আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১
আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২
আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২
আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩
আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭
আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১
আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০
আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭
আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০
আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২
আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫
হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২
ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২
আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮
বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪
আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫
আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮
আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০
আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫
আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫
আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০
আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭
ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১
আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬
ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭
আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০
আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯
আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২
আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০
আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬
আলোচ্য আয়াত থেকে এ মূলনীতিও স্থিরীকৃত হয় যে, যেখানে মর্যাদা যত বেশী হবে এবং যত বেশী বিশ্বস্ততার আশা করা হবে যেখানে মর্যাদাহানি ও অবিশ্বস্ততার অপরাধ ততবেশী কঠোর হবে এবং এ সঙ্গে তার শাস্তিও হবে তত বেশী কঠিন। যেমন মসজিদে শরাব পান করা নিজ গৃহে শরাব পান করার চেয়ে বেশী ভয়াবহ অপরাধ এবং এর শাস্তিও বেশী কঠোর। মাহরাম নারীদের সাথে যিনা করা অন্য নারীদের সাথে যিনা করার তুলনায় বেশী গোনাহের কাজ এবং এজন্য শাস্তিও হবে বেশী কঠিন।
এখন চিন্তার বিষয় হচ্ছে যে, দ্বীন নারীকে ভিন্ পুরুষের সাথে কোমল স্বরে কথা বলার অনুমতি দেয় না এবং পুরুষদের সাথে অপ্রয়োজনে কথা বলতেও তাদেরকে নিষেধ করে, সে কি কখনো নারীর মঞ্চে এসে নাচগান করা, বাজনা বাজানো ও রঙ্গরস করা পছন্দ করতে পারে? সে কি রেডিও-টেলিভিশনে নারীদের প্রেমের গান গেয়ে এবং সুমিষ্ট স্বরে অশ্লিল রচনা শুনিয়ে লোকদের আবেগকে উত্তেজিত করার অনুমতি দিতে পারে? নারীরা নাটকে কখনো কারো স্ত্রীর এবং কখনো কারো প্রেমিকার অভিনয় করবে, এটাকে কি সে বৈধ করতে পারে? অথবা তাদেরকে বিমানবালা (Air-hostess) করা হবে এবং বিশষভাবে যাত্রীদের মন ভোলাবার প্রশিক্ষণ দেয়া হবে, কিংবা ক্লাবে, সামাজিক উৎসবে ও নারী-পুরুষের মিশ্র অনুষ্ঠানে তারা চমকপ্রদ সাজ-সজ্জা করে আসবে এবং পুরুষদের সাথে অবাধে মিলেমিশে কথাবার্তা ও ঠাট্টা-তামাসা করবে, এসবকে কি সে বৈধ বলবে? এ সংস্কৃতি উদ্ভাবন করা হয়েছে কোন্ কুরআন থেকে? আল্লাহর নাযিল করা কুরআন তো সবার সামনে আছে। সেখানে কোথাও যদি এ সংস্কৃতির অবকাশ দেখা যায় তাহলে সেখানটা চিহ্নিত করা হোক।
مَنْ قَعَدَةْ مِنْكُنَّ فِى بَيْتِهَا فَاِنَّهَا تَدْرِكَ عَمَلَ الْمُجَاهِدِيْن-
“তোমাদের মধ্য থেকে যে গৃহমধ্যে বসে যাবে সে মুজাহিদদের মর্যাদা লাভ করবে।” অর্থাৎ মুজাহিদ তো তখনই স্থিরচিত্তে আল্লাহ পথে লড়াই করতে পারবে যখন নিজের ঘরের দিক থেকে সে পূর্ণ নিশ্চিন্ত থাকতে পারবে, তার স্ত্রী তার গৃহস্থালী ও সন্তানদেরকে আগলে রাখবে এবং তার অবর্তমানে তার স্ত্রী কোন অঘটন ঘটাবে না, এ ব্যাপারে সে পুরোপুরি আশঙ্কামুক্ত থাকবে। যে স্ত্রী তার স্বামীকে এ নিশ্চিন্ততা দান করবে সে ঘরে বসেও তার জিহাদে পুরোপুরি অংশীদার হবে। অন্য একটি হাদীস বায্যার ও তিরমিযী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে উদ্ধৃত করেছেন। তাতে তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ উক্তি বর্ণনা করেছেনঃ
ان الْمَرْأَةُ عَوْرَةٌ فَإِذَا خَرَجَتِ اسْتَشْرَفَهَا الشَّيْطَانُ وَاَقْرَبَ مَا تَكُوْنُ بِرَوْحَةٍ رَبِّهَا وَهِى فِى قَعْرِ بَيْتِهَا-
“নারী পর্দাবৃত থাকার জিনিস। যখন সে বের হয় শয়তান তার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে এবং তখনই সে আল্লাহর রহমতের নিকটতর হয় যখন সে নিজের গৃহে অবস্থান করে।” (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফসীর সূরা নূর ৪৯ টীকা)
কুরআন মজীদের এ পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট হুকুমের উপস্থিতিতে মুসলমান নারীদের জন্য অবকাশ কোথায় কাউন্সিল ও পার্লামেন্টে সদস্য হবার, ঘরের বাইরে সামাজিক কাজকর্মে দৌঁড়াদৌঁড়ি করার, সরকারী অফিসে পুরুষদের সাথে কাজ করা, কলেজে ছেলেদের সাথে শিক্ষালাভ করার, পুরুষদের হাসপাতলে নার্সিংয়ের দায়িত্ব সম্পাদন করার, বিমানে ও রেলগাড়িতে যাত্রীদের সেবা করার দায়িত্বে নিয়োজিত হবার এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভের জন্য তাদেরকে আমেরিকায় ও ইংল্যাণ্ড পাঠাবার? নারীদের ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করার বৈধতার সপক্ষে সবচেয়ে যে যুক্তি পেশ করা হয় সেটি হচ্ছে এই যে, হযরত আয়েশা (রা.) উষ্ট্র যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এ যুক্তি যারা পেশ করেন তারা সম্ভবত এ ব্যাপারে স্বয়ং হযরত আয়েশার কি চিন্তা ছিল তা জানেন না। আবদুল্লাহ ইবনে আহমাদ ইবনে হাম্বল যাওয়ায়েদুয যাহদ এবং ইবনুল মুনযির, ইবনে আবী শাইবাহ ও ইবনে সা’দ তাঁদের কিতাবে মাসরূক থেকে হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, হযরত আয়েশা (রা.) যখন কুরআন তেলাওয়াত করতে করতে এ আয়াতে পৌঁছতেন (وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ) তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে কেঁদে ফেলতেন, এমনকি তাঁর উড়না ভিজে যেতো। করণ এ প্রসঙ্গে উষ্ট্র যুদ্ধে গিয়ে তিনি যে ভুল করেছিলেন সে কথা তাঁর মনে পড়ে যেতো।
আরবী ভাষায় ‘তাবাররুজ” মানে হচ্ছে উন্মুক্ত হওয়া, প্রকাশ হওয়া এবং সুস্পষ্ট হয়ে সামনে এসে যাওয়া। দূর থেকে দেখা যায় এমন প্রত্যেক উঁচু ভবনকে আরবরা “বুরুজ” বলে থাকে। দুর্গ বা প্রাসাদের বাইরের অংশের উচ্চ কক্ষকে এ জন্যই বুরুজ বলা হয়ে থাকে। পালতোলা নৌকার পাল দূর থেকে দেখা যায় বলে তাকে “বারজা” বলা হয়, নারীর জন্য তাবাররুজ শব্দ ব্যবহার করা হলে তার তিনটি অর্থ হবে। এক, সে তার চেহারা ও দেহের সৌন্দর্য লোকদের দেখায়। দুই, সে তার পোশাক ও অলংকারের বহর লোকদের সামনে উন্মুক্ত করে। তিন, সে তার চাল-চলন ও চমক-ঠমকের মাধ্যমে নিজেকে অন্যদের সামনে তুলে ধরে। অভিধান ও তাফসীর বিশারদগণ এ শব্দটির এ ব্যাখ্যাই করেছেন। মুজাহিদ, কাতাদাহ ও ইবনে আবি নুজাইহ বলেন, التبرج المشى بتبخر وتكسر وتغنج- “তাবাররুজের অর্থ হচ্ছে, গর্ব ও মনোরম অংগভংগী সহকারে হেলেদুলে ও সাড়ম্বরে চলা।” মুকাতিল বলেন, ابداء قلائدها وقرطها وعنقها “নিজের হার, ঘাড় ও গলা সুস্পষ্ট করা।” আল মুবাররাদের উক্তি হচ্ছেঃ ان تبدى من مناسنها مايجب عليها ستره “নারীর এমন গুণাবলী প্রকাশ করা যেগুলো তার গোপন রাখা উচিত।” আবু উবাইদাহর ব্যাখ্যা হচ্ছেঃ
ان تخرج من محاسنها ماتستدهى به شهوة الرجال
“নারীর শরীর ও পোশাকের সৌন্দর্য এমনভাবে উন্মুক্ত করা যার ফলে পুরুষেরা তার প্রতি আকৃষ্ট হয়।”
জাহেলিয়াত শব্দটি কুরআন মজিদের এ জায়গা ছাড়াও আরো তিন জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছে। এক, আলে ইমরানের ১৫৪ আয়াত। সেখানে আল্লাহর পথে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে যারা গা বাঁচিয়ে চলে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, তারা “আল্লাহ সম্পর্কে সত্যের বিরুদ্ধে জাহেলিয়াতের মতো ধারণা পোষণ করে।” দুই, সূরা মা-য়েদাহর ৫০ আয়াতে। সেখানে আল্লাহর আইনের পরিবর্তে অন্য কারোর আইন অনুযায়ী ফায়সালাকারীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, “তারা কি জাহেলিয়াতের ফায়সালা চায়? ” তিন, সূরা ফাতহের ২৬ আয়াতে সেখানে মক্কার কাফেররা নিছক বিদ্বেষ বশত মুসলমানদের উমরাহ করতে দেয়নি বলে তাদের এ কাজকেও “জাহেলী স্বার্থান্ধতা ও জিদ” বলা হয়েছে। হাদীসে বলা হয়েছে, একবার হযরত আবু দারদা করো সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে তার মাকে গালি দেন। রসূলুল্লাহ ﷺ তা শুনে বলেন, “তোমার মধ্যে এখনো জাহেলিয়াত রয়ে গেছে।” অন্য একটি হাদীসে রসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, “তিনটি কাজ জাহেলিয়াতের অন্তর্ভুক্ত। অন্যের বংশের খোটা দেয়া, নক্ষত্রের আবর্তন থেকে ভাগ্য নির্ণয় করা এবং মৃতদের জন্য সুর করে কান্নাকাটি করা।” শব্দটির এ সমস্ত প্রয়োগ থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, জাহেলিয়াত বলতে ইসলামী পরিভাষায় এমন প্রত্যেকটি কার্যধারা বুঝায় যা ইসলামী কৃষ্টি ও সংস্কৃতি, ইসলামী শিষ্টাচার ও নৈতিকতা এবং ইসলামী মানসিকতার বিরোধী। আর প্রথম যুগের জাহেলিয়াত বলতে এমন অসৎকর্ম বুঝায় যার মধ্যে প্রাগৈসলামিক আরবরা এবং দুনিয়ার অন্যান্য সমস্ত লোকেরা লিপ্ত ছিল।
এ ব্যাখ্যা থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, আল্লাহ নারীদেরকে যে কার্যধারা থেকে বিরত রাখতে চান তা হচ্ছে, তাদের নিজেদের সৌন্দর্যের প্রদর্শনী করে গৃহ থেকে বের হওয়া। তিনি তাদের আদেশ দেন, নিজেদের গৃহে অবস্থান করো। কারণ, তোমাদের আসল কাজ রয়েছে গৃহে, বাইরে নয়। কিন্তু যদি বাইরে বের হবার প্রয়োজন হয়, তাহলে এমনভাবে বের হয়ো না যেমন জাহেলী যুগে নারীরা বের হতো। প্রসাধন ও সাজ-সজ্জা করে, সুশোভন অলংকার ও আঁটসাঁট বা হালকা মিহিন পোষাকে সজ্জিত হয়ে চেহারা ও দেহের সৌন্দর্যকে উন্মুক্ত করে এবং গর্ব ও আড়ম্বরের সাথে চলা কোন মুসলিম সমাজের নারীদের কাজ নয়। এগুলো জাহেলিয়াতের রীতিনীতি। ইসলামে এসব চলতে পারে না। এখন প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেই দেখতে পারেন আমাদের দেশে যে সংস্কৃতির প্রচলন করা হচ্ছে তা কুরআনের দৃষ্টিতে ইসলামের সংস্কৃতি না জাহেলিয়াতের সংস্কৃতি? তবে হ্যাঁ, আমদের কর্মকর্তাদের কাছে যদি অন্য কোন কুরআন এসে গিয়ে থাকে, যা থেকে ইসলামের এ নতুন তত্ত্ব ও ধ্যান-ধারণা বের করে তারা মুসলমানদের মধ্যে ছড়াচ্ছেন, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা।
أَتَعْجَبِينَ مِنْ أَمْرِ اللَّهِ رَحْمَتُ اللَّهِ وَبَرَكَاتُهُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الْبَيْتِ
“তোমরা কি আল্লাহর কাজে অবাক হচ্ছো? হে এ পরিবারের লোকেরা! তোমাদের প্রতি তো আল্লাহর রহমত ও তাঁর বরকত রয়েছে।”
সূরা কাসাসে যখন হযরত মূসা (আ) একটি দুগ্ধপোষ্য শিশু হিসেবে ফেরাউনের গৃহে পৌঁছে যান এবং ফেরাউনের স্ত্রী এমন কোন ধাত্রীর সন্ধান করতে থাকেন যার দুধ এ শিশু পান করবে তখন হযরত মূসার বোন গিয়ে বলেনঃ
هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَى أَهْلِ بَيْتٍ يَكْفُلُونَهُ لَكُم
“আমি কি তোমাদের এমন পরিবারের খবর দেবো যারা তোমাদের জন্য এ শিশুর লালন-পালনের দায়িত্ব নেবেন?”
কাজেই ভাষার প্রচলিত কথ্যরীতি, কুরআনের বর্ণনাভংগী এবং খোদ এ আয়াতটির পূর্বাপর আলোচ্য বিষয় সবকিছুই চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আহলি বায়েতের মধ্যে তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণও আছেন এবং তাঁর সন্তানরাও আছেন। বরং বেশী নির্ভুল কথা হচ্ছে এই যে, আয়াতে মূলত সম্বোধন করা হয়েছে তাঁর স্ত্রীগণকেই এবং সন্তানরা এর অন্তর্ভুক্ত গণ্য হয়েছেন শব্দের অর্থের প্রেক্ষিতে। এ কারণে ইবনে আব্বাস (রা.), উরওয়া ইবনে যুবাইর (রা.) এবং ইকরামাহ বলেন, এ আয়াতে আহলে বায়েত বলতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীদেরকেই বুঝানো হয়েছে।
কিন্তু কেউ যদি বলেন, ‘আহলুল বায়েত” শব্দ শুধুমাত্র স্ত্রীদের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, অন্য কেউ এর মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না, তাহলে একথাও ভুল হবে। “পরিবারবর্গ” শব্দের মধ্যে মানুষের সকল সন্তান-সন্ততি কেবল শামিল হয় তাই নয় বরং নবী ﷺ নিজে সুস্পষ্টভাবে তাদের শামিল হবার কথা বলেছেন। ইবনে আবি হাতেম বর্ণনা করেছেন, হযরত আয়েশাকে (রা.) একবার হযরত আলী (রা.) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়। জবাবে তিনি বলেনঃ
تَسْأَلُنِىْ عَنْ رَجُلٍ كَانَ مِنْ اَحَبَّ النَّاسِ اِلَى رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَكَانَتْ تَحْتَهُ ابْنَتَهُ وَاَحَبُّ النَّاسِ اِلَيْهِ-
“তুমি আমাকে এমন ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছো যিনি ছিলেন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয়তম লোকদের অন্তর্ভুক্ত এবং যার স্ত্রী ছিলেন রসূলের এমন মেয়ে যাকে তিনি মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসতেন।” তারপর হযরত আয়েশা (রা.) এ ঘটনা শুনানঃ নবী করীম ﷺ হযরত আলী ও ফাতেমা এবং হাসান ও হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমকে ডাকলেন এবং তাঁদের উপর একটা কাপড় ছড়িয়ে দিলেন এবং দোয়া করলেনঃ
اللَّهُمَّ هَؤُلاَءِ أَهْلُ بَيْتِى فَأَذْهِبْ عَنْهُمُ الرِّجْسَ وَطَهِّرْهُمْ تَطْهِيرًا
“হে আল্লাহ এরা আমার আহলে বায়েত (পরিবারবর্গ), এদের থেকে নাপাকি দূর করে দাও এবং এদেরকে পাক-পবিত্র করে দাও।”
হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমি নিবেদন করলাম, আমিও তো আপনার আহলে বায়েতের অন্তর্ভুক্ত (অর্থাৎ আমাকেও এ কাপড়ের নীচে নিয়ে আমার জন্যও দোয়া করুন) নবী করীম ﷺ বলেন, “তুমি আলাদা থাকো, তুমি তো অন্তর্ভুক্ত আছোই।” প্রায় একই ধরনের বক্তব্য সম্বলিত বহু সংখ্যক হাদীস মুসলিম, তিরমিযী, আহমাদ, ইবনে জারীর, হাকেম, বায়হাকি প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ আবু সাঈদ খুদরী (রা.), হযরত আয়েশা (রা.), হযরত আনাস (রা.), হযরত উম্মে সালামাহ (রা.), হযরত ওয়াসিলাহ ইবন আসকা’ এবং অন্যান্য কতিপয় সাহাবা থেকে বর্ণনা করেছেন। সেগুলো থেকে জানা যায়, নবী ﷺ হযরত আলী (রা.), ফাতেমা (রা.) এবং তাদের দু’টি সন্তানকে নিজের আহলে বায়েত গণ্য করেন। কাজেই যাঁরা তাঁদেরকে আহলে বায়েতের বাইরে মনে করেন তাদের চিন্তা ভুল।
অনুরূপভাবে যার উপরোক্ত হাদীসগুলোর ভিত্তিতে রসূলের পবিত্র স্ত্রীগণকে আহলে বায়েতের বাইরে গণ্য করেন তাদের মতও সঠিক নয়। প্রথমত যে বিষয়টি সরাসরি কুরআন থেকে প্রমাণিত, তাকে কোন হাদীসের ভিত্তিতে প্রত্যাখ্যান করা যেতে পারে না। দ্বিতীয়ত সংশ্লিষ্ট হাদীসগুলোর অর্থও তা নয় যা সেগুলো থেকে গ্রহণ করা হচ্ছে। এগুলোর কোন কোনটিতে এই যে কথা এসেছে যে, হযরত আয়েশা (রা.) ও হযরত উম্মে সালামাকে (রা.) নবী ﷺ সেই চাদরের নীচে নেননি যার মধ্যে হযরত আলী, ফতেমা, হাসান ও হোসাইনকে নিয়েছিলেন, এর অর্থ এ নয় যে, তিনি তাঁদেরকে নিজের “পরিবারের” বাইরে গণ্য করেছিলেন। বরং এর অর্থ হচ্ছে, স্ত্রীগণ তো পরিবারের অন্তর্গত ছিলেনই। কারণ কুরআন তাঁদেরকেই সম্বোধন করেছিল। কিন্তু নবী করীমের ﷺআশঙ্কা হলো, এ চারজন সম্পর্কে কুরআনের বাহ্যিক অর্থের দিক দিয়ে কারো যেন ভুল ধারণা না হয়ে যায় যে, তাঁরা আহলে বায়েতের বাইরে আছেন, তাই তিনি পবিত্র স্ত্রীগণের পক্ষে নয়, তাঁদের পক্ষে ব্যাপারটি সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করার প্রয়োজন অনুভব করেন।
একটি দল এ আয়াতের ব্যাখ্যায় শুধুমাত্র এতটুকু বাড়াবাড়ি করেই ক্ষান্ত থাকেননি যে, পবিত্র স্ত্রীগণকে আহলে বায়েত থেকে বের করে দিয়ে কেবলমাত্র হযরত আলী (রা.), ফাতেমা (রা.) ও তাঁদের দু’টি সন্তানকে এর মধ্যে শামিল করেছেন বরং এর ওপর এভাবে আরো বাড়াবাড়ি করেছেন যে, “আল্লাহ তো চান তোমাদের থেকে ময়লা দূর করে তোমাদের কে পুরোপুরি পবিত্র করে দিতে” কুরআনের এ শব্দগুলো থেকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, হযরত আলী, ফাতেমা এবং তাঁদের সন্তান-সন্ততি আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামগণের মতোই মাসূম তথা গোনাহমুক্ত নিষ্পাপ। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, “ময়লা” অর্থ ভ্রান্তি ও গোনাহ এবং আল্লাহর উক্তি অনুযায়ী আহলে বায়েতকে এগুলো থেকে মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। অথচ আয়াতে একথা বলা হয়নি যে, তোমাদের থেকে ময়লা দূর করে দেয়া হয়েছে এবং তোমাদেরকে পাক-পবিত্র করা হয়েছে। বরং বলা হয়েছে, আল্লাহ তোমাদের থেকে ময়লা দূর করতে এবং তোমাদের পুরোপুরি পাক পবিত্র করতে চান। পূর্বাপর আলোচনাও এখানে আহলে বায়েতের মর্যাদা বর্ণনা করাই উদ্দেশ্য একথা বলে না। বরং এখানে তো আহলে বায়েতকে এ মর্মে নসিহত করা হয়েছে, তোমরা অমুক কাজ করো এবং অমুক কাজ করো না কারণ আল্লাহ তোমাদের পাক পবিত্র করতে চান। অন্য কথায় এর অর্থ হচ্ছে, তোমরা অমুক নীতি অবলম্বন করলে পবিত্রতার নিয়ামতে সমৃদ্ধ হবে অন্যথায় তা লাভ করতে পারবে না। তবুও যদি يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ .................... وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا এর অর্থ এ নেয়া হয় যে, আল্লাহ তাঁদেরকে নিষ্পাপ করে দিয়েছেন, তাহলে অযু, গোসল ও তায়াম্মুমকারী প্রত্যেক মুসলমানকে নিষ্পাপ বলে মেনে না নেয়ার কোন কারণ নেই। কারণ তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেনঃ
وَلَكِنْ يُرِيدُ لِيُطَهِّرَكُمْ وَلِيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ
“কিন্তু আল্লাহ চান তোমাদেরকে পাক-পবিত্র করে দিতে এবং তাঁর নিয়ামত তোমাদের উপর পূর্ণ করে দিতে।” (আল মা-য়েদাহ, ৬)
এ আয়াতে দু’টি জিনিসের কথা বলা হয়েছে। এক, আল্লাহর আয়াত, দুই, হিকমাত বা জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। আল্লাহর আয়াত অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর কিতাবের আয়াত। কিন্তু হিকমাত শব্দটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবোধক। সকল প্রকার জ্ঞানের কথা এর অন্তর্ভুক্ত, যেগুলো নবী ﷺ লোকদেরকে শেখাতেন। আল্লাহর কিতাবের শিক্ষার ওপরও এ শব্দটি প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু কেবলমাত্র তার মধ্যেই একে সীমিত করে দেবার সপক্ষে কোন প্রমাণ নেই। কুরআনের আয়াত শুনানো ছাড়াও নবী ﷺ নিজের পবিত্র জীবন ও নৈতিক চরিত্র এবং নিজের কথার মাধ্যমে যে হিকমাতের শিক্ষা দিতেন তাও অপরিহার্যভাবে এর অন্তর্ভুক্ত। কেউ কেউ কেবলমাত্র এরই ভিত্তিতে যে আয়াতে مَا يُتْلَى (যা তেলাওয়াত করা হয়) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, এ দাবী করেন যে আল্লাহর আয়াত ও হিকমাত মানে হচ্ছে কেবলমাত্র কুরআন। কারণ “তেলাওয়াত” শব্দটি একমাত্র কুরআন তেলাওয়াতের সাথেই সংশ্লিষ্ট। কিন্তু এ যুক্তি একবারেই ভ্রান্ত। তেলওয়াত শব্দটি পারিভাষিকভাবে একমাত্র কুরআন বা আল্লাহর কিতাব তেলাওয়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট করে দেয়া পরবর্তীকালের লোকদের কাজ। কুরআনে এ শব্দটিকে পারিভাষিক অর্থে ব্যবহার করা হয়নি। সূরা বাকারার ১০২ আয়াতে এ শব্দটিকেই যাদুমন্ত্রের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। শয়তানরা হযরত সুলাইমানের নামের সাথে জড়িত করে এ মন্ত্রগুলো লোকদেরকে তেলাওয়াত করে শুনাতোঃ
وَاتَّبَعُوا مَا تَتْلُو الشَّيَاطِينُ عَلَى مُلْكِ سُلَيْمَانَ
“তারা অনুসরণ করে এমন এক জিনিসের যা তেলাওয়াত করতো অর্থাৎ যা শুনাতো শয়তানরা সুলাইমানের বাদশাহীর সাথে জড়িত করে”--থেকে স্পষ্টত প্রমাণিত হয়, কুরআন এ শব্দটিকে এর শাব্দিক অর্থে ব্যবহার করে। আল্লাহর কিতাবের আয়াত শুনাবার জন্য পারিভাষিকভাবে এক নির্দিষ্ট করে না।
ذَاقَ طَعْمَ الإِيمَانِ مَنْ رَضِىَ بِاللَّهِ رَبًّا وَبِالإِسْلاَمِ دِينًا وَبِمُحَمَّدٍ رَسُولاً
“ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করেছে সেই ব্যক্তি যে আল্লাহকে তার রব, ইসলামকে তার দ্বীন এবং মুহাম্মাদকে তার রসূল বলে মেনে নিতে রাজি হয়ে গেছে।” (মুসলিম)
অন্য একটি হাদীসে তিনি এর ব্যাখ্যা এভাবে করেছেনঃ
لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يَكُونَ هَوَاهُ تَبَعًا جِئْتَ بِهِ
“তোমাদের কোন ব্যক্তি মু’মিন হয় না যতক্ষণ না তার প্রবৃত্তি আমি যা এনেছি তার অনুগত হয়ে যায়।”(শারহুস সুন্নাহ)
عَنْ مُعَاذبن انس الجهنى عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَنَّ رَجُلاً سَأَلَهُ اىُّ الْمجاهدِين أَعْظَمُ أَجْراً يَا رسول الله؟ قَالَ أَكْثَرُهُمْ لِلَّهِ تَعَالَى ذِكْراً- قَالَ َأَىُّ الصَّائِمِينَ اكثر أَجْراً؟ قَالَ أَكْثَرُهُمْ لِلَّهِ عز وجل ذِكْراً - ثُمَّ ذَكَرَ الصَّلاَةَ وَالزَّكَاةَ وَالْحَجَّ وَالصَّدَقَةَ كُلُّ ذَلِكَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَكْثَرُهُمْ لِلَّهِ ذِكْراً-
“মু’আয ইবনে আনাস জুহানী বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রসূল! জিহাদকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিদান লাভ করবে কে? জবাব দিলেন, যে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী আল্লাহকে স্মরণ করবে। তিনি নিবেদন করেন, রোযা পালনকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী প্রতিদান পাবে কে? জবাব দিলেন, যে তাদের মধ্যে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশী স্মরণ করবে। আবার তিনি একই ভাবে নামায, যাকাত, হ্জ্জ ও সাদকা আদায়কারীদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। জবাবে নবী করীম ﷺ বলেন, “যে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশী স্মরণ করে।” (মুসনাদে আহমাদ)
এ আয়াত যদিও একটি বিশেষ সময়ে নাযিল হয় কিন্তু এর মধ্যে যে হুকুম বর্ণনা করা হয় তা ইসলামী আইনের একটি বড় মূলনীতি এবং সমগ্র ইসলামী জীবন ব্যবস্থার ওপর এটি প্রযুক্ত হয়। এর দৃষ্টিতে যে বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে কোন হুকুম প্রমাণিত হয় সে বিষয়ে কোন মুসলিম ব্যক্তি, জাতি, প্রতিষ্ঠান, আদালত, পার্লামেন্ট বা রাষ্ট্রের নিজের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা ব্যবহার করার কোন অধিকার নেই। মুসলমান হবার অর্থই হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সামনে নিজের স্বাধীন ইখতিয়ার বিসর্জন দেয়া। কোন ব্যক্তি বা জাতি মুসলমানও হবে আবার নিজের জন্য এ ইখতিয়ারটিও সংরক্ষিত রাখবে। এ দু’টি বিষয় পরস্পর বিরোধী-এ দু’টি কাজ এক সাথে হতে পারে না। কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি এ দু’টি দৃষ্টিভংগীকে একত্র করার ধারণা করতে পারে না। যে ব্যক্তি মুসলমান হিসেবে বেঁচে থাকতে চায় তাকে অবশ্যই আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সামনে আনুগত্যের শির নত করতে হবে। আর যে মুসলমান নয়। যদি সে না মানে তাহলে নিজেকে মুসলমান বলে যত জোরে গলা ফটিয়ে চিৎকার করুক না কেন আল্লাহ ও বান্দা উভয়ের দৃষ্টিতে সে মুনাফিকই গণ্য হবে।
এ অবস্থার প্রতিই মহান আল্লাহ তাঁর “যার প্রতি আল্লাহ ও তুমি অনুগ্রহ করেছিল” বাক্যাংশের মধ্যে ইশারা করেছেন।
ইমাম যয়নুল আবেদীন হযরত আলী ইবনে হোসাইন (রা.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় একথাই বলেছেন। তিনি বলেন, “আল্লাহ নবী ﷺ কে এই মর্মে খবর দিয়েছিলেন যে, যয়নব (রা.) আপনার স্ত্রীদের মধ্যে শামিল হতে যাচ্ছেন। কিন্তু যায়েদ (রা.) যখন এসে তাঁর কাছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন তখন তিনি বললেন, আল্লাহকে ভয় করো এবং নিজের স্ত্রী ত্যাগ করো না। এ কথায় আল্লাহ বললেন, আমি তোমাকে পূর্বেই জানিয়ে দিয়েছিলাম, আমি তোমাকে যয়নবের সাথে যয়নবের সাথে বিয়া দিচ্ছি অথচ তুমি যায়েদের সাথে কথা বলার সময় আল্লাহ যেকথা প্রকাশ করতে চান তা গোপন করছিলে। (ইবনে জারীর ও ইবনে কাসীর ইবনে আবী হাতেমের বরাত দিয়ে)
আল্লামা আলূসীও তাফসীর রুহল মা’আনীতে এর একই অর্থ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, “এটি হচ্ছে শ্রেয়তর কাজ পরিত্যাগ করার জন্য ক্রোধ প্রকাশ। নবী ﷺ নিশ্চুপ থাকতেন অথবা যায়েদকে (রা.) বলতেন, তুমি যা চাও করতে পারো, এ অবস্থায় এটিই ছিল শ্রেয়তর। অভিব্যক্ত ক্রোধের সারৎসার হচ্ছেঃ তুমি কেন যায়েদকে বললে তোমার স্ত্রীকে ত্যাগ করো না? অথচ আমি তোমাকে আগেই জানিয়ে দিয়েছি যে, যয়নব তোমার স্ত্রীদের মধ্যে শামিল হবে।”
তাদের প্রথম অভিযোগ ছিল, তিনি নিজের পুত্রবধূকে বিয়ে করেন, অথচ তাঁর নিজের শরীয়াতেও পুত্রের স্ত্রী পিতার জন্য হারাম। এর জবাবে বলা হয়েছে, “মুহাম্মাদ তোমাদের পুরুষদের কারো পিতা নন।” অর্থাৎ যে ব্যক্তির তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে বিয়ে করা হয়েছে তিনি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লামের পুত্রই ছিলেন না, কাজেই তার তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে বিয়ে করা হারাম হবে কেন? তোমরা নিজেরাই জানো মুহাম্মাদ ﷺ এর আদতে কোন পুত্র সন্তানই নেই। তাদের দ্বিতীয় আপত্তি ছিল, ঠিক আছে, পালক পুত্র যদি আসল পুত্র না হয়ে থাকে তাহলেও তার তালাক প্রাপ্ত স্ত্রীকে বিয়ে করা বড় জোর বৈধই হতে পারতো কিন্তু তাকে বিয়ে করার এমন কি প্রয়োজন ছিল? এর জবাবে বলা হয়েছে, “কিন্তু তিনি আল্লাহর রসূল।” অর্থাৎ রসূল হবার কারনে তাঁর ওপর এ দায়িত্ব ও কর্তব্য আরোপিত হয়েছিল যে তোমাদের রসম-রেওআজ যে হালাল জিনিসটিকে অযথা হারাম গণ্য করে রেখেছে সে ব্যাপারে সকল রকমের স্বার্থপ্রীতির তিনি অবসান ঘটিয়ে দেবেন এবং তার হালাল হবার ব্যাপারে কোনো প্রকার সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশই রাখবে না।
আবার অতিরিক্ত তাকিদ সহকারে বলা হয়েছে, “এবং তিনি শেষ নবী।” অর্থাৎ যদি কোন আইন ও সামাজিক সংস্কার তাঁর আমলে প্রবর্তিত না হয়ে থাকে তাহলে তাঁর পরে আগমনকারী নবী তার প্রবর্তন করতে পারতেন, কিন্তু তাঁর পরে আর কোন রসূল তো দূরের কথা কোন নবীই আসবেন না। কাজেই তিনি নিজেই জাহেলিয়াতের এ রসমটির মুলোচ্ছেদ করে যাবেন, এটা আরো অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল।
এরপর আরো বেশী জোর দিয়ে বলা হয়েছে, “আল্লাহ প্রত্যেটি বিষয়ের জ্ঞান রাখেন।” অর্থাৎ আল্লাহ জানেন, এ সময় মুহাম্মাদ ﷺ এর মাধ্যমে জাহেলিয়াতের এ রসমটির মুলোচ্ছেদ করা কেন জরুরী ছিল এবং এমনটি না করলে কি মহা অনর্থ হতো। তিনি জানেন, এখন আর তাঁর পক্ষ থেকে কোন নবী আসবেন না, কাজেই নিজের শেষ নবীর মাধ্যমে এখন যদি তিনি এ রসমটিকে উৎখাত না করেন তাহলে এমন দ্বিতীয় আর কোন সত্তাই নেই যিনি এটি ভঙ্গ করলে সারা দুনিয়ার মুসলমানদের মধ্য থেকে চিরকালেন জন্য এটি মূলোৎপাটিত হয়ে যাবে। পরবর্তী সংস্কারকগণ যদি এটি ভাঙেন, তাহলে তাদের মধ্য থেকে আরো কর্মও তাঁর ইন্তিকালের পরে এমন কোন বিশ্বজনীন ও চিরন্তন কর্তৃত্বের অধিকারী হবে না যার ফলে প্রত্যেক দেশের প্রত্যেক যুগের লোকেরা তার অনুসরণ করতে থাকবে এবং তাদের মধ্য থেকে কারো ব্যক্তিত্ব ও তাঁর নিজের মধ্যে এমন কোন পবিত্রতার বাহন হবে না যার ফলে তাঁর কোনো কাজ নিছক তাঁর সুন্নাত হবার কারণে মানুষের মন থেকে অপছন্দনীয়তার সকল প্রকার ধারণার মূলোচ্ছেদ করতে সক্ষম হবে। দুঃখের বিষয়, বর্তমান যুগের একটি দল এ আয়াতটি ভুল ব্যাখ্যা করে একটি বড় ফিতনার দরোজা খুলে দিয়েছে, তাই খতমে নবুওয়াত বিষটির পূর্ণ ব্যাখ্যা এবং এ দলটির ছড়ানো বিভ্রান্তিগুলো নিরসনের জন্য আমি এ সূরার তাফসীরের শেষে একটি বিস্তারিত পরিশিষ্ট সংযোজন করে দিয়েছি।
পরিশিষ্ট
{৭৭ টীকার সাথে সংশ্লিষ্ট}
বর্তমান যুগে একটি দল নতুন নবুওয়াতের ফিতনা সৃষ্টি করেছে। এর “খাতামুন নাবিয়্যীন” শব্দের অর্থ করে “নবীদের” মোহর। এরা বুঝাতে চায় রসূলুল্লাহর ﷺ পর তার মোহরাংকিত হয়ে আরো অনেক নবী দুনিয়ায় আগমন করবেন। অথবা অন্য কথায় বলা যায়, যতক্ষণ পর্যন্ত কারো নবুওয়াত রসূলুল্লাহর মোহরাংকিত না হয় ততক্ষণ তিনি নবী হতে পারবেন না।কিন্তু “খাতামুন নাবিয়্যীন” শব্দ সম্বলিত আয়াতটি যে ঘটনা পরস্পরায় বিবৃত হয়েছে, তাকে সেই বিশেষ পরিবেশে রেখে বিচার করলে, তা থেকে এ অর্থ গ্রহণের কোন সুযোগই দেখা যায় না। অধিকন্তু এ অর্থ গ্রহণ করার পর এ পরিবেশে শব্দটির ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তাই বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং বক্তব্যের আসল উদ্দেশ্যের ও পরিপন্হী হয়ে দাঁড়ায়। ১ এটা কি নিতান্ত অবান্তর ও অপ্রাসঙ্গিক কথা নয় যে, যয়নবের নিকাহর বিরুদ্ধে উত্থিত প্রতিবাদ এবং তা থেকে সৃষ্ট নানা প্রকার সংশয়-সন্দেহের জবাব দিতে দিতে হঠাৎ মাঝখানে বলে দেয়া হলোঃ মুহাম্মাদ ﷺ নবীদের মোহর। অর্থাৎ ভবিষ্যতে যত নবী আসবেন তারা সবাই তারই মোহরাংকিত হবেন। আগে পিছের এ ঘটনা মাঝখানে একথাটির আকস্মিক আগমন শুধু অবান্তরই নয়, এ থেকে প্রতিবাদকারীদের জবাবে যে যুক্তি পেশ করা হচ্ছিল, তাও দূর্বল হয়ে পড়ে। এহেন পরিস্থিতিতে প্রতিবাদকারীদের হাতে একটা চমৎকার সুযোগ আসতো এবং তারা সহজেই বলতে পারতো যে, আপনার জীবনে যদি এ কাজটা সম্পন্ন না করতেন, তাহলে ভালই হতো, কোন বিপদের সম্ভাবনা থাকতো না, এই বদ রসমটা বিলুপ্ত করার যদি এতেই প্রয়োজন হয়ে থাকে, তাহলে আপনার পরে আপনার মোহরাংকিত হয়ে যেসব নবী আসবেন, এ কাজটা তাদের হাতেই সম্পন্ন হবে।
উল্লেখিত দলটি শব্দটির আর একটি বিকৃত অর্থ নিয়েছেঃ “খাতামুন নাবিয়্যীন” অর্থ হলঃ “আফজালুন নাবিয়্যীন।” অর্থাৎ নবুওয়াতের দরজা উন্মুক্তই রয়েছে, তবে কিনা নবুওয়াত পূর্ণতা লাভ করেছে রসূলুল্লাহর ওপর। কিন্তু এ অর্থ গ্রহণ করতে গিয়েও পূর্বোল্লিখিত বিভ্রান্তির পুনরাবির্ভাবের হাত থেকে নিস্তার নেই। অগ্রপশ্চাতের সাথে এরও কোন সম্পর্ক নেই। বরং এটি পূর্বাপরের ঘটনা পরস্পরার সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থবহ। কাফের ও মুনাফিকরা বলতে পারতোঃ “জনাব, আপনার চাইতে কম মর্যাদার হলেও আপনার পরে যখন আরো নবী আসছেন, তখন এ কাজটা না হয় তাদের ওপরই ছেড়ে দিতেন। এ বদ রসমটাও যে আপনাকেই মিটাতে হবে, এরই বা কি এমন আবশ্যকতা আছে”!
১. বর্ণনার ধারাবাহিকতা অনুধাবন করার জন্য এ সূরার ৬৭ থেকে ৭৯ টীকার আলোচনাও সামনে রাখা দরকার।
আভিধানিক অর্থ
তাহলে পূর্বাপর ঘটনাবলীর সাথে সম্পর্কের দিক দিয়ে একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, এখানে “খাতামুন নাবিয়্যীন” শব্দের অর্থ নবুওয়য়াতের সিলসিলার পরিসমাপ্তি ঘোষণা অর্থাৎ রসূলুল্লাহর ﷺ পর আর কোন নবী আসবেন না। কিন্তু শুধু পূর্বাপর সম্বন্ধের দিক দিয়েই নয়, আভিধানিক অর্থের দিক দিয়েও এটিই একমাত্র সত্য। আরবী অভিধান এবং প্রবাদ অনুযায়ী ‘খতম’; শব্দের অর্থ হলঃ মোহর লাগানো, বন্ধ করা, শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া এবং কোন কাজ শেষ করে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করা।খাতামাল আমাল (خَتَمَ ألعَمَلَ) অর্থ হলোঃ ফারাগা মিনাল আমাল (فَرَغَ مِنَ ألعَمَلَ) অর্থাৎ কাজ শেষ করে ফেলেছে।
খাতামাল এনায়া (خَتَمَ ألاِنَاءَ) অর্থ হলোঃ পাত্রের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে এবং তার ওপর মোহর লাগিয়ে দিয়েছে, যাতে করে তার ভেতর থেকে কোন জিনিস বাইরে আসতে এবং বাইরে থেকে কিছু ভেতরে যেতে না পারে।
খাতামাল কিতাব (خَتَمَ الكِتَابَ) অর্থ হলোঃ পত্রের মুখ বন্ধ করে তার ওপর মোহর লাগিয়ে দিয়েছে, ফলে পত্রটি সংরক্ষিত হবে।
খাতামা আলাল কালব (خَتَمَ عَلَى القَلبِ) অর্থ হলোঃ দিলের ওপর মোহর লাগিয়ে দিয়েছে। এরপর কোন কথা আর সে বুঝতে পারবে না এবং তার ভেতরের জমে থাকা কোন কথা বাইরে বেরুতে পারবে না।
খিতামু কুল্লি মাশরুব (خَتَامَ كُلِّ مَشرُوبٍ) অর্থ হলোঃ কোন পানীয় পান করার পর শেষে যে স্বাদ অনুভূত হয়।
খাতিমাতু কুল্লি শাইয়িন আকিবাতুহু ওয়া আখিরাতুহু অর্থাৎ প্রত্যেক জিনিসের খাতিমা অর্থ হলো তার পরিণাম এবং শেষ।
খাতামাশ শাইয়্যি বালাগা আখিরাহ (خَتَمَ الشئِ , بَلَغَ اخِرَهُ) অর্থাৎ কোন জিনিসকে খতম করার অর্থ হলো তার শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া। খতমে কুরআন বলতে এ অর্থ গ্রহণকরা হয় এবং এ অর্থের ভিত্তিতে প্রত্যেক সূরার শেষ আয়াতকে বলা হয় ‘খাওয়াতিম’।
খাতামুল কওমে আখেরুহুম (خَاتَمُ القَومٍ اخرهم) অর্থাৎ খাতামুল কওম অর্থজাতির শেষ ব্যক্তি (দ্রষ্টব্যঃ লিসানুল আরব, কামুস এবং আকারাবুল মাওয়ারিদ।) ১
এ জন্যই সমস্ত অভিধান বিশারদ এবং তাফসীরকারগণ একযোগে “খাতামুন নাবিয্যীন” শব্দের অর্থ নিয়েছেন, আখেরুন নাবিয়্যীন অর্থাৎ নবীদের শেষ। আরবী অভিধান এবং প্রবাদ অনুযায়ী ‘খাতাম’-এর অর্থ ডাকঘরের মোহর নয়, যা চিঠির ওপর লাগিয়ে চিঠি পোষ্ট করা হয় বরং সেই মোহর যা খামের মুখে এ উদ্দেশ্যে লাগানো হয় যে, তার ভেতর থেকে কোন জিনিস বাইরে বেরুতে পারবে না এবং বাইরের কোন জিনিস ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না।
১. এখানে আমি মাত্র তিনটি আভিধানের উল্লেখ করলাম। কিন্তু শুধু এই তিনটি অভিধানই কেন, আরবি ভাষায় যে কোন নির্ভরযোগ্য অভিধান খুলে দেখুন, সেখানে ‘খতম’ শব্দের উপরোল্লিখিত ব্যাখ্যাই পাবেন। কিন্তু ‘খতমে নবুওয়াত’ অস্বীকারকারীরা আল্লাহর দ্বীনের সুরক্ষিত গৃহে সিঁদ কাটার জন্য এর আভিধানিক অর্থকে পূর্ণরূপে এড়িয়ে গেছেন। তারা বলতে চান, কোন ব্যক্তিকে খাতামুশ শোয়ারা খাতামুল ফোকাহা অথবা ‘খাতামুল মুফাসসিরীণ’ বললে এ অর্থ গ্রহণ করা হয় নাযে, যাকে ঐ পদবী দেয়া হয়, তার পরে আর কোন শায়ের তথা কবি, ফকিহ অথবা মুফাসসির পয়দা হননি। বরং এর অর্থ এই যে, ঐ ব্যক্তির ওপরে উল্লিখিত বিদ্যা অথবা শিল্পের পূর্ণতার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। অথবা কোন বস্তুকে অত্যধিক ফুটিয়ে তুলবার উদ্দেশ্যে এই ধরনের পদবী ব্যবহারের ফলে কখনো খতম-এর অভিধানিক অর্থ ‘পূর্ণ’ অথবা ‘শ্রেষ্ঠ’ হয় না এবং শেষ অর্থে এর ব্যবহার ত্রুটিপূর্ণ বলেও গণ্য হয় না। একমাত্র ব্যাকরণ-রীতি সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তিই এ ধরনের কথা বলতে পারেন। কোন ভাষারই নিয়ম এ নয় যে, কোন একটি শব্দ তার আসল অর্থের পরিবর্তে কখনো কখনো দূর সম্পর্কের অন্য কোন অর্থে ব্যবহৃত হলে সেটাই তার আসল অর্থে পরিণত হবে এবং আসল আভিধানিক অর্থে তার ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। আপনি যখন কোন আরবের সম্মুখে বলবেনঃ جَاءَ خَاتَمَ القَوْمَ (জাআ খাতামুল কওম)--তখন কখনো সে মনে করবে না যে, গোত্রের শ্রেষ্ঠ অথবা কামেল ব্যক্তি এসেছে। বরং সে মনে করবে যে, গোত্রের সবাই এসে গেছে, এমনকি অবশিষ্ট শেষ ব্যক্তিটি পর্যন্তও।
এই সঙ্গে একথাটিও সামনে রাখতে হবে যে, কোন কোন লোককে যে “খাতামুশ শো’য়ারা” “খাতামুল ফুকাহা” ও “খাতামুল মুহাদ্দিসীন” উপাধিগুলো দোয়া হয়েছে সেগুলো মানুষরাই তাদেরকে দিয়েছে। আর মানুষ যে ব্যক্তিকে কোন গুণের ক্ষেত্রে শেষ বলে দিচ্ছে তার পরে ঐ গুণ সম্পন্ন আর কেউ জন্মাবে কিনা তা সে কখনোই জানতে পারে না। তাই মানুষের কথায় এ ধরনের উপাধির অর্থ নিছক বাড়িয়ে বলা এবং শ্রেষ্ঠত্ব ও পূর্ণতার স্বীকৃতি ছাড়া আর বেশী কিছু হতে পারে না। কিন্তু আল্লাহ যখন কারো ব্যাপারে বলে দেন যে, অমুক গুণটি অমুক ব্যক্তি পর্যন্ত শেষ হয়ে গেছে তখন তাকে মানুষের কথার মতো উপমা বা রূপক মনে করে নেবার কোন কারণ নেই। আল্লাহ যদি কাউকে শেষ কবি বলে দিয়ে থাকেন তাহলে নিশ্চিন্তভাবে তারপর আর কোন কবি হতে পারে না। আর তিনি যাকে শেষ নবী বলে দিয়েছেন তার পরে আর কোন নবী হওয়াই অসম্ভব। কারণ, আল্লাহ হচ্ছেন ‘আলিমুল গাইব’ এবং মানুষ আলিমুল গাইব নয়। আল্লাহর কাউকে ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’ বলে দেয়া এবং মানুষের কাউকে ‘খাতামুশ শোয়ারা বা খাতামুল ফুকারা’, বলে দেয়া কেমন করে একই পর্যায়ভুক্ত হতে পারে?
খতমে নবুওয়াত সম্পর্কে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উক্তি
পূর্বাপর সম্বন্ধ এবং আভিধানিক অর্থের দিক দিয়ে শব্দটির যে অর্থ হয়, রসূলুল্লাহর ﷺ বিভিন্ন ব্যাখ্যাও তা সমর্থন করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ এখানে কতিপয় অত্যন্ত নির্ভুল হাদীসের উল্লেখ করছিঃ(1) قَالَ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَتْ بَنُو إِسْرَائِيلَ تَسُوسُهُمُ الأَنْبِيَاءُ ، كُلَّمَا هَلَكَ نَبِىٌّ خَلَفَهُ نَبِىٌّ ، وَإِنَّهُ لاَ نَبِىَّ بَعْدِى ، وَسَيَكُونُ خُلَفَاءُ (بخارى , كتاب المناقب , باب ماذكر عن بنى اسرائيل)
রসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ বনী ইসরাঈলের নেতৃত্ব করতেন আল্লাহর রসূলগণ। যখন কোন নবী ইন্তেকাল করতেন, তখন অন্য কোন নবী তার স্থলাভিষিক্তি হতেন। কিন্তু আমার পরে কোন নবী হবে না, শুধু খলীফা।
جَاءَ خَاتَمَ القَوْمَ (2) قَالَ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ مَثَلِى وَمَثَلَ الأَنْبِيَاءِ مِنْ قَبْلِى كَمَثَلِ رَجُلٍ بَنَى بَيْتًا فَأَحْسَنَهُ وَأَجْمَلَهُ ، إِلاَّ مَوْضِعَ لَبِنَةٍ مِنْ زَاوِيَةٍ ، فَجَعَلَ النَّاسُ يَطُوفُونَ بِهِ وَيَعْجَبُونَ لَهُ ، وَيَقُولُونَ هَلاَّ وُضِعَتْ هَذِهِ اللَّبِنَةُ قَالَ فَأَنَا اللَّبِنَةُ ، وَأَنَا خَاتِمُ النَّبِيِّينَ (بخارى كتاب المناقب , باب خاتم النبين)
রসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ আমি এবং আমার পূর্ববর্তী নবীদের দৃষ্টান্ত হলো এই যে, এক ব্যক্তি একটি দালান তৈরি করলো এবং খুব সুন্দর ও শোভনীয় করে সেটি সজ্জিত করলো। কিন্তু তার এক কোণে একটি ইটের স্থান শূন্য ছিল। দালানটির চতুর্দিকে মানুষ ঘুরে ঘুরে তার সৌন্দর্য দেখে বিস্ময় প্রকাশ করছিল এবং বলছিল, “এ স্থানে একটা ইট রাখা হয়নি কেন? বস্তুত আমি সেই ইট এবং আমিই শেষ নবী।” (অর্থাৎ আমার আসার পর নবুওয়াতের দালান পূর্ণতা লাভ করেছে, এখন এর মধ্যে এমন কোন শূন্যস্থান নেই যাকে পূর্ণ করার জন্য আবার কোন নবীর প্রয়োজন হবে।)
এই বক্তব্য সম্বলিত চারটি হাদীস মুসলিম শরীফে কিতাবুল ফাযায়েলের বাবু খাতামুন নাবিয়্যানে উল্লেখিত হয়েছে এবং শেষ হাদীসটিতে এতোটুকু অংশ বর্ধিত হয়েছে- فَجِئْتُ فَخَتَمْتُ الْاَنْبِيَاءَ “অতঃপর আমি এলাম এবং আমি নবীদের সিলসিলা ‘খতম’ করে দিলাম।”
হাদীসটি তিরমিযী শরীফে এই শব্দ সম্বলিত হয়ে ‘কিতাবুল মানাকিবের বাবু ফাদলিন নবী’ এবং কিতাবুল আদাবের ‘বাবুল আমসালে’ বর্ণিত হয়েছে।
মুসনাদে আবু দাউদ তিয়ালাসীতে হাদীসটি জাবের ইবনে আবদুল্লাহ বর্ণিত হাদীসের সিলসিলায় উল্লেখিত হয়েছে এবং এর শেষ অংশটুকু হলো خُتِمَ بِى الْاَنْبِيَاء “আমার মাধ্যমে নবীদের সিলসিলা ‘খতম’ করা হলো।”
মুসনাদে আহমাদে সামান্য শাব্দিক হেরফেরের সাথে এই বক্তব্য সম্বলিত হাদীস হযরত উবাই ইবনে কা’ব, হযরত আবু সাঈদ খুদরী এবং হযরত আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে।
(3) أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ فُضِّلْتُ عَلَى الأَنْبِيَاءِ بِسِتٍّ أُعْطِيتُ جَوَامِعَ الْكَلِمِ وَنُصِرْتُ بِالرُّعْبِ وَأُحِلَّتْ لِىَ الْغَنَائِمُ وَجُعِلَتْ لِىَ الأَرْضُ مَسْجِدًا وطَهُورًا وَأُرْسِلْتُ إِلَى الْخَلْقِ كَافَّةً وَخُتِمَ بِىَ النَّبِيُّونَ- (مسلم- ترمذى- ابن ماجه)
রসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ “ছ’টা ব্যাপারে অন্যান্য নবীদের ওপর আমাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছেঃ (১) আমাকে পূর্ণ অর্থব্যঞ্জক সংক্ষিপ্ত কথা বলার যোগ্যতা দেয়া হয়েছে। (২) আমাকে শক্তিমত্তা ও প্রতিপত্তি দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে। (৩) যুদ্ধলব্ধ অর্থ-সম্পদ আমার জন্য হালাল করা হয়েছে। (৪) পৃথিবীর যমীনকে আমার জন্য মসজিদে (অর্থাৎ আমার শরীয়াতে নামায কেবল বিশেষ ইবাদাতগাহে নয়, দুনিয়ার প্রত্যেক স্থানে পড়া যেতে পারে) এবং মাটিকে পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে (শুধু পানিই নয়, মাটির সাহায্যে তায়াম্মুম করেও পবিত্রতা হাসিল অর্থাৎ অজু এবং গোসলের কাজ সম্পন্ন করা যেতে পারে) পরিণত করা হয়েছে। (৫) সমগ্র দুনিয়ার জন্য আমাকে রসূল হিসেবে পাঠানো হয়েছে এবং (৬) আমার ওপর নবীদের সিলসিলা খতম করে দেয়া হয়েছে।”
(4) قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ الرِّسَالَةَ وَالنُّبُوَّةَ قَدِ انْقَطَعَتْ فَلاَ رَسُولَ بَعْدِى وَلاَ نَبِىَّ (ترمذى- كتاب الرؤيا , باب ذهاب النبوة- مسند احمد , مرويات بن مالك رض)
রসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ “রিসালাত এবং নবুওয়াতের সিলসিলা খতম করে দেয়া হয়েছে। আমার পর আর কোন রসূল এবং নবী আসবে না।”
(5) قَالَ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم أَنَا مُحَمَّدٌ وَأَنَا أَحْمَدُ وَأَنَا الْمَاحِى الَّذِى يُمْحَى بِىَ الْكُفْرُ وَأَنَا الْحَاشِرُ الَّذِى يُحْشَرُ النَّاسُ عَلَى عَقِبِى وَأَنَا الْعَاقِبُ وَالْعَاقِبُ الَّذِى لَيْسَ بَعْدَهُ نَبِىُّ- ( بخارى ومسلم , كتاب الفضائل- باب اسماء النبى- ترمذى , كتاب الادب , باب اسماء النبى- مؤطاء- كتاب اسماء النبى- المستدرك للحاكم , كتاب التاريخ , باب اسماء النبى)
রসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ “আমি মুহাম্মাদ। আমি আহমাদ। আমি বিলুপ্তকারী, আমার সাহায্যে কুফরকে বিলুপ্ত করা হবে। আমি সমবেতকারী আমার পরে লোকদেরকে হাশরের ময়দানে সমবেত করা হবে। (অর্থাৎ আমার পরে শুধু কিয়ামতই বাকি আছে) আমি সবার শেষে আগমনকারী হলো সেই) যার পরে আর নবী আসবে না।”
(6) قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ اللَّهَ لَمْ يَبْعَثْ نَبِيًّا إِلاَّ حَذَّرَ أُمَّتَهُ الدَّجَّالَ وَأَنَا آخِرُ الأَنْبِيَاءِ وَأَنْتُمْ آخِرُ الأُمَمِ وَهُوَ خَارِجٌ فِيكُمْ لاَ مَحَالَةَ- (ابن ماجه , كتاب الفتن , باب الدجال)
রসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ “আল্লাহ নিশ্চয়ই এমন কোন নবী পাঠাননি যিনি তার উম্মাতকে দাজ্জাল সম্পর্কে সতর্ক করেননি। (কিন্তু এখন আমিই শেষ নবী এবং তোমরা শেষ উম্মাত। দাজ্জাল নিঃসন্দেহে এখন তোমাদের মধ্যে বহির্গত হবে।”
(7) عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ جُبَيْرٍ قَالَ سَمِعْتُ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِى يَقُولُ خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَوْماً كَالْمُوَدِّعِ فَقَالَ أَنَا مُحَمَّدٌ النَّبِىُّ الأُمِّىُّ ثَلاَثاً وَلاَ نَبِىَّ بَعْدِى- (مسند احمد – مرويات – عبد الله بن عمروبن العاص)
আবদুর রহমান ইবনে জোবায়ের বলেনঃ আমিআবদুল্লাহ ইবনে উমর ইবনে আ’সকে বলতে শুনেছি, একদিন রসূলুল্লাহ ﷺ নিজের গৃহ থেকে বরে হয়ে আমাদের মধ্যে তাশরীফ আনলেন। তিনি এভাবে আসলেন যেন আমাদের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি তিনবার বললেন, আমি উম্মী নবী মুহাম্মাদ। অতঃপর বললেন, আমার পর আর কোন নবী নেই।
(8) قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لاَ نُبُوّةَ بعدى الا المبشرات قِيلِ وَمَا المُبَشّرات يَا رسول الله ؟ قَالَ الرُّؤيَا الحسنة- او قَالَ الرّؤيَا الصالِحَة- ( مسند احمد , مرويات ابو الطفيل – نسائى ابو داؤد)
রসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ আমার পরে আর কোন নবুওয়াত নেই। আছে সুবংবাদ দানকারী ঘটনাবলী। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল, সুসংবাদ দানকারী ঘটনাগুলো কি? জবাবে তিনি বললেনঃ ভালো স্বপ্ন। অথবা বললেন, কল্যাণময় স্বপ্ন। (অর্থাৎ আল্লাহর অহী নাযিল হবার এখন আর সম্ভাবনা নেই। বড়জোর এতোটুকু বলা যেতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে যদি কাউকে কোন ইঙ্গিত দেয়া হয়, তাহলে শুধু ভালো স্বপ্নের মাধ্যমেই তা দেয়া হবে)।
(9) قَالَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَوْ كَانَ بَعْدِى نَبِىٌّ لَكَانَ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ- ( ترمذى – كتاب المناقب)
রসূলুল্লাহ(সা.) বলেনঃ আমার পরে যদি কোন নবী হতো, তাহলে উমর ইবনে খাত্তাব সে সৌভাগ্য লাভ করতো।
(10) قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِعَلِىٍّ أَنْتَ مِنِّى بِمَنْزِلَةِ هَارُونَ مِنْ مُوسَى إِلاَّ أَنَّهُ لاَ نَبِىَّ بَعْدِى- (بخارى ومسلم – كتاب فضائل الصحابه)
রসূলুল্লাহ ﷺ হযরত আলীকে (রা.) বলেনঃ আমার সাথে তোমার সম্পর্ক মূসারসাথে হারুনের সম্পর্কের মতো। কিন্তু আমার পরে আর কোন নবী নেই।
বুখারী এবং মুসলিম তাবুক যুদ্ধের বর্ণনা প্রসঙ্গেও এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। মুসনাদে আহমাদে এই বিষয়বস্তু সম্বলিত দু’টি হাদীস হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস থেকে বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে একটি বর্ণনার শেষাংশ হলোঃ الا انه لانبوة بعدى “কিন্তু আমার পরে আর কোন নবুওয়াত নেই।” আবু দাউদ তিয়ালাসি, ইমাম আহমাদ এবং মুহাম্মাদ ইসহাক এ সম্পর্কে যে বিস্তারিত বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন তা থেকে জানা যায় যে, তাবুক যুদ্ধে রওয়ানা হবার পূর্বে রসূলুল্লাহ ﷺ হযরত আলীকে (রা.) মদীনা তাইয়্যেবার তত্ত্বাবধান এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রেখে যাবার ফয়সালা করেন। এ ব্যাপারটি নিয়ে মুনাফিকরা বিভিন্ন ধরনের কথা বলতে থাকে। হযরত আলী (রা.) রসূলুল্লাহকে ﷺ বলেন, হে আল্লাহর রসূল, আপনি কি আমাকে শিশু এবং নারীদের মধ্যে ছেড়ে যাচ্ছেন? রসূলুল্লাহ ﷺ তাকে সান্তনা দিয়ে বলেছিলেন-আমার সাথে তোমার সম্পর্কতো মূসার সাথে হারুনের সম্পর্কের মতো। অর্থাৎ তুর পর্বতে যাবার সময় হযরত মূসা (আ) যেমন বনী ইসরাঈলদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হযরত হারুনকে পেছনে রেখে গিয়েছিলেন অনুরুপভাবে মদীনার হেফাজতের জন্য আমি তোমাকে পেছনে রেখে যাচ্ছি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে রসূলুল্লাহ ﷺ মনে এই সন্দেহও জাগে যে, হযরত হারুনের সঙ্গে এভাবে তুলনা করার ফলে হয়তো পরে এ থেকে কোন বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। কাজেই পরমুহুর্তেই তিনি কথাটা স্পষ্ট করে দেন এই বলে যে, “আমার পর আর কোন ব্যক্তি নবী হবে না।”
(11) عَنْ ثَوْبَانَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ............ وَإِنَّهُ سَيَكُونُ فِى أُمَّتِى ثَلاَثُونَ كَذَّابُونَ كُلُّهُمْ يَزْعُمُ أَنَّهُ نَبِىٌّ وَأَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّينَ لاَ نَبِىَّ بَعْدِى- (ابو داود – كتاب الفتن)
হযরত সাওবান বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ আর কথা হচ্ছে এই যে, আমার উম্মতের মধ্যে ত্রিশজন মিথ্যাবাদী হবে। তাদের প্রত্যেকেই নিজেকে নবী বলে দাবী করবে। অথচ আমার পর আর কোন নবী নেই।
এ বিষয়বস্তু সম্বলিত আর একটি হাদীস আবু দাউদ ‘কিতাবুল মালাহেমে’ হযরত আবু হুরাইরা ﷺ থেকে বর্ণনা করেছেন। তিরমিযীও হযরত সাওবান এবং হযরত আবু হুরাইরা ﷺ থেকে এ হাদীস দু’টি বর্ণনা করেছেন। দ্বিতীয় বর্ণনাটির শব্দ হলো এই-
حَتَّى يُبْعَثَ دَجَّالُونَ كَذَّابُونَ قَرِيب مِنْ ثَلاَثِينَ ، كُلُّهُمْ يَزْعُمُ أَنَّهُ رَسُولُ اللَّهِ-
অর্থাৎ এমন কি ত্রিরিশ জনের মতো প্রতারক আসবে। তাদের মধ্য থেকে প্রত্যেকেই দাবী করবে যে, সে আল্লাহর রসূল।
(12) قَالَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَقَدْ كَانَ فِيمَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ مِنْ بَنِى إِسْرَائِيلَ رِجَالٌ يُكَلَّمُونَ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَكُونُوا أَنْبِيَاءَ ، فَإِنْ يَكُنْ مِنْ أُمَّتِى مِنْهُمْ أَحَدٌ فَعُمَرُ- (بخارى , كتاب المناقب)
রসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ তোমাদের পূর্বে অতিবাহিত বনী ইসরাঈল জাতির মধ্যে অনেক লোক এমন ছিলেন, যাদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে, অথচ তারা নবী ছিলেন না। আমার উম্মাতের মধ্যে যদি এমন কেউ হয়, তাহলে সে হবে উমর।
মুসলিমে এই বিষয়বস্তু সম্বলিত যে হাদীস উল্লেখিত হয়েছে, তাতে يكلمون এর পরিবর্তে محدثون শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু মুকাল্লাম এবং মুহাদ্দাস শব্দ দু’টি সমার্থক। অর্থাৎ এমন ব্যক্তি যার সঙ্গে আল্লাহ তায়ালা কথা বলেছেন অথবা যার সাথে পর্দার পেছন থেকে কথা বলা হয়। এ থেকে জানা যায় যে, নবুওয়াত ছাড়াও যদি এই উম্মাতের মধ্যে কেউ আল্লাহর সাথে কথা বলার সৌভাগ্য অর্জন করতো তাহলে তিনি একমাত্র হযরত উমরই হতেন।
(13) قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لاَ نَبِىَّ بَعْدِى وَلاَ أَمَةً بَعْدَ اُمَّتِى (بيهقى , كتاب الرؤيا – طبرانى)
রসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ আমার পরে আর কোন নবী নেই এবং আমার উম্মাতের পর আর কোন উম্মাত (অর্থাৎ কোন ভবিষ্যত নবীর উম্মাত) নেই।
(14) قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَإِنِّى آخِرُ الأَنْبِيَاءِ وَإِنَّ مَسْجِدِى آخِرُ الْمَسَاجِدِ- (مسلم , كتاب الحج . باب فضل الصلواة بمسجد مكة والمدينة)
রসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ আমি শেষ নবী এবং আমার মসজিদ (অর্থাৎ মসজিদে নববী) শেষ মসজিদ। ১
রসূলুল্লাহর ﷺ নিকট থেকে বহু সাহাবী হাদীসগুলো বর্ণনা করেছেন এবং বহু মুহাদ্দিস অত্যন্ত শক্তিশালী এবং নির্ভরযোগ্য সনদসহ এগুলো উদ্ধৃত করেছেন। এগুলো অধ্যয়ন করার পর স্পষ্ট জানা যায় যে, রসূলুল্লাহ ﷺ বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন শব্দের ব্যবহার করে একথা পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, তিনি শেষ নবী। তার পর কোন নবী আসবে না। নবুওয়াতের সিলসিলা তার ওপর খতম হয়ে গেছে এবং তার পরে যে ব্যক্তি রসূল অথবা নবী হবার দাবী করবে, সে হবে দাজ্জাল (প্রতারক) এবং কাজ্জাব ও মিথ্যুক। ২ কুরআনের “খাতামুন নাবিয়্যীন” শব্দের এর চাইতে বেশী শক্তিশালী, নির্ভরযোগ্যএবং প্রামান্য ব্যাখ্যা আর কি হতে পারে! রসূলুল্লাহর বাণীই এখানে চরম সনদ এবং প্রমাণ। উপরন্তু যখন তা কুরআনের একটি আয়াতের ব্যাখ্যা করে তখন আরো অধিক শক্তিশালী প্রমাণে পরিণত হয়। এখন প্রশ্ন হলো এই যে, মুহাম্মাদের ﷺ চেয়ে বেশী কে কুরআনকে বুঝেছে এবং তার চাইতে বেশী এর ব্যাখ্যার অধিকার কার আছে? এমন কে আছে যে খতমে নবুওয়াতের অন্য কোন অর্থ বর্ণনা করবে এবং তা মেনে নেয়া তো দূরের কথা, সে দিকে ভ্রূক্ষেপ করতেও আমরা প্রস্তুত হবো?
১. খতমে নবুওয়াত অস্বীকারীরা এ হাদীস থেকে প্রমাণ করে যে, রসূলুল্লাহ ﷺ যেমন তাঁর মসজিদকে শেষ মসজিদ বলেছেন, অথচ এটি শেষ মসজিদ নয়; এরপরও দুনিয়ার বেশুমার মসজিদ নির্মিত হয়েছে অনুরূপভাবে তিনি বলেছেন যে, তিনি শেষ নবী। এর অর্থ হলো এই যে, তাঁর পরেও নবী আসবেন। অবশ্য শ্রেষ্ঠত্বের দিক দিয়ে তিনি হলেন শেষ নবী এবং তাঁর মসজিদ শেষ মসজিদ। কিন্তু আসলে এ ধরনের বিকৃত অর্থই একথা প্রমাণ করে যে, এ লোকগুলো আল্লাহ এবং রসূলের কালামের অর্থ অনুধাবন করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। মুসলিম শরীফের যে স্থানে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে সেখানে এ বিষয়ের সমস্ত হাদীস সম্মুখে রাখলেই একথা পরিষ্ফুট হবে যে, রসূল্লাহ ﷺ তাঁর মসজিদকে শেষ মসজিদ কোন্ অর্থে বলেছেন। এখানে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ ), হযরত আবদুল্লাহইবনে উমর (রাঃ ) এবং হযরত মায়মুনার (রাঃ ) যে বর্ণনা ইমাম মুসলিম উদ্ধৃত করেছেন, তাতে বলা হয়েছে, দুনিয়ার মাত্র তিনটি মসজিদ এমন রয়েছে যেগুলো সাধারণ মসজিদগুলোর ওপর শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার। সেখানে নামায পড়লে অন্যান্য মসজিদের চেয়ে হাজার গুণ বেশী সওয়াব হাসিল হয় এবং এ জন্য একমাত্র এ তিনটি মসজিদে নামায পড়ার জন্য সফর করা জায়েয। দুনিয়ার অবশিষ্ঠ মসজিদগুলোর মধ্যে সমস্ত মসজিদকে বাদ দিয়ে বিশেষ করে একটি সমজিদে নামায পড়বার জন্য সেদিকে সফর করা জায়েয নয়। এর মধ্যে মসজিদুল হারাম হলো প্রথম মসজিদ। হযরত ইবরাহীম (আঃ ) এটি বানিয়েছিলেন। দ্বিতীয়টি মদীনা তাইয়েবার মসজিদে নববী। এটি নির্মাণ করেন রসূলুল্লাহ (সাঃ )। রসূলুল্লাহ (সাঃ ) এরশাদের অর্থ হলো এই যে, এখন যেহেতু আমার পর আর কোন নবী আসবে না, সেহেতু আমার মসজিদের পর দুনিয়ার আর চতুর্থ এমন কোন মসজিদ নির্মিত হবে না, যেখানে নামায পড়ার সওয়াব অন্যান্য মসজিদের তুলনায় বেশী হবে এবং সেখানে নামায পড়ার উদ্দেশ্যে সেদিকে সফর করা জায়েয হবে।
২. শেষ নবুওয়াতে অবিশ্বাসীরা নবী করিমের (সাঃ ) হাদীসের বিপরীতে হযরত আয়েশার (রাঃ ) বলে কথিত নিম্নোক্ত বর্ণনার উদ্ধৃতি দেয় ঃ “বল নিশ্চয়ই তিনি খাতামুন নাবিয়্যীন, একথা বলো না যে তার পর নবী নেই।” প্রথমত নবী করিমের (সা;) সুস্পষ্ট আদেশকে অস্বীকার করার জন্য হযরত আয়েশার (রাঃ) উদ্ধৃতি দেয়া একটা ধৃস্টতা। অধিকন্তু হযরত আয়েশার (রা.) বলে কথিত উপরোক্ত উদ্ধৃতি মোটেই নির্ভরযোগ্য নয়। হাদীস শাস্ত্রের কোন প্রমাণিক গ্রন্থেই হযরত আয়েশার (রা.) উপরোক্ত উক্তির উল্লেখ নেই। কোন বিখ্যাত হাদীস লিপিবদ্ধকারী এ হাদীসটি লিপিবদ্ধ বা উল্লেখ করেনি। উপরোক্ত হাদীসটি ‘দুররি মানসূর’ নামক তাফসীর এবং ‘তাকমিলাহ মাজমা-উল-বিহার’ নামক অপরিচিত হাদীস সংকলন থেকে নেয়া হয়েছে; কিন্তু এর উৎপত্তি বা বিশ্বস্ততা সম্বন্ধে কিছুই জানা নেই। রসূল (সা.)-এর সুস্পষ্ট হাদীস বর্ণনাকারীরা খুবই নির্ভরযোগ্য সূত্র ধেকে বর্ণনা করেছেন, তাকে অস্বীকার করার জন্য হযরত আয়েশার (রা.) উক্তির, যা দুর্বলতম সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। উল্লেখ চূড়ান্ত ধৃষ্টতা মাত্র।
সাহাবীদের ইজমা-
কুরআন এবং সুন্নাহর পর সাহাবায়ে কেরামের ইজমা বা মতৈক্য হলো তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সমস্ত নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, রসূলুল্লাহর ﷺ ইন্তেকালের অব্যবহিত পরেই যেসব লোক নবুওয়াতের দাবী করে এবং যারা তাদের নবুওয়াত স্বীকার করে নেয়, তাদের সবার বিরুদ্ধে সাহাবায়ে কেরাম সম্মিলিতভাবে যুদ্ধ করেছিলেন। এ সম্পর্কে মুসাইলামা কাজ্জাবের ব্যাপারটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সে রসূলুল্লাহর ﷺ নবুওয়াত অস্বীকার করছিল না; বরং সে দাবী করেছিলযে, রসূলুল্লাহর নবুওয়াতে তাকেও অংশীদার করা হয়েছে। রসূলুল্লাহর ইন্তেকালের পূর্বে সে তার নিকট যে চিঠি পাঠিয়েছিল তার আসল শব্দ হলো এইঃمِن مُسَيلَمَةِ رَسُوْلُ اللهِ اِلى مُحمَّدِرَّسُولُ الله سَلَامٌ عَلَيْكَ فَاِنِّى اُشْرِكْتُ فِى الْاَمْرِ مَعَكَ (طبرى ,جلد 2,صفحة 399,طبع مصر)
“আল্লাহর রসূল মুসাইলামার তরফ হতে আল্লাহর রসূল মুহাম্মাদের নিকট। আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আপনি জেনে রাখুন, আমাকে আপনার সাথে নবুওয়াতের কাজে শরীক করা হয়েছে।”
এছাড়াও ঐতিহাসিক তাবারী একথাও বর্ণনা করেছেন যে, মুসাইলামার ওখানে যে আযান দেয়া হতো তাতে اشهد ان محمدا رسول الله শব্দাবলীও বলা হতো। এভাবে স্পষ্ট করে রিসালাতে মুহাম্মাদীকে স্বীকার করে নেবার পরও তাকে কাফের ও ইসলামী মিল্লাত বহির্ভূত বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়েছে। ইতিহাস থেকে একথাও প্রমাণ হয় যে, বনু হোনায়ফা সরল অন্তকরণে তার ওপর ঈমান এনেছিল। অবশ্য তারা এই বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েছিল যে, মুহাম্মাদ ﷺ নিজেই তাকে তার নবুওয়াতের কাজে শরীক করেছেন। এছাড়াও আর একটা কথা হলো এই যে, মদীনা তাইয়্যেবা থেকে এক ব্যক্তি কুরআনের শিক্ষা গ্রহণ করেছিল এবং বনু হোনায়ফারনিকটে গিয়ে সে কুরআনের আয়াতকে মুসাইলামার নিকট অবতীর্ণ আয়াতরূপে পেশ করেছিল। (البداية والنهاية لابن كثير – جلدة صفحة 1) কিন্তু এ সত্ত্বেও সাহাবায়ে কেরাম তাকে মুসলমান বলে স্বীকার করেননি এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। অতঃপর একথা বলার যুযোগ নেই যে, ইসলাম বহির্ভূত হবার কারণে সাহাবীগণ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেননি বরং বিদ্রোহ ঘোষণা করার কারণেই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়েছিল। ইসলামী আইনের দৃষ্টিতে বিদ্রোহী মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হলেও তাদের যুদ্ধ বন্দীদেরকে গোলামে পরিণত করা যেতে পারে না। বরং শুধু মুসলমানই নয় জিম্মীও (অসুমলিম) বিদ্রোহ ঘোষণা করলে, গ্রেফতার করার পর তাকে গোলামে পরিণত করা জায়েয নয়। কিন্তু মুসাইলামা এবং তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) ঘোষণা করেন যে, তাদের মেয়েদের এবং অপ্রাপ্ত বয়স্কা ছেলেদেরকে গোলাম বানানো হবে এবং গ্রেফতার করার পর দেখা গেলো, সত্যি সত্যিই তাদেরকে গোলাম বানানো হয়েছে। হযরত আলী (রা.) তাদের মধ্য থেকেই জনৈক যুদ্ধ বন্দিনীর মালিক হন। এই যুদ্ধ বন্দিনীর গর্ভজাত পূত্র মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়াই হলেন ১পরবর্তীকালে ইসলামের ইতিহাসে সবর্জন পরিচিত ব্যক্তি। (البداية والنهاية جلد 2- صفحه 316-320) এ থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সাহাবায়ে কেরাম যে অপরাধের কারণে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন, তা কোন বিদ্রোহের অপরাধ ছিল না বরং সে অপরাধ ছিল এই যে, এক ব্যক্তি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরে নবুওয়াতের দাবী করে এবং অন্য লোকেরা তার নবুওয়াতের ওপর ঈমান আনে। রসূলুল্লাহর ইন্তেকালের অব্যবহিত পরেই এই পদক্ষেপ গৃহীত হয়। এর নেতৃত্ব দেন হযরত আবু বকুর সিদ্দীক (রা.) এবং সাহাবীদের সমগ্র দলটি একযোগে তার নেতৃত্বাধীনে এ কাজে অগ্রসর হন। সাহাবীদের ইজমার এর চাইতে সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত আর কি হতে পারে।
উম্মাতের সমগ্র আলেম সমাজের ইজমা-
শরীয়তে সাহাবীদের ইজমার পর চতুর্থ পর্যায়ের সবচাইতে শক্তিশালী দলিল হলো সাহাবীগণের পরবর্তী কালের আলেম সমাজের ইজমা। এদিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যায়, হিজরীর প্রথম শতাব্দী থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত প্রত্যেক যুগের এবং সমগ্র মুসলিমজাহানের প্রত্যেক এলাকার আলেম সমাজ হামেশাই এ ব্যাপারে একমত রয়েছেন যে, “মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরপরে কোন ব্যক্তি নবী হতে পারে না এবং তার পর যে ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবী করবে এবং যে ব্যক্তি এই মিথ্যা দাবীকে মেনে নেবে, সে কাফের এবং মিল্লাতে ইসলামের মধ্যে তার স্থান নেই।”এ ব্যাপারে আমি কতিপয় প্রমাণ পেশ করছিঃ
১) ইমাম আবু হানীফার যুগে (৮০-১৫০ হি) এক ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবী করে এবং বলেঃ “আমাকে সুযোগ দাও, আমি নবুওয়াতের সংকেত চিহ্ন পেশ করব।”
একথা শুনে ইমাম সাহেব বলেনঃ যে ব্যক্তি এর কাছ থেকে নবুওয়াতের কোন সংকেত চিহ্ন তলব করবে সেও কাফের হয়ে যাবে। কেননা রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ لَانَبِىُّ بَعْدِىْ “আমার পর আর কোন নবী নেই।”
১.হানাফিয়া নামে বনু হানাফিয়্যা গোত্রের মহিলা।
২) আল্লামা ইবনে জারীর তাবারী (২২৪-৩১০ হি) তাঁর বিখ্যাত কুরআনের তাফসীরে (ولكن رسول الله وخاتم النبين) আয়াতটির বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ اَلَّذِىْ خَتَمَ اللنُّبُوَّةَ فَطُبِعَ عَلَيْهَا فَلَا تُفْتَحْ لَاحَدِ بَعْدَهُ اِلَى قِيَامِ السَّاعَةِ- “যে নবুওয়াতকে খতম করে দিয়েছে এবং তার ওপর মোহর লাগিয়ে দিয়েছে কিয়ামত পর্যন্ত এর দরজা আর কারো জন্য খুলবে না।” (তাফসীরে ইবনে জারীর ২২ খন্ড ১২ পৃষ্ঠা।
৩) ইমাম তাহাবী (হি ২৩৯-৩২১) তার আকীদাতুস সালাফীয়া গ্রন্থে সালাফেসালেহীন (প্রথম যুগের শ্রেষ্ঠ সৎকর্মশীলগণ) এবং বিশেষ করে ইমাম আবু হানীফা, ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ রাহেমাহুমুল্লাহর আকিদা বিশ্বাস বর্ণনা প্রসঙ্গে নবুওয়াত সম্পর্কিত এ বিশ্বাস লিপিবদ্ধ করেছেন যে, “আর মুহাম্মাদ ﷺ হচ্ছেন আল্লাহর প্রিয়তম বান্দা, নির্বাচিত নবী ও পছন্দনীয় রসূল এবং শেষ নবী, মুত্তাকীদের উম্মাত, রসূলদের সরদার ও রব্বুল আলামীনের বন্ধু। আর তার পর নবুওয়াতের প্রত্যেকটি দাবী পথভ্রষ্টতা এবং প্রবৃত্তির লালসার বন্দেগী ছাড়া আর কিছুই নয়।”(শারহুত তাহাবীয়া ফিল আকীদাতিস সালাফিয়া, দারুল মাআরিফ মিসর, ১৫, ৮৭, ৯৬, ৯৭, ১০০ ও ১০২ পৃষ্ঠা।
৪) আল্লামা ইবনে হাজাম আন্দালুস (৩৮৪-৪৫৬) হি) লিখেছেনঃ নিশ্চয়ই রসূলুল্লাহ ইন্তেকালের পর অহীর সিলসিলা খতম হয়ে গেছে। এর সপক্ষে যুক্তি এই যে, অহী আসে একমাত্র নবীর কাছে এবং মহান আল্লাহ বলেছেন, মুহাম্মাদ তোমাদের পুরুষদের মধ্যে কারো পিতা নয়। কিন্তু সে আল্লাহ রসূল এবং সর্বশেষ নবী (আল মুহাল্লা, প্রথম খন্ড ২৬ পৃষ্ঠা)
৫) ইমাম গাযযালী বলেন-(৪৫০-৫০৫ হি) ১
لو فتح هذا الباب (اى باب انكار كون الاجماع حجة) ابجو الى امور شنيعة وهو ان قائلا لو قال يجوز ان بيعث رسول بعد نبينا محمد صلى الله عليه وسلم فيبعد التوقف فى تكفيره , ومستبعد استحالة ذالك عند البحث تستمد من الاجماع لامحالة , فان العقل لايحيله , وما نقل فيه من قوله لانبى بعدى , ومن قوله تعالى خاتم النبيين , فلا يعجز هذا القائل عن تاويله , فيقول خاتم النبيين اراد به اولوا العزم من الرسل , فان قالوا النبيين عام , فلا يبعد تخصيص العام , وقوله لا نبى بعدى لم يردبه الرسول وفوق بين النبى والرسول والنبى اعلى مرتبة من الرسول الى غير ذالك من انواع الهذيان , فهذا وامثاله لايمكن ان ندعى استحالته , من حيث مجرد اللفظ , فانا فى تاويل ظواهر التشبيه فضينا باحتمالات ابعد من هذه , ولم يكن ذالك مبطلا للنصوص , ولكن الرد على هذا القائل ان الامة فهمت بالاجماع من هذا اللفظ ومن قرائن احواله انه افهم عدم نبى بعده , ابدا وعدم رسول الله ابدا وانه ليس فيه تاويل ولاتخصيص فمنكر هذا لايكون الامنكر الاجماع (الاقتصاد فى الاعتقاد المطبعة الادبيه , مصر , ص 114) “যদি এ দরোজাটি (অর্থাৎ ইজমাকে প্রমাণ হিসেবে মানতে অস্বীকার করার দরোজা) খুলে দেয়া হয় তাহলে বড়ই ন্যক্কারজনক ব্যাপার হয়েদাঁড়াবে। যেমন যদি কেউ বলে, আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরে অন্য কোন নবীর আগমন অসম্ভব নয়, তাহলে তাকে কাফের বলার ব্যাপারে ইতস্তত করা যেতে পারে না। কিন্তু বিতর্কের সময় যে ব্যক্তি তাকে কাফের আখ্যায়িত করতে ইতস্তত করাকে অবৈধ প্রমাণ করতে চাইবে তাকে অবশ্যইইজমার সাহায্য নিতে হবে। কারণ নিরেট যুক্তি দ্বারা তার অবৈধ হবার ফয়সালা করা যায় না। আর কুরআন ও হাদীসের বাণীর ব্যাপারে বলা যায়, এ মতে বিশ্বাসী কোন ব্যক্তি “আমার পরে আর কোন নবী নেই।” এবং “নবীদের মোহর”এ উক্তি দু’টির নানা রকম চুলচেরা ব্যাখ্যা করতে অক্ষম হবে না। সে বলবে, “খাতামুন নাবীয়্যীন”মানে হচ্ছে অতীব মর্যাদাবান নবীদের আগমন শেষ হয়ে যাওয়া। আর যদি বলা হয়, “নবীগণ” শব্দটি দ্বারা সাধারণভাবে সকল নবীকে বুঝানো হয়েছে, তাহলে এই সাধারণ থেকে অসাধাণ ও ব্যতিক্রমী বের করা তার জন্য মোটেই কঠিন হবে না। “আমার পর আর নবী নেই” এ ব্যাপারে সে বলে দেবে, “আমার পর আর রসূল নেই” একথা তো বলা হয়নি। রসূল ও নবীর মধ্যে পার্থক্য আছে। নবীর মর্যাদা রসূলের চেয়ে বেশী। মোটকথা এ ধরনের আজেবাজে উদ্ভট কথা অনেক বলা যেতে পারে। আর নিছক শাব্দিক দিক দিয়ে এ ধরনের চুলচেরা ব্যাখ্যাকে আমরা একেবারে অসম্ভব ও বলি না। বরং বাহ্যিক উপমার ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আমরা এর চেয়েও দূরবর্তী সম্ভাবনার অবকাশ স্বীকার করি। আর এ ধরনের