পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

১৫৪ আয়াত

৪২ ) এদের আগে যারা অতিক্রান্ত হয়েছে তারাও বড় বড় চক্রান্ত করেছিল ৬১ কিন্তু আসল সিদ্ধান্তকর কৌশল তো পুরোপুরি আল্লাহর হাতে রয়েছে। তিনি জানেন কে কি উপার্জন করছে এবং শীঘ্রই এ সত্য অস্বীকারকারীরা দেখে নেবে কার পরিণাম ভালো হয়।
وَقَدْ مَكَرَ ٱلَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ فَلِلَّهِ ٱلْمَكْرُ جَمِيعًۭا ۖ يَعْلَمُ مَا تَكْسِبُ كُلُّ نَفْسٍۢ ۗ وَسَيَعْلَمُ ٱلْكُفَّـٰرُ لِمَنْ عُقْبَى ٱلدَّارِ ٤٢
৪৩ ) এ অস্বীকারকারীরা বলে, তুমি আল্লাহর প্রেরিত নও। বলো, “আমার ও তোমাদের মধ্যে আল্লাহর সাক্ষ যথেষ্ট এবং তারপর আসমানী কিতাবের জ্ঞান রাখে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির সাক্ষ।” ৬২
وَيَقُولُ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ لَسْتَ مُرْسَلًۭا ۚ قُلْ كَفَىٰ بِٱللَّهِ شَهِيدًۢا بَيْنِى وَبَيْنَكُمْ وَمَنْ عِندَهُۥ عِلْمُ ٱلْكِتَـٰبِ ٤٣
১ ) আলিফ লাম্‌ র। হে মুহাম্মাদ। এটি একটি কিতাব, তোমার প্রতি এটি নাযিল করেছি, যাতে তুমি লোকদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর মধ্যে নিয়ে আসো তাদের রবের প্রদত্ত সুযোগ ও সামর্থ্যের ভিত্তিতে, এমন এক আল্লাহর পথে যিনি প্রবল প্রতাপান্বিত ও আপন সত্তায় আপনি প্রশংসিত
الٓر ۚ كِتَـٰبٌ أَنزَلْنَـٰهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ ٱلنَّاسَ مِنَ ٱلظُّلُمَـٰتِ إِلَى ٱلنُّورِ بِإِذْنِ رَبِّهِمْ إِلَىٰ صِرَٰطِ ٱلْعَزِيزِ ٱلْحَمِيدِ ١
২ ) এবং পৃথিবী ও আকাশের যাবতীয় বস্তুর মালিক। আর কঠিন ধ্বংসকর শাস্তি রয়েছে তাদের জন্য যারা সত্য গ্রহণ করতে অস্বীকার করে,
ٱللَّهِ ٱلَّذِى لَهُۥ مَا فِى ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَمَا فِى ٱلْأَرْضِ ۗ وَوَيْلٌۭ لِّلْكَـٰفِرِينَ مِنْ عَذَابٍۢ شَدِيدٍ ٢
৩ ) যারা দুনিয়ার জীবনকে আখেরাতের ওপর প্রাধান্য দেয় যারা লোকদেরকে আল্লাহর পথ থেকে রুখে দিচ্ছে এবং চাচ্ছে এ পথটি (তাদের আকাংখা অনুযায়ী) বাঁকা হয়ে যাক। ভ্রষ্টতায় এরা অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
ٱلَّذِينَ يَسْتَحِبُّونَ ٱلْحَيَوٰةَ ٱلدُّنْيَا عَلَى ٱلْـَٔاخِرَةِ وَيَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِ وَيَبْغُونَهَا عِوَجًا ۚ أُو۟لَـٰٓئِكَ فِى ضَلَـٰلٍۭ بَعِيدٍۢ ٣
৪ ) আমি নিজের বাণী পৌঁছাবার জন্য যখনই কোন রসূল পাঠিয়েছি, সে তার নিজের সম্প্রদায়েরই ভাষায় বাণী পৌঁছিয়েছে, যাতে সে তাদেরকে খুব ভালো করে পরিষ্কারভাবে বুঝাতে পারে। তারপর আল্লাহ যাকে চান তাকে পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে চান হেদায়াত দান করেন। তিনি প্রবল পরাক্রান্ত ও জ্ঞানী।
وَمَآ أَرْسَلْنَا مِن رَّسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهِۦ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ ۖ فَيُضِلُّ ٱللَّهُ مَن يَشَآءُ وَيَهْدِى مَن يَشَآءُ ۚ وَهُوَ ٱلْعَزِيزُ ٱلْحَكِيمُ ٤
৫ ) আমি এর আগে মূসাকেও নিজের নিদর্শনাবলী সহকারে পাঠিয়ে ছিলাম। তাকেও আমি হুকুম দিয়েছিলাম, নিজের সম্প্রদায়কে অন্ধকার থেকে বের করে আলোকের মধ্যে নিয়ে এসো এবং তাদেরকে ইতিহাসের শিক্ষণীয় ঘটনাবলী শুনিয়ে উপদেশ দাও। এ ঘটনাবলীর মধ্যে বিরাট নিদর্শন রয়েছে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে সবর করে ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। ১০
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا مُوسَىٰ بِـَٔايَـٰتِنَآ أَنْ أَخْرِجْ قَوْمَكَ مِنَ ٱلظُّلُمَـٰتِ إِلَى ٱلنُّورِ وَذَكِّرْهُم بِأَيَّىٰمِ ٱللَّهِ ۚ إِنَّ فِى ذَٰلِكَ لَـَٔايَـٰتٍۢ لِّكُلِّ صَبَّارٍۢ شَكُورٍۢ ٥
৬ ) স্মরণ করো যখন মূসা তার সম্প্রদায়কে বললো, “আল্লাহর সেই অনুগ্রহের কথা স্মরণ করো যা তিনি তোমাদের প্রতি করেছেন। তিনি তোমাদের ফিরাউনী সম্প্রদায়ের কবল থেকে মুক্ত করেছেন, যারা তোমাদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালাতো, তোমাদের ছেলেদের হত্যা করতো এবং তোমাদের মেয়েদের জীবিত রাখতো। এর মধ্যে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য মহা পরীক্ষা ছিল।
وَإِذْ قَالَ مُوسَىٰ لِقَوْمِهِ ٱذْكُرُوا۟ نِعْمَةَ ٱللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ أَنجَىٰكُم مِّنْ ءَالِ فِرْعَوْنَ يَسُومُونَكُمْ سُوٓءَ ٱلْعَذَابِ وَيُذَبِّحُونَ أَبْنَآءَكُمْ وَيَسْتَحْيُونَ نِسَآءَكُمْ ۚ وَفِى ذَٰلِكُم بَلَآءٌۭ مِّن رَّبِّكُمْ عَظِيمٌۭ ٦
৭ ) আর স্মরণ করো, তোমাদের রব এই বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, যদি কৃতজ্ঞ থাকো ১১ তাহলে আমি তোমাদের আরো বেশী দেবো আর যদি নিয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞ হও তাহলে আমার শাস্তি বড়ই কঠিন। ১২
وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكُمْ لَئِن شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ ۖ وَلَئِن كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِى لَشَدِيدٌۭ ٧
৮ ) আর মূসা বললো, “যদি তোমরা কুফরী করো এবং পৃথিবীর সমস্ত অধিবাসীও কাফের হয়ে যায় তাহলে আল্লাহর কিছুই আসে যায় না এবং তিনি আপন সত্তায় আপনি প্রশংসিত।” ১৩
وَقَالَ مُوسَىٰٓ إِن تَكْفُرُوٓا۟ أَنتُمْ وَمَن فِى ٱلْأَرْضِ جَمِيعًۭا فَإِنَّ ٱللَّهَ لَغَنِىٌّ حَمِيدٌ ٨
৬১.
সত্যের কণ্ঠ রুদ্ধ করার জন্য মিথ্যা, প্রতারণা ও জুলুমের অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, এটা আজ কোন নতুন কথা নয়। অতীতে বারবার এমনি ধরনের কৌশল অবলম্বন করে সত্যের দাওয়াতকে পরাস্ত করার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
.
৬২.
অর্থাৎ আসমানী কিতাবের জ্ঞান রাখে এমন প্রত্যেক ব্যক্তি একথার সাক্ষ্য দেবে যে, যাকিছু আমি পেশ করছি তা ইতিপূর্বে আগত নবীগণের শিক্ষার পুনরাবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই নয়।
১.
অন্ধকার থেকে বের করে আলোর মধ্যে আনার মানে হচ্ছে, শয়তানের পথ থেকে সরিয়ে আল্লাহর পথে নিয়ে আসা। অন্য কথায়, যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে নেই সে আসলে অজ্ঞতা ও মূর্খতার অন্ধকারে বিভ্রান্তের মতো পথ হাতড়ে মরেছে। সে নিজেকে যতই উন্নত চিন্তার অধিকারী এবং জ্ঞানের আলোকে যতই উদ্ভাসিত মনে করুক না কেন তাতে আসল অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় না পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহর পথের সন্ধান পেয়েছে, গ্রামীণ এলাকার একজন অশিক্ষিত লোক হলেও সে আসলে জ্ঞানের আলোর রাজ্যে পৌঁছে গেছে।

তারপর এই যে, বলা হয়েছে “যাতে তুমি এদেরকে রবের প্রদত্ত সুযোগ ও সামর্থ্যের ভিত্তিতে আল্লাহর পথে নিয়ে এসো” এ উক্তির মধ্যে আসলে এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, কোন প্রচারক, তিনি নবী হলেও, সঠিক পথ দেখিয়ে দেয়া ছাড়া তিনি আর বেশী কিছু করতে পারেন না। এটা পুরোপুরি আল্লাহর দেয়া সুযোগ ও সামর্থ্যের ওপর নির্ভর করে। আল্লাহ কাউকে সুযোগ দিলে সে হেদায়াত লাভ করতে পারে। নয়তো নবীর মতো সফল ও পূর্ণ শক্তিধর প্রচারকও নিজের সকল শক্তি নিয়োগ করেও তাকে হেদায়াত দান করতে পারেন না। আর আল্লাহর সুযোগ দান সম্পর্কে বলা যায়, এর একটি স্বতন্ত্র বিধান রয়েছে। কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় এটি সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ থেকে পরিষ্কার জানা যায়, আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়াত লাভের সুযোগ একমাত্র সেই ব্যক্তি পায় যে নিজেই হেদায়াতের প্রত্যাশী হয়, জিদ, হঠকারিতা ও হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত থাকে, নিজের প্রবৃত্তি ও কামনা বাসনার দাস হয় না, পরিষ্কার খোলা চোখে দেখে সজাগ ও সতর্ক কানে শোনে, মুক্ত সুস্থ ও পরিষ্কার মস্তিষ্কে চিন্তা করে এবং যুক্তিসঙ্গত কথাকে কোন প্রকার পক্ষপাতিত্বের আশ্রয় না নিয়ে মেনে নেয়।

২.
মূল আয়াতে বলা হয়েছে ‘হামীদ’। হামীদ শব্দটি ‘মাহমুদ’ (প্রশংসিত)-এর সমার্থক হলেও উভয় শব্দের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। কাউকে মাহমুদ তখনই বলা হবে যখন তার প্রশংসা করা হয়েছে বা হয়। কিন্তু “হামীদ” বললে বুঝা যাবে কেউ তার প্রশংসা করুক বা না করুক সে নিজেই প্রশংসার অধিকারী ও যোগ্য। এখানে প্রশংসিত, প্রশংসার যোগ্য ও প্রশংসা লাভের হকদার ইত্যাদি শব্দের মাধ্যমে এ শব্দটির পূর্ণ অর্থ প্রকাশ হয় না। তাই আমি এর অনুবাদ করেছি আপন সত্তায় আপনি প্রশংসিত শব্দাবলীর মাধ্যমে।
.
৩.
অথবা অন্য কথায় যারা শুধুমাত্র দুনিয়ার স্বার্থ ও লাভের কথাই চিন্তা করে, আখেরাতের কোন পরোয়া করে না। যারা বৈষয়িক লাভ, স্বাদ ও আরাম-আয়েশের বিনিময়ে আখেরাতের ক্ষতি কিনে নিতে পারে কিন্তু আখেরাতের সাফল্য ও সমৃদ্ধির বিনিময়ে দুনিয়ার কোন ক্ষতি, কষ্ট ও বিপদ এমনকি কোন স্বাদ থেকে বঞ্চিত হওয়াও বরদাশত করতে পারে না। যারা দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ের পর্যালোচনা করে ধীরে ও সুস্থ মস্তিষ্কে দুনিয়াকে বেছে নিয়েছে এবং আখেরাতের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, তার স্বার্থ যেসব ক্ষেত্রে দুনিয়ার স্বার্থের সাথে সংঘর্ষশীল হবে সেসব ক্ষেত্রে তাকে ত্যাগ করে যেতে থাকবে।
৪.
অর্থাৎ তারা আল্লাহর ইচ্ছার অনুগত হয়ে থাকতে চায় না। বরং আল্লাহর দ্বীনকে নিজেদের ইচ্ছার অনুগত করে রাখতে চায়। নিজেদের প্রত্যেকটি ভাবনা-চিন্তা, মতবাদ ও ধারণা-অনুমানকে তারা নিজেদের আকীদা-বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত করে এবং এমন কোন আকীদাকে নিজেদের চিন্তারাজ্যে অবস্থান করতে দেয় না যা তাদের ভাবনার সাথে খাপ খায় না। তারা চায় আল্লাহর দ্বীন তাদের অনুসৃত প্রত্যেকটি রীতি-নীতি, আচার-আচরণ ও অভ্যাসকে বৈধতার ছাড়পত্র দিক এবং তাদের কাছে এমন কোন পদ্ধতির অনুসরণের দাবী না জানাক যা তারা পছন্দ করে না। এরা নিজেদের প্রবৃত্তি ও শয়তানের অনুসরণে যেদিকে মুখ ফিরায়, আল্লাহর দ্বীনও যেন এদের গোলাম হয়ে ঠিক সেদিকেই মুখ ফিরায়। সে যেন কোথাও এদেরকে বাধা না দেয় বা সমালোচনা না করে এবং কোথাও এদেরকে নিজের পথের দিকে ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা না করে। আল্লাহ‌ তাদের কাছে এ ধরনের দ্বীন পাঠালেই তারা তা মানতে প্রস্তুত।
.
৫.
এর দু’টি অর্থ হয়ঃ এক, আল্লাহ‌ যে সম্প্রদায়ের মধ্যে যে নবী পাঠিয়েছেন তার ওপর তার ভাষায়ই নিজের বাণী অবতীর্ণ করেছেন। এর উদ্দেশ্য ছিল, সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায় যেন তা ভালোভাবে বুঝতে পারে এবং পরবর্তী পর্যায়ে তারা এ ধরনের কোন ওজর পেশ করতে না পারে যে, আপনার পাঠানো শিক্ষা তো আমরা বুঝতে পারিনি কাজেই কেমন করে তার প্রতি ঈমান আনতে পারতাম। দুই, আল্লাহ‌ কখনো নিছক অলৌকিক ক্ষমতা দেখাবার জন্য আরব দেশে নবী পাঠিয়ে তাদের মুখ দিয়ে জাপানী বা চৈনিক ভায়ায় নিজের কালাম শুনাননি। এ ধরনের তেলেসমাতি দেখিয়ে লোকদের অভিনবত্ব প্রিয়তাকে পরিতৃপ্ত করার তুলনায় আল্লাহর দৃষ্টিতে শিক্ষা ও উপদেশ দান এবং বুঝিয়ে বলা ও সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করাই বেশী গুরুত্বের অধিকারী। এ উদ্দেশ্যে কোন জাতিকে তার নিজের ভাষায়, যে ভাষা সে বোঝে, পয়গাম পৌঁছানো প্রয়োজন।
৬.
অর্থাৎ সমগ্র জাতি যে ভাষা বোঝে নবী সে ভাষায় তার সমগ্র প্রচার কার্য পরিচালনা ও উপদেশ দান করা সত্ত্বেও সবাই হেদায়াত লাভ করে না। কারণ কোন বাণী কেবলমাত্র সহজবোধ্য হলেই যে, সকল শ্রোতা তা মেনে নেবে এমন কোন কথা নেই। সঠিক পথের সন্ধান লাভ ও পথভ্রষ্ট হওয়ার মূল সূত্র রয়েছে আল্লাহর হাতে। তিনি যাকে চান নিজের বাণীর সাহায্যে সঠিক পথে পরিচালিত করেন এবং যার জন্য চান এ একই বাণীকে তার জন্য পথভ্রষ্টাতার উপকরণে পরিণত করেন।
৭.
অর্থাৎ লোকেরা নিজে নিজেই সৎপথ লাভ করবে বা পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে, এটা সম্ভব নয়। কারণ তারা পুরোপুরি স্বাধীন নয়। বরং আল্লাহর কর্তৃত্বের অধীন। কিন্তু আল্লাহ‌ নিজের এ কর্তৃত্বকে অন্ধের মতো প্রয়োগ করেন না। কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই তিনি যাকে ইচ্ছা হেদায়াত দান করবেন এবং যাকে ইচ্ছা প্রথভ্রষ্ট করবেন এটা তাঁর রীতি নয়। কর্তৃত্বশীল ও বিজয়ী হওয়ার সাথে সাথে তিনি জ্ঞানী এবং প্রাজ্ঞও। তাঁর কাছ থেকে কোন ব্যক্তি যুক্তিসংগত কারণেই হেদায়াত লাভ করে। আর যে ব্যক্তিকে সঠিক পথ থেকে বঞ্চিত করে ভ্রষ্টতার মধ্যে ছেড়ে দেয়া হয় সে নিজেই নিজের ভ্রষ্টতাপ্রীতির কারণে এহেন আচরণ লাভের অধিকারী হয়।
৮.
আরবী ভাষায় পারিভাষিক অর্থে ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর স্মারককে “আইয়াম” বলা হয়। “আইয়ামূল্লাহ” বলতে মানুষের ইতিহাসের এমন সব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বুঝায় যেখানে আল্লাহ‌ অতীতের জাতিসমূহ ও বড় বড় ব্যক্তিত্বকে তাদের কর্মকাণ্ড অনুযায়ী শাস্তি বা পুরস্কার দিয়েছেন।
৯.
অর্থাৎ এসব ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যে এমন সব নিদর্শন রয়েছে যার মাধ্যমে এক ব্যক্তি আল্লাহর একত্বের সত্যতা ও নির্ভুলতার প্রমাণ পেতে পারে। এ সঙ্গে এ সত্যের পক্ষেও অসংখ্য সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারে যে, প্রতিদানের বিধান একটি বিশ্বজনীন আইন, তা পুরোপুরি হক ও বাতিলের তাত্ত্বিক ও নৈতিক পার্থক্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এবং তার দাবী পূরণ করার জন্য অন্য একটি জগত অর্থাৎ পরকালীন জগত অপরিহার্য। তাছাড়া এ ঘটনাবলীর মধ্যে এমনসব নিদর্শনও রয়েছে যার সাহায্যে কোন ব্যক্তি বাতিল বিশ্বাস ও মতবাদের ভিত্তিতে জীবনের ইমারত তৈরী করার অশুভ পরিণামের সন্ধান লাভ করতে এবং তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
১০.
অর্থাৎ এ নিদর্শনসমূহ তো যথাস্থানে আছে। কিন্তু একমাত্র তারাই এ থেকে লাভবান হতে পারে যারা আল্লাহর পরীক্ষায় ধৈর্য ও অবিচলতার সাথে এগিয়ে চলে এবং আল্লাহর নিয়ামতসমূহকে যথাযথভাবে অনুভব করে তাদের জন্য যথার্থ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। নীচমনা, সংকীর্ণচেতা ও কৃতঘ্ন স্বভাবের লোকেরা যদি এ নিদর্শনগুলো উপলব্ধি করেও তাহলে তাদের এ নৈতিক দুর্বলতা তাদেরকে সেই উপলব্ধি দ্বারা লাভবান হতে দেয় না।
.
১১.
অর্থাৎ যদি আমার নিয়ামতসমূহের অধিকার ও মর্যাদা চিহ্নিত করে সেগুলোকে সঠিকভাবে ব্যবহার করো, আমার বিধানের মোকাবিলায় অহংকারে মত্ত হতে ও বিদ্রোহ করতে উদ্বুদ্ধ না হও এবং আমার অনুগ্রহের অবদান স্বীকার করে নিয়ে আমার বিধানের অনুগত থাকো।
১২.
এ বিষয়বস্তু সম্বলিত ভাষণ বাইবেলের “দ্বিতীয় বিবরণ” পুস্তকে বিস্তারিতভাবে উদ্ধৃত হয়েছে। এ ভাষণে হযরত মূসা (আ) তাঁর ইন্তিকালের কয়েকদিন আগে বনী ইসলরাঈলকে তাদের ইতিহাসের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তারপর মহান আল্লাহ‌ তাঁর মাধ্যমে বনী ইসরাঈলের নিকট তাওরাতের যেসব বিধান পাঠিয়েছিলেন তিনি সেগুলোরও পুনরাবৃত্তি করেছেন। এরপর একটি সুদীর্ঘ ভাষণ দিয়েছেন। এ ভাষণে তিনি বলেছেন, যদি তারা তাদের রবের হুকুম মেনে চলে তাহলে তাদেরকে কিভাবে পুরস্কৃত করা হবে আর যদি নাফরমানির পথ অবলম্বন করে তাহলে কেমন কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। এ ভাষণটি দ্বিতীয় বিবরণের ৪, ৬, ১০, ১১ ও ২৮ থেকে ৩০ অধ্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে। এর কোন কোন স্থান অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ও শিক্ষণীয়। উদাহরণস্বরূপ এর কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি। এ থেকে সমগ্র ভাষণটির ব্যাপারে একটা ধারণা করা যাবে।

“হে ইসরায়েল শুন; আমাদের সদাপ্রভু একই সদাপ্রভু ; আর তুমি তোমার সমস্ত হৃদয়, তোমার সমস্ত প্রাণ ও তোমার সমস্ত শক্তি দিয়া আপন সদাপ্রভুকে প্রেম করিবে। আর এই যে সকল কথা আমি অদ্য তোমাকে আজ্ঞা করি, তাহা তোমার হৃদয়ে থাকুক। আর তোমরা প্রত্যেকে আপন আ‌পন সন্তানগণকে এ সকল যত্নপূর্বক শিক্ষা দিবে এবং গৃহে বসিবার কিংবা পথে চলিবার সময়ে এবং শয়ন কিংবা গাত্রোত্থানকালে ঐ সমস্তের বিষয়ে কথোপকথন করিবে।” (২: ৪-৭)

“এখন হে ঈসরায়েল, তোমার সদাপ্রভু তোমার কাছে কি চাহেন? কেবল এই, যেন তুমি আপন সদাপ্রভুকে ভয় করো, তাঁহার সকল পথে চল ও তাঁহাকে প্রেম কর এবং তোমার সমস্ত হৃদয় ও তোমার সমস্ত প্রাণের সহিত তোমার সদাপ্রভুর সেবা কর, অদ্য আমি তোমার মঙ্গলার্থে সদাপ্রভুর যে যে আজ্ঞা ও বিধি তোমাকে দিতেছি, সেই সকল যেন পালন কর। দেখ স্বর্গ এবং পৃথিবী ও তন্মধ্যস্থ যাবতীয় বস্তু তোমার সদাপ্রভুর।” (১০: ১২-১৪)

“আমি তোমাকে অদ্য যে সকল আজ্ঞা আদেশ করিতেছি, যত্নপূর্বক সেই সকল পালন করিবার জন্য যদি তুমি আপন সদাপ্রভুর রবে মনোযোগ সহকারে কর্ণপাত কর, তবে তোমার সদাপ্রভু পৃথিবীস্থ সমস্ত জাতির উপরে তোমাকে উন্নত করিবেন; আর তোমার সদাপ্রভুর রবে কর্ণপাত করিলে এ সকল আশীর্বাদ তোমার উপর বর্তিবে ও তোমাকে আশ্রয় করিবে। তুমি নগরে আশীর্বাদযুক্ত হইবে ও ক্ষেত্রে আশীর্বাদযুক্ত হইবে। ............ তোমার যে শত্রুগণ তোমার ওপর আক্রমণ চালায় তাহাদিগকে সদাপ্রভু তোমার সম্মুখে আঘাত করাইবেন....... সদাপ্রভু আজ্ঞা করিয়া তোমার গোলাঘর সম্বন্ধে ও তুমি যে কোন কার্যে হস্তক্ষেপ কর তৎসম্বন্ধে আশীর্বাদকে তোমার সহচর করিবেন;........ সদাপ্রভু আপন দিব্যানুসারে তোমাকে আপন পবিত্র প্রজা বলিয়া স্থাপন করিবেন; কেবল তোমার সদাপ্রভুর আজ্ঞা পালন ও তাহার পথে গমন করিতে হইবে। আর পৃথিবীর সমস্ত জাতি দেখিতে পাইবে যে, তোমার উপরে সদা প্রভুর নাম কীর্তিত হইয়াছে এবং তাহারা তোমা হইতে ভীত হইবে। ......... এবং তুমি অনেক জাতিকে ঋণ দিবে, কিন্তু আপনি ঋণ লইবে না। আর সদাপ্রভু তোমাকে মস্তক স্বরূপ করিবেন, পুচ্ছ স্বরূপ করিবেন না; তুমি অবনত না হইয়া কেবল উন্নত হইবে।”(২৮: ১-১৩)

“কিন্তু যদি তুমি আপন ঈশ্বর সদাপ্রভুর রবে কর্ণপাত না কর, আমি অদ্য তোমাকে যে সকল আজ্ঞা ও বিধি আদেশ করিতেছি, যত্নপূর্বক সেই সকল পালন না কর, তবে এ সমস্ত অভিশাপ তোমার প্রতি বর্তিবে ও তোমাকে আশ্রয় করিবে। তুমি নগরে শাপগ্রস্ত হইবে ও ক্ষেত্রে শাপগ্রস্ত হইবে। ............. যে কোন কার্যে তুমি হস্তক্ষেপ কর, সেই কার্যে সদাপ্রভু তোমার উপর অভিশাপ, উদ্বেগ ও ভর্ৎসনা প্রেরণ করিবেন। ......... তুমি যে দেশ অধিকার করিতে যাইতেছ, সেই দেশ হইতে যাবৎ উচ্ছিন্ন না হও, তাবৎ সদাপ্রভু তোমাকে মহামারীর আশ্রয় করিবেন। ............ তোমার মস্তকের উপরিস্থিত আকাশ পিত্তল ও নিম্নস্থিত ভূমি লৌহস্বরূপ হইবে। ............সদাপ্রভু তোমার শত্রুদের সম্মুখে তোমাকে পরাজিত করাইবেন; তুমি একপথ দিয়া তাহাদের বিরুদ্ধে যাইবে, কিন্তু সাত পথ দিয়া তাহাদের সম্মুখে হইতে পলায়ন করিবে। ......... তোমার সাথে কন্যার বিবাহ হইবে, কিন্তু অন্য পুরুষ তাহার সহিত সঙ্গম করিবে। তুমি গৃহ নির্মাণ করিবে, কিন্তু তাহাতে বাস করিতে পারিবে না। দ্রাক্ষাক্ষেত্র প্রস্তুত করিবে, কিন্তু তাহার ফল ভোগ করিবে না। তোমার গরু তোমার সম্মুখে জবাই হইবে, .......সদাপ্রভু তোমার বিরুদ্ধে যে শত্রুগণকে তুমি পাঠাইবেন, ক্ষুধায়, তৃষ্ণায়, উলংগতায় ও সকল বিষয়ের অভাব ভোগ করিতে করিতে তাহাদের দাসত্ব করিবে; এবং যে পর্যন্ত তিনি তোমার বিনাশ না করেন, সে পর্যন্ত শত্রুরা তোমার গ্রীবাতে লৌহের জোয়াল দিয়া রাখিবে। ............আর সদাপ্রভু তোমাকে পৃথীবীর এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত সমগ্র জাতির মধ্যে ছিন্ন ভিন্ন করিবেন।”(২৮: ১৫-১৬)

১৩.
এখানে হযরত মূসা (আ) ও তাঁর জাতির ইতিহাসের প্রতি এ সংক্ষিপ্ত ইঙ্গিত করার একটি বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। তা হচ্ছে, মক্কাবাসীদেরকে একথা জানানো যে, আল্লাহ‌ যখন কোন জাতির প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং এর জবাবে সংশ্লিষ্ট জাতি বিশ্বাসাঘাতকতা ও বিদ্রোহ করে তখন এ ধরনের জাতির এমন মারাত্মক ও ভয়াবহ পরিণামের সম্মুখীন হতে হয় যার সম্মুখীন আজ তোমাদের চোখের সামনে বনী ইসলাঈলরা হচ্ছে। কাজেই তোমরাও কি আল্লাহর নিয়ামত ও তাঁর অনুগ্রহের জবাবে যে অকৃতজ্ঞ মনোভাব প্রদর্শন করে নিজেদের এ একই পরিণাম দেখতে চাও?

এ প্রসঙ্গে একথাও মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ‌ তাঁর যে নিয়ামতের কদর করার জন্য এখানে কুরাইশদের কাছে দাবী জানাচ্ছেন তা বিশেষভাবে তাঁর এ নিয়ামতটি যে, তিনি মুহাম্মাদ ﷺ কে তাদের মধ্যে পয়দা করেছেন এবং তাঁর মাধ্যমেই তাদের কাছে এমন মহিমান্বিত শিক্ষা পাঠিয়েছেন যে সম্পর্কে নবী (সা.) বারবার কুরাইশদেরকে বলতেন-

كَلِمَةٍ وَاحِدَةٍ تعطو نيها تَمْلِكُونَ بِهَا الْعَرَبُ تَدِينُ لَكمْ الْعَجَمُ-

“আমার একটি মাত্র কথা মেনে নাও। আরব ও আজম সব তোমাদের করতলগত হয়ে যাবে।”

অনুবাদ: