আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১
আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২
আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২
আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩
আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭
আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১
আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০
আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭
আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০
আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২
আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫
হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২
ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২
আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮
বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪
আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫
আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮
আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০
আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫
আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫
আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০
আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭
ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১
আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬
ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭
আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০
আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯
আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২
আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০
আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬
এ আয়াত থেকে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্যের ওপর আলোকপাত হয়। সেটি হচ্ছে, হিদায়াত ও গোমরাহী, নেক কাজ ও বদ কাজ, জুলুম ও ন্যায় বিচার এবং এ ধরনের আরো অনেক কাজ-কর্মের যেসব প্রবণতা ও উদ্দীপনা স্বভাবসুলভ ভাবেই মানুষের মধ্যে বিদ্যমান থাকে, উপায়-উপকরণের উন্নতির কারণে বাহ্যত তার রূপ-প্রকৃতি যত ভিন্নই প্রতীয়মান হোক না কেন, প্রত্যেক যুগে এ পৃথিবীর প্রতিটি কোণে একইভাবে তার বহির্প্রকাশ ঘটে। আজকের মানুষ ট্যাংক, বিমান ও হাইড্রোজেন বোমার সাহায্য যুদ্ধ করলেও এবং প্রাচীন যুগের মানুষ লাঠি ও পাথরের সাহায্যে লড়াই করলেও যে মৌলিক কারণে মানুষে মানুষে লড়াই বাঁধে, তাতে চুল পরিমাণ পার্থক্যও আসেনি। আজ থেকে ৬ হাজার বছর পূর্বে কোন নাস্তিকের নাস্তিকতা গ্রহণের পেছনে যে চালিকা শক্তি কাজ করেছে বর্তমান যুগের কোন নাস্তিক তার নাস্তিকতার সপক্ষে যত যুক্তিই পেশ করুক না কেন, তাকে এ পথে পরিচালিত করার পেছনেও হুবহু সেসব চালিকা শক্তিই কাজ করে। যুক্তি-প্রমাণ পেশের ক্ষেত্রেও সে তার পূর্বাসূরীদের চেয়ে মৌলিকভাবে ভিন্ন কিছু বলে না।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে এ নিয়মটি বর্ণনা করার উদ্দেশ্য এ নয় যে, তিনি দ্বীনের তাবলীগের জন্য অনর্থক মানুষের পেছনে লেগে যেতেন। তাই আল্লাহ তাঁকে এ থেকে বিরত রাখতে চাইতেন। প্রকৃতপক্ষে একথা বলার কারণ হচ্ছে, ন্যায় ও সত্যের দিকে আহ্বানকারী যখন যথাসাধ্য সর্বাধিক যুক্তিসঙ্গত পন্থায় কিছু লোককে বুঝানোর দায়িত্ব পালন করেন এবং তাদের মধ্যে হঠকারিতা ও ঝগড়াটে মনোবৃত্তির লক্ষণ দেখে তাদেরকে এড়িয়ে যান তখন তারা তাঁর পেছনে লেগে যায় এবং তাঁর প্রতি এ বলে দোষারূপ করতে থাকে যে, আরে ভাই আপনি তো দেখছি ন্যায় ও সত্যের আচ্ছা ঝাণ্ডাবাহী। কথা বুঝার জন্য আমরা আপনার সাথে আলোচনা করতে চাই। কিন্তু আপনি আমাদের দিকে ফিরেও দেখেন না। অথচ তাদের উদ্দেশ্য কথা বুঝা নয়, বরং নিজেদের উদ্দেশ্যমূলক বিতর্কের মধ্যে ন্যায় ও সত্যের দাওয়াত পেশকারীকে জড়ানো এবং শুধু তার সময় নষ্ট করাই তাদের লক্ষ্য হয়ে থাকে। তাই আল্লাহ তা’আলা তাঁর পবিত্র কালামের মধ্যে সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন যে, “এ ধরনের মানুষের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করো না, তাদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করায় তোমাকে তিরস্কার করা যেতে পারে না।” এরপর কোন ব্যক্তি একথা বলে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দোষারোপ করতে পারতো না যে, আপনি তো আমাদেরকে আপনার দ্বীন বুঝানোর জন্য আদিষ্ট। তা সত্ত্বেও আপনি আমাদের কথার জবাব দেন না কেন?
এখানে প্রশ্ন দেখা দেয় যে, আল্লাহ তা’আলা শুধু জিন ও মানুষের স্রষ্টা নন। তিনি সমগ্র বিশ্ব-জাহান ও তার প্রতিটি জিনিসের স্রষ্টা। কিন্তু এখানে কেবল জিন ও মানুষ সম্পর্কে কেন বলা হয়েছে যে, আমি তাদেরকে আমার ছাড়া আর কারো দাসত্বের জন্য সৃষ্টি করিনি? অথচ গোটা সৃষ্টির প্রতিটি অণু-পরমাণু শুধু আল্লাহর দাসত্বের জন্য। এর জবাব হচ্ছে পৃথিবীতে জিন ও মানুষই শুধু সৃষ্টি যাদের স্বাধীনতা আছে। তারা তাদের ক্ষমতা ও ইখতিয়ারের গণ্ডির মধ্যে আল্লাহ তা’আলার দাসত্ব করতে চাইলে কিংবা তাঁর দাসত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে চাইলে নেবে এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যদের দাসত্ব করতে চাইলেও করতে পারে। জিন ও মানুষ ছাড়া এ পৃথিবীতে আর যত সৃষ্টি আছে তাদের এ ধরনের কোন স্বাধীনতা নেই। তাদের আদৌ কোন ক্ষমতা ও ইখতিয়ার নেই যে, তারা আল্লাহর দাসত্ব করবে না অন্য কারো দাসত্ব করতে পারবে। তাই এখানে শুধু জিন ও মানুষ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তারা তাদের ক্ষমতা ও ইখতিয়ারের গণ্ডির মধ্যে তাদের নিজ স্রষ্টার আনুগত্য ও দাসত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে এবং স্রষ্টা ছাড়া অন্যদের দাসত্ব করে নিজেরা নিজেদের স্বভাব প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করছে। তাদের জানা উচিত যে, তাদেরকে একমাত্র স্রষ্টা ছাড়া আর কারো দাসত্বের জন্য সৃষ্টি করা হয়নি। তাদের জন্য সোজা পথ হচ্ছে যে স্বাধীনতা তাদেরকে দেয়া হয়েছে তার অন্যায় ব্যবহার যেন না করে। বরং স্বাধীনতার এ সীমার মধ্যে নিজ নিজ ইচ্ছা অনুসারে ঠিক তেমনিভাবে যেন আল্লাহর দাসত্ব করে যেভাবে তার দেহের প্রতিটি লোম তার ক্ষমতা ও ইখতিয়ারবিহীন সীমার মধ্যে তাঁর দাসত্ব করছে।
এ আয়াতে ‘ইবাদত’ শব্দটিকে শুধু নামায রোযা এবং এ ধরনের অন্যান্য ইবাদাত অর্থে ব্যবহার করা হয়নি। তাই কেউ এর এ অর্থ গ্রহণ করতে পারে না যে জিন ও মানুষকে শুধু নামায পড়া, রোযা রাখা এবং তাসবীহ তাহলীল করার জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। এ অর্থটিও এর মধ্যে শামিল আছে বটে, তবে এটা তার পূর্ণাংগ অর্থ নয়। এর পূর্ণাংগ অর্থ হচ্ছে, জিন ও মানুষকে আল্লাহ ছাড়া অন্যের পূজা আনুগত্য আদেশ পালন ও বিনীত প্রার্থনার জন্য সৃষ্টি করা হয়নি। অন্য কারো সামনে নত হওয়া, অন্য কারো নির্দেশ পালন করা, অন্য কাউকে ভয় করা, অন্য কারো রচিত দ্বীন বা আদর্শের অনুসরণ করা, অন্য কাউকে নিজের ভাগ্যের নিয়ন্তা মনে করা এবং অন্য কোন সত্তার কাছে প্রার্থনার জন্য হাত বাড়ানো তাদের কাজ নয়। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা সাবার ব্যাখ্যা টীকা, ৬৩; আয যুমার, টীকা ২; আল জাসিয়া, টীকা ৩০)।
এ আয়াত থেকে আরো একটি আনুষাঙ্গিক বিষয় সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। তা হচ্ছে জিনেরা মানুষ থেকে স্বতন্ত্র একটি সৃষ্টি। যারা দাবী করে মানবজাতিরই কিছু সংখ্যক লোককে কুরআনে জিন বলা হয়েছে, এর দ্বারা তাদের ধারণার ভ্রান্তি অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে যায়। কুরআন মজীদের নিম্ন বর্ণিত আয়াতসমূহও এ সত্যেরই অনস্বীকার্য প্রমাণ পেশ করে। (আল আন’আম, ১০০, ১২৮; আল আ’রাফ, ৩৮, ১৭৯; হূদ, ১১৯; আল হিজর, ২৭ থেকে ৩৩; বনী ইসরাঈল, ৮৮; আল কাহফ, ৫০; আস সিজদা, ১৩; সাবা, ৪১; সাদ, ৭৫ ও ৭৬; হা-মীম আস সাজদা, ২৫; আল আহক্বাফ, ১৮; আর রহমান, ১৫, ৩৯, ৫৬; (এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল আম্বিয়া, টীকা ২১; আন নামল, টীকা ২৩, ৪৫; সূরা সাবার ব্যাখ্য টীকা ২৪)।
“আমি তাদের কাছে রিযিক চাই না, কিংবা তারা আমাকে খাবার দান করুক তাও চাই না” একথাটির মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত আছে। আল্লাহ বিমুখ লোকেরা পৃথিবীতে যাদের বন্দেগী করছে তারা সবাই প্রকৃতপক্ষে এসব বান্দার মুখাপেক্ষী। এরা যদি তার প্রভুত্ব না চালায় তাহলে তা একদিনও চলবে না। সে এদের রিযিক দাতা নয় এরাই বরং তাকে রিযিক পৌঁছিয়ে থাকে। সে এদের খাওয়ায় না, এরাই তাকে খাইয়ে থাকে। সে এদের প্রাণের রক্ষক নয়, বরং এরাই তাদের প্রাণ রক্ষা করে থাকে। এরাই তাদের সৈন্য সামন্ত। এদের ওপর নির্ভর করেই তাদের প্রভুত্ব চলে। যেখানেই কেউ এ মিথ্যা প্রভুদের সহযোগী বান্দা হয়নি কিংবা বান্দারা তাদেরকে সহযোগিতা করা থেকে বিরত থেকেছে সেখানেই তাদের সব জৌলুস হারিয়ে গিয়েছে এবং দুনিয়ার মানুষ তাদের পতন দেখতে পেয়েছে। সমস্ত উপাস্যের মধ্যে একমাত্র মহান ও মহাপরাক্রমশালী আল্লাহই এমন উপাস্য, নিজের ক্ষমতায়ই যাঁর প্রভুত্ব চলছে। যিনি তাঁর বান্দাদের নিকট থেকে কিছু নেন না, বরং তিনিই তাদের সবকিছু দেন।