পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

৩৯৯ আয়াত

২ ) তোমাদের বন্ধু পথভ্রষ্ট হয়নি বা বিপথগামীও হয়নি।
مَا ضَلَّ صَاحِبُكُمْ وَمَا غَوَىٰ ٢
৩ ) সে নিজের খেয়ালখুশী মতো কথা বলে না।
وَمَا يَنطِقُ عَنِ ٱلْهَوَىٰٓ ٣
৪ ) যা তার কাছে নাযিল করা হয় তা অহী ছাড়া আর কিছুই নয়।
إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْىٌۭ يُوحَىٰ ٤
৫ ) তাকে মহাশক্তির অধিকারী একজন শিক্ষা দিয়েছে, যে অত্যন্ত জ্ঞানী।
عَلَّمَهُۥ شَدِيدُ ٱلْقُوَىٰ ٥
৬ ) সে সামনে এসে দাঁড়ালো।
ذُو مِرَّةٍۢ فَٱسْتَوَىٰ ٦
৭ ) তখন সে উঁচু দিগন্তে ছিল।
وَهُوَ بِٱلْأُفُقِ ٱلْأَعْلَىٰ ٧
৮ ) তারপর কাছে এগিয়ে এলো এবং ওপরে শূন্যে ঝুলে রইলো।
ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّىٰ ٨
৯ ) অতঃপর তাদের মাঝে মুখোমুখি দু’টি ধনুকের জ্যা-এর মত কিংবা তার চেয়ে কিছু কম ব্যবধান রাইলো।
فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَىٰ ٩
১০ ) তখন আল্লাহ‌র বান্দাকে যে অহী পৌঁছানোর ছিল তা সে পৌঁছিয়ে দিল।
فَأَوْحَىٰٓ إِلَىٰ عَبْدِهِۦ مَآ أَوْحَىٰ ١٠
১১ ) দৃষ্টি যা দেখলো মন তার মধ্যে মিথ্যা সংমিশ্রিত করলো না। ১০
مَا كَذَبَ ٱلْفُؤَادُ مَا رَأَىٰٓ ١١
২.
রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ কে বুঝানো হয়েছে এবং কুরাইশদের সম্বোধন করা হয়েছে। মূল শব্দ ব্যবহার করা হয়েছেصَاحِبُكُمْ (তোমাদের বন্ধু)। আরবী ভাষায় صاحب বলতে বন্ধু, সাথী, নিকটে অবস্থানকারী এবং সাথে উঠা-বসা করে এমন লোককে বুঝায়। এখানে নবীর ﷺ নাম উল্লেখ করা বা “আমার রসূল” বলার পরিবর্তে “তোমাদের বন্ধু” বলে তাঁর কথা উল্লেখ করার মধ্যে অত্যন্ত গভীর তাৎপর্য আছে। এভাবে কুরাইশদের একথা বুঝানো হয়েছে যে, তোমাদের কাছে যে ব্যক্তির কথা বলা হচ্ছে তিনি তোমাদের এখানে বাইরে থেকে আসা কোন অপরিচিত ব্যক্তি নন যে, আগে থেকে তোমাদের সাথে তাঁর কোন জানা শোনাই নেই। তিনি তোমাদের নিজ কওমের লোক। তোমাদের মধ্যেই তিনি থাকেন এবং বসবাস করেন। তিনি কে, কি তাঁর পরিচয়, তিনি কেমন চরিত্র ও কর্মের অধিকারী মানুষ, কেমন তাঁর আচার-আচরণ, কেমন তাঁর অভ্যাস ও স্বভাব চরিত্র এবং আজ পর্যন্ত তোমাদের মাঝে তাঁর জীবন কেমন কেটেছে তা তোমাদের প্রতিটি শিশু পর্যন্ত জানে। তাঁর সম্পর্কে কেউ যদি নির্লজ্জের মত কিছু বলে তাহলে তাঁকে জানে তোমাদের মধ্যে এমন বহু মানুষ বর্তমান যারা নিজেরাই বিচার করে দেখতে পারে, একথা তাঁর ব্যাপারে প্রযোজ্য হয় কিনা।
৩.
এটিই মূল কথা যার জন্য অস্তমিত তারকা বা তারকারাজির শপথ করা হয়েছে। পথভ্রষ্ট হওয়ার অর্থ পথ না চেনার কারণে কারো ভুল পথে চলা এবং বিপথগামী হওয়ার অর্থ জেনে শুনে কারো ভুল পথ অবলম্বন করা। আল্লাহ‌র এ বাণীর তাৎপর্য হলো মুহাম্মাদ ﷺ তোমাদের একান্ত পরিচিত ব্যক্তি। তিনি পথভ্রষ্ট বা বিপথগামী হয়েছেন তাঁর বিরুদ্ধে তোমাদের এ অভিযোগ সম্পূর্ণরূপে ভুল। প্রকৃতপক্ষে তিনি পথভ্রষ্ট বা বিপথগামী কিছুই হননি। একথা বলতে যে কারণে তারকারাজির অস্তমিত হওয়ার শপথ করা হয়েছে তা হলো, রাতের অন্ধকারে যখন তারকা জ্বল জ্বল করে তখন কোন ব্যক্তি তার চারপাশের বস্তুকে স্পষ্ট দেখতে পায় না এবং বিভিন্ন বস্তুকে অস্পষ্টভাবে দেখতে পেয়ে সেগুলো সম্পর্কে ভুল অনুমান করতে পারে। যেমন অন্ধকারে দূরে থেকে কোন গাছ দেখে তাকে ভূত মনে করতে পারে। রশি পড়ে থাকতে দেখে তাকে সাপ মনে করতে পারে। বালুকাস্তূপের কোন পাথর উঁচু হয়ে থাকতে দেখে কোন হিংস্র জন্তু বসে আছে বলে মনে করতে পারে। কিন্তু যে সময় তারকাসমূহ অদৃশ্য হয়ে যায় এবং সকালের আলো উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তখন প্রতিটি বস্তু তার মূল আকার-আকৃতিতে মানুষের সামনে প্রকাশ পায়। সে সময় কোন বস্তুর মূল রূপ ও আকার আকৃতির ব্যাপারে কোন সন্দেহের সৃষ্টি হয় না। তোমাদের মধ্যে মুহাম্মাদ ﷺ এর ব্যাপারটিও তাই। তাঁর জীবন ও ব্যক্তিত্ব অন্ধকারে ঢাকা নয়, বরং আলোক উদ্ভাসিত ভোরের মত স্পষ্ট। তোমরা জানো, তোমাদের এ ‘বন্ধু” একজন অতি নম্র স্বভাব, জ্ঞানী ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। তাঁর সম্পর্কে কুরাইশদের কোন ব্যক্তির এ ভুল ধারণা কি করে হতে পারে যে, তিনি পথভ্রষ্ট হয়েছেন। তোমরা এও জান যে, তিনি অত্যন্ত সদিচ্ছা পরায়ণ এবং সত্যবাদী মানুষ। তোমাদের কেউ তাঁর সম্পর্কে কি করে এ মত পোষণ করতে পারে যে, তিনি জেনে শুনে শুধু যে নিজে বাঁকা পথ অবলম্বন করে বসে আছেন তাই নয়, অন্যদেরও সে বাঁকা পথের দিকে আহবান জানাতে উঠে পড়ে লেগেছেন।
.
৪.
অর্থাৎ যেসব কথার কারণে তোমরা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করছো যে, তিনি পথভ্রষ্ট বা বিপথগামী হয়েছেন সেসব কথা তাঁর মনগড়া নয় কিংবা তাঁর প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা ঐসবের উৎস নয়। তা আল্লাহ‌র পক্ষ থেকে অহীর মাধ্যমে তাঁর ওপর নাযিল করা হয়েছে এবং হচ্ছে। তিনি নিজে নবী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করেননি। তাই নিজের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য নবুওয়াতের দাবী করে বসেছেন এমন নয়। বরং আল্লাহ‌ তা’আলা অহীর মাধ্যমে যখন তাঁকে এ পদে অভিষিক্ত হতে আদেশ দিলেন তখনই তিনি তোমাদের মাঝে রিসালাতের তাবলীগ তথা প্রচারের জন্য তৎপরতা শুরু করলেন এবং বললেন, আমি তোমাদের জন্য আল্লাহ‌র নবী। একইভাবে ইসলামের এ আন্দোলন, তাওহীদের এ শিক্ষা, আখেরাত, হাশর-নাশর এবং কাজকর্মের প্রতিদানের এ খবর মহাবিশ্বে ও মানুষ সম্পর্কে এসব সত্য ও তথ্য এবং পবিত্র জীবন যাপন করার জন্য যেসব নীতিমালা তিনি পেশ করেছেন এসবও তাঁর নিজের রচিত দর্শন নয়। আল্লাহ‌ তা’আলা অহীর মাধ্যমে তাঁকে এসব বিষয়ের জ্ঞান দান করেছেন। অনুরূপভাবে তিনি তোমাদেরকে যে কুরআন শুনিয়ে থাকেন তাও তাঁর নিজের রচিত নয়। এসব আল্লাহ‌র বাণী। এসব বাণী অহীর মাধ্যমে তাঁর ওপর নাযিল হয়।

এখানে একটি প্রশ্ন আসে যে, নবী ﷺ সম্পর্কে আল্লাহ‌ তা’আলার এ উক্তি যে, “তিনি নিজের খেয়াল খুশীমত কথা বলেন না, যা বলেন তা তাঁর কাছে নাযিলকৃত অহী ছাড়া আর কিছুই নয়।” তাঁর পবিত্র মুখ থেকে উচ্চারিত কোন্‌ কোন্‌ কথার সাথে সম্পর্কিত? তিনি যত কথা বলতেন এ উক্তি কি তার সবটার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য? নাকি কিছু কিছু কথার ওপর প্রযোজ্য আর কিছু কথার জন্য প্রযোজ্য নয়? এর জবাব হচ্ছে আল্লাহ‌ তা’আলার এ উক্তি কুরআন মজীদের ক্ষেত্রে তো প্রযোজ্য হবেই। কুরআন মজীদ ছাড়া আরো যেসব কথা নবী সাল্লাল্লাহু ﷺ এর পবিত্র মুখ থেকে উচ্চারিত হতো তাও অনিবার্যরূপে তিন ভাগে বিভক্ত হতে পারে।

দ্বীনের প্রচার ও আল্লাহ‌র পথে মানুষকে আহবানের জন্য তিনি যেসব কথাবার্তা বলতেন অথবা কুরআন মজীদের বিষয়বস্তু তার শিক্ষা এবং আদেশ-নিষেধ ও হিদায়াতসমূহের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হিসেবে যা কিছু বলতেন অথবা কুরআনেরই উদ্দেশ্য ও দাবী পূরণ করার জন্য যেসব বক্তৃতা করতেন বা লোকদের উপদেশ ও শিক্ষা দিতেন এগুলো এক শ্রেণীর কথা। এসবকথা সম্পর্কে এরূপ সন্দেহ করার আদৌ কোন অবকাশ নেই যে, তিনি (নাউযুবিল্লাহ্‌) মনগড়া ভাবে বলতেন। এ ব্যাপারে প্রকৃতপক্ষে তাঁর মর্যাদা ছিল কুরআনের সরকারী ভাষ্যকার বা মুখপত্র এবং আল্লাহ‌ তা’আলার মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে। কুরআনের প্রতিটি শব্দ যেসব নবীর ﷺ ওপরে নাযিল করা হতো অনুরূপ এসব কথার প্রতিটি শব্দ যদিও তাঁর ওপর নাযিল করা হতো না কিন্তু তা অবশ্যই তাঁর ওপর নাযিলকৃত ওহীর জ্ঞান ভিত্তিক ছিল। এসব কথা ও কুরআনের মধ্যে শুধু এতটুকু পার্থক্য ছিল যে, কুরআনের ভাষা ও ভাব সব কিছুই আল্লাহ‌র পক্ষ থেকে ছিল। এসব কথার অর্থ ও ভাব আল্লাহ‌ তাঁকে শিখিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজের ভাষায় ও শব্দে তা প্রকাশ করতেন। এ পার্থক্যের কারণে কুরআনকে “অহীয়ে জলী” (প্রকাশ্য অহী) এবং নবীর ﷺ অবশিষ্ট এসব কথাবার্তাকে “অহীয়ে খফী” (অপ্রকাশ্য অহী) বলা হয়।

নবীর ﷺ দ্বিতীয় আরেক প্রকারের কথাবার্তা ছিল যা তিনি আল্লাহ‌র বিধানের তাবলীগ ও প্রচারণার চেষ্টা সাধনায় এবং দ্বীন প্রতিষ্ঠার তৎপরতার ক্ষেত্রে বলতেন। এ কাজে তাঁকে মুসলমানদের জামায়াতের নেতা এ পথ প্রদর্শক হিসেবে বিভিন্ন রকমের অসংখ্য দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হতো। এসব ব্যাপারে অনেক সময় তিনি তাঁর সঙ্গী সাথীদের পরামর্শও গ্রহণ করেছেন, নিজের মত বাদ দিয়ে তাদের মতও গ্রহণ করেছেন। তাদের জানতে চাওয়ার প্রেক্ষিতে কোন কোন সময় স্পষ্টভাবে বলেছেনও যে, একথা আমি আল্লাহ‌র আদেশে নয়, নিজের মত হিসেবেই বলছি। তাছাড়া অনেকবার এ রকমও হয়েছে যে, তিনি নিজের ইজতিহাদের ভিত্তিতে কোন কথা বলেছেন কিন্তু পরে আল্লাহ‌র পক্ষ থেকে তার পরিপন্থী নির্দেশনা এসেছে। এ ধরনের যত কথা তিনি বলেছেন তার কোন কথাই আদৌ এমন ছিল না এবং থাকতে পারে না যা তাঁর প্রবৃত্তির খেয়ালখুশী ও কামনা-বাসনার ফল। এখন প্রশ্ন হলো, তাঁর এ ধরনের সব কথা কি অহী ভিত্তিক ছিল? এ প্রশ্নের জবাব হলো, যেসব কথা সম্পর্কে তিনি নিজে স্পষ্ট করে বলেছেন যে, একথা আল্লাহ‌র নির্দেশ ভিত্তিক নয়, কিংবা যে ক্ষেত্রে তিনি সাহাবীদের (রাঃ) পরামর্শ চেয়েছেন এবং তাদের মতামত গ্রহণ করেছেন অথবা যেসব ক্ষেত্রে কোন কথা বা কাজ হয়ে যাওয়ার পর আল্লাহ‌ তা’আলা তার পরিপন্থী হিদায়াত নাযিল করেছেন সে কথা ছাড়া তাঁর আর সব কথাই পূর্বোক্ত ধরনের কথাসমূহের মত ‘অহীয়ে খফী’র অন্তর্ভুক্ত। তাই ইসলামী আন্দোলনের নেতা ও পথ প্রদর্শক, মু’মিনদের দলের সরদার এবং ইসলামী রাষ্ট্রের শাসকের যে পদ মর্যাদায় তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন তা তাঁর রচিত বা মানুষের প্রদত্ত ছিল না। তিনি আল্লাহ‌ তা’আলার পক্ষ থেকে এ কাজ করার জন্য আদিষ্ট ও নিযুক্ত হয়েছিলেন। এ পদমর্যাদার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে গিয়ে তিনি যা কিছু বলতেন এবং করতেন তা আল্লাহ‌র ইচ্ছার প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা নিয়ে করতেন। এক্ষেত্রে যেসব কথা তিনি তাঁর ইজতিহাদের ভিত্তিতে বলতেন, তাঁর ঐসব ইজতিহাদের অনেকগুলো আল্লাহ‌র কাছে অত্যন্ত পছন্দনীয় ছিল। আল্লাহ‌ তাঁকে জ্ঞানের যে আলো দিয়েছিলেন ওগুলো তা থেকে উৎসারিত ছিল। এ কারণে তাঁর ইজতিহাদ যেখানেই আল্লাহ‌র পছন্দের বাইরে চলে গিয়েছে সেখানে তৎক্ষনাত “অহীয়ে জলী’র মাধ্যমে তা সংশোধন করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ‌র পক্ষ থেকে তাঁর কোন কোন ইজতিহাদের এ সংশোধনই এ কথা প্রমাণ করে যে, তাঁর অবশিষ্ট সমস্ত ইজতিহাদ হুবহু আল্লাহ‌র মর্জির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল।

তৃতীয় আরেক রকমের কথা ছিল যা মানুষ হিসেবে নবী ﷺ সাধারণ কাজকর্মে বলতেন। নবুওয়াতের দায়-দায়িত্ব পালনের সাথে এসব কথার কোন সম্পর্ক ছিল না। এ ধরনের কথা তিনি নবী হওয়ার পূর্বেও বলতেন এবং নবী হওয়ার পরেও বলতেন। এ ধরনের কথা সম্পর্কে সর্ব প্রথমে বুঝে নিতে হবে যে, ঐ গুলো নিয়ে কাফেরদের সাথে কোন ঝগড়া বিবাদ ছিল না। এসব কথার কারণে কাফেররা তাঁকে পথভ্রষ্ট ও বিপথগামী বলেনি।

তারা এ অভিযোগ আরোপ করতো প্রথম দুই শ্রেণীর কথার ক্ষেত্রে। তাই তৃতীয় প্রকারের কথা আদৌ আলোচ্য বিষয় ছিল না। অতএব আল্লাহ‌ তা’আলার এ বাণী এ প্রকারের কথার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কিন্তু ঐ প্রকারের কথা এখানে আলোচনা বহির্ভূত হওয়া সত্ত্বেও এটা বাস্তব যে, জীবনের একান্ত ব্যক্তিগত ক্ষেত্রেও রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর মুখ থেকে কখনো সত্যের পরিপন্থী কোন কথা বের হতো না। নবী ও মুত্তাকী সুলভ জীবন যাপনের জন্য আল্লাহ‌ তা’আলা তাঁর জন্য কথা ও কাজের যে সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন তাঁর কথা ও কাজ সদা সর্বদা সে গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো। তাই প্রকৃত পক্ষে ঐ সব কথার মধ্যেও অহীর নূর প্রতিফলিত হতো। কোন কোন সহীহ হাদীসে রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ থেকে একথাটিই বর্ণিত হয়েছে। মুসনাদে আহমদে হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত হয়েছে, যে এক সময় নবী ﷺ বলেছিলেন, لاَ أَقُولُ إِلاَّ حَقًّا ”আমি সত্য কথা ছাড়া কিছু বলি না।” এক সাহাবী বললেনঃ إِنَّكَ تُدَاعِبُنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ “হে আল্লাহ‌র রসূল, অনেক সময় তো আপনি আমাদের সাথে হাসি-ঠাট্টাও করেন।” জবাবে নবী ﷺ বললেনঃ “ إِنِّى لاَ أَقُولُ إِلاَّ حَقًّا “প্রকৃতপক্ষে তখনো আমি সত্য ছাড়া কিছু বলি না।” মুসনাদে আহমাদ ও আবু দাউদে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আ’স থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেনঃ আমি রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর পবিত্র মুখ থেকে যা-ই শুনতাম তা সংরক্ষিত করার উদ্দেশ্যে লিখে রাখতাম। কুরাইশরা আমাকে এ কাজ করতে নিষেধ করলো তারা বলতে শুরু করলো, তুমিতো সব কথাই লিপিবদ্ধ করে যাচ্ছো। অথচ রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ তো মানুষ। অনেক সময় রাগান্বিত হয়েও কোন কথা বলেন। এতে আমি লেখা ছেড়ে দিলাম। পরবর্তী সময়ে আমি এ বিষয়টি নবীর ﷺ কাছে বললে তিনি বললেনঃ

اكْتُبْ فَوَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ مَا يَخْرُجُ مِنْهُ إِلاَّ حَقٌّ

“তুমি লিখতে থাকো, যাঁর মুঠিতে আমার প্রাণ, সে মহান সত্ত্বার শপথ, আমার মুখ থেকে সত্য ছাড়া কখনো কোন কথা উচ্চারিত হয়নি।”

এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, আমার গ্রন্থ তাফহীমাত, ১ম খণ্ড, শিরোনাম “রিসালাত আওর উসফে আহকাম।” (নির্বাচিত রচনাবলী, ১ম খণ্ড)।

৫.
অর্থাৎ তাঁকে শিক্ষাদানকারী কোন মানুষ নয়, যা তোমরা মনে করে থাকো। মানব সত্ত্বার ঊর্ধ্বের একটি মাধ্যম থেকে তিনি এ জ্ঞান লাভ করেছেন। “মহাশক্তির অধিকারী” অর্থ কারো কারো মতে আল্লাহ‌র পবিত্র সত্ত্বা। কিন্তু তাফসীরকারদের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এ ব্যাপারে একমত যে, এর অর্থ জিবরাঈল আলাইহিস সালাম। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ), হযরত আয়েশা (রাঃ), হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ), কাতাদা, মুজাহিদ এবং রাবী, ইবনে আনাস থেকে এ মতটিই বর্ণিত হয়েছে। ইবনে জারীর, ইবনে কাসীর, রাযী, আলূসী, প্রমুখ তাফসীরকারগণও এমতটিই গ্রহণ করেছেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ সাহেব এবং মাওলানা আশরাফ আলী সাহেবও তাদের অনুবাদে এটিই অনুসরণ করেছেন। সত্য বলতে কি, কুরআন মজীদের অন্যান্য বর্ণনা থেকেও এটি প্রমাণিত হয়েছে। সূরা তাকভীরে আল্লাহ‌ তা’আলা বলেছেনঃ

إِنَّهُ لَقَوْلُ رَسُولٍ كَرِيمٍ - ذِي قُوَّةٍ عِنْدَ ذِي الْعَرْشِ مَكِينٍ - مُطَاعٍ ثَمَّ أَمِينٍ وَمَا صَاحِبُكُمْ بِمَجْنُونٍ - وَلَقَدْ رَآهُ بِالْأُفُقِ الْمُبِينِ (ايات : 19-23)

“প্রকৃতপক্ষে এ এক মহাশক্তিধর সম্মানিত ফেরেশতার বর্ণনা, আরশের অধিপতির কাছে অত্যন্ত মর্যাদাবান। তাঁর আদেশ পালিত হয় এবং সেখানে অত্যন্ত বিশ্বাসী। তোমাদের বন্ধু মোটেই পাগল নন। তিনি সে ফেরেশতাকে আসমানের পরিষ্কার দিগন্তে দেখেছেন।”

যে ফেরেশতার মাধ্যমে নবীর ﷺ হৃদয়-মনে এ শিক্ষা নাযিল করা হয়েছিল সূরা বাকারার ৯৭ আয়াতে সে ফেরেশতার নামও বলে দেয়া হয়েছেঃ

قُلْ مَنْ كَانَ عَدُوًّا لِجِبْرِيلَ فَإِنَّهُ نَزَّلَهُ عَلَى قَلْبِكَ بِإِذْنِ اللَّهِ

যদি এসব আয়াত সূরা ‘নাজমের’এ আয়াতের সাথে মিলিয়ে পাঠ করা হয় তাহলে এ ব্যাপারে আদৌ সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে, মহাশক্তিধর শিক্ষক বলতে যে, আল্লাহ‌ তা’আলাকে নয়, বরং জিবরাঈলকে বুঝানো হয়েছে সে ব্যাপারে আদৌ কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না। এ বিষয়ে পরে আরো বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

এক্ষেত্রে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, জিবরাঈলকে কি করে রসুলুল্লাহ্‌ ﷺ এর শিক্ষক বলা যায়। তাহলে তো এর অর্থ দাঁড়াবে তিনি শিক্ষক আর নবী ﷺ ছাত্র। এভাবে তো নবীর ﷺ তুলনায় জিবরাঈল আলাইহিস সালামের মর্যাদা অধিক বলে স্বীকার করে নেয়া হয়। কিন্তু এরূপ সন্দেহ করা ভুল। কারণ, জিবরাঈল নবীকে ﷺ তাঁর নিজের জ্ঞান শিক্ষা দিতেন না যে, তার মর্যাদা অধিক হয়ে যাবে। তাঁকে আল্লাহ‌ তা’আলা রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ পর্যন্ত জ্ঞান পৌঁছে দেয়ার মাধ্যম বানিয়েছিলেন। শিক্ষার মাধ্যম বা বাহক হওয়ার কারণে তিনি রূপক অর্থ নবীর ﷺ শিক্ষক ছিলেন। এতে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের কোন ব্যাপার নেই। পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয হওয়ার পর রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ কে নামাযের সঠিক সময় জানানোর জন্য তাঁকে দু’দিন পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ানোর উদ্দেশ্যে আল্লাহ‌ তা’আলা জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে তাঁর কাছে পাঠিয়েছিলেন। বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী এবং মুয়াত্তা প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থে সহীহ সনদে এ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এসব হাদীসে রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ নিজেই বলেছেন যে, তিনি মুক্তাদী হয়েছিলেন এবং জিবরাঈল আলাইহিস সালাম ইমাম হয়ে নামায পড়েয়েছিলেন। এভাবে শুধু শিক্ষার জন্য তাঁকে ইমাম বানানোর অর্থ এ নয় যে, জিবরাঈল আলাইহিস সালাম নবীর ﷺ চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। এটাও ঠিক অনুরূপ ব্যাপার।

৬.
মূল আয়াতেذُو مِرَّةٍ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। ইবনে আব্বাস ও কাতাদা একে সুন্দর ও জাঁকজমকপূর্ণ অর্থে গ্রহণ করেছেন। মুজাহিদ, হাসান বাসরী, ইবনে যায়েদ এবং সুফিয়ান সাওরী বলেনঃ এর অর্থ শক্তিশালী। সাঈদ ইবনে মুসাইয়েবের মতে এর অর্থ জ্ঞানের অধিকারী। হাদীসে নবী ﷺ বলেছেনঃ لَا تَحِلُّ الصَّدَقَةُ لِغَنِيٍّ وَلَا لِذِي مِرَّةٍ سَوِيٍّ এ হাদীসে ذومرة শব্দকে তিনি সুস্থ ও সবল অর্থ ব্যবহার করেছেন। আরবী বাকরীতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে, সক্ষম, বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী অর্থেও এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। এখানে জিবরাঈল আলাইহিস সালামের ক্ষেত্রে আল্লাহ‌ তা’আলা এ ব্যাপক অর্থব্যঞ্জক শব্দটি ব্যবহার করেছেন এই জন্য যে, তাঁর মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক ও শারীরিক উভয় প্রকার শক্তি পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান। এর সবগুলো অর্থ এক সাথে বুঝানোর মত কোন শব্দ বাংলা ভাষায় নেই। তাই অনুবাদে আমরা এর মধ্য থেকে একটি অর্থকে গ্রহণ করেছি। কারণ, পূর্বের আয়াতাংশেই দৈহিক শক্তির পূর্ণতার উল্লেখ করা হয়েছে।
.
৭.
দিগন্ত অর্থ আসমানের পূর্ব প্রান্ত যেখানে সূর্য উদিত হয় এবং দিনের আলো ছড়িয়ে পড়ে। সূরা তাকভীরের ২৩ আয়াতে একেই পরিষ্কার দিগন্ত বলা হয়েছে। দু’টি আয়াত থেকেই পরিষ্কার বুঝা যায় যে, নবী ﷺ প্রথমবার যখন জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে দেখেন তখন তিনি আসমানের পূর্ব প্রান্ত থেকে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। নির্ভরযোগ্য কিছুসংখ্যক রেওয়ায়াত থেকে জানা যায় আল্লাহ‌ তা’আলা তাঁকে মূল যে আকৃতিতে সৃষ্টি করেছিলেন সে সময় তিনি মূল আকৃতিতে ছিলেন। যে রেওয়ায়াতে এ বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে পরে আমরা তার সবগুলোই উদ্ধৃত করবো।
.
৮.
অর্থাৎ আসমানের পূর্ব দিগন্তের উপরের দিকে আবির্ভূত হওয়ার পর জিবরাঈল আলাইহিস সালাম রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর দিকে অগ্রসর হতে থাকলেন এবং অগ্রসর হতে হতে তাঁর কাছে এসে উপর দিকে শূন্যে ঝুলে থাকলেন। এরপর তিনি তাঁর দিকে এগিয়ে গেলেন এবং এতটা নিকটবর্তী হলেন যে, তাঁর এবং রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর মধ্যে মুখোমুখি দু’টি ধনুকের জ্যা পরিমাণ কিংবা তার চেয়েও কিছু কম ব্যবধান রইলো। সাধারণভাবে মুফাসসিরগণ قَابَ قَوْسَيْنِ অর্থ দুই ধনুক পরিমাণই বর্ণনা করেছেন। কিন্তু হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) قوس শব্দের অর্থ করেছেন হাত এবং كَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ অর্থ করেছেন এই যে, উভয়ের মাঝে তখন দুই হাত পরিমাণ ব্যবধান ছিল মুখোমুখি লাগানো দু’টি ধনুকের মধ্যবর্তী ব্যবধানের সমান কিংবা তার চেয়ে কিছু কম ব্যবধান ছিল বলার অর্থ এই নয় যে, দুরত্বের পরিমাণ নির্ণয়ের ব্যাপারে আল্লাহ‌ তা’আলার কোন সন্দেহ হয়েছে, (নাউযুবিল্লাহ্‌)। এ ধরনের বাচনভঙ্গী গ্রহণের কারণ হলে সব ধনুক একই পরিমাপের হয় না। সূতরাং ঐ হিসেব অনুসারে যদি কোন কোন দূরত্ব বর্ণনা করা হয় তাহলে দূরত্বের পরিমাণে অবশ্যই কম বেশী হবে।
৯.
মূল আয়াত হচ্ছে, فَأَوْحَى إِلَى عَبْدِهِ مَا أَوْحَى । এ আয়াতাংশটির দু’টি অনুবাদ সম্ভব। একটি হচ্ছে, তিনি আল্লাহ‌র বান্দার প্রতি যা কিছু অহী নাযিল করার ছিল তা করলেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, তিনি অহী করলেন নিজের বান্দার ওপর যা কিছু অহী করার ছিল। প্রথম অনুবাদ করা হলে তার অর্থ হবে জিবরাঈল আল্লাহ‌র বান্দাকে অর্থাৎ রসূল ﷺ কে অহী দিলেন যা তাঁকে অহী দেয়ার ছিল। দ্বিতীয় অনুবাদটি করলে তার অর্থ হবে আল্লাহ‌ তা’আলা জিবরাঈলের মাধ্যমে তাঁর বান্দাহকে অহী দিলেন যা অহী দেয়ার ছিল। তাফসীরকারগণ এ দু’টি অর্থই বর্ণনা করেছেন। কিন্তু প্রথম অর্থটাই পূর্বাপর বিষয়ের সাথে অধিক সামঞ্জস্যশীল। হযরত হাসান বাসরী এবং ইবনে যায়েদ থেকে এ অর্থটাই বর্ণিত হয়েছে এক্ষেত্রে প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে যে, عَبدُهُ শব্দের ه সর্বনাম اوحى ক্রিয়ার কর্তার প্রতি ইঙ্গিত করার পরিবর্তে আল্লাহ‌র প্রতি কিভাবে ইঙ্গিত করবে? কারণ সূরার শুরু থেকে এ পর্যন্ত কোথাও আদৌ আল্লাহ‌র নাম উল্লেখিত হয়নি। এর জবাব হলো, যেখানে বক্তব্যের পূর্ব প্রসঙ্গ দ্বারা সর্বনামের উদ্দিষ্ট বিশেষ ব্যক্তির প্রতি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় সেখানে পূর্বে উল্লেখ করা হোক বা না হোক সর্বনাম দ্বারা আপনা থেকেই সে ব্যক্তিকে বুঝাবো। কুরআন মজীদে এর অনেকগুলো দৃষ্টান্ত আছে। যেমনঃ আল্লাহ‌ তা’আলা বলেছেনঃ إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ “আমি কদরের রাতে তা নাযিল করেছি।” এখানে কোথাও কুরআনের উল্লেখ মোটেই করা হয়নি। কিন্তু বক্তব্য থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, ه সর্বনাম দ্বারা কুরআনকেই বুঝানো হয়েছে। অন্য এক জায়গায় বলা হয়েছেঃ

وَلَوْ يُؤَاخِذُ اللَّهُ النَّاسَ بِمَا كَسَبُوا مَا تَرَكَ عَلَى ظَهْرِهَا مِنْ دَابَّةٍ

“আল্লাহ্‌ যদি মানুষকে তাদের কৃতকর্মের জন্য পাকড়াও করতে শুরু করেন তাহলে তার পৃষ্ঠে জীবন্ত কিছুই রাখবেন না।”

এখানে আগে বা পরে পৃথিবীর কোন উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু কথার ধরন থেকে আপনিই প্রকাশ পায় যে, তার পৃষ্ঠ অর্থ ভূ-পৃষ্ঠ। সূরা ইয়াসীনে বলা হয়েছে وَمَا عَلَّمْنَاهُ الشِّعْرَ وَمَا يَنْبَغِي لَهُ “আমি তাকে কবিতা শিক্ষা দেইনি। আর কবিতা তার জন্য শোভাও পায় না।” এখানে পূর্বে বা পরে কোথাও রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর কোন উল্লেখ নেই। কিন্তু কথার ধরন থেকে প্রকাশ পায় যে, সর্বনামগুলো তাঁর প্রতি ইঙ্গিত করেছে। সূরা আর-রহমানে বলা হয়েছেঃ كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ “তার ওপরে যা আছে সবই ধ্বংস হয়ে যাবে।” এখানে আগে ও পরে পৃথিবী পৃষ্ঠের কোন উল্লেখ নেই। কিন্তু বাচনভঙ্গি দ্বারা বুঝা যায় عليها এর সর্বনাম ها দ্বারা সেদিনকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।

সূরা ওয়াকিয়ায় বলা হয়েছেঃ إِنَّا أَنْشَأْنَاهُنَّ إِنْشَاءً “আমি তাদেরকে বিশেষভাবে সৃষ্টি করবো। আশে পাশে এমন কোন বস্তু নেই যার প্রতি هُنّ শব্দটি দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে। কথার ভঙ্গি থেকে প্রকাশ পায় যে, এর দ্বারা জান্নাতের নারীদের বুঝানো হয়েছে। জিবরাঈল নিজের বান্দাকে অহী দিলেন اَوْحَى اِلَى عَبْدِهِ আয়াতাংশের অর্থ যেহেতু এরকম হতে পারে না। তাই “জিবরাঈল (আঃ) আল্লাহ‌র বান্দাকে অহী দিলেন কিংবা আল্লাহ‌ জিবরাঈলের মাধ্যমে তাঁর বান্দাকে অহী দিলেন।” অনিবার্যরূপে এই অর্থই গ্রহণ করতে হবে।

১০.
অর্থাৎ দিনের আলোতে, পূর্ণ জাগ্রত অবস্থায় এবং খোলা চোখে মুহাম্মাদ ﷺ যা কিছু দেখলেন সে সম্পর্কে তাঁর মন বলেনি যে, এসব দৃষ্টিভ্রম কিংবা আমি কোন জ্বিন বা শয়তান দেখছি কিংবা আমার সামনে কোন কাল্পনিক ছবি ভেসে উঠেছে এবং জেগে জেগেই কোন স্বপ্ন দেখছি। বরং তাঁর চোখ যা দেখছিলো মন হুবহু তাই বিশ্বাস করেছে। তিনি যে সত্যি সত্যিই জিবরাঈল এবং যে বাণী তিনি পৌঁছিয়ে দিচ্ছিলেন তাও বাস্তবে আল্লাহ‌র অহী সে ব্যাপারে তার মনে কোন সন্দেহ জাগেনি।

এখানে প্রশ্ন জাগে যে, কি কারণে এ বিস্ময়কর ও অস্বাভাবিক ব্যাপার দেখা সত্ত্বেও রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর মনে আদৌ কোন সন্দেহ সৃষ্টি হলো না এবং তিনি পূর্ণ নিশ্চয়তা সহ জানতে পারলেন যে, তাঁর চোখ যা দেখছে তা প্রকৃতপক্ষেই সত্য ও বাস্তব, কোন কাল্পনিক বস্তু বা কোন জিন কিংবা শয়তান নয়? এ প্রশ্ন নিয়ে আমরা যখন গভীরভাবে চিন্তা করি তখন পাঁচটি কারণ আমাদের বোধগম্য হয়।

প্রথম কারণ, যে পারিপার্শিক অবস্থা ও পরিবেশ দেখার কাজটি সংঘটিত হয়েছিল সেটাই তার সত্যতা সম্পর্কে দৃঢ় প্রত্যয় সৃষ্টি করে দেয়। রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ অন্ধকারে মুরাকাবারত অবস্থায় স্বপ্নে কিংবা অর্ধ জাগ্রত অবস্থায় এ দর্শন লাভ করেছিলেন না, বরং তখন সকালের পরিষ্কার আলোয় চারদিক উদ্ভাসিত ছিল, তিনি পুরোপুরি জাগ্রত ছিলেন, খোলা আকাশে এবং দিনের পূর্ণ আলোতে তিনি নিজ চোখে ঠিক তেমনিভাবে এ দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিলেন যেমন কোন ব্যক্তি পৃথিবীর অন্যান্য জিনিস দেখে থাকে। এতে যদি সন্দেহের অবকাশ থাকে তাহলে আমরা দিনের বেলা নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, মানুষ, ঘরবাড়ী, মোট কথা যা কিছু দেখে থাকি তা সবই সন্দেহ যুক্ত এবং শুধু দৃষ্টিভ্রম ছাড়া আর কিছুই হতে পারেনা।

দ্বিতীয় কারণ, নবী ﷺ এর মানসিক অবস্থাও এর সত্যতার স্বপক্ষে দৃঢ় প্রত্যয় সৃষ্টি করেছিলো। তিনি পূর্ণরূপে স্বজ্ঞান ও সুস্থ ছিলেন। তাঁর ইন্দ্রিয়সমূহ সুস্থ ও সচল ছিল। তাঁর মন-মগজে পূর্ব থেকে এরূপ কোন খেয়াল চেপে ছিল না যে, এ ধরনের কোন দর্শন লাভ হওয়া উচিত বা হতে যাচ্ছে। এরূপ চিন্তা এবং তা অর্জন করার চেষ্টা থেকে মন-মগজ সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ছিল। এ পরিস্থিতিতে তিনি আকস্মিকভাবে এ ঘটনার মুখোমুখি হলেন। তাই সন্দেহ করার আদৌ কোন অবকাশ ছিল না যে, চোখ কোন বাস্তব দৃশ্য দেখছে না, বরং সামনে এসে দাঁড়ানো একটি কাল্পনিক বস্তু দেখছে।

তৃতীয় কারণ, এ পরিস্থিতিতে তাঁর সামনে যে সত্ত্বা আবির্ভূত হয়েছিল তা এত বিরাট, এত জাঁকালো, এত সুন্দর এবং এতই আলোকোদ্ভাসিত ছিল যে, ইতিপূর্বে নবীর ﷺ চিন্তায় ও ধ্যান-ধারণায় এরূপ সত্ত্বার কল্পিত রূপও আসেনি। সুতরাং তা তাঁর কল্পনা প্রসূতও ছিল না। কোন জিন বা শয়তান এমন জাঁকালো হতে পারে না। তাই তিনি তাকে ফেরেশতা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেননি। হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে মাসউদ থেকে বর্থিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ বলেছেনঃ সে সময় আমি জিবরাঈলকে দেখেছি, তাঁর তখন ছয়শত ডানা ছিল (মুসনাদে আহমাদ)। অপর একটি বর্ণনায় আবদুল্লাহ্‌ ইবনে মাসউদ (রাঃ) আরো ব্যাখ্যা করেছেন যে, জিবরাঈল আলাইহিস সালামের এক একটি ডানা এমন বিশাল ছিল যে, গোটা দিগন্ত জুড়ে আছে বলে মনে হচ্ছিল (মুসনাদে আহমাদ)। আল্লাহ‌ তায়ালা নিজে তাঁর অবস্থাকে شَدِيدُ الْقُوَى এবং ذُو مِرَّةٍ শব্দ দিয়ে বর্ণনা করেছেন।

চতুর্থ কারণ, সে সত্ত্বা যেসব শিক্ষা দান করেছিলেন তাও এ সাক্ষাতের সত্যতা সম্পর্কে প্রশান্তিদায়ক ছিল। তাঁর মাধ্যমে তিনি হঠাৎ যেসব জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং গোটা মহাবিশ্বের প্রকৃত সত্য ও তাৎপর্যের ধারক যেসব জ্ঞান লাভ করলেন তাঁর মন-মগজে সে সম্পর্কে কোন ধারণাও ছিল না। তাই তিনি সন্দেহ করেননি যে, আমারই ধ্যান-ধারণা ও কল্পনা সুবিন্যস্ত হয়ে আমার সামনে এসে হাজির হয়েছে। অনুরূপভাবে ঐ জ্ঞান সম্পর্কে এমন সন্দেহ পোষণেরও কোন অবকাশ ছিল না যে, শয়তান ঐ আকৃতিতে এসে তাঁকে ধোঁকা দিচ্ছে। কারণ, মানুষকে শিরক ও মূর্তিপূজার পরিবর্তে নির্ভেজাল তাওহীদের শিক্ষা দেয়া কি কখনো শয়তানের কাজ হতে পারে, না শয়তান কোনদিন এমন কাজ করেছে? আখেরাতের জবাবদিহি সম্পর্কে কি শয়তান কখনো মানুষকে সাবধান করেছে? জাহেলীয়াত ও তার রীতিনীতির বিরুদ্ধে কি মানুষকে কখনো ক্ষেপিয়ে তুলেছে? নৈতিক গুণাবলীর প্রতি কি আহবান জানিয়েছে? না কি কোন ব্যক্তিকে বলেছে তুমি নিজে শুধু এ শিক্ষাকে গ্রহণ কর তাই নয়, বরং গোটা বিশ্বের বুক থেকে শিরক জুলুম এবং পাপ পঙ্কিলতাকে উৎখাত এবং ঐসব দুস্কৃতির জায়গায় তাওহীদ, ন্যায়বিচার এবং তাকওয়ার সুফলসমূহ প্রতিষ্ঠা করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যাও?

পঞ্চম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, আল্লাহ‌ তা’আলা যখন কোন ব্যক্তিকে নবুওয়াত দানের জন্য বাছাই করেন তখন তাঁর হৃদয়-মনকে সব রকম সন্দেহ সংশয় ও শয়তানী প্ররোচনা থেকে মক্ত করে দৃঢ় বিশ্বাস ও প্রত্যয় দ্বারা পূর্ণ করে দেন। এ অবস্থায় তাঁর চোখ যা দেখে এবং কান যা শোনে তার সত্যতা সম্পর্কে তাঁর মন-মগজে সামান্যতম দ্বিধা-দ্বন্দ্বও সৃষ্টি হয় না। তিনি সম্পূর্ণ উদার ও উন্মুক্ত মনে এমন প্রতিটি সত্যকে গ্রহণ করে নেন যা তাঁর রবের পক্ষ থেকে তাঁর কাছে প্রকাশ হয়। তা চোখে দেখার মত প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষন হতে পারে, ইলহামী জ্ঞান হিসেবে তার মনে সৃষ্টি করা হতে পারে কিংবা অহীর পয়গাম হিসেবে আসতে পারে একটি একটি করে যার প্রতিটি শব্দ শুনানো হয়ে থাকে। এর সবকটি ক্ষেত্রেই নবীর এ উপলব্ধি পুরোপুরিই থাকে যে, তিনি সব রকম শয়তানী হস্তক্ষেপ থেকে চূড়ান্তভাবে সুরক্ষিত। যে আকারেই হোক না কেন যা কিছু তাঁর কাছে পৌঁছেছে তা অবিকল তাঁর প্রভুর নিকট থেকে এসেছে। আল্লাহ‌ প্রদত্ত সমস্ত অনুগ্রহ ও নিয়ামতের মত নবীর এ উপলব্ধি ও অনুভূতিও এমন একটি নিশ্চিত জিনিস যার মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি বা বিভ্রান্তির কোন সম্ভাবনা নেই। মাছের যেমন তার সাঁতারু হওয়া সম্পর্কে অনুভূতি আছে এবং তা আল্লাহ‌ প্রদত্ত। এতে যেমন বিভ্রান্তির লেশমাত্র থাকতে পারে না। অনুরূপ নবীর তাঁর নবী হওয়া সম্পর্কে যে অনূভূতি তাও আল্লাহ‌ প্রদত্ত হয়ে থাকে। কখনো এক মুহূর্তের জন্যও তাঁর মনে এ সন্দেহ জাগে না যে, নবী হওয়ার ব্যাপারে হয়তো সে বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে।

অনুবাদ: