিতা সম্ভ্রান্ত মহিলারা তো অবিবাহিতা সম্ভ্রান্ত মহিলাদের তুলনায় কঠিন শাস্তি লাভের যোগ্য। কারণ তারা দু’টি সংরক্ষণ ব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলে। যদিও কুরআন তাদের ব্যাপারে রজমের শাস্তির বিধান সুস্পষ্ট করেনি তবুও অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে সেদিকে ইঙ্গিত করেছে। এ বিষয়টি স্থুল বুদ্ধির লোকদের দৃষ্টির অগোচরে থেকে যেতে পারে কিন্তু নবীর সূক্ষ্ম ও সুতীক্ষ্ম অন্তরালে থাকা তার পক্ষে সম্ভবপর ছিল না।
৪৭.
অর্থাৎ সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে বিয়ে করার সামর্থ্য না থাকলে কোন ক্রীতদাসীর মালিকের অনুমতিক্রমে তাকে বিয়ে করার সুবিধা।
.
৪৮.
সূরার শুরু থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত যে নির্দেশ ও বিধান দেয়া হয়েছে এবং এই সূরা নাযিলের পূর্বে সূরা বাকারায় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের সমস্যাবলী সমাধানের জন্য যে বিধান দেয়া হয়েছিল সেসবের দিকে সামগ্রিকভাবে একটি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে, মানব সভ্যতার প্রাচীনতম যুগ থেকে প্রতি যুগের নবীগণ ও তাঁদের সৎ ও সত্যনিষ্ঠ অনুসারীগণ সমাজ, সংস্কৃতি ও নৈতিকতার এই আইনগুলো কার্যকর করে এসেছেন। আল্লাহ‌ তাঁর অসীম অনুগ্রহের বদৌলতে তোমাদেরকে জাহেলীয়াতের অবস্থা থেকে বের করে সৎ ও সত্যনিষ্ঠ লোকদের জীবনধারার দিকে পরিচালিত করেছেন।
৪৯.
এখানে মুনাফিক, রক্ষণশীল ও প্রাচীন পন্থী মূর্খ এবং মদীনার উপকণ্ঠের ইহুদীদের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। সমাজ ও সংস্কৃতিতে শত শত বছরের পুঞ্জীভূত জাহেলী বংশ ও গোত্রপ্রীতি এবং রসম-রেওয়াজের বিরুদ্ধে যে সংস্কার অভিযান চলছিল মুনাফিক ও রক্ষণশীলদের কাছে তা ছিল অত্যন্ত অপ্রীতিকর। তারা এটাকে কোনক্রমেই বরদাশত করতে পারছিল না। মৃতের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে মেয়েদের অংশ লাভ, শ্বশুর বাড়ির বাঁধন থেকে বিধবাদের মুক্তি পাওয়া এবং ইদ্দত শেষ হবার পর যেকোন ব্যক্তিকে বিয়ে করার ব্যাপারে তাদের স্বাধীন ক্ষমতা লাভ, সৎ-মাকে বিয়ে করা হারাম হওয়া দুই বোনকে একই সাথে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করাকে অবৈধ গণ্য করা, পালকপুত্রকে বিয়ে করা হালাল গণ্য করা এবং এই ধরনের আরো অনেক সংস্কারমূলক কার্যাবলীর প্রত্যেকটির ওপর বয়োবৃদ্ধ ও বাপ-দাদার রীতি-রেওয়াজের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিরা চীৎকার করে উঠছিল। দীর্ঘদিন থেকে এই বিধানগুলোর বিরুদ্ধে নানান কথাবার্তা চলছিল। দুষ্ট লোকেরা নবী ﷺ ও তাঁর সংস্কারমূলক দাওয়াতের বিরুদ্ধে এই বিরূপ কথাগুলো ব্যবহার করে লোকদেরকে উত্তেজিত করে চলছিল। যেমন, ইসলামী শরীয়াত যে ধরনের বিয়েকে হারাম গণ্য করছিল তেমনি ধরনের কোন বিয়ের ফলে ইতিপূর্বে যে ব্যক্তির জন্ম হয়েছিল তাকে এই বলে উত্তেজিত করা হচ্ছিলঃ “নিন জনাব, আজ যে নতুন বিধান ওখানে এসেছে তার দৃষ্টিতে তো আপনার বাপ ও মায়ের সম্পর্ক অবৈধ গণ্য হয়েছে।” এভাবে সেখানে আল্লাহর বিধানের আওতায় যে সংস্কারমূলক কাজ হচ্ছিল এই নির্বোধ লোকেরা তার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছিল।

অন্যদিকে ছিল ইহুদীরা। শত শত বছরের অপ্রয়োজনীয় সূক্ষ্ম শাস্ত্রীয় বিশ্লেষণের মাধ্যমে তারা আল্লাহর শরীয়াতের গায়ে নিজেদের মনগড়া আইন-বিধানের একটি মোটা চামড়া জড়িয়ে দিয়েছিল। শরীয়াতের মধ্যে তারা অসংখ্য বিধি-নিষেধ, সূক্ষ্মতা ও কঠোরতা বৃদ্ধি করেছিল। বহু হালাল জিনিসকে তারা হারাম করে নিয়েছিল। অনেক কল্পনাভিত্তিক কুসংস্কারকে তারা আল্লাহর আইনের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিল। এখন কুরআন যে সহজ-সরল শরীয়াত পেশ করছিল তার মর্যাদা অনুধাবন করা তাদের উলামা ও জনগণ উভয়ের মন-মানস ও রুচির সম্পূর্ণ বিরোধী ছিল। কুরআনের বিধান শুনে তারা অস্থির হয়ে পড়তো। এক একটি বিষয়ের ওপর শত শত আপত্তি উত্থাপন করতো। তাদের দাবী ছিল, যদি কুরআন তাদের ফকীহদের সমস্ত ইজতিহাদ ও তাদের পূর্বপূরুষদের যাবতীয় কাল্পনিক কুসংস্কার ও পৌরানিকতাবাদকে আল্লাহর শরীয়াত হিসেবে গণ্য না করে, তাহলে এটি কখনোই আল্লাহর কিতাব হতে পারে না। যেমন, ইহুদীদের নিয়ম ছিল, মাসিক ঋতুস্রাবের সময় তারা মেয়েদেরকে সম্পূর্ণ নাপাক মনে করতো। তাদের রান্না করা খাবার খেতো না। তাদের হাতের পানি পান করতো না। তাদের সাথে এক বিছানায় বসতো না। এমনকি তাদের হাতে স্পর্শ লেগে যাওয়াকে মকরূহ মনে করা হতো। এই কদিন মেয়েরা তাদের নিজেদের ঘরে নিজেরা ‘অচ্ছুৎ’ হয়ে থাকতো। ইহুদীদের সংস্পর্শে এসে মদীনার আনসারদের মধ্যেও এই রেওয়াজ চালু হয়ে গিয়েছিল। রসূলুল্লাহু ﷺ মদীনায় এলে তাঁকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়। জবাবে সূরা বাকারার ২৮ রুকূ’র প্রথম আয়াতটি নাযিল হয়। এই আয়াতের প্রেক্ষিতে নবী ﷺ হুকুম দেন, মাসিক ঋতুস্রাবের সময় স্ত্রীদের সাথে যে সমস্ত সম্পর্ক যেভাবে রাখা হতো সেগুলো ঠিক তেমনিভাবেই এখন তাদের সাথে রাখো। এতে ইহুদীরা হৈ চৈ করতে লাগলো। তারা বলতে থাকলো, এ ব্যক্তি তো কসম খেয়ে বসেছে, আমাদের এখানে যা কিছু হারাম হয়ে আছে সেগুলোকে সে হালাল করেই ছাড়বে এবং যেসব জিনিসকে আমরা নাপাক গণ্য করে এসেছি সেগুলোকে পাক-পবিত্র গণ্য করবেই।

.
৫০.
“অন্যায়ভাবে” বলতে এখানে এমন সব পদ্ধতির কথা বুঝানো হয়েছে যা সত্য ও ন্যায়নীতি বিরোধী এবং নৈতিক দিক দিয়েও শরীয়াতের দৃষ্টিতে নাজায়েয। “লেনদেন” মানে হচ্ছে, পরস্পরের মধ্যে স্বার্থ ও মুনাফার বিনিময় করা। যেমন ব্যবসায়, শিল্প ও কারিগরী ইত্যাদি ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। সেখানে একজন অন্যজনের প্রয়োজন সরবরাহ করার জন্য পরিশ্রম করে এবং তার বিনিময় দান করে। পারস্পরিক রেজামন্দি অর্থ হচ্ছে, কোন বৈধ চাপ বা ধোঁকা ও প্রতারণার মাধ্যমে লেনদেন হবে না। ঘুষ ও সুদের মধ্যে আপাত রেজামন্দি থাকে কিন্তু আসলে এই রেজামন্দির পেছনে থাকে অক্ষমতা। প্রতিপক্ষ নিজের অক্ষমতার কারণে বাধ্য ও অন্যন্যোপায় হয়ে চাপের মুখে ঘুষ ও সুদ দিতে রাজী হয়। জুয়ার মধ্যেও বাহ্যিক দৃষ্টিতে রেজামন্দিই মনে হয়। কিন্তু আসলে জুয়াতে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক ব্যক্তি একমাত্র সে-ই বিজয়ী হবে এই ভ্রান্ত আশায় এতে অংশগ্রহণে রাজি হয়। পরাজয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে কেউ এতে অংশগ্রহণ করে না। প্রতারণা ও জালিয়াতির কারবারেও বাহ্যত রেজামন্দিই দেখা যায়। কিন্তু এখানেই রেজামন্দির পেছনে এই ভুল ধারণা কাজ করে যে, এর মধ্যে প্রতারনা ও জালিয়াতী নেই। দ্বিতীয় পক্ষ যদি জানতে পারে যে, প্রথম পক্ষ তার সাথে প্রতারণা ও জালিয়াতী করছে তাহলে সে কখনো এতে রাজি হবে না।
৫১.
এ বাক্যটি আগের বাক্যের পরিশিষ্ট হতে পারে আবার একটি স্বতন্ত্র বাক্যও হতে পারে। একে যদি আগের বাক্যের পরিশিষ্ট মনে করা হয় তাহলে এর অর্থ হয়, অন্যের অর্থ-সম্পদ অবৈধ ভাবে আত্মসাত করা আসলে নিজেকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করার নামান্তর। এর ফলে সমাজ ব্যবস্থায় বিপর্যয় দেখা দেয়। এর অনিষ্টকর পরিণতি থেকে হারামখোর ব্যক্তি নিজেও রক্ষা পেতে পারে না এবং আখেরাতে এর কারণে মানুষ কঠিন শাস্তির অধিকারী হয়। আর যদি একে একটি স্বতন্ত্র বাক্য মনে করা হয় তাহলে এর দু’টি অর্থ হয়। এক, পরস্পরকে হত্যা করো না। দুই, আত্মহত্যা করো না। মহান আল্লাহ‌ এক্ষেত্রে এমন ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করেছেন এবং বাক্য এমনভাবে গঠন করেছেন যার ফলে এই তিনটি অর্থই এখান থেকে পাওয়া যেতে পারে এবং তিনটি অর্থই সত্য।
৫২.
অর্থাৎ আল্লাহ‌ তোমাদের শুভাকাংখী। তিনি তোমাদের ভালো চান। তিনি তোমাদের এমন কাজ করতে নিষেধ করছেন যার মধ্যে তোমাদের নিজেদের ধ্বংস নিহিত রয়েছে। এটা তোমাদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ ও করুনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
.
৫৩.
অর্থাৎ আমি সংকীর্ণমনা নই এবং সংকীর্ণ দৃষ্টির অধিকারীও নই। ছোটখাটো ভুল-ভ্রান্তি ধরে আমি বান্দাকে শাস্তি দেই না। তোমাদের আমলনামায় যদি বড় বড় অপরাধ না থাকে তাহলে ছোটখাটো অপরাধগুলোকে উপেক্ষা করা হবে এবং তোমাদের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনাই হবে না। তবে যদি তোমরা বড় বড় অপরাধ করে থাকো, তাহলে তোমাদের বিরুদ্ধে মামলা চালানো হবে এবং তাতে ছোটখাটো অপরাধগুলোও ধর্তব্যের গণ্য হবে, সেজন্য পাকড়াও করা হবে।

এখানে বড় গোনাহ ও ছোট গোনাহর মধ্যে নীতিগত পার্থক্য বুঝে নেয়া উচিত। কুরআন ও সুন্নাতের মধ্যে আমি যতটুকু চিন্তা-ভাবনা করতে পেরেছি তাতে আমি এটা বুঝতে সক্ষম হয়েছি (তবে যথার্থ সত্য একমাত্র আল্লাহ জানেন) যে, তিনটি কারণে কোন কাজ বড় গোনাহে পরিণত হয়ঃ

একঃ কারো অধিকার হরণ করা। সে অধিকার আল্লাহর, বাপ-মার, অন্য মানুষের বা হরণকারীর নিজেরও হতে পারে। তারপর যার অধিকার যত বেশী হবে তার অধিকার হরণও ঠিক তত বেশী বড় গোনাহ হবে। এ কারণেই গোনাহকে ‘জুলুম’ও বলা হয়। আর এ জন্য কুরআনে শিরককে জুলুম বলা হয়েছে।

দুইঃ আল্লাহকে ভয় না করা এবং আল্লাহর মোকাবিলায় আত্মম্ভরিতা করা, এর ফলে মানুষ আল্লাহর আদেশ ও নিষেধের পরোয়া করে না। তাঁর নাফরমানি করার উদ্দেশ্যে ইচ্ছা করেই এমন কাজ করে যা করতে তিনি নিষেধ করেছেন এবং জেনে বুঝে এমন কাজ থেকে বিরত থাকে যা করার জন্য তিনি হুকুম দিয়েছেন। এই নাফরমানি যে পরিমাণ নির্লজ্জতা, অহমিকা, দুঃসাহস ও আল্লাহভীতির মনোভাবে সমৃদ্ধ হবে গোনাহটিও ঠিক সেই পর্যায়ের কঠিন ও মারাত্মক হবে। এই অর্থের প্রেক্ষিতেই গোনাহের জন্য ‘ফিস্‌ক’ (ফাসেকী) ও ‘মাসিয়াত’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।

তিনঃ যে সমস্ত সম্পর্কের সুস্থতা ও বলিষ্ঠতার ওপর মানব জীবনের শান্তি ও নিরাপত্তা নির্ভর করে সেগুলো বিকৃত ও ছিন্ন করা। এ সম্পর্ক বান্দা ও আল্লাহর মধ্যে এবং বান্দা ও বান্দার মধ্যে হতে পারে। আবার যে সম্পর্ক যত বেশী গুরুত্বপূর্ণ, যা ছিন্ন করলে শাস্তি ও নিরাপত্তার যত বেশী ক্ষতি হয় এবং যার ব্যাপারে যত বেশী নিরাপত্তার আশা করা যেতে পারে, তাকে ছিন্ন করা, কেটে ফেলা ও নষ্ট করার গোনাহ তত বেশী বড় হয়। যেমন যিনা ও তার বিভিন্ন পর্যায় সম্পর্কে চিন্তা করুন। এ কাজটি আসলে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থায় বিপর্যয় ডেকে আনে। তাই এটি মূলত একটি বড় গোনাহ। কিন্তু এর বিভিন্ন অবস্থা গোনাহের ব্যাপারে একটি অন্যটির চাইতে বেশী মারাত্মক। বিবাহিত ব্যক্তির যিনা করা অবিবাহিত ব্যক্তির যিনা করার তুলনায় অনেক কঠিন গোনাহ। বিবাহিত মহিলার সাথে যিনা করা অবিবাহিতা মেয়ের সাথে যিনা করার তুলনায় অনেক বেশী দুষনীয়। প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে যিনা করা অপ্রতিবেশির স্ত্রীর সাথে যিনা করার তুলনায় বেশী খারাপ। মাহরাম মহিলা যেমন, মা, মেয়ে, বোনের সাথে যিনা করা, অন্য অনাত্মীয় মহিলার সাথে যিনা করার তুলনায় অনেক বেশী পাপ। অন্য কোন জায়গায় যিনা করার তুলনায় মসজিদে যিনা করা কঠিন গোনাহ। ওপরে বর্ণিত কারণের ভিত্তিতে এই দৃষ্টান্তগুলোতে একই কাজের বিভিন্ন অবস্থার মধ্যে গোনাহ হবার দিক দিয়ে পর্যায়ের পার্থক্য সূচিত হয়েছে। যেখানে নিরাপত্তার আশা যত বেশী, যেখানে মানবিক সম্পর্ক যত বেশী সম্মানের অধিকারী এবং যেখানে এই সম্পর্ক ছিন্ন করা যত বেশী বিপর্যয়ের কারণ বলে বিবেচিত হয়, সেখানে যিনা করা তত বেশী বড় গোনাহ। এই অর্থের প্রেক্ষিতে গোনাহের জন্য ‘ফুজুর’ এর পরিভাষা করা হয়।

.
৫৪.
এই আয়াতে বিরাট গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক বিধান দেয়া হয়েছে। এটি সংরক্ষিত এবং যথাযথভাবে কার্যকরী করা হলে সমাজ জীবনে মানুষ বিপুল শান্তি ও নিরাপত্তা লাভে সক্ষম হবে। আল্লাহ‌ সমস্ত মানুষকে সমান করে তৈরী করেননি। বরং তাদের মধ্যে অসংখ্য দিক দিয়ে পার্থক্য সৃষ্টি করে রেখেছেন। কেউ সুশ্রী, কেউ কুশ্রী। কেউ সুকন্ঠ, কেউ কর্কশ ভাষী। কেউ শক্তিশালী, কেউ দুর্বল। কেউ পূর্ণাঙ্গ সুগঠিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অধিকারী, আবার কেউ জন্মগতভাবে পঙ্গু। কাউকে শারীরিক ও মানসিক শক্তির মধ্যে কোন একটি শক্তি বেশী দেয়া হয়েছে আবার কাউকে দেয়া হয়েছে অন্য কোন শক্তি। কাউকে অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় পয়দা করা হয়েছে আর কাউকে খারাপ অবস্থায়। কাউকে বেশী উপায় উপকরণ দেয়া হয়েছে, কাউকে দেয়া হয়েছে কম। এ তারতম্য ও পার্থক্যের ভিত্তিতেই মানুষের সমাজ-সংস্কৃতি বৈচিত্রমণ্ডিত হয়েছে। আর এটিই বুদ্ধি ও যুক্তিসম্মত। কিন্তু যেখানেই এই পার্থক্যের স্বাভাবিক সীমানা ছাড়িয়ে মানুষ তার ওপর নিজের কৃত্রিম পার্থক্যের বোঝা চাপিয়ে দেয় সেখানেই এক ধরনের বিপর্যয় দেখা দেয়। আর যেখানে আদতে এই পার্থক্যকেই বিলুপ্ত করে দেবার জন্য প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালানো হয় সেখানে আর এক ধরনের বিপর্যয় দেখা দেয়। মানুষের মধ্যে একটি বিশেষ মানসিকতা দেখা যায়। নিজের চাইতে কাউকে অগ্রসর দেখতে পেলে সে অস্থির হয়ে পড়ে। মানুষের এই মানসিকতা তাই সমাজ জীবনে হিংসা, বিদ্বেষ, রেষারেষি, শত্রুতা, দ্বন্দ্ব, সংঘাত ইত্যাদি সৃষ্টির মূল। এরই ফলে যে অনুগ্রহ সে বৈধ পথে অর্জন করতে পারে না তাকে অবৈধ পথে লাভ করার জন্য উঠে পড়ে লাগে। এই মানসিকতা থেকে দূরে থাকার জন্য আল্লাহর এই আয়াতে নির্দেশ দিচ্ছেন, তাঁর বক্তব্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে, অন্যদের প্রতি তিনি যে অনুগ্রহ করেছেন তুমি তার আকাঙ্ক্ষা করো না। তবে আল্লাহর কাছে অনুগ্রহের জন্য দোয়া করো। তিনি নিজের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অনুযায়ী তোমার জন্য যে অনুগ্রহটি উপযোগী মনে করবেন সেটিই তোমাকে দান করবেন। আর তিনি যে বলেছেন, “যা কিছু পুরুষরা উপার্জন করেছে তাদের অংশ হবে সেই অনুযায়ী আর যা কিছু মেয়েরা উপার্জন করেছে তাদের অংশ হবে সেই অনুযায়ী” এর অর্থ যতদূর আমি বুঝতে পেরেছি তা হচ্ছে এই যে, পুরুষদের ও মেয়েদের মধ্য থেকে যাকে আল্লাহ‌ যাই কিছু দিয়েছেন তাকে ব্যবহার করে যে যেমন কিছু নেকী বা গোনাহ অর্জন করবে সেই অনুযায়ী অথবা অন্য কথায় সেই জাতীয় জিনিসের মধ্য থেকেই আল্লাহর কাছে সে অংশ পাবে।
৫৫.
আরববাসীদের নিয়ম ছিল, যাদের মধ্যে বন্ধুত্ব বা ভ্রাতৃত্বের চুক্তি ও অঙ্গীকার হয়ে যেতো, তারা পরস্পরের উত্তরাধিকারী হয়ে যেতো। এভাবে যাকে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করা হতো, সেও পালক পিতার সম্পত্তির ওয়ারিস হয়ে যেতো। এই আয়াতে জাহেলিয়াতের এই পদ্ধতিটি বাতিল করে বলা হয়েছে, মীরাস তো আমার নির্ধারিত বিধান অনুযায়ী আত্মীয়দের মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে, তবে যাদের সাথে তোমাদের চুক্তি ও অঙ্গীকার আছে তাদেরকে তোমরা নিজেদের জীবদ্দশায় যা চাও দিতে পারো।
অনুবাদ: