পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

১৬৯ আয়াত

৫১ ) তোমাকে ইখতিয়ার দেয়া হচ্ছে, তোমার স্ত্রীদের মধ্য থেকে যাকে চাও নিজের থেকে আলাদা করে রাখো, যাকে চাও নিজের সাথে রাখো এবং যাকে চাও আলাদা রাখার পরে নিজের কাছে ডেকে নাও। এতে তোমার কোন ক্ষতি নেই। এভাবে বেশী আশা করা যায় যে, তাদের চোখ শীতল থাকবে এবং তারা দুঃখিত হবে না আর যা কিছুই তুমি তাদেরকে দেবে তাতে তারা সবাই সন্তুষ্ট থাকবে। ৯১ আল্লাহ জানেন যা কিছু তোমাদের অন্তরে আছে এবং আল্লাহ‌ সর্বজ্ঞ ও সহনশীল। ৯২
۞ تُرْجِى مَن تَشَآءُ مِنْهُنَّ وَتُـْٔوِىٓ إِلَيْكَ مَن تَشَآءُ ۖ وَمَنِ ٱبْتَغَيْتَ مِمَّنْ عَزَلْتَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكَ ۚ ذَٰلِكَ أَدْنَىٰٓ أَن تَقَرَّ أَعْيُنُهُنَّ وَلَا يَحْزَنَّ وَيَرْضَيْنَ بِمَآ ءَاتَيْتَهُنَّ كُلُّهُنَّ ۚ وَٱللَّهُ يَعْلَمُ مَا فِى قُلُوبِكُمْ ۚ وَكَانَ ٱللَّهُ عَلِيمًا حَلِيمًۭا ٥١
৫২ ) এরপর তোমার জন্য অন্য নারীরা হালাল নয় এবং এদের জায়গায় অন্য স্ত্রীদের আনবে এ অনুমতিও নেই, তাদের সৌন্দর্য তোমাকে যতই মুগ্ধ করুক না কেন, ৯৩ তবে বাঁদীদের মধ্য থেকে তোমার অনুমতি আছে। ৯৪ আল্লাহ সবকিছু দেখাশুনা করছেন।
لَّا يَحِلُّ لَكَ ٱلنِّسَآءُ مِنۢ بَعْدُ وَلَآ أَن تَبَدَّلَ بِهِنَّ مِنْ أَزْوَٰجٍۢ وَلَوْ أَعْجَبَكَ حُسْنُهُنَّ إِلَّا مَا مَلَكَتْ يَمِينُكَ ۗ وَكَانَ ٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَىْءٍۢ رَّقِيبًۭا ٥٢
৫৩ ) হে ঈমানদারগণ! নবী গৃহে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করো না, ৯৫ খাবার সময়ের অপেক্ষায়ও থেকো না। হ্যাঁ, যদি তোমাদের খাবার জন্য ডাকা হয়, তাহলে অবশ্যই এসো ৯৬ কিন্তু খাওয়া হয়ে গেলে চলে যাও, কথাবার্তায় মশগুল হয়ে পড়ো না। ৯৭ তোমাদের এসব আচরণ নবীকে কষ্ট দেয় কিন্তু তিনি লজ্জায় কিছু বলেন না এবং আল্লাহ‌ হককথা বলতে লজ্জা করেন না। নবীর স্ত্রীদের কাছে যদি তোমাদের কিছু চাইতে হয় তাহলে পর্দার পেছন থেকে চাও। এটা তোমাদের এবং তাদের মনের পবিত্রতার জন্য বেশী উপযোগী। ৯৮ তোমাদের জন্য আল্লাহর রসূলকে কষ্ট দেয়া মোটেই জায়েয নয় ৯৯ এবং তাঁর পরে তাঁর স্ত্রীদেরকে বিয়ে করাও জায়েয নয়, ১০০ এটা আল্লাহর দৃষ্টিতে মস্তবড় গোনাহ।
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا تَدْخُلُوا۟ بُيُوتَ ٱلنَّبِىِّ إِلَّآ أَن يُؤْذَنَ لَكُمْ إِلَىٰ طَعَامٍ غَيْرَ نَـٰظِرِينَ إِنَىٰهُ وَلَـٰكِنْ إِذَا دُعِيتُمْ فَٱدْخُلُوا۟ فَإِذَا طَعِمْتُمْ فَٱنتَشِرُوا۟ وَلَا مُسْتَـْٔنِسِينَ لِحَدِيثٍ ۚ إِنَّ ذَٰلِكُمْ كَانَ يُؤْذِى ٱلنَّبِىَّ فَيَسْتَحْىِۦ مِنكُمْ ۖ وَٱللَّهُ لَا يَسْتَحْىِۦ مِنَ ٱلْحَقِّ ۚ وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَـٰعًۭا فَسْـَٔلُوهُنَّ مِن وَرَآءِ حِجَابٍۢ ۚ ذَٰلِكُمْ أَطْهَرُ لِقُلُوبِكُمْ وَقُلُوبِهِنَّ ۚ وَمَا كَانَ لَكُمْ أَن تُؤْذُوا۟ رَسُولَ ٱللَّهِ وَلَآ أَن تَنكِحُوٓا۟ أَزْوَٰجَهُۥ مِنۢ بَعْدِهِۦٓ أَبَدًا ۚ إِنَّ ذَٰلِكُمْ كَانَ عِندَ ٱللَّهِ عَظِيمًا ٥٣
৫৪ ) তোমরা কোন কথা প্রকাশ বা গোপন করো আল্লাহ‌ সবকিছুই জানেন। ১০১
إِن تُبْدُوا۟ شَيْـًٔا أَوْ تُخْفُوهُ فَإِنَّ ٱللَّهَ كَانَ بِكُلِّ شَىْءٍ عَلِيمًۭا ٥٤
৫৫ ) নবীর স্ত্রীদের গৃহে তাদের বাপ, ছেলে ভাই-ভাতিজা, ভাগনা ১০২ সাধারণ মেলামেশার মহিলারা ১০৩ এবং তাদের মালিকাধীন দাসদাসীরা ১০৪ এলে কোন ক্ষতি নেই। (হে নারীগণ!) তোমাদের আল্লাহর নাফরমানি থেকে দূরে থাকা উচিত। আল্লাহ‌ প্রত্যেকটি জিনিসের প্রতি দৃষ্টি রাখেন। ১০৫
لَّا جُنَاحَ عَلَيْهِنَّ فِىٓ ءَابَآئِهِنَّ وَلَآ أَبْنَآئِهِنَّ وَلَآ إِخْوَٰنِهِنَّ وَلَآ أَبْنَآءِ إِخْوَٰنِهِنَّ وَلَآ أَبْنَآءِ أَخَوَٰتِهِنَّ وَلَا نِسَآئِهِنَّ وَلَا مَا مَلَكَتْ أَيْمَـٰنُهُنَّ ۗ وَٱتَّقِينَ ٱللَّهَ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلَىٰ كُلِّ شَىْءٍۢ شَهِيدًا ٥٥
৫৬ ) আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরূদ পাঠান। ১০৬ হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি দরূদ ও সালাম পাঠাও। ১০৭
إِنَّ ٱللَّهَ وَمَلَـٰٓئِكَتَهُۥ يُصَلُّونَ عَلَى ٱلنَّبِىِّ ۚ يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ صَلُّوا۟ عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا۟ تَسْلِيمًا ٥٦
৫৭ ) যারা আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূলকে কষ্ট দেয় তাদেরকে আল্লাহ‌ দুনিয়ায় ও আখেরাতে অভিশপ্ত করেছেন এবং তাদের জন্য লাঞ্ছনাদায়ক আযাবের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ১০৮
إِنَّ ٱلَّذِينَ يُؤْذُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ لَعَنَهُمُ ٱللَّهُ فِى ٱلدُّنْيَا وَٱلْـَٔاخِرَةِ وَأَعَدَّ لَهُمْ عَذَابًۭا مُّهِينًۭا ٥٧
৫৮ ) আর যারা মু’মিন পুরুষ ও মহিলাদেরকে কোন অপরাধ ছাড়াই কষ্ট দেয় তারা একটি বড় অপবাদ ১০৯ ও সুস্পষ্ট গোনাহর বোঝা নিজেদের ঘাড়ে চাপিয়ে নিয়েছে।
وَٱلَّذِينَ يُؤْذُونَ ٱلْمُؤْمِنِينَ وَٱلْمُؤْمِنَـٰتِ بِغَيْرِ مَا ٱكْتَسَبُوا۟ فَقَدِ ٱحْتَمَلُوا۟ بُهْتَـٰنًۭا وَإِثْمًۭا مُّبِينًۭا ٥٨
৫৯ ) হে নবী! তোমার স্ত্রীদের, কন্যাদের ও মু’মিনদের নারীদেরকে বলে দাও তারা যেন তাদের চাদরের প্রান্ত তাদের ওপর টেনে নেয়। ১১০ এটি অধিকতর উপযোগী পদ্ধতি, যাতে তাদেরকে চিনে নেয়া যায় এবং কষ্ট না দেয়া হয়। ১১১ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও করুণাময়। ১১২
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِىُّ قُل لِّأَزْوَٰجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَآءِ ٱلْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِن جَلَـٰبِيبِهِنَّ ۚ ذَٰلِكَ أَدْنَىٰٓ أَن يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ ۗ وَكَانَ ٱللَّهُ غَفُورًۭا رَّحِيمًۭا ٥٩
৬০ ) যদি মুনাফিকরা এবং যাদের মনে গলদ ১১৩ আছে তারা আর যারা মদীনায় উত্তেজনাকর গুজব ছড়ায়, ১১৪ তারা নিজেদের তৎপরতা থেকে বিরত না হয়, তাহলে আমি তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবার জন্য তোমাকে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে দেবো; তারপর খুব কমই তারা এ নগরীতে তোমার সাথে থাকতে পারবে।
۞ لَّئِن لَّمْ يَنتَهِ ٱلْمُنَـٰفِقُونَ وَٱلَّذِينَ فِى قُلُوبِهِم مَّرَضٌۭ وَٱلْمُرْجِفُونَ فِى ٱلْمَدِينَةِ لَنُغْرِيَنَّكَ بِهِمْ ثُمَّ لَا يُجَاوِرُونَكَ فِيهَآ إِلَّا قَلِيلًۭا ٦٠
৯১.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সংসার জীবনের সংকটমুক্ত করাই ছিল এ আয়াতটির উদ্দেশ্য। এর ফলে তিনি পরিপূর্ণ নিশ্চিন্ততার সাথে নিজের কাজ করতে পারতেন। যখন আল্লাহ‌ পরিষ্কার ভাষায় তাঁকে পবিত্র স্ত্রীদের মধ্য থেকে যার সাথে তিনি যেমন ব্যবহার করতে চান তা করার ইখতিয়ার দিয়ে দেন তখন এ মু’মিন ভদ্রমহিলাদের তাঁকে কোনভাবে পেরেশান করার অথবা পরস্পর ঈর্ষা ও প্রতিযোগিতার কলহ সৃষ্টি করে সমস্যার মুখোমুখি করার আর কোন সম্ভাবনাই থাকে না। কিন্তু আল্লাহর কাছ থেকে এ ইখতিয়ার লাভ করার পরও নবী করীম (রা.) সকল স্ত্রীদের মধ্যে পূর্ণ সমতা ও ইনসাফ কায়েম করেন, কাউকেও কারো ওপর প্রাধান্য দেননি এবং যথারীতি পালা নির্ধারণ করে কায়েম করেন, তিনি সবার কাছে যেতে থাকেন। মুহাদ্দিসদের মধ্যে একমাত্র আবু রাযীন বর্ণনা করেন, নবী করীম (রা.) কেবলমাত্র চারজন স্ত্রীর (হযরত আয়েশা, হযরত হাফসাহ, হযরত যয়নব ও হযরত উম্মে সালামাহ) জন্য পালা নির্ধারণ করেন, বাকি অন্য সকল স্ত্রীর জন্য কোন পালা নির্দিষ্ট করেননি। কিন্তু অন্য সকল মুহাদ্দিস ও মুফাসসির এর প্রতিবাদ করেন। তাঁরা অত্যন্ত শক্তিশালী রেওয়ায়াতের মাধ্যমে এ প্রমাণ পেশ করেন যে, এ ইখতিয়ার লাভ করার পরও নবী করীম (রা.) সকল স্ত্রীর কাছে পালাক্রমে যেতে থাকেন এবং সবার সাথে সমান ব্যবহার করতে থাকেন। বুখারী, তিরমিযী, নাসাঈ ও আবু দাউদ প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ হযরত আয়েশার এ উক্তি উদ্ধৃত করেছেনঃ “এ আয়াত নাযিলের পর নবী করীমের ﷺ রীতি এটিই ছিল যে, তিনি আমাদের মধ্য থেকে কোন স্ত্রীর পালার দিন অন্য স্ত্রীর কাছে যেতে হলে তার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তবে যেতেন।” আবু বকর জাসসাস হযরত উরওয়াহ ইবনে যুবাইরের (রা.) রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, হযরত আয়েশা (রা.) তাঁকে বলেনঃ “রসূলুল্লাহ ﷺ পালা বন্টনের ক্ষেত্রে আমাদের কাউকে কারো ওপর প্রাধান্য দিতেন না। যদিও এমন ঘটনা খুব কমই ঘটতো যে, তিনি একই দিন নিজের সকল স্ত্রীর কাছে যাননি। তবুও যে স্ত্রীর পালার দিন হতো সেদিন তাকে ছাড়া আর কাউকে স্পর্শও করতেন না। হযরত আয়েশা (রা.) এ হাদীসটিও বর্ণনা করেছেনঃ যখন নবী ﷺ তাঁর শেষ রোগে আক্রান্ত হন এবং চলাফেরা করা তাঁর জন্য কঠিন হয়ে পড়ে তখন তিনি সকল স্ত্রীদের থেকে অনুমতি চান এই মর্মে, আমাকে আয়েশার কাছে থাকতে দাও। তারপর যখন সবাই অনুমতি দেন তখন তিনি শেষ সময়ে হযরত আয়েশার (রা.) কাছে থাকেন। ইবনে আবি হাতেম ইমাম যুহরীর উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন স্ত্রীকে পালা থেকে বঞ্চিত করার কথা প্রমাণিত নয়। একমাত্র হযরত সওদা (রা.) এর ব্যতিক্রম। তিনি সানন্দে নিজের পালা হযরত আয়েশাকে (রা.) দিয়ে দেন। কারণ তিনি অনেক বয়োবৃদ্ধা হয়ে পড়েছিলেন।

এখানে কারো মনে এ ধরনের কোন সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে, আল্লাহ‌ এ আয়াতে তাঁর নবীর জন্য নাউযুবিল্লাহ কোন অন্যায় সুবিধা দান করেছিলেন এবং তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণের অধিকার হরণ করেছিলেন। আসলে যেসব মহৎ কল্যাণ ও সুবিধার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীদের সংখ্যার ব্যাপারটি সাধারণ নিয়মের বাইরে রাখা হয়েছিল নবীকে সাংসারিক জীবনে শান্তি দান করা এবং যেসব কারণে তাঁর মনে পেরেশানী সৃষ্টি হতে পারে সেগুলোর পথ বন্ধ করে দেয়া ছিল সেসব কল্যাণ ও সুবিধারই দাবী। নবীর পবিত্র স্ত্রীগণের জন্য এটা ছিল বিরাট মর্যাদার ব্যাপার। তাঁরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ন্যায় মহামহিম ব্যক্তিত্বের স্ত্রীর মর্যাদা লাভ করেছিলেন। এরই বদৌলতে তাঁরা ইসলামী দাওয়াত ও সংস্কারের এ মহিমান্বিত কর্মে নবী করীমের ﷺ সহযোগী হতে সক্ষম হয়েছিলেন, যিনি কিয়ামত পর্যন্ত মানবতার কল্যাণের মাধ্যমে পরিণত হতে যাচ্ছিলেন। এ উদ্দেশ্যে নবী ﷺ যেমন অসাধারণ ত্যাগ ও কুরবানীর পথ অবলম্বন করেছিলেন এবং সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের সামর্থ্যের শেষ সীমা পর্যন্ত কুরবানী করে চলছিলেন ঠিক তেমনি ত্যাগ স্বীকার করা নবীর ﷺ পবিত্র স্ত্রীগণেরও কর্তব্য ছিল। তাই নবী করীমের ﷺ সকল স্ত্রী মহান আল্লাহর এ ফায়সালা সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন।

৯২.
এটি নবী করীমের ﷺ পবিত্র স্ত্রীগণের জন্যও সতর্কবাণী এবং অন্য সমস্ত লোকদের জন্যও। পবিত্র স্ত্রীগণের জন্য এ বিষয়ের সতর্কবাণী যে, আল্লাহর এ হুকুম এসে যাবার পর যদি তাদের হৃদয় দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে তাহলে তারা পাকড়াও থেকে নিষ্কৃতি লাভ করতে পারবে না। অন্য লোকদের জন্য এর মধ্যে এ সতর্কবাণী রয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে যদি তারা কোন প্রকার ভুল ধারণাও নিজেদের মনে পোষণ করে অথবা চিন্তা-ভাবনার কোন পর্যায়েও কোন প্ররোচনা লালন করতে থাকে, তাহলে আলাহর কাছে তাদের এ প্রচ্ছন্ন দুস্কৃতি গোপন থাকবে না। এই সাথে আল্লাহর সহিষ্ণুতা গুণের কথাও বলে দেয়া হয়েছে। এভাবে মানুষ জানবে, নবী সম্পর্কে গোস্তাখীমূলক চিন্তা যদিও কঠিন শাস্তিযোগ্য তবুও যার মনে কখনো এ ধরনের প্ররোচনা সৃষ্টি হয় সে যদি তা বের করে দেয়, তাহলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা লাভের আশা আছে।
৯৩.
এ উক্তিটির দু’টি অর্থ রয়েছে। এক ওপরে ৫০ আয়াতে নবী করীমের ﷺ জন্য যেসব নারীকে হালাল করে দেয়া হয়েছে তারা ছাড়া আর কোন নারী এখন আর তার জন্য হালাল নয়। দুই, যখন তার পবিত্র স্ত্রীগণ অভাবে অনটনে তার সাথে থাকবেন বলে রাজী হয়ে গেছেন এবং আখেরাতের জন্য তারা দুনিয়াকে বিসর্জন দিয়েছেন আর তিনি তাদের সাথে যে ধরনের আচরণ করবেন তাতেই তারা খুশী তখন এক্ষেত্রে আর তার জন্য তাদের থেকে কাউকে তালাক দিয়ে তার জায়গায় অন্য স্ত্রী গ্রহণ করা হালাল নয়। এ উক্তিটির দু’টি অর্থ রয়েছে। এক ওপরে ৫০ আয়াতে নবী করীমের ﷺ জন্য যেসব নারীকে হালাল করে দেয়া হয়েছে তারা ছাড়া আর কোন নারী এখন আর তাঁর জন্য হালাল নয়। দুই, যখন তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণ অভাবে অনটনে তাঁর সাথে থাকবেন বলে রাজী হয়ে গেছেন এবং আখেরাতের জন্য তাঁরা দুনিয়াকে বিসর্জন দিয়েছেন আর তিনি তাঁদের সাথে যে ধরনের আচরণ করবেন তাতেই তাঁরা খুশী তখন এক্ষেত্রে আর তাঁর জন্য তাঁদের মধ্য থেকে কাউকে তালাক দিয়ে তাঁর জায়গায় অন্য স্ত্রী গ্রহণ করা হালাল নয়।
৯৪.
এ আয়াতটি পরিষ্কার করে একথা বর্ণনা করছে যে, বিবাহিতা স্ত্রীগণ ছাড়া মালিকানাধীন নারীদের সাথেও মিলনের অনুমতি রয়েছে এবং তাদের ব্যাপারে কোন সংখ্যা-সীমা নেই। সূরা নিসার ৩ আয়াতে, সূরা মু’মিনূনের ৬ আয়াতে এবং সূরা মা’আরিজের ৩০ আয়াতে এ বিষয়বস্তুটি পরিষ্কার করে বলে দেয়া হয়েছে। এ সমস্ত আয়াতে মালিকানাধীন মহিলাদেরকে বিবাহিতা নারীদের মোকাবিলায় একটি আলাদা গোষ্ঠী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং তারপর তাদের সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপনকে বৈধ গণ্য করা হয়েছে। এছাড়াও সূরা নিসার ৩ আয়াত বিবাহিতা স্ত্রীদের জন্য ৪ জনের সীমারেখা নির্ধারণ করে। কিন্তু সেখানে আল্লাহ‌ মালিকানাধীন মহিলাদের কোন সংখ্যাসীমা বেঁধে দেননি এবং এতদসংক্রান্ত অন্য আয়াতগুলোতেও কোথাও এ ধরনের কোন সীমার প্রতি ইঙ্গিতও করেননি। বরং এখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে, আপনার জন্য এরপর অন্য মহিলাদেরকে বিয়ে করা অথবা কাউকে তালাক দিয়ে অন্য স্ত্রী নিয়ে আসা হালাল নয়। তবে মালিকানাধীন মহিলারা হালাল। এ থেকে পরিষ্কার প্রকাশ হয় মালিকানাধীন মহিলাদের ব্যাপারে কোন সংখ্যা-সীমা নির্ধারিত নেই।

কিন্তু এর অর্থ এ নয়, ইসলামী শরীয়াত ধনীদের অসংখ্য বাঁদী কিনে আয়েশ করার জন্য এ সুযোগ দিয়েছে। বরং আসলে প্রবৃত্তি পূজারী লোকেরা এ আইনটি থেকে অযথা সুযোগ গ্রহণ করেছে। আইন তৈরি করা হয়েছিল মানুষের সুবিধার জন্য। আইন থেকে এ ধরনের সুযোগ গ্রহণের জন্যও তা তৈরি করা হয়নি। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে ঠিক তেমনি যেমন শরীয়াত একজন পুরুষকে চারজন পর্যন্ত মহিলাকে বিয়ে করার অনুমতি দেয় এবং তাকে নিজের স্ত্রীকে তালাক দিয়ে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করারও অনুমতি দেয়। মানুষের প্রয়োজন সামনে রেখে এ আইন তৈরি করা হয়েছিল। এখন যদি কোন ব্যক্তি নিছক আয়েশ করার জন্য চারটি মহিলাকে বিয়ে করে কিছুদিন তাদের সাথে থাকার পর তাদেরকে তালাক দিয়ে আবার নতুন করে চারটি বউ ঘরে আনার ধারা চালু করে, তাহলে এটা তো আইনের অবকাশের সুযোগ গ্রহণ করাই হয়। এর পুরো দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপরই বর্তাবে, আল্লাহর শরীয়াতের ওপর নয়। অনুরূপভাবে যুদ্ধে গ্রেফতারকৃত মহিলাদেরকে যখন তাদের জাতি মুসলিম বন্দীদের বিনিময়ে ফিরিয়ে নিতে অথবা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে এগিয়ে আসে না তখন ইসলামী শরীয়াত তাদেরকে বাঁদী হিসেবে গ্রহণ করার অনুমতি দিয়েছে। তাদেরকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যেসব ব্যক্তির মালিকানায় দিয়ে দেয়া হয় তাদের ঐ সব মহিলার সাথে সঙ্গম করার অধিকার দিয়েছে। এর ফলে তাদের অস্তিত্ব সমাজে নৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। তারপর যেহেতু বিভিন্ন যুদ্ধে গ্রেফতার হয়ে আসা লোকদের কোন নির্দিষ্ট সংখ্যা থাকতে পারে না, তাই আইনগতভাবে এক ব্যক্তি একই সঙ্গে ক’জন গোলাম বা বাঁদী রাখতে পারে, এরও কোন সীমা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। গোলাম ও বাঁদীদের বেচাকেনাও এজন্য বৈধ রাখা হয়েছে যে, যদি কোন গোলাম বা বাঁদীর তার মালিকের সাথে বনিবনা না হয় তাহলে সে অন্য মালিকের অধীনে চলে যেতে পারবে এবং এক ব্যক্তির চিরন্তন মালিকানা মালিক ও অধীনস্থ উভয়ের জন্য আযাবে পরিণত হবে না। শরীয়াত এ সমস্ত নিয়ম ও বিধান তৈরি করেছিল মানুষের অবস্থা ও প্রয়োজন সামনে রেখে তার সুবিধার জন্য। যদি ধনী লোকেরা একে বিলাসিতার মাধ্যমে পরিণত করে নিয়ে থাকে তাহলে এজন্য শরীয়াত নয়, তারাই অভিযুক্ত হবে।

.
৯৫.
প্রায় এক বছর পরে সূরা নূরে যে সাধারণ হুকুম দেয়া হয় এটা তার ভূমিকা স্বরূপ। প্রাচীন যুগে আরবের লোকেরা নিসংকোচে একজন অন্যজনের ঘরে ঢুকে পড়তো। কেউ যদি কারো সাথে দেখা করতে চাইতো তাহলে দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকার বা অনুমতি নিয়ে ভেতরে যাবার নিয়ম ছিল না। বরং ভেতরে গিয়ে গৃহকর্তা গৃহে আছে কি নেই স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের কাছে জিজ্ঞেস করে তা জানতে চাইতো। এ জাহেলী পদ্ধতি বহু ক্ষতির কারণ হয়ে পড়েছিল। অনেক সময় বহু নৈতিক অপকর্মেরও সূচনা এখান থেকে হতো। তাই প্রথমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গৃহে এ নিয়ম জারী করা হয় যে, কোন নিকটতম বন্ধু বা দূরবর্তী আত্মীয়-স্বজন হলেও বিনা অনুমতিতে তাঁর গৃহে প্রবেশ করতে পারবে না। তারপর সূরা নূরে এ নিয়মটি সমস্ত মুসলমানের গৃহে জারী করার সাধারণ হুকুম দিয়ে দেয়া হয়।
৯৬.
এ প্রসঙ্গে এটা দ্বিতীয় হুকুম। আরববাসীদের মধ্যে যেসব সভ্যতা বিবর্জিত আচরণের প্রচলন ছিল তার মধ্যে একটি এও ছিল যে, কোন বন্ধু বা পরিচিত লোকের গৃহে তারা পৌঁছে যেতো ঠিক খাবার সময় তাক করে। অথবা তার গৃহে এসে বসে থাকতো এমনকি খাবার সময় এসে যেতো। এহেন আচরণে গৃহকর্তা অধিকাংশ সময় বেকায়দায় পড়ে যেতো। মুখ ফুটে যদি বলে এখন আমার খাবার সময় মেহেরবানী করে চলে যান, তাহলে বড়ই অসভ্যতা ও রুঢ়তার প্রকাশ হয়। আর যদি খাওয়ায়, তাহলে হঠাৎ আগত কতজনকে খাওয়াবে। যখনই যতজন লোকই আসুক সবসময় সঙ্গে সঙ্গেই তাদের খাওয়াবার ব্যবস্থা করার মতো সামর্থ্য সবাই রাখে না। আল্লাহ‌ এ অভদ্র আচরণ করতে তাদেরকে নিষেধ করেন এবং হুকুম দেন, কোন ব্যক্তির গৃহে খাওয়ার জন্য তখনই যেতে হবে যখন গৃহকর্তা খাওয়ার দাওয়াত দেবে। এ হুকুম শুধুমাত্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য নির্দিষ্ট ছিল না বরং সেই আদর্শগৃহে এ নিয়ম এজন্যই জারী করা হয়েছিল যেন তা মুসলমানদের সাধারণ সাংস্কৃতিক জীবনের নিয়মে ও বিধানে পরিণত হয়ে যায়।
৯৭.
এটি আরো একটি অসভ্য আচরণ সংশোধনের ব্যবস্থা। কোন কোন লোক খাওয়ার দাওয়াতে এসে খাওয়া দাওয়া সেরে এমনভাবে ধরণা দিয়ে বসে চুটিয়ে আলাপ জুড়ে দেয় যেন আর উঠবার নামটি নেই, মনে হয় এ আলাপ আর শেষ হবে না। গৃহকর্তা ও গৃহবাসীদের এতে কি অসুবিধা হচ্ছে তার কোন পরোয়াই তারা করে না। ভদ্রতা জ্ঞান বিবর্জিত লোকেরা তাদের এ আচরণের মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেও কষ্ট দিতে থাকতো এবং তিনি নিজের ভদ্র ও উদার স্বভাবের কারণে এসব বরদাশত করতেন। শেষে হযরত যয়নবের ওলিমার দিন এ কষ্টদায়ক আচরণ সীমা ছাড়িয়ে যায়। নবী করীমের ﷺ বিশেষ খাদেম হযরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেছেনঃ রাতের বেলা ছিল ওলিমার দাওয়াত। সাধারণ লোকেরা খাওয়া শেষ করে বিদায় নিয়েছিল। কিন্তু দু’তিন জন লোক বসে কথাবার্তায় মশগুল হয়ে গিয়েছিলন। নবী ﷺ বিরক্ত হয়ে উঠলেন এবং পবিত্র স্ত্রীদের ওখান থেকে এক চক্কর দিয়ে এলেন। ফিরে এসে দেখলেন তারা যথারীতি বসেই আছেন। তিনি আবার উঠে গেলেন এবং হযরত আয়েশার কামরায় বসলেন। অনেকটা রাত অতিবাহিত হয়ে যাবার পর যখন তিনি জানলেন তারা চলে গেছেন তখন তিনি হযরত যয়নবের (রা.) কক্ষে গেলেন। এরপর এ বদ অভ্যাসগুলো সম্পর্কে লোকদেরকে সতর্ক করে দেয়া স্বয়ং আল্লাহর জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়লো। হযরত আনাসের (রা.) রেওয়ায়াত অনুযায়ী এ আয়াত সে সময়ই নাযিল হয়। (মুসলিম, নাসাঈ ও ইবনে জারীর)
৯৮.
এ আয়াতকেই হিজাব বা পর্দার আয়াত বলা হয়। বুখারীতে হযরত আনাস ইবনে মালেকের (রা.) উদ্ধৃত হয়েছে উমর (রা.) এ আয়াতটি নাযিল হবার পূর্বে নবী করীমের ﷺ কাছে নিবেদন করেছিলেনঃ হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহর রসূল! আপনার এখানে ভালোমন্দ সবরকম লোক আসে। আহা, যদি আপনি আপনার পবিত্র স্ত্রীদেরকে পর্দা করার হুকুম দিতেন। অন্য এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, একবার হযরত উমর (রা.) নবী করীমের ﷺ স্ত্রীদের বলেনঃ “যদি আপনাদের ব্যাপারে আমার কথা মেনে নেয়া হয় তাহলে আমার চোখ কখনোই আপনাদের দেখবে না।” কিন্তু রসূলুল্লাহ ﷺ যেহেতু আইন রচনার ক্ষেত্রে স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন না, তাই তিনি আল্লাহর ইশারার অপেক্ষায় ছিলেন। শেষ পর্যন্ত এ হুকুম এসে গেলো যে, মাহরাম পুরুষরা ছাড়া (যেমন সামনের দিকে ৫৫ আয়াতে আসছে) অন্য কোন পুরুষ নবী করীমের ﷺ গৃহে প্রবেশ করবে না। আর সেখানে মহিলাদের কাছে যারই কিছু কাজের প্রয়োজন হবে তাকে পর্দার পেছনে থেকেই কথা বলতে হবে। এ হুকুমের পরে পবিত্র স্ত্রীদের গৃহে দরজার ওপর পর্দা লটকে দেয়া হয় এবং যেহেতু নবী করীমের ﷺ গৃহ সকল মুসলমানের জন্য আদর্শগৃহ ছিল তাই সকল মুসলমানের গৃহের দরজায়ও পর্দা ঝোলানো হয়। আয়াতের শেষ অংশ নিজেই এদিকে ইঙ্গিত করছে যে, যারাই পুরুষ ও নারীদের মন পাক পবিত্র রাখতে চায় তাদেরকে অবশ্যই এ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।

এখন যে ব্যক্তিকেই আল্লাহ‌ দৃষ্টিশক্তি দান করেছেন সে নিজেই দেখতে পারে, যে কিতাবটি নারী পুরুষকে সামনা সামনি কথা বলতে বাঁধা দেয় এবং পর্দার অন্তরাল থেকে কথা বলার কারণ স্বরূপ একথা বলে যে, “তোমাদের ও তাদের অন্তরের পবিত্রতার জন্য এ পদ্ধতিটি বেশী উপযোগী”, তার মধ্যে কেমন করে এ অভিনব প্রাণপ্রবাহ সঞ্চার করা যেতে পারে, যার ফলে নারী পুরুষের মিশ্র সভা-সমিতি ও সহশিক্ষা এবং গণপ্রতিষ্ঠান ও অফিসসমূহে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা একেবারেই বৈধ হয়ে যাবে এবং এর ফলে মনের পবিত্রতা মোটেই প্রভাবিত হবে না? কেউ যদি কুরআনের বিধান অনুসরণ করতে না চায়, তাহলে সে তার বিরুদ্ধাচরণ করুক এবং পরিষ্কার বলে দিক আমি এর অনুসরণ করতে চাই না, এটিই তার জন্য অধিক যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতি। কিন্তু কুরআনের সুস্পষ্ট বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করবে এবং তারপর আবার বেহায়ার মতো বুক ফুলিয়ে বলবে, এটি ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা যা আমি উদ্ভাবন করে নিয়ে এসেছি-এটি বড়ই হীন আচরণ। কুরআন ও সুন্নাহর বাইরে কোন্ জায়গা থেকে তারা ইসলামের এ তথাকথিত শিক্ষা খুঁজে পেলেন?

৯৯.
সে সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে যেসব অপবাদ ছড়ানো হচ্ছিল এবং কাফের ও মুনাফেকদের সাথে সাথে অনেক দুর্বল ঈমানদার মুসলমানও তাতে অংশ গ্রহণ করতে শুরু করেছিলেন, এখানে সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
১০০.
সূরার শুরুতে “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীগণ হচ্ছেন মু’মিনগণের মা” বলে যে বক্তব্য উপস্থাপন হয়েছে এ হচ্ছে তার ব্যাখ্যা।
.
১০১.
অর্থাৎ নবী করীমের ﷺ বিরুদ্ধে কোন ব্যক্তি যদি অন্তরেও কোন খারাপ ধারণা পোষণ করে অথবা তাঁর স্ত্রীদের সম্পর্কে কারো নিয়তের মধ্যে কোন অসততা প্রচ্ছন্ন থাকে, তাহলে আল্লাহর কাছে তা গোপন থাকবে না এবং এজন্য সে শাস্তি পাবে।
১০২.
ব্যাখ্যার জন্য সূরা নূরের তাফসীরের ৩৮ থেকে ৪২ পর্যন্ত টীকা দেখুন। এ প্রসঙ্গে আল্লামা আলূসীর এ ব্যাখ্যাও উল্লেখযোগ্য যে, ভাই, ভাতিজা ও ভাগনাদের বিধানের মধ্যে এমন সব আত্মীয়রাও এসে যায় যারা একজন মহিলার জন্য হারাম-তারা রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয় বা দুধ সম্পর্কিত যাই হোক না কেন। এ তালিকায় চাচা ও মামার উল্লেখ করা হয়নি। কারণ তারা নারীর জন্য পিতার সমান। অথবা তাদের উল্লেখ না করার কারণ হচ্ছে এই যে, ভাতিজা ও ভাগনার কথা এসে যাবার পর তাদের কথা বলার প্রয়োজন নেই। কেননা ভাতিজা ও ভাগনাকে পর্দা না করার পেছনে যে কারণ রয়েছে চাচা ও মামাকে পর্দা না করার কারণও তাই। (রুহুল মা’আনী)
১০৩.
ব্যাখ্যার জন্য দেখুন সূরা নূরের তাফসীর ৪৩ টীকা।
১০৪.
ব্যাখ্যার জন্য সূরা নূরের তাফসীরের ৪৪ টীকা।
১০৫.
একথার অর্থ হচ্ছে, এ চূড়ান্ত হুকুম এসে যাবার পর ভবিষ্যতে এমন কোন ব্যক্তিকে বেপর্দা অবস্থায় গৃহে প্রবেশের অনুমতি দেয়া যাবে না যে ঐ ব্যতিক্রমী আত্মীয়দের গণ্ডীর বাইরে অবস্থান করে। দ্বিতীয় অর্থ এও হয় যে, স্ত্রীদের কখনো এমন নীতি অবলম্বন করা উচিত নয় যার ফলে স্বামীর উপস্থিতিতে তারা পর্দার নিয়ন্ত্রণ মেনে চলবে এবং স্বামীর অনুপস্থিতিতে গায়ের মাহরাম পুরুষদের সামনে পর্দা উঠিয়ে দেবে। তাদের এ কর্ম স্বামীর দৃষ্টির আড়ালে থাকতে পারে কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টির আড়ালে থাকতে পারে না।
১০৬.
আল্লাহর পক্ষ থেকে নবীর প্রতি দরূদের অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ‌ নবীর প্রতি সীমাহীন করুণার অধিকারী। তিনি তাঁর প্রশংসা করেন। তাঁর কাজে বরকত দেন। তাঁর নাম বুলন্দ করেন। তাঁর প্রতি নিজের রহমতের বারি বর্ষণ করেন। ফেরেশতাদের পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি দরূদের অর্থ হচ্ছে, তাঁরা তাঁকে চরমভাবে ভালোবাসেন এবং তাঁর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, আল্লাহ‌ যেন তাঁকে সর্বাধিক উচ্চ মর্যাদা দান করেন, তাঁর শরীয়াতকে প্রসার ও বিস্তৃতি দান করেন এবং তাঁকে একমাত্র মাহমুদ তথা সবোর্চ্চ প্রশংসিত স্থানে পৌঁছিয়ে দেন। পূর্বাপর বিষয়বস্তুর প্রতি দৃষ্টি দিলে এ বর্ণনা পরম্পরায় একথা কেন বলা হয়েছ তা পরিষ্কার অনুভব করা যায়। তখন এমন একটি সময় ছিল যখন ইসলামের দুশমনরা এ সুস্পষ্ট জীবন ব্যবস্থার বিস্তার ও সম্প্রসারণের ফলে নিজেদের মনের আক্রোশ প্রকাশের জন্য নবী করীমের ﷺ বিরুদ্ধে একের পর এক অপবাদ দিয়ে চলছিল এবং তারা নিজেরা একথা মনে করছিল যে, এভাবে কাঁদা ছিটিয়ে তারা তাঁর নৈতিক প্রভাব নির্মূল করে দেবে। অথচ এ নৈতিক প্রভাবের ফলে ইসলাম ও মুসলমানরা দিনের পর দিন এগিয়ে চলছিল। এ অবস্থায় আলোচ্য আয়াত নাযিল করে আল্লাহ‌ দুনিয়াকে একথা জানিয়ে দেন যে, কাফের, মুশরিক ও মুনাফিকরা আমার নবীর দুর্নাম রটাবার এবং তাঁকে অপদস্ত করার যতই প্রচেষ্টা চালাক না কেন শেষ পর্যন্ত তারা ব্যর্থ হবে। কারণ আমি তাঁর প্রতি মেহেরবান এবং সমগ্র বিশ্ব-জাহানের আইন ও শৃংখলা ব্যবস্থা যেসব ফেরেশতার মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে তারা সবাই তাঁর সহায়ক ও প্রশংসাকারী। আমি যেখানে তাঁর নাম বুলন্দ করছি এবং আমার ফেরেশতারা তার প্রশংসাবলীর আলোচনা করছে সেখানে তাঁর নিন্দাবাদ করে তারা কি লাভ করতে পারে? আমার রহমত ও বরকত তাঁর সহযোগী এবং আমার ফেরেশতারা দিনরাত দোয়া করছে, হে রব্বুল আলামীন! মুহাম্মাদের ﷺ মর্যাদা আরো বেশী উঁচু করে দাও এবং তাঁর দ্বীনকে আরো বেশী প্রসারিত ও বিকশিত করো। এ অবস্থায় তারা বাজে অস্ত্রের সাহায্যে তাঁর কি ক্ষতি করতে পারে?
১০৭.
অন্য কথায় এর অর্থ হচ্ছে, হে লোকেরা! মুহাম্মাদ রসূলুল্লাহর বদৌলতে তোমরা যারা সঠিক পথের সন্ধান পেয়েছো তারা তাঁর মর্যাদা অনুধাবন করো এবং তাঁর মহা অনুগ্রহের হক আদায় করো। তোমরা মূর্খতার অন্ধকারে পথ ভুলে বিপথে চলছিলে, এ ব্যক্তি তোমাদের জ্ঞানের আলোক বর্তিকা দান করেছেন। তোমরা নৈতিক অধঃপতনের মধ্যে ডুবেছিলে, এ ব্যক্তি তোমাদের সেখান থেকে উঠিয়েছেন এবং তোমাদের মধ্যে যোগ্যতা সৃষ্টি করে দিয়েছেন, যার ফলে আজ মানুষ তোমাদেরকে ঈর্ষা করে। তোমরা বর্বর ও পাশবিক জীবন যাপন করছিলে, এ ব্যক্তি তোমাদের সর্বোত্তম মানবিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাজে সুসজ্জিত করেছেন। তিনি তোমাদের ওপর এসব অনুগ্রহ করেছেন বলেই দুনিয়ার কাফের ও মুশরিকরা এ ব্যক্তির বিরুদ্ধে আক্রোশে ফেটে পড়ছে। নয়তো দেখো, তিনি কারো সাথে ব্যক্তিগতভাবে কোন দুর্ব্যবহার করেননি। তাই এখনি তোমাদের কৃতজ্ঞতার অনিবার্য দাবী হচ্ছে এই যে, তারা এ আপাদমস্তক কল্যাণ ব্রতী ব্যক্তিত্বের প্রতি যে পরিমাণ হিংসা ও বিদ্বেষ পোষণ করে ঠিক একই পরিমাণ বরং তার চেয়ে বেশী ভালোবাসা তোমরা তাঁর প্রতি পোষণ করো। তারা তাঁকে যে পরিমাণ ঘৃণা করে ঠিক ততটাই বরং তার চেয়ে বেশীই তোমরা তাঁর প্রতি অনুরক্ত হবে। তারা তাঁর যতটা নিন্দা করে ঠিক ততটাই বরং তার চেয়ে বেশী তোমরা তাঁর প্রশংসা করো। তারা তাঁর যতটা অশুভাকাংখী হয় তোমরা তার ঠিক ততটাই বরং তার চেয়ে বেশী শুভাকাংখী হয়ে যাও এবং তাঁর পক্ষে সেই একই দোয়া করো যা আল্লাহর ফেরেশতারা দিনরাত তাঁর জন্য করে যাচ্ছে, হে দোজাহানের রব! তোমার নবী যেমন আমাদের প্রতি বিপুল অনুগ্রহ করেছেন তেমনি তুমিও তাঁর প্রতি অসীম ও অগণিত রহমত বর্ষণ করো, তাঁর মর্যাদা দুনিয়াতেও সবচেয়ে বেশী উন্নত করো এবং আখেরাতেও তাঁকে সকল নৈকট্য লাভকারীদের চাইতেও বেশী নৈকট্য দান করো।

এ আয়াতে মুসলমানদেরকে দু’টো জিনিসের হুকুম দেয়া হয়েছে। একটি হচ্ছে, “সাল্লু আলাইহে অর্থাৎ তাঁর প্রতি দরূদ পড়ো। অন্যটি হচ্ছে, “ওয়া সাল্লিমূ তাসলীমা” অর্থাৎ তাঁর প্রতি সালাম ও প্রশান্তি পাঠাও।

“সালাত” শব্দটি যখন “আলা” অব্যয় সহকারে বলা হয় তখন এর তিনটি অর্থ হয়ঃ এক, কারো অনুরক্ত হয়ে পড়া। দুই, কারো প্রশংসা করা। তিন, কারো পক্ষে দোয়া করা। এ শব্দটি যখন আল্লাহর জন্য বলা হবে তখন একথা সুস্পষ্ট যে, তৃতীয় অর্থটির জন্য এটি বলা হবে না। কারণ আল্লাহর অন্য কারো কাছে দোয়া করার ব্যাপারটি একেবারেই অকল্পনীয়। তাই সেখানে অবশ্যই তা হবে শুধুমাত্র প্রথম দু’টি অর্থের জন্য। কিন্তু যখন এ শব্দ বান্দাদের তথা মানুষ ও ফেরেশতাদের জন্য বলা হবে তখন তা তিনটি অর্থেই বলা হবে। তার মধ্যে ভালোবাসার অর্থও থাকবে, প্রশংসার অর্থও থাকবে এবং দোয়া ও রহমতের অর্থও থাকবে। কাজেই মু’মিনদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষে “সাল্লু আলাইহে”-এর হুকুম দেয়ার অর্থ হচ্ছে এই যে, তোমরা তাঁর ভক্ত-অনুরক্ত হয়ে যাও তাঁর প্রশংসা করো এবং তাঁর জন্য দোয়া করো।

“সালাত” শব্দেরও দু’টি অর্থ হয়। এক সবরকমের আপদ-বিপদ ও অভাব অনটন মুক্ত থাকা। এর প্রতিশব্দ হিসেবে আমাদের এখানে সালামতি বা নিরাপত্তা শব্দের ব্যবহার আছে, দুই, শান্তি, সন্ধি ও অবিরোধিতা। কাজেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষে “সাল্লিমূ তাসলিমা” বলার একটি অর্থ হচ্ছে, তোমরা তাঁর জন্য পূর্ণ নিরাপত্তার দোয়া করো। আর এর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, তোমরা পুরোপুরি মনে প্রাণে তাঁর সাথে সহযোগিতা করো, তাঁর বিরোধিতা করা থেকে দূরে থাকো এবং তাঁর যথার্থ আদেশ পালনকারীতে পরিণত হও।

এ হুকুমটি নাযিল হবার পর বহু সাহাবী রসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেন, হে আল্লাহর রসূল! সালামের পদ্ধতি তো আপনি আমাদের বলে দিয়েছেন। (অর্থাৎ নামাযে “আসসালামু আলাইকা আইয়ূহান নাবীয্যু ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ” এবং দেখা সাক্ষাত হলে “আসসালামু আলাইকা ইয়া রসূলুল্লাহ” বলা।) কিন্তু আপনার প্রতি সালাত পাঠাবার পদ্ধতিটা কি? এর জবাবে নবী করীম ﷺ বিভিন্ন লোককে বিভিন্ন সময় যেসব দরূদ শিখিয়েছেন তা আমি নিচে উদ্ধৃত করছিঃ

কা’ব ইবনে ‘উজরাহ (রা.) থেকেঃ

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ

এ দরূদটি সামান্য শাব্দিক বিভিন্নতা সহকারে হযরত কা’ব ইবনে উজ্ রাহ (রাঃ) থেকে বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে ইমাম আহমাদ, ইবনে আবী শাইবাহ, আবদুর রাজ্জাক, ইবনে আবী হাতেম ও ইবনে জারীরে উদ্ধৃত হয়েছে। ‌‍

ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকেঃ তাঁর থেকেও হালকা পার্থক্য সহকারে ওপরে বর্ণিত একই দরূদ উদ্ধৃত হয়েছে। (ইবনে জারীর)

আবু হুমাইদ সায়েদী (রাঃ ) থেকেঃ

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ أَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّتِهِ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ أَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّتِهِ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ

(মুআত্তা ইমাম মালেক, মুসনাদে আহমাদ, বুখারী, মুসলিম, নাসাঈ, আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ)

আবু মাসউদ বদরী (রাঃ) থেকেঃ

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ فَى الْعَالَمِينَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ

(মালেক, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, আহমদ, ইবনে জারীর, ইবনে হাব্বান ও হাকেম)

আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকেঃ

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ عَبْدِكَ وَرَسُولِكَ ، كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ ، وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ ، كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ-

(আহমাদ, বুখারী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ)

বুরাইদাতাল খুযাঈ থেকেঃ

اللَّهُمَّ اجْعَلْ صَلَوَاتِكَ وَرَحْمَتَكَ وَبَرَكَاتِكَ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا جَعَلْتَهَا عَلَى إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ-

(আহমাদ, আবদ ইবনে হুমাইদ ও ইবনে মারদুইয়া)

হযরত আবু হুরাইরাহ (রাঃ ) থেকেঃ

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ وَبَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ آلِ إِبْرَاهِيمَ فِى الْعَالَمِينَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ- (নাসাঈ)

হযরত তালহা (রাঃ) থেকেঃ

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ (ইবনে জারীর)

এ দরূদগুলো শব্দের পার্থক্য সত্ত্বেও অর্থ সবগুলোর একই। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। এ বিষয়গুলো ভালোভাবে অনুধাবন করতে হবে।

প্রথমত, এসবগুলোতে নবী করীম ﷺ মুসলমানদেরকে বলেছেন, আমার ওপর দরূদ পাঠ করার সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হচ্ছে এই যে, তোমরা আল্লাহর কাছে এ মর্মে দোয়া করো, হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদের ﷺ ওপর দরূদ পাঠাও। অজ্ঞ লোকেরা, যাদের অর্থজ্ঞান নেই, তারা সঙ্গে সঙ্গেই আপত্তি করে বসে যে, এতো বড়ই অদ্ভূত ব্যাপার যে, আল্লাহ‌ তো আমাদের বলছেন তোমরা আমার নবীর ওপর দরূদ পাঠ করো কিন্তু অপর দিকে আমরা আল্লাহকে বলছি তুমি দরূদ পাঠাও। অথচ এভাবে নবী ﷺ লোকদেরকে একথা বলেছেন যে, তোমরা আমার প্রতি “সালাতের” হক আদায় করতে চাইলেও করতে পারো না, তাই আল্লাহরই কাছে দোয়া চাও যেন তিনি আমার প্রতি দরূদ পাঠান। একথা বলা নিষ্প্রয়োজন, আমরা নবী করীমের ﷺ মর্যাদা বুলন্দ করতে পারি না। আল্লাহই বুলন্দ করতে পারেন। আমরা নবী করীমের ﷺ অনুগ্রহের প্রতিদান দিতে পারি না। আল্লাহই তার প্রতিদান দিতে পারেন। আমরা নবী করীমের ﷺ কথা আলোচনাকে উচ্চমাপে পৌঁছাবার এবং তাঁর দ্বীনকে সম্প্রসারিত করার জন্য যতই প্রচেষ্টা চালাই না কেন আল্লাহর মেহেরবানী এবং তাঁর সুযোগ ও সহায়তা দান ছাড়া তাতে কোন প্রকার সাফল্য অর্জন করতে পারি না। এমন কি নবী করীমের ﷺ প্রতি ভক্তি ভালোবাসাও আমাদের অন্তরে আল্লাহরই সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। অন্যথায় শয়তান নাজানি কত রকম প্ররোচনা দিয়ে আমাদের তাঁর প্রতি বিরূপ করে তুলতে পারে। اعاذنا الله من ذلك- ---আল্লাহ‌ আমাদের তা থেকে বাঁচান। কাজেই নবী করীমের ﷺ ওপর দরূদের হক আদায় করার জন্য আল্লাহর কাছে তাঁর প্রতি সালাত বা দরূদের দোয়া করা ছাড়া আর কোন পথ নেই। যে ব্যক্তি “আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মুহাম্মাদিন” বলে সে যেন আল্লাহ‌ সমীপে নিজের অক্ষমতা স্বীকার করতে গিয়ে বলে, হে আল্লাহ! তোমার নবীর ওপর সালাত বা দরূদ পাঠানোর যে কর্তব্য আমার ওপর চাপানো আছে তা যথাযথভাবে সম্পন্ন করার সামর্থ্য আমার নেই, আমার পক্ষ থেকে তুমিই তা সম্পন্ন করে দাও এবং তা করার জন্য আমাকে যেভাবে কাজে নিয়োগ করতে হয় তা তুমি নিয়োগ করো।

দ্বিতীয়ত, নবী করীমের ﷺ ভদ্রতা ও মহানুভবতার ফলে তিনি কেবল নিজেকেই এ দোয়ার জন্য নির্দিষ্ট করে নেননি। বরং নিজের সাথে তিনি নিজের পরিজন স্ত্রী ও পরিবারকেও শামিল করে নিয়েছেন। স্ত্রী ও পরিবার অর্থ সুস্পষ্ট আর পরিজন শব্দটি নিছক নবী করীমের ﷺ পরিবারের লোকদের জন্য নির্দিষ্ট নয়। বরং এর মধ্যে এমনসব লোকও এসে যায় যারা তাঁর অনুসারী এবং তাঁর পথে চলেন। পরিজন অর্থে মূলে “আল” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আরবী ভাষার দৃষ্টিতে “আল” ও “আহল” --এর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে এই যে, কোন ব্যক্তির “আল” হচ্ছে এমন সব লোক যারা হয় তার সাথী, সাহায্যকারী ও অনুসারী, তারা তার আত্মীয় বা অনাত্মীয় হোক বা না হোক অবশ্যই তার আত্মীয়। কুরআন মজীদের ১৪টি স্থানে “আলে ফেরাউন” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে কোন জায়গায়ও “আহল” মানে ফেরাউনের পরিবারের লোকেরা নয়। বরং এমন সমস্ত লোক যারা হযরত মূসার মোকাবিলায় ফেরাউনের সমর্থক ও সহযোগী ছিল। (দৃষ্টান্ত স্বরূপ দেখুন সূরা বাকারার ৪৯-৫০, আলে ইমরানের ১১, আল আ’রাফের ১৩০ ও আল মু’মিনূনের ৪৬ আয়াতসমুহ) কাজেই এমন সমস্ত লোকই “আলে” মুহাম্মাদ ﷺ এর বহির্ভূত হয়ে যায় যারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শের অনুসারী নয়। চাই, তারা নবীর পরিবারের লোকই হোক না কেন। পক্ষান্তরে এমন সমস্ত লোক ও এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় যারা নবী করীমের ﷺ পদাংক অনুসরণ করে চলে, চাই তারা নবী করীমের ﷺ কোন দূরবর্তী রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয় নাই হোক। তবে নবী পরিবারের এমন প্রত্যেকটি লোক সর্বতোভাবেই “আলে” মুহাম্মাদের ﷺ অন্তর্ভুক্ত হবে যারা তাঁর সাথে রক্ত সম্পর্কও রাখে আবার তাঁর অনুসারীও।

তৃতীয়, তিনি যেসব দরূদ শিখিয়েছেন তার প্রত্যেকটিতেই অবশ্যই একথা রয়েছে যে, তাঁর প্রতি এমন অনুগ্রহ করা হোক যা ইবরাহীম ও ইবরাহীমের পরিজনদের ওপর করা হয়েছিল। এ বিষয়টি বুঝতে লোকদের বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আলেমগণ এর বিভিন্ন জটিল ব্যাখ্যা (তাবীল) করেছেন। কিন্তু কোন একটি ব্যাখ্যাও ঠিকমতো গ্রহণীয় নয়। আমার মতে এর সঠিক ব্যাখ্যা হচ্ছে এই যে, (অবশ্য আল্লাহই সঠিক জানেন) আল্লাহ‌ হযরত ইবরাহীমের প্রতি একটি বিশেষ করুণা করেন। আজ পর্যন্ত কারো প্রতি এ ধরনের করুণা প্রদর্শন করেননি। আর তা হচ্ছে এই যে, যারা নবুওয়াত, অহী ও কিতাবকে হিদায়াতের উৎস বলে মেনে নেয় তারা সবাই হযরত ইবরাহীমের (আ) নেতৃত্বের প্রশ্নে একমত। এ ব্যাপারে মুসলমান, খৃস্টান ও ইহুদির মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। কাজেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বক্তব্যের অর্থ হচ্ছে এই যে, যেভাবে হযরত ইবরাহীমকে মহান আল্লাহ‌ সমস্ত নবীর অনুসারীদের নেতায় পরিণত করেছেন। অনুরূপভাবে আমাকেও পরিণত করুন। এমন কোন ব্যক্তি যে নবুওয়াত মেনে নিয়েছে সে যেন আমার নবুওয়াতের প্রতি ঈমান আনা থেকে বঞ্চিত না হয়।

নবী করীমের ﷺ প্রতি দরূদ পড়া ইসলামের সুন্নাত। তাঁর নাম উচ্চারিত হলে তাঁর প্রতি দরূদ পাঠ করা মুস্তাহাব। বিশেষ করে নামাযে দরূদ পড়া সুন্নাত। এ বিষয়ে সমগ্র আলেম সমাজ একমত। সমগ্র জীবনে নবী (সা.) এর প্রতি একবার দরূদ পড়া ফরয, এ ব্যাপারে ইজমা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কারণ আল্লাহ‌ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এর হুকুম দিয়েছেন। কিন্তু এরপর দরূদের ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের মধ্যে বিভিন্ন মত দেখা দিয়েছে।

ইমাম শায়েঈ (র.) বলেন, নামাযে একজন মুসল্লী যখন শেষ বার তাশাহ্হুদ পড়ে তখন সেখানে সালাতুন আলান নবী (صلوة على النبى) পড়া ফরয। কোন ব্যক্তি এভাবে না পড়লে তার নামায হবে না। সাহাবীগণের মধ্য থেকে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.), হযরত আবু মাসউদ আনসারী (রা.), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) ও হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.), তাবেঈদের মধ্য থেকে শা’বী, ইমাম মুহাম্মাদ বাকের, মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব কুরযী ও মুকাতিল ইবনে হাউয়ান এবং ফকীহগণের মধ্য থেকে ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহও এ মতের প্রবক্তা ছিলেন। শেষের দিকে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বালও মত অবলম্বন করেন।

ইমাম আবু হানীফা (র), ইমাম মালেক (র) ও অধিকাংশ উলামা এ মত পোষণ করেন যে, দরূদ সারা জীবনে শুধুমাত্র একবার পড়া ফরয। এটি কালেমায়ে শাহাদাতের মতো। যে ব্যক্তি একবার আল্লাহকে ইলাহ বলে মেনে নিয়েছে এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতের স্বীকৃতি দিয়েছে সে ফরয আদায় করে দিয়েছে। অনুরূপভাবে যে একবার দরূদ পড়ে নিয়েছে সে নবীর ওপর সালাত পাঠ করার ফরয আদায়ের দায়িত্ব মুক্ত হয়ে গেছে। এরপর তার ওপর আর কালেমা পড়া ফরয নয় এবং দরূদ পড়াও ফরয নয়।

একটি দল নামাযে দরূদ পড়াকে সকল অবস্থায় ওয়াজিব গণ্য করেন। কিন্তু তারা তাশাহহুদের সাথে তাকে শৃংখলিত করেন না।

অন্য একটি দলের মতে প্রত্যেক দোয়ায় দরূদ পড়া ওয়াজিব। আরো কিছু লোক নবী করীমের ﷺ নাম এলে দরূদ পড়া ওয়াজিব বলে অভিমত পোষণ করেন। অন্য একটি দলের মতে এক মজলিসে নবী করীমের ﷺ নাম যতবারই আসুক না কেন দরূদ পড়া কেবলমাত্র একবারই ওয়াজিব।

কেবলমাত্র ওয়াজিব হবার ব্যাপারে এ মতবিরোধ। তবে দরূদের ফযীলত, তা পাঠ করলে প্রতিদান ও সওয়াব পাওয়া এবং তার একটি অনেক বড় সৎকাজ হবার ব্যাপারে তো সমস্ত মুসলিম উম্মাত একমত। যে ব্যক্তি ঈমানের সামান্যতম স্পর্শও লাভ করেছে তার এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন থাকতে পারে না। এমন প্রত্যেকটি মুসলমানের অন্তর থেকেই তো স্বাভাবিকভাবে দরূদ বের হবে যার মধ্যে এ অনুভূতি থাকবে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর পরে আমাদের প্রতি সবচেয়ে বড় অনুগ্রহকারী। মানুষের দিলে ঈমান ও ইসলামের মর্যাদা যত বেশী হবে তত বেশী মর্যাদা হবে তার দিলে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুগ্রহেরও। আর মানুষ যত বেশী এ অনুগ্রহের কদর করতে শিখবে তত বেশীই সে নবী করীমের ﷺ ওপর দরূদ পাঠ করবে। কাজেই বেশী বেশী দরূদ পড়া হচ্ছে একটি মাপকাঠি। এটি পরিমাপ করে জানিয়ে দেয় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দ্বীনের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কতটা গভীর এবং ঈমানের নিয়ামতের কতটা কদর তার অন্তরে আছে। এ কারণেই নবী ﷺ বলেছেনঃ

مَنْ صَلَّى عَلَىَّ صَلاَةً لَمْ تَزَلِ الْمَلاَئِكَةُ تُصَلِّى عَلَيْهِ مَا صَلَّى عَلَىَّ

“যে ব্যক্তি আমার প্রতি দরূদ পাঠ করে ফেরেশতারা তার প্রতি দরূদ পাঠ করে যতক্ষণ সে দরূদ পাঠ করতে থাকে।” (আহমাদ ও ইবনে মাজাহ)

مَنْ صَلَّى عَلَىَّ وَاحِدَةً صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ عَشْرًا

“যে আমার ওপর একবার দরূদ পড়ে আল্লাহ‌ তার ওপর দশবার দরূদ পড়েন।” (মুসলিম)

أَوْلَى النَّاسِ بِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَكْثَرُهُمْ عَلَىَّ صَلاَةً(ترمذى)

“কিয়ামতের দিন আমার সাথে থাকার সবচেয়ে বেশী হকদার হবে সেই ব্যক্তি যে আমার ওপর সবচেয়ে বেশী দরূদ পড়বে।” (তিরযিমী)

الْبَخِيلُ الَّذِى مَنْ ذُكِرْتُ عِنْدَهُ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَىَّ(ترمذى)

“আমার কথা যে ব্যক্তির সামনে আলোচনা করা হয় এবং সে আমার ওপর দরূদ পাঠ করে না সে কৃপণ।” (তিরযিমী)

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম ছাড়া অন্যের জন্য اللهم صل على فلان অথবা صلى الله عليه وسلم কিংবা এ ধরনের অন্য শব্দ সহকারে ‘সালাত’ পেশ করা জায়েয কিনা, এ ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। একটি দল, কাযী ঈয়াযের নাম এ দলের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, একে সাধারণভাবে জায়েয মনে করে। এদের যুক্তি হচ্ছে, কুরআনে আল্লাহ‌ নিজেই অ-নবীদের ওপর একাধিক জায়গায় সালাতের কথা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন। যেমন

أُولَئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ (البقرة-157) خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ (التوبة-103) هُوَ الَّذِي يُصَلِّي عَلَيْكُمْ وَمَلَائِكَتُهُ (الاحزاب-43)

এভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামাও একাধিকবার অ-নবীদের জন্য সালাত শব্দ সহকারে দোয়া করেন। যেমন একজন সাহাবীর জন্য তিনি দোয়া করেন الهم صل على ال ابى اوفى (যে আল্লাহ! আবু আওফার পরিজনদের ওপর সালাত পাঠাও) হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহর (রা.) স্ত্রীর আবেদনের জবাবে বলেন, صلى الله عليك وعلى زوجك (আল্লাহ তোমার ও তোমার স্বামীর ওপর সালাত পাঠান)। যারা যাকাত নিয়ে আসতেন তাদের পক্ষে তিনি বলতেন, الهم صل عليهم (হে আল্লাহ!‌ ওদের ওপর সালাত পাঠাও)। হযরত সা’দ ইবনে উবাদার পক্ষে তিনি বলেন, الهم اجعل صلوتك ورحمتك على ال سعدبن عباده (হে আল্লাহ!‌ সা’দ ইবনে উবাদার (রা.) পরিজনদের ওপর তোমার সালাত ও রহমত পাঠাও)। আবার মু’মিনের রূহ সম্পর্কে নবী করীম ﷺ খবর দিয়েছেন যে, ফেরেশতারা তার জন্য দোয়া করেঃ صلى الله عليك وعلى جسدك কিন্তু মুসলিম উম্মাহর অধিকাংশের মতে এমনটি করা আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূলে জন্য তো সঠিক ছিল কিন্তু আমাদের জন্য সঠিক নয়। তারা বলেন, সালাত ও সালামকে মুসলমানরা আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। এটি বর্তমানে তাদের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। তাই নবীদের ছাড়া অন্যদের জন্য এগুলো ব্যবহার না করা উচিত। এজন্যই হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয একবার নিজের একজন শাসন কর্তাকে লিখেছিলেন, “আমি শুনেছি কিছু বক্তা এ নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করতে শুরু করেছেন যে, ‘তারা সালাতু আলান নাবী’ --এর মতো নিজেদের পৃষ্ঠপোষক ও সাহায্য কারীদের জন্যও “সালাত” শব্দ ব্যবহার করছেন। আমার এ পত্র পৌঁছে যাবার পরপরই তাদেরকে এ কাজ থেকে নিরস্ত করো এবং সালাতকে একমাত্র নবীদের জন্য নির্দিষ্ট করে অন্য মুসলমানদের জন্য দোয়া করেই ক্ষান্ত হবার নিদের্শ দাও।” (রুহুল মা’আনী) অধিকাংশ আলেম এ মতও পোষণ করেন যে, নবী করীম ﷺ ছাড়া অন্য কোন নবীর জন্যও “সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম” ব্যবহার করা সঠিক নয়।

১০৮.
আল্লাহকে কষ্ট দেবার অর্থ হয় দু’টি জিনিস। এক, তাঁর নাফরমানি করা। তাঁর মোকাবিলায় কুফরী, শিরক ও নাস্তিক্যবাদের পথ অবলম্বন করা। তিনি যা হারাম করেছেন তাকে হালাল করা। দুই, তাঁর রসূলকে কষ্ট দেয়া কারণ রসূলের আনুগত্য যেমন আল্লাহর আনুগত্য ঠিক তেমনি রসূলের নিন্দাবাদ আল্লাহর নিন্দাবাদের শামিল। রসূলের বিরোধিতা আল্লাহর বিরোধিতার সমার্থক। রসূলের নাফরমানি আল্লাহরই নাফরমানি।
১০৯.
এ আয়াতটি অপবাদের সংজ্ঞা নিরূপণ করে। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে যে দোষ নেই অথবা যে অপরাধ মানুষ করেনি তা তার ওপর আরোপ করা। নবী ﷺ ও এটি সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন। আবু দাউদ ও তিরমিযী বর্ণনা করেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হয়, গীবত কি? জবাবে বলেনঃ ذكرك اخاك بما يكره “তোমার নিজের ভাইয়ের আলোচনা এমনভাবে কর যা সে অপছন্দ করে।” জিজ্ঞেস করা হয়, যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে সেই দোষ সত্যিই থেকে থাকে? জবাব দেনঃ

ان كان فيه ما تقول فقد اغتبته وان لم يكن فيه ماتقوم فقد بهته

“তুমি যে দোষের কথা বলছো তা যদি তার মধ্যে থাকে তাহলে তুমি তার গীবত করলে আর যদি তা তার মধ্যে না থাকে তাহলে তার ওপর অপবাদ দিলে।”

এ কাজটি কেবলমাত্র একটি নৈতিক গোনাহই নয়, আখেরাতে যার শাস্তি পাওয়া যাবে বরং এ আয়াতের দাবী হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রের আইনেও মিথ্যা অপবাদ দান করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ গণ্য করতে হবে।

.
১১০.
মূল শব্দগুলো হচ্ছে, يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ আরবী ভাষায় ‌‘জিলবাব’‍‍‍‍ বলা হয় বড় চাদরকে। আর ‘ইদন’ (ادناء) শব্দের আসল মানে হচ্ছে নিকটবর্তী করা ও ঢেকে নেয়া। কিন্তু যখন তার সাথে ‘আলা’ অব্যয় (Preposition) বসে তখন তার মধ্যে ইরখা (ارخاء) অর্থাৎ ওপর থেকে ঝুলিয়ে দেয়ার অর্থ সৃষ্টি হয়। বর্তমান যুগের কোন কোন অনুবাদক ও তাফসীরকার পাশ্চাত্য ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে এ শব্দের অনুবাদ করেন শুধুমাত্র “জড়িয়ে নেয়া” যাতে চেহারা কোনভাবে ঢেকে রাখার হুকুমের বাইরে থেকে যায়। কিন্তু যা বর্ণনা করছেন আল্লাহর উদ্দেশ্য যদি তাই হতো, তাহলে তিনি يدنين اليهن বলতেন। যে ব্যক্তিই আরবী ভাষা জানেন তিনি কখনো একথা মেনে নিতে পারেন না যে, يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ মানে কেবলমাত্র জড়িয়ে নেয়া হতে পারে। তাছাড়া مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ শব্দ দু’টি এ অর্থ গ্রহণ করার পথে আরো বেশী বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। একথা সুস্পষ্ট যে, এখানে মিন (من) শব্দটি ‘কিছু’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ চাদরের এক অংশ। আর এটাও সুস্পষ্ট যে, জড়িয়ে নিতে হলে পুরো চাদর জড়াতে হবে, নিছক তার একটা অংশ নয়। তাই আয়াতের পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে, নারীরা যেন নিজেদের চাদর ভালোভাবে জড়িয়ে ঢেকে নিয়ে তার একটি অংশ বা একটি পাল্লা নিজেদের ওপর লটকিয়ে দেয়, সাধারণভাবে যাকে বলা হয় ঘোমটা।

নবুওয়াত যুগের নিকটবর্তী কালের প্রধান মুফাসসিরগণ এর এ অর্থই বর্ণনা করেন। ইবনে জারীর ও ইবনুল মুনযিরের বর্ণনা মতে মুহাম্মাদ ইবনে সিরীন (রা.) হযরত উবাইদাতুস সালমানীর কাছে এ আয়াতটির অর্থ জিজ্ঞেস করেন। (এই হযরত উবাইদাহ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে মুসলমান হন কিন্তু তাঁর খিদমতে হাযির হতে পারেননি। হযরত উমরের (রা.) আমলে তিনি মদীনা আসেন এবং সেখানেই থেকে যান। তাঁকে ফিকহ ও বিচার সংক্রান্ত বিষয়ে কাযী শুরাইহ-এর সমকক্ষ মনে করা হতো।) তিনি জবাবে কিছু বলার পরিবর্তে নিজের চাদর তুলে নেন এবং তা দিয়ে এমনভাবে মাথা ও শরীর ঢেকে নেন যে তার ফলে পুরো মাথা ও কপাল এবং পুরো চেহারা ঢাকা পড়ে যায়, কেবলমাত্র একটি চোখ খোলা থাকে। ইবনে আব্বাসও প্রায় এই একই ব্যাখ্যা করেন। তাঁর যেসব উক্তি ইবনে জারীর, ইবনে আবি হাতেম ও ইবনে মারদুইয়া উদ্ধৃত করেছেন তা থেকে তাঁর যে বক্তব্য পাওয়া যায় তা হচ্ছে এই যে, “আল্লাহ মহিলাদেরকে হুকুম দিয়েছেন যে, যখন তারা কোন কাজে ঘরের বাইরে বের হবে তখন নিজেদের চাদরের পাল্লা ওপর দিয়ে লটকে দিয়ে যেন নিজেদের মুখ ঢেকে নেয় এবং শুধুমাত্র চোখ খোলা রাখে।” কাতাদাহ ও সুদ্দীও এ আয়াতের এ ব্যাখ্যাই করেছেন।

সাহাবা ও তাবে’ঈদের যুগের পর ইসলামের ইতিহাসে যত বড় বড় মুফাসসির অতিক্রান্ত হয়েছেন তাঁরা সবাই একযোগে এ আয়াতের এ অর্থই বর্ণনা করেছেন। ইমাম ইবনে জারীর তাবারী বলেনঃ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ অর্থাৎ ভদ্র ঘরের মেয়েরা যেন নিজেদের পোশাক আশাকে বাঁদীদের মতো সেজে ঘর থেকে বের না হয়। তাদের চেহারা ও কেশদাম যেন খোলা না থাকে। বরং তাদের নিজেদের ওপর চাদরের একটি অংশ লটকে দেয়া উচিত। ফলে কোন ফাসেক তাদেরকে উত্যক্ত করার দুঃসাহস করবে না। (জামেউল বায়ান ২২ খন্ড, ৩৩ পৃষ্ঠা)।

আল্লামা আবু বকর জাসসাস বলেন, “এ আয়াতটি প্রমাণ করে, যবুতী মেয়েদের চেহারা অপরিচিত পুরুষদের থেকে লুকিয়ে রাখার হুকুম দেয়া হয়েছে। এই সাথে ঘর থেকে বের হবার সময় তাদের সতর ও পবিত্রতা সম্পন্না হবার কথা প্রকাশ করা উচিত। এর ফলে সন্দেহযুক্ত চরিত্র ও কর্মের অধিকারী লোকেরা তাদেরকে দেখে কোন প্রকার লোভ ও লালসার শিকার হবে না।” (আহকামুল কুরআন, ৩ খন্ড, ৪৫৮ পৃষ্ঠা)

আল্লামা যামাখশারী বলেন, يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ অর্থাৎ তারা যেন নিজেদের চাদরের একটি অংশ লটকে নেয় এবং তার সাহায্যে নিজেদের চেহারা ও প্রান্তভাগগুলো ভালোভাবে ঢেকে নেয়।” (আল কাশশাফ, ২ খন্ড, ২২ পৃষ্ঠা)

আল্লামা নিযামুদ্দীন নিশাপুরী বলেন, يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ অর্থাৎ নিজেদের ওপর চাদরের একটি অংশ লটকে দেয়। এভাবে মেয়েদেরকে মাথা ও চেহারা ঢাকার হুকুম দেয়া হয়েছে। (গারায়েবুল কুরআন ২২, খন্ড ৩২ পৃষ্ঠা)

ইমাম রাযী বলেনঃ “এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, লোকেরা যেন জানতে পারে এরা দুশ্চরিত্রা মেয়ে নয়। কারণ যে মেয়েটি নিজের চেহারা ঢাকবে, অথচ চেহারা সতরের অন্তর্ভুক্ত নয়, তার কাছে কেউ আশা করতে পারে না যে, সে নিজের ‘সতর’ অন্যের সামনে খুলতে রাজী হবে। এভাবে প্রত্যেক ব্যক্তি জানবে, এ মেয়েটি পর্দানশীল, একে যিনার কাজে লিপ্ত করার আশা করা যেতে পারে না।” (তাফসীরে কবীর, ২ খন্ড, ৫৯১ পৃষ্ঠা)

এ আয়াত থেকে পরোক্ষভাবে আর একটি বিষয়ের সন্ধান পাওয়া যায়। অর্থাৎ এখান থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কয়েকটি কন্যা থাকার কথা প্রমাণিত হয়। কারণ, আল্লাহ‌ বলছেন, “হে নবী! তোমার স্ত্রীদের ও কন্যাদেরকে বলো।” এ শব্দাবলী এমনসব লোকদের উক্তি চূড়ান্তভাবে খন্ডন করে যারা আল্লাহর ভয়শূন্য হয়ে নিসংকোচে এ দাবী করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কেবলমাত্র একটি কন্যা ছিল এবং তিনি ছিলেন, হযরত ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা। বাদবাকি অন্য কন্যারা তাঁর ঔরসজাত ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন তাঁর স্ত্রীর পূর্ব স্বামীর ঔরসজাত এবং তাঁর কাছে প্রতিপালিত। এ লোকেরা বিদ্বেষে অন্ধ হয়ে একথাও চিন্তা করেন না যে, নবী সন্তানদেরকে তাঁর ঔরসজাত হবার ব্যাপারটি অস্বীকার করে তারা কতবড় অপরাধ করছেন এবং আখেরাতে এজন্য তাদেরকে কেমন কঠিন জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হবে। সমস্ত নির্ভরযোগ্য হাদীস এ ব্যাপারে ঐকমত্য ব্যক্ত করেছে যে, হযরত খাদীজার (রা.) গর্ভে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কেবলমাত্র একটি সন্তান হযরত ফাতেমা (রা.) জন্ম গ্রহণ করেননি বরং আরো তিন কন্যাও জন্মলাভ করে। নবী করীমের ﷺ সবচেয়ে প্রাচীন সীরাত লেখক মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক হযরত খাদীজার সাথে নবী করীমের ﷺ বিয়ের ঘটনা উল্লেখ করার পর বলেনঃ “ইবরাহীম ছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমস্ত ছেলে মেয়ে তাঁরই গর্ভে জন্ম নেয়। তাদের নাম হচ্ছেঃ কামেস, তাহের ও তাইয়েব এবং যয়নব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম ও ফাতেমা। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ খন্ড, ২০২ পৃষ্ঠা) প্রখ্যাত বংশতালিকা বিশেষজ্ঞ হিশাম ইবনে মুহাম্মাদ ইবনুস সায়েব কালবির বর্ণনা হচ্ছেঃ “নবুওয়াত লাভের পূর্বে মক্কায় জন্ম গ্রহণকারী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রথম সন্তান হলো কাসেম। তারপর জন্ম লাভ করে যয়নব, তারপর রুকাইয়া, তারপর উম্মে কুলসুম।” (তাবকাতে ইবনে সা’দ, ১খন্ড, ১৩৩ পৃষ্ঠা) ইবনে হাযম জাওয়ামেউস সিয়ারে লিখেছেন, হযরত খাদীজার (রা.) গর্ভে নবী করীমের ﷺ চারটি কন্যা জন্ম গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে সবার বড় ছিলেন হযরত যয়নব (রা.), তাঁর ছোট ছিলেন হযরত রুকাইয়া (রা.), তাঁর ছোট ছিলেন হযরত ফাতেমা (রা.) এবং তাঁর ছোট ছিলেন উম্মে কুলসুম (রা.) (পৃষ্ঠা ৩৮-৩৯) তাবারী, ইবনে সা’দ আল মুহাব্বার গ্রন্থ প্রণেতা আবু জাফর মুহাম্মাদ ইবনে হাবীব এবং আল ইসতি’আব গ্রন্থ প্রণেতা ইবনে আবদুল বার নির্ভরযোগ্য বরাতের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্বে হযরত খাদীজার (রা.) আরো দু’জন স্বামী অতিক্রান্ত হয়েছিল। একজন ছিলেন আবু হালাহ তামিমী, তাঁর ঔরসে জন্ম নেয় হিন্দ ইবনে আবু হালাহ। দ্বিতীয় জন ছিলেন আতীক ইবনে আয়েদ মাখযূমী। তাঁর ঔরসে হিন্দ নামে এক মেয়ের জন্ম হয়। তারপর তাঁর বিয়ে হয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে। সকল বংশ তালিকা বিশেষজ্ঞ এ ব্যাপারে একমত যে তাঁর ঔরসে হযরত খাদীজার (রা.) গর্ভে ওপরে উল্লেখিত চার কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। (দেখুন তাবারী, ২ খন্ড, ৪১১ পৃষ্ঠা তাবকাত ইবনে সা’দ, ৮ খন্ড, ১৪-১৬ পৃষ্ঠা, কিতাবুল মুহাব্বার, ৭৮, ৭৯ ও ৪৫২ পৃষ্ঠা এবং আল ইসতি’আব, ২খন্ড, ৭১৮ পৃষ্ঠা।) এ সমস্ত বর্ণনা নবী করীমের ﷺ একটি নয় বরং কয়েকটি মেয়ে ছিল, কুরআন মজীদের এ বর্ণনাকে অকাট্য প্রমাণ করে।

১১১.
“চিনে নেয়া যায়” এর অর্থ হচ্ছে, তাদেরকে এ ধরনের অনাড়ম্বর লজ্জা নিবারণকারী পোশাকে সজ্জিত দেখে প্রত্যেক প্রত্যক্ষকারী জানবে তারা অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের পূত-পবিত্র মেয়ে, এমন ভবঘুরে অসতী ও পেশাদার মেয়ে নয়, কোন অসদাচারী মানুষ যার কাছে নিজের কামনা পূর্ণ করার আশা করতে পারে। “না কষ্ট দেয়া হয়” এর অর্থ হচ্ছে এই যে, তাদেরকে যেন উত্যক্ত ও জ্বালাতন না করা হয়।

এখানে কিছুক্ষণ থেমে একবার একথাটি অনুবাধন করার চেষ্টা করুন যে, কুরআনের এ হুকুম এবং এ হুকুমের যে উদ্দেশ্য আল্লাহ‌ নিজেই বর্ণনা করেছেন তা ইসলামী সমাজ বিধানের কোন্ ধরনের প্রাণ শত্তির প্রকাশ ঘটাচ্ছে। ইতিপূর্বে সূরা নূরের ৩১ আয়াতে এ নির্দেশ আলোচিত হয়েছে যে, মহিলারা তাদের সাজসজ্জা অমুক অমুক ধরনের পুরুষ ও নারীদের ছাড়া আর কারো সামনে প্রকাশ করবে না। “আর মাটির ওপর পা দাপিয়ে চলবে না, যাতে যে সৌন্দর্য তারা লুকিয়ে রেখেছে লোকেরা যেন তা জেনে না ফেলে।” এ হুকুমের সাথে যদি সূরা আহযাবের এ আয়াতটি মিলিয়ে পড়া হয় তাহলে পরিষ্কার জানা যায় যে, এখানে চাদর দিয়ে ঢাকার যে হুকুম এসেছে অপরিচিতদের থেকে সৌন্দর্য লুকানোই হচ্ছে তার উদ্দেশ্য। আর একথা সুস্পষ্ট যে, এ উদ্দেশ্য তখনই পূর্ণ হতে পারে যখন চাদরটি হবে সাদামাটা। নয়তো একটি উন্নত নকশাদার ও দৃষ্টিনন্দন কাপড় জড়িয়ে নিলে তো উল্টো এ উদ্দেশ্য আরো খতম হয়ে যাবে। তাছাড়া আল্লাহ‌ কেবল চাদর জড়িয়ে সৌন্দর্য ঢেকে রাখার হুকুম দিচ্ছেন না বরং একথাও বলছেন যে, মহিলারা যেন চাদরের একটি অংশ নিজেদের ওপর লটকে দেয়। কোন বিচক্ষণ বিবেকবান ব্যক্তি এ উক্তিটির এছাড়া দ্বিতীয় কোন অর্থ করতে পারেন না যে, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ঘোমটা দেয়া যাতে শরীর ও পোশাকের সৌন্দর্য ঢাকার সাথে সাথে চেহারাও ঢাকা পড়বে। তারপর আল্লাহ‌ নিজেই এ হুকুমটির ‘ইল্লাত’ (কার্যকারণ) এ বর্ণনা করেছেন যে, এটি এমন একটি সর্বাধিক উপযোগী পদ্ধতি যা থেকে মুসলমান মহিলাদেরকে চিনে নেয়া যাবে এবং তারা উত্যক্ত হবার হাত থেকেও বেঁচে যাবে। এ থেকে আপনা-আপনিই একথা প্রকাশ হয়ে যায় যে, এ নিদের্শ এমন সব মহিলাকে দেয়া হচ্ছে যারা পুরুষদের হাতে উত্যক্ত হবার এবং তাদের দৃষ্টিতে পড়ার ও তাদের কামনা-লালসার বস্তুতে পরিণত হবার ফলে আনন্দ অনুভব করার পরিবর্তে একে নিজেদের জন্য কষ্টদায়ক লাঞ্ছনাকর মনে করে, যারা সমাজে নিজেদেরকে বে-আবরু মক্ষিরাণী ধরনের মহিলাদের মধ্যে গণ্য করাতে চায় না। বরং সতী-সাধ্বী গৃহ প্রদীপ হিসেবে পরিচিত হতে চায়। এ ধরনের শরীফ ও পূত চরিত্রের অধিকারিনী সৎকর্মশীলা মহিলাদের সম্পর্কে আল্লাহ‌ বলেন, যদি সত্যিই তোমরা এভাবে নিজেদেরকে পরিচিত করাতে চাও এবং পুরুষদের যৌন লালসার দৃষ্টি সত্যিই তোমাদের জন্য আনন্দাদায়ক না হয়ে কষ্টকর হয়ে থাকে, তাহলে এজন্য তোমরা খুব ভালোভাবে সাজসজ্জা করে বাসর রাতের কনে সেজে ঘর থেকে বের হয়ো না এবং দর্শকদের লালসার দৃষ্টির সামনে নিজেদের সৌন্দর্যকে উজ্জল করে তুলে ধরো না। কেননা এটা এর উপযোগী পদ্ধতি নয়। বরং এজন্য সর্বাধিক উপযোগী পদ্ধতি এই হতে পারে যে, তোমরা একটি সাদামাটা চাদরে নিজেদের সমস্ত সৌন্দর্য ও সাজসজ্জা ঢেকে বের হবে, চেহারা ঘোমটার আড়ালে রাখবে এবং এমনভাবে চলবে যাতে অলংকারের রিনিঝিনি আওয়াজ লোকদেরকে তোমাদের প্রতি আকৃষ্ট করবে না। বাইরে বের হবার আগে যেসব মেয়ে সাজগোজ করে নিজেদেরকে তৈরী করে এবং ততক্ষণ ঘরের বাইরে পা রাখে না যতক্ষন অপরূপ সাজে নিজেদেরকে সজ্জিতা না করে নেয়, তাদের এর উদ্দেশ্য এছাড়া আর কি হতে পারে যে, তারা সারা দুনিয়ার পুরুষদের জন্য নিজেদেরকে দৃষ্টিনন্দন করতে চায় এবং তাদেরকে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করতে চায়। এরপর যদি তারা বলে, দর্শকদের ভ্রূভংগী তাদেরকে কষ্ট দেয়, এরপর যদি তাদের দাবী হয় তারা “সমাজের মক্ষিরানী” এবং “সর্বজনপ্রিয় মহিলা” হিসেবে নিজেদেরকে চিত্রিত করতে চায় না বরং পূত-পবিত্রা গৃহিনী হয়েই থাকতে চায়, তাহলে এটা একটা প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষের কথা তার নিয়ত নির্ধারণ করে না বরং কাজেই তার আসল নিয়ত প্রকাশ করে। কাজেই যে নারী আকর্ষণীয়া হয়ে পর পুরুষের সামনে যায়, তার এ কাজটির পেছনে কোন্ ধরনের উদ্দেশ্য কাজ করছে সেটা ঐ কাজ দ্বারাই প্রকাশ পায়। কাজেই এসব মহিলাদের থেকে যা আশা করা যেতে পারে ফিতনাবাজ লোকেরা তাদের থেকে তাই আশা করে থাকে। কুরআন মহিলাদেরকে বলে, তোমরা একই সঙ্গে “গৃহপ্রদীপ” ও “সমাজের মক্ষিরাণী” হতে পারো না। গৃহপ্রদীপ হতে চাইলে সমাজের মক্ষিরাণী হবার জন্য যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয় তা পরিহার করো এবং এমন জীবনধারা অবলম্বন করো যা গৃহপ্রদীপ হতে সাহায্য করতে পারে। কোন ব্যক্তির ব্যক্তিগত মত কুরআনের অনুকূল হোক বা তার প্রতিকূল এবং তিনি কুরআনের পথনিদের্শককে নিজের কর্মনীতি হিসেবে গ্রহণ করতে চান বা না চান, মোটকথা তিনি যদি ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে জাল-জুয়াচুরির পথ অবলম্বন করতে না চান, তাহলে কুরআনের অর্থ বুঝতে তিনি ভুল করতে পারেন না। তিনি যদি মুনাফিক না হয়ে থাকেন, তাহলে পরিষ্কারভাবে একথা মেনে নেবেন যে, ওপরে যা বর্ণনা করা হয়েছে তাই হচ্ছে কুরআনের উদ্দেশ্য। এরপর তিনি যে বিরুদ্ধাচরণই করবেন একথা মেনে নিয়েই করবেন যে, তিনি কুরআন বিরোধী কাজ করছেন অথবা কুরআনের নিদের্শনাকে ভুল মনে করছেন।

১১২.
অর্থাৎ ইতিপূর্বে জাহেলী জীবন যাপন করার সময় যেসব ভুল করা হয় আল্লাহ‌ নিজ মেহেরবানীতে তা ক্ষমা করে দেবেন তবে এজন্য শর্ত হচ্ছে, এখন পরিষ্কার পথ নিদের্শ লাভ করার পর তোমরা নিজেদের কর্মধারা সংশোধন করে নেবে এবং জেনে বুঝে তার বিরুদ্ধাচরণ করবে না।
১১৩.
“মনের গলদ” বলতে এখানে দু’ধরনের গলদের কথা বলা হয়েছে। এক, মানুষ নিজেকে মুসলমানদের মধ্যে গণ্য করা সত্ত্বেও ইসলাম ও মুসলমানদের অশুভাকাংখী হয়। দুই, মানুষ অসৎ সংকল্প, লাস্পট্য ও অপরাধী মানসিকতার আশ্রয় নেয় এবং তার পূতিগন্ধময় প্রবণতাগুলো তার উদ্যোগ, আচরণ ও কর্মকাণ্ড থেকে বিচ্ছুরিত হতে থাকে।
১১৪.
এখানে এমন সব লোকের কথা বলা হয়েছে যারা মুসলমানদের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্ক ছড়াবার এবং তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেবার জন্য সেসময় প্রতি দিন মদীনায় এ ধরনের গুজব ছড়িয়ে বেড়াতো যে, অমুক জায়গায় মুসলমানরা খুব বেশী মার খেয়ে গেছে, অমুক জাগয়ায় মুলসমানদের বিরুদ্ধে বিপুল শক্তিশালী সমাবেশ ঘটছে এবং শিগগির মদীনার ওপর অতর্কিত হামলা হবে। এই সঙ্গে তাদের আর একটি কাজ এও ছিল যে, তারা নবীর পরিবার ও শরীফ মুসলমানদের পারিবারিক জীবন সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকার অলীক গল্প তৈরি করে সেগুলো ছড়াতে থাকতো, যাতে এর ফলে জনগণের মধ্যে কুধারণা সৃষ্টি হয় এবং মুসলমানদের নৈতিক প্রভাব ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
.
অনুবাদ: