আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১
আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২
আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২
আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩
আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭
আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১
আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০
আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭
আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০
আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২
আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫
হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২
ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২
আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮
বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪
আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫
আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮
আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০
আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫
আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫
আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০
আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭
ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১
আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬
ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭
আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০
আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯
আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২
আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০
আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬
একঃ যে ভাষায় কুরআন মজীদ নাযিল হয়েছে তা সে ভাষার সাহিত্যের উচ্চতম ও পূর্ণাঙ্গ নমুনা। গোটা গ্রন্থের একটি শব্দ বা একটি বাক্যও মানের নিচে নয়। যে বিষয়টিই ব্যক্ত করা হয়েছে সেটিই উপযুক্ত শব্দ ও উপযুক্ত বাচনভংগীতে বর্ণনা করা হয়েছে। একই বিষয় বার বার বর্ণিত হয়েছে এবং প্রতিবারই বর্ণনার নতুন ভংগী গ্রহণ করা হয়েছে কিন্তু সেজন্য পৌনপুনিকতার দৃষ্টিকটূতা ও শ্রুতিকটূতা কোথাও সৃষ্টি হয়নি। গোটা গ্রন্থে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত শব্দের গাঁথুনি এমন যেন আংটির মুল্যবান পাথরগুলো ছেঁটে ছেঁটে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। কথা এতটা মর্মস্পর্শী যে, তা শুনে ভাষাভিজ্ঞ কোন ব্যক্তিই মাথা নিচু না করে থাকতে পারে না। এমন কি অমান্যকারী এবং বিরোধী ব্যক্তির মনপ্রাণ ও ভাবাবেগ পর্যন্ত উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। ১৪ শত বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও আজ অবধি এ গ্রন্থ তার ভাষায় সাহিত্যের সবচেয়ে উন্নত নমুনা। এর সমপর্যায়ের তো দূরের কথা সাহিত্যিক মর্যাদা ও মূল্যমানে আরবী ভাষায় কোন গ্রন্থ আজ পর্যন্ত এর ধারে কাছেও পৌঁছনি। শুধু তাই নয়, এ গ্রন্থ আরবী ভাষাকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরে বসেছে যে, ১৪ শত বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও এ ভাষার বিশুদ্ধতার মান তাই আছে যা এ গ্রন্থ প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিল। অথচ এ সময়ের মধ্যে ভাষাসমূহ পরিবর্তিত হয়ে ভিন্ন রূপ ধারণ করে। পৃথিবীতে আর কোন ভাষা এমন নেই যা এত দীর্ঘ সময় পর্যন্ত লিখন পদ্ধতি, রচনা রীতি, বাচনভংগী, ভাষার নিয়মকানুন এবং শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে একই রূপ নিয়ে টিকে আছে। এর সাহিত্যমান আজ পর্যন্ত আরবী ভাষার উচ্চ মানের সাহিত্য। ১৪ শত বছর আগে কুরআনে যে বিশুদ্ধ ভাষা ব্যবহার করা হয়েছিল বক্তৃতা ও লেখায় আজও সেটাই বিশুদ্ধ ভাষা বলে মানা হচ্ছে। দুনিয়ার কোন ভাষায় মানুষের রচিত কোন গ্রন্থ কি এ মর্যাদা লাভ করেছে!
দুইঃ এটা পৃথিবীর একমাত্র গ্রন্থ যা মানবজাতির ধ্যান-ধারণা, স্বভাব-চরিত্র, সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং জীবন প্রণালির ওপর এমন ব্যাপক, এমন গভীর এবং এমন সর্বাত্মক প্রভাব বিস্তার করেছে যে, পৃথিবীতে তার কোন নজির পাওয়া যায় না। এর প্রভাব প্রথমে একটা জাতির মধ্যে পরিবর্তন আনলো। অতঃপর সেই জাতি তৎপর হয়ে পৃথিবীর একটি বিশাল অংশে পরিবর্তন আনলো। দ্বিতীয় আর কোন গ্রন্থ নেই যা এতটা বিপ্লবাত্মক প্রমাণিত হয়েছে। এ গ্রন্থ কেবলমাত্র কাগজের পৃষ্ঠাসমূহেই লিপিবদ্ধ থাকেনি বরং তার এক একটি শব্দ ধ্যান-ধারণাকে বাস্তবে রূপদান করেছে এবং একটি স্বতন্ত্র সভ্যতা নির্মাণ করেছে। ১৪ শত বছর ধরে তার এ প্রভাব চলে আসছে এবং দিনে দিনে তা আরো বিস্তৃত হচ্ছে।
তিনঃ এ গ্রন্থ যে বিষয়ে আলোচনা করে তা একটি ব্যাপকতর বিষয়। এর পরিধি আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত গোটা বিশ্ব-জাহানকে পরিব্যাপ্ত করে আছে। এ গ্রন্থ বিশ্ব-জাহানের তাৎপর্য তার শুরু ও শেষ এবং তার নিয়ম-শৃংখলা সম্পর্কে বক্তব্য ও মত পেশ করে। এ গ্রন্থ বলে দেয় এ বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা, শৃংখলাবিধানকারী এবং পরিচালক কে? কি তাঁর গুণাবলী, কি তাঁর ইখতিয়ার ও ক্ষমতা এবং কি সেই মূল ও আসল বিষয় আর যার ভিত্তিতে তিনি এ গোটা বিশ্ব ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করেছেন। সে এ পৃথিবীতে মানুষের প্রকৃত মর্যাদা ও অবস্থান সঠিকভাবে নির্দিষ্ট করে বলে দেয় যে, এটা তার স্বাভাবিক অবস্থান এবং এটা তার জন্মগত মর্যাদা। সে এ অবস্থান ও মর্যাদা পাল্টে দিতে সক্ষম নয়। এ অবস্থান ও মর্যাদার দিক দিয়ে মানুষের জন্য সত্য ও বাস্তবতার সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল সঠিক পথ কি এবং সত্য ও বাস্তবের সাথে সংঘাতপূর্ণ ভ্রান্ত পথ কি তা সে বলে দেয়। সঠিক পথের সঠিক হওয়া এবং ভ্রান্ত পথের ভ্রান্ত হওয়া প্রমাণের জন্য সে যমীন ও আসমানের এক একটি বস্তু থেকে মহাবিশ্ব ব্যবস্থার এক একটি প্রান্ত থেকে মানুষের নিজের আত্মা ও সত্তা থেকে এবং মানুষেরই নিজের ইতিহাস থেকে অসংখ্য যুক্তি-প্রমাণ পেশ করে। এর সাথে সে বলে দেয় মানুষ কিভাবে ও কি কি কারণে ভ্রান্ত পথে চলেছে এবং প্রতি যুগে তাকে কিভাবে সঠিক পথ বাতলে দেয়া হয়েছে যা সবসময় একই ছিল এবং একই থাকবে। সে কেবল সঠিক পথ দেখিয়েই ক্ষান্ত হয় না। বরং সে পথে চলার জন্য একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার চিত্র পেশ করে যার মধ্যে আকায়েদ, আখলাক, আত্মার পরিশুদ্ধি, ইবাদত বন্দেগী, সামাজিকতা, তাহযীব, তামাদ্দুন, অর্থনীতি, রাজনীতি, ন্যায়বিচার, আইন-কানুন, এক কথায় মানব জীবনের প্রতিটি দিক সম্পর্কে অত্যন্ত সুসংবদ্ধ বিধি-বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। তাছাড়া এ সঠিক পথ অনুসরণ করার এবং ভ্রান্ত পথসমূহে চলার কি কি ফলাফল এ দুনিয়ায় দেখা দেবে এবং দুনিয়ার বর্তমান ব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ার পর অন্য আরেকটি জগতে দেখা দেবে তাও সে বিস্তারিত বলে দেয়। সে এ দুনিয়ার পরিসমাপ্তি এবং আরেকটি দুনিয়া প্রতিষ্ঠার অবস্থা অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে আলোচনা করে, এ পরিবর্তনের সমস্ত স্তর এক এক করে বলে দেয়, দৃষ্টির সামনে পরজগতের পূর্ণ চিত্র অংকন করে এবং সেখানে মানুষ কিভাবে আরেকটি জীবন লাভ করবে তা স্পষ্ট করে বর্ণনা করে, কিভাবে তার পার্থিব জীবনের কার্যাবলীর হিসেব-নিকেশ হবে, কোন্ কোন্ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, কেন অনস্বীকার্য রূপে তার সামনে তার আমলনামা পেশ করা হবে। সেসব কাজের প্রমাণ স্বরূপ কি ধরনের অকাট্য সাক্ষ্যসমূহ পেশ করা হবে, পুরস্কার ও শাস্তিলাভকারী কেন পুরস্কার ও শাস্তিলাভ করবে। পুরস্কার লাভকারীরা কি ধরনের পুরস্কারলাভ করবে এবং শাস্তি প্রাপ্তরা কি কি ভাবে তাদের কার্যাবলীর মন্দফল ভোগ করবে, এ ব্যাপক বিষয়ে যে বক্তব্য এ গ্রন্থে পেশ করা হয়েছে তার মর্যাদা এমন নয় যে, তার রচয়িতা তর্ক শাস্ত্রের কিছু যুক্তিতর্ক একত্রিত করে কতকগুলো অনুমানের প্রসাদ নির্মাণ করেছেন, বরং এর রচয়িতা প্রকৃত সত্য সম্পর্কে সরাসরি জ্ঞান রাখেন তাঁর দৃষ্টি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছু দেখছে। সমস্ত সত্য তাঁর কাছে উন্মুক্ত। মহাবিশ্বের গোটাটাই তাঁর কাছে একখানা উন্মুক্ত গ্রন্থের মত। মানবজাতির শুরু থেকে শেষ পর্যন্তই শুধু নয়। লয় প্রাপ্তির পর তার অপর জীবনও তিনি যুগপৎ এক দৃষ্টিতে দেখছেন এবং শুধু অনুমান ও ধারণার ভিত্তিতে নয়, জ্ঞানের ভিত্তিতে মানুষকে পথপ্রদর্শন করছেন। এ গ্রন্থ যেসব সত্যকে তাত্বিকভাবে পেশ করে থাকে আজ পর্যন্ত তার কোন একটিকে ভুল বা মিথ্যা বলে প্রমাণ করা যায়নি। বিশ্ব-জাহান ও মানুষ সম্পর্কে সে যে ধারণা পেশ করে তা সমস্ত দৃশ্যমান বস্তু ও ঘটনাবলীর পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা পেশ করে এবং জ্ঞানের প্রতিটি শাখায় গবেষণার ভিত্তি রচনা করে। দর্শন বিজ্ঞান এবং সমাজ বিজ্ঞানের সমস্ত সাম্প্রতিকতম প্রশ্নের জবাব তার বাণীতে বর্তমান এবং এসবের মধ্যে এমন একটা যৌক্তিক সম্পর্ক বিদ্যমান যে, ঐগুলোকে ভিত্তি করে একটা পূর্ণাংগ সুসংবদ্ধ ও ব্যাপক চিন্তাপদ্ধতি গড়ে ওঠে। তাছাড়া জীবনের প্রতিটি দিক সম্পর্কে সে মানুষকে যে বাস্তব পথনির্দেশনা দিয়েছে তা শুধু যে, সর্বোচ্চ মানের যুক্তিগ্রাহ্য ও অত্যন্ত পবিত্র তাই নয়। বরং ১৪ শত বছর ধরে ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন আনাচে কানাচে অসংখ্য মানুষ কার্যত তার অনুসরণ করেছে। আর অভিজ্ঞতা তাকে সর্বোত্তম ব্যবস্থা বলে প্রমাণিত করেছে। এরূপ মর্যাদার মানব রচিত কোন গ্রন্থ কি দুনিয়ায় আছে কিংবা কোন সময় ছিল, যা এ গ্রন্থের মোকাবিলায় এনে দাঁড় করানো যেতে পারে?
চারঃ এ গ্রন্থ পুরোটা একবারে লিখে দুনিয়ার সামনে পেশ করা হয়নি। বরং কতকগুলো প্রাথমিক নির্দেশনা নিয়ে একটি সংস্কার আন্দোলন শুরু করা হয়েছিল। এরপর ২৩ বছর পর্যন্ত উক্ত আন্দোলন যেসব স্তর অতিক্রম করেছে তার অবস্থা ও প্রয়োজন অনুসারে ঐ আন্দোলনের নেতার মুখ দিয়ে এর বিভিন্ন অংশ কখনো দীর্ঘ ভাষণ এবং কখনো সংক্ষিপ্ত বাক্যের আকারে উচ্চারিত হয়েছে। অতঃপর এ কার্যক্রম পূর্ণতা লাভের পর বিভিন্ন সময়ে মুখ থেকে উচ্চারিত এসব অংশ পূর্ণাংগ গ্রন্থের আকারে সাজিয়ে দুনিয়ার সামনে পেশ করা হয়েছে যাকে ‘কুরআন’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। আন্দোলনের নেতার বক্তব্য হলো, এসব ভাষণ ও বাক্য তাঁর রচিত নয়, বরং তা বিশ্ব-জাহানের রবের পক্ষ থেকে তাঁর কাছে নাযিল হয়েছে। কেউ যদি একে ঐ নেতার নিজের রচিত বলে অভিহিত করে, তাহলে সে দুনিয়ার গোটা ইতিহাস থেকে এমন একটি নজির পেশ করুক যে, কোন মানুষ বছরের পর বছর নিজে একাধারে একটি বড় সংঘবদ্ধ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে কখনো একজন বক্তা এবং কখনো একজন নৈতিক শিক্ষক হিসেবে, কখনো একটি মজলূম দলের নেতা হিসেবে, কখনো একটি রাষ্ট্রের শাসক হিসেবে, কখনো আইন ও বিধান দাতা হিসেবে মোটকথা অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ-পরিস্থিতি ও সময়ে ভিন্ন ভিন্ন মর্যাদায় অধিষ্ঠিত থেকে ভিন্ন ভিন্ন যেসব বক্তব্য পেশ করেছেন, কিংবা কথা বলেছেন, তা একত্রিত হয়ে একটি পূর্ণাংগ, সুসংবদ্ধ ও সর্বাত্মক চিন্তা ও কর্মপ্রণালীতে পরিণত হয়েছে এবং তার মধ্যে কোথাও কোন বৈপরীত্য পাওয়া যায় না, তার মধ্যে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটিই মাত্র কেন্দ্রীয় ধারণা ও চিন্তার ধারাবাহিকতা সক্রিয় দেখা যায়। প্রথম দিন থেকে তিনি তাঁর আন্দোলনের যে ভিত্তি বর্ণনা করেছিলেন শেষ দিন পর্যন্ত সে ভিত্তি অনুসারে আকীদা-বিশ্বাস ও কার্যাবলীর এমন একটি ব্যাপক ও সার্বজনীন আদর্শ নির্মাণ করেছেন যার প্রতিটি অংশ অন্যান্য অংশের সাথে পূর্ণরূপে সামঞ্জস্য রাখে এবং এ সংকলন অধ্যয়নকারী কোন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তিই একথা উপলব্ধি না করে পারবে না যে আন্দোলনের সূচনাকালে আন্দোলনকারীর সামনে আন্দোলনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত গোটা আন্দোলনের পূর্ণাংগ চিত্র বর্তমান ছিল। এমন কখনো হয়নি মধ্য পথে কোন স্থানে তাঁর মাথায় এমন কোন ধারণার উদ্ভব হয়েছে যা পূর্বে তাঁর কাছে পরিষ্কার ছিল না অথবা যা পরে পরিবর্তন করতে হয়েছে। মস্তিস্কের সৃষ্টিশীলতার এমন চরম পরাকাষ্ঠা দেখাতে সক্ষম হয়েছে এমন কোন মানুষ যদি কোন সময় জন্মগ্রহণ করে থাকে তাহলে তা দেখিয়ে দেয়া হোক।
পাঁচঃ যে নেতার মুখ থেকে এসব ভাষণ ও বাণীসমূহ উচ্চারিত হয়েছে, তিনি হঠাৎ কোন গোপন আস্তানা থেকে শুধু এগুলো শোনানোর জন্য বেরিয়ে আসতেন না এবং শোনাবার পর আবার কোথাও চলে যেতেন না। এ আন্দোলন শুরু করার পূর্বেও তিনি মানব সমাজে জীবন যাপন করেছিলেন এবং পরেও জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সবসময় ঐ সমাজেই থাকতেন। মানুষ তাঁর আলোচনা ও বক্তব্যের ভাষা এবং বাচনভংগীর সাথে ভালভাবে পরিচিত ছিল। হাদীসসমূহে তার একটি বড় অংশ এখনও সংরক্ষিত আছে। পরবর্তী সময়ের আরবী ভাষাবিজ্ঞ মানুষ যা পড়ে সহজেই দেখতে পারে না যে, সেই নেতার বাচনভংগী কেমন ছিল। তাঁর স্বভাষী মানুষ সে সময়ও পরিষ্কার উপলব্ধি করতো এবং আরবী ভাষা জানা মানুষ আজও উপলব্ধি করে যে, এ গ্রন্থের (কুরআন) ভাষা ও বাকরীতি সেই নেতার ভাষা ও বাকরীতি থেকে অনেক ভিন্ন। এমন কি তার ভাষণের মধ্যে যেখানে এ গ্রন্থের কোন বাক্যের উদ্ধৃতি আসে তখন উভয়ের ভাষার পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পৃথিবীতে কোন মানুষ কি কখনো দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন স্টাইলে বছরের পর বছর কথা বলার ভান করতে সক্ষম হয়েছে বা হতে পারে অথচ দু’টিই যে, একই ব্যক্তির স্টাইল, সে রহস্য কখনো প্রকাশ পায় না? এ ধরনের ভান বা অভিনয় করে আকস্মিক বা সাময়িকভাবে সফল হওয়া সম্ভব। কিন্তু একাধারে ২৩ বছর পর্যন্ত এমনটি হওয়া কোনক্রমেই সম্ভব নয় যে, এক ব্যক্তি যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা অহী হিসেবে কথা বলে তখন তার ভাষা ও স্টাইল এক রকম হবে আবার যখন নিজের পক্ষ থেকে কথা বলে বা বক্তৃতা করে তখন তার ভাষা ও স্টাইল সম্পূর্ণ আরেক রকম হবে।
ছয়ঃ এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দান কালে সেই নেতা বিভিন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। কখনো তিনি বছরের পর বছর স্বদেশবাসী ও স্বগোত্রীয় লোকদের উপহাস, অবজ্ঞা ও চরম জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, কখনো তাঁর সঙ্গী-সাথীদের ওপর এমন জুলুম করা হয়েছে যে, তারা দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। কখনো শত্রুরা তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে, কখনো তাঁর নিজেকেই স্বদেশভূমি ছেড়ে হিজরত করতে হয়েছে। কখনো তাঁকে চরম দারিদ্রকষ্ট সইতে এবং ভুখা জীবন কাটাতে হয়েছে। কখনো তাঁকে একের পর এক লড়াইয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং তাতে বিজয় ও পরাজয় উভয়টিই এসেছে। কখনো তিনি দুশমনদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেছেন এবং যেসব দুশমন তাঁর ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল তাদেরকেই তাঁর সামনে অধোবদন হতে হয়েছে। কখনো তিনি এমন ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভ করেছেন যা খুব কম লোকের ভাগ্যেই জুটে থাকে। একথা স্পষ্ট যে, এ ধরনের নানা পরিস্থিতিতে কোন মানুষের আবেগ অনুভূতি এক রকম থাকতে পারে না। এসব রকমারি ক্ষেত্র ও পরিস্থিতিতে সেই নেতা যখনই তাঁর ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে কথা বলেছেন তখনই তাঁর মধ্যে স্বভাবসুলভ মানবোচিত আবেগ অনুভূতির প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে যা এরূপ ক্ষেত্র ও পরিস্থিতিতে একজন মানুষের মনে সচারাচর সৃষ্টি হয়ে থাকে। কিন্তু এসব পরিস্থিতিতে তাঁর মুখ হতে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা অহী হিসেবে যেসব কথা শোনা গিয়েছে তা ছিল মানবিক আবেগ-অনুভূতি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। কোন একটি ক্ষেত্রেও কোন কট্টর সমালোচকও অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলতে পারবে না যে, এখানে মানবিক আবেগ-অনুভূতির প্রভাব পড়েছে বলে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
সাতঃ এ গ্রন্থে যে ব্যাপক ও পূর্ণাংগ জ্ঞান পাওয়া যায় তা সে যুগের আরববাসী, রোমান, গ্রীক ও ইরানবাসীদের কাছে তো দূরের কথা এ বিংশ শতাব্দীর বড় বড় পণ্ডিতদেরও কারো ঝুলিতে নেই। বর্তমানে অবস্থা এই যে, দর্শন, বিজ্ঞান এবং সমাজ বিদ্যার কোন একটি শাখার অধ্যয়নে গোটা জীবন কাটিয়ে দেয়ার পরই কেবল কোন ব্যক্তি জ্ঞানের সেই শাখার সর্বশেষ সমস্যাবলী জানতে পারে। তারপর যখন গভীর দৃষ্টি নিয়ে সে কুরআন অধ্যয়ন করে তখন জানতে পারে যে, এ গ্রন্থে সেসব সমস্যার একটি সুস্পষ্ট জবাব বিদ্যমান। এ অবস্থা জ্ঞানের কোন একটি শাখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং যেসব জ্ঞান বিশ্ব-জাহান ও মানুষের সাথে কোনভাবে সম্পর্কিত তার সবগুলোর ক্ষেত্রেই সঠিক। কি করে বিশ্বাস করা যেতে পারে যে, ১৪ শত বছর পূর্বে আরব-মরুর এক নিরক্ষর ব্যক্তি জ্ঞানের প্রতিটি শাখায় এমন ব্যাপক দক্ষ ছিল এবং তিনি প্রতিটি মৌলিক সমস্যা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে সেগুলোর একটি পরিষ্কার ও চূড়ান্ত জওয়াব খুঁজে পেয়েছিলেন?
কুরআনের মু’জিযা হওয়ার যদিও আরো অনেক কারণ আছে। তবে কেউ যদি শুধু এ কয়টি কারণ নিয়ে চিন্তা করে তাহলে সে জানতে পারবে কুরআন নাযিল হওয়ার যুগে কুরআনের মু’জিযা হওয়া যতটা স্পষ্ট ছিল আজ তার চেয়ে অনেক গুণে বেশী স্পষ্ট এবং ইনশায়াল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত স্পষ্টতম হতে থাকবে।
এটা ছিল এমন একটি তীক্ষ্ণ ছুঁচালো প্রশ্ন যা মুশরিকদের আকীদা-বিশ্বাসের ভিত্তিমূলকেই কাঁপিয়ে দিয়েছে। বুখারী ও মুসলিম বর্ণিত হাদীসে আছে, বদর যুদ্ধের পর বন্দী কুরাইশদের মুক্ত করার বিষয়ে আলোচনা করার জন্য মক্কার কাফেরদের পক্ষ থেকে জুবাইর ইবনে মুতয়িম মাদীনায় আসে। তখন রসূলুল্লাহ ﷺ মাগরিবের নামাযে ইমামতি করছিলেন। নামাযে তিনি সূরা তূর পড়ছিলেন। তার নিজের বর্ণনা হচ্ছে, নবী (সা.) যখন সূরার এ আয়াত পড়ছিলেন তখন মনে হলো, আমার কলিজাটা বুঝি বক্ষ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। সেদিন এ আয়াত শুনে তার মনে ইসলাম বদ্ধমূল হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এটি তার ইসলাম গ্রহণ করার একটি বড় কারণ হয়েছিল।