পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

১৭৮ আয়াত

২৭ ) পৃথিবীতে যত গাছ আছে তা সবই যদি কলম হয়ে যায় এবং সমুদ্র (দোয়াত হয়ে যায়) , তাকে আরো সাতটি সমুদ্র কালি সরবরাহ করে তবুও আল্লাহর কথা (লেখা) শেষ হবে না। ৪৮ অবশ্যই আল্লাহ‌ মহাপরাক্রমশালী ও জ্ঞানী।
وَلَوْ أَنَّمَا فِى ٱلْأَرْضِ مِن شَجَرَةٍ أَقْلَـٰمٌۭ وَٱلْبَحْرُ يَمُدُّهُۥ مِنۢ بَعْدِهِۦ سَبْعَةُ أَبْحُرٍۢ مَّا نَفِدَتْ كَلِمَـٰتُ ٱللَّهِ ۗ إِنَّ ٱللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌۭ ٢٧
২৮ ) তোমাদের সমগ্র মানবজাতিকে সৃষ্টি করা এবং তারপর পুনর্বার তাদেরকে জীবিত করা (তার জন্য) নিছক একটিমাত্র প্রাণী (সৃষ্টি করা এবং তাকে পুনরুজ্জীবিত) করার মতই ব্যাপার। আসলে আল্লাহ‌ সবকিছুই শোনেন ও দেখেন। ৪৯
مَّا خَلْقُكُمْ وَلَا بَعْثُكُمْ إِلَّا كَنَفْسٍۢ وَٰحِدَةٍ ۗ إِنَّ ٱللَّهَ سَمِيعٌۢ بَصِيرٌ ٢٨
২৯ ) তুমি কি দেখো না, আল্লাহ‌ রাতকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে নিয়ে আসেন এবং দিনকে রাতের মধ্যে? তিনি সূর্য ও চন্দ্রকে নিয়মের অধীন করে রেখেছেন, ৫০ সবই চলছে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। ৫১ আর (তুমি কি জানো না) তোমরা যা কিছুই করো না কেন আল্লাহ‌ তা জানেন।
أَلَمْ تَرَ أَنَّ ٱللَّهَ يُولِجُ ٱلَّيْلَ فِى ٱلنَّهَارِ وَيُولِجُ ٱلنَّهَارَ فِى ٱلَّيْلِ وَسَخَّرَ ٱلشَّمْسَ وَٱلْقَمَرَ كُلٌّۭ يَجْرِىٓ إِلَىٰٓ أَجَلٍۢ مُّسَمًّۭى وَأَنَّ ٱللَّهَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌۭ ٢٩
৩০ ) এ সবকিছু এ কারণে যে, আল্লাহই হচ্ছেন সত্য ৫২ এবং তাকে বাদ দিয়ে অন্য যেসব জিনিসকে এরা ডাকে তা সবই মিথ্যা, ৫৩ আর (এ কারণে যে, ) আল্লাহই সমুচ্চ ও শ্রেষ্ঠ। ৫৪
ذَٰلِكَ بِأَنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلْحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدْعُونَ مِن دُونِهِ ٱلْبَـٰطِلُ وَأَنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلْعَلِىُّ ٱلْكَبِيرُ ٣٠
৩১ ) তুমি কি দেখো না সমুদ্রে নৌযান চলে আল্লাহর অনুগ্রহে, যাতে তিনি তোমাদের দেখাতে পারেন তার কিছু নিদর্শন। ৫৫ আসলে এর মধ্যে রয়েছে বহু নিদর্শন প্রত্যেক সবর ও শোকরকারীর জন্য। ৫৬
أَلَمْ تَرَ أَنَّ ٱلْفُلْكَ تَجْرِى فِى ٱلْبَحْرِ بِنِعْمَتِ ٱللَّهِ لِيُرِيَكُم مِّنْ ءَايَـٰتِهِۦٓ ۚ إِنَّ فِى ذَٰلِكَ لَـَٔايَـٰتٍۢ لِّكُلِّ صَبَّارٍۢ شَكُورٍۢ ٣١
৩২ ) আর যখন (সমুদ্রে) একটি তরঙ্গ তাদেরকে ছেয়ে ফেলে ছাউনির মতো তখন তারা আল্লাহকে ডাকে নিজেদের আনুগত্যকে একদম তাঁর জন্য একান্ত করে নিয়ে। তারপর যখন তিনি তাদেরকে উদ্ধার করে স্থলদেশে পৌঁছিয়ে দেন তখন তাদের কেউ কেউ মাঝপথ বেছে নেয়, ৫৭ আর প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতক ও অকৃতজ্ঞ ছাড়া আর কেউ আমার নিদর্শনাবলী অস্বীকার করে না। ৫৮
وَإِذَا غَشِيَهُم مَّوْجٌۭ كَٱلظُّلَلِ دَعَوُا۟ ٱللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ فَلَمَّا نَجَّىٰهُمْ إِلَى ٱلْبَرِّ فَمِنْهُم مُّقْتَصِدٌۭ ۚ وَمَا يَجْحَدُ بِـَٔايَـٰتِنَآ إِلَّا كُلُّ خَتَّارٍۢ كَفُورٍۢ ٣٢
৩৩ ) হে মানুষেরা! তোমাদের রবের ক্রোধ থেকে সতর্ক হও এবং সেদিনের ভয় করো যেদিন কোন পিতা নিজের পুত্রের পক্ষ থেকে প্রতিদান দেবে না এবং কোন পুত্রই নিজের পিতার পক্ষ থেকে কোন প্রতিদান দেবে না। ৫৯ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। ৬০ কাজেই এ দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদের প্রতারিত না করে ৬১ এবং প্রতারক যেন তোমাকে আল্লাহর ব্যাপারে প্রতারিত করতে সক্ষম না হয়। ৬২
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱتَّقُوا۟ رَبَّكُمْ وَٱخْشَوْا۟ يَوْمًۭا لَّا يَجْزِى وَالِدٌ عَن وَلَدِهِۦ وَلَا مَوْلُودٌ هُوَ جَازٍ عَن وَالِدِهِۦ شَيْـًٔا ۚ إِنَّ وَعْدَ ٱللَّهِ حَقٌّۭ ۖ فَلَا تَغُرَّنَّكُمُ ٱلْحَيَوٰةُ ٱلدُّنْيَا وَلَا يَغُرَّنَّكُم بِٱللَّهِ ٱلْغَرُورُ ٣٣
৩৪ ) একমাত্র আল্লাহই সেই সময়ের জ্ঞান রাখেন। তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন। তিনিই জানেন মাতৃগর্ভে কি লালিত হচ্ছে। কোন প্রাণসত্তা জানে না আগামীকাল সে কি উপার্জন করবে এবং কোন ব্যক্তির জানা নেই তার মৃত্যু হবে কোন যমীনে। আল্লাহই সকল জ্ঞানের অধিকারী এবং তিনি সবকিছু জানেন। ৬৩
إِنَّ ٱللَّهَ عِندَهُۥ عِلْمُ ٱلسَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ ٱلْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِى ٱلْأَرْحَامِ ۖ وَمَا تَدْرِى نَفْسٌۭ مَّاذَا تَكْسِبُ غَدًۭا ۖ وَمَا تَدْرِى نَفْسٌۢ بِأَىِّ أَرْضٍۢ تَمُوتُ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌۢ ٣٤
১ ) আলিফ লাম মীম।
الٓمٓ ١
২ ) এ কিতাবটি রব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ, এতে কোন সন্দেহ নেই।
تَنزِيلُ ٱلْكِتَـٰبِ لَا رَيْبَ فِيهِ مِن رَّبِّ ٱلْعَـٰلَمِينَ ٢
৪৮ .
“আল্লাহর কথা” মানে তার সৃষ্টিকর্ম এবং তার শক্তি ও জ্ঞানের নিদর্শন। এ বিষয়বস্তুটি সূরা আল কাহফের ১০৯ আয়াতে এর থেকে আরো একটু ভিন্ন ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এক ব্যক্তি ধারণা করবে, বোধ হয় এ বক্তব্যে বাড়াবাড়ি বা অতিকথন আছে। কিন্তু সামান্য চিন্তা করলে এক ব্যক্তি অনুভব করবে, এর মধ্যে তিল পরিমাণও অতিকথা নেই। এ পৃথিবীর গাছগুলো কেটে যতগুলো কলম তৈরি করা যেতে পারে এবং পৃথিবীর বর্তমান সাগরের পানির সাথে আরো তেমনি সাতটি সাগরের পানিকে কালিতে পরিণত করলে তা দিয়ে আল্লাহর শক্তি, জ্ঞান ও সৃষ্টির কথা লিখে শেষ করা তো দূরের কথা হয়তো পৃথিবীতে যেসব জিনিস আছে সেগুলোর তালিকা তৈরি করাই সম্ভবপর হবে না। শুধুমাত্র এ পৃথিবীতেই যেসব জিনিসের অস্তিত্ব রয়েছে সেগুলোই গণনা করা কঠিন, তার ওপর আবার এই অথৈ মহাবিশ্বের সৃষ্টির বিবরণ লেখার তো কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না।

এ বর্ণনা থেকে আসলে এ ধরনের একটি ধারণা দেয়াই উদ্দেশ্য যে, এত বড় বিশ্ব-জাহানকে যে আল্লাহ‌ অস্তিত্ব দান করেছেন এবং আদি থেকে অনন্তকাল পর্যন্ত এর যাবতীয় আইন্তশৃঙ্খলা ব্যবস্থা পরিচালনা করে চলেছেন তার সার্বভৌম কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে তোমরা যেসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সত্তাকে উপাস্যে পরিণত করে বসেছো তাদের গুরুত্ব ও মর্যাদাই বা কি। এই বিরাট-বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করা তো দূরের কথা এর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান এবং নিছক জ্ঞানটুকু পর্যন্ত লাভ করার ক্ষমতা কোন সৃষ্টির নেই। তাহলে কেমন করে এ ধারণা করা যেতে পারে যে, সৃষ্টিকুলেরর মধ্য থেকে কেউ এখানে আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্ব ক্ষমতার কোন অংশও লাভ করতে পারে, যার ভিত্তিতে সে ভাগ্য ভাঙা গড়ার ক্ষমতার অধিকারী হয়ে বসে।

.
৪৯ .
অর্থাৎ তিনি একই সময় সমগ্র বিশ্ব-জাহানের আওয়াজ আলাদা আলাদাভাবে শুনছেন এবং কোন আওয়াজ তার শ্রবণেন্দ্রিয়কে এমনভাবে দখল করে বসে না যার ফলে একটি শুনতে গিয়ে অন্যগুলো শুনতে না পারেন। অনুরূপভাবে তিনি একই সময় সমগ্র বিশ্ব-জাহানকে তার প্রত্যেকটি জিনিস ও ঘটনা সহকারে বিস্তারিত আকারেও দেখছেন এবং কোন জিনিস দেখার ব্যাপারে তার দর্শনেন্দ্রিয় এমনভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়ে না যে, একটিকে দেখতে গিয়ে তিনি অন্যগুলো দেখতে অপারগ হয়ে পড়েন। মানবকুলের সৃষ্টি এবং তাদের পুনরুজ্জীবনের ব্যাপারটিও ঠিক এই একই পর্যায়ের। সৃষ্টির প্রারম্ভকাল থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত যতগুলো মানুষ জন্ম নিয়েছে এবং আগামীতে কিয়ামত পর্যন্ত জন্ম নেবে তাদের সবাইকে তিনি আবার মাত্র এক মুহূর্তেই সৃষ্টি করতে পারেন। তার সৃষ্টিক্ষমতা একটি মানুষের সৃষ্টিতে এমনভাবে লিপ্ত হয়ে পড়ে না যে, সে একই সময়ে তিনি অন্য মানুষদের সৃষ্টি করতে অপরাগ হয়ে পড়েন। একজন মানুষ সৃষ্টি করা বা কোটি কোটি মানুষ সৃষ্টি করা দু’ টোই তার জন্য সমান।
৫০ .
অর্থাৎ রাত ও দিনের যথারীতি নিয়মিত আসাই একথা প্রকাশ করে যে, সূর্য ও চন্দ্র একটি নিয়মের নিগড়ে বাঁধা। সূর্য ও চন্দ্রের উল্লেখ এখানে নিছক এ জন্য করা হয়েছে যে, এ দু’ টি মহাশূন্যের সবচেয়ে দৃশ্যমান জিনিস এবং মানুষ অতি প্রাচীনকাল থেকে এদেরকে উপাস্যে পরিণত করে আসছে এবং আজও বহুলোক এদেরকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করে। অন্যথায় প্রকৃতপক্ষে মহান আল্লাহ‌ পৃথিবীসহ বিশ্ব-জাহানের সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্রকে একটি অনড় নিয়ম-শৃঙ্খলা ও আইনের নিগড়ে বেঁধে রেখেছেন। এ থেকে এক চুল পরিমাণ এদিক ওদিক করার ক্ষমতা তাদের নেই।
৫১ .
প্রত্যেকটি জিনিসের যে বয়স তথা সময়-কাল নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে সেই সময় পর্যন্ত তা চলছে। চন্দ্র, সূর্য বা বিশ্ব-জাহানের অন্য কোন গ্রহ-নক্ষত্র কোনটাই চিরন্তন ও চিরস্থায়ী নয়। প্রত্যেকের একটি সূচনাকাল আছে। তার পূর্বে তার অস্তিত্ব ছিল না। আবার প্রত্যেকের আছে একটি সমাপ্তিকাল তারপর আর তার অস্তিত্ব থাকবে না। এ আলোচনার উদ্দেশ্য হচ্ছে একথা বুঝিয়ে দেয়া যে, এ ধরনের ধ্বংস ও ক্ষমতাহীন বস্তু ও সত্তাগুলো উপাস্য হতে পারে কেমন করে?
.
৫২ .
অর্থাৎপ্রকৃত সার্বভৌম ক্ষমতাধর কর্তা, সৃষ্টি ও পরিচালনা ব্যবস্থাপনার আসল ও একচ্ছত্র মালিক।
৫৩ .
অর্থাৎ তারা সবাই নিছক তোমাদের কাল্পনিক খোদা। তোমরা কল্পনার জগতে বসে ধারণা করে নিয়েছো যে, অমুকজন আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতার অংশীদার এবং অমুক মহাত্মা সংকট নিরসন ও অভাব মোচন করার ক্ষমতা রাখেন। অথচ প্রকৃতপক্ষে তাদের কেউ কোন কিছুই করার ক্ষমতা রাখে না।
৫৪ .
অর্থাৎ প্রত্যেকটি জিনিসের ঊর্ধ্বে এবং সবার শ্রেষ্ঠ। তার সামনে সব জিনিসই নিচু। প্রত্যেকের চেয়ে তিনি বড় এবং সবাই তার সামনে ছোট।
৫৫.
অর্থাৎ এমন নিদর্শনাবলী দেখাতে চান যা থেকে জানা যায় একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহই সমস্ত ক্ষমতার মালিক। মানুষ যতই বিপুল ক্ষমতাসম্পন্ন ও সমুদ্র যাত্রার উপযোগী জাহাজ নির্মাণ করুক এবং জাহাজ পরিচালনা বিদ্যা ও তার সাথে সম্পর্কিত তথ্য জ্ঞান্তঅভিজ্ঞতায় যতই যতই পারদর্শী হোক না কেন সমুদ্রে তাকে যেসব ভয়ংকর শক্তির সম্মুখীন হতে হয় আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া সেগুলোর মোকাবিলায় সে একা নিজের দক্ষতা ও কৌশলের ভিত্তিতে নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে সফর করতে পারে না। তার অনুগ্রহ দৃষ্টি সরে যাবার সাথে সাথেই মানুষ জানতে পারে তার উপায়-উপকরণ ও কারিগরী পারদর্শিতা কতটা অর্থহীন ও অকেজো। অনুরূপভাবে নিরাপদ ও নিশ্চিত অবস্থায় মানুষ যতই কট্টর নাস্তিক ও মুশরিক হোক না কেন, সমুদ্রে তুফানে যখন তার নৌযান ডুবে যেতে থাকে তখন নাস্তিকও জানতে পারে আল্লাহ‌ আছেন এবং মুশরিকও জেনে ফেলে আল্লাহ‌ মাত্র একজনই।
৫৬.
অর্থাৎ যাদের মধ্যে এ দু’টি গুণ পাওয়া যায় তারা যখন এ নিদর্শনগুলোর মাধ্যমে সত্যকে চিনতে পারে তখন তারা চিরকালের জন্য তাওহীদের শিক্ষা গ্রহণ করে তাকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরে। প্রথম গুণটি হচ্ছে, তাদের বড়ই সবরকারী (صبار) তথা অত্যন্ত ধৈর্যশীল হতে হবে। তারা অস্থিরমতি হবে না বরং তাদের পদক্ষেপে দৃঢ়তা থাকবে। সহনীয় ও অসহনীয়, কঠিন ও কোমল এবং ভালো ও মন্দ সকল অবস্থায় তারা একটি সৎ ও সুস্থ বিশ্বাসের ওপর অটল থাকবে। তাদের মধ্যে এ ধরনের কোন দুর্বলতা থাকবে না যে, দুঃসময়ের মুখোমুখি হলে আল্লাহর সামনে নতজানু হয়ে কান্নাকাটি করতে থাকবে আস সুসময় আসার সাথে সাথেই সবকিছু ভুলে যাবে। অথবা এর বিপরীত ভালো অবস্থায় আল্লাহকে মেনে চলতে থাকবে এবং বিপদের একটি আঘাতেই আল্লাহকে গালি দিতে শুরু করবে। দ্বিতীয় গুণটি হচ্ছে তাদেরকে বড়ই শোকরকারী (شكور) তথা অত্যন্ত কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী হতে হবে। তারা নিমকহারাম ও বিশ্বাসঘাতক হবে না, উপকারীর উপকার ভুলে যাবে না। বরং অনুগ্রহের কদর করবে এবং অনুগ্রহকারীর জন্য একটি স্বতন্ত্র কৃতজ্ঞতার অনুভূতি হর-হামেশা নিজের মনের মধ্যে জাগ্রত রাখবে।
৫৭.
এর কয়েকটি অর্থ হতে পারে। মাঝপথকে যদি সরল ও সঠিক পথের অর্থে গ্রহণ করা হয় তাহলে এর অর্থ হবে, তাদের মধ্যে এমন লোক খুব কমই হয় যারা তুফানে ঘেরাও হবার পর যে তাওহীদের স্বীকৃতি দিয়েছিল সে সময় অতিক্রান্ত হবার পরও তার ওপর অবিচল থাকে এবং এ শিক্ষাটি তাদেরকে চিরকালের জন্য সত্য ও সঠিক পথযাত্রীতে পরিণত করে। আর যদি মাঝপথের অর্থ করা হয় মধ্যমপন্থা ও ভারসাম্য, তাহলে এর অর্থ হবে, তাদের মধ্যে থেকে কিছু লোক এ অভিজ্ঞতা লাভের আগের সময়ের মতো নিজেদের শিরক ও নাস্তিক্যবাদী চিন্তা-বিশ্বাসে আর তেমন একনিষ্ঠ ও শক্তভাবে টিকে থাকে না। এর দ্বিতীয় অর্থ হবে, সে সময় অতিক্রান্ত হবার পর তাদের মধ্য থেকে কিছু লোকের মধ্যে আন্তরিকতার যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল তা স্তিমিত হয়ে পড়ে। আল্লাহ‌ এখানে এ দ্ব্যর্থক বাক্যাংশটি এ তিনটি অবস্থার প্রতি ইঙ্গিত করার জন্যই ব্যবহার করেছেন, এটারই সম্ভাবনা বেশি। তবে উদ্দেশ্য সম্ভবত একথা বলা যে, সামুদ্রিক ঝড়ের সময় সবার টনক নড়ে যায় এবং বুদ্ধি ঠিকমত কাজ করে। তখন তারা শিরক ও নাস্তিক্যবাদ পরিহার করে সবাই এক আল্লাহকে ডাকতে থাকে সাহায্যের জন্য। কিন্তু নিরাপদে উপকূলে পৌঁছে যাবার পর স্বল্প সংখ্যক লোকই এ অভিজ্ঞতা থেকে কোন স্থায়ী শিক্ষা লাভ করে। আবার এ স্বল্প সংখ্যক লোকেরাও তিনভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল, যারা চিরকালের জন্য শুধরে যায়। দ্বিতীয় দলের কুফরীর মধ্যে কিছুটা সমতা আসে। তৃতীয় দলটি এমন পর্যায়ের যাদের মধ্যে উক্ত সাময়িক ও জরুরী সময়কালীন আন্তরিকতার কিছু না কিছু বাকি থাকে।
৫৮.
এর আগের আয়াতে যে দু’টি গুণের বর্ণনা এসেছে তার মোকাবিলায় এখানে এ দু’টি দোষের উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বাসঘাতক এমন এক ব্যক্তি যে মারাত্মক রকমের বেঈমানী করে এবং নিজের প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার পালন করে না। আর অকৃতজ্ঞ হচ্ছে এমন এক ব্যক্তি যার প্রতি যতই অনুগ্রহ করা হোক না কেন সে তা কখনোই স্বীকার করে না এবং নিজের অনুগ্রহকারীর প্রতি আগ্রাসী আচরণ করে। এসব দোষ যাদের মধ্যে পাওয়া যায় তারা বিপদ উত্তীর্ণ হবার পর নিঃসংকোচে নিজেদের কুফরী, নাস্তিকতা ও শিরকের দিকে ফিরে যায়। ঝড়-তুফানের সময় তারা আল্লাহর অস্তিত্বের এবং একক আল্লাহর অস্তিত্বের কিছু চিহ্ন ও নিদর্শন বাইরে ও নিজেদের মনের মধ্যেও পেয়েছিল এবং এ সত্যের স্বতঃস্ফুর্ত অনুভূতিই তাদেরকে আল্লাহর শরণাপন্ন হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল একথা তারা মানতে চায় না। তাদের মধ্যে যারা নাস্তিক তারা তাদের এ কাজের যে ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে তা হচ্ছে এই যে, এ তো ছিল একটা দুর্বলতা। কঠিন বিপদের সময় অস্বাভাবিক অবস্থায় আমরা এ দুর্বলতার শিকার হয়েছিলাম। নয়তো আসলে আল্লাহ‌ বলতে কিছুই নেই। ঝড়-তুফানের মুখ থেকে কোন আল্লাহ‌ আমাদের বাঁচায়নি। অমুক অমুক কারণে ও উপায়ে আমরা বেঁচে গেছি। আর মুশরিকরা তো সাধারণভাবেই বলে থাকে, অমুক অমুক সাধুবাবা অথবা দেবী ও দেবতার ছায়া আমাদের মাথার ওপর ছিল। তাদের কল্যাণেই আমরা এ যাত্রায় রক্ষা পেয়েছি। কাজেই তীরে পৌঁছেই তারা নিজেদের মিথ্যা উপাস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে থাকে এবং তাদের দরজায় গিয়ে শিন্নী চড়াতে থাকে। তাদের মনে এ চিন্তার উদয়ই হয় না যে, যখন সবদিকের সব আশা-ভরসা-সহায় ছিন্ন ও নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল তখন একমাত্র এক লা-শরীক আল্লাহ‌ ছাড়া আর কেউ ছিল না এবং তারই শরণাপন্ন তারা হয়েছিল।
৫৯.
অর্থাৎ বন্ধু, নেতা, পীর এবং এ পর্যায়ের অন্যান্য লোকেরা তবু তো দূর সম্পর্কের। দুনিয়ায় সবচেয়ে নিকট সম্পর্ক হচ্ছে সন্তান ও পিতামাতার মধ্যে। কিন্তু সেখানে অবস্থা হবে যদি পুত্র পাকড়াও হয়, তাহলে পিতা এগিয়ে গিয়ে একথা বলবে না যে, তার গোনাহের জন্য আমাকে পাকড়াও করো। অন্যদিকে পিতার দুর্ভোগ শুরু হয়ে গেলে পুত্রের একথা বলার হিম্মত হবে না যে, তার বদলে আমাকে জাহান্নামে পঠিয়ে দাও। এ অবস্থায় নিকট সম্পর্কহীন তিন ব্যক্তিরা সেখানে পরস্পরের কোনো কাজে লাগবে এ আশা করার কি অবকাশই বা থাকে। কাজেই যে ব্যক্তি দুনিয়ায় পরের জন্য নিজের পরকাল ঝরঝরে করে অথবা অন্যের ওপর ভরসা করে নিজে ভ্রষ্টতা ও পাপের পথ অবলম্বন করে সে একটা গণ্ডমূর্খ। এ প্রসঙ্গে ১৫ আয়াতের বিষয়বস্তুও সামনে রাখা উচিত। সেখানে সন্তানদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, দুনিয়াবী জীবনের বিভিন্ন কাজে-কারবারে অবশ্যই পিতা-মাতার সেবা করতে ও তাদের কথা মেনে চলতে হবে কিন্তু ধর্ম ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে পিতা-মাতার কথায় গোমরাহীর পথ অবলম্বন কোনমতেই ঠিক নয়।
৬০ .
আল্লাহর প্রতিশ্রুতি বলতে কিয়ামতের প্রতিশ্রুতির কথা বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ একদিন কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। তখন আল্লাহর আদালত প্রতিষ্ঠিত হবেই। সেখানে প্রত্যেককে তার নিজের কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
৬১.
দুনিয়ার জীবন স্থুলদর্শী লোকদেরকে নানা রকমের ভুল ধারণায় নিমজ্জিত করে। কেউ মনে করে, বাঁচা-মরা যা কিছু শুধুমাত্র এ দুনিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, এরপর আর দ্বিতীয় কোন জীবন নেই। কাজেই যা কিছু করার এখানেই করে নাও। কেউ অর্থ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও প্রাচুর্যের নেশায় মত্ত হয়ে নিজের মৃত্যুর কথা ভুলে যায় এবং এ ভুল ধারণা পোষণ করতে থাকে যে, তার এ আরাম-আয়েশ ও কর্তৃত্ব চিরস্থায়ী, এর ক্ষয় নেই। কেউ নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে কেবলমাত্র বৈষয়িক লাভ ও স্বাদ-আহলাদকে একমাত্র উদ্দেশ্য মনে করে নেয় এবং “জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন” ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যকে কোন গুরুত্বই দেয় না। এর ফলে তার মনুষ্যত্বের মান যত নিচে নেমে যেতে থাকে না কেন তার কোন পরোয়াই সে করে না। কেউ মনে করে বৈষয়িক সমৃদ্ধিই ন্যায়-অন্যায় সত্য-মিথ্যার আসল মানদণ্ড। এ সমৃদ্ধি যে পথেই অর্জিত হবে তাই সত্য এবং তার বিপরীত সবকিছুই মিথ্যা। কেউ এ সমৃদ্ধিকেই আল্লাহর দরবারে অনুগৃহীত হবার আলামত মনে করে। এর ফলে সে সাধারণভাবে মনে করতে থাকে, যদি দেখা যায় যে কোন উপায়েই হোক না কেন একজন লোক বিপুল সম্পদের অধিকারী হতে চলেছে, তাহলে সে আল্লাহর প্রিয়পাত্র এবং যার বৈষয়িক অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে, তা হক পথে থাকা ও সৎ নীতি অবলম্বন করার কারণেই হোক না কেন তার পরকাল ঝরঝরে হয়ে গেছে। এ ধারণা এবং এ ধরনের যত প্রকার ভুল ধারণা আছে সবগুলোকেই মহান আল্লাহ‌ এ আয়াতে “দুনিয়ার জীবনের প্রতারণা” বলে উল্লেখ করেছেন।
৬২.
الْغَرُورُ প্রতারক শয়তানও হতে পারে আবার কোন মানুষ বা একদল মানুষও হতে পারে, মানুষের নিজের মন ও প্রবৃত্তিও হতে পারে এবং অন্য কোন জিনিসও হতে পারে। কোন বিশেষ ব্যক্তি বা বিশেষ বস্তু নির্ধারণ না করে এ বহুমুখী অর্থের অধিকারী শব্দটিকে তার সাধারণ ও সার্বজনীন অর্থে ব্যবহার করার কারণ হচ্ছে এই যে, বিভিন্ন লোকের কাছে প্রতারিত হবার মূল বিভিন্ন হয়ে থাকে। যে ব্যক্তিবিশেষ করে যে উপায়েই এমন প্রতারণার শিকার হয়েছে যা সঠিক দিক থেকে ভুল দিকে তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। তা-ই তার জন্য “আল গারূর” তথা প্রতারক।

“আল্লাহর ব্যাপারে প্রতারিত করা” শব্দ গুলো ব্যাপক অর্থের অধিকারী। বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা এর অন্তর্ভুক্ত। কাউকে তার “প্রতারক” এ নিশ্চয়তা দেয় যে, আল্লাহ‌ আদতেই নেই। কাউকে বুঝায়, আল্লাহ‌ এ দুনিয়া সৃষ্টি করে হাত-পা গুটিয়ে বসে গেছেন এবং এখন এ দুনিয়া তিনি বান্দাদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। কাউকে এ ভুল ধারণা দেয় যে, আল্লাহর এমন কিছু প্রিয়পাত্র আছে, যাদের নৈকট্য অর্জন করে নিলে তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে। তুমি নিশ্চিতভাবেই ক্ষমার অধিকারী হবে। কাউকে এভাবে প্রতারণা করে যে, আল্লাহ‌ তো ক্ষমাশীল ও করুণাময়। তোমরা পাপ করতে থাকো, তিনি ক্ষমা করে যেতে থাকবেন। কাউকে বুঝায়, মানুষ তো নিছক একটা অক্ষম জীব ছাড়া আর কিছুই নয়। তার মনে ভুল ধারণা সৃষ্টি করে দেয় এই বলে যে, তোমাদের তো হাত-পা বাঁধা, যা কিছু খারাপ কাজ তোমরা করো সব আল্লাহই করান। ভালো কাজ থেকে তোমরা দূরে সরে যাও, কারণ আল্লাহ‌ তা করার তাওফীক তোমাদের দেন না। না জানি আল্লাহর ব্যাপারে এমনিতর কত বিচিত্র প্রতারণার শিকার মানুষ প্রতিদিন হচ্ছে। যদি বিশ্লেষণ করে দেখা হয়, তাহলে শেষ পর্যন্ত প্রত্যেকটি গোমরাহী, গোনাহ ও অপরাধের মূল কারণ হিসেবে দেখা যাবে, মানুষ আল্লাহর ব্যাপারে কোন না কোন প্রতারণার শিকার হয়েছে এবং তার ফলেই তার বিশ্বাসে দেখা দিয়েছে বিভ্রান্তি অথবা সে নৈতিক চরিত্রহীনতার শিকার হয়েছে।

৬৩.
এটি আসলে একটি প্রশ্নের জবাব। কিয়ামতের কথা ও আখেরারতের প্রতিশ্রুতি শুনে মক্কার কাফেররা রসূলুল্লাহ ﷺ কে বারবার এ প্রশ্নটি করতো। প্রশ্নটি ছিল, সে সময়টি কবে আসবে? কুরআন মজীদে কোথাও তাদের এ প্রশ্নটি উদ্ধৃত করে জবাব দেয়া হয়েছে আবার কোথাও উদ্ধৃত না করেই জবাব দেয়া হয়েছে। কারণ শ্রোতাদের মনে এ প্রশ্ন জাগরুক ছিল। এ আয়াতটিতেও প্রশ্নের উল্লেখ ছাড়াই জবাব দেয়া হয়েছে।

“একমাত্র আল্লাহই সে সময়ের জ্ঞান রাখেন” এ প্রথম বাক্যটিই মূল প্রশ্নের জবাব। তার পরের চারটি বাক্য এ জবাবের স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে পেশ করা হয়েছে। যুক্তির সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছে, যেসব বিষয়ের প্রতি মানুষ নিকটতম আকর্ষণ অনুভব করে সেগুলো সম্পর্কেও তার কোন জ্ঞান নেই। তাহলে সারা দুনিয়ার শেষ ক্ষণটি কবে ও কখন আসবে, একথা জানা তার পক্ষে কেমন করে সম্ভব? তোমাদের সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতা বিরাটভাবে নির্ভর করে বৃষ্টির ওপর। কিন্তু আল্লাহর হাতে রয়েছে এর পুরো যোগসূত্র। যেখানে যখন যতটুকু চান বর্ষণ করান এবং যখনি চান থামিয়ে দেন। কেউ একটুও জানে না কোথায় কখন কতটুকু বৃষ্টি হবে এবং কোন ভূখণ্ড তা থেকে বঞ্চিত হবে অথবা কোন ভূখণ্ডে বৃষ্টি উল্টো ক্ষতিকর প্রমাণিত হবে। তোমাদের বীর্যে তোমাদের স্ত্রীদের গর্ভসঞ্চার হয় এবং এর সাথে তোমাদের বংশধারার ভবিষ্যত জড়িত। কিন্তু তোমরা জানো না এ গর্ভে কি লালিত হচ্ছে এবং কোন আকৃতিতে ও কোন্ ধরনের কল্যাণ বা অকল্যাণ নিয়ে তা বের হয়ে আসবে। আগামীকাল তোমাদের কি হবে তা-ও তোমরা জানো না।

একটি আকস্মিক দুর্ঘটনা তোমাদের ভাগ্য বদলে দিতে পারে। কিন্তু এক মিনিট আগেও তোমরা তার খবর পাও না। তোমরা এও জানো না, তোমাদের এ জীবনের সমাপ্তি ঘটবে কোথায় কি অবস্থায়। এ সমস্ত তথ্যজ্ঞান আল্লাহ‌ নিজেরই কাছে রেখেছেন এবং এর কোন একটির জ্ঞানও তোমাদের দেননি। এর মধ্যে প্রত্যেকটি জিনিসই এমন যে সম্পর্কে তোমরা পূর্বাহ্ণেই কিছু জানতে চাও যাতে এ জ্ঞানের সাহায্যে তোমরা আগেভাগেই কিছু পদক্ষেপ নিতে পারো। কিন্তু সেসব ব্যাপারে আল্লাহর নিজস্ব ব্যবস্থাপনা এবং তার ফায়সালার ওপর ভরসা করো। এভাবে দুনিয়ার শেষক্ষণটির ব্যাপারেও আল্লাহর ফায়সালারপ্রতি আস্থা স্থাপন করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। এর জ্ঞানও কাউকে দেয়া হয়নি এবং দেয়া যেতে পারে না।

এখানে আর একটি কথাও ভালোভাবে বুঝে নেয়া দরকার। সেটি হচ্ছে, যেসব বিষয় আল্লাহ‌ ছাড়া কেউ জানে না তেমনি ধরনের গায়েব বা অদৃশ্য বিষয়াবলীর কোন তালিকা এখানে দেয়া হয়নি। এখানে তো কেবলমাত্র হাতের কাছের কিছু জিনিস উদাহরণস্বরূপ পেশ করা হয়েছে। যেগুলোর প্রতি মানুষের গভীরতম ও নিকটতম আকর্ষণ ও আগ্রহ রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না। এ থেকে এ সিদ্ধান্ত টানা ঠিক হবে না যে, মাত্র এ পাঁচটি বিষয়ই গায়েবের অন্তর্ভুক্ত, যে সম্পর্কে আল্লাহ‌ ছাড়া আর কেউ কিছুই জানে না। অথচ গায়েব এমন জিনিসকে বলা হয় যা সৃষ্টির অগোচরে এবং একমাত্র আল্লাহর দৃষ্টি সম্মুখে থাকে। প্রকৃতপক্ষে এ গায়েবের কোন সীমা পরিসীমা নেই। (এ বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আন নাহল, ৮৩ টীকা)।

.
১.
কুরআন মজীদের অনেকগুলো সূরা এ ধরনের কোন না কোন পরিচিতিমূলক বক্তব্য দিয়ে শুরু হয়েছে। এ বাণী কোথায় থেকে আসছে সূরার শুরুতেই তা জানিয়ে দেয়াই হয় এর উদ্দেশ্য। রেডিও ঘোষক প্রোগ্রাম শুরু করার সূচনাতেই যেমন ঘোষণা করে দেন, আমি অমুক স্টেশন থেকে বলছি, এটা বাহ্যত তেমনি ধরনের একটা ভূমিকাসূচক বক্তব্য। কিন্তু রেডিওর এমনি ধরনের একটা মামুলি ঘোষণার বিপরীতে কুরআন মজীদের কোন সূরার সূচনা যখন এ ধরনের একটা অসাধারণ ঘোষণার মাধ্যমে শুরু হয়, যাতে বলা হয়, এ বাণী আসছে বিশ্ব-জাহানের শাসনকর্তার পক্ষ থেকে তখন এটা শুধমাত্র বাণীর উৎস বর্ণনা করাই হয় না বরং এই সঙ্গে এর মধ্যে শামিল হয়ে যায় একটা বিরাট বড় দাবী, একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ এবং একটা কঠোর ভীতি প্রদর্শনও। কারণ কথা শুরু করেই সে ঝট করে এত বড় একটা খবর দিয়ে দিচ্ছে যে, এটা মানুষের সামনে এ দাবী স্বীকার করা না করার কোন প্রশ্ন উত্থাপন করে। স্বীকার করলে চিরকালের জন্য তার সামনে আনুগত্যের শির নত করে দিতে হবে, তারপর তার মোকাবিলায় মানুষের আর কোন স্বাধীনতা থাকতে পারে না। আর স্বীকার না করলে নিশ্চিতভাবেই তাকে একটা ভয়াবহ আশঙ্কার মুখোমুখি হতে হবে। অর্থাৎ যদি সত্যিই এটা বিশ্ব-জাহানের প্রভুর বাণী হয়ে থাকে তাহলে একে প্রত্যাখ্যান করার ফল স্বরূপ তাকে চিরন্তন দুভার্গ্যের শিকার হতে হবে। এ জন্য এ ভূমিকাসূচক বাক্যটির শুধুমাত্র নিজের এই প্রকৃতিগত অসাধারণত্বেরই কারণে মানুষকে কান লাগিয়ে চূড়ান্ত মনোনিবেশ সহকারে এ বাণী শোনার এবং একে আল্লাহর বাণী হিসেবে স্বীকার করার বা না করার ফয়সালা করতে বাধ্য করে।

এ কিতাব রব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে নাযিল করা হয়েছে, শুধুমাত্র এতটুকু কথা বলেই এখানে শেষ করা হয়নি। বরং এর পরেও পূর্ণ জোরেশোরে বলা হয়েছেلَا رَيْبَ فِيهِ অর্থাৎ এটা আল্লাহর কিতাব এবং আল্লাহর কাছ থেকে এর অবতীর্ণ হবার ব্যাপারে আদৌ কোন সন্দেহের অবকাশই নেই। এ তাগিদসূচক বাক্যাংশ টিকে যদি কুরআন নাযিলের ঘটনামূলক পটভূমি এবং খোদ কুরআনের নিজের পূর্বাপর বক্তব্যের আলোকে দেখা হয় তাহলে পরিষ্কার অনুভব করা যাবে যে, তার মধ্যে দাবীর সাথে যুক্তি-প্রমাণও নিহিত রয়েছে এবং এ যুক্তি-প্রমাণ মক্কা মু’আযযামার যেসব অধিবাসীর সামনে এ দাবী পেশ করা হচ্ছিল তাদের কাছে গোপন ছিল না। এ কিতাব উপস্থাপনকারীর সমগ্র জীবন তাদের সামনে ছিল। কিতাব উপস্থাপন করার আগেরও এবং পরেরও। তারা জানতো, যিনি এ দাবী সহকারে এ কিতাব পেশ করছেন তিনি আমাদের জাতির সবচেয়ে সত্যবাদী, দায়িত্বশীল ও সৎ চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি। তারা এও জানতো যে, নবুওয়াত দাবী করার একদিন আগে পর্যন্তও কেউ তার মুখ থেকে কখনো সেসব কথা শোনেননি যেগুলো নবুওয়াত দাবী করার পরপরই তিনি সহসাই বলতে শুরু করে দিয়েছিলেন। তারা এ কিতাবের ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গি এবং মুহাম্মাদ ﷺ এর ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গির মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য দেখতে পেতো। তারা পরিষ্কারভাবে একথাও জানতো যে, একই ব্যক্তি কখনো এত বেশি সুস্পষ্ট পার্থক্য সহকারে দু’টি ভিন্ন স্টাইলের অধিকারী হতে পারে না। তারা এ কিতাবের একান্ত অসাধারণ সাহিত্য অলংকারও দেখছিল এবং আরবী ভাষাভাষি হিসেবে তারা নিজেরাই জানতো যে, তাদের সকল কবি ও সাহিত্যিক এর নজির পেশ করতে অক্ষম হয়েছে। তাদের জাতির কবি, গণক ও বাগ্নীদের বাণী এবং এ বাণীর মধ্যে কত বড় ফারাক রয়েছে এবং এ বাণীর মধ্যে যে পবিত্র-পরিচ্ছন্ন বিষয়বস্তু বর্ণিত হয়েছে কত উন্নতমানের তাও তাদের অজানা ছিল না। তারা এ কিতাব ও এর উপস্থাপকের দাওয়াতের মধ্যে কোথাও দূরবর্তী এমন কোন স্বার্থপরতার সামান্যতম চিহ্নও দেখতে পেতো না যা থেকে কোন মিথ্যা দাবীদারের কথা ও কাজ কখনো মুক্ত হতে পারে না। নবুওয়াতের দাবী করে মুহাম্মাদ ﷺ নিজের, নিজের পরিবার অথবা নিজের গোত্র ও জাতির জন্য কি অর্জন করতে চাচ্ছিলেন এবং এ কাজের মধ্যে তার নিজের কোন স্বার্থটি নিহিত রয়েছে তা তারা অণুবীক্ষণ যন্ত্র লাগিয়েও চিহ্নিত করতে পারতো না। তারপর এ দাওয়াতের দিকে তার জাতির কেমন ধরনের লোকেরা আকৃষ্ট হয়ে চলছে এবং তার সাথে সম্পৃক্ততাদের জীবনে কতবড় বিপ্লব সাধিত হচ্ছে তাও তারা দেখছিল। এ সমস্ত বিষয় মিলে মিশে দাবীর স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তাই এ পটভূমিতে একথা বলা একদম যথেষ্ট ছিল যে, এ কিতাবের রব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত হওয়াটা সকল প্রকার সন্দেহ-সংশয়ের উর্ধ্বে। এর পাশে আরো কোন যুক্তি বসিয়ে যুক্তির বহর বৃদ্ধি করার কোন প্রয়োজন ছিল না।

অনুবাদ: