পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

১৪২ আয়াত

৫৬ ) দুনিয়ায় সুস্থ পরিবেশ বহাল করার পর আর সেখানে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না। ৪৪ আল্লাহকেই ডাকো ভীতি ও আশা সহকারে। ৪৫ নিশ্চিতভাবেই আল্লাহর রহমত সৎকর্মশীল লোকদের নিকবর্তী।
وَلَا تُفْسِدُوا۟ فِى ٱلْأَرْضِ بَعْدَ إِصْلَـٰحِهَا وَٱدْعُوهُ خَوْفًۭا وَطَمَعًا ۚ إِنَّ رَحْمَتَ ٱللَّهِ قَرِيبٌۭ مِّنَ ٱلْمُحْسِنِينَ ٥٦
৫৭ ) আর আল্লাহই বায়ুকে নিজের অনুগ্রহের পূর্বাহ্নে সুসংবাদবাহীরূপে পাঠান। তারপর যখন সে পানি ভরা মেঘ বহন করে তখন কোন মৃত ভূখণ্ডের দিকে তাকে চালিয়ে দেন এবং সেখানে বারি বর্ষণ করে(সেই মৃত ভূখণ্ড থেকে) নানা প্রকার ফল উৎপাদন করেন। দেখো, এভাবে আমি মৃতদেরকে মৃত্যুর অবস্থা থেকে বের করে আনি। হয়তো এ চাক্ষুষ পর্যবেক্ষণ থেকে তোমরা শিক্ষা লাভ করবে।
وَهُوَ ٱلَّذِى يُرْسِلُ ٱلرِّيَـٰحَ بُشْرًۢا بَيْنَ يَدَىْ رَحْمَتِهِۦ ۖ حَتَّىٰٓ إِذَآ أَقَلَّتْ سَحَابًۭا ثِقَالًۭا سُقْنَـٰهُ لِبَلَدٍۢ مَّيِّتٍۢ فَأَنزَلْنَا بِهِ ٱلْمَآءَ فَأَخْرَجْنَا بِهِۦ مِن كُلِّ ٱلثَّمَرَٰتِ ۚ كَذَٰلِكَ نُخْرِجُ ٱلْمَوْتَىٰ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ ٥٧
৫৮ ) উৎকৃষ্ট ভুমি নিজের রবের নির্দেশে প্রচুর ফসল উৎপন্ন করে এবং নিকৃষ্ট ভুমি থেকে নিকৃষ্ট ধরনের ফসল ছাড়া আর কিছুই ফলে না। ৪৬ এভাবেই আমি কৃতজ্ঞ জনগোষ্ঠির জন্য বারবার নিদর্শনসমূহ পেশ করে থাকি।
وَٱلْبَلَدُ ٱلطَّيِّبُ يَخْرُجُ نَبَاتُهُۥ بِإِذْنِ رَبِّهِۦ ۖ وَٱلَّذِى خَبُثَ لَا يَخْرُجُ إِلَّا نَكِدًۭا ۚ كَذَٰلِكَ نُصَرِّفُ ٱلْـَٔايَـٰتِ لِقَوْمٍۢ يَشْكُرُونَ ٥٨
৫৯ ) নুহকে আমি তার সম্প্রদায়ের কাছে পাঠাই। ৪৭ সে বলেঃ “হে আমার স্বগোত্রীয় ভাইয়েরা! আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। ৪৮ আমি তোমাদের জন্য একটি ভয়াবহ দিনের আযাবের আশঙ্কা করছি।”
لَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَىٰ قَوْمِهِۦ فَقَالَ يَـٰقَوْمِ ٱعْبُدُوا۟ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَـٰهٍ غَيْرُهُۥٓ إِنِّىٓ أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍۢ ٥٩
৬০ ) তার সম্প্রদায়ের প্রধানরা জবাব দেয়ঃ “আমরা তো দেখতে পাচ্ছি তুমি সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত হয়েছো।
قَالَ ٱلْمَلَأُ مِن قَوْمِهِۦٓ إِنَّا لَنَرَىٰكَ فِى ضَلَـٰلٍۢ مُّبِينٍۢ ٦٠
৬১ ) নূহ বলেঃ হে আমার সম্প্রদায়ের ভাইয়েরা! আমি কোন গোমরাহীতে লিপ্ত হইনি বরং আমি রব্বুল আলামীনের রসূল।
قَالَ يَـٰقَوْمِ لَيْسَ بِى ضَلَـٰلَةٌۭ وَلَـٰكِنِّى رَسُولٌۭ مِّن رَّبِّ ٱلْعَـٰلَمِينَ ٦١
৬২ ) তোমাদের কাছে আমার রবের বাণী পৌঁছে দিচ্ছি। আমি তোমাদের কল্যাণকামী। আল্লাহর পক্ষ থেকে আমি এমন সব কিছু জানি যা তোমার জান না।
أُبَلِّغُكُمْ رِسَـٰلَـٰتِ رَبِّى وَأَنصَحُ لَكُمْ وَأَعْلَمُ مِنَ ٱللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ ٦٢
৬৩ ) তোমরা কি এ জন্য অবাক হচ্ছো যে, তোমাদের কাছে তোমাদের স্বীয় সম্প্রদায়েরই এক ব্যক্তির মাধ্যমে তোমাদের রবের স্মারক এসেছে, তোমাদেরকে সতর্ক করার জন্য যাতে তোমরা ভুল পথে চলা থেকে রক্ষা পাও এবং তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করা হয়? ৪৯
أَوَعَجِبْتُمْ أَن جَآءَكُمْ ذِكْرٌۭ مِّن رَّبِّكُمْ عَلَىٰ رَجُلٍۢ مِّنكُمْ لِيُنذِرَكُمْ وَلِتَتَّقُوا۟ وَلَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ ٦٣
৬৪ ) কিন্তু তারা তাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করলো। অবশেষে আমি তাকে ও তার সাথীদেরকে একটি নৌকায় (আরোহণ করিয়ে) রক্ষা করি এবং আমার আয়াতকে যারা মিথ্যা বলেছিল তাদেরকে ডুবিয়ে দেই। ৫০ নিঃসন্দেহে তারা ছিল দৃষ্টিশক্তিহীন জনগোষ্ঠি।
فَكَذَّبُوهُ فَأَنجَيْنَـٰهُ وَٱلَّذِينَ مَعَهُۥ فِى ٱلْفُلْكِ وَأَغْرَقْنَا ٱلَّذِينَ كَذَّبُوا۟ بِـَٔايَـٰتِنَآ ۚ إِنَّهُمْ كَانُوا۟ قَوْمًا عَمِينَ ٦٤
৬৫ ) আর 'আদ' (জাতি) র ৫১ কাছে আমি পাঠাই তাদের ভাই হূদকে। সে বলেঃ “হে আমার সম্প্রদায়ের ভাইয়েরা! তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। এরপরও কি তোমরা ভুল পথে চলার ব্যাপারে সাবধান হবে না?”
۞ وَإِلَىٰ عَادٍ أَخَاهُمْ هُودًۭا ۗ قَالَ يَـٰقَوْمِ ٱعْبُدُوا۟ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَـٰهٍ غَيْرُهُۥٓ ۚ أَفَلَا تَتَّقُونَ ٦٥
৪৪.
"পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না।"-অর্থাৎ পৃথিবীর পরিচালন ব্যবস্থাকে বিঘ্নিত ও বিনষ্ট করো না। মানুষ যখন আল্লাহর বন্দেগী না করে নিজের বা অন্য কারোর তাবেদারী করে এবং আল্লাহর পথনির্দেশনা গ্রহণ না করে নিজের সমাজ, সংস্কৃতি ও নৈতিকতাকে এমনসব মূলনীতি ও আইনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করে যা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কারোর পথনির্দেশনা থেকে গৃহীত, তখন এমন একটি মৌলিক ও সার্বিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়, যা পৃথিবীর পরিচালন ব্যবস্থাকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই বিপর্যয়ের পথ রোধ করাই কুরআনের উদ্দেশ্য। এই সঙ্গে কুরআন এ সত্যটি সম্পর্কেও সজাগ করতে চায় যে, 'বিপর্যয়' পৃথিবীর ব্যবস্থাপনায় মৌল বিষয় নয় এবং 'সুস্থতা' তার সাথে সাময়িকভাবে সংযুক্ত হয়নি। বরং 'সুস্থতা' হচ্ছে এ ব্যবস্থাপনার মৌল বিষয় এবং নিছক মানুষের মূর্খতা অজ্ঞতা ও বিদ্রোহাত্মক কার্যকলাপের ফলে 'বিপর্যয়' তার ওপর সাময়িকভাবে আপতিত হয়। অন্য কথায় বলা যায়, এখানে মূর্খতা, অজ্ঞতা, অসভ্যতা, শিরক, বিদ্রোহ ও নৈতিক বিশৃংখলার মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনের সূচনা হয়নি এবং এগুলো দুর করার জন্য পরবর্তীকালে ক্রমাগত সংশোধন, সংস্কার ও সুস্থতা বিধানের কাজ চলেনি। বরং প্রকৃতপক্ষে মানব জীবনের সূচনা হয়েছে সুস্থ ও সুসভ্য ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে এবং পরবর্তীকালে দুস্কর্মশীল লোকেরা নিজেদের নির্বুদ্ধিতা ও দুষ্ট মনোবৃত্তির সাহায্যে এ সুস্থ ব্যবস্থাপনাটিকে ক্রমান্বয়ে বিনষ্ট ও বিপর্যস্ত করেছে। এ বিপর্যয় নির্মূল করে জীবন ব্যবস্থাকে আবার নতুন করে সংশোধিত ও সুস্থ করে তোলার জন্যই মহান আল্লাহ‌ যুগে যুগে ধারাবাহিকভাবে নবী পাঠিয়েছেন। তাঁরা প্রত্যেক যুগে মানুষকে এ একই দাওয়াত দিয়ে এসেছেন যে, যে সুস্থ ও সভ্য বিধানের ভিত্তিতে দুনিয়ার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল তার মধ্যে বিপর্যয় সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকো।

সভ্যতার বিবর্তন সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে একটি মহল যে উদ্ভট মতাদর্শ পেশ করেছেন, কুরআনের দৃষ্টিভংগী তাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁরা বলছেন, মানুষ অন্ধকার থেকে বের হয়ে ধীরে ধীরে ও পর্যায়ক্রমে আলোর মধ্যে এসেছে। বিকৃতি, অসভ্যতার ও বর্বরতা থেকে তার জীবনের সূচনা হয়েছে। তারপর পর্যায়ক্রমে তা সুস্থতা ও সভ্যতার দিকে এসেছে। বিপরীত পক্ষে কুরআন বলছে, আল্লাহ‌ মানুষকে পূর্ণ আলোকের মধ্যে এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। পূর্ণ আলোকোজ্জ্বল পরিবেশে একটি সুস্থ জীবন ব্যবস্থার আওতাধীনে তার জীবন পথে চলা শুরু হয়েছিল। তারপর মানুষ নিজেই শয়তানের নেতৃত্ব গ্রহণ করে বারবার অন্ধকারের মধ্যে প্রবেশ করেছে এবং এ সুস্থ জীবন ব্যবস্থায় বিপর্যয় ডেকে এনেছে। অন্যদিকে আল্লাহ‌ বারবার নিজের নবী ও রাসূলগণকে পাঠিয়েছেন। তাঁরা মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে আসার এবং বিপর্যয় সৃষ্টি থেকে বিরত থাকার জন্য আহবান জানিয়েছেন। (দেখুন সূরা বাকারা, ২৩০ টীকা)।

৪৫.
এ বাক্যটি থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে ওপরের বাক্যে যাকে 'বিপর্যয়' বলা হয়েছিল তা হচ্ছে আসলে মানুষের আল্লাহর পরিবর্তে অন্য কাউকে নিজের অভিভাবক, বন্ধু ও কার্য সম্পাদনকারী গণ্য করে সাহায্যের জন্য তাকে ডাকা। অন্যদিকে মানুষের এ ডাক একমাত্র আল্লাহর সত্তাকে কেন্দ্র করে উচ্চারিত হওয়ার নামই 'সুস্থতা' ও বিশুদ্ধতা।

ভীতি ও আশা সহকারে ডাকার অর্থ হচ্ছে, তোমাদের ভয় করতে হলে একমাত্র আল্লাহকেই করতে হবে এবং কোন আশা পোষন করতে হলে তাও করতে হবে একমাত্র আল্লাহরই কাছ থেকে। এ অনুভূতি সহকারে আল্লাহকে ডাকতে হবে যে, তোমাদের ভাগ্য পুরোপুরি তাঁরই করুণা নির্ভর। সৌভাগ্য, সাফল্য ও মুক্তিলাভ একমাত্র তাঁরই সাহায্য ও পথনির্দেশনায় সম্ভব। অন্যথায় তাঁর সাহায্য থেকে বঞ্চিত হলে তোমাদের জন্য ব্যর্থতা ও ধ্বংস অনিবার্য।

.
.
৪৬.
এখানে একটি সূক্ষ্ম বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। মূল বক্তব্য বিষয়টি অনুধাবন করার জন্য এ সম্পর্কে অবহিত হওয়া অপরিহার্য। এখানে বৃষ্টি ও তার বরকতের উল্লেখ করার উদ্দেশ্য শুধু আল্লাহর অসীম ক্ষমতা বর্ণনা ও মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের প্রমাণ তুলে ধরাই নয়, বরং সেই সাথে একটি উপমার সাহায্যে রিসালাত ও তার বরকতসমূহ এবং তার মাধ্যমে ভাল ও মন্দের মধ্যে এবং উৎকৃষ্ট ও নিকৃষ্টের মধ্যে পার্থক্যের চিত্র অংকন করাও এর লক্ষ্য। রসূলের আগমন এবং আল্লাহর শিক্ষা ও পথনির্দেশনা নাযিল হওয়াকে জলকণা বহনকারী বায়ু প্রবাহ ও রহমতের মেঘমালায় আছন্ন হয়ে যাওয়া এবং অমৃতধারাপূর্ণ বারিবিন্দু বর্ষনের সাথে তুলনা করা হয়েছে। আবার বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে মৃত পতিত ভূমির অকস্মাৎ সঞ্জীবিত হওয়া এবং তার উদর থেকে জীবনের অঢেল সম্পদরাজি উৎসারিত হবার ঘটনাকে নবীর শিক্ষা, অনুশীলন ও নেতৃত্বের মৃত ভূপতিত মানবতার অকস্মাৎ জেগে ওঠার এবং তার বক্ষদেশে থেকে কল্যাণের স্রোতস্বিনী উৎসারিত হবার পরিস্থিতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে, বৃষ্টি বর্ষনের ফলে এসব বরকত কেবলমাত্র এমনসব ভূমি লাভ করে, যা মূলত উর্বর কিন্তু নিছক পানির অভাবে যার শস্য উৎপাদনের যোগ্যতা চাপা পড়েছিল। ঠিক তেমনি রিসালাতের এ কল্যাণধারা থেকেও কেবলমাত্র সেই সব লোক লাভবান হতে পারে যারা মূলত মৃৎবৃত্তির অধিকারী এবং কেবলমাত্র নেতৃত্ব ও পথ নির্দেশনা না পাওয়ার কারণে যাদের যোগ্যতা ও সুস্থ মনোবৃত্তি সুস্পষ্ট রূপলাভ করার ও কর্মতৎপরতা হবার সুযোগ পায় না। অন্যদিকে দুষ্ট মনোবৃত্তির অধিকারী ও দুষ্কর্মশীল মানুষেরা হচ্ছে এমন ধরনের অনুর্বর জমির মত, যা রহমতের বারি বর্ষণে কোনক্রমেই লাভবান হয় না বরং বৃষ্টির পানি পড়ার সাথে সাথেই যার পেটের সমস্ত বিষ কাঁটা গাছ ও ঝোপ ঝাড়ের আকারে বের হয়ে আসে। অনুরূপভাবে রিসালাতের আবির্ভাবে তাদের কোন ফায়দা হয় না বরং উল্টো তাদের অভ্যন্তরের সমস্ত দুষ্কৃতি ও শয়তানী মনোবৃত্তি পূর্ণোদ্যমে সক্রিয় হয়ে ওঠে।

পরবর্তী কয়েকটি রুকূ’তে ধারাবাহিকভাবে ঐতিহাসিক প্রমাণ সহকারে এ উপমাটিকে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, প্রত্যেক যুগে নবীর আগমনের পর মানব জাতি দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি ভাগ হচ্ছে সুস্থ ও সৎ চেতনা সম্পন্ন লোকদের। রিসালাতের অমিয় ধারায় অবগাহন করে তারা পরিপুষ্ট হয় এবং উন্নতি ও উত্তম ফলে ফুলে সুশোভিত হয়। আর দ্বিতীয় ভাগটি হচ্ছে দুষ্ট চেতনা সম্পন্ন জনগোষ্ঠির। কষ্টিপাথরের সামনে আসার সাথে সাথেই তারা নিজের সমস্ত অসৎ প্রবণতার ডালি উন্মুক্ত করে দেয়। তাদের সমস্ত দুষ্কৃতি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। অবশেষে তাদেরকে ঠিক তেমনিভাবে ছেঁটে দূরে নিক্ষেপ করা হয় যেভাবে স্বর্ণকার রূপা ও সোনার ভেজাল অংশটুকু ছেঁটে দূরে নিক্ষেপ করে।

.
৪৭.
হযরত নূহ আলাইহিস সালাম ও তার সম্প্রদায় থেকে এ ঐতিহাসিক বিবরণের সূচনা করা হযেছে। কারণ কুরআনের দৃষ্টিতে হযরত আদম আলাইহিস সালাম তাঁর সন্তানদের যে সৎ ও সুস্থ জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে যান, তাতে প্রথম বিকৃতি দেখা দেয় হযরত নূহের যুগে এবং এরই সংশোধন ও এ জীবন ব্যবস্থাকে আবার সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য মহান আল্লাহ‌ হযরত নূহকে পাঠান।

কুরআনের ইঙ্গিত ও বাইবেলের সুস্পষ্ট বর্ণনার পর একথা আজ নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত হয়ে গেছে যে, বর্তমান ইরাকেই হযরত নূহের সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। বেবিলনের প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের অভ্যন্তরে বাইবেলের চাইতেও যে প্রাচীন লিপি পাওয়া গেছে, তা থেকেও এর সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। কুরআনে ও তাওরাতে যে ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, ঐ প্রাচীন লিপিতেও তদ্রুপ এক কাহিনীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ঘটনাটি মুসেল-এর আশেপাশে ঘটেছিল বলে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার কুর্দিস্তান ও আর্মেনিয়া এলাকায় প্রাচীনকাল থেকে বংশ পরম্পরায় যেসব কিংবদন্তী চলে আসছে তা থেকেও জানা যায় যে, প্লাবনের পর হযরত নূহের নৌকা এ এলাকার কোন এক স্থানে থেমেছিল। আজো মুসেলের উত্তরে ইবনে উমর দ্বীপের আশেপাশে এবং আর্মেনিয়া সীমান্তে “আরারাত” পাহাড়ের আশেপাশে নূহ আলাইহিস সালামের বিভিন্ন নিদর্শন চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। ‘নখচীওয়ান’ শহরের অধিবাসীদের মধ্যে আজো এ প্রবাদ প্রচলিত যে, হযরত নুহ এ শহরের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।

নূহের প্লাবনের মত প্রায় একই ধরনের ঘটনার কথা গ্রীক, মিসর, ভারত ও চীনের প্রাচীন সাহিত্যেও পাওয়া যায়। এছাড়াও বার্মা, মালয়েশিয়া, পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, অষ্ট্রেলিয়া, নিউগিনি এবং আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন এলাকায়ও এ একই ধরনের কিংবদন্তী প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। এ থেকে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, এ ঘটনাটি এমন এক সময়ের সাথে সম্পর্কিত যখন সমগ্র মানব জাতির দুনিয়ার একই এলাকায় অবস্থান করতো, তারপর সেখান থেকে তাদের বংশধরেরা দুনিয়ার চর্তুদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তাই সকল জাতি তাদের উন্মেষকালীন ইতিহাসে একটি সর্বব্যাপী প্লাবনের ঘটনা নির্দেশ করেছে। অবশ্য কালের আবর্তনে এর যথার্থ বিস্তারিত তথ্যাদি তারা বিস্মৃত হয়ে গেছে এবং প্রত্যেকে নিজের চিন্তা-ভাবনা অনুযায়ী আসল ঘটনার গায়ে প্রলেপ লাগিয়ে এক একটা বিরাট কল্পকাহিনী তৈরী করে নিয়েছে।

৪৮.
কুরআন মজীদের এ স্থানে ও অন্যান্য স্থানে হযরত নূহ ও তাঁর সম্প্রদায়ের যে অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে তা থেকে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এ সম্প্রদায়টি আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করতো না, তাঁর সম্পর্কে নিরেট অজ্ঞও ছিল না এবং তাঁর ইবাদাত করতেও তারা অস্বীকার করতো না। বরং তারা প্রকৃতপক্ষে যে গোমরাহীতে লিপ্ত ছিল সেটি ছিল শিরক। অর্থাৎ তারা আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বে অন্যান্য সত্তাকেও শরীক করতো এবং ইবাদাত লাভের অধিকারে তাদেরকে তাঁর সাথে হিস্সাদার মনে করতো। তারপর এ মৌলিক গোমরাহী থেকে এ জাতির মধ্যে অসংখ্য ত্রুটি ও দুষ্কৃতির জন্ম নেয়। যেসব মনগড়া মাবুদকে আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বের অংশীদার গণ্য করা হয়েছিল, তাদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য জাতির মধ্যে একটি বিশেষ শ্রেণীর জন্ম হয়। এ শ্রেণীটি সমস্ত ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্তৃত্বের একচ্ছত্র মালিক হয়ে বসে। জাতিকে তারা উচ্চ শ্রেণী ও নিম্ন শ্রণীতে বিভক্ত করে। সমাজ জীবন জুলুম ও বিপর্যয়ে ভরপুর করে তোলে। নৈতিক উচ্ছৃংখলতা, চারিত্রিক নৈরাজ্য ও পাপাচারের মাধ্যমে মানবতার মূলে কুঠারাঘাত করে। এ অবস্থার পরিবর্তন করার জন্য হযরত নূহ আলাইহিস সালাম অত্যন্ত সবর, সহিষ্ণুতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে দীর্ঘকাল প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালান। কিন্তু সাধারণ মানুষকে তারা নিজেদের প্রতারনা জালে এমনভাবে আবদ্ধ করে নেয় যার ফলে সংশোধনের কোন কৌশল কার্যকর প্রমাণিত হয়নি। অবশেষে হযরত নূহ (আ) আল্লাহর কাছে এ মর্মে দোয়া করেনঃ ‍‍"হে আল্লাহ! এ কাফেরদের একজনকেও পৃথিবীর বুকে জীবিত ছেড়ে দিয়ো না। কারণ এদের কাউকে জীবিত ছেড়ে দিলে এরা তোমার বান্দাদেরকে গোমরাহ করতে থাকবে এবং এদের বংশে যাদেরই জন্ম হবে তারাই হবে অসৎকর্মশীল, দুশ্চরিত্র ও বিশ্বাসঘাতক।” (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন সুরা হুদ ৩ রুকূ, সূরা শূআরা ৬ রুকূ ও সমগ্র সূরা নূহ)।
.
.
.
.
৪৯.
এ ব্যাপারটি ঘটেছিল হযরত নূহ (আ) ও তাঁর জাতির মধ্যে। ঠিক এ একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল হযরত মুহাম্মাদ ﷺ ও তাঁর সম্প্রদায়ের মধ্যে। হযরত মুহাম্মাদ ﷺ ও হযরত নূহ (আ) এর মত একই বাণী এনেছিলেন। মক্কার সরদাররা হযরত মুহাম্মাদ ﷺ এর নবুওয়াতের বিরুদ্ধে যেসব সন্দেহ প্রকাশ করছিল সেই একই ধরনের সন্দেহ হাজার হাজার বছর আগে হযরত নূহের সম্প্রদায়ের প্রধানরাও পেশ করেছিল। আবার এসবের জবাবে হযরত নূহ (আ) যেসব কথা বলতেন, হযরত মুহাম্মাদ ﷺ ও সেই একই কথা বলতেন। পরবর্তীতে অন্যান্য নবীদের ও তাদের জাতির যেসব ঘটনা ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়েছে সেখানেও এটাই দেখানো হয়েছে যে, প্রত্যেক নবীর জাতির ভূমিকা মক্কাবাসীদের ভূমিকার সাথে এবং প্রত্যেক নবীর ভাষণ মুহাম্মাদ ﷺ এর ভাষণের সাথে পুরোপুরি সাদৃশ্য রাখে। এর সাহায্যে কুরআন তার পাঠক ও শ্রোতাদেরকে একথা বুঝাতে চায় যে, প্রতি যুগে মানুষের গোমরাহী মূলগতভাবে একই ধরনের ছিল এবং আল্লাহর পাঠানো মানবতার শিক্ষকদের দাওয়াতও প্রতিযুগে প্রত্যেকটি দেশে একই রকম ছিল। অনুরূপভাবে যারা নবীদের দাওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং নিজেদের গোমরাহীর নীতিতে অবিচল থেকেছে তাদের পরিণামও একই হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে।
৫০.
কুরআনের বর্ণনাভঙ্গির সাথে যাদের ভাল পরিচয় নেই তারা অনেক সময় এ সন্দেহে পড়ে যান যে, সম্ভবত এই সমগ্র ব্যাপারটি একটি বা দু’টি বৈঠকেই সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল। গোটা কার্যধারা এরূপ ছিল বলে মনে হয় যে, নবী এলেন এবং তিনি নিজের দাওয়াত পেশ করলেন। লোকেরা আপত্তি ও প্রশ্ন উত্থাপন করলো এবং তিনি তার জবাব দিলেন। তারপর লোকেরা তাঁর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করলো আর অমনি আল্লাহ‌ আযাব পাঠিয়ে দিলেন। অথচ ব্যাপারটি ঠিক এমন নয়। যেসব ঘটনাকে যুথবদ্ধ করে এখানে মাত্র কয়েকটি বাক্যে বর্ণনা করা হয়েছে সেগুলো সংঘটিত হতে সুদীর্ঘকাল ও বছরের পর বছর সময় লেগেছিল। কুরআনের একটি বিশেষ বর্ণনা পদ্ধতি হচ্ছে, কুরআন শুধুমাত্র গল্প বলার জন্য ঘটনা বা কাহিনী বর্ণনা করে যায় না বরং শিক্ষা দেবার জন্য বর্ণনা করে যায়। তাই সর্বত্র ঐতিহাসিক ঘটনাবলী বর্ণনা করার সময় কাহিনীর কেবলমাত্র সেই অংশটুকুই কুরআন উপস্থাপন করে, যার সাথে উদ্দেশ্য ও মূল বিষয়বস্তুর কোন সম্পর্ক থাকে। এছাড়া কাহিনীর অন্যান্য বিস্তারিত বিবরণকে সম্পূর্ণ বাদ দেয়। আবার যদি কোন কাহিনীকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বর্ণনা করে থাকে তাহলে সর্বত্র উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন বিস্তারিত বিবরণও পেশ করে থাকে। যেমন এই নূহ আলাইহিস সালামের কাহিনীটির কথাই ধরা যাক। নবীর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করার ও তাকে মিথ্যুক বলার পরিণাম বর্ণনা করাই এখানে এর উদ্দেশ্য। কাজেই নবী যত দীর্ঘকাল পর্যন্ত নিজের জাতিকে দাওয়াত দিতে থেকেছেন, সে কথা বলার এখানে কোন প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু যেখানে মুহাম্মাদ ﷺ ও তাঁর সাথীদেরকে সবর করার উপদেশ দেয়ার উদ্দেশ্যে এ কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে সেখানে বিশেষভাবে নূহ আলাইহিস সালামের দাওয়াতের দীর্ঘ সময়ের উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম ও তাঁর সাথী গণ নিজেদের মাত্র কয়েক বছরের প্রচেষ্টা ও সাধনা ফলপ্রসূ হতে না দেখে হতোদ্যম না হয়ে পড়েন এবং অন্যদিকে তারা যেন নূহ আলাইহিস সালামের সবরের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন, যিনি সুদীর্ঘকাল অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক পরিবেশে সত্যের দাওয়াত দেয়া অব্যাহত রেখেছেন এবং কোন সময় একটুও হতাশ হননি। (সূরা আনকাবুত, আয়াত-১৪)

এখানে আর একটি সন্দেহও দেখা দেয়। এটি দূর করাও প্রয়োজন।কোন ব্যক্তি যখন বারবার কুরআনে পড়তে থাকে, অমুক জাতি নবীর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেছিল, নবী তাদেরকে আল্লাহর আযাব অবতীর্ণ হবার খবর দিয়েছিলেন এবং অকস্মাৎ একদিন আল্লাহর আযাব এসে সেই জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। এ সময় তার মনে প্রশ্ন জাগে, এ ধরনের ঘটনা এখন ঘটে না কেন? যদিও এখনো বিভিন্ন জাতির উত্থান পতন হয় কিন্তু এ উত্থান পতনের ধরনই আলাদা। এখন তো এমন হয় না যে, একটি সতর্কবাণী উচ্চারণ করার পর ভূমিকম্প, প্লাবন বা ঝড় এলো এবং পুরো এক একটি জাতি ধ্বংস হয়ে গেলো। এর জবাবে বলা যায়, প্রকৃতপক্ষে একজন নবী সরাসরি যে জাতিকে দাওয়াত দেন তার ব্যাপারটি অন্য জাতিদের ব্যাপার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের। যে জাতির মধ্যে কোন নবীর জন্ম হয়, তিনি সরাসরি তার ভাষায় তার কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছিয়ে দেন এবং নিজের নিখুঁত ব্যক্তি চরিত্রের মাধ্যমে নিজের বিশ্বস্ততা ও সত্যতার জীবন্ত আদর্শ তার সামনে তুলে ধরেন, এতে করে তার সামানে আল্লাহর যুক্তি প্রমাণ তথা তার দাওয়াত পূর্ণরূপে উপস্থাপিত হয়েছে বলে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়ে যায়। তার জন্য ওযর-আপত্তি পেশ করার আর কোন অবকাশই থাকেনা। আল্লাহর পাঠানো রসূলকে সামনা-সামনি অস্বীকার করার পর তার অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছে, যার ফলে ঘটনাস্থলেই তার সম্পর্কে চূড়ান্ত ফয়সালা হয়ে যাওয়া জরুরী হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে, যেসব জাতির কাছে আল্লাহর বাণী সরাসরি নয় বরং বিভিন্ন মাধ্যমে এসে পৌঁছেছে তাদের ব্যাপারটির ধরন এর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কাজেই নবীদের সময় যেসব ঘটনার অবতারণা হতে দেখা যেতো এখন যদি আর সে ধরনের কোন ঘটনা না ঘটে থাকে তাহলে তাতে অবাক হবার কিছুই নেই। কারণ, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর নবুওয়াতের সিলসিলা বন্ধ হয়ে গেছে। তবে হাঁ, কোন নবীকে সামনা সামনি প্রত্যাখ্যান করার পর কোন জাতির ওপর যে আযাব আসতো তেমনি ধরনের কোন আযাব যদি বর্তমানে কোন জাতির ওপর আসে তাহলে তাতেই বরং অবাক হতে হবে।

কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, বর্তমানে যেসব জাতি আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্মক আচরণ করছে এবং নৈতিক ও চিন্তাগত দিক দিয়ে গোমরাহীতে লিপ্ত হয়েছে, তাদের ওপর আল্লাহর আযাব আসা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে, এখনো এসব জাতির ওপর আযাব আসছে। কখনো সতর্ককারী ছোট ছোট আযাব, আবার কখনো চূড়ান্ত ফায়সালাকারী বড় বড় আযাব। কিন্তু আম্বিয়া আলাহিমুস সালাম ও আসমানী কিতাবগুলোর মত এ আযাবগুলোর নৈতিক তাৎপর্যের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকৃষ্ট করার দায়িত্ব কেউ গ্রহণ করছে না। বরং এর বিপরীত পক্ষে স্থুল দৃষ্টির অধিকারী বিজ্ঞানী, সত্য সম্পর্কে অজ্ঞ, ঐতিহাসিক ও দার্শনিকদের একটি বিরাট গোষ্ঠী মানব জাতির ঘাড়ে চেপে বসে আছে। তারা এ ধরনের যাবতীয় ঘটনার ব্যাখ্যা করে প্রাকৃতিক আইন বা ঐতিহাসিক কার্যকারণের মানদণ্ডে। এভাবে তারা মানুষকে অসচেতনতা ও বিস্মৃতির মধ্যে নিক্ষেপ করতে থাকে। তারা মানুষকে কখনো একথা বুঝার সুযোগ দেয়না যে, উপরে একজন আল্লাহ‌ আছেন, তিনি অসৎকর্মশীল জাতিদেরকে প্রথমে তাদের অসৎ কর্মের জন্য সতর্ক করে দেন, তারপর যখন তারা তাঁর পাঠানো সতর্ক সংকেতসমূহ থেকে চোখ বন্ধ করে নিয়ে নিজেদের অসৎকর্ম চালিয়ে যেতে থাকে অবিশ্রান্ত ভাবে, তখন তিনি তাদেরকে ধ্বংসের আবর্তে নিক্ষেপ করেন।

.
৫১.
'আদ' ছিল আরবের প্রাচীনতম জাতি। আরবের সাধারণ মানুষের মুখে মুখে এদের কাহিনী প্রচলিত ছিল। ছোট ছোট শিশুরাও তাদের নাম জানতো। তাদের অতীত কালের প্রতাপ-প্রতিপত্তি ও গৌরব গাঁথা প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছিল। তারপর দুনিয়ার বুক থেকে তাদের নাম-নিশানা মুছে যাওয়াটাও প্রবাদের রূপ নিয়েছিল। আদ জাতির এ বিপুল পরিচিতির কারণেই আরবী ভাষায় প্রত্যেকটি প্রাচীন ও পুরাতন জিনিসের জন্য 'আদি' শব্দ ব্যবহার করা হয়। প্রাচীন ধ্বংসাবশেষকে 'আদিয়াত' বলা হয়। যে জমির মালিক বেঁচে নেই এবং চাষাবাদকারী না থাকার কারণে যে জমি অনাবাদ পড়ে থাকে তাকে 'আদি-উল-আরদ' বলা হয়। প্রাচীন আরবী কবিতায় আমরা এ জাতির নামের ব্যবহার দেখি প্রচুর পরিমাণে। আরবের বংশধারা বিশেষজ্ঞগণও নিজেদের দেশের বিলুপ্ত জাতিদের মধ্যে সর্বপ্রথম এ জাতিটির নামোচ্চারণ করে থাকেন। হাদীসে বলা হয়েছে, একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে বনু যহল ইবনে শাইবান গোত্রের এক ব্যক্তি আসেন। তিনি আদ জাতির এলাকার অধিবাসী ছিলেন। তিনি প্রাচীনকাল থেকে তাদের এলাকার লোকদের মধ্যে আদজাতি সম্পর্কে যেসব কিংবদন্তী চলে আসছে তা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শুনান।

কুরআনের বর্ণনা মতে এ জাতিটির আবাসস্থল ছিল 'আহকাফ' এলাকা। এ এলাকাটি হিজায, ইয়ামন ও ইয়ামামার মধ্যবর্তী 'রাবয়ুল খালী'র দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত। এখন থেকে অগ্রসর হয়ে তারা ইয়ামনের পশ্চিম সমুদ্রোপকূল এবং ওমান ও হাজরা মাউত থেকে ইরাক পর্যন্ত নিজেদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বিস্তৃত করেছিল। ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে এ জাতিটির নিদর্শনাবলী দুনিয়ার বুক থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কিন্তু দক্ষিণ আরবের কোথাও কোথাও এখনো কিছু পুরাতন ধ্বংস স্তূপ দেখা যায়। সেগুলোকে আদ জাতির নিদর্শন মনে করা হয়ে থাকে। হাজরা মাউতে এক জায়গায় হযরত হূদ আলাইহিস সালামের নামে একটি কবরও পরিচিত লাভ করেছে। ১৮৩৭ খৃস্টাব্দে James R.Wellested নামক একজন ইংরেজ নৌ-সেনাপতি 'হিসনে গুরাবে' একটি পুরাতন ফলকের সন্ধান লাভ করেন। এতে হযরত হূদ আলাইহিস সালামের উল্লেখ রয়েছে। এ ফলকে উৎকীর্ণ লিপি থেকে পরিষ্কার জানা যায়, এটি হযরত হূদের শরীয়াতের অনুসারীদের লেখা ফলক। (আল আহকাফ দেখুন)।

.
অনুবাদ: