পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

১৬৯ আয়াত

৪১ ) হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে বেশী করে স্মরণ করো
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ ٱذْكُرُوا۟ ٱللَّهَ ذِكْرًۭا كَثِيرًۭا ٤١
৪২ ) এবং সকাল সাঁঝে তাঁর মহিমা ঘোষণা করতে থাকো। ৭৮
وَسَبِّحُوهُ بُكْرَةًۭ وَأَصِيلًا ٤٢
৪৩ ) তিনিই তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং তাঁর ফেরেশতারা তোমাদের জন্য দোয়া করে, যাতে তিনি তোমাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোকের মধ্যে নিয়ে আসেন, তিনি মু’মিনদের প্রতি বড়ই মেহেরবান। ৭৯
هُوَ ٱلَّذِى يُصَلِّى عَلَيْكُمْ وَمَلَـٰٓئِكَتُهُۥ لِيُخْرِجَكُم مِّنَ ٱلظُّلُمَـٰتِ إِلَى ٱلنُّورِ ۚ وَكَانَ بِٱلْمُؤْمِنِينَ رَحِيمًۭا ٤٣
৪৪ ) যেদিন তারা তাঁর সাথে সাক্ষাত করবে, তাদের অভ্যর্থনা হবে সালামের মাধ্যমে
تَحِيَّتُهُمْ يَوْمَ يَلْقَوْنَهُۥ سَلَـٰمٌۭ ۚ وَأَعَدَّ لَهُمْ أَجْرًۭا كَرِيمًۭا ٤٤
৪৫ ) এবং তাদের জন্য আল্লাহ‌ বড়ই সম্মানজনক প্রতিদানের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। ৮০ হে নবী! ৮১ আমি তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষী বানিয়ে, ৮২
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِىُّ إِنَّآ أَرْسَلْنَـٰكَ شَـٰهِدًۭا وَمُبَشِّرًۭا وَنَذِيرًۭا ٤٥
৪৬ ) সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী করে ৮৩ আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহ্বানকারীরূপে ৮৪ এবং উজ্জ্বল প্রদীপ হিসেবে।
وَدَاعِيًا إِلَى ٱللَّهِ بِإِذْنِهِۦ وَسِرَاجًۭا مُّنِيرًۭا ٤٦
৪৭ ) সুসংবাদ দাও তাদেরকে যারা ঈমান এনেছে (তোমার প্রতি) যে, তাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে রয়েছে বিরাট অনুগ্রহ।
وَبَشِّرِ ٱلْمُؤْمِنِينَ بِأَنَّ لَهُم مِّنَ ٱللَّهِ فَضْلًۭا كَبِيرًۭا ٤٧
৪৮ ) আর কখনো দমিত হয়ো না কাফের ও মুনাফিকদের কাছে, পরোয়া করো না তাদের পীড়নের এবং ভরসা করো আল্লাহর প্রতি। আল্লাহই যথেষ্ট এজন্য যে, মানুষ তাঁর হাতে তার যাবতীয় বিষয় সোপর্দ করে দেবে।
وَلَا تُطِعِ ٱلْكَـٰفِرِينَ وَٱلْمُنَـٰفِقِينَ وَدَعْ أَذَىٰهُمْ وَتَوَكَّلْ عَلَى ٱللَّهِ ۚ وَكَفَىٰ بِٱللَّهِ وَكِيلًۭا ٤٨
৪৯ ) হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা মুমিন নারীদেরকে বিয়ে করো এবং তারপর তাদেরকে স্পর্শ করার আগে তালাক দিয়ে দাও ৮৫ তখন তোমাদের পক্ষ থেকে তাদের জন্য কোনো ইদ্দত অপরিহার্য নয়, যা পুরা হবার দাবী তোমরা করতে পারো। কাজেই তাদেরকে কিছু অর্থ দাও এবং ভালোভাবে বিদায় করো। ৮৬
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓا۟ إِذَا نَكَحْتُمُ ٱلْمُؤْمِنَـٰتِ ثُمَّ طَلَّقْتُمُوهُنَّ مِن قَبْلِ أَن تَمَسُّوهُنَّ فَمَا لَكُمْ عَلَيْهِنَّ مِنْ عِدَّةٍۢ تَعْتَدُّونَهَا ۖ فَمَتِّعُوهُنَّ وَسَرِّحُوهُنَّ سَرَاحًۭا جَمِيلًۭا ٤٩
৫০ ) হে নবী! আমি তোমার জন্য হালাল করে দিয়েছি তোমার স্ত্রীদেরকে যাদের মহর তুমি আদায় করে দিয়েছো ৮৭ এবং এমন নারীদেরকে যারা আল্লাহ‌ প্রদত্ত বাঁদীদের মধ্য থেকে তোমার মালিকানাধীন হয়েছে আর তোমার চাচাত, ফুফাত, মামাত, খালাত বোনদেরকে, যারা তোমার সাথে হিজরত করেছে এবং এমন মু’মিন নারীকে যে নিজেকে নবীর কাছে নিবেদন করেছে যদি নবী তাকে বিয়ে করতে চায়, ৮৮ এ সুবিধাদান বিশেষ করে তোমার জন্য, অন্য মু’মিনদের জন্য নয়। ৮৯ সাধারণ মু’মিনদের ওপর তাদের স্ত্রী ও বাঁদীদের ব্যাপারে আমি যে সীমারেখা নির্ধারণ করেছি তা আমি জানি, (তোমাকে এ সীমারেখা থেকে এজন্য আলাদা রেখেছি) যাতে তোমার কোন অসুবিধা না হয়, ৯০ আর আল্লাহ‌ ক্ষমাশীল ও মেহেরবান।
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِىُّ إِنَّآ أَحْلَلْنَا لَكَ أَزْوَٰجَكَ ٱلَّـٰتِىٓ ءَاتَيْتَ أُجُورَهُنَّ وَمَا مَلَكَتْ يَمِينُكَ مِمَّآ أَفَآءَ ٱللَّهُ عَلَيْكَ وَبَنَاتِ عَمِّكَ وَبَنَاتِ عَمَّـٰتِكَ وَبَنَاتِ خَالِكَ وَبَنَاتِ خَـٰلَـٰتِكَ ٱلَّـٰتِى هَاجَرْنَ مَعَكَ وَٱمْرَأَةًۭ مُّؤْمِنَةً إِن وَهَبَتْ نَفْسَهَا لِلنَّبِىِّ إِنْ أَرَادَ ٱلنَّبِىُّ أَن يَسْتَنكِحَهَا خَالِصَةًۭ لَّكَ مِن دُونِ ٱلْمُؤْمِنِينَ ۗ قَدْ عَلِمْنَا مَا فَرَضْنَا عَلَيْهِمْ فِىٓ أَزْوَٰجِهِمْ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَـٰنُهُمْ لِكَيْلَا يَكُونَ عَلَيْكَ حَرَجٌۭ ۗ وَكَانَ ٱللَّهُ غَفُورًۭا رَّحِيمًۭا ٥٠
.
৭৮.
মুসলমানদেরকে এ উপদেশ দেয়াই এর উদ্দেশ্য যে, যখন শত্রুদের পক্ষ থেকে আল্লাহর রসূলের প্রতি ব্যাপকভাবে বিদ্রূপ ও নিন্দাবাদ করা হয় এবং আল্লাহর সত্য দ্বীনকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য রসূলের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের তুফান সৃষ্টি করা হয় তখন নিশ্চিন্তে এসব বাজে খিস্তি খেউড় শুনতে থাকা, নিজেই শত্রুদের ছাড়নো সন্দেহ সংশয়ে জড়িয়ে পড়া এবং জবাবে তাদেরকেও গালাগালি করতে থাকা মু’মিনদের কাজ নয়। বরং তাদের কাজ হচ্ছে, সাধারণ দিনগুলোর তুলনায় এসব দিনে বিশেষভাবে আল্লাহকে আরো বেশী করে স্মরণ করা। “আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ করা”র অর্থ ৬৩ টীকায় বর্ণনা করা হয়েছে। সকাল সাঁঝে আল্লাহ‌র মহিমা ঘোষণা করার অর্থ হচ্ছে সর্বক্ষণ তাঁর তাসবীহ করা। আর তাসবীহ করা মানে আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করা, নিছক তাসবীহর দানা হাতে নিয়ে গুণতে থাকা নয়।
৭৯.
মুসলমানদের মনে এ অনুভূতি সৃষ্টি করাই এর উদ্দেশ্য যে, কাফের ও মুনাফিকদের মনের সমস্ত জ্বালা ও আক্রোশের কারণ হচ্ছে আল্লাহর রহমত, যা তাঁর রসূলের বদৌলতে তোমাদের ওপর বর্ষিত হয়েছে। এরই মাধ্যমে তোমরা ঈমানী সম্পদ লাভ করেছো, কুফরী ও জাহেলিয়াতের অন্ধকার ভেদ করে ইসলামের আলোকে চলে এসেছো এবং তোমাদের মধ্যে এমন উন্নত নৈতিক বৃত্তি ও গুণাবলীর সৃষ্টি হয়েছে যেগুলোর কারণে অন্যদের থেকে তোমাদের সুস্পষ্ট শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিভাত হচ্ছে। হিংসুটেরা রসূলের ওপর এরই ঝাল ঝাড়ছে। এ অবস্থায় এমন কোন নীতি অবলম্বন করো না যার ফলে তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়ে যাও।

অনুগ্রহের ভাব প্রকাশ করার জন্য মূলে সালাত (يصلى-صلوة) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। “সালাত” শব্দটি যখন আরো (على) অব্যয় সহকারে আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাদের জন্য ব্যবহার করা হয় তখন এর অর্থ হয় রহমত, অনুগ্রহ, করুণা ও স্নেহশীষ। আর যখন এটি ফেরেশতাদের পক্ষ থেকে মানুষের জন্য ব্যবহৃত হয় তখন এর অর্থ হয় রহমতের দোয়া করা। অর্থাৎ ফেরেশতারা আল্লাহর কাছে মানুষের জন্য এই মর্মে দোয়া করে যে, হে আল্লাহ‌, তুমি এদের প্রতি অনুগ্রহ করো এবং তোমার দানে এদেরকে আপ্লুত করে দাও। এভাবে يُصَلِّي عَلَيْكُمْ এর অর্থ এও হয় যে, يشيع عنكم الذكر الجميل فى عباد الله অর্থাৎ আল্লাহ‌ তাঁর বান্দাদের মধ্যে তোমাদেরকে খ্যাতি দান করেন এবং এমন পর্যায়ে উন্নীত করেন যার ফলে আল্লাহর সমুদয় সৃষ্টি তোমাদের প্রশংসা করতে থাকে এবং ফেরেশতারা তোমাদের প্রশংসা ও সুনামের আলোচনা করতে থাকে।

.
৮০.
মূলে বলা হয়েছেঃ تَحِيَّتُهُمْ يَوْمَ يَلْقَوْنَهُ سَلَامٌ “তার সাথে মোলাকাতের সময় সেদিন তাদের অভ্যর্থনা হবে সালাম” এর তিনটি অর্থ হতে পারে। এক, আল্লাহ নিজেই “আসসালামু আলাইকুম” বলে তাদেরকে অভ্যর্থনা করবেন। যেমন সূরা ইয়াসীন--এর ৫৮ আয়াত বলা হয়েছেঃ

سَلَامٌ قَوْلًا مِنْ رَبٍّ رَحِيمٍ

দুই, ফেরেশতারা তাদেরকে সালাম করবে। যেমন সূরা নাহলে বলা হয়েছেঃ

الَّذِينَ تَتَوَفَّاهُمُ الْمَلَائِكَةُ طَيِّبِينَ يَقُولُونَ سَلَامٌ عَلَيْكُمُ ادْخُلُوا الْجَنَّةَ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ

“ফেরেশতারা যাদের রূহ কবয করবে এমন অবস্থায় যখন তারা পবিত্র লোক ছিল, তাদেরকে তারা বলবে, শান্তি ও নিরাপত্তা হোক তোমাদের প্রতি, প্রবেশ করো জান্নাতে তোমাদের সৎকাজসমূহের বদৌলতে, যা তোমরা দুনিয়ায় করতে।”

(৩২ আয়াত)

তিন, তারা নিজেরাই পরস্পরকে সালাম করবে। সূরা ইউনুসে বলা হয়েছেঃ

دَعْوَاهُمْ فِيهَا سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَتَحِيَّتُهُمْ فِيهَا سَلَامٌ وَآخِرُ دَعْوَاهُمْ أَنِ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ

“সেখানে তাদের আওয়াজ হবে, হে আল্লাহ! পবিত্র তোমার সত্তা, তাদের অভ্যর্থনা হবে ‘সালাম’ এবং তাদের কথা শেষ হবে এ বাক্য দিয়ে যে, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রব্বুল আলামিনের জন্যই।” (১০ আয়াত)

৮১.
মুসলমানদেরকে উপদেশ দেবার পর এবার আল্লাহ‌ তাঁর নবীকে সম্বোধন করে কয়েকটা সান্ত্বনার বাণী উচ্চারণ করেছেন। বক্তব্যের উদ্দেশ্য হচ্ছেঃ আপনাকে আমি এসব উন্নত মর্যাদা দান করেছি। এ বিরোধীরা অপবাদ ও মিথ্যাচারের তুফান সৃষ্টি করে আপনার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কারণ আপনার ব্যক্তিত্ব তার অনেক ঊর্ধ্বে। কাজেই আপনি তাদের শয়তানির কারণে দুঃখ ভারাক্রান্ত হবেন না এবং তাদের প্রচারণাকে তিলার্ধও গুরুত্ব দেবেন না। নিজের আরোপিত দায়িত্ব পালন করে যেতে থাকেন এবং তাদের মনে যা চায় তাই বকবক করতে বলুন। এ সঙ্গে পরোক্ষভাবে মু’মিন ও কাফের নির্বশেষে সকল মানুষকে বলা হয়েছে যে, কোন সাধারণ মানুষের সাথে তাদের মোকাবিলা হচ্ছে না বরং মহান আল্লাহ‌ যাঁকে মর্যাদার উচ্চমার্গে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন তেমনি এক মহান ব্যক্তিত্বের সাথে হচ্ছে তাদের মোকাবিলা।
৮২.
নবীকে সাক্ষী করার অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবোধক। তিন ধরনের সাক্ষ্য প্রদান এর অন্তর্ভুক্তঃ

একঃ মৌখিক সাক্ষ্যদান। অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীন যেসব সত্য ও মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত নবী তার সত্যতার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে যাবেন এবং দুনিয়াবাসীকে পরিষ্কার বলে দেবেন, এটিই সত্য এবং এর বিরুদ্ধে যা কিছু আছে সবই মিথ্যা। আল্লাহর অস্তিত্ব ও তাঁর একত্ব, ফেরেশতাদের অস্তিত্ব, অহী নাযিল হওয়া, মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অনিবার্যতা এবং জান্নাত ও জাহান্নামের প্রকাশ, দুনিয়া বাসীদের কাছে যতই অদ্ভূত মনে হোক না কেন এবং তারা একথাগুলোর বক্তাকে যতই বিদ্রূপ করুক বা তাকে পাগল বলুক না কেন, নবী কারো পরোয়া না করেই দাঁড়িয়ে যাবেন এবং সোচ্চার কন্ঠে বলে দেবেন, এসব কিছুই সত্য এবং যারা এসব মানে না তারা পথভ্রষ্ট। এভাবে নৈতিকতা ও সভ্যতা-সংস্কৃতির যে ধারণা, মূল্যবোধ, মূলনীতি ও বিধান আল্লাহ‌ তাঁর সামনে সুস্পষ্ট করেছেন সেগুলোকে সারা দুনিয়ার মানুষ মিথ্যা বললেও এবং তারা তার বিপরীত পথে চললেও নবীর কাজ হচ্ছে সেগুলোকেই প্রকাশ্য জনসম্মুখে পেশ করবেন এবং দুনিয়ায় প্রচলিত তার বিরোধী যাবতীয় পদ্ধতিকে ভ্রান্ত ঘোষণা করবেন। অনুরূপভাবে আল্লাহর শরীয়াতে যা কিছু হালাল সারা দুনিয়া তাকে হারাম মনে করলেও নবী তাকে হালালই বলবেন। আর আল্লাহর শরীয়াতে যা হারাম সারা দুনিয়া তাকে হালাল ও ভালো গণ্য করলেও নবী তাকে হারামই বলবেন।

দুইঃ কর্মের সাক্ষ্য। অর্থাৎ দুনিয়ার সামনে যে মতবাদ পেশ করার জন্য নবীর আবির্ভাব হয়েছে তিনি নিজের জীবনের সমগ্র কার্মকান্ডের মাধ্যমে তার প্রদর্শনী করবেন। যে জিনিসকে তিনি মন্দ বলেন তাঁর জীবন তার সকল প্রকার গন্ধমুক্ত হবে। যে জিনিসকে তিনি ভালো বলেন তাঁর চরিত্রে তা পূর্ণমাত্রায় দেদীপ্যমান হবে। যে জিনিসকে তিনি ফরয বলেন তা পালন করার ক্ষেত্রে তিনি সবচেয়ে অগ্রণী হবেন। যে জিনিসকে তিনি গোনাহ বলেন তা থেকে দূরে থাকার ব্যাপারে কেউ তাঁর সমান হবে না। যে জীবন বিধানকে তিনি আল্লাহ‌ প্রদত্ত জীবন বিধান বলেন তাকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে তিনি কোন প্রচেষ্টার ত্রুটি করবেন না। তিনি নিজের দাওয়াতে ব্যাপারে কতটা সত্যনিষ্ঠ ও আন্তরিকতা তাঁর নিজের চরিত্র ও কার্যধারাই সাক্ষ্য দেবে। তাঁর সত্তা তাঁর শিক্ষার এমন মূর্তিমান আদর্শ হবে, যা দেখে প্রত্যেক ব্যক্তি জানবে, যে দ্বীনের দিকে তিনি দুনিয়াবাসীকে আহবান জানাচ্ছেন তা কোন্ মানের মানুষ তৈরি করতে চায়, কোন্ ধরনের চরিত্র সৃষ্টি তার লক্ষ্য এবং তার সাহায্যে সে কোন্ ধরনের জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা করে।

তিনঃ পরকালীন সাক্ষ্য। অর্থাৎ আখেরাতে যখন আল্লাহর আদালত প্রতিষ্ঠিত হবে তখন নবী এ মর্মে সাক্ষ্য দেবেন, তাঁকে যে পয়গাম দেয়া হয়েছিল তা তিনি কোন প্রকার কাটছাঁট ও কমবেশী না করে হুবহু মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের সামনে নিজের কথা ও কর্মের মাধ্যমে সত্যকে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরার ব্যাপারে সামান্যতম ত্রুটি করেননি। এ সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তাঁর বাণী মান্যকারী কি পুরস্কার পাবে এবং অমান্যকারী কোন্ ধরনের শাস্তির অধিকারী হবে তার ফায়সালা করা হবে।

এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে, নবী ﷺ কে সাক্ষ্যদানের পর্যায়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে আল্লাহ‌ তাঁর প্রতি কত বড় দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন এবং এত উচ্চ স্থানে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য কত মহান ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন। একথা স্পষ্ট, কথা ও কর্মের মাধ্যমে আল্লাহর সত্য দ্বীনের সাক্ষ্য প্রদান করার ক্ষেত্রে নবী ﷺ এর তিল পরিমাণও ত্রুটি হয়নি। তবেই তো তিনি আখেরাতে এই মর্মে সাক্ষ্য দিতে পারবেন, “আমি লোকদের সামনে সত্যকে পুরোপুরি সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছিলাম।” আর তবেই তো আল্লাহর প্রমাণ (হুজ্জাত) লোকদের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। অন্যথায় যদি সাক্ষ্য দেবার ব্যাপারে এখানে নাউযুবিল্লাহ তাঁর কোন ত্রুটি থেকে যায়, তাহলে না তিনি আখেরাতে তাদের জন্য সাক্ষী হতে পারবেন আর না সত্য অমান্যকারীদের অপরাধ সত্য প্রমাণিত হতে পারবে।

কেউ কেউ এ সাক্ষ্যদানকে এ অর্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন যে, নবী ﷺ আখেরাতে লোকদের কাজের ওপর সাক্ষ্য দেবেন এবং এ থেকে তারা একথা প্রমাণ করেন যে, নবী করীম ﷺ সকল মানুষের কার্যক্রম দেখছেন অন্যথায় না দেখে কেমন করে সাক্ষ্য দিতে পারবেন? কিন্তু কুরআন মজীদের দৃষ্টিতে এ ব্যাখ্যা একবারেই ভ্রান্ত। কুরআন আমাদের বলে, লোকদের কার্যক্রমের ওপর সাক্ষ্য কায়েম করার জন্য তো আল্লাহ‌ অন্য একটি ব্যবস্থা করেছেন। এ উদ্দেশ্যে তাঁর ফেরেশতারা প্রত্যেক ব্যক্তির আমলনামা তৈরি করছে। (দেখুন সূরা কাফ ১৭-১৮ আয়াত এবং আল কাহ্‌ফ ১৪৯ আয়াত) আর এজন্য তিনি মানুষের নিজের অংগ-প্রত্যংগেরও সাক্ষ্য নেবেন। (সূরা ইয়াসীন, ৬৫; হা মীম আস্ সাজদাহ, ২০-২১) বাকী রইলো নবীগণের ব্যাপার। আসলে নবীগণের কাজ বান্দাদের কার্যক্রমের ওপর সাক্ষ্য দেয়া নয় বরং বান্দাদের কাছে যে সত্য পৌঁছিয়ে দেয়া হয়েছিল, সে বিষয়ে তারা সাক্ষ্য দেবেন। কুরআন পরিষ্কার বলেঃ

يَوْمَ يَجْمَعُ اللَّهُ الرُّسُلَ فَيَقُولُ مَاذَا أُجِبْتُمْ قَالُوا لَا عِلْمَ لَنَا إِنَّكَ أَنْتَ عَلَّامُ الْغُيُوبِ

“যেদিন আল্লাহ‌ সমস্ত রসূলকে সমবেত করবেন তারপর জিজ্ঞেস করবেন; তোমাদের দাওয়াতের কি জবাব দেয়া হয়েছিল? তখন তারা বলবে, আমাদের কিছুই জানা নেই। সমস্ত অজ্ঞাত ও অজানা কথাতো একমাত্র তুমিই জানো।’ (আল মা-য়েদাহ, ১০৯)

আর এ প্রসঙ্গে হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে কুরআন বলে, যখন তাঁকে ঈসায়ীদের গোমরাহী সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে তখন তিনি বলবেনঃ

وَكُنْتُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا مَا دُمْتُ فِيهِمْ فَلَمَّا تَوَفَّيْتَنِي كُنْتَ أَنْتَ الرَّقِيبَ عَلَيْهِمْ

“আমি যতদিন তাদের মধ্যে ছিলাম ততদিন পর্যন্ত তাদের ওপর সাক্ষী ছিলাম। যখন আপনি আমাকে উঠিয়ে নিয়েছেন তখন আপনিই তাদের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন।” (আল মা-য়েদাহ, ১১৭)

নবীগন যে মানুষের কাজের ব্যাপারে সাক্ষী হবেন না এ সম্পর্কে এ আয়াতটি একেবারেই সুস্পষ্ট। তাহলে তাঁরা সাক্ষী হবেন কোন্ জিনিসের? এর পরিষ্কার জবাব কুরআন এভাবে দিয়েছেঃ

وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا

“আর হে মুসলমানগণ! এভাবে আমি তোমাদেরকে করেছি একটি মধ্যপন্থী উম্মাত, যাতে তোমরা লোকদের ওপর সাক্ষী হবে এবং রসূল তোমাদের ওপর সাক্ষী হন।” (আল বাকারাহ, ১৪৩)

وَيَوْمَ نَبْعَثُ فِي كُلِّ أُمَّةٍ شَهِيدًا عَلَيْهِمْ مِنْ أَنْفُسِهِمْ وَجِئْنَا بِكَ شَهِيدًا عَلَى هَؤُلَاءِ

“আর যেদিন আমি প্রত্যেক উম্মাতের মধ্যে তাদেরই মধ্য থেকে একজন সাক্ষী উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে দেবো, যে তাদের ওপর সাক্ষ্য দেবে এবং (হে মুহাম্মাদ) তোমাকে এদের ওপর সাক্ষী হিসেবে নিয়ে আসবো।” (আন নাহল, ৮৯)

এ থেকে জানা যায়, কিয়ামতের দিন নবী ﷺ এর উম্মাতকে এবং প্রত্যেক উম্মাতের ওপর সাক্ষ্যদানকারী সাক্ষীদেরকে যে ধরনের সাক্ষ্যদান করার জন্য ডাকা হবে নবী ﷺ এর সাক্ষ্য তা থেকে ভিন্ন ধরনের হবে না। একথা সুস্পষ্ট যে, এটা যদি কার্যাবলীর সাক্ষ্যদান হয়ে থাকে, তাহলে সে সবের উপস্থিত ও দৃশ্যমান হওয়াও অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। আর মানুষের কাছে তার স্রষ্টার পয়গাম পৌঁছে গিয়েছিল কিনা কেবল এ বিষয়ের সাক্ষ্য দেয়ার জন্য যদি এ সাক্ষীদেরকে ডাকা হয়, তাহলে অবশ্যই নবী করীমকেও ﷺ এ উদ্দেশ্যেই পেশ করা হবে। বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও ইমাম আহমাদ প্রমুখগণ আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আবুদ দারদা, আনাস ইবনে মালেক ও অন্যান্য বহু সাহাবা থেকে যে হাদীসগুলো উদ্ধৃত করেছেন সেগুলোও এ বিষয়বস্তুর সমর্থক। সেগুলোর সম্মিলিত বিষয়বস্তু হচ্ছেঃ নবী ﷺ কিয়ামতের দিন দেখবেন তাঁর কিছু সাহাবীকে আনা হচ্ছে কিন্তু তারা তাঁর দিকে না এসে অন্যদিকে যাচ্ছে অথবা তাদেরকে ধাক্কা দিয়ে অন্য দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। নবী করীম ﷺ তাদেরকে দেখে নিবেদন করবেন, হে আল্লাহ! এরা তো আমার সাহাবী। একথায় আল্লাহ‌ বলবেন, তুমি জানো না তোমার পর এরা কি সব কাজ করেছে। এ বিষয়বস্তুটি এত বিপুল সংখ্যক সাহাবী থেকে এত বিপুল সংখ্যক সনদ সহকারে বর্ণিত হয়েছে যে, এর নির্ভুলতায় সন্দেহ পোষণ করার কোন অবকাশ নেই। আর এ থেকে একথাও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, নবী ﷺ নিজের উম্মাতের প্রত্যেক ব্যক্তির এবং তার প্রত্যেকটি কাজের দর্শক মোটেই নন। তবে যে হাদীসে বলা হয়েছে যে, নবী (সা.) এর সামনে তাঁর উম্মাতের কার্যাবলী পেশ করা হয়ে থাকে সেটি কোনক্রমেই এর সাথে সংঘর্ষশীল নয়। কারণ তার মূল বক্তব্য শুধুমাত্র এতটুকু যে, মহান আল্লাহ‌ নবী করীমকে ﷺ তাঁর উম্মাতের কার্যাবলী সম্পর্কে অবহিত রাখেন। তার এ অর্থ কোথা থেকে পাওয়া যায় যে, তিনি প্রত্যেক ব্যক্তির কার্যকলাপ চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করছেন?

৮৩.
এখানে এ পার্থক্যটা সামনে রাখতে হবে যে, কোন ব্যক্তিকে স্বে‌চ্ছাকৃতভাবে ঈমান ও সৎকাজের জন্য শুভ পরিণামের সুসংবাদ দেয়া এবং কুফরী ও অসৎকাজের অশুভ পরিণামের ভয় দেখানো এক কথা এবং কারো আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী হয়ে প্রেরিত হওয়া সম্পূর্ণ আলাদা কথা। যে ব্যক্তিই আল্লাহর পক্ষ থেকে এ পদে নিযুক্ত হবেন তাঁর নিজের সুসংবাদ ও ভীতি প্রদর্শনের পেছনে অবশ্যই কিছু ক্ষমতা থাকে, যার ভিত্তিতে তার সুসংবাদ ও সতর্কীকরণগুলো আইনের মর্যাদা লাভ করে। তার কোন কাজের সুসংবাদ দেয়ার অর্থ হয়, যে সর্বময় ক্ষমতা সম্পন্ন শাসকের পথ থেকে তিনি প্রেরিত হয়েছেন তিনি এ কাজটি পছন্দনীয় ও প্রতিদান লাভের যোগ্য বলে ঘোষণা দিচ্ছেন। কাজেই তা নিশ্চয়ই ফরয বা ওয়াজিব বা মুস্তাহাব এবং কাজটি যিনি করেছেন তিনি নিশ্চয়ই প্রতিদান লাভ করবেন। আর তার কোন কাজের অশুভ পরিণামের খবর দেয়ার অর্থ হয়, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সত্তা সে কাজ করতে নিষেধ করছেন, কাজেই তা অবশ্যই হারাম ও গোনাহের কাজ এবং নিশ্চিতভাবেই সে কার্য সম্পাদনকারী শাস্তি লাভ করবে। কোন অনিয়োগকৃত সতর্ককারী ও সুসংবাদ দানকারী কখনো এ মর্যাদা লাভ করবে না।
৮৪.
এখানেও একজন সাধারণ প্রচারকের প্রচার ও নবীর প্রচারের মধ্যেও সেই একই পার্থক্য রয়েছে যেদিকে ওপরে ইঙ্গিত করা হয়েছে। প্রত্যেক প্রচারকই আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেন এবং দিতে পারেন কিন্তু তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্ত হন না। পক্ষান্তরে নবী আল্লাহর হুকুমে (Sanction) দাওয়াত দিতে এগিয়ে যান। তাঁর দাওয়াত নিছক প্রচার নয় বরং তার পেছনেও থাকে তাঁর প্রেরক রব্বুল আলামীনের শাসন কর্তৃত্বের ক্ষমতা। তাই আল্লাহ‌ প্রেরিত আহবায়কের বিরোধিতা স্বয়ং আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ হিসেবে গণ্য হয়। দুনিয়ার কোন রাষ্ট্রের সরকারী কার্য সম্পাদনকারী সরকারী কর্মচারীকে বাধা দেয়া যেমন সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ মনে করা হয় এও ঠিক তেমনি।
.
.
.
৮৫.
এ বাক্যটিতে একথা সুস্পষ্ট যে, এখানে ‘নিকাহ’ তথা বিবাহ শব্দটি থেকে শুধুমাত্র বিবাহ বন্ধনের কথাই প্রকাশ হয়েছে। আরবী ভাষায় ‘নিকাহ’ শব্দটির আসল অর্থ কি অভিধানবিদদের মধ্যে এ ব্যাপারে বহুতর মতবিরোধ দেখা গেছে। একটি দল বলে, এ শব্দটির মধ্যে শাব্দিকভাবে সঙ্গম ও বিয়ে উভয় অর্থ প্রচ্ছন্নভাবে রয়েছে। তৃতীয় একটি দল বলে, এর আসল অর্থ হচ্ছে এক জোড়া মানব মানবীর বিবাহ এবং সঙ্গমের জন্য একে রূপকভাবে ব্যবহার করা হয়। চতুর্থ দলটি বলে, এর আসল অর্থ হচ্ছে সঙ্গম এবং বিয়ের জন্য একে রূপকভাবে ব্যবহার করা হয়। এর প্রমাণ হিসেবে প্রত্যেক দল আরবীয় প্রবাদ ও বাগধারা থেকে দৃষ্টান্ত পেশ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু রাগেব ইস্‌ফাহানী অত্যন্ত জোরের সাথে দাবী করেছেনঃ

اصل النكاح العقد ثم استعير للجماع ومحال ان يكون فى الاصل للجماع ثم استعير للعقد-

“নিকাহ শব্দটির আসল অর্থ হচ্ছে বিয়ে, তারপর এ শব্দটিকে রূপক অর্থে সহবাসের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। এটা একবারেই অসম্ভব যে, এর আসল অর্থ হবে সহবাস এবং একে রূপক অর্থে বিয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।”

এর সপক্ষে যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, আরবী ভাষায় বা দুনিয়ার অন্যান্য ভাষায় সহবাস-এর জন্য প্রকৃতপক্ষে যতগুলো শব্দ তৈরী করা হয়েছে তার সবই অশ্লীল। কোন রুচিশীল ব্যক্তি কোন ভদ্র মজলিসে সেগুলো মুখে উচ্চারণ করাও পছন্দ করেন না। এখন যে শব্দটিকে প্রকৃতপক্ষে এ কাজের জন্য তৈরি করা হয়েছে মানুষের সমাজ তাকে বিয়ের জন্য রূপক হিসেবে ব্যবহার করবে, এটা কেমন করে সম্ভব? এ অর্থটি প্রকাশ করার জন্য তো প্রত্যেক ভাষায় রুচিশীল শব্দই ব্যবহার করা হয়, অশ্লীল শব্দ নয়।

কুরআন ও সুন্নাতের ব্যাপারে বলা যায়, সেখানে ‘নিকাহ’ একটি পারিভাষিক শব্দ। সেখানে এর অর্থ হচ্ছে নিছক বিবাহ অথবা বিবাহোত্তর সঙ্গম। কিন্তু বিবাহ বিহীন সঙ্গম অর্থে একে কোথাও ব্যবহার করা হয়নি। এ ধরনের সঙ্গমকে তো কুরআন ও সুন্নাত বিয়ে নয়, যিনা ও ব্যভিচার বলে।

৮৬.
এটি একটি একক আয়াত। সম্ভবত সে সময় তালাকের কোন সমস্যা সৃষ্টি হবার কারণে এটি নাযিল হয়েছিল। তাই পূর্ববর্তী বর্ণনা ও পরবর্তী বর্ণনার ধারাবাহিকতার মধ্যে একে রেখে দেয়া হয়েছে। এ বিন্যাসের ফলে একথা স্বতস্ফূর্তভাবেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এটি পূর্ববর্তী ভাষণের পরে এবং পরবর্তী ভাষণের পূর্বে নাযিল হয়।

এ আয়াত থেকে যে আইনগত বিধান বের হয় তার সার সংক্ষেপ হচ্ছেঃ

একঃ আয়াতে যদিও “মু’মিন নারীরা” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যা থেকে বাহ্যত অনুমান করা যেতে পারে যে, এখানে যে আইনের বর্ণনা দেয়া হয়েছে কিতাবী (ইহুদী ও খৃস্টান) নারীদের ব্যাপারে সে আইন কার্যকর নয়। কিন্তু উম্মাতের সকল উলামা এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, পরোক্ষভাবে কিতাবী নারীদের জন্যও এ একই হুকুম কার্যকার হবে। অর্থাৎ কোন আহলি কিতাব নারীকে যদি কোন মুসলমান বিয়ে করে তাহলে তার তালাক, মহর, ইদ্দত এবং তাকে তালাকের পরে কাপড়-চোপড় দেবার যাবতীয় বিধান একজন মু’মিন নারীকে বিয়ে করার অবস্থায় যা হয়ে থাকে তাই হবে। উলামা এ ব্যাপারে একমত, আল্লাহ‌ এখানে বিশেষভাবে যে কেবলমাত্র মু’মিন নারীদের কথা বলেছেন এর আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে কেবলমাত্র এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা যে, মুসলমানদের জন্য মু’মিন নারীরাই উপযোগী। ইহুদি ও খৃস্টান নারীদেরকে বিয়ে করা অবশ্যই জায়েয কিন্তু তা সঙ্গত ও পছন্দীয় নয়। অন্যকথায় বলা যায়, কুরআনের এ বর্ণনারীতি থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, মু’মিনগণ মু’মিন নারীদেরকে বিয়ে করবে আল্লাহ‌ এটাই চান।

দুইঃ “স্পর্শ করা বা হাত লাগানো।” এর আভিধানিক অর্থ তো হয় নিছক ছুঁয়ে দেয়া। কিন্তু এখানে এ শব্দটি রূপক অর্থে সহবাসের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। এ দিক দিয়ে আয়াতের বাহ্যিক অর্থের দাবী হচ্ছে এই যে, যদি স্বামী সহবাস না করে থাকে, তাহলে সে স্ত্রীর সাথে একান্তে (খালওয়াত) অবস্থান করলেও বরং তার গায়ে হাত লাগালেও এ অবস্থায় তালাক দিলে ইদ্দত অপরিহার্য হবে না। কিন্তু ফকীহগণ সতর্কতামূলকভাবে এ বিধান দিয়েছেন যে, যদি “খালওয়াতে সহীহা” তথা সঠিক অর্থে একান্তে অবস্থান সম্পন্ন হয়ে গিয়ে থাকে (অর্থাৎ যে অবস্থায় স্ত্রী সঙ্গম সম্ভব হয়ে থাকে) তাহলে এরপর তালাক দেয় হলে ইদ্দত অপরিহার্য হবে এবং একমাত্র এমন অবস্থায় ইদ্দত পালন করতে হবে না যখন খালওয়াতের (একান্তে অবস্থান) পূর্বে তালাক দিয়ে দেয়া হবে।

তিনঃ খালওয়াতের পূর্বে তালাক দিলে ইদ্দত নাকচ হয়ে যাবার অর্থ হচ্ছে, এ অবস্থায় পুরুষের রুজু করার অর্থাৎ স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেবার অধিকার খতম হয়ে যায় এবং তালাকের পরপরই যাকে ইচ্ছা বিয়ে করার অধিকার নারীর থাকে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এ বিধান শুধুমাত্র খালওয়াতের পূর্বে তালাক দেবার সাথে সংশ্লিষ্ট। যদি খালওয়াতের পূর্বে স্বামী মারা যায় তাহলে এ অবস্থায় স্বামীর মৃত্যুরপর যে ইদ্দত পালন করতে হয় তা বাতিল হয়ে যাবে না বরং বিবাহিতা স্বামীর সাথে সহবাস করেছে এমন স্ত্রীর জন্য চারমাস দশ দিনের ইদ্দত পালন করা ওয়াজিব হয় তাই তার জন্যও ওয়াজিব হবে। (ইদ্দত বলতে এমন সময়কাল বুঝায় যা অতিবাহিত হবার পূর্বে নারীর জন্য দ্বিতীয় বিবাহ জায়েয নয়)

চারঃ مَا لَكُمْ عَلَيْهِنَّ مِنْ عِدَّةٍ (তোমাদের জন্য তাদের ওপর কোন ইদ্দত অপরিহার্য হবে না।) এ শব্দগুলো একথা প্রকাশ করে যে, ইদ্দত হচ্ছে স্ত্রীর ওপর স্বামীর অধিকার। কিন্তু এর এ অর্থ নয় যে, এটা শুধুমাত্র পুরুষের অধিকার। আসলে এর মধ্যে রয়েছে আরো দু’টি অধিকার। একটি হচ্ছে সন্তানের অধিকার এবং অন্যটি আল্লাহর বা শরীয়াতের অধিকার। পুরুষের অধিকার হচ্ছে এজন্য যে, এ অন্তরবর্তীকালে তার রুজু করার অধিকার থাকে। তাছাড়া আরো এজন্য যে, তার সন্তানের বংশ প্রমাণ ইদ্দত পালনকালে স্ত্রীর গর্ভবতী হওয়া বা না হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার ওপর নির্ভরশীল। সন্তানের অধিকার এর মধ্যে শামিল হবার কারণ হচ্ছে এই যে, পিতা থেকে পুত্রের বংশ-ধারা প্রমাণিত হওয়া তার আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য জরুরী এবং তার নৈতিক মর্যাদাও তার বংশধারা সংশয়িত না হওয়ার ওপর নির্ভরশীল। তারপর এর মধ্যে আল্লাহর অধিকার (বা শরীয়াতের অধিকার) এজন্য শামিল হয়ে যায় যে, যদি লোকদের নিজেদের ও নিজেদের সন্তানদের অধিকারের পরোয়া না-ই বা হয় তবুও আল্লাহর শরীয়াত এ অধিকারগুলোর সংরক্ষণ জরুরী গণ্য করে। এ কারণেই কোন স্বামী যদি স্ত্রীকে একথা লিখে দেয় যে, আমার মৃত্যুর পর অথবা আমার থেকে তালাক নেবার পর তোমার ওপর আমার পক্ষ থেকে কোন ইদ্দত ওয়াজিব হবে না তবুও শরীয়াত কোন অবস্থায়ই তা বাতিল করবে না।

পাঁচঃ فَمَتِّعُوهُنَّ وَسَرِّحُوهُنَّ سَرَاحًا جَمِيلًا (এদেরকে কিছু সম্পদ দিয়ে ভালো মতো বিদায় করে দাও) এ হুকুমটির উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে হবে দু’টি পদ্ধতির মধ্য থেকে কোন একটি পদ্ধতিতে। যদি বিয়ের সময় মহর নির্ধারিত হয়ে থাকে এবং তারপর খালওয়াতের (স্বামী স্ত্রীর একান্ত অবস্থান) পূর্বে তালাক দেয়া হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে এ অবস্থায় অর্ধেক মহর দেয়া ওয়াজিব হয়ে যাবে যেমন সূরা বাকারার ২৩৭ আয়াতে বলা হয়েছে এর বেশী কিছু দেয়া অপরিহার্য নয় কিন্তু মুস্তাহাব। যেমন এটা পছন্দনীয় যে, অর্ধেক মহর দেবার সাথে সাথে বিয়ের কনে সাজাবার জন্য স্বামী তাকে যে কাপড় চোপড় দিয়ে ছিল তা তার কাছে থাকতে দেবে অথবা যদি আরো কিছু জিনিসপত্র বিয়ের সময় তাকে দেয়া হয়ে থাকে তাহলে সেগুলো ফেরত নেয়া হবে না। কিন্তু যদি বিয়ের সময় মহর নির্ধারিত না করা হয়ে থাকে তাহলে এ অবস্থায় স্ত্রীকে কিছু না কিছু দিয়ে বিদায় করে দেয়া ওয়াজিব। আর এ কিছু না কিছু হতে হবে মানুষের মর্যাদা ও সামর্থ্য অনুযায়ী। যেমন সূরা বাকারার ২৩৬ আয়াতে বলা হয়েছে। আলেমগণের একটি দল এ মতের প্রবক্তা যে, মহর নির্ধারিত থাকা বা না থাকা অবস্থায়ও অবশ্যই “মুতা-ই-তালাক” দেয়া ওয়াজিব। (ইসলামী ফিকাহর পরিভাষায় মুতা-ই-তালাক এমন সম্পদকে বলা হয় যা তালাক দিয়ে বিদায় করার সময় নারীকে দেয়া হয়।)

ছয়ঃ ভালোভাবে বিদায় করার অর্থ কেবল “কিছু না কিছু” দিয়ে বিদায় করা নয় বরং একথাও এর অন্তর্ভুক্ত যে, কোন প্রকার অপবাদ না দিয়ে এবং বেইজ্জত না করে ভদ্রভাবে আলাদা হয়ে যাওয়া। কোন ব্যক্তির যদি স্ত্রী পছন্দ না হয় অথবা অন্য কোন অভিযোগ দেখা দেয় যে কারণে সে স্ত্রীকে রাখতে চায় না, তাহলে ভালো লোকদের মতো সে তালাক দিয়ে বিদায় করে দেবে। এমন যেন না হয় যে, সে তার দোষ লোকদের সামনে বলে বেড়াতে থাকবে এবং তার বিরুদ্ধে এমনভাবে অভিযোগের দপ্তর খুলে বসবে যে অন্য কেউ আর তাকে বিয়ে করতে চাইবে না। কুরআনের এ উক্তি থেকে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ হয়ে যায় যে, তালাকের প্রয়োগকে কোন পঞ্চায়েত বা আদালতের অনুমতির সাথে সংশ্লিষ্ট করা আল্লাহর শরীয়াতের জ্ঞান ও কল্যাণনীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কারণ এ অবস্থায় “ভালোভাবে বিদায় দেবার” কোন সম্ভাবনাই থাকে না। বরং স্বামী না চাইলেও অপমান, বেইজ্জতি ও দুর্নামের ঝাক্কি পোহাতে হবেই। তাছাড়া পুরুষের তালাক দেবার ইখতিয়ার কোন পঞ্চায়েত বা আদালতের অনুমতি সাপেক্ষ হবার কোন অবকাশই আয়াতের শব্দাবলীতে নেই। আয়াত একদম স্পষ্টভাবে বিবাহকারী পুরুষকে তালাকের ইখতিয়ার দিচ্ছে এবং তার ওপরই দায়িত্ব আরোপ করছে, সে যদি হাত লাগাবার পূর্বে স্ত্রীকে ত্যাগ করতে চায় তাহলে অবশ্যই অর্ধেক মহর দিয়ে বা নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু সম্পদ দিয়ে তাকে বিদায় করে দেবে। এ থেকে পরিষ্কারভাবে আয়াতের এ উদ্দেশ্য জানা যায় যে, তালাককে খেলায় পরিণত হওয়ার পথ রোধ করার জন্য পুরুষের ওপর আর্থিক দায়িত্বের একটি বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এর ফলে সে নিজের তালাকের ইখতিয়ার ভেবে চিন্তে ব্যবহার করবে এবং পরিবারের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বাইরের কোন হস্তক্ষেপও হতে পারবে না। বরং স্বামী কেন স্ত্রীকে তালাক দিচ্ছে একথা কাউকে বলতে বাধ্য হবার কোন সুযোগই আসবে না।

সাতঃ ইবনে আব্বাস (রা.), সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব, হাসান বাসরী আলী ইবনুল হোসাইন (যয়নুল আবেদীন) ইমাম শাফেঈ ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল আয়াতের “যখন তোমরা বিয়ে করো এবং তারপর তালাক দিয়ে দাও” শব্দাবলী থেকে এ বিধান নির্ণয় করেছেন যে, তালাক তখনই সংঘটিত হবে যখন তার পূর্বে বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে যায়। বিয়ের পূর্বে তালাক কার্যকর হয় না। কাজেই যদি কোন ব্যক্তি বলে, আমি অমুক মেয়েকে বা অমুক গোত্র বা জাতির মেয়েকে অথবা কোন মেয়েকে বিয়ে করলে তাকে তালাক” তাহলে তার এ উক্তি অর্থহীন পেশ করা যায়, রসূলে করীম ﷺ বলেছেনঃ আরবী لاطلاق لابن ادم فى مالا يملك “ইবনে আদম যে জিনিসের মালিক নয় তার ব্যাপারে তালাকের ইখতিয়ার ব্যবহার করার অধিকার তার নেই। আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযি ও ইবনে মাজাহ। তিনি আরো বলেছেনঃ ماطلاق قبل النكاح “বিয়ের পূর্বে কোন তালাক নেই” (ইবনে মাজাহ) কিন্তু ফকীহদের একটি বড় দল বলেন, এ আয়াত ও এ হাদীসগুলো কেবলমাত্র এখনই প্রযুক্ত হবে যখন কোন ব্যক্তি তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়নি এমন কোন মেয়েকে এভাবে বলে, তোমাকে তালাক অথবা আমি তোমাকে তালাক দিলাম। এ উক্তি যদি সে এভাবে বলে, যদি আমি তোমাকে বিয়ে করি তাহলে তোমাকে তালাক”, তাহলে এটা বিয়ে করার পূর্বে তালাক দেয়া নয় বরং আসলে সে এ বিষয়ের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এবং ঘোষণা করছে যে, যখন সেই মেয়েটির সাথে তার বিয়ে হবে তখন তার ওপর তালাক অনুষ্ঠিত হবে। এ উক্তি অর্থহীন, উদ্ভট ও প্রভাবহীন হতে পারে না। বরং যখনই মেয়েটিকে সে বিয়ে করবে তখনই তার ওপর তালাক সংঘটিত হয়ে যাবে। যেসব ফকীহ এ মত অবলম্বন করেছেন তাঁদের মধ্যে আবার এ বিষয়ে মতবিরোধ হয়েছে যে, এ ধরনের তালাকের প্রয়োগ সীমা কতখানি।

ইমাম আবু হানীফা মুহাম্মাদ ও ইমাম যুফার বলেন, কোন ব্যক্তি যদি কোন মেয়ে, কোন জাতি বা কোন গোত্র নির্দেশ করে বলে অথবা উদাহরণস্বরূপ সাধারণ কথায় এভাবে বলে, “যে মেয়েকেই আমি বিয়ে করবো তাকেই তালাক।” তাহলে উভয় অবস্থায়ই তালাক সংঘটিত হয়ে যাবে। আবু বকর জাসসাস এ একই অভিমত হযরত ওমর (রা.), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.), ইবরাহীম নাখাঈ, মুজাহিদ ও উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহেমাহুমুল্লাহ থেকে উদ্ধৃত করেছেন।

সুফিয়ান সওরী ও উসমানুল বাত্তী বলেন, তালাক কেবলমাত্র তখনি হবে যখন বক্তা এভাবে বলবে, “যদি আমি অমুক মেয়েকে বিয়ে করি তাহলে তার ওপর তালাক সংগঠিত হবে।”

হাসান ইবনে সালেহ, লাইস ইবনে সা’দ ও আমেরুশ শা’বী বলেন, এ ধরনের তালাক সাধারণভাবেও সংঘটিত হতে পারে, তবে শর্ত এই যে, এর প্রয়োগক্ষেত্র সুনির্দিষ্ট হতে হবে। যেমন এক ব্যক্তি এভাবে বললোঃ “যদি আমি অমুক পরিবার, অমুক গোত্রে, অমুক শহর, অমুক দেশ বা অমুক জাতির মেয়ে বিয়ে করি, তাহলে তার ওপর তালাক কার্যকর হবে।”

ইবনে আবী লাইলা ও ইমাম মালেক ওপরে উদ্ধৃত মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করে অতিরিক্ত শর্ত আরোপ করেন এবং বলেন, এর মধ্যে সময়-কালও নির্ধারিত হতে হবে। যেমন, যদি এক ব্যক্তি এভাবে বলে, “যদি আমি এ বছর বা আগামী দশ বছরের মধ্যে অমুক মেয়ে বা অমুক দলের মেয়েকে বিয়ে করি, তাহলে তার ওপর তালাক কার্যকর হবে অন্যথায় তালাক হবে না। বরং ইমাম মালেক এর ওপর আরো এতটুকু বৃদ্ধি করেন যে, যদি এ সময়-কাল এতটা দীর্ঘ হয় যার মধ্যে ঐ ব্যক্তির জীবিত থাকার আশা করা যায় না তাহলে তার উক্তি অকার্যকর হয়ে যাবে।

৮৭.
যারা আপত্তি করে বলতো, “মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তো অন্যদের জন্য একই সময় চারজনের বেশী স্ত্রী রাখতে নিষেধ করেন কিন্তু তিনি নিজে পঞ্চম স্ত্রী গ্রহণ করলেন কেমন করে,” এখানে আসলে তাদের জবাব দেয়া হয়েছে। এ আপত্তির ভিত্তি ছিল এরই ওপর যে, হযরত যয়নবকে (রা.) বিয়ে করার সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রী ছিলেন চারজন। এদের একজন ছিলেন হযরত সওদা (রা.)। তাঁকে তিনি বিয়ে করেছিলেন হিজরাতের ৩ বছর আগে। দ্বিতীয় ছিলেন হযরত আয়েশা (রা.) তাঁকেও হিজরাতের ৩ বছর আগে বিয়ে করেছিলেন কিন্তু হিজরী প্রথম বছরের শওয়াল মাসে তিনি স্বামীগৃহে আসেন। তৃতীয় স্ত্রী ছিলেন হযরত হাফসা (রা.) ৩ হিজরীর শাবান মাসে তাঁকে বিয়ে করেন। চতুর্থ স্ত্রী ছিলেন হযরত উম্মে সালামাহ (রা.)। ৪ হিজরীর শওয়াল মাসে নবী করীম ﷺ তাঁকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন। এভাবে হযরত যয়নব (রা.) ছিলেন তাঁর পঞ্চম স্ত্রী। এর বিরুদ্ধে কাফের ও মুনাফিকরা যে আপত্তি জানাচ্ছিল তার জবাব আল্লাহ‌ এভাবে দিচ্ছেনঃ হে নবী! তোমার এ পাঁচজন স্ত্রী, যাদের মহর আদায় করে তুমি বিয়ে করেছো, তাদেরকে আমি তোমার জন্য হালাল করে দিয়েছি। অন্যকথায় এ জবাবের অর্থ হচ্ছে, সাধারণ মুসলমানদের জন্য চার-এর সীমা নির্দেশও আমিই করেছি এবং নিজের নবীকে এ সীমার ঊর্ধ্বেও রেখেছি আমিই। যদি তাদের জন্য সীমা নির্দেশ করার ইখতিয়ার আমার থেকে থাকে, তাহলে নবীকে সীমার ঊর্ধ্বে রাখার ইখতিয়ার আমার থাকবে না কেন?

এ জবাবের ব্যাপারে আবার একথা মনে রাখতে হবে যে, এর সাহায্যে কাফের ও মুনাফিকদেরকে নিশ্চিন্ত করা এর উদ্দেশ্য নয় বরং এমন মুসলমানদেরকে নিশ্চিন্ত করা এর উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম বিরোধীরা যাদের মনে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করার চেষ্টা করছিল। তারা যেহেতু বিশ্বাস করতো, কুরআন আল্লাহর কালাম এবং আল্লাহর নিজের শব্দসহই এ কুরআন নাযিল হয়েছে, তাই কুরআনের একটি সুস্পষ্ট বক্তব্য সম্বলিত আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ‌ এ ঘোষণা দিয়েছেনঃ নবী নিজেই নিজেকে চারজন স্ত্রী রাখার সাধারণ আইনের আওতার বাইরে রাখেননি বরং এ ব্যবস্থা আমিই করেছি।

৮৮.
পঞ্চম স্ত্রীকে নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য হালাল করা ছাড়াও আল্লাহ‌ এ আয়াতে তাঁর জন্য আরো কয়েক ধরনের মহিলাদেরকে বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছেনঃ একঃ আল্লাহ‌ প্রদত্ত বাঁদীদের মধ্য থেকে যারা তাঁর মালিকানাধীন হয়। এ অনুমতি অনুযায়ী তিনি বনী কুরাইযার যুদ্ধবন্দিনীদের মধ্য থেকে হযরত রাইহানাকে (রা.), বনিল মুসতালিকের যুদ্ধবন্দিনীদের মধ্য থেকে হযরত যুওয়াইরাকে (রা.), খয়বরের যুদ্ধবন্দিনীদের মধ্য থেকে হযরত সফীয়াকে (রা.) এবং মিসরের মুকাওকিস প্রেরিত হযরত মারিয়া কিবতিয়াকে (রা.) নিজের জন্য নির্দিষ্ট করে নেন। এদের মধ্য থেকে প্রথমোক্ত তিনজনকে তিনি মুক্তি দান করে তাদেরকে বিয়ে করেন। কিন্তু হযরত মারিয়া কিবতিয়ার (রা.) সাথে মালিকানাধীন হবার ভিত্তিতে সহবাস করেন। তিনি তাকে মুক্তি দিয়ে বিয়ে করেন একথা তার সম্পর্কে প্রমাণিত নয়।

দুইঃ তাঁর চাচাত, মামাত, ফুফাত ও খালাত বোনদের মধ্য থেকে যারা হিজরাতে তাঁর সহযোগী হন। আয়াতে তাঁর সাথে হিজরত করার যে কথা এসেছে তার অর্থ এ নয় যে, হিজরাতের সফরে তাঁর সাথেই থাকতে হবে বরং এর অর্থ ছিল, ইসলামের জন্য তাঁরাও আল্লাহর পথে হিজরত করেন। তাঁর ওপরে উল্লেখিত মুহাজির আত্মীয়দের মধ্য থেকেও যাকে ইচ্ছা তাকে বিয়ে করার ইখতিয়ারও তাঁকে দেয়া হয়। কাজেই এ অনুমতির ভিত্তিতে তিনি ৭ হিজরী সালে হযরত উম্মে হাবীবাকে (রা.) বিয়ে করেন। (পরোক্ষভাবে এ আয়াতে একথা সুস্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে যে, চাচা, মামা, ফুফী ও খালার মেয়েকে বিয়ে করা একজন মুসলমানের জন্য হালাল। এ ব্যাপারে ইসলামী শরীয়াত খৃস্ট ও ইহুদী উভয় ধর্ম থেকে আলাদা। খৃস্টীয় বিধানে এমন মহিলাকে বিয়ে করা অবৈধ যার সাথে সাত পুরুষ পর্যন্ত পুরুষের বংশধারা মিলে যায়। আর ইহুদীদের সমাজে সহোদর ভাইঝি ও ভাগনীকেও বিয়ে করা বৈধ।)

তিনঃ যে মু’মিন নারী নিজেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য ‘হিবা’ তথা দান করে অর্থাৎ মহর ছাড়াই নিজেকে নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করতে তৈরি হয়ে যায় এবং নবী (সা.) তা গ্রহণ করা পছন্দ করেন। এ অনুমতির ভিত্তিতে তিনি ৭ হিজরীর শওয়াল মাসে হযরত মায়মুনাকে (রা.) নিজের সহধর্মিনী রূপে গ্রহণ করেন। কিন্তু মহর ছাড়া তার হিবার সুযোগ নেয়া পছন্দ করেননি। তাই তার কোন আকাঙ্ক্ষা ও দাবী ছাড়াই তাঁকে মহর দান করেন। কোন কোন তাফসীরকার বলেন, নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন হিবাকারিনী স্ত্রী ছিল না। কিন্তু এর অর্থ আসলে হচ্ছে এই যে, তিনি হিবাকারিনী কোন স্ত্রীকেও মহর থেকে বঞ্চিত করেননি।

৮৯.
এ বাক্যটির সস্পর্ক যদি নিকটের বাক্যের সাথে মেনে নেয়া হয়, তাহলে এর অর্থ হবে, অন্য কোন মুসলমানের জন্য কোন মহিলা নিজেকে তার হাতে হিবা করবে এবং সে মহর ছাড়াই তাকে বিয়ে করবে, এটা জায়েয নয়। আর যদি ওপরের সমস্ত ইবারতের সাথে এর সম্পর্ক মেনে নেয়া হয়, তাহলে এর অর্থ হবে, চারটির বেশী বিয়ে করার সুবিধাও একমাত্র নবী করীমের ﷺ জন্যই নির্দিষ্ট, সাধারণ মুসলমানের জন্য নয়। এ আয়াত থেকে একথাও জানা যায় যে, কিছু বিধান নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য নির্দিষ্ট রয়েছে, উম্মাতের অন্য লোকেরা এ ব্যাপারে তাঁর সাথে শরীক নেই। কুরআন ও সুন্নাহর মধ্যে তাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালিয়ে এ ধরনের বহু বিধানের কথা জানা যায়। যেমন নবী করীমের ﷺ জন্য তাহাজ্জুদের নামায ফরয ছিল এবং সমগ্র উম্মাতের জন্য তা নফল। তাঁর ও তাঁর পরিবারবর্গের জন্য সাদকা নেয়া হারাম এবং অন্য কারোর জন্য তা হারাম নয়। তাঁর মীরাস বণ্টন হতে পারতো না কিন্তু অন্য সকলের মীরাস বন্টনের জন্য সূরা নিসায় বিধান দেয়া হয়েছে। তাঁর জন্য চারজনের অধিক স্ত্রী হালাল করা হয়েছে। স্ত্রীদের মধ্যে সমতাপূর্ণ ইনসাফ তাঁর জন্য ওয়াজিব করা হয়নি। নিজেকে হিবাকারী নারীকে মহর ছাড়াই বিয়ে করার অনুমতি তাঁকে দেয়া হয়েছে। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণকে সমগ্র উম্মাতের জন্য হারাম করে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে এমন একটি বিশেষত্ত্বও নেই যা নবী করীম ﷺ ছাড়া অন্য কোন মুসলমানও অর্জন করেছে। মুফাসসিরগণ তাঁর আর একটি বৈশিষ্ট্যও বর্ণনা করেছেন। তা হচ্ছে এই যে, আহলি কিতাবের কোন মহিলাকে বিয়ে করাও তাঁর জন্য নিষিদ্ধ ছিল। অথচ উম্মাতের সবার জন্য তারা হালাল।
৯০.
সাধারণ নিয়ম থেকে মহান আল্লাহ‌ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে আলাদা রেখেছেন তার মধ্যে রয়েছে এ সুবিধা ও কল্যাণ। “যাতে সংকীর্ণতা ও অসুবিধা না থাকে”-এর অর্থ এ নয় যে, নাউযুবিল্লাহ তাঁর প্রবৃত্তির লালসা খুব বেশী বেড়ে গিয়েছিল বলে তাঁকে বহু স্ত্রী রাখার অনুমতি দেয়া হয়, যাতে শুধুমাত্র চারজন স্ত্রীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকতে তিনি সংকীর্ণতা ও অসুবিধা অনুভব না করেন। এ বাক্যাংশের এ অর্থ কেবলমাত্র এমন এক ব্যক্তি গ্রহণ করতে পারে যে বিদ্বেষ ও সংকীর্ণ স্বার্থপ্রীতিতে অন্ধ হয়ে একথা ভুলে যায় যে, মুহাম্মাদ ﷺ ২৫ বছর বয়সে এমন এক মহিলাকে বিয়ে করেন যার বয়স ছিল তখন ৪০ বছর এবং পুরো ২৫ বছর ধরে তিনি তাঁর সাথে অত্যন্ত সুখী দাম্পত্য জীবন যাপন করতে থাকেন। তাঁর ইন্তিকালের পর তিনি অন্য একজন অধিক বয়সের বিগত যৌবনা মহিলা হযরত সওদাকে (রা.) বিয়ে করেন। পুরো চার বছর পর্যন্ত তিনি একাই ছিলের তাঁর স্ত্রী। এখন কোন বুদ্ধিমান বিবেকবান ব্যক্তি একথা কল্পনা করতে পারে যে, ৫৩ বছর পার হয়ে যাবার পর সহসা তাঁর যৌন কামনা বেড়ে যেতে থাকে এবং তাঁর অনেক বেশী সংখ্যক স্ত্রীর প্রয়োজন হয়ে পড়ে? আসলে “সংকীর্ণতা ও অসুবিধা না থাকে”-এর অর্থ অনুধাবন করতে হলে একদিকে নবী করীমের ﷺ ওপর আল্লাহ‌ যে মহান দায়িত্ব অর্পন করেছিলেন তার প্রতি দৃষ্টি রাখা এবং অন্যদিকে যে অবস্থার মধ্যে আল্লাহ‌ তাঁকে এ মহান দায়িত্ব সম্পাদন করার জন্য নিযুক্ত করেছিলেন তা অনুধাবন করা জরুরী। সংকীর্ণ স্বার্থপ্রীতি থেকে মন-মানসিতকাকে মুক্ত করে যে ব্যক্তিই এ দু’টি সত্য অনুধাবন করবেন তিনিই স্ত্রী গ্রহণের ব্যাপারে তাঁকে ব্যাপক অনুমতি দেয়া কেন জরুরী ছিল এবং চারের সীমারেখা নির্দেশের মধ্যে তাঁর জন্য কি সংকীর্ণতা ও অসুবিধা ছিল তা ভালোভাবেই জানতে পারবেন।

নবী করীমকে ﷺ যে কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তা ছিল এই যে, তিনি একটি অসংগঠিত ও অপরিপক্ব জাতিকে, যারা কেবল ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকেই নয় বরং সাধারণ সভ্যতা সংস্কৃতির দৃষ্টিতেও ছিল অগোছালো ও অগঠিত, তাদেরকে জীবনের প্রতিটি বিভাগে শিক্ষা ও অনুশীলনের মাধ্যমে একটি উন্নত পর্যায়ের সুসভ্য, সংস্কৃতিবান ও পরিচ্ছন্ন জাতিতে পরিণত করবেন। এ উদ্দেশ্যে কেবলমাত্র পুরুষদেরকে অনুশীলন দেয়া যথেষ্ট ছিল না বরং মহিলাদের অনুশীলনও সমান জরুরী ছিল। কিন্তু সভ্যতা ও সংস্কৃতির যে মূলনীতি শিখাবার জন্য তিনি নিযুক্ত হয়েছিলেন তার দৃষ্টিতে নারী ও পুরুষের অবাধ মেলামেশা নিষিদ্ধ ছিল এবং এ নিয়ম ভংগ করা ছাড়া তাঁর পক্ষে মহিলাদেরকে সরাসরি অনুশীলন দান করা সম্ভবপর ছিল না। তাই মহিলাদের মধ্যে কাজ করার কেবলমাত্র একটি পথই তাঁর জন্য খোলা ছিল এবং সেটি হচ্ছে, বিভিন্ন বয়সের ও বিভিন্ন বৃদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা সম্পন্ন মহিলাদেরকে তিনি বিয়ে করতেন, নিজে সরাসরি তাদেরকে অনুশীলন দান করে তার নিজের সাহায্য সহায়তার জন্য প্রস্তুত করতেন এবং তারপর তাদের সাহায্যে নগরবাসী ও মরুচারী এবং যুবতী, পৌঢ় ও বৃদ্ধা সব ধরনের নারীদেরকে দ্বীন, নৈতিকতা ও কৃষ্টি সংস্কৃতির নতুন নীতিসমূহ শিখাবার ব্যবস্থা করতেন।

এছাড়াও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পুরাতন জাহেলী জীবন ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে তার জায়গায় কার্যত ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্বও দেয়া হয়েছিল। এ দায়িত্ব সম্পাদন করার জন্য জাহেলী জীবন ব্যবস্থার প্রবক্তা ও পতাকাবাহীদের সাথে যুদ্ধ অপরিহার্য ছিল। এ সংঘাত এমন একটি দেশে শুরু হতে যাচ্ছিল যেখানে গোত্রীয় জীবনধারা নিজের বিশেষ বিশেষ সাংস্কৃতিক অবয়বে প্রচলিত ছিল। এ অবস্থায় অন্যান্য ব্যবস্থার সাথে বিভিন্ন পরিবারে বিয়ে করে বহুবিধ বন্ধুত্বকে পাকাপোক্ত এবং বহুতর শত্রুতাকে খতম করার ব্যবস্থা করা তাঁর জন্য জরুরী ছিল। তাই যেসব মহিলাকে তিনি বিয়ে করেন তাঁদের ব্যক্তিগত গুণাবলী ছাড়াও তাঁদের নির্বাচনের ক্ষেত্রে এসব বিষয়ও কমবেশী জড়িত ছিল। হযরত আয়েশা (রা.) ও হযরত হাফসাকে (রা.) বিয়ে করে তিনি হযরত আবুবকর (রা.) ও হযরত উমরের (রা.) সাথে নিজের সম্পর্ককে আরো বেশী গভীর ও মজবুত করে নেন। হযরত উম্মে সালামাহ (রা.) ছিলেন এমন এক পরিবারের মেয়ে যার সাথে ছিল আবু জেহেল ও খালেদ ইবনে ওলিদের সম্পর্ক। হযরত উম্মে হাবীবা (রা.) ছিলেন আবু সুফিয়ানের মেয়ে। এ বিয়েগুলো সংশ্লিষ্ট পরিবার গুলোর শত্রুতার জের অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। বরং হযরত উম্মে হাবীবার সাথে নবী করীমের ﷺ বিয়ে হবার পর আবু সুফিয়ান আর কখনো তাঁর মোকাবিলায় অস্ত্র ধরেননি। হযরত সুফিয়া (রা.), হযরত জুওয়াইরিয়া (রা.) ও হযরত রাইহানা (রা.) ইহুদি পরিবারের মেয়ে ছিলেন। তাঁদেরকে মুক্ত করে দিয়ে যখন নবী করীম (রা.) তাঁদেরকে বিয়ে করেন তখন তাঁর বিরুদ্ধে ইহুদিদের তৎপরতা স্তিমিত হয়ে পড়ে। কারণ সে যুগের আরবীয় নীতি অনুযায়ী যে ব্যক্তির সাথে কোন গোত্রের মেয়ের বিয়ে হতো তাকে কেবল মেয়েটির পরিবারেরই নয় বরং সমগ্র গোত্রের জামাতা মনে করা হতো এবং জামাতার সাথে যুদ্ধ করা ছিল বড়ই লজ্জাকর।

সমাজের কার্যকর সংশোধন এবং তার জাহেলী রসম রেওয়াজ নির্মূল করাও তাঁর নবুওয়াতের অন্যতম দায়িত্ব ছিল। কাজেই এ উদ্দেশ্যেও তাঁকে একটি বিয়ে করতে হয়। সূরা আহযাবে এ বিষয়টির বিস্তারিত আলোচনা হয়ে গেছে।

এসব বিষয় বিয়ের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য কোন রকম সংকীর্ণতা ও অসুবিধা না রাখার তাগাদা করছিল। এর ফলে যে মহান দায়িত্ব তাঁর প্রতি অর্পিত হয়েছিল তার প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে তিনি প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিয়ে করতে পারতেন।

যারা মনে করেন একাধিক বিয়ে কেবলমাত্র কয়েকটি বিশেষ ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই বৈধ এবং সেগুলো ছাড়া তা বৈধ হবার পেছনে অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে না, এ বর্ণনা থেকে তাদের চিন্তার বিভ্রান্তিও সুস্পষ্ট হয়ে যায়। একথা সুস্পষ্ট যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একাধিক বিয়ে করার পেছনে তা স্ত্রীর রুগ্নতা, বন্ধ্যাত্ব বা সন্তানহীনতা অথবা এতিম প্রতিপালনের সমস্যা ছিল না। এসব সীমাবদ্ধ ব্যক্তিগত প্রয়োজন ছাড়া তিনি সমস্ত বিয়ে করেন প্রচার ও শিক্ষামূলক প্রয়োজনে অথবা সমাজ সংস্কারার্থে কিংবা রাজনৈতিক ও সামাজিক উদ্দেশ্যে। প্রশ্ন হচ্ছে, যখন আজ হাতেগোনা যে কয়টি বিশেষ উদ্দেশ্যের কথা বলা হচ্ছে আল্লাহ‌ নিজেই সেগুলোর জন্য একাধিক বিয়েকে সীমাবদ্ধ করে রাখেননি এবং আল্লাহর রসূল এগুলো ছাড়া অন্যান্য বহু উদ্দেশ্যে একাধিক বিয়ে করেছেন তখন অন্য ব্যক্তি আইনের মধ্যে নিজের পক্ষ থেকে কতিপয় শর্ত ও বিধি-নিষেধ আরোপ করার এবং সে শরীয়াত অনুযায়ী এ নির্ধারণ করছে বলে দাবী করার কী অধিকার রাখে? আসলে একাধিক বিয়ে মূলতই একটি অপকর্ম, এই পাশ্চত্য ধারণাটি উক্ত সীমা নির্ধারণের মূলে কাজ করছে। উক্ত ধারণার ভিত্তিতে এ মতবাদেরও জন্ম হয়েছে যে, এ হারাম কাজটি যদি কখনো হালাল হয়েও যায় তাহলে তা কেবলমাত্র অপরিহার্য প্রয়োজনের জন্যই হতে পারে। এখন এ বাইর থেকে আমদানী করা চিন্তার ওপর ইসলামের জাল ছাপ লাগাবার যতই চেষ্টা করা হোক না কেন কুরআন ও সুন্নাহ এবং সমগ্র উম্মাতে মুসলিমার সাহিত্য এর সাথে মোটেই পরিচিত নয়।

.
অনুবাদ: