পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

১৫১ আয়াত

৭৪ ) তারপর নূহের পর আমি বিভিন্ন পয়গম্বরকে তাদের কওমের কাছে পাঠাই এবং তারা সুস্পষ্ট নিদর্শন নিয়ে তাদের কাছে আসে। কিন্তু যে জিনিসকে তারা আগেই মিথ্যা বলেছিল তাকে আর মেনে নিতে প্রস্তুত হলো না। এভাবে আমি সীমা অতিক্রমকারীদের দিলে মোহর মেরে দেই। ৭১
ثُمَّ بَعَثْنَا مِنۢ بَعْدِهِۦ رُسُلًا إِلَىٰ قَوْمِهِمْ فَجَآءُوهُم بِٱلْبَيِّنَـٰتِ فَمَا كَانُوا۟ لِيُؤْمِنُوا۟ بِمَا كَذَّبُوا۟ بِهِۦ مِن قَبْلُ ۚ كَذَٰلِكَ نَطْبَعُ عَلَىٰ قُلُوبِ ٱلْمُعْتَدِينَ ٧٤
৭৫ ) তারপর ৭২ মুসা ও হারুনকে আমি তাদের পরে আমার নিদর্শনসহ ফেরাউন ও তার সরদারদের কাছে পাঠাই। কিন্তু তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারে মত্ত হয় ৭৩ এবং তারা ছিল অপরাধী সম্প্রদায়।
ثُمَّ بَعَثْنَا مِنۢ بَعْدِهِم مُّوسَىٰ وَهَـٰرُونَ إِلَىٰ فِرْعَوْنَ وَمَلَإِي۟هِۦ بِـَٔايَـٰتِنَا فَٱسْتَكْبَرُوا۟ وَكَانُوا۟ قَوْمًۭا مُّجْرِمِينَ ٧٥
৭৬ ) পরে যখন আমার কাছ থেকে সত্য তাদের সামনে আসে, তারা বলে দেয়, এ তো সুস্পষ্ট যাদু। ৭৪
فَلَمَّا جَآءَهُمُ ٱلْحَقُّ مِنْ عِندِنَا قَالُوٓا۟ إِنَّ هَـٰذَا لَسِحْرٌۭ مُّبِينٌۭ ٧٦
৭৭ ) মুসা বললো, সত্য, যখন তোমাদের সামনে এলো তখন তোমরা তার সম্পর্কে এমন (কথা) বলছো? এ কি যাদু? অথচ যাদুকর সফলকাম হয় না। ৭৫
قَالَ مُوسَىٰٓ أَتَقُولُونَ لِلْحَقِّ لَمَّا جَآءَكُمْ ۖ أَسِحْرٌ هَـٰذَا وَلَا يُفْلِحُ ٱلسَّـٰحِرُونَ ٧٧
৭৮ ) তারা জবাবে বললো, “তুমি কি যে পথে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছি সে পথ থেকে আমাদের ফিরিয়ে দিতে এবং যাতে যমীনে তোমাদের দু’জনের প্রাধান্য কায়েম হয়ে যায়, সেজন্য এসেছো? ৭৬ তোমাদের কথা তো আমরা মেনে নিতে প্রস্তুত নই।”
قَالُوٓا۟ أَجِئْتَنَا لِتَلْفِتَنَا عَمَّا وَجَدْنَا عَلَيْهِ ءَابَآءَنَا وَتَكُونَ لَكُمَا ٱلْكِبْرِيَآءُ فِى ٱلْأَرْضِ وَمَا نَحْنُ لَكُمَا بِمُؤْمِنِينَ ٧٨
৭৯ ) আর ফেরাউন (নিজের লোকদের) বললো, সকল দক্ষ ও অভিজ্ঞ যাদুকরকে আমার কাছে হাযির করো।
وَقَالَ فِرْعَوْنُ ٱئْتُونِى بِكُلِّ سَـٰحِرٍ عَلِيمٍۢ ٧٩
৮০ ) -যখন যাদুকররা সে গেলো, মুসা তাদেরকে বললো, যা কিছু তোমাদের নিক্ষেপ করার আছে নিক্ষেপ করো।
فَلَمَّا جَآءَ ٱلسَّحَرَةُ قَالَ لَهُم مُّوسَىٰٓ أَلْقُوا۟ مَآ أَنتُم مُّلْقُونَ ٨٠
৮১ ) তারপর যখন তারা নিজেদের ভোজবাজি, নিক্ষেপ করলো, মুসা, বললো, তোমরা এই যা কিছু নিক্ষেপ করেছো এগুলো যাদু। ৭৭ আল্লাহ এখনই একে ব্যর্থ করে দেবেন। ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের কাজকে আল্লাহ‌ সার্থক হতে দেন না।
فَلَمَّآ أَلْقَوْا۟ قَالَ مُوسَىٰ مَا جِئْتُم بِهِ ٱلسِّحْرُ ۖ إِنَّ ٱللَّهَ سَيُبْطِلُهُۥٓ ۖ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُصْلِحُ عَمَلَ ٱلْمُفْسِدِينَ ٨١
৮২ ) আর অপরাধীদের কাছে যতই বিরক্তিকর হোক না কেন আল্লাহ‌ তার ফরমানের সাহায্যে সত্যকে সত্য করেই দেখিয়ে দেন।
وَيُحِقُّ ٱللَّهُ ٱلْحَقَّ بِكَلِمَـٰتِهِۦ وَلَوْ كَرِهَ ٱلْمُجْرِمُونَ ٨٢
৮৩ ) (তারপর দেখো) মুসাকে তার কওমের কতিপয় নওজোয়ান ৭৮ ছাড়া কেউ মেনে নেয়নি, ৭৯ ফেরাউনের ভয়ে এবং তাদের নিজেদেরই কওমের নেতৃস্থানীয় লোকদের ভয়ে। (তাদের আশঙ্কা ছিল) ফেরাউন তাদের ওপর নির্যাতন চালাবে। আর প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এই যে, ফেরাউন দুনিয়ায় পরাক্রমশালী ছিল এবং সে এমন লোকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল যারা কোন সীমানা মানে না। ৮০
فَمَآ ءَامَنَ لِمُوسَىٰٓ إِلَّا ذُرِّيَّةٌۭ مِّن قَوْمِهِۦ عَلَىٰ خَوْفٍۢ مِّن فِرْعَوْنَ وَمَلَإِي۟هِمْ أَن يَفْتِنَهُمْ ۚ وَإِنَّ فِرْعَوْنَ لَعَالٍۢ فِى ٱلْأَرْضِ وَإِنَّهُۥ لَمِنَ ٱلْمُسْرِفِينَ ٨٣
৭১.
সীমা অতিক্রমকারী লোক তাদেরকে বলে যারা একবার ভুল করার পর আবার নিজের কথার বক্রতা, একগুঁয়েমি ও একগুঁয়েমী ও হঠকারিতার কারণে নিজের ভুলের ওপর অবিচল থাকে এবং যে কথা মেনে নিতে একবার অস্বীকার করেছে তাকে আর কোন প্রকার উপদেশ, অনুরোধ-উপরোধ ও কোন উন্নত থেকে উন্নত পর্যায়ের যুক্তি প্রদানের মাধ্যমে মেনে নিতে চায় না। এ ধরনের লোকদের ওপর শেষ পর্যন্ত আল্লাহর এমন লানত পড়ে যে, তাদের আর কোনদিন সঠিক পথে চলার সুযোগ হয় না।
৭২.
এ প্রসঙ্গে সূরা আ'রাফের ১৩ থেকে ২১ রুকুর মধ্যে মুসাও ফেরাউনের সংঘাতের ব্যাপারে আমি যে টীকাগুলো দিয়েছে সেগুলো পড়ে দেখা যেতে পারে। সেখানে যেসব বিষয়ের ব্যাখ্যা করেছি এখানে আর সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করা হবে না।
৭৩ .
অর্থাৎ সে নিজের বিপুল বৈভব, রাজক্ষমতা ও শান-শওকতের নেশায় মত্ত হয়ে নিজেরাই নিজেকে ভৃত্যের আসন থেকে ওপরে তুলে নিয়েছে এবং আনুগত্যর শির নত করার পরিবর্তে গর্বোন্নত হয়েছে।
.
৭৪.
অর্থাৎ হযরত মূসার বাণী শুনে তারা সেই একই কথা বলেছিল যা মক্কার কাফেররা বলেছিল হযরত মুহাম্মাদ (স) এর কথা শুনে। কাফেররা বলেছিল এ ব্যক্তি তো পাক্কা যাদুকর। (দেখুন এ সূরা ইউনুসের দ্বিতীয় আয়াত)

এখানে প্রাসঙ্গিক আলোচনার প্রতি দৃষ্টি রাখলে একথা স্পষ্টই ধরা পড়ে যে, আসলে হযরত নূহ (আ) এবং তার পরে সাইয়িদুনা মুহাম্মাদ ﷺ পর্যন্ত সকল নবী পর্যায়ক্রমে যে দায়িত্ব নিযুক্ত হয়েছেন হযরত মূসা ও হারুন(আ) সেই একই দায়িত্ব নিযুক্ত হয়েছিলেন এ সূরার শুরু থেকে একই বিষয়বস্তু চলে আসছে। এ বিষয়বস্তুটি হচ্ছে একমাত্র আল্লাহ‌ রাব্বুল আলামীনকে নিজের রব ও ইলাহ হিসেবে মেনে নাও। এই সঙ্গে একথা স্বীকার কর নাও যে, জীবনের পরে আর একটি জীবন আসছে, সেখানে তোমাদের আল্লাহ‌ সামনে হাযির হতে এবং নিজেদের কাজের হিসাব দিতে হবে। তারপর যারা নবীর এ দাওয়াত মনে নিতে অস্বীকার করছিল তাদেরকে বুঝানো হচ্ছে। শুধুমাত্র তোমাদের কল্যাণ নয় বরং সমগ্র বিশ্ব মানবতার কল্যাণ চিরকাল একটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে এসেছে। সে বিষয়টি হচ্ছে, তাওহীদ ও আখেরাত বিশ্বাসের আহবানে সাড়া দেয়া। প্রতি যুগে আল্লাহর নবীগণ এ আহবানই জানিয়েছেন। তারা এ আহবানে সাড়া দিয়ে নিজের ব্যবস্থাকে এরই ভিত্তিতে কায়েম করার তাগিদ করেছেন। যারা একাজ করেছে একমাত্র তারাই কল্যাণ ও সাফল্য লাভ করেছে। আর যে জাতি একে অস্বীকার করেছে তারা শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে গেছে। এটিই এ সূরার কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়। এ প্রেক্ষাপটে যখন ঐতিহাসিক নজীর হিসেবে অন্যান্য নবীদের প্রসঙ্গে আলোচিত হয়েছে তখন অনিবার্যভাবে দাওয়াত এর অর্থ হয়েছে এই যে, এ সূরায় যে দাওয়াত দেয়া হয়েছে সেইই ছিল সকল নবীর দাওয়াত এবং এ দাওয়াত নিয়েই হযরত মুসা ও হারুণকেও ফেরাউন ও তার কওমের সরদারদের কাছে গিয়েছিলেন। কোন কোন লোক যেমন মনে করে থাকেন, হযরত মুসা ও হারুনের দায়িত্ব ছিল একটি বিশেষ জাতিকে অন্যান্য জাতির গোলামী থেকে মুক্ত করা। যদি এটিই সত্য হতো তাহলে এ প্রেক্ষাপটি এ ঘটনাটিকে ঐতিহাসিক নজীর হিসেবে পেশ করা একেবারেই বেমানান হতো। নিঃসন্দেহে বনী ইসরাঈলকে (একটি মুসলিম কওম) একটি কাফের কওমের আধিপত্য (যদি তারা নিজেদের কুফরীর ওপর অটল থাকে) মুক্ত করা এদের দুজনের মিশনের একটি অংশ ছিল। কিন্তু এটি ছিল তাদের নবুওয়াতের একটি আনুষঙ্গিক উদ্দেশ্য, মূল উদ্দেশ্য ছিল না। আসল উদ্দেশ্য তাই ছিল যা কুরআনের দৃষ্টিতে সকল নবীর নবুওয়াতের উদ্দেশ্য ছিল এবং সূরা নাযিআতে যে সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে বলে দেয়া হয়েছেঃ

اذْهَبْ إِلَى فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَى - فَقُلْ هَلْ لَكَ إِلَى أَنْ تَزَكَّى - وَأَهْدِيَكَ إِلَى رَبِّكَ فَتَخْشَى

ফেরাউনের কাছে যাও, কারণ সে গোলামীর সীমা অতিক্রম করে গেছে এবং তাকে বলো, তুমি কি নিজেকে শুধরে জন্য তৈরী আছো? আমি তোমাকে তোমার রবের দিকে পথ দেখাবো, তুমি কি তাকে ভয় করবে?

কিন্তু যেহেতু ফেরাউন ও তার রাজ্যের প্রধানগণ এ দাওয়াত গ্রহণ করেনি এবং শেষ পর্যন্ত হযরত মূসাকে নিজের মুসলিম কওমকে তার অধীনতার নাগপাশ থেকে বের করে আনতে হয়েছিল। তাই তার মিশনের এ অংশটিই ইতিহাসে প্রাধান্য লাভ করেছে এবং কুরআনেও একে ঠিক ইতিহাসে যেভাবে আছে তেমনিভাবে তুলে ধরা হয়েছে। যে ব্যক্তি কুরআনের বিস্তারিত বিবরণগুলোকে তার মৌলিক বক্তব্য থেকে আলাদা করে দেখার মতো ভুল করে না বরং সেগুলোকে সমগ্র বক্তব্যের অধীনেই দেখে থাকে, সে কখনো একটি জাতির দাসত্ব মুক্তিকে কোন নবীর নবুওয়াতের আসল উদ্দেশ্য এবং আল্লাহর সত্য দ্বীনকে দাওয়াতকে নিছক তার আনুষঙ্গিক উদ্দেশ্য মনে করার মত বিভ্রান্তিতে লিপ্ত হতে পারে না। (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন সুরা ত্বা-হা ৪৪ থেকে ৫২ আয়াত, যুখরুফ ৪৬ থেকে ৫৬ আয়াত এবং মুযাম্মিল ১৫ থেকে ১৬ আয়াত)।

৭৫.
এর মানে হচ্ছে আপাতদৃষ্টিতে মুজিযা ও যাদুর মধ্যে যে সাদৃশ্য রয়েছে তার ফলে তোমরা নির্দ্বিধায় তাকে যাদু গণ্য করেছো। কিন্তু মূর্খের দল, তোমরা একটুও ভেবে দেখ না, যাদুকররা কোন ধরনের চরিত্রের অধিকারী হয় এবং তারা কি উদ্দেশ্যে যাদু করে। একজন যাদুকর কি কখনো কোন ব্যক্তিগত স্বার্থ ছাড়াই এবং কোন চিন্তা-ভাবনা না করেই বেধড়ক একজন স্বৈরাচারী শাসকের দরবারে আসে, তাকে তার ভ্রষ্টতার জন্য ধমক দেয় ও তিরস্কার করে এবং তার প্রতি আল্লাহর আনুগত্য করার ও আত্মিক পবিত্রতা অর্জন করার আহবান জানায়? তোমাদের কাছে কোন যাদুকর এলে প্রথমে রাজ সম্মুখে নিজের তেলেসমাতি দেখাবার সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য দরবারের পরিষদবর্গের খোশামোদ করতে থাকতো। তারপর দরবারে প্রবেশ করার সৌভাগ্য হলে সাধারণ তোষামোদকারীদের থেকেও বেশী নির্লজ্জতার সাথে অভিবাদন পেশ করতো, চীৎকার করে করে রাজার দীর্ঘায়ু কামনা করতো, তার সৌভাগ্যের জন্য দোয়া করতো এবং বড়ই কাতর কাকুতিমিনতি সহকারে নিবেদন করতো, হে রাজন! আপনার একজন উৎসর্গিত প্রাণ সেবাদাসের কৃতিত্ব কিছুটা দর্শন করুন। আর তার যাদু দেখে নেবার পর সে পুরস্কার লাভের আশায় নিজের হাত পাততো। এ সমগ্র বিষয়বস্তুটি শুধু একটি মাত্র বাক্যের মধ্যে গুটিয়ে নিয়ে বলা হয়েছে, যাদুকর কোন কল্যাণ প্রাপ্ত লোক হয় না।
৭৬.
বনী ইসরাঈলকে উদ্ধার করা যদি হযরত মূসা (আ) ও হারুনের (আ) মূল দাবী হতো তাহলে ফেরাউন ও তার দরবারের লোকদের এ ধরনেরআশঙ্কা করার কোন প্রয়োজন ছিল না যে, এ দুই মহান ব্যক্তির দাওয়াত ছড়িয়ে পড়লে সারা মিসরের লোকদের ধর্ম বদলে যাবে এবং দেশে তাদের পরিবর্তে এদের দু’জনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। হযরত মূসা (আ) মিসরবাসীকে আল্লাহর বন্দেগীর প্রতি যে আহবান জানাচ্ছিলেন এটিই তো ছিল তাদের আশঙ্কার কারণ। এর ফলে যে মুশরিকী ব্যবস্থার ওপর ফেরাউনের বাদশাহী, তার সরদারদের নেতৃত্ব এবং ধর্মীয় নেতাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল তা বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। (আরো বেশী জানার জন্য দেখুন সূরা আ'রাফের ৬৬ এবং সূরা মু’মিনের ৪৩ টীকা)।
.
.
.
৭৭ .
অর্থাৎ আমি যা দেখিয়েছি তা যাদু ছিল না বরং তোমরা এই যা দেখাচ্ছো এ হচ্ছে যাদু।
.
.
৭৮.
কুরআনের মূল বাক্যে ذُرِّيَّةٌ(যুররিয়াতুন) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর মানে সন্তান-সন্ততি। আমি এর অনুবাদ করেছি নওজোয়ান। কিন্তু এ বিশেষ শব্দটির মাধ্যমে কুরআন মজীদে যে কথা বর্ণনা করতে চায় তা হচ্ছে এই যে, বিভীষিকাময় দিনগুলোতে গুটিকয় ছেলেমেয়েই তো সত্যের সাথে সহযোগিতা করার এবং সত্যের পতাকাবাহীকে নিজেদের নেতা হিসেবে মেনে নেয়ার দুঃসাহস করেছিল। কিন্তু মা-বাপ ও জাতির বয়স্ক লোকেরা এ সৌভাগ্য লাভ করতে পারেনি। তারা তখন বৈষয়িক স্বার্থ পূজা, সুবিধাবাদিতা ও নিরাপদ জীবন যাপনের চিন্তায় এত বেশী বিভোর ছিল যে, এমন কোন সত্যের সাথে সহযোগিতা করতে তারা উদ্যোগী হয়নি যার পথ তারা দেখছিল বিপদসংকুল। বরং তারা উল্টো নওজোয়ানদের পথ রোধ করে দাঁড়াচ্ছিল। তাদেরকে বলছিল, তোমরা মূসার ধারে কাছেও যেয়ো না, অন্যথায় তোমরা নিজেরা ফেরাউনের রোষাগ্নিতে পড়বে এবং আমাদের জন্যও বিপদ ডেকে আনবে।

কুরআনের একথা বিশেষভাবে সুস্পষ্ট করে পেশ করার কারণ হচ্ছে এই যে, মক্কার জনবসতিতেও মুহাম্মাদ ﷺ এর সাথে সহযোগিতা করার জন্য যারা এগিয়ে এসেছিলেন তারাও জাতির বয়স্ক ও বয়োবৃদ্ধ লোক ছিলেন না। বরং তারাও সবাই ছিলেন বয়সে নবীন। আলী ইবনে আবী তালেব (রা.), জাফর ইবনে তাইয়ার(রা.), যুবাইর (রা.), তালহা (রা.), সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা.), মুসআব ইবনে উমাইর (রা.), আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের (রা.) মতো লোকদের বয়স ইসলাম গ্রহণের সময় ২০ বছরের কম ছিল। আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.), বিলাল (রা.) ও সোহাইবের (রা.) বয়স ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ছিল। আবু উবাদাহ ইবনুল জাররাহ (রা.), যায়েদ ইবনে হারেসাহ (রা.), উসমান ইবনে আফ্ফান (রা.) ও উমর ফারুকের (রা.) বয়স ছিল ৩০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। এদের সবার থেকে বেশী বয়সের ছিলেন হযরত আবুবকর সিদ্দীক (রা.)। তার বয়স ঈমান আনার সময় ৩৮ বছরের বেশী ছিল না। প্রথমিক মুসলমানদের মধ্যে শুধুমাত্র একজন সাহাবীর নাম আমরা পাই যার বসয় ছিল নবী (সা.) এর চেয়ে বেশী। তিনি ছিলেন হযরত উবাদাহ ইবনে হারেস মুত্তালাবী (রা.)। আর সম্ভবত সাহাবীগণের সমগ্র দলের মধ্যে একমাত্র হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.) ছিলেন নবী (সা.) এর সমবয়সী।

৭৯.
মূল ইবারতে فَمَا آمَنَ لِمُوسَى ফামা আমানা লিমুছা শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়েছে। এতে কেউ কেউ সন্দেহ পোষণ করেছেন, হয়তো বনী ইসরাঈলের সবাই কাফের ছিল এবং শুরুতে তাদের মধ্যে থেকে মাত্র গুটিকয় লোক ঈমান এনেছিল। কিন্তু ঈমান শব্দের পরে যখন লাম ব্যবহৃত হয় তখন সাধারণত এর অর্থ হয় আনুগত্য ও তাবেদারী করা। অর্থাৎ কারোর কথা মেনে নেয়া এবং তার কথায় ওঠাবসা করা। কাজেই মূলত এ শব্দগুলোর ভাবগত অর্থ হচ্ছে, গুটিকয় নওজোয়ানকে বাদ দিয়ে বাকি সমস্ত বনী ইসরাঈল জাতির কেউই হযরত মুসাকে নিজের নেতা ও পথপ্রদর্শক হিসেবে মেনে নিয়ে তার আনুগত্য করতে এবং ইসলামী দাওয়াতের কাজে তাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত হয়নি। তারপর পরবর্তী বাক্যাংশ একথা সুস্পষ্ট করে দিয়েছে যে, তাদের এ কার্যধারার আসল কারণ এ ছিল না যে, হযরত মূসার সত্যবাদী ও তার দাওয়াত সত্য হবার ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোন সন্দেহ ছিল বরং এর কারণ শুধুমাত্র এই ছিল যে, তারা এবং বিশেষ করে তাদের প্রধান ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ হযরত মূসার সহযোগী হয়ে ফেরাউনের নির্যাতনের যাতাকলে নিষ্পেষিত হবার ঝুঁকি নিতে রাজী ছিল না। যদিও তারা বংশধারা ও ধর্মীয় উভয় দিক দিয়ে হযরত ইব্রাহীম, ইসহাক, ইয়াকুব ও ইউসুফ (আ) এর উম্মত ছিল এবং এ দিক দিয়ে তারা সবাই মুসলমান ছিল। কিন্তু দীর্ঘকালীন নৈতিক অবক্ষয় এবং পরাধীনতার ফলে সৃষ্ট কাপুরুষতা তাদের মধ্যে কুফরী ও গোমরাহীর শাসনের বিরুদ্ধে ঈমান ও হেদায়াতের ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে নিজেরা এগিয়ে আসার অথবা যে এগিয়ে এসেছে তাকে সাহায্য করার মত মনোবল অবশিষ্ট রাখেনি।

হযরত মূসা ও ফেরাউনের এ সংঘাতে সাধারণ বনী ইসরাঈলের ভূমিকা কি ছিল? একথা বাইবেলের নিম্নোক্ত অংশ থেকে আমরা জানতে পারি।

পরে ফেরাউনের নিকট ইহতে বাহির হইয়া আসিবার সময় তাহারা মূসার ও হারুণের সাক্ষাত পাইল। তাহারা পথে দাঁড়াইয়া ছিলেন। তাহারা তাহাদিগকে কহিল, সদা প্রভু তোমাদের প্রতি দৃষ্টি করিয়া বিচার করুনঃ কেননা, তোমরা ফেরাউনের দৃষ্টিতে ও তাহার দাসগণের দৃষ্টিতে আমাদিগকে দুর্গন্ধ স্বরূপ করিয়া আমাদের প্রাণনাশার্থে তাহাদের হস্তে খড়গ দিয়াছ। (যাত্রা পুস্তক৫: ২০-২১)

তালমুদে লেখা হয়েছে বনী ইসরাঈল মূসা ও হারুন (আ) কে বলতোঃ

“আমাদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে, একটি নেকড়ে বাঘ একটি ছাগলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং রাখাল এসে নেকড়ের মুখ থেকে ছাগলটিকে বাঁচাবার চেষ্টা করলো। তাদের উভয়ের দ্বন্দ্ব-সংঘাতে ছাগলটা টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। ঠিক এভাবেই তোমার ও ফেরাউনের টানা হেঁচড়ায় আমাদের দফা রফা হয়েই যাবে।”

সূরা আ'রাফে একথাগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছেঃ বনী ইসরাইল হযরত মুসাকে বললোঃ

أُوذِينَا مِنْ قَبْلِ أَنْ تَأْتِيَنَا وَمِنْ بَعْدِ مَا جِئْتَنَا (اية-129)

“তুমি আসার আগেও আমরা নির্যাতিত হয়েছি, তুমি আসার পরেও নিপীড়নের শিকার হচ্ছি।”

৮০.
মূল ইবারতেمُسْرِفِينَ(মুসরিফীন) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, সীমা অতিক্রমকারী। কিন্তু এ শাব্দিক অনুবাদের সাহায্যে তার আসল প্রাণবস্তু সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে না। মুসরিফীন শব্দটির আসল অর্থ হচ্ছে, এমন সব লোক যারা নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য যে কোন নিকৃষ্টতম পন্থা অবলম্বন করতে দ্বিধা করে না। যারা কোন প্রকার জুলুম, নৈতিকতা বিগর্হিত কাজ এবং যে কোন ধরনের পাশবিকতা ও বর্বরতায় লিপ্ত হতে একটুও কুণ্ঠিত হয় না। যারা নিজেদের লালসা ও প্রবৃত্তির শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে। তারা এমন কোন সীমানাই মানে না যেখানে তাদের থেমে যেতে হবে।
অনুবাদ: