আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১
আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২
আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২
আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩
আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭
আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১
আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০
আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭
আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০
আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২
আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫
হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২
ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২
আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮
বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪
আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫
আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮
আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০
আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫
আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫
আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০
আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭
ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১
আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬
ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭
আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০
আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯
আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২
আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০
আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬
অনুগ্রহের ভাব প্রকাশ করার জন্য মূলে সালাত (يصلى-صلوة) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। “সালাত” শব্দটি যখন আরো (على) অব্যয় সহকারে আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাদের জন্য ব্যবহার করা হয় তখন এর অর্থ হয় রহমত, অনুগ্রহ, করুণা ও স্নেহশীষ। আর যখন এটি ফেরেশতাদের পক্ষ থেকে মানুষের জন্য ব্যবহৃত হয় তখন এর অর্থ হয় রহমতের দোয়া করা। অর্থাৎ ফেরেশতারা আল্লাহর কাছে মানুষের জন্য এই মর্মে দোয়া করে যে, হে আল্লাহ, তুমি এদের প্রতি অনুগ্রহ করো এবং তোমার দানে এদেরকে আপ্লুত করে দাও। এভাবে يُصَلِّي عَلَيْكُمْ এর অর্থ এও হয় যে, يشيع عنكم الذكر الجميل فى عباد الله অর্থাৎ আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে তোমাদেরকে খ্যাতি দান করেন এবং এমন পর্যায়ে উন্নীত করেন যার ফলে আল্লাহর সমুদয় সৃষ্টি তোমাদের প্রশংসা করতে থাকে এবং ফেরেশতারা তোমাদের প্রশংসা ও সুনামের আলোচনা করতে থাকে।
سَلَامٌ قَوْلًا مِنْ رَبٍّ رَحِيمٍ
দুই, ফেরেশতারা তাদেরকে সালাম করবে। যেমন সূরা নাহলে বলা হয়েছেঃ
الَّذِينَ تَتَوَفَّاهُمُ الْمَلَائِكَةُ طَيِّبِينَ يَقُولُونَ سَلَامٌ عَلَيْكُمُ ادْخُلُوا الْجَنَّةَ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
“ফেরেশতারা যাদের রূহ কবয করবে এমন অবস্থায় যখন তারা পবিত্র লোক ছিল, তাদেরকে তারা বলবে, শান্তি ও নিরাপত্তা হোক তোমাদের প্রতি, প্রবেশ করো জান্নাতে তোমাদের সৎকাজসমূহের বদৌলতে, যা তোমরা দুনিয়ায় করতে।”
(৩২ আয়াত)
তিন, তারা নিজেরাই পরস্পরকে সালাম করবে। সূরা ইউনুসে বলা হয়েছেঃ
دَعْوَاهُمْ فِيهَا سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَتَحِيَّتُهُمْ فِيهَا سَلَامٌ وَآخِرُ دَعْوَاهُمْ أَنِ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
“সেখানে তাদের আওয়াজ হবে, হে আল্লাহ! পবিত্র তোমার সত্তা, তাদের অভ্যর্থনা হবে ‘সালাম’ এবং তাদের কথা শেষ হবে এ বাক্য দিয়ে যে, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রব্বুল আলামিনের জন্যই।” (১০ আয়াত)
একঃ মৌখিক সাক্ষ্যদান। অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীন যেসব সত্য ও মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত নবী তার সত্যতার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে যাবেন এবং দুনিয়াবাসীকে পরিষ্কার বলে দেবেন, এটিই সত্য এবং এর বিরুদ্ধে যা কিছু আছে সবই মিথ্যা। আল্লাহর অস্তিত্ব ও তাঁর একত্ব, ফেরেশতাদের অস্তিত্ব, অহী নাযিল হওয়া, মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অনিবার্যতা এবং জান্নাত ও জাহান্নামের প্রকাশ, দুনিয়া বাসীদের কাছে যতই অদ্ভূত মনে হোক না কেন এবং তারা একথাগুলোর বক্তাকে যতই বিদ্রূপ করুক বা তাকে পাগল বলুক না কেন, নবী কারো পরোয়া না করেই দাঁড়িয়ে যাবেন এবং সোচ্চার কন্ঠে বলে দেবেন, এসব কিছুই সত্য এবং যারা এসব মানে না তারা পথভ্রষ্ট। এভাবে নৈতিকতা ও সভ্যতা-সংস্কৃতির যে ধারণা, মূল্যবোধ, মূলনীতি ও বিধান আল্লাহ তাঁর সামনে সুস্পষ্ট করেছেন সেগুলোকে সারা দুনিয়ার মানুষ মিথ্যা বললেও এবং তারা তার বিপরীত পথে চললেও নবীর কাজ হচ্ছে সেগুলোকেই প্রকাশ্য জনসম্মুখে পেশ করবেন এবং দুনিয়ায় প্রচলিত তার বিরোধী যাবতীয় পদ্ধতিকে ভ্রান্ত ঘোষণা করবেন। অনুরূপভাবে আল্লাহর শরীয়াতে যা কিছু হালাল সারা দুনিয়া তাকে হারাম মনে করলেও নবী তাকে হালালই বলবেন। আর আল্লাহর শরীয়াতে যা হারাম সারা দুনিয়া তাকে হালাল ও ভালো গণ্য করলেও নবী তাকে হারামই বলবেন।
দুইঃ কর্মের সাক্ষ্য। অর্থাৎ দুনিয়ার সামনে যে মতবাদ পেশ করার জন্য নবীর আবির্ভাব হয়েছে তিনি নিজের জীবনের সমগ্র কার্মকান্ডের মাধ্যমে তার প্রদর্শনী করবেন। যে জিনিসকে তিনি মন্দ বলেন তাঁর জীবন তার সকল প্রকার গন্ধমুক্ত হবে। যে জিনিসকে তিনি ভালো বলেন তাঁর চরিত্রে তা পূর্ণমাত্রায় দেদীপ্যমান হবে। যে জিনিসকে তিনি ফরয বলেন তা পালন করার ক্ষেত্রে তিনি সবচেয়ে অগ্রণী হবেন। যে জিনিসকে তিনি গোনাহ বলেন তা থেকে দূরে থাকার ব্যাপারে কেউ তাঁর সমান হবে না। যে জীবন বিধানকে তিনি আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান বলেন তাকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে তিনি কোন প্রচেষ্টার ত্রুটি করবেন না। তিনি নিজের দাওয়াতে ব্যাপারে কতটা সত্যনিষ্ঠ ও আন্তরিকতা তাঁর নিজের চরিত্র ও কার্যধারাই সাক্ষ্য দেবে। তাঁর সত্তা তাঁর শিক্ষার এমন মূর্তিমান আদর্শ হবে, যা দেখে প্রত্যেক ব্যক্তি জানবে, যে দ্বীনের দিকে তিনি দুনিয়াবাসীকে আহবান জানাচ্ছেন তা কোন্ মানের মানুষ তৈরি করতে চায়, কোন্ ধরনের চরিত্র সৃষ্টি তার লক্ষ্য এবং তার সাহায্যে সে কোন্ ধরনের জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা করে।
তিনঃ পরকালীন সাক্ষ্য। অর্থাৎ আখেরাতে যখন আল্লাহর আদালত প্রতিষ্ঠিত হবে তখন নবী এ মর্মে সাক্ষ্য দেবেন, তাঁকে যে পয়গাম দেয়া হয়েছিল তা তিনি কোন প্রকার কাটছাঁট ও কমবেশী না করে হুবহু মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের সামনে নিজের কথা ও কর্মের মাধ্যমে সত্যকে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরার ব্যাপারে সামান্যতম ত্রুটি করেননি। এ সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তাঁর বাণী মান্যকারী কি পুরস্কার পাবে এবং অমান্যকারী কোন্ ধরনের শাস্তির অধিকারী হবে তার ফায়সালা করা হবে।
এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে, নবী ﷺ কে সাক্ষ্যদানের পর্যায়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে আল্লাহ তাঁর প্রতি কত বড় দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন এবং এত উচ্চ স্থানে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য কত মহান ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন। একথা স্পষ্ট, কথা ও কর্মের মাধ্যমে আল্লাহর সত্য দ্বীনের সাক্ষ্য প্রদান করার ক্ষেত্রে নবী ﷺ এর তিল পরিমাণও ত্রুটি হয়নি। তবেই তো তিনি আখেরাতে এই মর্মে সাক্ষ্য দিতে পারবেন, “আমি লোকদের সামনে সত্যকে পুরোপুরি সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছিলাম।” আর তবেই তো আল্লাহর প্রমাণ (হুজ্জাত) লোকদের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। অন্যথায় যদি সাক্ষ্য দেবার ব্যাপারে এখানে নাউযুবিল্লাহ তাঁর কোন ত্রুটি থেকে যায়, তাহলে না তিনি আখেরাতে তাদের জন্য সাক্ষী হতে পারবেন আর না সত্য অমান্যকারীদের অপরাধ সত্য প্রমাণিত হতে পারবে।
কেউ কেউ এ সাক্ষ্যদানকে এ অর্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন যে, নবী ﷺ আখেরাতে লোকদের কাজের ওপর সাক্ষ্য দেবেন এবং এ থেকে তারা একথা প্রমাণ করেন যে, নবী করীম ﷺ সকল মানুষের কার্যক্রম দেখছেন অন্যথায় না দেখে কেমন করে সাক্ষ্য দিতে পারবেন? কিন্তু কুরআন মজীদের দৃষ্টিতে এ ব্যাখ্যা একবারেই ভ্রান্ত। কুরআন আমাদের বলে, লোকদের কার্যক্রমের ওপর সাক্ষ্য কায়েম করার জন্য তো আল্লাহ অন্য একটি ব্যবস্থা করেছেন। এ উদ্দেশ্যে তাঁর ফেরেশতারা প্রত্যেক ব্যক্তির আমলনামা তৈরি করছে। (দেখুন সূরা কাফ ১৭-১৮ আয়াত এবং আল কাহ্ফ ১৪৯ আয়াত) আর এজন্য তিনি মানুষের নিজের অংগ-প্রত্যংগেরও সাক্ষ্য নেবেন। (সূরা ইয়াসীন, ৬৫; হা মীম আস্ সাজদাহ, ২০-২১) বাকী রইলো নবীগণের ব্যাপার। আসলে নবীগণের কাজ বান্দাদের কার্যক্রমের ওপর সাক্ষ্য দেয়া নয় বরং বান্দাদের কাছে যে সত্য পৌঁছিয়ে দেয়া হয়েছিল, সে বিষয়ে তারা সাক্ষ্য দেবেন। কুরআন পরিষ্কার বলেঃ
يَوْمَ يَجْمَعُ اللَّهُ الرُّسُلَ فَيَقُولُ مَاذَا أُجِبْتُمْ قَالُوا لَا عِلْمَ لَنَا إِنَّكَ أَنْتَ عَلَّامُ الْغُيُوبِ
“যেদিন আল্লাহ সমস্ত রসূলকে সমবেত করবেন তারপর জিজ্ঞেস করবেন; তোমাদের দাওয়াতের কি জবাব দেয়া হয়েছিল? তখন তারা বলবে, আমাদের কিছুই জানা নেই। সমস্ত অজ্ঞাত ও অজানা কথাতো একমাত্র তুমিই জানো।’ (আল মা-য়েদাহ, ১০৯)আর এ প্রসঙ্গে হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে কুরআন বলে, যখন তাঁকে ঈসায়ীদের গোমরাহী সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে তখন তিনি বলবেনঃ
وَكُنْتُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا مَا دُمْتُ فِيهِمْ فَلَمَّا تَوَفَّيْتَنِي كُنْتَ أَنْتَ الرَّقِيبَ عَلَيْهِمْ
“আমি যতদিন তাদের মধ্যে ছিলাম ততদিন পর্যন্ত তাদের ওপর সাক্ষী ছিলাম। যখন আপনি আমাকে উঠিয়ে নিয়েছেন তখন আপনিই তাদের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন।” (আল মা-য়েদাহ, ১১৭)
নবীগন যে মানুষের কাজের ব্যাপারে সাক্ষী হবেন না এ সম্পর্কে এ আয়াতটি একেবারেই সুস্পষ্ট। তাহলে তাঁরা সাক্ষী হবেন কোন্ জিনিসের? এর পরিষ্কার জবাব কুরআন এভাবে দিয়েছেঃ
وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا
“আর হে মুসলমানগণ! এভাবে আমি তোমাদেরকে করেছি একটি মধ্যপন্থী উম্মাত, যাতে তোমরা লোকদের ওপর সাক্ষী হবে এবং রসূল তোমাদের ওপর সাক্ষী হন।” (আল বাকারাহ, ১৪৩)
وَيَوْمَ نَبْعَثُ فِي كُلِّ أُمَّةٍ شَهِيدًا عَلَيْهِمْ مِنْ أَنْفُسِهِمْ وَجِئْنَا بِكَ شَهِيدًا عَلَى هَؤُلَاءِ
“আর যেদিন আমি প্রত্যেক উম্মাতের মধ্যে তাদেরই মধ্য থেকে একজন সাক্ষী উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে দেবো, যে তাদের ওপর সাক্ষ্য দেবে এবং (হে মুহাম্মাদ) তোমাকে এদের ওপর সাক্ষী হিসেবে নিয়ে আসবো।” (আন নাহল, ৮৯)
এ থেকে জানা যায়, কিয়ামতের দিন নবী ﷺ এর উম্মাতকে এবং প্রত্যেক উম্মাতের ওপর সাক্ষ্যদানকারী সাক্ষীদেরকে যে ধরনের সাক্ষ্যদান করার জন্য ডাকা হবে নবী ﷺ এর সাক্ষ্য তা থেকে ভিন্ন ধরনের হবে না। একথা সুস্পষ্ট যে, এটা যদি কার্যাবলীর সাক্ষ্যদান হয়ে থাকে, তাহলে সে সবের উপস্থিত ও দৃশ্যমান হওয়াও অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। আর মানুষের কাছে তার স্রষ্টার পয়গাম পৌঁছে গিয়েছিল কিনা কেবল এ বিষয়ের সাক্ষ্য দেয়ার জন্য যদি এ সাক্ষীদেরকে ডাকা হয়, তাহলে অবশ্যই নবী করীমকেও ﷺ এ উদ্দেশ্যেই পেশ করা হবে। বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও ইমাম আহমাদ প্রমুখগণ আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আবুদ দারদা, আনাস ইবনে মালেক ও অন্যান্য বহু সাহাবা থেকে যে হাদীসগুলো উদ্ধৃত করেছেন সেগুলোও এ বিষয়বস্তুর সমর্থক। সেগুলোর সম্মিলিত বিষয়বস্তু হচ্ছেঃ নবী ﷺ কিয়ামতের দিন দেখবেন তাঁর কিছু সাহাবীকে আনা হচ্ছে কিন্তু তারা তাঁর দিকে না এসে অন্যদিকে যাচ্ছে অথবা তাদেরকে ধাক্কা দিয়ে অন্য দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। নবী করীম ﷺ তাদেরকে দেখে নিবেদন করবেন, হে আল্লাহ! এরা তো আমার সাহাবী। একথায় আল্লাহ বলবেন, তুমি জানো না তোমার পর এরা কি সব কাজ করেছে। এ বিষয়বস্তুটি এত বিপুল সংখ্যক সাহাবী থেকে এত বিপুল সংখ্যক সনদ সহকারে বর্ণিত হয়েছে যে, এর নির্ভুলতায় সন্দেহ পোষণ করার কোন অবকাশ নেই। আর এ থেকে একথাও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, নবী ﷺ নিজের উম্মাতের প্রত্যেক ব্যক্তির এবং তার প্রত্যেকটি কাজের দর্শক মোটেই নন। তবে যে হাদীসে বলা হয়েছে যে, নবী (সা.) এর সামনে তাঁর উম্মাতের কার্যাবলী পেশ করা হয়ে থাকে সেটি কোনক্রমেই এর সাথে সংঘর্ষশীল নয়। কারণ তার মূল বক্তব্য শুধুমাত্র এতটুকু যে, মহান আল্লাহ নবী করীমকে ﷺ তাঁর উম্মাতের কার্যাবলী সম্পর্কে অবহিত রাখেন। তার এ অর্থ কোথা থেকে পাওয়া যায় যে, তিনি প্রত্যেক ব্যক্তির কার্যকলাপ চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করছেন?
اصل النكاح العقد ثم استعير للجماع ومحال ان يكون فى الاصل للجماع ثم استعير للعقد-
“নিকাহ শব্দটির আসল অর্থ হচ্ছে বিয়ে, তারপর এ শব্দটিকে রূপক অর্থে সহবাসের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। এটা একবারেই অসম্ভব যে, এর আসল অর্থ হবে সহবাস এবং একে রূপক অর্থে বিয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।”
এর সপক্ষে যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, আরবী ভাষায় বা দুনিয়ার অন্যান্য ভাষায় সহবাস-এর জন্য প্রকৃতপক্ষে যতগুলো শব্দ তৈরী করা হয়েছে তার সবই অশ্লীল। কোন রুচিশীল ব্যক্তি কোন ভদ্র মজলিসে সেগুলো মুখে উচ্চারণ করাও পছন্দ করেন না। এখন যে শব্দটিকে প্রকৃতপক্ষে এ কাজের জন্য তৈরি করা হয়েছে মানুষের সমাজ তাকে বিয়ের জন্য রূপক হিসেবে ব্যবহার করবে, এটা কেমন করে সম্ভব? এ অর্থটি প্রকাশ করার জন্য তো প্রত্যেক ভাষায় রুচিশীল শব্দই ব্যবহার করা হয়, অশ্লীল শব্দ নয়।
কুরআন ও সুন্নাতের ব্যাপারে বলা যায়, সেখানে ‘নিকাহ’ একটি পারিভাষিক শব্দ। সেখানে এর অর্থ হচ্ছে নিছক বিবাহ অথবা বিবাহোত্তর সঙ্গম। কিন্তু বিবাহ বিহীন সঙ্গম অর্থে একে কোথাও ব্যবহার করা হয়নি। এ ধরনের সঙ্গমকে তো কুরআন ও সুন্নাত বিয়ে নয়, যিনা ও ব্যভিচার বলে।
এ আয়াত থেকে যে আইনগত বিধান বের হয় তার সার সংক্ষেপ হচ্ছেঃ
একঃ আয়াতে যদিও “মু’মিন নারীরা” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যা থেকে বাহ্যত অনুমান করা যেতে পারে যে, এখানে যে আইনের বর্ণনা দেয়া হয়েছে কিতাবী (ইহুদী ও খৃস্টান) নারীদের ব্যাপারে সে আইন কার্যকর নয়। কিন্তু উম্মাতের সকল উলামা এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, পরোক্ষভাবে কিতাবী নারীদের জন্যও এ একই হুকুম কার্যকার হবে। অর্থাৎ কোন আহলি কিতাব নারীকে যদি কোন মুসলমান বিয়ে করে তাহলে তার তালাক, মহর, ইদ্দত এবং তাকে তালাকের পরে কাপড়-চোপড় দেবার যাবতীয় বিধান একজন মু’মিন নারীকে বিয়ে করার অবস্থায় যা হয়ে থাকে তাই হবে। উলামা এ ব্যাপারে একমত, আল্লাহ এখানে বিশেষভাবে যে কেবলমাত্র মু’মিন নারীদের কথা বলেছেন এর আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে কেবলমাত্র এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা যে, মুসলমানদের জন্য মু’মিন নারীরাই উপযোগী। ইহুদি ও খৃস্টান নারীদেরকে বিয়ে করা অবশ্যই জায়েয কিন্তু তা সঙ্গত ও পছন্দীয় নয়। অন্যকথায় বলা যায়, কুরআনের এ বর্ণনারীতি থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, মু’মিনগণ মু’মিন নারীদেরকে বিয়ে করবে আল্লাহ এটাই চান।
দুইঃ “স্পর্শ করা বা হাত লাগানো।” এর আভিধানিক অর্থ তো হয় নিছক ছুঁয়ে দেয়া। কিন্তু এখানে এ শব্দটি রূপক অর্থে সহবাসের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। এ দিক দিয়ে আয়াতের বাহ্যিক অর্থের দাবী হচ্ছে এই যে, যদি স্বামী সহবাস না করে থাকে, তাহলে সে স্ত্রীর সাথে একান্তে (খালওয়াত) অবস্থান করলেও বরং তার গায়ে হাত লাগালেও এ অবস্থায় তালাক দিলে ইদ্দত অপরিহার্য হবে না। কিন্তু ফকীহগণ সতর্কতামূলকভাবে এ বিধান দিয়েছেন যে, যদি “খালওয়াতে সহীহা” তথা সঠিক অর্থে একান্তে অবস্থান সম্পন্ন হয়ে গিয়ে থাকে (অর্থাৎ যে অবস্থায় স্ত্রী সঙ্গম সম্ভব হয়ে থাকে) তাহলে এরপর তালাক দেয় হলে ইদ্দত অপরিহার্য হবে এবং একমাত্র এমন অবস্থায় ইদ্দত পালন করতে হবে না যখন খালওয়াতের (একান্তে অবস্থান) পূর্বে তালাক দিয়ে দেয়া হবে।
তিনঃ খালওয়াতের পূর্বে তালাক দিলে ইদ্দত নাকচ হয়ে যাবার অর্থ হচ্ছে, এ অবস্থায় পুরুষের রুজু করার অর্থাৎ স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেবার অধিকার খতম হয়ে যায় এবং তালাকের পরপরই যাকে ইচ্ছা বিয়ে করার অধিকার নারীর থাকে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এ বিধান শুধুমাত্র খালওয়াতের পূর্বে তালাক দেবার সাথে সংশ্লিষ্ট। যদি খালওয়াতের পূর্বে স্বামী মারা যায় তাহলে এ অবস্থায় স্বামীর মৃত্যুরপর যে ইদ্দত পালন করতে হয় তা বাতিল হয়ে যাবে না বরং বিবাহিতা স্বামীর সাথে সহবাস করেছে এমন স্ত্রীর জন্য চারমাস দশ দিনের ইদ্দত পালন করা ওয়াজিব হয় তাই তার জন্যও ওয়াজিব হবে। (ইদ্দত বলতে এমন সময়কাল বুঝায় যা অতিবাহিত হবার পূর্বে নারীর জন্য দ্বিতীয় বিবাহ জায়েয নয়)
চারঃ مَا لَكُمْ عَلَيْهِنَّ مِنْ عِدَّةٍ (তোমাদের জন্য তাদের ওপর কোন ইদ্দত অপরিহার্য হবে না।) এ শব্দগুলো একথা প্রকাশ করে যে, ইদ্দত হচ্ছে স্ত্রীর ওপর স্বামীর অধিকার। কিন্তু এর এ অর্থ নয় যে, এটা শুধুমাত্র পুরুষের অধিকার। আসলে এর মধ্যে রয়েছে আরো দু’টি অধিকার। একটি হচ্ছে সন্তানের অধিকার এবং অন্যটি আল্লাহর বা শরীয়াতের অধিকার। পুরুষের অধিকার হচ্ছে এজন্য যে, এ অন্তরবর্তীকালে তার রুজু করার অধিকার থাকে। তাছাড়া আরো এজন্য যে, তার সন্তানের বংশ প্রমাণ ইদ্দত পালনকালে স্ত্রীর গর্ভবতী হওয়া বা না হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার ওপর নির্ভরশীল। সন্তানের অধিকার এর মধ্যে শামিল হবার কারণ হচ্ছে এই যে, পিতা থেকে পুত্রের বংশ-ধারা প্রমাণিত হওয়া তার আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য জরুরী এবং তার নৈতিক মর্যাদাও তার বংশধারা সংশয়িত না হওয়ার ওপর নির্ভরশীল। তারপর এর মধ্যে আল্লাহর অধিকার (বা শরীয়াতের অধিকার) এজন্য শামিল হয়ে যায় যে, যদি লোকদের নিজেদের ও নিজেদের সন্তানদের অধিকারের পরোয়া না-ই বা হয় তবুও আল্লাহর শরীয়াত এ অধিকারগুলোর সংরক্ষণ জরুরী গণ্য করে। এ কারণেই কোন স্বামী যদি স্ত্রীকে একথা লিখে দেয় যে, আমার মৃত্যুর পর অথবা আমার থেকে তালাক নেবার পর তোমার ওপর আমার পক্ষ থেকে কোন ইদ্দত ওয়াজিব হবে না তবুও শরীয়াত কোন অবস্থায়ই তা বাতিল করবে না।
পাঁচঃ فَمَتِّعُوهُنَّ وَسَرِّحُوهُنَّ سَرَاحًا جَمِيلًا (এদেরকে কিছু সম্পদ দিয়ে ভালো মতো বিদায় করে দাও) এ হুকুমটির উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে হবে দু’টি পদ্ধতির মধ্য থেকে কোন একটি পদ্ধতিতে। যদি বিয়ের সময় মহর নির্ধারিত হয়ে থাকে এবং তারপর খালওয়াতের (স্বামী স্ত্রীর একান্ত অবস্থান) পূর্বে তালাক দেয়া হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে এ অবস্থায় অর্ধেক মহর দেয়া ওয়াজিব হয়ে যাবে যেমন সূরা বাকারার ২৩৭ আয়াতে বলা হয়েছে এর বেশী কিছু দেয়া অপরিহার্য নয় কিন্তু মুস্তাহাব। যেমন এটা পছন্দনীয় যে, অর্ধেক মহর দেবার সাথে সাথে বিয়ের কনে সাজাবার জন্য স্বামী তাকে যে কাপড় চোপড় দিয়ে ছিল তা তার কাছে থাকতে দেবে অথবা যদি আরো কিছু জিনিসপত্র বিয়ের সময় তাকে দেয়া হয়ে থাকে তাহলে সেগুলো ফেরত নেয়া হবে না। কিন্তু যদি বিয়ের সময় মহর নির্ধারিত না করা হয়ে থাকে তাহলে এ অবস্থায় স্ত্রীকে কিছু না কিছু দিয়ে বিদায় করে দেয়া ওয়াজিব। আর এ কিছু না কিছু হতে হবে মানুষের মর্যাদা ও সামর্থ্য অনুযায়ী। যেমন সূরা বাকারার ২৩৬ আয়াতে বলা হয়েছে। আলেমগণের একটি দল এ মতের প্রবক্তা যে, মহর নির্ধারিত থাকা বা না থাকা অবস্থায়ও অবশ্যই “মুতা-ই-তালাক” দেয়া ওয়াজিব। (ইসলামী ফিকাহর পরিভাষায় মুতা-ই-তালাক এমন সম্পদকে বলা হয় যা তালাক দিয়ে বিদায় করার সময় নারীকে দেয়া হয়।)
ছয়ঃ ভালোভাবে বিদায় করার অর্থ কেবল “কিছু না কিছু” দিয়ে বিদায় করা নয় বরং একথাও এর অন্তর্ভুক্ত যে, কোন প্রকার অপবাদ না দিয়ে এবং বেইজ্জত না করে ভদ্রভাবে আলাদা হয়ে যাওয়া। কোন ব্যক্তির যদি স্ত্রী পছন্দ না হয় অথবা অন্য কোন অভিযোগ দেখা দেয় যে কারণে সে স্ত্রীকে রাখতে চায় না, তাহলে ভালো লোকদের মতো সে তালাক দিয়ে বিদায় করে দেবে। এমন যেন না হয় যে, সে তার দোষ লোকদের সামনে বলে বেড়াতে থাকবে এবং তার বিরুদ্ধে এমনভাবে অভিযোগের দপ্তর খুলে বসবে যে অন্য কেউ আর তাকে বিয়ে করতে চাইবে না। কুরআনের এ উক্তি থেকে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ হয়ে যায় যে, তালাকের প্রয়োগকে কোন পঞ্চায়েত বা আদালতের অনুমতির সাথে সংশ্লিষ্ট করা আল্লাহর শরীয়াতের জ্ঞান ও কল্যাণনীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কারণ এ অবস্থায় “ভালোভাবে বিদায় দেবার” কোন সম্ভাবনাই থাকে না। বরং স্বামী না চাইলেও অপমান, বেইজ্জতি ও দুর্নামের ঝাক্কি পোহাতে হবেই। তাছাড়া পুরুষের তালাক দেবার ইখতিয়ার কোন পঞ্চায়েত বা আদালতের অনুমতি সাপেক্ষ হবার কোন অবকাশই আয়াতের শব্দাবলীতে নেই। আয়াত একদম স্পষ্টভাবে বিবাহকারী পুরুষকে তালাকের ইখতিয়ার দিচ্ছে এবং তার ওপরই দায়িত্ব আরোপ করছে, সে যদি হাত লাগাবার পূর্বে স্ত্রীকে ত্যাগ করতে চায় তাহলে অবশ্যই অর্ধেক মহর দিয়ে বা নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু সম্পদ দিয়ে তাকে বিদায় করে দেবে। এ থেকে পরিষ্কারভাবে আয়াতের এ উদ্দেশ্য জানা যায় যে, তালাককে খেলায় পরিণত হওয়ার পথ রোধ করার জন্য পুরুষের ওপর আর্থিক দায়িত্বের একটি বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এর ফলে সে নিজের তালাকের ইখতিয়ার ভেবে চিন্তে ব্যবহার করবে এবং পরিবারের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বাইরের কোন হস্তক্ষেপও হতে পারবে না। বরং স্বামী কেন স্ত্রীকে তালাক দিচ্ছে একথা কাউকে বলতে বাধ্য হবার কোন সুযোগই আসবে না।
সাতঃ ইবনে আব্বাস (রা.), সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব, হাসান বাসরী আলী ইবনুল হোসাইন (যয়নুল আবেদীন) ইমাম শাফেঈ ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল আয়াতের “যখন তোমরা বিয়ে করো এবং তারপর তালাক দিয়ে দাও” শব্দাবলী থেকে এ বিধান নির্ণয় করেছেন যে, তালাক তখনই সংঘটিত হবে যখন তার পূর্বে বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে যায়। বিয়ের পূর্বে তালাক কার্যকর হয় না। কাজেই যদি কোন ব্যক্তি বলে, আমি অমুক মেয়েকে বা অমুক গোত্র বা জাতির মেয়েকে অথবা কোন মেয়েকে বিয়ে করলে তাকে তালাক” তাহলে তার এ উক্তি অর্থহীন পেশ করা যায়, রসূলে করীম ﷺ বলেছেনঃ আরবী لاطلاق لابن ادم فى مالا يملك “ইবনে আদম যে জিনিসের মালিক নয় তার ব্যাপারে তালাকের ইখতিয়ার ব্যবহার করার অধিকার তার নেই। আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযি ও ইবনে মাজাহ। তিনি আরো বলেছেনঃ ماطلاق قبل النكاح “বিয়ের পূর্বে কোন তালাক নেই” (ইবনে মাজাহ) কিন্তু ফকীহদের একটি বড় দল বলেন, এ আয়াত ও এ হাদীসগুলো কেবলমাত্র এখনই প্রযুক্ত হবে যখন কোন ব্যক্তি তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়নি এমন কোন মেয়েকে এভাবে বলে, তোমাকে তালাক অথবা আমি তোমাকে তালাক দিলাম। এ উক্তি যদি সে এভাবে বলে, যদি আমি তোমাকে বিয়ে করি তাহলে তোমাকে তালাক”, তাহলে এটা বিয়ে করার পূর্বে তালাক দেয়া নয় বরং আসলে সে এ বিষয়ের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এবং ঘোষণা করছে যে, যখন সেই মেয়েটির সাথে তার বিয়ে হবে তখন তার ওপর তালাক অনুষ্ঠিত হবে। এ উক্তি অর্থহীন, উদ্ভট ও প্রভাবহীন হতে পারে না। বরং যখনই মেয়েটিকে সে বিয়ে করবে তখনই তার ওপর তালাক সংঘটিত হয়ে যাবে। যেসব ফকীহ এ মত অবলম্বন করেছেন তাঁদের মধ্যে আবার এ বিষয়ে মতবিরোধ হয়েছে যে, এ ধরনের তালাকের প্রয়োগ সীমা কতখানি।
ইমাম আবু হানীফা মুহাম্মাদ ও ইমাম যুফার বলেন, কোন ব্যক্তি যদি কোন মেয়ে, কোন জাতি বা কোন গোত্র নির্দেশ করে বলে অথবা উদাহরণস্বরূপ সাধারণ কথায় এভাবে বলে, “যে মেয়েকেই আমি বিয়ে করবো তাকেই তালাক।” তাহলে উভয় অবস্থায়ই তালাক সংঘটিত হয়ে যাবে। আবু বকর জাসসাস এ একই অভিমত হযরত ওমর (রা.), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.), ইবরাহীম নাখাঈ, মুজাহিদ ও উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহেমাহুমুল্লাহ থেকে উদ্ধৃত করেছেন।
সুফিয়ান সওরী ও উসমানুল বাত্তী বলেন, তালাক কেবলমাত্র তখনি হবে যখন বক্তা এভাবে বলবে, “যদি আমি অমুক মেয়েকে বিয়ে করি তাহলে তার ওপর তালাক সংগঠিত হবে।”
হাসান ইবনে সালেহ, লাইস ইবনে সা’দ ও আমেরুশ শা’বী বলেন, এ ধরনের তালাক সাধারণভাবেও সংঘটিত হতে পারে, তবে শর্ত এই যে, এর প্রয়োগক্ষেত্র সুনির্দিষ্ট হতে হবে। যেমন এক ব্যক্তি এভাবে বললোঃ “যদি আমি অমুক পরিবার, অমুক গোত্রে, অমুক শহর, অমুক দেশ বা অমুক জাতির মেয়ে বিয়ে করি, তাহলে তার ওপর তালাক কার্যকর হবে।”
ইবনে আবী লাইলা ও ইমাম মালেক ওপরে উদ্ধৃত মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করে অতিরিক্ত শর্ত আরোপ করেন এবং বলেন, এর মধ্যে সময়-কালও নির্ধারিত হতে হবে। যেমন, যদি এক ব্যক্তি এভাবে বলে, “যদি আমি এ বছর বা আগামী দশ বছরের মধ্যে অমুক মেয়ে বা অমুক দলের মেয়েকে বিয়ে করি, তাহলে তার ওপর তালাক কার্যকর হবে অন্যথায় তালাক হবে না। বরং ইমাম মালেক এর ওপর আরো এতটুকু বৃদ্ধি করেন যে, যদি এ সময়-কাল এতটা দীর্ঘ হয় যার মধ্যে ঐ ব্যক্তির জীবিত থাকার আশা করা যায় না তাহলে তার উক্তি অকার্যকর হয়ে যাবে।
এ জবাবের ব্যাপারে আবার একথা মনে রাখতে হবে যে, এর সাহায্যে কাফের ও মুনাফিকদেরকে নিশ্চিন্ত করা এর উদ্দেশ্য নয় বরং এমন মুসলমানদেরকে নিশ্চিন্ত করা এর উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম বিরোধীরা যাদের মনে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করার চেষ্টা করছিল। তারা যেহেতু বিশ্বাস করতো, কুরআন আল্লাহর কালাম এবং আল্লাহর নিজের শব্দসহই এ কুরআন নাযিল হয়েছে, তাই কুরআনের একটি সুস্পষ্ট বক্তব্য সম্বলিত আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ এ ঘোষণা দিয়েছেনঃ নবী নিজেই নিজেকে চারজন স্ত্রী রাখার সাধারণ আইনের আওতার বাইরে রাখেননি বরং এ ব্যবস্থা আমিই করেছি।
দুইঃ তাঁর চাচাত, মামাত, ফুফাত ও খালাত বোনদের মধ্য থেকে যারা হিজরাতে তাঁর সহযোগী হন। আয়াতে তাঁর সাথে হিজরত করার যে কথা এসেছে তার অর্থ এ নয় যে, হিজরাতের সফরে তাঁর সাথেই থাকতে হবে বরং এর অর্থ ছিল, ইসলামের জন্য তাঁরাও আল্লাহর পথে হিজরত করেন। তাঁর ওপরে উল্লেখিত মুহাজির আত্মীয়দের মধ্য থেকেও যাকে ইচ্ছা তাকে বিয়ে করার ইখতিয়ারও তাঁকে দেয়া হয়। কাজেই এ অনুমতির ভিত্তিতে তিনি ৭ হিজরী সালে হযরত উম্মে হাবীবাকে (রা.) বিয়ে করেন। (পরোক্ষভাবে এ আয়াতে একথা সুস্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে যে, চাচা, মামা, ফুফী ও খালার মেয়েকে বিয়ে করা একজন মুসলমানের জন্য হালাল। এ ব্যাপারে ইসলামী শরীয়াত খৃস্ট ও ইহুদী উভয় ধর্ম থেকে আলাদা। খৃস্টীয় বিধানে এমন মহিলাকে বিয়ে করা অবৈধ যার সাথে সাত পুরুষ পর্যন্ত পুরুষের বংশধারা মিলে যায়। আর ইহুদীদের সমাজে সহোদর ভাইঝি ও ভাগনীকেও বিয়ে করা বৈধ।)
তিনঃ যে মু’মিন নারী নিজেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য ‘হিবা’ তথা দান করে অর্থাৎ মহর ছাড়াই নিজেকে নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করতে তৈরি হয়ে যায় এবং নবী (সা.) তা গ্রহণ করা পছন্দ করেন। এ অনুমতির ভিত্তিতে তিনি ৭ হিজরীর শওয়াল মাসে হযরত মায়মুনাকে (রা.) নিজের সহধর্মিনী রূপে গ্রহণ করেন। কিন্তু মহর ছাড়া তার হিবার সুযোগ নেয়া পছন্দ করেননি। তাই তার কোন আকাঙ্ক্ষা ও দাবী ছাড়াই তাঁকে মহর দান করেন। কোন কোন তাফসীরকার বলেন, নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন হিবাকারিনী স্ত্রী ছিল না। কিন্তু এর অর্থ আসলে হচ্ছে এই যে, তিনি হিবাকারিনী কোন স্ত্রীকেও মহর থেকে বঞ্চিত করেননি।
নবী করীমকে ﷺ যে কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তা ছিল এই যে, তিনি একটি অসংগঠিত ও অপরিপক্ব জাতিকে, যারা কেবল ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকেই নয় বরং সাধারণ সভ্যতা সংস্কৃতির দৃষ্টিতেও ছিল অগোছালো ও অগঠিত, তাদেরকে জীবনের প্রতিটি বিভাগে শিক্ষা ও অনুশীলনের মাধ্যমে একটি উন্নত পর্যায়ের সুসভ্য, সংস্কৃতিবান ও পরিচ্ছন্ন জাতিতে পরিণত করবেন। এ উদ্দেশ্যে কেবলমাত্র পুরুষদেরকে অনুশীলন দেয়া যথেষ্ট ছিল না বরং মহিলাদের অনুশীলনও সমান জরুরী ছিল। কিন্তু সভ্যতা ও সংস্কৃতির যে মূলনীতি শিখাবার জন্য তিনি নিযুক্ত হয়েছিলেন তার দৃষ্টিতে নারী ও পুরুষের অবাধ মেলামেশা নিষিদ্ধ ছিল এবং এ নিয়ম ভংগ করা ছাড়া তাঁর পক্ষে মহিলাদেরকে সরাসরি অনুশীলন দান করা সম্ভবপর ছিল না। তাই মহিলাদের মধ্যে কাজ করার কেবলমাত্র একটি পথই তাঁর জন্য খোলা ছিল এবং সেটি হচ্ছে, বিভিন্ন বয়সের ও বিভিন্ন বৃদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা সম্পন্ন মহিলাদেরকে তিনি বিয়ে করতেন, নিজে সরাসরি তাদেরকে অনুশীলন দান করে তার নিজের সাহায্য সহায়তার জন্য প্রস্তুত করতেন এবং তারপর তাদের সাহায্যে নগরবাসী ও মরুচারী এবং যুবতী, পৌঢ় ও বৃদ্ধা সব ধরনের নারীদেরকে দ্বীন, নৈতিকতা ও কৃষ্টি সংস্কৃতির নতুন নীতিসমূহ শিখাবার ব্যবস্থা করতেন।
এছাড়াও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পুরাতন জাহেলী জীবন ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে তার জায়গায় কার্যত ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্বও দেয়া হয়েছিল। এ দায়িত্ব সম্পাদন করার জন্য জাহেলী জীবন ব্যবস্থার প্রবক্তা ও পতাকাবাহীদের সাথে যুদ্ধ অপরিহার্য ছিল। এ সংঘাত এমন একটি দেশে শুরু হতে যাচ্ছিল যেখানে গোত্রীয় জীবনধারা নিজের বিশেষ বিশেষ সাংস্কৃতিক অবয়বে প্রচলিত ছিল। এ অবস্থায় অন্যান্য ব্যবস্থার সাথে বিভিন্ন পরিবারে বিয়ে করে বহুবিধ বন্ধুত্বকে পাকাপোক্ত এবং বহুতর শত্রুতাকে খতম করার ব্যবস্থা করা তাঁর জন্য জরুরী ছিল। তাই যেসব মহিলাকে তিনি বিয়ে করেন তাঁদের ব্যক্তিগত গুণাবলী ছাড়াও তাঁদের নির্বাচনের ক্ষেত্রে এসব বিষয়ও কমবেশী জড়িত ছিল। হযরত আয়েশা (রা.) ও হযরত হাফসাকে (রা.) বিয়ে করে তিনি হযরত আবুবকর (রা.) ও হযরত উমরের (রা.) সাথে নিজের সম্পর্ককে আরো বেশী গভীর ও মজবুত করে নেন। হযরত উম্মে সালামাহ (রা.) ছিলেন এমন এক পরিবারের মেয়ে যার সাথে ছিল আবু জেহেল ও খালেদ ইবনে ওলিদের সম্পর্ক। হযরত উম্মে হাবীবা (রা.) ছিলেন আবু সুফিয়ানের মেয়ে। এ বিয়েগুলো সংশ্লিষ্ট পরিবার গুলোর শত্রুতার জের অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। বরং হযরত উম্মে হাবীবার সাথে নবী করীমের ﷺ বিয়ে হবার পর আবু সুফিয়ান আর কখনো তাঁর মোকাবিলায় অস্ত্র ধরেননি। হযরত সুফিয়া (রা.), হযরত জুওয়াইরিয়া (রা.) ও হযরত রাইহানা (রা.) ইহুদি পরিবারের মেয়ে ছিলেন। তাঁদেরকে মুক্ত করে দিয়ে যখন নবী করীম (রা.) তাঁদেরকে বিয়ে করেন তখন তাঁর বিরুদ্ধে ইহুদিদের তৎপরতা স্তিমিত হয়ে পড়ে। কারণ সে যুগের আরবীয় নীতি অনুযায়ী যে ব্যক্তির সাথে কোন গোত্রের মেয়ের বিয়ে হতো তাকে কেবল মেয়েটির পরিবারেরই নয় বরং সমগ্র গোত্রের জামাতা মনে করা হতো এবং জামাতার সাথে যুদ্ধ করা ছিল বড়ই লজ্জাকর।
সমাজের কার্যকর সংশোধন এবং তার জাহেলী রসম রেওয়াজ নির্মূল করাও তাঁর নবুওয়াতের অন্যতম দায়িত্ব ছিল। কাজেই এ উদ্দেশ্যেও তাঁকে একটি বিয়ে করতে হয়। সূরা আহযাবে এ বিষয়টির বিস্তারিত আলোচনা হয়ে গেছে।
এসব বিষয় বিয়ের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য কোন রকম সংকীর্ণতা ও অসুবিধা না রাখার তাগাদা করছিল। এর ফলে যে মহান দায়িত্ব তাঁর প্রতি অর্পিত হয়েছিল তার প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে তিনি প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিয়ে করতে পারতেন।
যারা মনে করেন একাধিক বিয়ে কেবলমাত্র কয়েকটি বিশেষ ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই বৈধ এবং সেগুলো ছাড়া তা বৈধ হবার পেছনে অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে না, এ বর্ণনা থেকে তাদের চিন্তার বিভ্রান্তিও সুস্পষ্ট হয়ে যায়। একথা সুস্পষ্ট যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একাধিক বিয়ে করার পেছনে তা স্ত্রীর রুগ্নতা, বন্ধ্যাত্ব বা সন্তানহীনতা অথবা এতিম প্রতিপালনের সমস্যা ছিল না। এসব সীমাবদ্ধ ব্যক্তিগত প্রয়োজন ছাড়া তিনি সমস্ত বিয়ে করেন প্রচার ও শিক্ষামূলক প্রয়োজনে অথবা সমাজ সংস্কারার্থে কিংবা রাজনৈতিক ও সামাজিক উদ্দেশ্যে। প্রশ্ন হচ্ছে, যখন আজ হাতেগোনা যে কয়টি বিশেষ উদ্দেশ্যের কথা বলা হচ্ছে আল্লাহ নিজেই সেগুলোর জন্য একাধিক বিয়েকে সীমাবদ্ধ করে রাখেননি এবং আল্লাহর রসূল এগুলো ছাড়া অন্যান্য বহু উদ্দেশ্যে একাধিক বিয়ে করেছেন তখন অন্য ব্যক্তি আইনের মধ্যে নিজের পক্ষ থেকে কতিপয় শর্ত ও বিধি-নিষেধ আরোপ করার এবং সে শরীয়াত অনুযায়ী এ নির্ধারণ করছে বলে দাবী করার কী অধিকার রাখে? আসলে একাধিক বিয়ে মূলতই একটি অপকর্ম, এই পাশ্চত্য ধারণাটি উক্ত সীমা নির্ধারণের মূলে কাজ করছে। উক্ত ধারণার ভিত্তিতে এ মতবাদেরও জন্ম হয়েছে যে, এ হারাম কাজটি যদি কখনো হালাল হয়েও যায় তাহলে তা কেবলমাত্র অপরিহার্য প্রয়োজনের জন্যই হতে পারে। এখন এ বাইর থেকে আমদানী করা চিন্তার ওপর ইসলামের জাল ছাপ লাগাবার যতই চেষ্টা করা হোক না কেন কুরআন ও সুন্নাহ এবং সমগ্র উম্মাতে মুসলিমার সাহিত্য এর সাথে মোটেই পরিচিত নয়।