পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

১২৭ আয়াত

৫১ ) এ হচ্ছে সেই অপকর্মের প্রতিফল যা তোমরা আগেই করে রেখে এসেছো। নয়তো আল্লাহ‌ তার বান্দাদের ওপর জুলুমকারী নন।”
ذَٰلِكَ بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيكُمْ وَأَنَّ ٱللَّهَ لَيْسَ بِظَلَّـٰمٍۢ لِّلْعَبِيدِ ٥١
৫২ ) এ ব্যাপারটি তাদের সাথে ঠিক তেমনিভাবে ঘটেছে, যেমন ফেরাউনের লোকদেরও তাদের আগের অন্যান্য লোকদের সাথে ঘটে এসেছে। তারা আল্লাহর আয়াতসমূহ মেনে নিতে অস্বীকার করেছে। ফলে তাদের গোনাহের ওপর আল্লাহ‌ তাদেরকে পাকড়াও করেছেন। আল্লাহ‌ ক্ষমতাশালী এবং কঠোর শাস্তিদাতা।
كَدَأْبِ ءَالِ فِرْعَوْنَ ۙ وَٱلَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ ۚ كَفَرُوا۟ بِـَٔايَـٰتِ ٱللَّهِ فَأَخَذَهُمُ ٱللَّهُ بِذُنُوبِهِمْ ۗ إِنَّ ٱللَّهَ قَوِىٌّۭ شَدِيدُ ٱلْعِقَابِ ٥٢
৫৩ ) এটা ঠিক আল্লাহর এ রীতি অনুযায়ী হয়েছে, যে রীতি অনুযায়ী তিনি কোন জাতিকে কোন নিয়ামত দান করে ততক্ষণ পর্যন্ত তার মধ্যে কোন পরিবর্তন সাধন করেন না যতক্ষন না সেই জাতি নিজেই নিজের কর্মনীতির পরিবর্তন সাধন করে। ৪০ আল্লাহ সবকিছু শুনেন ও সবকিছু জানেন।
ذَٰلِكَ بِأَنَّ ٱللَّهَ لَمْ يَكُ مُغَيِّرًۭا نِّعْمَةً أَنْعَمَهَا عَلَىٰ قَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا۟ مَا بِأَنفُسِهِمْ ۙ وَأَنَّ ٱللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌۭ ٥٣
৫৪ ) ফেরাউনের লোকজন ও তাদের আগের জাতিদের সাথে যা কিছু ঘটেছে এ রীতি অনুযায়ীই ঘটেছে। তারা নিজেদের রবের নিদর্শনসমূহকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছে। ফলে তাদের গুনাহের জন্য আমি তাদেরকে ধ্বংস করেছি এবং ফেরাউনের লোক-লস্করকে ডুবিয়ে দিয়েছি। এরা সবাই ছিল জালেম।
كَدَأْبِ ءَالِ فِرْعَوْنَ ۙ وَٱلَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ ۚ كَذَّبُوا۟ بِـَٔايَـٰتِ رَبِّهِمْ فَأَهْلَكْنَـٰهُم بِذُنُوبِهِمْ وَأَغْرَقْنَآ ءَالَ فِرْعَوْنَ ۚ وَكُلٌّۭ كَانُوا۟ ظَـٰلِمِينَ ٥٤
৫৫ ) অবশ্যি আল্লাহর কাছে যমীনের ওপর বিচরনশীল জীবের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হচ্ছে তারাই, যারা সত্যকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছে। তারপর তারা আর কোন মতেই তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়।
إِنَّ شَرَّ ٱلدَّوَآبِّ عِندَ ٱللَّهِ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ فَهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ ٥٥
৫৬ ) (বিশেষ করে) তাদের মধ্য থেকে এমন সব লোক যাদের সাথে তুমি চুক্তি করছো, তারপর তারা প্রত্যেকবার তা ভঙ্গ করে এবং একটুও আল্লাহর ভয় করে না। ৪১
ٱلَّذِينَ عَـٰهَدتَّ مِنْهُمْ ثُمَّ يَنقُضُونَ عَهْدَهُمْ فِى كُلِّ مَرَّةٍۢ وَهُمْ لَا يَتَّقُونَ ٥٦
৫৭ ) কাজেই এ লোকদের যদি তোমরা যুদ্ধের মধ্যে পাও, তাহলে তাদের এমনভাবে মার দেবে যেন তাদের পরে অন্য যারা এমনি ধরনের আচরণ করতে চাইবে, তারা দিশা হারিয়ে ফেলে। ৪২ আশা করা যায়, চুক্তি ভংগকারীদের এ পরিণাম থেকে তারা শিক্ষা গ্রহণ করবে।
فَإِمَّا تَثْقَفَنَّهُمْ فِى ٱلْحَرْبِ فَشَرِّدْ بِهِم مَّنْ خَلْفَهُمْ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُونَ ٥٧
৫৮ ) আর যদি কখনো কোন জাতির পক্ষ থেকে তোমাদের খেয়ানতের আশঙ্কা থাকে তাহলে তার চুক্তি প্রকাশ্যে তার সামনে ছুড়ে দাও। ৪৩ নিঃসন্দেহে আল্লাহ‌ খেয়ানতকারীকে পছন্দ করেন না।
وَإِمَّا تَخَافَنَّ مِن قَوْمٍ خِيَانَةًۭ فَٱنۢبِذْ إِلَيْهِمْ عَلَىٰ سَوَآءٍ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ ٱلْخَآئِنِينَ ٥٨
৫৯ ) সত্য অস্বীকারকারীরা যেন এ ভুল ধারণা পোষণ না করে যে, তারা জিতে গেছে। নিশ্চয়ই তারা আমাকে হারাতে পারবে না।
وَلَا يَحْسَبَنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ سَبَقُوٓا۟ ۚ إِنَّهُمْ لَا يُعْجِزُونَ ٥٩
৬০ ) আর তোমরা নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী সর্বাধিক পরিমাণ শক্তি ও সদাপ্রস্তুত ঘোড়া তাদের মোকাবিলার জন্য যোগাড় করে রাখো। ৪৪ এর মাধ্যমে তোমরা ভীতসন্ত্রস্ত করবে আল্লাহর শত্রুকে, নিজের শত্রুকে এবং অন্য এমন সব শত্রুকে যাদেরকে তোমরা চিনো না। কিন্তু আল্লাহ‌ চেনেন। আল্লাহর পথে তোমরা যা কিছু খরচ করবে, তার পূর্ণ প্রতিদান তোমাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হবে এবং তোমাদের প্রতি কখনো জুলুম করা হবে না।
وَأَعِدُّوا۟ لَهُم مَّا ٱسْتَطَعْتُم مِّن قُوَّةٍۢ وَمِن رِّبَاطِ ٱلْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِۦ عَدُوَّ ٱللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ وَءَاخَرِينَ مِن دُونِهِمْ لَا تَعْلَمُونَهُمُ ٱللَّهُ يَعْلَمُهُمْ ۚ وَمَا تُنفِقُوا۟ مِن شَىْءٍۢ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ يُوَفَّ إِلَيْكُمْ وَأَنتُمْ لَا تُظْلَمُونَ ٦٠
.
.
৪০.
অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত কোন জাতি নিজেকে আল্লাহর নিয়ামতের পুরোপুরি অনুপযুক্ত প্রমাণ না করে থাকে, ততক্ষন পর্যন্ত আল্লাহ‌ তার কাছ থেকে নিজের নিয়ামত ছিনিয়ে নেন না।
.
.
.
৪১.
এখানে বিশেষভাবে ইহুদীদের প্রতি ইশারা করা হয়েছে। মদীনা তাইয়েবায় আসার পর নবী ﷺ সর্বপ্রথম তাদের সাথেই সৎ প্রতিবেশী সুলভ জীবন-যাপন ও পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার চুক্তি করেছিলেন। তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য তিনি নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী পূর্ণ প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তাছাড়া ধর্মীয় দিক দিয়েও তিনি ইহুদীদেরকে মুশরিকদের তুলনায় নিজের অনেক কাছের মনে করতেন। প্রত্যেক ব্যাপারেই তিনি মুশরিকদের মোকাবিলায় আহলি কিতাবদের মত ও পথকে অগ্রাধিকার দিতেন। কিন্তু নবী ﷺ নির্ভেজাল তাওহীদ ও সৎ চরিত্র নীতি সংক্রান্ত যেসব কথা প্রচার করে চলছিলেন, বিশ্বাস ও কর্মের গোমরাহীর বিরুদ্ধে যে সমালোচনা করে চলছিলেন এবং সত্য দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য যে প্রচেষ্ঠা ও সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন, ইহুদীদের উলামা ও মাশায়েখ গোষ্ঠী তা একটুও পছন্দ করতো না। এ নতুন আন্দোলন যাতে কোনভাবেই সাফল্য লাভ করতে না পারে সেজন্য তারা অনবরত ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছিল। এ উদ্দেশ্যে তারা মদীনার মুনাফিক মুসলমানদের সাথে মিলে চক্রান্ত করে চলছিল। এ উদ্দেশ্যেই তারা আওস ও খাযরাজ বংশীয় লোকদের যেসব পুরাতন শত্রুতা ইসলাম পূর্বযুগে তাদের মধ্যে খুনাখুনি ও হানাহানির কারণ হতো, সেগুলোকে উৎসাহিত ও উত্তেজিত করতো। এ উদ্দেশ্যেই কুরাইশ ও অন্যান্য ইসলাম বিরোধী গোত্রগুলোর সাথে তাদের গোপন যোগসাজস চলছিল। নবী (সা.) ও তাদের মধ্যে যে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তা সত্ত্বেও এসব কাজ করে চলছিল। যখন বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হলো, শুরুতে তারা আশা করেছিল, কুরাইশদের প্রথম আঘাতেই এই আন্দোলনের মৃত্যু ঘণ্টা বেজে উঠবে। কিন্তু ফলাফল দেখা গেলো তাদের প্রত্যাশার বিপরীত। এ অবস্থায় তাদের অন্তরে আরো বেশী করে জ্বলে উঠলো হিংসার আগুন। বদরের বিজয় যাতে ইসলামের শক্তিকে একটি স্থায়ী ‘বিপদে’ পরিণত না করে দেয় এআশঙ্কায় তারা নিজেদের বিরোধীতামূলক প্রচেষ্টা আরো বেশী জোরদার করে দিল। এমনকি একজন নেতা কা’ব ইবনে আশরাফ (কুরাইশদের পরাজয়ের খবর শুনে যে ব্যক্তি চিৎকার করে বলে উঠেছিল, আজ যমীনের পেট তার পিঠের চেয়ে আমাদের জন্য অনেক ভাল) নিজে মক্কা গেলো। সেখানে সে উদ্দীপনাময় শোক গীতি গেয়ে কুরাইশদের অন্তরে প্রতিশোধ স্পৃহা জাগিয়ে তুলতে থাকলো। এখানেই তারা ক্ষান্ত হলো না। ইহুদীদের বনী কাইনুকা গোত্র সৎ প্রতিবেশী সুলভ বসবাসের চুক্তি ভঙ্গ করে তাদের জনবসতিতে যেসব মুসলমান মেয়ে কোন কাজে যেতো, তাদেরকে উত্যক্ত ও উৎপীড়ন করতে শুরু করলো। নবী ﷺ যখন তাদের এ অন্যায় কার্যকলাপের জন্য তাদের তিরস্কার করলেন তখন তারা জবাবে হুমকি দিলঃ “আমাদের মক্কার কুরাইশ মনে করো না। আমরা যুদ্ধ করতে ও যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রাণ দিতে জানি। আমাদের মোকাবিলায় যুদ্ধ ক্ষেত্রে নামলে তোমরা টের পাবে, পুরুষ কাকে বলে।”
৪২.
এর অর্থ হচ্ছে, যদি কোন জাতির সাথে আমাদের চুক্তি হয়, তারপর তারা নিজেদের চুক্তির দায়িত্ব বিসর্জন দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তাহলে আমরাও চুক্তির নৈতিক দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে যাবো। এক্ষেত্রে আমরাও তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ন্যায়সঙ্গত অধিকার লাভ করবো। তাছাড়া যদি কোন জাতির সাথে আমাদের যুদ্ধ চলতে থাকে এবং আমরা দেখি, শত্রুপক্ষের সাথে এমন এক সম্প্রদায়ের লোকরাও যুদ্ধে শামিল হয়েছে যাদের সাথে আমাদের চুক্তি রয়েছে তাহলে আমরা তাদেরকে হত্যা করতে এবং তাদের সাথে শত্রুর মত ব্যবহার করতে একটুও দ্বিধা করবো না। কারণ তারা ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের সম্প্রদায়ের চুক্তি ভঙ্গ করে তাদের ধন-প্রাণের নিরাপত্তার প্রশ্নে তাদের সম্প্রদায়ের সাথে আমাদের যে চুক্তি রয়েছে তা লংঘন করেছে। ফলে নিজেদের নিরাপত্তার অধিকার তারা প্রমাণ করতে পারেনি।
.
৪৩.
এ আয়াতের দৃষ্টিতে যদি কোন ব্যক্তি, দল বা দেশের সাথে আমাদের চুক্তি থাকে এবং তার কর্মনীতি আমাদের মনে তার বিরুদ্ধে চুক্তি মেনে চলার ব্যাপারে গড়িমসি করার অভিযোগ সৃষ্টি করে অথবা সুযোগ পেলেই সে আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে এ ধরনেরআশঙ্কা দেখা দেয়, তাহলে আমাদের পক্ষে একতরফাভাবে এমন সিদ্ধান্ত করা কোনক্রমেই বৈধ নয় যে, আমাদের ও তার মধ্যে কোন চুক্তি নেই। আর এই সঙ্গে হঠাৎ তার সাথে আমাদের এমন ব্যবহার করা উচিত নয় যা একমাত্র চুক্তি না থাকা অবস্থায় করা যেতে পারে। বরং এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হলে, কোন বিরোধীতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করার আগে দ্বিতীয় পক্ষকে স্পষ্ট ভাষায় একথা জানিয়ে দেবার জন্য আমাদের তাগিদ দেয়া হয়েছে যে, আমাদের ও তোমাদের মধ্যে এখন আর কোন চুক্তি নেই। এভাবে চুক্তি ভঙ্গ করার জ্ঞান আমরা যতটুকু অর্জন করেছি, তারাও ততটুকু অর্জন করতে পারবে এবং চুক্তি এখনো অপরিবর্তিত আছে, এ ধরনের ভুল ধারণা তারা পোষণ করবে না। আল্লাহর এ ফরমান অনুযায়ী নবী (সা.) ইসলামের আন্তর্জাতিক রাজনীতির নিম্নোক্ত স্থায়ী মূলনীতি ঘোষনা করছিলেনঃ

مَنْ كَانَ بَيْنَهُ وَبَيْنَ قَوْمٍ عَهْدٌ فَلاَ يَحُلُّن عُقْدَةً حَتَّى يَنْقَضِىَ أَمَدُهَا أَوْ يَنْبِذَ إِلَيْهِمْ عَلَى سَوَاءٍ-

“কোন জাতির সাথে কারোর কোন চুক্তি থাকলে, চুক্তির মেয়াদ শেষ হবার আগে তার চুক্তি লংঘন করা উচিত নয়। এক পক্ষ চুক্তি ভঙ্গ করলে, উভয় পক্ষের সমতার ভিত্তিতে অপর পক্ষ চুক্তি বাতিল করার কথা জানাতে পারে।”

তারপর এ নিয়মকে তিনি আরো একটু ব্যাপক ভিত্তিক করে সমস্ত ব্যাপারে এ সাধারণ নীতি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেনঃ لَاتَخُنَّ مَن خَانَكَ(যে ব্যক্তি তোমরা সাথে খেয়ানত ও বিশ্বাসঘাতকতা করে, তুমি তার সাথে খেয়ানত করো না)। এ নীতিটি শুধুমাত্র বক্তৃতা বিবৃতিতে বলার ও বইয়ের শোভা বর্ধনের জন্য ছিল না বরং বাস্তব জীবনে একে পুরোপুরি মেনে চলা হতো। আমীর মুআবীয়া (রা.) একবার নিজের রাজত্বকালে রোম সাম্রাজ্যের সীমান্তে সেনা সমাবেশ করতে শুরু করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল চুক্তির মেয়াদ শেষ হবার সাথে সাথেই অতর্কিতে রোমান এলাকায় আক্রমণ চালাবেন। তাঁর এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে রসূলের ﷺ সাহাবী আমর ইবনে আমবাসা (রা.) কঠোর প্রতিবাদ জানান। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ হাদীসটি শুনিয়ে চুক্তির মেয়াদের মধ্যেই এ ধরনের শত্রুতামূলক কার্যকলাপকে বিশ্বাসঘাতকতা বলে অভিহিত করেন। অবশেষে আমীর মু’আবীয়াকে এ নীতির সামনে মাথা নোয়াতে হয় এবং তিনি সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ বন্ধ করে দেন।

একতরফাভাবে চুক্তি ভঙ্গ ও যুদ্ধ ঘোষনা করা ছাড়া আক্রমণ করার পদ্ধতি প্রাচীন জাহেলী যুগেও ছিল এবং বর্তমান যুগের সুসভ্য জাহিলিয়াতেও এর প্রচলন আছে। এর নতুনতম দৃষ্টান্ত হচ্ছে বিগত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে রাশিয়ার ওপর জার্মানীর আক্রমণ এবং ইরানের বিরুদ্ধে রাশিয়া ও বৃটেনের সামরিক কার্যক্রম। সাধারণত এ ধরনের কার্যক্রমের স্বপক্ষে এ ওযর পেশ করা হয় যে, আক্রমণের পূর্বে জানিয়ে দিলে প্রতিপক্ষ সতর্ক হয়ে যায়। এ অবস্থায় কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হতে হয় অথবা যদি আমরা অগ্রসর হয়ে হস্তক্ষেপ না করতাম তাহলে আমাদের শত্রুরা সুবিধা লাভ করতো। কিন্তু নৈতিক দায়িত্ব পালন থেকে অব্যহতি লাভের জন্য এ ধরনের বাহানাকে যদি যথেষ্ট মনে করা হয় তাহলে দুনিয়ায় আর এমন কোন অপরাধ থাকে না যা কোন না কোন বাহানায় করা যেতে পারে না। প্রত্যেক চোর, ডাকাত, ব্যভিচারী, ঘাতক ও জালিয়াত নিজের অপরাধের জন্য এমনি ধরনের কোন না কোন কারণ দর্শাতে পারে। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে, আন্তর্জাতিক পরিবেশে এরা একটি জাতির জন্য এমন অনেক কাজ বৈধ মনে করে যা জাতীয় পরিবেশে কোন ব্যক্তিবিশেষ করলে তাদের দৃষ্টিতে অবৈধ বলে গণ্য হয়।

এ প্রসঙ্গে একথা জেনে নেয়ারও প্রয়োজন যে, ইসলামী আইন শুধুমাত্র একটি অবস্থায় পূর্ব ঘোষণা ছাড়া আক্রমণ করা বৈধ গণ্য করে। সে অবস্থাটি হচ্ছে, দ্বিতীয় পক্ষ যখন ঘোষণা দিয়েই চুক্তি ভঙ্গ করে এবং আমাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে শত্রুতামূলক কাজ করে। এহেন অবস্থায় উল্লেখিত আয়াতের নির্দেশ অনুযায়ী আমাদের পক্ষ থেকে তার কাছে চুক্তি ভঙ্গ করার নোটিশ দেবার প্রয়োজন হয় না। বরং আমরা অঘোষিতভাবে তার বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করার অধিকার লাভ করি। বনী খুযাআর ব্যাপারে কুরাইশরা যখন হুদাইবিয়ার চুক্তি প্রকাশ্যে ভঙ্গ করে তখন নবী (সা.) তাদেরকে চুক্তি ভঙ্গ করার নোটিশ দেয়ার প্রয়োজন মনে করেননি এবং কোন প্রকার ঘোষনা না দিয়েই মক্কা আক্রমণ করে বসেন। নবী (সা.) এর এ কার্যক্রম থেকেই মুসলিম ফকীহগণ এ ব্যতিক্রমধর্মী বিধি রচনা করেছেন। কিন্তু কোন অবস্থায় যদি আমরা এ ব্যতিক্রমধর্মী নিয়ম থেকে ফায়দা উঠাতে চাই, তাহলে অবশ্যি সেই সমস্ত অবস্থা আমাদের সামনে থাকতে হবে যে অবস্থায় নবী (সা.) এ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এভাবে তাঁর সমগ্র কার্যক্রমের একটি সুবিধাজনক অংশ মাত্রের অনুসরণ না করে তার সবটুকুর অনুসরণ করা হবে। হাদীস ও সীরাতের কিতাবগুলো থেকে যা কিছু প্রমাণিত হয় তা হচ্ছে নিম্নরূপঃ

একঃ কুরাইশদের চুক্তি ভঙ্গের ব্যাপারটি এত বেশী সুস্পষ্ট ছিল যে, তারা যে চুক্তি ভঙ্গ করেছে এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করার কোন সুযোগ ছিল না। কুরাইশরা এবং তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট লোকেরা নিজেরাও চুক্তি যথার্থই ভেঙে গেছে বলে স্বীকার করতো। তারা নিজেরাই চুক্তি নবায়নের জন্য আবু সুফিয়ানকে মদীনায় পাঠিয়েছিল। এর পরিষ্কার অর্থ ছিল, তাদের দৃষ্টিতেও চুক্তি অক্ষুন্ন ছিল না। তবুও চুক্তি ভঙ্গকারী জাতি নিজেই চুক্তি ভঙ্গ করার কথা স্বীকার করবে, এটা জরুরী না। তবে চুক্তি ভঙ্গ করার ব্যাপারটি একেবারে সুস্পষ্ট ও সন্দেহাতীত হওয়া অবশ্যি জরুরী।

দুইঃ কুরাইশদের পক্ষ থেকে চুক্তি ভঙ্গ করার পরও নবী (সা.) নিজের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে বা ইশারা ইঙ্গিতে এমন কোন কথা বলেননি যা থেকে এ ইশারা পাওয়া যায় যে, এ চুক্তি ভঙ্গ করা সত্ত্বেও তিনি এখনো তাদেরকে একটি চুক্তিবদ্ধ জাতি মনে করেন এবং এখনো তাদের সাথে তাঁর চুক্তিমূলক সম্পর্ক বজায় রয়েছে বলে মনে করেন। সমস্ত বর্ণনা একযোগে একথা প্রমাণ করে যে, আবু সুফিয়ান যখন মদীনায় এসে চুক্তি নবায়নের আবেদন করে, তখন তিনি তা গ্রহণ করেননি।

তিনঃ তিনি নিজে কুরাইশদের বিরুদ্ধে সামরিক কার্যক্রম গ্রহণ করেন এবং প্রকাশ্যে গ্রহণ করেন। তাঁর কার্যক্রমে কোন প্রকার প্রতারণার সামান্যতম গন্ধও পাওয়া যায় না। তিনি বাহ্যত সন্ধি এবং গোপনে যুদ্ধের পথ অবলম্বন করেননি।

এটিই এ ব্যাপারে নবী (সা.) এর উত্তম আদর্শ। কাজেই ওপরে উল্লেখিত আয়াতের সাধারণ বিধান থেকে সরে গিয়ে যদি কোন কার্যক্রম অবলম্বন করা যেতে পারে, তাহলে তা এমনি বিশেষ অবস্থায়ই করা যেতে পারে এবং নবী (সা.) যে ধরনের সরল-সহজ-ভদ্রজনোচিত পথে তা করেছিলেন তেমনি পথেই করা যেতে পারে।

তাছাড়া কোন চুক্তিবদ্ধ জাতির সাথে কোন বিষয়ে যদি আমাদের কোন বিবাদ সৃষ্টি হয়ে যায় এবং আমরা দেখি পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা বা আন্তর্জাতিক সালিশের মাধ্যমে এ বিবাদের মীমাংসা হচ্ছে না অথবা যদি আমরা দেখি, দ্বিতীয় পক্ষ বল প্রয়োগ করে এর মীমাংসা করতে উঠে পড়ে লেগেছে, তাহলে এক্ষেত্রে আমাদের জন্য বল প্রয়োগ করে এর মীমাংসায় পৌঁছানো সম্পূর্ণরূপে বৈধ হয়ে যাবে। কিন্তু উপরোক্ত আয়াত আমাদের ওপর এ নৈতিক দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে যে, আমাদের এ বল প্রয়োগ পরিষ্কার ও দ্ব্যর্থহীন ঘোষণার পর হতে হবে এবং তা হতে হবে প্রকাশ্যে। লুকিয়ে লুকিয়ে গোপনে এমন ধরনের সামরিক কার্যক্রম করা যার প্রকাশ্য ঘোষণা দিতে আমরা প্রস্তুত নই, একটি অসদাচার ছাড়া আর কিছুই নয়। ইসলাম এর শিক্ষা আমাদের দেয়নি।

.
.
৪৪.
এর অর্থ হচ্ছে, তোমাদের কাছে যুদ্ধোপকরণ ও একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী (Standing Army) সর্বক্ষণ তৈরী থাকতে হবে। তাহলে প্রয়োজনের সময় সঙ্গে সঙ্গেই সামরিক পদক্ষেপ নেয়া সম্ভবপর হবে। এমন যেন না হয়, বিপদ মাথার ওপর এসে পড়ার পর হতবুদ্ধি হয়ে তাড়াতাড়ি স্বেচ্ছাসেবক, অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য রসদপত্র যোগাড় করার চেষ্টা করা হবে এবং এভাবে প্রস্তুতি পর্ব সম্পন্ন হতে হতেই শত্রু তার কাজ শেষ করে ফেলবে।
.
অনুবাদ: