পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

৩৯৯ আয়াত

৫১ ) আল্লাহর সাথে আর কাউকে উপাস্য বানাবে না। আমি তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য স্পষ্ট সাবধানকারী। ৪৮
وَلَا تَجْعَلُوا۟ مَعَ ٱللَّهِ إِلَـٰهًا ءَاخَرَ ۖ إِنِّى لَكُم مِّنْهُ نَذِيرٌۭ مُّبِينٌۭ ٥١
৫২ ) এভাবেই হয়ে এসেছে। এদের পূর্ববর্তী জাতিসমূহের কাছেও এমন কোন রসূল আসেনি যাকে তারা যাদুকর বা পাগল বলেনি। ৪৯
كَذَٰلِكَ مَآ أَتَى ٱلَّذِينَ مِن قَبْلِهِم مِّن رَّسُولٍ إِلَّا قَالُوا۟ سَاحِرٌ أَوْ مَجْنُونٌ ٥٢
৫৩ ) এরা কি এ ব্যাপারে পরস্পর কোন সমঝোতা করে নিয়েছে? না, এরা সবাই বরং বিদ্রোহী। ৫০
أَتَوَاصَوْا۟ بِهِۦ ۚ بَلْ هُمْ قَوْمٌۭ طَاغُونَ ٥٣
৫৪ ) অতএব, হে নবী, তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও। এজন্য তোমার প্রতি কোন তিরস্কার বাণী নেই। ৫১
فَتَوَلَّ عَنْهُمْ فَمَآ أَنتَ بِمَلُومٍۢ ٥٤
৫৫ ) তবে উপদেশ দিতে থাকো। কেননা, উপদেশ ঈমান গ্রহণকারীদের জন্য উপকারী। ৫২
وَذَكِّرْ فَإِنَّ ٱلذِّكْرَىٰ تَنفَعُ ٱلْمُؤْمِنِينَ ٥٥
৫৬ ) জিন ও মানুষকে আমি শুধু এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার দাসত্ব ৫৩ করবে।
وَمَا خَلَقْتُ ٱلْجِنَّ وَٱلْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ ٥٦
৫৭ ) আমি তাদের কাছে কোন রিযিক চাই না কিংবা তারা আমাকে খাওয়াবে ৫৪ তাও চাই না।
مَآ أُرِيدُ مِنْهُم مِّن رِّزْقٍۢ وَمَآ أُرِيدُ أَن يُطْعِمُونِ ٥٧
৫৮ ) আল্লাহ নিজেই রিযিকদাতা এবং অত্যন্ত শক্তিধর ও পরাক্রমশালী। ৫৫
إِنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلرَّزَّاقُ ذُو ٱلْقُوَّةِ ٱلْمَتِينُ ٥٨
৫৯ ) তাই যারা জুলুম করেছে ৫৬ তাদের প্রাপ্য হিসেবে ঠিক তেমনি আযাব প্রস্তুত আছে যেমনটি এদের মত লোকেরা তাদের অংশ পুরো লাভ করেছে। সেজন্য এসব লোক যেন আমার কাছে তাড়াহুড়ো না করে। ৫৭
فَإِنَّ لِلَّذِينَ ظَلَمُوا۟ ذَنُوبًۭا مِّثْلَ ذَنُوبِ أَصْحَـٰبِهِمْ فَلَا يَسْتَعْجِلُونِ ٥٩
৬০ ) যেদিনের ভয় তাদের দেখানো হচ্ছে পরিণামে সেদিন তাদের জন্য ধ্বংস রয়েছে।
فَوَيْلٌۭ لِّلَّذِينَ كَفَرُوا۟ مِن يَوْمِهِمُ ٱلَّذِى يُوعَدُونَ ٦٠
৪৮.
এ বাক্যাংশ যদিও আল্লাহ তা’আলারই বাণী, কিন্তু এর বক্তা আল্লাহ তা’আলা নন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। ব্যাপারটা যেন এই যে, আল্লাহ তাঁর নবীকে মুখ দিয়ে বলাচ্ছেন যে, আল্লাহর দিকে দ্রুত অগ্রসর হও। আমি তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদের সাবধান করে দিচ্ছি। এ ধরনের কথার উদাহরণ কুরআন মজীদের সর্বপ্রথম সূরা অর্থাৎ সূরা ফাতিহায় বিদ্যমান যেখানে বক্তব্য আল্লাহর কিন্তু বক্তা হিসেবে বান্দা কথাগুলো পেশ করে। إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ – اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ সেখানে যেমন একথা বলা হয়নি যে, হে ঈমানদারগণ, তোমরা তোমাদের রবের কাছে এভাবে দোয়া করো। কিন্তু কথার ধরণ থেকে আপনা আপনি একথার ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, এটা একটা দোয়া যা আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন। ঠিক তেমনি এখানেও বলা হয়নি যে, “হে নবী, তুমি এসব লোককে বলো।” কিন্তু কথার ধরণ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে এতে আল্লাহ তা’আলার নির্দেশনা অনুসারে নবী ﷺ তাওহীদ গ্রহণের জন্য একটা আহবান পেশ করেছেন। সূরা ফাতিহা ছাড়াও কুরআন মজীদের আরো কতিপয় স্থানে এ ধরনের বাণী বিদ্যমান যেখানে বক্তব্য আল্লাহর কিন্তু বক্তা কোথাও ফেরেশতা এবং কোথাও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। ঐসব ক্ষেত্রে বক্তা কে তা সুস্পষ্টভাবে পেশ করা না হলেও কথার ধরণ থেকেই স্বতই প্রকাশ পায় যে, কার মুখ দিয়ে আল্লাহ তার বক্তব্য পেশ করছেন। উদাহরণ হিসেবে দেখুন, সূরা মারয়াম, ৬৪, ৬৫; আস সাফফাত, ১৫৯ থেকে ১৬৭ ও সূরা আশ শূরা, ১০।
৪৯.
অর্থাৎ এ ঘটনা এই প্রথম সংঘটিত হয়নি যে, আল্লাহর প্রেরিত রসূলের মুখে আখেরাতের খবর এবং তাওহীদের দাওয়াত শুনে মানুষ তাঁকে যাদুকর ও পাগল বলছে। রিসালাতের গোটা ইতিহাস সাক্ষী, মানবজাতির হিদায়াতের জন্য যখন থেকে রসূলের আগমন ধারা শুরু হয়েছে জাহেলরা তখন থেকে আজ পর্যন্ত একইভাবে এ নির্বুদ্ধিতার কাজটি বারবার করে যাচ্ছে। যে রসূলই এসে এ মর্মে সাবধান করেছেন যে, তোমরা বহু সংখ্যক খোদার বান্দা নও, বরং একমাত্র আল্লাহই তোমাদের স্রষ্টা, উপাস্য এবং তোমাদের ভাগ্যের মালিক ও নিয়ন্তা, জাহেলরা তখনই এ মর্মে হৈ চৈ শুরু করে দিয়েছে যে, এ ব্যক্তি যাদুকর। সে তাঁর যাদুর সাহায্যে আমাদের বিবেক-বুদ্ধি বিকৃত করতে চায়। যে রসূলই এসে সাবধান করেছেন যে, তোমাদেরকে পৃথিবীতে দায়িত্ব মুক্ত করে ছেড়ে দেয়া হয়নি বরং জীবনের কাজ-কর্ম শেষ করার পর তোমাদেরকে তোমাদের সৃষ্টিকর্তা ও মালিকের সামনে হাজির হয়ে হিসেব দিতে হবে এবং সে হিসেবের পরিণামে নিজের কাজ-কর্মের প্রতিদান বা শাস্তি পেতে হবে, তাতে নির্বোধ লোকেরা বলে উঠেছে---এ লোকটি পাগল, এর বিবেক বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। আরে মৃত্যুর পরে কি আমরা পুনরায় জীবিত হবো?
৫০.
অর্থাৎ একথা সুস্পষ্ট যে, হাজার হাজার বছর ধরে প্রতিটি যুগে বিভিন্ন দেশ ও জাতির লোকদের নবী-রসূলের দাওয়াতের মোকাবিলায় একই আচরণ করা এবং তাঁদের বিরুদ্ধে একই রকমের কথা বলার কারণ এ নয় যে, একটি সম্মেলন করে আগের ও পরের সমস্ত মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যখনই কোন নবী এসে এ দাওয়াত পেশ করবে তখনই তাঁকে এ জবাব দিতে হবে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে, তাহলে তাদের আচরণের এ সাদৃশ্য এবং একই প্রকৃতির জবাবের ক্রমাগত পুনরাবৃত্তি কেন? এর একমাত্র জবাব এই যে, অবাধ্যতা ও সীমালঙ্ঘন এদের সবার সাধারণ বৈশিষ্ট্য। তাছাড়া এ আচরণের আর কোন কারণ নেই। প্রত্যেক অজ্ঞ লোকেরাই যেহেতু আল্লাহর দাসত্ব থেকে মুক্ত ও তাঁর জিজ্ঞাসাবাদ সম্পর্কে বেপরোয়া হয়ে পৃথিবীতে লাগামহীন পশুর মত জীবন যাপন করতে আগ্রহী, তাই শুধু এ কারণে যিনিই তাদেরকে আল্লাহর দাসত্ব ও আল্লাহ ভীতিমূলক জীবন যাপনের আহবান জানিয়েছেন তাঁকেই তারা একই ধরাবাঁধা জবাব দিয়ে এসেছে।

এ আয়াত থেকে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্যের ওপর আলোকপাত হয়। সেটি হচ্ছে, হিদায়াত ও গোমরাহী, নেক কাজ ও বদ কাজ, জুলুম ও ন্যায় বিচার এবং এ ধরনের আরো অনেক কাজ-কর্মের যেসব প্রবণতা ও উদ্দীপনা স্বভাবসুলভ ভাবেই মানুষের মধ্যে বিদ্যমান থাকে, উপায়-উপকরণের উন্নতির কারণে বাহ্যত তার রূপ-প্রকৃতি যত ভিন্নই প্রতীয়মান হোক না কেন, প্রত্যেক যুগে এ পৃথিবীর প্রতিটি কোণে একইভাবে তার বহির্প্রকাশ ঘটে। আজকের মানুষ ট্যাংক, বিমান ও হাইড্রোজেন বোমার সাহায্য যুদ্ধ করলেও এবং প্রাচীন যুগের মানুষ লাঠি ও পাথরের সাহায্যে লড়াই করলেও যে মৌলিক কারণে মানুষে মানুষে লড়াই বাঁধে, তাতে চুল পরিমাণ পার্থক্যও আসেনি। আজ থেকে ৬ হাজার বছর পূর্বে কোন নাস্তিকের নাস্তিকতা গ্রহণের পেছনে যে চালিকা শক্তি কাজ করেছে বর্তমান যুগের কোন নাস্তিক তার নাস্তিকতার সপক্ষে যত যুক্তিই পেশ করুক না কেন, তাকে এ পথে পরিচালিত করার পেছনেও হুবহু সেসব চালিকা শক্তিই কাজ করে। যুক্তি-প্রমাণ পেশের ক্ষেত্রেও সে তার পূর্বাসূরীদের চেয়ে মৌলিকভাবে ভিন্ন কিছু বলে না।

৫১.
এ আয়াতে দ্বীনের তাবলীগের একটি নিয়ম বর্ণনা করা হয়েছে। বিষয়টি ভালভাবে বুঝে নিতে হবে। হকের দাওয়াত পেশকারী যখন যুক্তিসঙ্গত প্রমাণাদিসহ কারো সামনে সুস্পষ্টভাবে দাওয়াত পেশ করে এবং তার সন্দেহ-সংশয় আপত্তি ও যুক্তি-প্রমাণের জবাবও পেশ করে তখন সত্য প্রকাশ করার যে দায়িত্ব ও কর্তব্য তার ওপরে থাকে তা থেকে সে অব্যহতি লাভ করে। এরপরও যদি সেই ব্যক্তি তার আকীদা-বিশ্বাস ও ধ্যাণ-ধারণার প্রতি অটল থাকে, তার দায়-দায়িত্ব হকের দাওয়াত পেশকারীর ওপর বর্তায় না। এরপরও ঐ ব্যক্তির পেছনে লেগে থাকা, তার সাথে আলাপ-আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক করে নিজের সময় ব্যয় করা এবং কোন না কোনভাবে ঐ একজন মাত্র ব্যক্তিকে নিজের সমমনা বানানোকে নিজের একমাত্র কাজ মনে করা তার জন্য জরুরী নয়। এক্ষেত্রে দাওয়াত পেশকারী তার কর্তব্য পালন করেছে। সে মানতে না চাইলে না মানবে। তার প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করার কারণে দাওয়াত পেশকারীকে এ অপবাদ দেয়া যাবে না যে, সে একজন মানুষকে গোমরাহীর মধ্যে ডুবে থাকতে দিয়েছে। কেননা, এখন সে নিজেই তার গোমরাহীর জন্য দায়ী।

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে এ নিয়মটি বর্ণনা করার উদ্দেশ্য এ নয় যে, তিনি দ্বীনের তাবলীগের জন্য অনর্থক মানুষের পেছনে লেগে যেতেন। তাই আল্লাহ তাঁকে এ থেকে বিরত রাখতে চাইতেন। প্রকৃতপক্ষে একথা বলার কারণ হচ্ছে, ন্যায় ও সত্যের দিকে আহ্বানকারী যখন যথাসাধ্য সর্বাধিক যুক্তিসঙ্গত পন্থায় কিছু লোককে বুঝানোর দায়িত্ব পালন করেন এবং তাদের মধ্যে হঠকারিতা ও ঝগড়াটে মনোবৃত্তির লক্ষণ দেখে তাদেরকে এড়িয়ে যান তখন তারা তাঁর পেছনে লেগে যায় এবং তাঁর প্রতি এ বলে দোষারূপ করতে থাকে যে, আরে ভাই আপনি তো দেখছি ন্যায় ও সত্যের আচ্ছা ঝাণ্ডাবাহী। কথা বুঝার জন্য আমরা আপনার সাথে আলোচনা করতে চাই। কিন্তু আপনি আমাদের দিকে ফিরেও দেখেন না। অথচ তাদের উদ্দেশ্য কথা বুঝা নয়, বরং নিজেদের উদ্দেশ্যমূলক বিতর্কের মধ্যে ন্যায় ও সত্যের দাওয়াত পেশকারীকে জড়ানো এবং শুধু তার সময় নষ্ট করাই তাদের লক্ষ্য হয়ে থাকে। তাই আল্লাহ তা’আলা তাঁর পবিত্র কালামের মধ্যে সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন যে, “এ ধরনের মানুষের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করো না, তাদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করায় তোমাকে তিরস্কার করা যেতে পারে না।” এরপর কোন ব্যক্তি একথা বলে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দোষারোপ করতে পারতো না যে, আপনি তো আমাদেরকে আপনার দ্বীন বুঝানোর জন্য আদিষ্ট। তা সত্ত্বেও আপনি আমাদের কথার জবাব দেন না কেন?

৫২.
এ আয়াতে দ্বীন প্রচারের আরেকটি নিয়ম বর্ণনা করা হয়েছে। ন্যায় ও সত্যের দাওয়াতের প্রকৃত উদ্দেশ্য সেসব পুণ্যাত্মাদের কাছে ঈমানের নিয়ামত পৌঁছিয়ে দেয়া, যারা নিয়ামতের মূল্য বুঝে এবং নিজেরা তা অর্জন করতে চায়। কিন্তু দাওয়াত পেশকারী জানে না মানব সামজের লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে সেসব পুণ্যাত্মা কোথায় আছে। তাই তার কাজ হচ্ছে, ব্যাপকভাবে তার দাওয়াতের কাজ ক্রমাগত চালিয়ে যাওয়া। যাতে যেখানে যেখানে ঈমান গ্রহণ করার মত লোক আছে সেখানেই যেন তার কথা পৌঁছে যায়। এ লোকেরাই তার প্রকৃত সম্পদ। তাদের খুঁজে বের করাই তার মূল কাজ। এদের বাছাই করে এনে আল্লাহর রাস্তায় দাঁড় করানো তার লক্ষ হওয়া উচিত। মাঝ পথে আদম সন্তানদের যেসব বাজে উপাদানের সাথে তার সাক্ষাত হবে তাদের প্রতি ততক্ষন পর্যন্ত তার মনোযোগ দেয়া উচিত যতক্ষণ সে অভিজ্ঞতা দ্বারা না জানবে যে, এগুলো বাজে জিনিস। তাদের বাজে ও ফাসাদ সৃষ্টিকারী হওয়া সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর এ প্রকৃতির লোকদের পেছনে তাঁর মূল্যবান সময় নষ্ট না করা উচিত। কারণ, এরা তার উপদেশে উপকৃত হওয়ার মত মানুষ নয়। এদের পেছনে শক্তি ব্যয় করার বরঞ্চ সেসব লোকের ক্ষতি হয় যারা এ উপদেশ দ্বারা উপকৃত হয়।
৫৩.
অর্থাৎ আমি তাদেরকে অন্য কারো দাসত্বের জন্য নয় আমার নিজের দাসত্বের জন্য সৃষ্টি করেছি। তারা আমার দাসত্ব করবে এজন্য যে, আমি তাদের স্রষ্টা। যখন অন্য কেউ এদের সৃষ্টি করেনি তখন তার দাসত্ব করার কি অধিকার এদের আছে? তাছাড়া তাদের জন্য এটা কি করে বৈধ হতে পারে যে, এদের স্রষ্টা আমি অথচ এরা দাসত্ব করবে অন্যদের!

এখানে প্রশ্ন দেখা দেয় যে, আল্লাহ তা’আলা শুধু জিন ও মানুষের স্রষ্টা নন। তিনি সমগ্র বিশ্ব-জাহান ও তার প্রতিটি জিনিসের স্রষ্টা। কিন্তু এখানে কেবল জিন ও মানুষ সম্পর্কে কেন বলা হয়েছে যে, আমি তাদেরকে আমার ছাড়া আর কারো দাসত্বের জন্য সৃষ্টি করিনি? অথচ গোটা সৃষ্টির প্রতিটি অণু-পরমাণু শুধু আল্লাহর দাসত্বের জন্য। এর জবাব হচ্ছে পৃথিবীতে জিন ও মানুষই শুধু সৃষ্টি যাদের স্বাধীনতা আছে। তারা তাদের ক্ষমতা ও ইখতিয়ারের গণ্ডির মধ্যে আল্লাহ তা’আলার দাসত্ব করতে চাইলে কিংবা তাঁর দাসত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে চাইলে নেবে এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যদের দাসত্ব করতে চাইলেও করতে পারে। জিন ও মানুষ ছাড়া এ পৃথিবীতে আর যত সৃষ্টি আছে তাদের এ ধরনের কোন স্বাধীনতা নেই। তাদের আদৌ কোন ক্ষমতা ও ইখতিয়ার নেই যে, তারা আল্লাহর দাসত্ব করবে না অন্য কারো দাসত্ব করতে পারবে। তাই এখানে শুধু জিন ও মানুষ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তারা তাদের ক্ষমতা ও ইখতিয়ারের গণ্ডির মধ্যে তাদের নিজ স্রষ্টার আনুগত্য ও দাসত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে এবং স্রষ্টা ছাড়া অন্যদের দাসত্ব করে নিজেরা নিজেদের স্বভাব প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করছে। তাদের জানা উচিত যে, তাদেরকে একমাত্র স্রষ্টা ছাড়া আর কারো দাসত্বের জন্য সৃষ্টি করা হয়নি। তাদের জন্য সোজা পথ হচ্ছে যে স্বাধীনতা তাদেরকে দেয়া হয়েছে তার অন্যায় ব্যবহার যেন না করে। বরং স্বাধীনতার এ সীমার মধ্যে নিজ নিজ ইচ্ছা অনুসারে ঠিক তেমনিভাবে যেন আল্লাহর দাসত্ব করে যেভাবে তার দেহের প্রতিটি লোম তার ক্ষমতা ও ইখতিয়ারবিহীন সীমার মধ্যে তাঁর দাসত্ব করছে।

এ আয়াতে ‘ইবাদত’ শব্দটিকে শুধু নামায রোযা এবং এ ধরনের অন্যান্য ইবাদাত অর্থে ব্যবহার করা হয়নি। তাই কেউ এর এ অর্থ গ্রহণ করতে পারে না যে জিন ও মানুষকে শুধু নামায পড়া, রোযা রাখা এবং তাসবীহ তাহলীল করার জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। এ অর্থটিও এর মধ্যে শামিল আছে বটে, তবে এটা তার পূর্ণাংগ অর্থ নয়। এর পূর্ণাংগ অর্থ হচ্ছে, জিন ও মানুষকে আল্লাহ ছাড়া অন্যের পূজা আনুগত্য আদেশ পালন ও বিনীত প্রার্থনার জন্য সৃষ্টি করা হয়নি। অন্য কারো সামনে নত হওয়া, অন্য কারো নির্দেশ পালন করা, অন্য কাউকে ভয় করা, অন্য কারো রচিত দ্বীন বা আদর্শের অনুসরণ করা, অন্য কাউকে নিজের ভাগ্যের নিয়ন্তা মনে করা এবং অন্য কোন সত্তার কাছে প্রার্থনার জন্য হাত বাড়ানো তাদের কাজ নয়। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা সাবার ব্যাখ্যা টীকা, ৬৩; আয যুমার, টীকা ২; আল জাসিয়া, টীকা ৩০)।

এ আয়াত থেকে আরো একটি আনুষাঙ্গিক বিষয় সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। তা হচ্ছে জিনেরা মানুষ থেকে স্বতন্ত্র একটি সৃষ্টি। যারা দাবী করে মানবজাতিরই কিছু সংখ্যক লোককে কুরআনে জিন বলা হয়েছে, এর দ্বারা তাদের ধারণার ভ্রান্তি অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে যায়। কুরআন মজীদের নিম্ন বর্ণিত আয়াতসমূহও এ সত্যেরই অনস্বীকার্য প্রমাণ পেশ করে। (আল আন’আম, ১০০, ১২৮; আল আ’রাফ, ৩৮, ১৭৯; হূদ, ১১৯; আল হিজর, ২৭ থেকে ৩৩; বনী ইসরাঈল, ৮৮; আল কাহফ, ৫০; আস সিজদা, ১৩; সাবা, ৪১; সাদ, ৭৫ ও ৭৬; হা-মীম আস সাজদা, ২৫; আল আহক্বাফ, ১৮; আর রহমান, ১৫, ৩৯, ৫৬; (এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল আম্বিয়া, টীকা ২১; আন নামল, টীকা ২৩, ৪৫; সূরা সাবার ব্যাখ্য টীকা ২৪)।

.
৫৪.
অর্থাৎ জ্বীন ও মানুষের কাছে আমার কোন উদ্দেশ্য বাঁধা পড়ে নেই যে, এরা আমার দাসত্ব করলে আমার প্রভুত্ব চলবে আর এরা আমার দাসত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে আমি আর আল্লাহ‌ থাকতে পারবো না। আমি তাদের বন্দেগী বা দাসত্বের মুখাপেক্ষী নই। বরং আমার বন্দেগী করা তাদের প্রকৃতির দাবী। এ উদ্দেশ্যেই তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। নিজ প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করা তাদের নিজেদেরই ক্ষতি।

“আমি তাদের কাছে রিযিক চাই না, কিংবা তারা আমাকে খাবার দান করুক তাও চাই না” একথাটির মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত আছে। আল্লাহ‌ বিমুখ লোকেরা পৃথিবীতে যাদের বন্দেগী করছে তারা সবাই প্রকৃতপক্ষে এসব বান্দার মুখাপেক্ষী। এরা যদি তার প্রভুত্ব না চালায় তাহলে তা একদিনও চলবে না। সে এদের রিযিক দাতা নয় এরাই বরং তাকে রিযিক পৌঁছিয়ে থাকে। সে এদের খাওয়ায় না, এরাই তাকে খাইয়ে থাকে। সে এদের প্রাণের রক্ষক নয়, বরং এরাই তাদের প্রাণ রক্ষা করে থাকে। এরাই তাদের সৈন্য সামন্ত। এদের ওপর নির্ভর করেই তাদের প্রভুত্ব চলে। যেখানেই কেউ এ মিথ্যা প্রভুদের সহযোগী বান্দা হয়নি কিংবা বান্দারা তাদেরকে সহযোগিতা করা থেকে বিরত থেকেছে সেখানেই তাদের সব জৌলুস হারিয়ে গিয়েছে এবং দুনিয়ার মানুষ তাদের পতন দেখতে পেয়েছে। সমস্ত উপাস্যের মধ্যে একমাত্র মহান ও মহাপরাক্রমশালী আল্লাহই এমন উপাস্য, নিজের ক্ষমতায়ই যাঁর প্রভুত্ব চলছে। যিনি তাঁর বান্দাদের নিকট থেকে কিছু নেন না, বরং তিনিই তাদের সবকিছু দেন।

.
৫৫.
মূল আয়াতে مَتِينُ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যার অর্থ দৃঢ় ও অটল যা কেউ নড়াতে পারে না।
৫৬.
এখানে জুলুম অর্থ বাস্তব ও সত্যের প্রতি জুলুম করা এবং নিজে নিজের প্রকৃতির প্রতি জুলুম করা। পূর্বাপর প্রসঙ্গ থেকে একথা প্রকাশ পাচ্ছে যে, এখানে জুলুম-নির্যাতনকারী বলতে সেসব মানুষকে বুঝানো হয়েছে যারা বিশ্ব-জাহানের রবকে বাদ দিয়ে অন্যদের দাসত্ব করছে, যারা আখেরাত অস্বীকার করছে, পৃথিবীতে নিজেদেরকে দায়িত্ব মুক্ত মনে করছে এবং সেসব নবী-রসূলদের অস্বীকার করছে যারা তাদেরকে প্রকৃত সত্য সম্পর্কে সতর্ক করার চেষ্টা করেছেন।
৫৭.
কাফেররা দাবী করে বলতো যে, সে প্রতিফল দিবস আসার পথে কোথায় আটকে গেল, তা এসে পড়ছে না কেন? এটা কাফেরদের সে দাবিরই জবাব।
.
অনুবাদ: