পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

১৪২ আয়াত

৪৬ ) এ উভয় দলের মাঝখানে থাকবে একটি অন্তরাল। এর উচু স্থানে (আ’রাফ) অপর কিছু লোক থাকবে। তারা জান্নাতে প্রবেশ করেনি ঠিকই কিন্তু তারা হবে তার প্রার্থী।
وَبَيْنَهُمَا حِجَابٌۭ ۚ وَعَلَى ٱلْأَعْرَافِ رِجَالٌۭ يَعْرِفُونَ كُلًّۢا بِسِيمَىٰهُمْ ۚ وَنَادَوْا۟ أَصْحَـٰبَ ٱلْجَنَّةِ أَن سَلَـٰمٌ عَلَيْكُمْ ۚ لَمْ يَدْخُلُوهَا وَهُمْ يَطْمَعُونَ ٤٦
৪৭ ) তারা প্রত্যেককে তার লক্ষণের সাহায্যে চিনে নেবে। জান্নাতবাসীদেরকে ডেকে তারা বলবেঃ “তোমাদের প্রতি শান্তি হোক!” আর যখন তাদের দৃষ্টি জাহান্নামবাসীদের দিকে ফিরবে, তারা বলবেঃ “হে আমাদের রব! এ জালেমদের সাথে আমাদের শামিল করো না।”
۞ وَإِذَا صُرِفَتْ أَبْصَـٰرُهُمْ تِلْقَآءَ أَصْحَـٰبِ ٱلنَّارِ قَالُوا۟ رَبَّنَا لَا تَجْعَلْنَا مَعَ ٱلْقَوْمِ ٱلظَّـٰلِمِينَ ٤٧
৪৮ ) আবার এ আ'রাফের লোকেরা জাহান্নামের কয়েকজন বড় বড় ব্যক্তিকে তাদের আলামত দেখে চিনে নিয়ে ডেকে বলবেঃ “দেখলে তো তোমরা, আজ তোমাদের দলবলও তোমাদের কোন কাজে লাগলো না। আর তোমাদের যেই সাজ-সরঞ্জামকে তোমরা অনেক বড় মনে করতে তাও কোন উপকারে আসলো না।
وَنَادَىٰٓ أَصْحَـٰبُ ٱلْأَعْرَافِ رِجَالًۭا يَعْرِفُونَهُم بِسِيمَىٰهُمْ قَالُوا۟ مَآ أَغْنَىٰ عَنكُمْ جَمْعُكُمْ وَمَا كُنتُمْ تَسْتَكْبِرُونَ ٤٨
৪৯ ) আর এ জান্নাতের অধিবাসীরা কি তারাই নয়, যাদের সম্পর্কে তোমরা কসম খেয়ে বলতে, এদেরকে তো আল্লাহ‌ তাঁর রহমত থেকে কিছুই দেবেন না? আজ তাদেরকেই বলা হয়েছে, প্রবেশ করো জান্নাতে- তোমাদের কোন ভয়ও নেই, দুঃখও নেই।”
أَهَـٰٓؤُلَآءِ ٱلَّذِينَ أَقْسَمْتُمْ لَا يَنَالُهُمُ ٱللَّهُ بِرَحْمَةٍ ۚ ٱدْخُلُوا۟ ٱلْجَنَّةَ لَا خَوْفٌ عَلَيْكُمْ وَلَآ أَنتُمْ تَحْزَنُونَ ٤٩
৫০ ) আর জাহান্নামবাসীরা জান্নাতবাসীদেরকে ডেকে বলবেঃ “সামান্য একটু পানি আমাদের উপর ঢেলে দাও না। অথবা আল্লাহ‌ তোমাদের যে রিযিক দান করেছেন তা থেকেই কিছু ফেলে দাও না।” তারা জবাবে বলবেঃ “আল্লাহ এ দু’টি জিনিসই সত্য অস্বীকারকারীদের জন্য হারাম করেছেন,
وَنَادَىٰٓ أَصْحَـٰبُ ٱلنَّارِ أَصْحَـٰبَ ٱلْجَنَّةِ أَنْ أَفِيضُوا۟ عَلَيْنَا مِنَ ٱلْمَآءِ أَوْ مِمَّا رَزَقَكُمُ ٱللَّهُ ۚ قَالُوٓا۟ إِنَّ ٱللَّهَ حَرَّمَهُمَا عَلَى ٱلْكَـٰفِرِينَ ٥٠
৫১ ) যারা নিজেদের দ্বীনকে খেলা ও কৌতুকের ব্যাপার বানিয়ে নিয়েছিল এবং দুনিয়ার জীবন যাদেরকে প্রতারণায় নিমজ্জিত করেছিল।” আল্লাহ‌ বলেন, “আজ আমিও তাদেরকে ঠিক তেমনিভাবে ভুলে যাবো যেভাবে তারা এ দিনটির মুখোমুখী হওয়ার কথা ভুলে গিয়েছিল এবং আমার আয়াতসমূহ অস্বীকার করেছিল।” ৩৫
ٱلَّذِينَ ٱتَّخَذُوا۟ دِينَهُمْ لَهْوًۭا وَلَعِبًۭا وَغَرَّتْهُمُ ٱلْحَيَوٰةُ ٱلدُّنْيَا ۚ فَٱلْيَوْمَ نَنسَىٰهُمْ كَمَا نَسُوا۟ لِقَآءَ يَوْمِهِمْ هَـٰذَا وَمَا كَانُوا۟ بِـَٔايَـٰتِنَا يَجْحَدُونَ ٥١
৫২ ) আমি এদের কাছে এমন একটি কিতাব নিয়ে এসেছি যাকে পূর্ণ জ্ঞানের ভিত্তিতে বিশদ ব্যাখ্যামূলক করেছি ৩৬ এবং যা ঈমানদারদের জন্য পথ নির্দেশনা ও রহমত স্বরূপ। ৩৭
وَلَقَدْ جِئْنَـٰهُم بِكِتَـٰبٍۢ فَصَّلْنَـٰهُ عَلَىٰ عِلْمٍ هُدًۭى وَرَحْمَةًۭ لِّقَوْمٍۢ يُؤْمِنُونَ ٥٢
৫৩ ) এখন এরা কি এর পরিবর্তে এ কিতাব যে পরিণামের খবর দিচ্ছে তার প্রতীক্ষায় আছে? ৩৮ যেদিন সেই পরিণাম সামনে এসে যাবে সেদিন যারা তাকে উপেক্ষা করেছিল তারাই বলবেঃ “যথার্থই আমাদের রবের রসূলগণ সত্য নিয়ে এসেছিলেন। এখন কি আমরা এমন কিছু সুপারিশকারী পাবো যারা আমাদের পক্ষে সুপারিশ করবে? অথবা আমাদের পুনরায় ফিরে যেতে দেয়া হবে, যাতে পূর্বে আমরা যা কিছু করতাম তার পরিবর্তে এখন অন্য পদ্ধতিতে কাজ করে দেখাতে পারি?” ৩৯ তারা নিজেরাই নিজেদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং যে মিথ্যা তারা রচনা করেছিল তার সবটুকুই আজ তাদের কাছ থেকে উধাও হয়ে গেছে।
هَلْ يَنظُرُونَ إِلَّا تَأْوِيلَهُۥ ۚ يَوْمَ يَأْتِى تَأْوِيلُهُۥ يَقُولُ ٱلَّذِينَ نَسُوهُ مِن قَبْلُ قَدْ جَآءَتْ رُسُلُ رَبِّنَا بِٱلْحَقِّ فَهَل لَّنَا مِن شُفَعَآءَ فَيَشْفَعُوا۟ لَنَآ أَوْ نُرَدُّ فَنَعْمَلَ غَيْرَ ٱلَّذِى كُنَّا نَعْمَلُ ۚ قَدْ خَسِرُوٓا۟ أَنفُسَهُمْ وَضَلَّ عَنْهُم مَّا كَانُوا۟ يَفْتَرُونَ ٥٣
৫৪ ) প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই তোমাদের রব, যিনি আকাশ ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। ৪০ তারপর তিনি নিজের কর্তৃত্বের আসনে সমাসীন হন। ৪১ তিনি রাত দিয়ে দিনকে ঢেকে দেন তারপর রাতের পেছনে দিন দৌড়িয়ে চলে আসে। তিনি সূর্য, চন্দ্র ও তারকা রাজী সৃষ্টি করেন। সবাই তাঁর নির্দেশের আনুগত। জেনে রাখো, সৃষ্টি তারই এবং নির্দেশও তাঁরই। ৪২ আল্লাহ বড়ই বরকতের অধিকারী। ৪৩ তিনি সমগ্র বিশ্বজাহানের মালিক ও প্রতিপালক।
إِنَّ رَبَّكُمُ ٱللَّهُ ٱلَّذِى خَلَقَ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضَ فِى سِتَّةِ أَيَّامٍۢ ثُمَّ ٱسْتَوَىٰ عَلَى ٱلْعَرْشِ يُغْشِى ٱلَّيْلَ ٱلنَّهَارَ يَطْلُبُهُۥ حَثِيثًۭا وَٱلشَّمْسَ وَٱلْقَمَرَ وَٱلنُّجُومَ مُسَخَّرَٰتٍۭ بِأَمْرِهِۦٓ ۗ أَلَا لَهُ ٱلْخَلْقُ وَٱلْأَمْرُ ۗ تَبَارَكَ ٱللَّهُ رَبُّ ٱلْعَـٰلَمِينَ ٥٤
৫৫ ) তোমাদের রবকে ডাকো কান্নাজড়িত কণ্ঠে ও চুপে চুপে। অবশ্যি তিনি সীমা লংঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না।
ٱدْعُوا۟ رَبَّكُمْ تَضَرُّعًۭا وَخُفْيَةً ۚ إِنَّهُۥ لَا يُحِبُّ ٱلْمُعْتَدِينَ ٥٥
.
.
.
.
.
৩৫.
জান্নাতবাসী, জাহান্নামবাসী ও আ'রাফবাসীদের এ পারস্পরিক সংলাপ থেকে পরকালীন জীবনে মানুষের শক্তির সীমানা কতদূর বিস্তৃত হবে তা কিছুটা আন্দাজ করা যেতে পারে। সেখানে দৃষ্টিশক্তি এতটা প্রসারিত হবে যার ফলে জান্নাত, জাহান্নাম বা আ'রাফের লোকেরা যখন ইচ্ছা পরস্পরকে দেখতে পারবে। সেখানে আওয়াজ ও শ্রবণশক্তিও হবে বহু দূরপাল্লার। ফলে এ পৃথক পৃথক জগতের লোকেরা পরস্পরের সাথে অতি সহজেই কথাবার্তা বলতে পারবে। পরকালীন জগত সম্পর্কে এ বর্ণনা এবং এ ধরনের আরো যেসব বর্ণনা কুরআনে উদ্বৃত্ত হয়েছে তা এ ধারণা সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট যে, সেখানকার জীবন যাপনের বিধান আমাদের এ দুনিয়ার প্রাকৃতিক বিধান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর হবে। অবশ্যি এখানে আমাদের যে ব্যক্তি-সত্তা রয়েছে সেখানেও তাই থাকবে। তবে যেসব লোকের মস্তিষ্ক এ প্রাকৃতিক জগতের সীমানার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে রয়ে গেছে এবং বর্তমান জীবন ও এর সংক্ষিপ্ত পরিমাপগুলো ছাড়া ব্যাপকতর কোন জিনিসের ধারণা যাদের মস্তিষ্কে সংকুলান হয় না, তারা কুরআন ও হাদীসের এ ধরনের বর্ণনাগুলোকে অবাক দৃষ্টিতে দেখে থাকে এবং কখনো কখনো এগুলোকে বিদ্রূপও করে থাকে। এভাবে তারা তাদের বুদ্ধির স্বল্পতারই প্রমাণ দিয়ে থাকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এদের বুদ্ধির পরিসর যতটা সংকীর্ণ জগত ও জীবনের সম্ভাবনাগুলো ততটা সংকীর্ণ নয়।
৩৬.
অর্থাৎ এতে পরিপূর্ণ বিশদ বিবরণ সহকারে যথার্থ সত্য, মানুষের জন্য দুনিয়ার জীবনে সঠিক কর্মনীতি এবং সঠিক জীবন পদ্ধতির মূল নীতিগুলো কি কি, তা বর্ণনা করা হয়েছে। তারপর নিছক আন্দাজ-অনুমান বা ধারণা-কল্পনার ভিত্তিতে এ বিস্তারিত বিবরণগুলো দেয়া হয়নি। বরং নির্ভেজাল ও নির্ভুল জ্ঞানের ভিত্তিতে দেয়া হয়েছে।
৩৭.
অর্থ হচ্ছে, প্রথমত এ কিতাবের বিষয়বস্তু ও এর শিক্ষাবলী এত বেশী স্পষ্ট যে, এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলে যেকোন মানুষের সামনে সত্য পথ পরিষ্কারভাবে ভেসে উঠতে পারে। তাছাড়া যারা এ কিতাবকে মানে, এ কিতাবটি তাদের জীবনে কেমন সঠিক পথনির্দেশনা দেয় এবং এটি যে কত বড় অনুগ্রহ তা তাদের জীবনে ঘটনাবলী থেকে কার্যত প্রত্যক্ষ করা যেতে পারে। এর প্রভাব গ্রহণ করার সাথে সাথেই মানুষের মন-মানস, নৈতিক বৃত্তি ও চরিত্রে সর্বোত্তম বৈপ্লবিক পরিবর্তন শুরু হয়ে যায়। এ কিতাবের প্রতি ঈমান আনার পর সাহাবায়ে কেরামের জীবনে যে বিস্ময়কর পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল তার দিকে এখানে ইশারা করা হয়েছে।
৩৮.
এ বিষয়বস্তুটিকে অন্য কথায় এভাবে বলা যেতে পারে, এক ব্যক্তিকে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতিতে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয়া হয় কিন্তু এরপরও সে তা মানতে প্রস্তুত হয় না। তারপর তার সামনে কিছু লোক সঠিক পথে চলে দেখিয়েও দেয় যে, ভুল পথ চলার সময় তারা কেমন ছিল এবং এখন সঠিক পথ অবলম্বন করার পর তাদের জীবনে কত ভাল পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু এ থেকেও ঐ ব্যক্তি কোন শিক্ষা গ্রহণ করে না। তাহলে এর অর্থ এ দাঁড়ায় যে, এখন ঐ ব্যক্তি নিজের ভুল পথে চলার শাস্তি লাভ করার পরই কেবল একথা মেনে নেবে যে, সে ভুল পথে ছিল। যে ব্যক্তি ডাক্তারের জ্ঞানগর্ভ পরামর্শ গ্রহণ করে না এবং নিজের মত অসংখ্য রোগীকে ডাক্তারের পরামর্শ মত চলে রোগমুক্ত হতে দেখেও তা থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ করে না, সে এখন মৃত্যু শয্যায় শায়িত হয়েই কেবল একথা স্বীকার করবে যে, যেভাবে ও যে পদ্ধতিতে সে জীবন যাপন করে আসছিল তা সত্যিই তার জন্য ধ্বংসকর ছিল।
৩৯.
অর্থাৎ তারা পুনর্বার এ দুনিয়ায় ফিরে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করবে। তারা বলবে, আমাদের যে সত্যের খবর দেয়া হয়েছিল এবং তখন আমরা যে সত্যটি মেনে নেইনি, এখন চাক্ষুষ দেখার পর আমরা সে ব্যাপারে জেনে গেছি। কাজেই এখন যদি আমাদের আবার দুনিয়ায় পাঠিয়ে দেয়া হয় তাহলে এখন আমাদের কর্মপদ্ধতি আর আগের মত হবে না। (এ মিনতি এবং এর কি জবাব দেয়া হবে তা জানার জন্য দেখুন সুরা আন'আমের আয়াত ২৭-২৮, ইবরাহীম ৪৪-৪৫, সাজদা ১২-১৩, ফাতের ৩৭, যুমার ৫৬-৫৯, মু’মিন ১১-১২)।
.
৪০.
এখানে দিন শব্দটি প্রচলিত ২৪ ঘণ্টার দিন অর্থে অথবা যুগ বা কাল (PERIOD) অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে। শেষোক্ত অর্থে কুরআনে একাধিক ব্যবহার লক্ষণীয়। যেমন সুরা হজ্জের ৬ রুকূ’তে আয়াত ৪৭ এ বলা হয়েছেঃ

وَإِنَّ يَوْمًا عِنْدَ رَبِّكَ كَأَلْفِ سَنَةٍ مِمَّا تَعُدُّونَ

(আর প্রকৃতপক্ষে তোমরা যে হিসাব কষে থাকো, সেই দৃষ্টিতে তোমার রবের এখানে একটি দিন এক হাজার বছরের সমান)।

আবার সূরা মা’আরিজ-এর ৪নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ

تَعْرُجُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ إِلَيْهِ فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ

(ফেরেশতারা ও জিব্রীল তাঁর দিকে আরোহণ করে একদিনে, যার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছর)। তবে এখানে ‘দিন’ শব্দের প্রকৃত তাৎপর্য কি, তা আল্লাহই ভাল জানেন। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, সূরা হামীম সাজদা-টীকা ১১-১৫)

৪১.
আল্লাহর “ইস্তিওয়া আলাল আরশ”(কর্তৃত্বের আসনে সমাসীন হওয়া) এর বিস্তারিত স্বরূপ অনুধাবন করা আমাদের পক্ষে কঠিন। খুব সম্ভবত সমগ্র বিশ্ব-জাহান সৃষ্টির পর মহান আল্লাহ‌ কোন একটি স্থানকে তাঁর এ অসীম সাম্রাজ্যের কেন্দ্র নির্ধারণ করেন এবং সেখানে নিজের আলোক রশ্মির বিচ্ছুরণকে কেন্দ্রীভূত করে দেন আর তারই নাম দেন “আরশ” (কর্তৃত্বের আসন)। সেখান থেকে সমগ্র বিশ্বজাহানের নব নব সৃষ্টির প্রক্রিয়া চলছে ও ক্রমাগত শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটছে, সেই সাথে সৃষ্টি জগতের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাও অব্যাহত রয়েছে। আবার এও সম্ভব হতে পারে যে, আরশ অর্থ শাসন কর্তৃত্ব এবং আরশের ওপর সমাসীন হয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ‌ এ বিশ্ব-জাহান সৃষ্টি করার পর এর শাসন দণ্ড নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। মোটকথা আরশের ওপর সমাসীন হওয়ার বিস্তারিত অর্থ যাই হোক না কেন, মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ‌ যে এ বিশ্ব-জগতের নিছক স্রষ্টাই নন বরং এর পরিচালক ও ব্যবস্থাপকও একথা ভালভাবে হৃদয়ঙ্গম করানোই কুরআনে এর উল্লেখের আসল উদ্দেশ্য। তিনি এ দুনিয়াকে অস্তিত্বশীল করার পর এর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে কোথাও বসে যাননি। বরং কার্যত তিনিই সারা বিশ্ব-জাহানের ছোট বড় প্রত্যেকটি বস্তুর ওপর কর্তৃত্ব করছেন। পরিচালনা ও শাসন কর্তৃত্বের যাবতীয় ক্ষমতা কার্যত তাঁরই হাতে নিবদ্ধ। প্রতিটি বস্তু তাঁর নির্দেশের অনুগত। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণাও তাঁর নির্দেশ মেনে চলে। প্রতিটি বস্তু ও প্রাণীর ভাগ্যই চিরন্তনভাবে তাঁর নির্দেশের সাথে যুক্ত। যে মৌলিক বিভ্রান্তিটির কারণে মানুষ কখনো শিরকের গোমরাহীতে লিপ্ত হয়েছে, আবার কখনো নিজেকে স্বাধীন ক্ষমতা সম্পন্ন ঘোষণা করার মতো ভ্রান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, কুরআন এভাবে তার মূলোৎপাটন করতে চায়। বিশ্ব-জাহানের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা থেকে আল্লাহকে কার্যত সম্পর্কহীন মনে করার অনিবার্য ফল দাঁড়ায় দু’টি। মানুষ নিজের ভাগ্যকে অন্যের হাতে বন্দি মনে করবে এবং তার সামনে মাথা নত করে দেবে অথবা নিজেকেই নিজের ভাগ্যের নিয়ন্তা মনে করবে এবং নিজেকে সর্বময় কর্তৃত্বশালী স্বাধীন সত্তা মনে করে কাজ করে যেতে থাকবে।

এখানে আরো একটি কথা প্রণিধানযোগ্য। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যকার সম্পর্ক সুস্পষ্ট করার জন্য কুরআন মজীদে মানুষের ভাষা থেকে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এমন সব শব্দ পরিভাষা, উপমা ও বর্ণনাভংগী গ্রহণ করা হয়েছে, যা রাজত্ব ও বাদশাহীর সাথে সম্পর্ক রাখে। এ বর্ণনাভংগী কুরআনে এত বেশী স্পষ্ট যে, অর্থ বুঝে কুরআন পাঠকারী যে কোন ব্যক্তিই এ বিষয়টি অনুভব না করে থাকতে পারবেন না। কোন কোন অর্বাচীন সমালোচক স্বীয় বিকৃত চিন্তা ও মানসিকতার কারণে এ বাচনভংগী থেকে বুঝেছেন যে, এ কিতাবটি যে যুগের “রচনা” সে যুগে মানুষের মন-মস্তিষ্কে রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রভাব ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ছিল। তাই এ কিতাবের রচয়িতা (এ বিবেকহীন নিন্দুকদের মতে এর রচয়িতা নাকি হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহকে একজন রাজা ও বাদশাহ হিসেবেই পেশ করেছেন। অথচ কুরআন যে শাশ্বত ও অনাদি-অনন্ত সত্য উপস্থাপন করছে তা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সে সত্যটি হচ্ছে, ভুমণ্ডলে ও নভোমণ্ডলে একমাত্র আল্লাহর রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত। সার্বভৌমত্ব (Sovereignty) বলতে যা বুঝায় তা একমাত্র তারই সত্তার একচেটিয়া অধিকার ও বৈশিষ্ট্য। আর বিশ্ব-জাহানের এ ব্যবস্থাপনা একটি পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা বিশেষ, যেখানে ঐ একক সত্তা, সমস্ত ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী। কাজেই এ ব্যবস্থার মধ্যে যে ব্যক্তি বা দল নিজের বা অন্য কারুর আংশিক বা পূর্ণ কর্তৃত্বের দাবীদার হয়, সে নিজেকে নিছক প্রতারণার জালে আবদ্ধ করে রেখেছে। তাছাড়া এ ব্যবস্থার মধ্যে অবস্থান করে মানুষ পক্ষে ঐ একক সত্তাকে একই সাথে ধর্মীয় অর্থেও একমাত্র মাবুদ এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক অর্থেও একমাত্র শাসক (Sovereign) হিসেবে মেনে নেয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোন সঠিক দৃষ্টিভংগী ও কর্মনীতি হতে পারে না।

৪২.
”আরশের উপর সমাসীন হলেন” বাক্যটির মাধ্যমে সংক্ষেপে যে বিষয়টি বর্ণিত হয়েছিল এখানে তারই কিছুটা অতিরিক্ত ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ‌ নিছক স্রষ্টাই নন, তিনি হুকুমকর্তা এবং শাসকও। তিনি সৃষ্টি করার পর নিজের সৃষ্ট বস্তুসমূহকে অন্যের কর্তৃত্বে সোপর্দ করে দেননি অথবা সমগ্র সৃষ্টিকে বা তার অংশ বিশেষকে ইচ্ছামত চলার জন্য স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেননি। বরং কার্যত সমগ্র বিশ্ব-জগতের পরিচালনা ব্যবস্থা আল্লাহর নিজের হাতেই কেন্দ্রীভূত রয়েছে। দিন রাত্রির আবর্তন আপনা আপনিই হচ্ছে না। বরং আল্লাহর হুকুমে হচ্ছে। তিনি যখনই চাইবেন দিন ও রাতকে থামিয়ে দেবেন আবার যখনই চাইবেন এ ব্যবস্থা বদলে দেবেন। সূর্য, চন্দ্র, তারকা এরা কেউ নিজস্ব কোন শক্তির অধিকারী নয়। বরং এরা সবাই সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর কর্তৃত্বাধীন। এরা একান্ত অনুগত দাসের মত সেই কাজই করে যাচ্ছে যে কাজে আল্লাহ‌ এদেরকে নিযুক্ত করেছেন।
৪৩.
বরকতের আসল অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি, উন্নতি, বিকাশ। এই সঙ্গে এ শব্দটির মধ্যে একদিকে উচ্চতা ও মহত্বের ভাবধারা নিহিত রয়েছে এবং অন্যদিকে রয়েছে স্থীতিশীলতা ও অবিচলতার ভাবধারাও। আবার মঙ্গল ও কল্যাণের ভাবধারাও নিশ্চিতভাবে এসব অর্থের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কাজেই আল্লাহর বড়ই বরকতের অধিকারী হবার অর্থ এ দাঁড়ায় যে, তাঁর মঙ্গল ও কল্যাণের কোন সীমা নেই। তাঁর সত্তা থেকে সীমাহীন কল্যাণ চতুর্দিকে বিস্তৃত হচ্ছে এবং তিনি অতি উন্নত ও শ্রেষ্ঠ এক সত্তা। তাঁর মহত্বের কোন শেষ নেই। আর তাঁর এ কল্যাণ, মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব চিরস্থায়ী ও অনন্তকালীন-সাময়িক নয়। এর ক্ষয়ও নেই। পতনও নেই। (আল-ফুরকান, টীকা ১-১৯ দ্রষ্টব্য)।
.
.
অনুবাদ: