পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

৫৬৪ আয়াত

১৭ ) সে তার সমর্থক দলকে ডেকে নিক ১৪
فَلْيَدْعُ نَادِيَهُۥ ١٧
১৮ ) আমি ডেকে নিই আযাবের ফেরেশতাদেরকে। ১৫
سَنَدْعُ ٱلزَّبَانِيَةَ ١٨
১৯ ) কখনই নয়, তার কথা মেনে নিয়ো না, তুমি সিজদা করো এবং (তোমার রবের) নৈকট্য অর্জন করো। ১৬
كَلَّا لَا تُطِعْهُ وَٱسْجُدْ وَٱقْتَرِب ۩ ١٩
১ ) আমি এ (কুরআন) নাযিল করেছি কদরের রাতে।
بِّسْمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحْمَـٰنِ ٱلرَّحِيمِ إِنَّآ أَنزَلْنَـٰهُ فِى لَيْلَةِ ٱلْقَدْرِ ١
২ ) তুমি কি জানো, কদরের রাত কি?
وَمَآ أَدْرَىٰكَ مَا لَيْلَةُ ٱلْقَدْرِ ٢
৩ ) কদরের রাত হাজার মাসের চাইতেও বেশী ভালো।
لَيْلَةُ ٱلْقَدْرِ خَيْرٌۭ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍۢ ٣
৪ ) ফেরেশতারা ও রূহ এই রাতে তাদের রবের অনুমতিক্রমে প্রত্যেকটি হুকুম নিয়ে নাযিল হয়।
تَنَزَّلُ ٱلْمَلَـٰٓئِكَةُ وَٱلرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمْرٍۢ ٤
৫ ) এ রাতটি পুরোপুরি শান্তিময় ফজরের উদয় পর্যন্ত।
سَلَـٰمٌ هِىَ حَتَّىٰ مَطْلَعِ ٱلْفَجْرِ ٥
১ ) আহলি কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা কাফের ছিল তাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ না আসা পর্যন্ত তারা (নিজেদের কুফরী থেকে) বিরত থাকতে প্রস্তুত ছিল না।
لَمْ يَكُنِ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ مِنْ أَهْلِ ٱلْكِتَـٰبِ وَٱلْمُشْرِكِينَ مُنفَكِّينَ حَتَّىٰ تَأْتِيَهُمُ ٱلْبَيِّنَةُ ١
২ ) (অর্থাৎ) আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন রসূল যিনি পবিত্র সহীফা পড়ে শুনাবেন,
رَسُولٌۭ مِّنَ ٱللَّهِ يَتْلُوا۟ صُحُفًۭا مُّطَهَّرَةًۭ ٢
১৪.
যেমন ভূমিকায় আমরা বলেছি, আবু জেহেলের হুমকির জবাবে যখন রসূলুল্লাহ ﷺ তাকে ধমক দিয়েছিলেন তখন সে বলেছিল, হে মুহাম্মাদ! তুমি কিসের জোরে আমাকে ভয় দেখাচ্ছো? আল্লাহর কসম, এই উপত্যকায় আমার সমর্থকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী। তার এই কথায় এখানে বলা হচ্ছেঃ নাও, এখন তাহলে তোমার সেই সমর্থকদের ডেকে নাও।
১৫.
মূলে ‘যাবানীয়াহ’ ( رَبانيت) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কাতাদাহর ব্যাখ্যা অনুযায়ী এটি আরবী ভাষায় পুলিশের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর “যাবান” (زبن) শব্দের আসল মানে হচ্ছে, ধাক্কা দেয়া। রাজা বাদশাহদের দরবারে লাঠিধারী চোবদার থাকতো। তাদের কাজ হতো যার প্রতি বাদশাহ নারাজ হতেন তাকে ধাক্কা দিয়ে দরবার থেকে বের করে দেয়া। কাজেই এখানে আল্লাহর বাণীর অর্থ হচ্ছে, সে তার সমর্থকদেরকে ডেকে আনুক, আর আমি আমার পুলিশ বাহিনী তথা আযাবের ফেরেশতাদেরকে ডেকে আনি। এই আযাবের ফেরেশতারা তার সমর্থকদেরকে ঠাণ্ডা করে দিক।
১৬.
সিজদা করা মানে নামায পড়া। অর্থাৎ হে নবী! তুমি নির্ভয়ে আগের মতো নামায পড়তে থাকো। এর মাধ্যমে নিজের রবের নৈকট্য লাভ করো। সহীহ মুসলিম ইত্যাদি গ্রন্থে হযরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণিত হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছেঃ “বান্দা সিজদায় থাকা অবস্থায় তার রবের সবচেয়ে বেশী নিকটবর্তী হয়।” আবার মুসলিমে হযরত আবু হুরাইরার (রা.) এ রেওয়ায়াতটিও উদ্ধৃত হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন এ আয়াতটি পড়তেন তখন তেলাওয়াতে সিজদা করতেন।
১.
মূল শব্দ হচ্ছে আন্‌যালনাহু (اَنْزَلْنَاهُ ) “আমি একে নাযিল করেছি” কিন্তু আগে কুরআনের কোন উল্লেখ না করেই কুরআনের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, “নাযিল করা” শব্দের মধ্যেই কুরআনের অর্থ রয়ে গেছে। যদি আগের বক্তব্য বা বর্ণনাভঙ্গি থেকে কোন সর্বনাম কোন বিশেষ্যের জায়গায় বসেছে তা প্রকাশ হয়ে যায় তাহলে এমন অবস্থায় আগে বা পরে কোথাও সেই বিশেষ্যটির উল্লেখ না থাকলেও সর্বনামটি ব্যবহার করা যায়। কুরআনে এর একাধিক দৃষ্টান্ত রয়ে গেছে। (এ ব্যাপারে আরো বেশী জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন আন্ নাজম ৯ টীকা)

এখানে বলা হয়েছে আমি কদরের রাতে কুরআন নাযিল করেছি আবার সূরা বাকারায় বলা হয়েছে, شَهْرُ رَمَضاَنَ الَّذِىْ اُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْاَانُ “রমযান মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে।” (১৮৫ আয়াতে) এ থেকে জানা যায়, নবী ﷺ এর কাছে হেরা গুহায় যে রাতে আল্লাহ‌র ফেরেশতা, ওহী নিয়ে এসেছিলেন সেটি ছিল রমযান মাসের একটি রাত। এই রাতকে এখানে কদরের রাত বলা হয়েছে। সূরা দুখানে একে মুবারক রাত বলা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ اِناَّ اَنْزَلْنَاهُ فِىْ لَيْلَةٍ مُّباَرَكَةٍ “অবশ্যই আমি একে একটি বরকতপূর্ণ রাতে নাযিল করেছি।” (সুরা দুখান, ৩ আয়াত)

এই রাতে কুরআন নাযিল করার দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, এই রাতে সমগ্র কুরআন অহীর ধারক ফেরেশতাদেরকে দিয়ে দেয়া হয়। তারপর অবস্থা ও ঘটনাবলী অনুযায়ী তেইশ বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম আল্লাহ‌র হুকুমে তার আয়াত ও সূরাগুলো রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর ওপর নাযিল করতে থাকেন। ইবনে আব্বাস (রাঃ) এ অর্থটি বর্ণনা করেছেন। (ইবনে জারীর, ইবনুল মুনযির, ইবনে আবী হাতেম, হাকেম, ইবনে মারদুইয়া ও বায়হাকী) এর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, এই রাত থেকেই কুরআন নাযিলের সূচনা হয়। এটি ইমাম শা’বীর উক্তি। অবশ্যি ইবনে আব্বাসের (রাঃ) ওপরে বর্ণিত বক্তব্যের মতো তাঁর একটি উক্তিও উদ্ধৃত করা হয়। (ইবনে জারীর) যা হোক, উভয় অবস্থায় কথা একই থাকে। অর্থাৎ রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর ওপর কুরআন নাযিলের সিলসিলা এই রাতেই শুরু হয় এবং এই রাতেই সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত নাযিল হয়। তবুও এটি একটি অভ্রান্ত সত্য, রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর এবং তাঁর ইসলামী দাওয়াতের জন্য কোন ঘটনা বা ব্যাপারে সঠিক নির্দেশ লাভের প্রয়োজন দেখা দিলে তখনই আল্লাহ‌ কুরআনের সূরা ও আয়াতগুলো রচনা করতেন না। বরং সমগ্র বিশ্ব-জাহান সৃষ্টির পূর্বে অনাদিকালে মহান আল্লাহ‌ পৃথিবীতে মানব জাতির সৃষ্টি, তাদের মধ্যে নবী প্রেরণ, নবীদের ওপর কিতাব নাযিল, সব নবীর পরে মুহাম্মাদ ﷺ কে পাঠানো এবং তাঁর প্রতি কুরআন নাযিল করার সমস্ত পরিকল্পনা তৈরি করে রেখেছিলেন। কদরের রাতে কেবলমাত্র এই পরিকল্পনার শেষ অংশের বাস্তবায়ন শুরু হয়। এই সময় যদি সমগ্র কুরআন অহী ধারক ফেরেশতাদের হাতে তুলে দেয়া হয়ে থাকে তাহলে তা মোটেই বিস্ময়কর নয়।

কোন কোন তাফসীরকার কদরকে তকদীর অর্থে গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ এই রাতে আল্লাহ‌ তকদীরের ফয়সালা জারী করার জন্য তা ফেরেশতাদের হাতে তুলে দেন। সূরা দুখানের নিম্নোক্ত আয়াতটি এই বক্তব্য সমর্থন করেঃ

فِيْهَا يُفْرَقُ كُلُّ اَمْرٍ حَكِيْمٍ

“এই রাতে সব ব্যাপারে জ্ঞানগর্ভ ফয়সালা প্রকাশ করা হয়ে থাকে।” (দুখান, ৪ আয়াত) অন্যদিকে ইমাম যুহরী বলেন, কদর অর্থ হচ্ছে শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা। অর্থাৎ এটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ রাত। এই অর্থ সমর্থন করে এই সূরার নিম্নোক্ত আয়াতটি “কদরের রাত হাজার মাসের চাইতেও উত্তম।”

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কোন্‌ রাত ছিল? এ ব্যাপারে ব্যাপক মতবিরোধ দেখা যায়। এ সম্পর্কে প্রায় ৪০ টি মতের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে আলেম সমাজের সংখ্যাগুরু অংশের মতে রমযানের শেষ দশ তারিখের কোন একটি বেজোড় রাত হচ্ছে এই কদরের রাত। আবার তাদের মধ্যেও বেশীরভাগ লোকের মত হচ্ছে সেটি সাতাশ তারিখের রাত। এ প্রসঙ্গে বর্ণিত নির্ভরযোগ্য হাদীসগুলো এখানে উল্লেখ করেছি।

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ লাইলাতুল কদর সম্পর্কে বলেনঃ সেটি সাতাশের বা উনত্রিশের রাত। (আবু দাউদ) হযরত আবু হুরাইরার (রাঃ) অন্য একটি রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে সেটি রমযানের শেষ রাত। (মুসনাদে আহমাদ)

যির ইবনে হুবাইশ হযরত উবাই ইবনে কা’বকে (রাঃ) কদরের রাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। তিনি হলফ করে কোন কিছুকে ব্যতিক্রম হিসেবে দাঁড় না করিয়ে বলেন, এটা সাতাশের রাত। (আহমাদ, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী ও ইবনে হিব্বান)

হযরত আবু যারকে (রাঃ) এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়। তিনি বলেন, হযরত উমর (রাঃ), হযরত হুযাইফা (রাঃ) এবং রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর বহু সাহাবার মনে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ ছিল না যে, এটি রমযানের সাতাশতম রাত। (ইবনে আবী শাইবা)

হযরত উবাদাহ ইবনে সামেত (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ বলেন, রমযানের শেষ দশ রাতের বেজোড় রাতগুলোর যেমন একুশ, তেইশ, পঁচিশ, সাতাশ বা শেষ রাতের মধ্যে রয়েছে কদরের রাত। (মুসনাদে আহমাদ)

হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে আব্বাস (রঃ) বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ বলেন, তাকে খোঁজ রমযানের শেষ দশ রাতের মধ্যে যখন মাস শেষ হতে আর নয় দিন বাকি থাকে। অথবা সাত দিন বা পাঁচ দিন বাকি থাকে। (বুখারী) অধিকাংশ আলেম এর অর্থ করেছেন এভাবে যে, রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এখানে বেজোড় রাতের কথা বলতে চেয়েছেন।

হযরত আবু বকর (রঃ) রেওয়ায়াত করেছেন, নয় দিন বাকি থাকতে বা সাত দিন বা পাঁচ দিন বা এক দিন বাকি থাকতে শেষ রাত। তাঁর বক্তব্যের অর্থ ছিল, এই তারিখগুলোতে কদরের রাতকে তালাশ করো। (তিরমিযী, নাসায়ী)

হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ বলেনঃ কদরের রাতকে রমযানের শেষ দশ রাতের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে তালাশ করো। (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, তিরমিযী) হযরত আয়েশা (রাঃ) ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) এও বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত রমযানের শেষ দশ রাতে ইতিকাফ করেছেন।

এ প্রসঙ্গে হযরত মু’আবীয়া (রঃ), হযরত ইবনে উমর, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এবং অন্যান্য সাহাবীগণ যে রেওয়ায়াত করেছেন তার ভিত্তিতে পূর্ববর্তী আলেমগণের বিরাট অংশ সাতাশ রমযানকেই কদরের রাত বলে মনে করেন। সম্ভবত কদরের রাতের শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য থেকে লাভবান হবার আগ্রহে যাতে লোকেরা অনেক বেশী রাত ইবাদাতে কাটাতে পারে এবং কোন একটি রাতকে যথেষ্ট মনে না করে সেজন্য আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে কোন একটি রাত নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। এখানে প্রশ্ন দেখা দেয়, যখন মক্কা মু’আযযমায় রাত হয় তখন দুনিয়ার একটি বিরাট অংশে থাকে দিন, এ অবস্থায় এসব এলাকার লোকেরা তো কোন দিন কদরের রাত লাভ করতে পারবে না। এর জবাব হচ্ছে, আরবী ভাষায় ,রাত’ শব্দটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে দিন ও রাতের সমষ্টিকে বলা হয়। কাজেই রমযানের এই তারিখগুলোর মধ্য থেকে যে তারিখটিই দুনিয়ার কোন অংশে পাওয়া যাবে তার দিনের পূর্বেকার রাতটিই সেই এলাকার জন্য কদরের রাত হতে পারে।

.
২.
মুফাস্‌সিরগণ সাধারণভাবে এর অর্থ করেছেন, এ রাতের সৎকাজ হাজার মাসের সৎকাজের চেয়ে ভালো। কদরের রাত এ গণনার বাইরে থাকবে। সন্দেহ নেই একথাটির মধ্যে যথার্থ সত্য রয়ে গেছে এবং রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এই রাতের আমলের বিপুল ফযীলত বর্ণনা করেছেন। কাজেই বুখারী ও মুসলিমে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ বলেছেনঃ

مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ اِيْماَنً وَّاِحْتِسَاباً غُفِرَ لَهُوْ ماَ تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ -

“যে ব্যক্তি কদরের রাতে ঈমানের সাথে এবং আল্লাহ‌র কাছ থেকে প্রতিদান লাভের উদ্দেশ্যে ইবাদাতের জন্য দাঁড়ালো তার পিছনের সমস্ত গোনাহ মাফ করা হয়েছে।”

মুসনাদে আহমাদে হযরত উবাদাহ ইবনে সামেত (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ বলেছেনঃ “কদরের রাত রয়েছে রমযানের শেষ দশ রাতের মধ্যে। যে ব্যক্তি প্রতিদান লাভের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এসব রাতে ইবাদাতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে আল্লাহ‌ তার আগের পিছনের সব গোনাহ্‌ মাফ করে দেবেন।” কিন্তু আয়াতে উচ্চারিত শব্দগুলোয় একথা বলা হয়নি (اَلْعَمَلُ فِىْ لَيْلَةِ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنَ الْعَمَلِ فِىْ اَلْفِ شَهْرٍ ) (কদরের রাতের আমল হাজার রাতের আমলের চেয়ে ভালো) বরং বলা হয়েছে, “কদরের রাত হাজার মাসের চেয়ে ভালো।” আর মাস বলতে একেবারে গুণে গুণে তিরাশি বছর চার মাস নয়। বরং আরববাসীদের কথার ধরনই এই রকম ছিল, কোন বিপুল সংখ্যার ধারণা দেবার জন্য তারা “হাজার” শব্দটি ব্যবহার করতো। তাই আয়াতের অর্থ হচ্ছে, এই একটি রাতে এত বড় নেকী ও কল্যাণের কাজ হয়েছে যা মানবতার সুদীর্ঘ ইতিহাসে কোন দীর্ঘতম কালেও হয়নি।

৩.
রূহ বলতে জিব্রাঈল আলাইহিস সালামকে বুঝানো হয়েছে। তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার কারণে সমস্ত ফেরেশতা থেকে আলাদা করে তাঁর উল্লেখ করা হয়েছে।
৪.
অর্থাৎ তারা নিজেদের তরফ থেকে আসে না। বরং তাদের রবের অনুমতিক্রমে আসে। আর প্রত্যেকটি হুকুম বলতে সূরা দুখানের ৫ আয়াতে “আমরে হাকীম” (বিজ্ঞতাপূর্ণ কাজ) বলতে যা বুঝানো হয়েছে এখানে তার কথাই বলা হয়েছে।
৫.
অর্থাৎ সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত সারাটা রাত শুধু কল্যাণে পরিপূর্ণ। সেখানে ফিতনা, দুস্কৃতি ও অনিষ্টকারিতার ছিটেফোঁটাও নেই।
১.
আহলি কিতাব ও মুশরিক উভয় দলই কুফরী কর্মকাণ্ডে জড়িত হলেও দু’দলকে দু’টি পৃথক নাম দেয়া হয়েছে। যাদের কাছে আগের নবীদের আনা কোন আসমানী কিতাব ছিল, তা যত বিকৃত আকারেই থাক না কেন, তারা তা মেনে চলতো, তাদেরকে বলা হয় আহলি কিতাব। আর যারা কোন নবীর অনুসারী ছিল না। কোন আসমানী কিতাবও মানতো না তারা মুশরিক। কুরআন মজীদের বহু স্থানে আহলি কিতাবদের শির্কের উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন খৃস্টানদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ “তারা বলে, আল্লাহ‌ তিন খোদার একজন।”(আল মায়েদাহ ৭৩) “তারা মসীহকেও খোদা বলে।”(আল মায়েদাহ ১৭) “তারা মসীহকে আল্লাহর পুত্র গণ্য করে।” (আত তাওবা ৩০) আবার ইহুদিদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ “তারা উযাইরকে আল্লাহর পুত্র বলে”(আত তাওবা ৩০) কিন্তু এসব সত্ত্বে কুরআনের কোথাও তাদের জন্য মুশরিক পরিভাষা ব্যবহার করা হয়নি। বরং তাদের উল্লেখ করা হয়েছে “আহলি কিতাব” বা “যাদের কিতাব দেয়া হয়েছিল” শব্দের মাধ্যমে। অথবা ইয়াহুদ ও নাসারা শব্দদ্বয়ের মাধ্যমে। কারণ তারা তাওহিদী ধর্ম মানতো, তারপর শিরক করতো। বিপরীত পক্ষে অ-আহলি কিতাবদের জন্য পারিভাষিক পর্যায়ে মুশরিক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ তারা শিরককেই আসল ধর্ম গণ্য করতো। তাওহীদকে তারা পুরোপুরি ও চূড়ান্তভাবে অস্বীকার করতো। এ দু’টি দলের মধ্যকার এ পার্থক্যটা শুধুমাত্র পরিভাষার পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল না, শরীয়াতের বিধানের মধ্যেও এ পার্থক্য ছিল। আহলি কিতাবরা আল্লাহর নাম নিয়ে যদি কোন হালাল প্রাণীকে সঠিক পদ্ধতিতে যবেহ করে তাহলে তা মুসলমানের জন্য হালাল গণ্য করা হয়েছে। তাদের মেয়েদেরকে বিয়ে করারও অনুমতি দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে মুশরিকদের যবেহ করা প্রাণীও হালাল নয় এবং তাদের মেয়েদেরকে বিয়ে করারও অনুমতি দেয়া হয়নি।
২.
এখানে কুফরী শব্দটিকে ব্যাপক অর্থে বর্ণনা করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রকার কুফরী দৃষ্টিভংগী এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন কেউ এই অর্থে কাফের ছিল যে, সে আদৌ আল্লাহকে মানতো না। আবার কেউ আল্লাহকে মানতো ঠিকই কিন্তু তাঁকে একমাত্র মাবুদ বলে মানতো না। বরং আল্লাহর সত্ত্বা ও তাঁর সার্বভৌম কর্তৃত্বের গুণাবলী ও ক্ষমতায় কোন না কোনভাবে অন্যদেরকে শরীক করে তাদের বন্দেগীও করতো। কেউ আল্লাহর একত্ব স্বীকার করতো কিন্তু এ সত্ত্বেও আবার কোন না কোন্ ধরনের শিরকও করতো। কেউ আল্লাহকে মানতো কিন্তু তাঁর নবীদেরকে মানতো না এবং নবীদের মাধ্যমে যে হেদায়াত এসেছিল তাকে মানতে অস্বীকার করতো। কেউ এক নবীকে মানতো কিন্তু অন্য নবীকে অস্বীকার করতো। মোটকথা, বিভিন্ন ধরনের কুফরীতে লোকেরা লিপ্ত ছিল। এখানে ‘আহলি কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা কাফের ছিল’ একথা বলার অর্থ এ নয় যে, তাদের মধ্যে তাহলে কিছু লোক ছিল যারা কুফরীতে লিপ্ত ছিল না। বরং এর অর্থ হচ্ছে, কুফরীতে লিপ্ত দু’টি দল ছিল, একটি আহলি কিতাব ও অন্যটি মুশরিক। এখানে মিন (مِنْ) শব্দটি কতক বা কিছু অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। বরং ‘মিন’এখানে বর্ণনামূলক। যেমন সূরা হজ্জের ৩০ আয়াতে বলা হয়েছেঃ فَاجۡتَنِبُوۡا الرِّجۡسَ مِنَ الۡاَوۡثَانِ অর্থাৎ মূর্তিদের অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকো। এর অর্থ এ নয় যে, মূর্তিদের মধ্যে যে অপবিত্রতা আছে তা থেকে দূরে থাকো। তেমনি اَلَّذِيْنَكَفَرُوْامِنْ اَهْلِ الْكِتَلبِ والْمُشْرِكِيْن এর অর্থও হচ্ছেঃ যারা কুফরী করে, যারা আহলে কিতাব ও মুশরিকদের দলের অন্তর্ভুক্ত। এর অর্থ এ নয় যে, এই দু’টি দলের মধ্য থেকে যারা কুফরী করে।
৩.
অর্থাৎ একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ এসে তাদেরকে কুফরীর প্রতিটি গলদ ও সত্য বিরোধী বিষয় বুঝাবে এবং যুক্তি-প্রমাণের সাহায্যে সুস্পষ্ট পদ্ধতিতে সত্য সঠিক পথ তাদের সামনে পেশ করবে, এছাড়া এই কুফরীর অবস্থা থেকে বের হবার আর কোন পথ তাদের সামনে ছিল না। এর মানে এ নয় যে, এ সুস্পষ্ট প্রমাণটি এসে যাবার পর তারা সবাই কুফরী পরিত্যাগ করবে। বরং এর মানে হচ্ছে এই প্রমাণটির অনুপস্থিতিতে তাদের এই অবস্থার মধ্য থেকে বের হয়ে আসা সম্ভবপরই ছিল না। তবে তার আসার পরও তাদের মধ্য থেকে যারা নিজেদের কুফরীর ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল তার দায়িত্ব তাদের ওপরই বর্তায়। এরপর তারা আল্লাহর কাছে অভিযোগ করতে পারবে না যে, আপনি আমাদের হোদায়াতের কোন ব্যবস্থা করেননি। এই ধরনের কথা কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে বলা হয়েছে। যেমন সুরা নাহলে বলা হয়েছেঃ وَعَلَى اللّٰهِ قَصۡدُ السَّبِيۡلِ “সোজা পথ দেখানো আল্লাহরই দায়িত্ব।” (৯ আয়াত) সূরা লাইলে বলা হয়েছেঃ اِنَّ عَلَيۡنَا لَلۡهُدٰى‌ۖ “পথ দেখাবার দায়িত্ব আমার।” (১২ আয়াত)

اِنَّاۤ اَوۡحَيۡنَاۤ اِلَيۡكَ كَمَاۤ اَوۡحَيۡنَاۤ اِلٰى نُوۡحٍ وَّالنَّبِيّٖنَ مِنۡۢ بَعۡدِهٖ‌ۚ .......................... رُّسُلاً مُّبَشِّرِيۡنَ وَمُنۡذِرِيۡنَ لِئَلَّا يَكُوۡنَ لِلنَّاسِ عَلَى اللّٰهِ حُجَّةٌۢ بَعۡدَ الرُّسُلِ‌ؕ

“আমি তোমার প্রতি ঠিক তেমনিভাবে অহী পাঠিয়েছি যেভাবে নূহ ও তারপর নবীদের প্রতি পাঠিয়ে ছিলাম------------------এই রসূলদেরকে সুসংবাদ দানকারী ও সতর্ককারী করা হয়েছে যাতে রসূলদের পর লোকদের জন্য আল্লাহর বিরুদ্ধে কোন যুক্তি না থাকে।” (আন নিসা ১৬৩-১৬৫ আয়াত)

يٰۤاَهۡلَ الۡكِتٰبِ قَدۡ جَآءَكُمۡ رَسُوۡلُنَا يُبَيِّنُ لَكُمۡ عَلٰى فَتۡرَةٍ مِّنَ الرُّسُلِ اَنۡ تَقُوۡلُوۡا مَا جَآءَنَا مِنۡۢ بَشِيۡرٍ وَّلَا نَذِيۡرٍ‌ فَقَدۡ جَآءَكُمۡ بَشِيۡرٌ وَّنَذِيۡرٌ‌ؕ

“হে আহলি কিতাব! রসূলদের সিলসিলা দীর্ঘকাল বন্ধ থাকার পর প্রকৃত সত্যকে সুস্পষ্ট করার জন্য তোমাদের কাছে আমার রসূল এসেছে। যাতে তোমরা বলতে না পারো আমাদের কাছে না কোন সুসংবাদ দানকারী এসেছিল, না এসেছিল কোন সতর্ককারী। কাজেই নাও, এখন তোমাদের কাছে সুসংবাদদানকারী এসে গেছে এবং সতর্ককারীও।” (আল মায়েদাহ ১৯)

৪.
এখানে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ বলা হয়েছে। কারণ তাঁর নবুওয়াত লাভের আগের ওপরের জীবন, নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও তাঁর কুরআনের মতো কিতাব পেশ করা, তাঁর শিক্ষা ও সাহচর্যের প্রভাবে ঈমান গ্রহণকারীদের জীবনে অস্বাভাবিক পরিবর্তন সূচিত হওয়া, তাঁর পুরোপুরি যুক্তিসঙ্গত আকীদা-বিশ্বাস, অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ইবাদাত-বন্দেগী, চূড়ান্ত পর্যায়ের পবিত্র ও নিষ্কলুষ নৈতিক চরিত্র এবং মানব জীবন গঠনের জন্য সবচেয়ে ভালো মূলনীতি ও বিধি-বিধান শিক্ষা দেয়া, তাঁর কথা ও কাজের মধ্যে পুরোপুরি সামঞ্জস্য থাকা এবং সব ধরনের বিরোধিতা ও বাধা-বিপত্তির মোকাবেলায় সীমাহীন দৃঢ়তা ও বলিষ্ঠতা সহকারে তাঁর নিজের দাওয়াতের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া---এসব বিষয়ই তিনি যে যথার্থই আল্লাহর রসূল সে কথারই ছিল সুস্পষ্ট আলামত।
৫.
আভিধানিক অর্থে ‘সহীফা’ বলা হয় “লিখিত পাতাকে।” কিন্তু কুরআন মজীদে এ শব্দটিকে পারিভাষিক অর্থে নবীগণের ওপর নাযিলকৃত কিতাব হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আর পবিত্র সহীফা মানে হচ্ছে এমন সব সহীফা যার মধ্যে কোনো প্রকার বাতিল কোন্ ধরনের গোমরাহী ও ভ্রষ্টতা এবং কোন নৈতিক অপবিত্রতার মিশ্রণ নেই।কোন ব্যক্তি এই কথাগুলোর পুরোপুরি গুরুত্ব তখনই অনুধাবন করতে পারবেন যখন তিনি-কুরআনের পাশাপাশি বাইবেল (এবং অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থগুলোও) অধ্যয়ন করবেন। সেখানে তিনি দেখবেন সঠিক কথার সাথে সাথে এমন কথাও লেখা আছে, যা সত্য ও ন্যায় এবং সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির পরিপন্থী। আবার এই সঙ্গে নৈতিক দিক দিয়েও অত্যন্ত নিম্নমানের। এসব কথা পড়ার পর কুরআন পড়লে যেকোন ব্যক্তি তার অসাধারণ পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার প্রমাণ পেয়ে যাবেন।
অনুবাদ: