পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

৩৯৯ আয়াত

৭৭ ) এ তো মহা সম্মানিত কুরআন। ৩৭
إِنَّهُۥ لَقُرْءَانٌۭ كَرِيمٌۭ ٧٧
৭৮ ) একখানা সুরক্ষিত গ্রন্থে লিপিবদ্ধ। ৩৮
فِى كِتَـٰبٍۢ مَّكْنُونٍۢ ٧٨
৭৯ ) পবিত্র সত্তাগণ ছাড়া আর কেউ তা স্পর্শ করতে পারে না। ৩৯
لَّا يَمَسُّهُۥٓ إِلَّا ٱلْمُطَهَّرُونَ ٧٩
৮০ ) এটা বিশ্ব-জাহানের রবের নাযিলকৃত।
تَنزِيلٌۭ مِّن رَّبِّ ٱلْعَـٰلَمِينَ ٨٠
৮১ ) এরপরও কি তোমরা এ বাণীর প্রতি উপেক্ষার ভাব প্রদর্শন করছো? ৪০
أَفَبِهَـٰذَا ٱلْحَدِيثِ أَنتُم مُّدْهِنُونَ ٨١
৮২ ) এ নিয়ামতে তোমরা নিজেদের অংশ রেখেছো এই যে, তোমরা তা অস্বীকার করছো? ৪১
وَتَجْعَلُونَ رِزْقَكُمْ أَنَّكُمْ تُكَذِّبُونَ ٨٢
৮৩ ) তোমরা যদি কারো অধীন না হয়ে থাকো
فَلَوْلَآ إِذَا بَلَغَتِ ٱلْحُلْقُومَ ٨٣
৮৪ ) এবং নিজেদের এ ধারণার ব্যাপারে যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে মৃত্যু পথযাত্রীর প্রাণ যখন কণ্ঠনালীতে উপনীত হয়
وَأَنتُمْ حِينَئِذٍۢ تَنظُرُونَ ٨٤
৮৫ ) এবং তোমরা নিজ চোখে দেখতে পাও যে, সে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে সে সময় তোমরা বিদায়ী প্রাণবায়ূকে ফিরিয়ে আন না কেন?
وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنكُمْ وَلَـٰكِن لَّا تُبْصِرُونَ ٨٥
৮৬ ) সে সময় তোমাদের চেয়ে আমিই তার অধিকতর নিকটে থাকি।
فَلَوْلَآ إِن كُنتُمْ غَيْرَ مَدِينِينَ ٨٦
৩৭.
তারকারাজি ও গ্রহসমূহের ‘অবস্থান স্থল’ অর্থ তাদের মনযিল ও তাদের কক্ষপথসমূহ। আর কুরআনের মহা সম্মানিত গ্রন্থ হওয়া সম্পর্কে ঐগুলোর শপথ করার অর্থ হচ্ছে ঊর্ধ্বজগতে সৌরজগতের ব্যবস্থাপনা যত সুসংবদ্ধ ও মজবুত এই বাণীও ততটাই সুসংবদ্ধ ও মজবুত। যে আল্লাহ ঐ ব্যবস্থা তৈরী করেছেন সে আল্লাহ এই বাণীও নাযিল করেছেন। মহাবিশ্বের অসংখ্য ছায়াপথ (Galaxies) ঐ সব ছায়াপথের মধ্যে সীমা সংখ্যাহীন নক্ষত্র (Stars) এবং গ্রহরাজি (Planets) বাহ্যত ছড়ানো ছিটানো দেখা গেলেও তাদের মধ্যে পূর্ণ মাত্রার যে সুসংবদ্ধতা বিরাজমান এ মহাগ্রন্থও ঠিক অনুরূপ পূর্ণ মাত্রার সুসংবদ্ধ ও সুবিন্যস্ত জীবন বিধান পেশ করে। যার মধ্যে আকীদা-বিশ্বাসের ভিত্তিতে নৈতিক চরিত্র, ইবাদত, তাহযীব, তামাদ্দুন, অর্থ ও সমাজ ব্যবস্থা, আইন ও আদালত, যুদ্ধ ও সন্ধি মোট কথা মানব জীবনের সকল বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত পথনির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং এর কোন একটি দিকই আরেকটি দিকের সাথে সামঞ্জস্যহীন ও বেখাপ্পা নয়। অথচ এই ব্যবস্থা বিভিন্ন আয়াত ও ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে প্রদত্ত ভাষণে বর্ণনা করা হয়েছে। তাছাড়া ঊর্ধ্বজগতের জন্য আল্লাহর নির্ধারিত নিয়ম-শৃঙ্খলা যেমন অপরিবর্তনীয়, তাতে কোন সময় সামান্য পরিমাণ পার্থক্যও সূচিত হয় না, ঠিক তেমনি এই গ্রন্থে যেসব সত্য ও পথনির্দেশনা পেশ করা হচ্ছে তাও অটল ও অপরিবর্তনীয়, তার একটি বিন্দুকেও স্ব-স্থান বিচ্যুত করা যেতে পারে না।
৩৮.
এর অর্থ ‘লওহে মাহফুজ’। এটি বুঝাতে كِتَابٍ مَكْنُونٍ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ এমন লিখিত বস্তু যা গোপন করে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ যা কারো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সুরক্ষিত ঐ লিপিতে কুরআন মজীদ লিখিত হওয়ার অর্থ হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপরে কুরআন নাযিল হওয়ার পূর্বে আল্লাহ তা’আলার কাছে তা সেই ভাগ্যলিপিতে লিপিবদ্ধ হয়ে গিয়েছে যাতে কোন রকম পরিবর্তন পরিবর্ধন সম্ভব নয়। কারণ, তা যেকোন সৃষ্টির ধরা ছোঁয়ার ঊর্ধ্বে।
৩৯.
কাফেররা কুরআনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আরোপ করতো এটা তার জবাব। তারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গণক আখ্যায়িত করে বলতো, জিন ও শয়তানরা তাঁকে এসব কথা শিখিয়ে দেয়। কুরআন মজীদের কয়েকটি স্থানে এর জবাব দেয়া হয়েছে। যেমনঃ সূরা শূ’আরাতে বলা হয়েছেঃ

وَمَا تَنَزَّلَتْ بِهِ الشَّيَاطِينُ - وَمَا يَنْبَغِي لَهُمْ وَمَا يَسْتَطِيعُونَ - إِنَّهُمْ عَنِ السَّمْعِ لَمَعْزُولُونَ

“শয়তান এ বাণী নিয়ে আসেনি। এটা তার জন্য সাজেও না। আর সে এটা করতেও পারে না। এ বাণী শোনার সুযোগ থেকেও তাকে দূরে রাখা হয়েছে।” (আয়াত ২১০ থেকে ২১২)

এ বিষয়টিই এখানে এ ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে যে, “পবিত্র সত্তা ছাড়া কেউ তা স্পর্শ করতে পারে না।” অর্থাৎ শয়তান কর্তৃক এ বাণী নিয়ে আসা কিংবা নাযিল হওয়ার সময় এতে কর্তৃত্ব খাটানো বা হস্তক্ষেপ করা তো দূরের কথা যে সময় ‘লওহে মাহফূজ’ থেকে তা নবীর ﷺ ওপর নাযিল করা হয় সে সময় পবিত্র সত্তাসমূহ অর্থাৎ পবিত্র ফেরেশতারা ছাড়া কেউ তার ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারে না। ফেরেশতাদের জন্য পবিত্র কথাটি ব্যবহার করার তাৎপর্য হলো মহান আল্লাহ তাদেরকে সব রকমের অপবিত্র আবেগ অনুভূতি এবং ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা থেকে পবিত্র রেখেছেন।

আনাস (রা.), ইবনে মালেক, ইবনে আব্বাস (রা.), সাঈদ ইবনে জুবাইর, ইকরিমা, মুজাহিদ, কাতাদা, আবুল আলীয়া, সুদ্দী, দাহহাক এবং ইবনে যায়েদ, এ আয়াতের এ ব্যাখ্যাই বর্ণনা করেছেন। বাক্য বিন্যাসের সাথেও এটি সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ, বাক্যের ধারাবাহিকতা থেকে এ কথাই বুঝা যায় যে, তাওহীদ ও আখেরাত সম্পর্কে মক্কার কাফেরদের ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণার প্রতিবাদ করার পর কুরআন মজীদ সম্পর্কে তাদের ভ্রান্ত ধারণা প্রত্যাখ্যান করে তারকা ও গ্রহরাজির “অবস্থান ক্ষেত্র” সমূহে শপথ করে বলা হচ্ছে, এটি একটি অতি উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন গ্রন্থ, আল্লাহর সুরক্ষিত লিপিতে তা লিপিবদ্ধ আছে কোন সৃষ্টির পক্ষে তাতে হস্তক্ষেপ করার কোন সম্ভাবনা নেই এবং তা এমন পদ্ধতিতে নবীর ওপর নাযিল হয় যে, পবিত্র ফেরেশতাগণ ছাড়া কেউ তা স্পর্শও করতে পারে না।

মুফাসসিরদের মধ্যে কেউ কেউ এ আয়াতের لا শব্দটিকে ‘না’ অর্থে গ্রহণ করেছেন। তাঁরা আয়াতের অর্থ করেছেন “পাক পবিত্র নয় এমন কোন ব্যক্তি যেন তা স্পর্শ না করে” “কিংবা এমন কোন ব্যক্তির তা স্পর্শ করা উচিত-নয়, যে না পাক।” আরো কতিপয় মুফাসসির যদিও لا শব্দটিকে ‘না’ অর্থেই গ্রহণ করেছেন এবং আয়াতের অর্থ করেছেন এই গ্রন্থ পবিত্র সত্তাগণ ছাড়া আর কেউ স্পর্শ করে না। কিন্তু তাদের বক্তব্য হচ্ছে, এখানে ‘না’ শব্দটি ঠিক তেমনি নির্দেশ সূচক যেমন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لاَ يَظْلِمُهُ মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করে না)। এর মধ্যে উল্লেখিত ‘না’ শব্দটি নির্দেশসূচক। এখানে যদিও বর্ণনামূলকভাবে বলা হয়েছে যে, মুসলমান মুসলমানের ওপর জুলুম করে না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, মুসলমান যেন মুসলমানের ওপর জুলুম না করে। অনুরূপ এ আয়াতে যদিও বলা হয়েছে যে, পবিত্র লোক ছাড়া কুরআনকে কেউ স্পর্শ করে না। কিন্তু তা থেকে এ নির্দেশ পাওয়া যায় যে, তা হচ্ছে, পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত কোন ব্যক্তি যেন তা স্পর্শ না করে।

তবে প্রকৃতপক্ষে এ ব্যাখ্যা আয়াতের পূর্বাপর প্রসঙ্গের সাথে খাপ খায় না। পূর্বাপর বিষয়বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন করে এ বাক্যের এরূপ অর্থ করা যেতে পারে। কিন্তু যে বর্ণনাধারার মধ্যে কথাটি বলা হয়েছে সে প্রেক্ষিতে রেখে একে বিচার করলে এ কথা বলার আর কোন সুযোগই থাকে না, “পবিত্র লোকেরা ছাড়া কেউ যেন এ গ্রন্থ স্পর্শ না করে।” কারণ, এখানে সম্বোধন করা হয়েছে কাফেরদেরকে। তাদের বলা হচ্ছে, এটি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কিতাব। এ কিতাব সম্পর্কে তোমাদের এ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত যে, শয়তানরা নবীকে তা শিখিয়ে দেয়। কোন ব্যক্তি পবিত্রতা ছাড়া এ গ্রন্থ স্পর্শ করতে পারবে না শরীয়াতের এই নির্দেশটি এখানে বর্ণনা করার কি যুক্তি ও অবকাশ থাকতে পারে? বড় জোর বলা যেতে পারে তা হচ্ছে, এ নির্দেশ দেয়ার জন্য যদিও আয়াতটি নাযিল হয়নি। কিন্তু বাক্যের ভঙ্গি থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, আল্লাহর দরবারে যেমন কেবল পবিত্র সত্তারাই এ গ্রন্থ স্পর্শ করতে পারে অনুরূপ দুনিয়াতেও অন্তত সেসব ব্যক্তি নাপাক অবস্থায় এ গ্রন্থ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুক। যারা এ গ্রন্থের আল্লাহর বাণী হওয়া সম্পর্কে বিশ্বাস পোষণ করে।

এ মাসায়ালা সম্পর্কে যেসব হাদীস বর্ণিত হয়েছে তা নিম্নরূপঃ

একঃ ইমাম মালেক (র) মুয়াত্তা গ্রন্থে আবদুল্লাহ ইবনে আবী বকর মুহাম্মাদ ইবনে আমর ইবনে হাযম বর্ণিত এ হাদীস উদ্ধৃত করেছেন যে, রসূলুল্লাহ ﷺ ইয়ামানের নেতৃবৃন্দের কাছে আমর ইবনে হাযমের মাধ্যমে যে লিখিত নির্দেশনামা পাঠিয়েছিলেন তার মধ্যে এ নির্দেশটিও ছিল যে, لاَ يَمَسُّ الْقُرْآنَ إِلاَّ طَاهِرٌ (পাক পবিত্র লোক ছাড়া কেউ যেন কুরআন স্পর্শ না করে)। আবু দাউদ তাঁর ‘মীরাসীল’ গ্রন্থে ইমাম যুহরী থেকে একথাটি উদ্ধৃত করেছেন। অর্থাৎ তিনি আবু মুহাম্মাদ ইবনে আমর ইবনে হাযমের কাছে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের লিখিত যে নির্দেশনামা দেখেছিলেন তার মধ্যে এ নির্দেশটিও ছিল।

দুইঃ হযরত আলী থেকে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তাতে তিনি বলেছেনঃ

ان رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَلَمْ يَكُنْ يَحْجِزُهُ عَنْ القران شَيْءٌ , لَيْسَ الْجَنَابَةَ-

“অপবিত্র অবস্থা ছাড়া অন্য কিছুই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কুরআন তিলাওয়াত থেকে বিরত রাখতে পারতো না।” (আবু দাউদ, নাসায়ী, তিরমিযী)।

তিনঃ ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

لاَ تَقْرَأُ الْحَائِضُ وَلاَ الْجُنُبُ مِنَ الْقُرْآنِ

“ঋতুবতী নারী ও নাপাক কোন ব্যক্তি যেন কুরআনের কোন অংশ না পড়ে।” (আবু দাউদ, তিরমিযী)।

চারঃ বুখারীর একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ ﷺ রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে যে পত্র দিয়েছিলেন তাতে পবিত্র কুরআনের এ আয়াতটিও লিখিত ছিলঃ

يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَى كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ.................

সাহাবা কিরাম (রা.) ও তাবেয়ীনদের থেকে এ মাসয়ালাটি সম্পর্কে যেসব মতামত বর্ণিত হয়েছে তা নিম্নরূপঃ

হযরত সালমান ফারসী (রা.) অযু ছাড়া কুরআন শরীফ পড়া দুষণীয় মনে করতেন না। তবে তাঁর মতে এরূপ ক্ষেত্রে হাত দিয়ে কুরআন স্পর্শ করা জায়েয নয়। হযরত সা’দ (রা.) ইবনে আবী ওয়াককাস এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)ও এমত অনুসরণ করতেন। হযরত হাসান বাসরী ও ইবরাহীম নাখয়ীও বিনা ওযুতে কুরআন শরীফ স্পর্শ করা মাকরূহ মনে করতেন। (আহকামুল কুরআন--- জাসসাস)। আতা, তাউস, শা’বী এবং কাসেম ইবনে মুহাম্মাদও এই মত পোষণ করতেন বলে বর্ণিত হয়েছে (আল-মুগনী-ইবনে কুদামাহ)। তবে তাঁদের সবার মতে অযু ছাড়া কুরআন শরীফ স্পর্শ না করে পড়া কিংবা মুখস্ত পড়া জায়েয।

নাপাক, হায়েজ ও নিফাস অবস্থায় কুরআন শরীফ পড়া হযরত উমর (রা.), হযরত আলী (রা.), হযরত হাসান বাসরী, হযরত ইবরাহীম নাখয়ী এবং ইমাম যুহরীর মতে মাকরূহ। তবে ইবনে আব্বাসের (রা.) মত ছিল এই যে, কোন ব্যক্তি কুরআনের যে অংশ স্বভাবতই মুখে মুখে পড়তে অভ্যস্ত তা মুখস্ত পড়তে পারে। তিনি এ মতের ওপর আমলও করতেন। এ মাসয়ালা সম্পর্কে হযরত সা’ঈদ ইবনুল মুসাইয়েব এবং সা’ঈদ ইবনে জুবাইরকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেনঃ তার স্মৃতিতে কি কুরআন সংরক্ষিত নেই? সুতরাং পড়ায় কি দোষ হতে পারে? (আল-মুগনী ও আল-মুহাল্লা-ইবনে হাযম)।

এ মাসয়ালা সম্পর্কে ফকীহদের মতামত নিম্নরূপঃ

ইমাম আলাউদ্দীন আল-কাশানী بدائع الصنائع গ্রন্থে এ বিষয়ে হানাফীদের মতের ব্যাখ্যা করে বলেছেনঃ বিনা অযুতে নামায পড়া জায়েজ নয়, তেমনি কুরআন মজীদ স্পর্শ করাও জায়েজ নয়। তবে কুরআন মজীদ যদি গেলাফের মধ্যে থাকে তাহলে স্পর্শ করা যেতে পারে। কোন কোন ফকীহর মতে চামড়ার আরবণ এবং করো করো মতে যে কোষ, লেফাফা, বা জুযদানের মধ্যে কুরআন শরীফ রাখা হয় এবং তা থেকে আবার বের করা যায় তা-ই গেলাফের পর্যায়ভুক্ত। অনুরূপ বিন অযুতে তাফসীর গ্রন্থসমূহ এবং এমন কোন বস্তু স্পর্শ করা উচিত নয় যার ওপর কুরআনের কোন আয়াত লিখিত আছে। কিন্তু ফিকহার গ্রন্থসমূহ স্পর্শ করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রেও উত্তম হচ্ছে বিনা অযুতে স্পর্শ না করা। কারণ দলীল প্রমাণ হিসেবে তার মধ্যে কুরআনের আয়াত লিখিত আছে শুধু সেই অংশ বিনা অযুতে স্পর্শ করা ঠিক নয়। কিন্তু যে অংশে টীকা লেখা হয় তা ফাঁকা হোক কিংবা ব্যাখ্যা হিসেবে কিছু লেখা থাক, তা স্পর্শ করায় কোন দোষ নেই। তবে সঠিক কথা হলো, টীকা বা ব্যাখ্যাসমূহও কুরআনেরই একটা অংশ এবং তা স্পর্শ করা কুরআন মজীদ স্পর্শ করার শামিল। এরপর কুরআন শরীফ পড়া সম্পর্কে বলা যায় যে, “বিনা অযুতে কুরআন শরীফ পড়া জায়েয।” ফতোয়ায়ে আলমগিরী গ্রন্থে শিশুদেরকে এই নির্দেশের আওতা বহির্ভূত গণ্য করা হয়েছে। অযু থাক বা না থাক শিক্ষার জন্য শিশুদের হাতে কুরআন শরীফ দেয়া যেতে পারে।

ইমাম নববী (র) المنهاج গ্রন্থে শাফেয়ী মাযহাবের মতামত বর্ণনা করেছেন এভাবেঃ নামায ও তাওয়াফের মত বিনা অযুতে কুরআন মজীদ স্পর্শ করা কিংবা তার কোন পাতা স্পর্শ করা হারাম। অনুরূপ কুরআনের জিলদ স্পর্শ করাও নিষেধ। তাছাড়া কুরআন যদি কোন থলি বা ব্যাগের মধ্যে রাখা থাকে কিংবা গেলাফ বা বাক্সের মধ্যে থাকে বা দরসে কুরআনের জন্য তার কোন অংশ কোন ফলকের ওপরে লিখিত থাকে তাও স্পর্শ করা জায়েজ নয়। তবে যদি করো মালপত্রের মধ্যে রাখা থাকে, কিংবা তাফসীর গ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ থাকে অথবা কোন মুদ্রার গায়ে তা ক্ষোদিত হয় তাহলে তা স্পর্শ খরা জায়েয। শিশুর অযু না থাকলেও সে কুরআন স্পর্শ করতে পারে। কেউ যদি অযু ছাড়া কুরআন পাঠ করে তাহলে কাঠ বা অন্য কোন জিনিসের সাহায্যে পাতা উল্টাতে পারে।

‘আল-ফিকহু আলাল মাযাহিবিল আরবা’আ’ গ্রন্থে মালেকী মাযহাবের যে মত উদ্ধৃত করা হয়েছে তা হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ ফকীহদের সাথে তারা এ ব্যাপারে একমত যে, হাত দিয়ে কুরআন মজীদ স্পর্শ করার জন্য অযু শর্ত কিন্তু কুরআন শিক্ষার প্রয়োজনে তারা শিক্ষক ও ছাত্র উভয়কে এ ব্যাপারে ছাড় দিয়েছেন। এমনকি তাদের মতে শিক্ষার জন্য ঋতুবতী নারীর জন্যও কুরআন স্পর্শ করা জায়েয। ইবনে কুদামা আল-মুগনী গ্রন্থে ইমাম মালেকের (র) এ উক্তিটি উদ্ধৃত করেছেন যে, নাপাক অবস্থায় তো কুরআন শরীফ পড়া নিষেধ। কিন্তু ঋতু অবস্থায় নারীর জন্য কুরআন পড়ার অনুমতি আছে। কারণ, আমরা যদি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তাকে কুরআন পড়া থেকে বিরত রাখি তাহলে সে তা ভুলে যাবে।

ইবনে কুদামা হাম্বলী মাযহাবের যেসব বিধি-বিধান উল্লেখ করেছেন তা হচ্ছে, নাপাক এবং হায়েজ ও নিফাস অবস্থায় কুরআন কিংবা কুরআনের পূর্ণ কোন আয়াত পড়া জায়েয নয়। তবে বিসমিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ ইত্যাদি পড়া জায়েয। কারণ এগুলো কুরআনের কোন না কোন আয়াতের অংশ হলেও সেগুলো পড়ার ক্ষেত্রে কুরআন তেলাওয়াতের উদ্দেশ্য থাকে না। তবে কোন অবস্থায়ই বিনা অযুতে হাত দিয়ে কুরআন শরীফ স্পর্শ করা জায়েয নয়। তবে চিঠিপত্র কিংবা ফিকাহর কোন গ্রন্থ বা অন্যকিছু লিখিত বিষয়ের মধ্যে যদি কুরআনের কোন আয়াত লিপিবদ্ধ থাকে তাহলে তা হাত দিয়ে স্পর্শ করা নিষেধ নয়। অনুরূপভাবে যদি কোন জিনিসের মধ্যে সংরক্ষিত থাকে তাহলে অযু ছাড়াই তা হাত দিয়ে ধরে উঠানো যায়। তাফসীর গ্রন্থসমূহ হাত দিয়ে ধরার ক্ষেত্রে অযু শর্ত নয়। তাছাড়া তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে অযুহীন কোন লোককে যদি হাত দিয়ে কুরআন শরীফ স্পর্শ করতে হয় তাহলে সে তায়াম্মুম করে নিতে পারে। ‘আল ফিকহু আলাল মাযাহিবিল আরবা’আ’ গ্রন্থে হাম্বলী মাযহাবের এ মাসয়ালাটিও উল্লেখ আছে যে, শিক্ষার উদ্দেশ্যও শিশুদের বিনা অযুতে কুরআন শরীফ স্পর্শ করা ঠিক নয়। তাদের হাতে কুরআন শরীফ দেয়ার আগে তাদের অভিভাবকদের কর্তব্য তাদের অযু করানো।

এ মাসায়ালা সম্পর্কে জাহেরীদের মতামত হচ্ছে, কেউ বিনা অযুতে থাক বা নাপাক অবস্থায় থাক কিংবা ঋতুবতী স্ত্রীলোক হোক সবার জন্য কুরআন পাঠ করা এবং হাত দিয়ে তা স্পর্শ করা সবর্বাবস্থায় জায়েয। ইবনে হাযম তাঁর আল-মুহাল্লা গ্রন্থে (১ম খণ্ড, ৭৭ থেকে ৮৪ পৃষ্ঠা) এ মাসয়ালা সম্পর্কে সবিস্তার আলোচনা করেছেন। তাতে এ মতটি সঠিক ও বিশুদ্ধ হওয়া সম্পর্কে বহু দলীল প্রমাণ পেশ করেছেন। তিনি বলেছেন, কুরআন পাঠ করা এবং তা স্পর্শ করার ব্যাপারে ফকীহগণ যে শর্তাবলী আরোপ করেছেন তার কোনটিই কুরআন ও সুন্নাহ থেকে প্রমাণিত নয়।

.
৪০.
মুল আয়াতের কথাটি হচ্ছে أَنْتُمْ مُدْهِنُونَ ادهان অর্থ কোন ব্যাপারে খোশামোদ ও তোয়াজ করার নীতি গ্রহণ করা, গুরুত্ব না দেয়া এবং যথাযোগ্য মনোযোগের উপযুক্ত মনে না করা। ইংরেজীতে (to take lightly) কথাটি দ্বারা প্রায় একই অর্থ প্রকাশ পায়।
৪১.
ইমাম রাযী تَجْعَلُونَ رِزْقَكُمْ কথাটির ব্যাখ্যায় এখানে রিযিক শব্দটির অর্থ আয় রোজগার ও উপার্জন হওয়ার সম্ভাবনার কথাও প্রকাশ করেছেন। কুরাইশ গোত্রের কাফেররা যেহেতু কুরআনের দাওয়াতকে তাদের উপার্জন ও আর্থিক স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করতো। তারা মনে করতো এ আন্দোলন যদি সাফল্য মণ্ডিত হয় তাহলে আমাদের আয় উপার্জনের পথ ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই আয়াতটির অর্থ এও হতে পারে যে, তোমরা পেটের ধান্ধার কারণেই কুরআনকে অস্বীকার করে যাচ্ছো। তোমাদের কাছে হক ও বাতিলের কোন গুরুত্বই নেই। তোমাদের দৃষ্টিতে সত্যিকার গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হচ্ছে রুটি। রুটির জন্য তোমরা হকের বিরোধিতা করতে এবং বাতিলের সহযোগিতা গ্রহণ করতে একটুও দ্বিধান্বিত নও।
.
.
.
.
অনুবাদ: