আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১
আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২
আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২
আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩
আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭
আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১
আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০
আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭
আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০
আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২
আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫
হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২
ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২
আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮
বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪
আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫
আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮
আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০
আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫
আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫
আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০
আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭
ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১
আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬
ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭
আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০
আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯
আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২
আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০
আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬
উল্লেখ্য, আরবে সত্য দ্বীনের আলো সর্বপ্রথম পৌঁছেছিল হযরত হূদ ও হযরত সালেহ আলাইহিস সালামের মাধ্যমে। এটা ছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগের ঘটনা। তারপর আসেন হযরত ইবরাহীম ও হযরত ইসমাঈল (আ)। নবী (সা.) এর যুগের আড়াই হাজার বছর আগে অতিক্রান্ত হয়েছিল তাদের যুগ। এরপর নবী (সা.) এর পূর্বে আরবের যমীনে যে সর্বশেষ নবী পাঠানো হয় তিনি ছিলেন হযরত শো’আইব (আ)। তার আগমনের পরও প্রায় দু’হাজার বছর অতিক্রান্ত হয়েছিল। এ সময়টা এত দীর্ঘ ছিল যে, এ প্রেক্ষিতে এ জাতির মধ্যে কোন সতর্ককারী আসেনি একথা বলা একেবারেই যথার্থ ছিল। এ উক্তির অর্থ এ নয় যে, এ জাতি একজন সতর্ককারীর প্রত্যাশী ছিল।
এখানে আর একটা প্রশ্ন সামনে এসে যায়। সেটাও পরিষ্কার করে দেয়া দরকার। এ আয়াতটি পড়তে গিয়ে মানুষের মনে সংশয় জাগে, নবী (সা.) এর পূর্বে শত শত বছর পর্যন্ত আরবে যখন কোন নবী আসেননি তখন সে জাহেলী যুগে যেসব লোক অতিক্রান্ত হয়ে গেছে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে কিসের ভিত্তিতে? সৎ পথ কোনটা এবং অসৎ পথ তথা পথভ্রষ্টতা কোনটা তা কি তারা জানতো? তারপর যদি তারা পথভ্রষ্ট হয়ে থাকে তাহলে তাদের এ পথভ্রষ্টতার জন্য তাদেরকে দায়ী করা যেতে পারে কেমন করে? এর জবাব হচ্ছে, সেকালের লোকদের দ্বীনের বিস্তারিত জ্ঞান না থাকলেও আসল দ্বীন যে তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদ এবং নবীগণ কখনো মূর্তিপূজা শিখান নি, একথা সেকালেও লোকদের অজানা ছিল না। আরবের লোকেরা তাদের দেশে আবির্ভূত নবীদের যেসব বাণী ও ঐত্যিহের অধিকারী হয়েছিল তার মধ্যেও এ সত্য সংরক্ষিত ছিল। নিকটতম দেশগুলোয় আগত নবীগণ যথা হযরত মূসা, হযরত দাউদ, হযরত সুলাইমান ও হযরত ঈসা (আ) এর শিক্ষার মাধ্যমেও তারা এ সত্যের সন্ধান পেয়েছিল। আরবী প্রবাদসমূহের মাধ্যমে একথা ব্যাপকভাবে প্রচারিত ও সর্বজন পরিচিত ছিল যে, প্রাচীনযুগে আরববাসীদের আসল ধর্ম ছিল ইবরাহীমের ধর্ম এবং মূর্তিপূজার ব্যাপক প্রচলন সত্ত্বেও আরবের বিভিন্ন অংশে স্থানে স্থানে এমন সব লোক ছিল যারা শিরক অস্বীকার করতো, তাওহীদের ঘোষণা দিতো এবং মূর্তির বেদীমূলে বলিদান করার প্রকাশ্যে নিন্দা করতো। নবী (সা.) এর আমলের একেবারেই কাছাকাছি সময়ে কুসসা ইবনে সায়েদাতিল ইয়াদী, উমাইয়াহ ইবনে আবিস সালত, সুওয়াইদ ইবনে আমরিল মুসতালেকী ওকী ইবনে সালামাহ ইবনে যুহাইরিল ইয়াদী, আমর ইবনে জুনদুবিল জুহানী, আবু কায়েস সারমাহ ইবনে আবী আনাস, যায়েদ ইবনে শিহাবিত তামিমী, আলমুতালামমিস ইবনে উমাইয়াহ আলকিনানী, যুহাইর ইবনে আবী সুলমা, খালেদ ইবনে সিনান ইবনে গাইসিল আবসী, আবদুল্লাহ আলকুদ্বাঈ এবং এ ধরনের আরো বহু লোকের অবস্থা আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি। ইতিহাসে এদেরকে ‘হুনাফা’ তথা সঠিক সত্যপন্থী নামে স্মরণ করা হয়। এরা সবাই প্রকাশ্যে তাওহীদকে আসল দ্বীন বলে ঘোষণা করতেন এবং মুশরিকদের ধর্মের সাথে নিজেদের সম্পর্কহীনতার কথা পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করতেন। একথা সুস্পষ্ট, পূর্ববর্তী নবীগণের যেসব শিক্ষা সমাজে তখনো প্রচলিত ছিল তার প্রভাব থেকেই তাদের মনে এ চিন্তার জন্ম হয়েছিল। তাছাড়া ইয়ামনে খৃষ্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকের প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের যে শিলালিপির আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে আবিষ্কৃত হয়েছে তা থেকে জানা যায়, সেকালে সেখানে একটি তাওহীদী ধর্মের অস্তিত্ব ছিল। তার অনুসারীদের আকাশ ও পৃথিবীর করুণাময় রবকেই একক ইলাহ ও উপাস্যে স্বীকার করতো। ৩৭৮ খৃষ্টাব্দের একটি শিলালিপি পাওয়া গেছে একটি প্রাচীন উপাসনালয়ের ধ্বংসাবশেষে থেকে। তাতে লিখিত আছে, এ উপাসনালয়টি “যু-সামাওয়া”র“ইলাহ” অর্থাৎ আকাশের ইলাহি অথবা আকাশের রবের ইবাদাত করার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে। ৪৬৫ খৃষ্টাব্দের একটি শিলালিপিতে লিখিত হয়েছেঃ
بنصر وردا الهن بعل سمين وارضين (بنصرو تعون الاله رب السماء ولارض)
এ কথাগুলো সুস্পষ্টভাবে তাওহীদ বিশ্বাসের কথা ব্যক্ত করছে। একটি কবরগাত্রে সে যুগের আর একটি শিলালিপি পাওয়া গেছে। তাতে লেখা আছেঃ
بخيل رحمنن (يعنى استعين بحول الرحمن)
অনুরূপভাবে দক্ষিণ আরবে ফোরাত নদী ও কিন্নাসিরীনের মাঝখানে যাবাদ নামক স্থানে ৫১২ খৃষ্টাব্দের একটি শিলালিপি পাওয়া গেছে। তাতে লেখা আছেঃ
بسم الا له , لاعز الا له , لاشكر الا له
এ সমস্ত কথাই প্রকাশ করছে যে, নবী (সা.) এর নবুয়ত লাভের পূর্বে পূর্ববর্তী নবীগণের শিক্ষার প্রভাব আরব ভূখণ্ড থেকে একেবারে নির্মূল হয়ে যায়নি। কমপক্ষে “তোমাদের আল্লাহ এক ও একক” এ কথাটুকু স্মরণ করিয়ে দেবার মতো বহু উপায় ও উপকরণ বিদ্যমান ছিল। (আরো বেশি ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল ফুরকান, ৮৪ টীকা।)
وَيَسْتَعْجِلُونَكَ بِالْعَذَابِ وَلَنْ يُخْلِفَ اللَّهُ وَعْدَهُ وَإِنَّ يَوْمًا عِنْدَ رَبِّكَ كَأَلْفِ سَنَةٍ مِمَّا تَعُدُّونَ
“এরা শীঘ্রই আযাব চাচ্ছে। আল্লাহ কখনো ওয়াদার বরখেলাফ করবেন না। কিন্তু তোমার রবের কাছে একদিন তোমাদের গণনায় এক হাজার বছরের সমান হয়ে থাকে।” (৪৭ আয়াত)
অন্য এক জায়গায় একথার জবাব এভাবে দেয়া হয়েছেঃ
سَأَلَ سَائِلٌ بِعَذَابٍ وَاقِعٍ - لِلْكَافِرِينَ لَيْسَ لَهُ دَافِعٌ - مِنَ اللَّهِ ذِي الْمَعَارِجِ - تَعْرُجُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ إِلَيْهِ فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ - فَاصْبِرْ صَبْرًا جَمِيلًا - إِنَّهُمْ يَرَوْنَهُ بَعِيدًا - وَنَرَاهُ قَرِيبًا
“প্রশ্নকারী প্রশ্ন করছে সেই আযাব সম্পর্কে, যা কাফেরদের ওপর আপতিত হবে, যার প্রতিরোধকারী কেউ নেই, সেই আল্লাহর পক্ষ থেকে যিনি সমুচ্চ স্তরসম্পন্ন (অর্থাৎ পর্যায়ক্রমে কাজ করেন)। ফেরেশতা ও রূহ তার দিকে উঠতে থাকে এমন একদিনে যার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছর। কাজেই হে নবী! সুন্দর সবর অবলম্বন করুন। এরা তাকে দূরবর্তী মনে করে এবং আমি তাকে দেখছি নিকটে। (আল মা’আরিজ, ১-৭ আয়াত)
এসব উক্তি থেকে যে কথা বুঝানো হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, মানুষের ইতিহাসে আল্লাহর ফায়সালা দুনিয়ার সময় ও পঞ্জিকা অনুসারে হয় না কোন জাতিকে যদি বলা হয়, অমুক নীতি অবলম্বন করলে তোমাদের এ ধরনের পরিণামের সম্মুখীন হতে হবে, তাহলে যে জাতি একথার এ অর্থ গ্রহণ করবে যে, আজই সে নীতি অবলম্ব করলে কালই তার অশুভ পরিণাম সামনে এসে যাবে, সে হবে বড়ই নির্বোধ। পরিণামফল প্রকাশের জন্য দিন, মাস, বছর এমনকি শত শত বছর ও কোন বড় মেয়াদ নয়।
কানও চোখ অর্থ হচ্ছে এমন সব যার সাহায্যে মানুষ জ্ঞান আহরণ করে। যদিও জ্ঞান আহরণের মাধ্যমের মধ্যে জিহ্বা, নাসিকা ও ত্বকও অন্তর্ভুক্ত তবুও যেহেতু শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলোর তুলনায় অনেক বেশি বড় ও বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাই কুরআন বিভিন্ন স্থানে এ দু’টিকেই আল্লাহর উল্লেখযোগ্য দান আকারে পেশ করছে। এরপর “হৃদয়” মানে হচ্ছে এমন একটি “মন” (mind) যা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে সংগৃহীত ও তথ্যাদি বিন্যস্ত করে তা থেকে ফলাফল বের করে আনে এবং কর্মের বিভিন্ন সম্ভাব্য পথগুলোর মধ্য থেকে কোন একটি পথ নির্বাচন করে এবং সে পথে চলার সিদ্ধান্ত নেয়।
এ সংক্ষিপ্ত আয়াতে অনেকগুলো সত্যের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। এগুলোকে হালকা দৃষ্টিতে দেখে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া ঠিক নয়।
একঃ এখানে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে, মৃত্যু এমনভাবে আসে না যেমন নাকি একটি ঘড়ি চলতে চলতে হঠাৎ দম শেষ হয়ে যাবা কারণে বন্ধ হয়ে যায়। বরং এ কাজের জন্য আসলে আল্লাহ একজন বিশিষ্ট ফেরেশতা নিযুক্ত করে রেখেছেন। তিনি এসে যথারীতি রূহকে ঠিক তেমনিভাবে গ্রহণ করেন যেমন একজন সরকারী আমীন (official Receiver) কোন জিনিস নিজের কবজায় নিয়ে নেয়। কুরআনের অন্যান্য স্থানে এর আরো যে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে তা থেকে জানা যায়, মৃত্যু বিভাগীয় এ অফিসারের অধীনে পুরোপুরি একটি আমলা বাহিনী রয়েছে। তারা মৃত্যু দান করা, রূহকে দেহ থেকে বের করে আনা এবং তাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেবার বহুতর দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া এ আমলারা অপরাধী রূহ ও সৎ মু’মিন রূহদের সাথে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহার করেন। (এসব বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য সূরা নিসা, ৯৭ ; আন’আম, ৯৩ ; আন নাহল, ২৮; এবং ওয়াকি’আহ ৮৩ ও ৯৪ আয়াত দেখুন।)
দুইঃ এ থেকে একথাও জানা যায় যে, মৃত্যুর ফলে মানুষের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায় না। বরং তার রূহ দেহ থেকে বের হয়ে সঞ্জীবিত থাকে। কুরআনের “মৃত্যুর ফেরেশতা তোমাদেরকে পুরোপুরি তার কবজায নিয়ে নেবে” শব্দগুলো এ সত্যটির প্রকাশ করে। কারণ কোন বিলুপ্ত জিনিসকে কবজায় নেয়া বা নিয়ন্ত্রণাধীন করা হয় না। কবজায় বা অধিকারে নিয়ে নেবার অর্থই হচ্ছে অধিকৃত জিনিস অধিকারকারীর কাছে রয়েছে।
তিনঃ এ থেকেও জানা যায় যে, মৃত্যুকালে যে জিনিসটি অধিকারে নিয়ে নেয়া হয় তা মানুষের জৈবিক জীবন (Biological life) নয় বরং তার সেই অহম (Ego) যাকে “আমরা” “তুমি”“তোমরা” শব্দাবলীর সাহায্যে চিত্রিত করা হয়। এ অহম দুনিয়ার কাজ করে যে ধরনের ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয় তার সবটুকুই পুরোপুরি (Intact) বের করে নেয়া হয়। এমনভাবে বের করে নেয়া হয় যার ফলে তার গুণাবলীতে কোনো প্রকার কমবেশি দেখা দেয় না। মৃত্যুর পরে এ জিনিসই তার রবের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। একেই পরকালে নবজন্ম ও নতুন দেহ দান করা হবে। এরই বিরূদ্ধে ‘মোকদ্দমা’ চালানো হবে। এর কাছ থেকেই হিসেব নেয়া হবে এবং একেই পুরস্কার ও শাস্তি দেয়া হবে।