পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

১২৭ আয়াত

৬১ ) আর হে নবী! শত্রু যদি সন্ধি ও শান্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে, তাহলে তুমিও সেদিকে ঝুঁকে পড়ো এবং আল্লাহর প্রতি নির্ভর করো। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছু শুনেন এবং জানেন।
۞ وَإِن جَنَحُوا۟ لِلسَّلْمِ فَٱجْنَحْ لَهَا وَتَوَكَّلْ عَلَى ٱللَّهِ ۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلْعَلِيمُ ٦١
৬২ ) যদি তারা তোমাকে প্রতারিত করতে চায় তাহলে তোমার জন্য আল্লাহ‌ যথেষ্ট। ৪৫ তিনিই তো নিজের সহায়তায় ও মুমিনদের মাধ্যমে তোমাকে সমর্থন জানিয়েছেন
وَإِن يُرِيدُوٓا۟ أَن يَخْدَعُوكَ فَإِنَّ حَسْبَكَ ٱللَّهُ ۚ هُوَ ٱلَّذِىٓ أَيَّدَكَ بِنَصْرِهِۦ وَبِٱلْمُؤْمِنِينَ ٦٢
৬৩ ) এবং মুমিনদের অন্তর পরস্পরের সাথে জুড়ে দিয়েছেন। তুমি সারা দুনিয়ার সমস্ত সম্পদ ব্যয় করলেও এদের অন্তর জোড়া দিতে পারতে না। কিন্তু আল্লাহ‌ তাদের অন্তর জুড়ে দিয়েছেন। ৪৬ অবশ্যি তিনি বড়ই পরাক্রমশালী ও জ্ঞানী।
وَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِهِمْ ۚ لَوْ أَنفَقْتَ مَا فِى ٱلْأَرْضِ جَمِيعًۭا مَّآ أَلَّفْتَ بَيْنَ قُلُوبِهِمْ وَلَـٰكِنَّ ٱللَّهَ أَلَّفَ بَيْنَهُمْ ۚ إِنَّهُۥ عَزِيزٌ حَكِيمٌۭ ٦٣
৬৪ ) হে নবী! তোমার জন্য ও তোমার অনুসারী ঈমানদারদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِىُّ حَسْبُكَ ٱللَّهُ وَمَنِ ٱتَّبَعَكَ مِنَ ٱلْمُؤْمِنِينَ ٦٤
৬৫ ) হে নবী! মুমিনদেরকে যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করো। তোমাদের মধ্যে বিশজন সবরকারী থাকলে তারা দু'শ জনের ওপর বিজয়ী হবে। আর যদি এমনি ধরনের একশ জন থাকে, তাহলে তারা সত্য অস্বীকারকারীদের মধ্য থেকে এক হাজার জনের ওপর বিজয়ী হবে। কারণ তারা এমন এক ধরনের লোক যাদের বোধশক্তি নেই। ৪৭
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِىُّ حَرِّضِ ٱلْمُؤْمِنِينَ عَلَى ٱلْقِتَالِ ۚ إِن يَكُن مِّنكُمْ عِشْرُونَ صَـٰبِرُونَ يَغْلِبُوا۟ مِا۟ئَتَيْنِ ۚ وَإِن يَكُن مِّنكُم مِّا۟ئَةٌۭ يَغْلِبُوٓا۟ أَلْفًۭا مِّنَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌۭ لَّا يَفْقَهُونَ ٦٥
৬৬ ) বেশ, এখন আল্লাহ‌ তোমাদের বোঝা হালকা করে দিয়েছেন এবং তিনি জেনেছেন যে, এখনো তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা রয়েছে। কাজেই যদি তোমাদের মধ্যে একশ জন সবরকারী হয়, তাহলে তারা দু'শ জনের ওপর এবং এক হাজার লোক এমনি পর্যায়ের হলে, তারা দু'হাজারের ওপর আল্লাহর হুকুমে বিজয়ী হবে। ৪৮ আর আল্লাহ‌ সবরকারীদের সাথে আছেন।
ٱلْـَٔـٰنَ خَفَّفَ ٱللَّهُ عَنكُمْ وَعَلِمَ أَنَّ فِيكُمْ ضَعْفًۭا ۚ فَإِن يَكُن مِّنكُم مِّا۟ئَةٌۭ صَابِرَةٌۭ يَغْلِبُوا۟ مِا۟ئَتَيْنِ ۚ وَإِن يَكُن مِّنكُمْ أَلْفٌۭ يَغْلِبُوٓا۟ أَلْفَيْنِ بِإِذْنِ ٱللَّهِ ۗ وَٱللَّهُ مَعَ ٱلصَّـٰبِرِينَ ٦٦
৬৭ ) সারা দেশে শত্রুদেরকে ভালভাবে পর্যুদস্ত না করা পর্যন্ত কোন নবীর পক্ষে নিজের কাছে বন্দীদের রাখা শোভনীয় নয়। তোমরা চাও দুনিয়ার স্বার্থ। অথচ আল্লাহর সামনে রয়েছে আখেরাত। আর আল্লাহ‌ পরাক্রমশালী ও বিজ্ঞ।
مَا كَانَ لِنَبِىٍّ أَن يَكُونَ لَهُۥٓ أَسْرَىٰ حَتَّىٰ يُثْخِنَ فِى ٱلْأَرْضِ ۚ تُرِيدُونَ عَرَضَ ٱلدُّنْيَا وَٱللَّهُ يُرِيدُ ٱلْـَٔاخِرَةَ ۗ وَٱللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌۭ ٦٧
৬৮ ) আল্লাহর লিখন যদি আগেই না লেখা হয়ে যেতো, তাহলে তোমরা যা কিছু করেছো সেজন্য তোমাদের কঠোর শাস্তি দেয়া হতো।
لَّوْلَا كِتَـٰبٌۭ مِّنَ ٱللَّهِ سَبَقَ لَمَسَّكُمْ فِيمَآ أَخَذْتُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌۭ ٦٨
৬৯ ) কাজেই তোমরা যা কিছু সম্পদ লাভ করেছো তা খাও, কেননা, তা হালাল ও পাক-পবিত্র এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। ৪৯ নিশ্চয়ই আল্লাহ‌ ক্ষমাশীল ও করুণাময়।
فَكُلُوا۟ مِمَّا غَنِمْتُمْ حَلَـٰلًۭا طَيِّبًۭا ۚ وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٌۭ رَّحِيمٌۭ ٦٩
৭০ ) হে নবী! তোমাদের হাতে যেসব বন্দী আছে তাদেরকে বলো, যদি আল্লাহ‌ তোমাদের অন্তরে ভাল কিছু দেখেন, তাহলে তিনি তোমাদের থেকে যা নেয়া হয়েছে তা থেকে অনেক বেশী দেবেন এবং তোমাদের ভুলগুলোর মাফ করে দেবেন। আল্লাহ‌ ক্ষমাশীল ও করুণাময়।
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِىُّ قُل لِّمَن فِىٓ أَيْدِيكُم مِّنَ ٱلْأَسْرَىٰٓ إِن يَعْلَمِ ٱللَّهُ فِى قُلُوبِكُمْ خَيْرًۭا يُؤْتِكُمْ خَيْرًۭا مِّمَّآ أُخِذَ مِنكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ۗ وَٱللَّهُ غَفُورٌۭ رَّحِيمٌۭ ٧٠
.
৪৫.
অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বিষয়াদিতে তোমাদের কাপুরুষোচিত নীতি অবলম্বন করা উচিত নয়। বরং আল্লাহর ওপর ভরসা করে নির্ভীক ও সাহসী নীতি অবলম্বন করা উচিত। শত্রু সন্ধির কথা আলোচনা করতে চাইলে নিসংকোচে তার সাথে আলোচনার টেবিলে বসে যাবার জন্য তৈরী থাকা প্রয়োজন। সে সদুদ্দেশ্যে সন্ধি করতে চায় না বরং বিশ্বাসঘাতকতা করতে চায়, এ অজুহাত দেখিয়ে তার সাথে আলোচনায় বসতে অস্বীকার করো না। কারোর নিয়ত নিশ্চিতভাবে জানা সম্ভবপর নয়। সে যদি সত্যিই সন্ধি করার নিয়ত করে থাকে, তাহলে অনর্থক তার নিয়তের ব্যাপারে সন্ধিহান হয়ে রক্তপাতকে দীর্ঘায়িত করবে কেন? আর যদি বিশ্বাসঘাতকতা করার নিয়তে করে থাকে, তাহলে তোমাদের আল্লাহর ওপর ভরসা করে সাহসী হওয়া দরকার। সন্ধির জন্য যে হাত এগিয়ে এসেছে তার জবাবে হাত বাড়িয়ে দাও। এর ফলে তোমাদের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হবে। আর যুদ্ধ করার জন্য যে হাত উঠবে নিজের তেজস্বী বাহু দিয়ে তাকে ভেঙ্গে গুঁড়ো করে দাও। এভাবে সমুচিত জবাব দিতে পারলে কোন বিশ্বাসঘাতক জাতি আর তোমাদের ননীর পুতুল মনে করার দুঃসাহস দেখাবে না।
.
৪৬.
আরববাসীদের মধ্য থেকে যারা ঈমান এনেছিলেন তাদের মধ্যে যে ভ্রাতৃত্ব, স্নেহ, প্রীতি, ভালবাসা সৃষ্টি করে মহান আল্লাহ‌ তাদেরকে একটি শক্তিশালী দলে পরিণত করেছিলেন, এখানে সেদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। অথচ এ দলের ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন গোত্র থেকে বের হয়ে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে শত শত বছর থেকে শত্রুতা চলে আসছিল। বিশেষ করে আল্লাহর এ মেহেরবানী তো আওস ও খাযরাজের ব্যাপারে ছিল সবচেয়ে বেশী সুস্পষ্ট। এ গোত্র দু’টি মাত্র দু'বছর আগেও পরস্পরের রক্তের পিয়াসী ছিল। ইতিহাসখ্যাত বুআস যুদ্ধ শেষ হয়েছিল তখনো খুব বেশী দিন হয়নি। এ যুদ্ধে আওস খাযরাজকে এবং খাযরাজ আওসকে যেন দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্য মরণপণ করেছিল। এ ধরনের মারাত্মক পর্যায়ের শত্রুতাকে মাত্র দু’তিন বছরের মধ্যে গভীর বন্ধুত্বে ও ভ্রাতৃত্বে পরিণত করা এবং এসব পরস্পর বিরোধী অংশগুলোকে একত্র করে এমন একটি সীসাঢালা প্রাচীরে পরিণত করা, যেমন নবী (সা.) এর যুগের ইসলামী দলটি-নিঃসন্দেহে সাধারণ মানবীয় শক্তির অসাধ্য ব্যাপার ছিল। অন্যদিকে পার্থিব উপকরণাদির সাহায্যে এত বড় মহান কার্য সম্পাদন সম্ভবপর ছিল না। কাজেই মহান আল্লাহ‌ বলেন, আমার সাহায্য ও সমর্থনের এ বিরাট সুফল যখন তোমরা লাভ করতে পেরেছো, তখন আগামীতেও তোমাদের দৃষ্টি পার্থিব কার্যকরণের ওপর নয় বরং আল্লাহর সমর্থনের ওপর নিবদ্ধ হওয়া উচিত। কারণ সবকিছুর সফলতা একমাত্র তাঁর মাধ্যমেই সম্ভব।
.
.
৪৭.
আধুনিক পরিভাষায় যাকে আভ্যন্তরীণ সূক্ষ্মতর শক্তি, নৈতিক শক্তি বা মনোবল (Morale) বলা হয়, আল্লাহ‌ তাকেই ফিকাহ, বোধ, উপলব্ধি, বুদ্ধি ও ধী-শক্তি (Understanding) বলেছেন। এ অর্থ ও ভাবধারা প্রকাশের জন্য এ শব্দটি আধুনিক পরিভাষার তুলনায় বেশী বিজ্ঞানসম্মত। যে ব্যক্তি নিজের উদ্দেশ্যের ব্যাপারে সঠিকভাবে সচেতন এবং ঠাণ্ডা মাথায় ভালভাবে ভেবে-চিন্তে এ জন্য সংগ্রাম করতে থাকে যে, যে জিনিসের জন্য সে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে এসেছে তা তার ব্যক্তিগত জীবনের চেয়ে অনেক বেশী মূল্যবান এবং তা নষ্ট হয়ে গেলে তার জন্য বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়ে পড়বে, সে এ ধরনের চেতনা ও উপলব্ধি থেকে বঞ্চিত একজন যোদ্ধার চেয়ে কয়েকগুণ বেশী শক্তিশালী। যদিও শরীরিক শক্তির প্রশ্নে উভয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তারপর যে ব্যক্তি সত্যের জ্ঞান রাখে, যে ব্যক্তি নিজের অস্তিত্ব, আল্লাহর অস্তিত্ব, আল্লাহর সাথে নিজের সম্পর্ক এবং পার্থিব জীবনের তাৎপর্য, মৃত্যুর তাৎপর্য ও মৃত্যুর পরের জীবনের তাৎপর্য ভালভাবে উপলব্ধি করে এবং যে ব্যক্তি হক ও বাতিলের পার্থক্য আর এই সাথে বাতিলের বিজয়ের ফলাফল সম্পর্কেও সঠিকভাবে জ্ঞাত, তার শক্তির ধারে কাছেও এমন সব লোক পৌঁছতে পারবে না যারা জাতীয়তাবাদ, স্বাদেশিকতাবাদ বা শ্রেণী সংগ্রামের চেতনা নিয়ে কর্মক্ষেত্রে নেমে আসে। এ জন্যই বলা হয়েছে, একজন বোধশক্তি সম্পন্ন সজাগ মু’মিন ও একজন কাফেরের মধ্যে সত্যের জ্ঞান ও সত্য সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণেই প্রকৃতিগতভাবে এক ও দশের অনুপাত সৃষ্টি হয়। কিন্তু শুধুমাত্র উপলব্ধি ও জ্ঞানের সাহায্যে এই অনুপাত প্রতিষ্ঠিত হয় না বরং সেই সাথে সবরের গুণও এর একটি অপরিহার্য শর্ত।
৪৮.
এর অর্থ এ নয় যে, প্রথমে এক ও দশের অনুপাত ছিল এবং এখন যেহেতু তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা এসে গেছে তাই এক ও দুইয়ের অনুপাত কায়েম করা হয়েছে। বরং এর সঠিক অর্থ হচ্ছে, নীতিগত ও মানগতভাবে মু’মিন ও কাফেরের মধ্যেতো এক ও দশেরই অনুপাত বিদ্যমান। কিন্তু যেহেতু এখন তোমাদের নৈতিক প্রশিক্ষণ পূর্ণতা লাভ করেনি এবং এখনো তোমাদের চেতনা, উপলব্ধি ও অনুধাবন ক্ষমতা পরিপক্কতা অর্জন করেনি, তাই আপাতত সর্বনিম্ন মান ধরেই তোমাদের কাছে দাবী করা হচ্ছে যে, নিজেদের চাইতে দ্বিগুণ শক্তিধরদের বিরুদ্ধে লড়তে তো তোমাদের ইতস্তত করা উচিত নয়। মনে রাখতে হবে, ২য় হিজরীতে এ বক্তব্য উপস্থাপিত হয়। তখন মুসলমানদের মধ্যে বহু লোক সবেমাত্র নতুন নতুন ইসলাম গ্রহণ করেছিল এবং তাদের প্রশিক্ষণ ছিল প্রাথমিক অবস্থায়। পরে নবী (সা.) এর নেতৃত্বে যখন তারা পরিপক্কতা অর্জন করলেন, তখন প্রকৃতপক্ষে তাদের ও কাফেরদের মধ্যে এক ও দশের অনুপাতই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। বস্তুত নবী (সা.) এর আমলের শেষের দিকে এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগের বিভিন্ন যুদ্ধে বারবার এর সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে।
.
.
.
৪৯.
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় টীকাকারগণ যেসব হাদিস বর্ণনা করেছেন তার মোদ্দাকথা হচ্ছেঃ বদরের যুদ্ধে কুরাইশদের যেসব লোক বন্দী হয় তাদের সাথে কেমন ব্যবহার করা হবে এ নিয়ে পরে পরামর্শ হয়। হযরত আবু বকর (রা.) পরামর্শ দেন, ফিদিয়া (মুক্তিপণ) নিয়ে তাদের ছেড়ে দেয়া হোক। হযরত উমর (রা.) বলেন, তাদের হত্যা করা হোক। নবী (সা.) হযরত আবু বকরের (রা.) মত গ্রহণ করেন এবং ফিদিয়া তথা বিনিময় মূল্য স্থিরীকৃত হয়ে যায়। এর ফলে মহান আল্লাহ‌ তিরস্কার করে ও অসন্তোষ প্রকাশ করে এ আয়াত নাযিল করেন। কিন্তু তাফসীরকারগণ “আল্লাহর লিখন যদি আগেই লেখা না হয়ে যেতো” আয়াতের এ অংশের কোন যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। তারা বলেন, এখানে আল্লাহর তাকদীরের কথা বলা হয়েছে অথবা আল্লাহ‌ আগেভাগেই মুসলমানদের জন্য গনীমাতের মাল হালাল করে দেবার সংকল্প করেছিলেন। কিন্তু একথা সুস্পষ্ট, যতক্ষন পর্যন্ত শরীয়াতের বিধান প্রদানকারী অহীর মাধ্যমে কোন জিনিসের অনুমতি না দেয়া হয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত তা গ্রহণ করা জায়েয হতে পারেনা। কাজেই নবী (সা.) সহ সমগ্র ইসলামী জামায়াত এ ব্যাখ্যার কারণে গুনাহগার গণ্য হবে। “খবরে ওয়াহিদ” (অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী হাদীস) এর ওপর নির্ভর করে এ ধরনের ব্যাখ্যা গ্রহণ করে নেয়া বড়ই কঠিন ব্যাপার।

আমার মতে এ আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা নিম্নরূপঃ বদরের যুদ্ধের আগে সূরা মুহাম্মাদে যুদ্ধ সম্পর্কে যে প্রাথমিক নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তাতে বলা হয়েছিলঃ

فَإِذَا لَقِيتُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا فَضَرْبَ الرِّقَابِ حَتَّى إِذَا أَثْخَنْتُمُوهُمْ فَشُدُّوا الْوَثَاقَ فَإِمَّا مَنًّا بَعْدُ وَإِمَّا فِدَاءً حَتَّى تَضَعَ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا

“কাজেই যখন তোমরা কাফেরদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকো তখন তাদের গর্দানে আঘাত করো। শেষে যখন তোমরা তাদের সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করবে তখন তাদের কষে বাঁধবে। তারপর হয় করুণা, নয় মুক্তিপণ। তোমরা জিহাদ চালিয়ে যাবে যতক্ষণ না যুদ্ধের অবসান ঘটে।” সূরা মুহাম্মাদঃ ৪

এ বক্তব্যে যুদ্ধাবন্দীদের থেকে ফিদিয়া আদায় করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল ঠিকই কিন্তু এই সঙ্গে এ মর্মে শর্ত লাগানো হয়েছিল যে, প্রথমে শত্রুদের শক্তি ভালভাবে চূর্ণ করে দিতে হবে তারপর তাদের বন্দী করার কথা চিন্তা করতে হবে। এ ফরমান অনুযায়ী মুসলমানরা বদরে যেসব যুদ্ধ অপরাধীকে বন্দী করেছিল, তারপর তাদের কাছ থেকে যেসব ফিদিয়া আদায় করেছিল তা অনুমতি মোতাবেক ছিল ঠিকই কিন্তু সেখানে ভুলটি ছিল এইঃ পূর্বাহ্ণে “শত্রুর শক্তি ভালভাবে চূর্ণ করে দেবার” যে শর্তটি রাখা হয়েছিল তা পূর্ণ করার ব্যাপারে ত্রুটি দেখা দিয়েছিল। যুদ্ধে কুরাইশ সেনারা যখন পালাতে শুরু করলো, তখন মুসলমানদের অনেকেই গনীমাতের মাল লুটপাট করতে এবং কাফেরদের ধরে ধরে বাঁধতে লাগলো। এ সময় খুব কম লোকই শত্রুদের পিছনে কিছু দূর পর্যন্ত ধাওয়া করেছিল। অথচ মুসলমানরা যদি পূর্ণ শক্তিতে তাদেরকে ধাওয়া করতো, তাহলে সেদিনই কুরাইশদের শক্তি নির্মূল হয়ে যেতো। এ জন্য আল্লাহ‌ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আর এ ক্ষোভ নবীর ওপর নয় বরং মুসলমানদের ওপর। আল্লাহর এ মহান ফরমানের মর্ম হচ্ছেঃ তোমরা এখনো নবীর মিশন ভালভাবে উপলব্ধি করতে পারোনি। ফিদিয়া ও গনিমাতের মাল আদায় করে অর্থভাণ্ডার ভরে তোলা নবীর আসল কাজ নয়। একমাত্র কুফরের শক্তির দম্ভ ভেঙে গুড়িয়ে দেয়ার কাজটিই তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সাথে সরাসরি সম্পর্ক রাখে। কিন্তু দুনিয়ার লোভ লালসা তোমাদের ওপর বারবার প্রাধান্য বিস্তার করে। প্রথমে তোমরা চাইলে শত্রুর মূল শক্তিকে এড়িয়ে বাণিজ্য কাফেলার ওপর আক্রমণ চালাতে। তারপর চাইলে শত্রুর মাথা গুড়িয়ে দেবার পরিবর্তে গনীমাতের মাল লুট করতে ও যুদ্ধ অপরাধীদের বন্দী করতে। আবার এখন গনিমাতের মাল নিয়ে ঝগড়া করতে শুরু করেছো। যদি আমি আগেই ফিদিয়া আদায় করার অনুমতি না দিয়ে দিতাম তাহলে তোমাদের এ কার্যক্রমের জন্য তোমাদের কঠোর শাস্তি দিতাম। যা হোক, এখন তোমরা যা কিছু নিয়েছো তা খেয়ে ফেলো কিন্তু আগামীতে এমন ধরনের আচরণ অবলম্বন করা থেকে দূরে থাকো, যা আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয়। এ ব্যাখ্যার ব্যাপারে আমি মত স্থির করে ফেলেছিলাম এমন সময় ইমাম আবু বকর জাসসাস তার আহকামুল কুরআন গ্রন্থে এ ব্যাখ্যাটিকে কমপক্ষে গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন দেখে আমি আরো একটু বেশী মানসিক নিশ্চিন্ততা অনুভব করতে পেরেছি। তারপর সীরাতে ইবনে হিশামও একটি রেওয়ায়াত দেখেছি। তাতে বলা হয়েছে, মুসলিম মুজাহিদরা যখন গনীমাতের মাল আহরণ করতে ও কাফেরদেরকে ধরে ধরে বেঁধে ফেলতে ব্যস্ত ছিলেন তখন নবী (সা.) হযরত সা'দ ইবনে মু'আযের (রা.) চেহারায় কিছু বিরক্তির ভাব লক্ষ্য করলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “হে সা'দ! মনে হচ্ছে, লোকদের এ কাজ তোমার পছন্দ হচ্ছে না।” তিনি জবাব দিলেন “ঠিকই, হে আল্লাহর রসূল!, মুশরিকদের সাথে এ প্রথম যুদ্ধ এবং এ যুদ্ধে আল্লাহ‌ তাদেরকে পরাজিত করেছেন। কাজেই এ সময় বন্দী করে তাদের প্রাণ বাঁচাবার চাইতে বরং তাদেরকে চরমভাবে গুড়িয়ে দিলেই বেশী ভাল হতো।” (২য় খণ্ড, ২৮০-২৮১ পৃঃ)।

.
.
অনুবাদ: