পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

২০২ আয়াত

৩ ) ব্যভিচারী যেন ব্যভিচারিনী বা মুশরিক নারী ছাড়া কাউকে বিয়ে না করে এবং ব্যভিচারিনীকে যেন ব্যভিচারী বা মুশরিক ছাড়া আর কেউ বিয়ে না করে। আর এটা হারাম করে দেয়া হয়েছে মু’মিনদের জন্য।
ٱلزَّانِى لَا يَنكِحُ إِلَّا زَانِيَةً أَوْ مُشْرِكَةًۭ وَٱلزَّانِيَةُ لَا يَنكِحُهَآ إِلَّا زَانٍ أَوْ مُشْرِكٌۭ ۚ وَحُرِّمَ ذَٰلِكَ عَلَى ٱلْمُؤْمِنِينَ ٣
৪ ) আর যারা সতী-সাধ্বী নারীর ওপর অপবাদ লাগায়, তারপর চারজন সাক্ষী আনে না, তাদেরকে আশিটি বেত্রাঘাত করো এবং তাদের সাক্ষ্য কখনো গ্রহণ করো না। তারা নিজেরাই ফাসেক।
وَٱلَّذِينَ يَرْمُونَ ٱلْمُحْصَنَـٰتِ ثُمَّ لَمْ يَأْتُوا۟ بِأَرْبَعَةِ شُهَدَآءَ فَٱجْلِدُوهُمْ ثَمَـٰنِينَ جَلْدَةًۭ وَلَا تَقْبَلُوا۟ لَهُمْ شَهَـٰدَةً أَبَدًۭا ۚ وَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْفَـٰسِقُونَ ٤
৫ ) তবে যারা এরপর তাওবা করে এবং শুধরে যায়, অবশ্যই আল্লাহ‌ (তাদের পক্ষে) ক্ষমাশীল ও মেহেরবান।
إِلَّا ٱلَّذِينَ تَابُوا۟ مِنۢ بَعْدِ ذَٰلِكَ وَأَصْلَحُوا۟ فَإِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٌۭ رَّحِيمٌۭ ٥
৬ ) আর যারা নিজেদের স্ত্রীদেরকে অভিযোগ দেয় এবং তাদের কাছে তারা নিজেরা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন সাক্ষী থাকে না, তাদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তির সাক্ষ্য হচ্ছে (এই যে, সে) চার বার আল্লাহর নামে কসম খেয়ে সাক্ষ্য দেবে যে, সে (নিজের অভিযোগে) সত্যবাদী
وَٱلَّذِينَ يَرْمُونَ أَزْوَٰجَهُمْ وَلَمْ يَكُن لَّهُمْ شُهَدَآءُ إِلَّآ أَنفُسُهُمْ فَشَهَـٰدَةُ أَحَدِهِمْ أَرْبَعُ شَهَـٰدَٰتٍۭ بِٱللَّهِ ۙ إِنَّهُۥ لَمِنَ ٱلصَّـٰدِقِينَ ٦
৭ ) এবং পঞ্চম বার বলবে, তার প্রতি আল্লাহ‌র লা’নত হোক যদি সে (নিজের অভিযোগে) মিথ্যাবাদী হয়ে থাকে।
وَٱلْخَـٰمِسَةُ أَنَّ لَعْنَتَ ٱللَّهِ عَلَيْهِ إِن كَانَ مِنَ ٱلْكَـٰذِبِينَ ٧
৮ ) আর স্ত্রীর শাস্তি এভাবে রহিত হতে পারে যদি সে চার বার আল্লাহ‌র নামে কসম খেয়ে সাক্ষ্য দেয় যে, এ ব্যক্তি (তার অভিযোগে) মিথ্যাবাদী
وَيَدْرَؤُا۟ عَنْهَا ٱلْعَذَابَ أَن تَشْهَدَ أَرْبَعَ شَهَـٰدَٰتٍۭ بِٱللَّهِ ۙ إِنَّهُۥ لَمِنَ ٱلْكَـٰذِبِينَ ٨
৯ ) এবং পঞ্চমবার বলে, তার নিজের ওপর আল্লাহর গজব নেমে আসুক যদি এ ব্যক্তি (তার অভিযোগে) সত্যবাদী হয়।
وَٱلْخَـٰمِسَةَ أَنَّ غَضَبَ ٱللَّهِ عَلَيْهَآ إِن كَانَ مِنَ ٱلصَّـٰدِقِينَ ٩
১০ ) তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর দয়া না থাকলে এবং আল্লাহ বড়ই মনোযোগ দানকারী ও জ্ঞানী না হলে (স্ত্রীদের প্রতি অভিযোগের ব্যাপারে তোমাদেরকে বড়ই জটিলতার সম্মুখীন করতো) ।
وَلَوْلَا فَضْلُ ٱللَّهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُۥ وَأَنَّ ٱللَّهَ تَوَّابٌ حَكِيمٌ ١٠
১১ ) যারা এ মিথ্যা অপবাদ তৈরী করে এনেছে তারা তোমাদেরই ভিতরের একটি অংশ। এ ঘটনাকে নিজেদের পক্ষে খারাপ মনে করো না বরং এও তোমাদের জন্য ভালই। ১০ যে এর মধ্যে যতটা অংশ নিয়েছে সে ততটাই গোনাহ কামাই করেছে আর যে ব্যক্তি এর দায়-দায়িত্বের বড় অংশ নিজের মাথায় নিয়েছে ১১ তার জন্য তো রয়েছে মহাশাস্তি।
إِنَّ ٱلَّذِينَ جَآءُو بِٱلْإِفْكِ عُصْبَةٌۭ مِّنكُمْ ۚ لَا تَحْسَبُوهُ شَرًّۭا لَّكُم ۖ بَلْ هُوَ خَيْرٌۭ لَّكُمْ ۚ لِكُلِّ ٱمْرِئٍۢ مِّنْهُم مَّا ٱكْتَسَبَ مِنَ ٱلْإِثْمِ ۚ وَٱلَّذِى تَوَلَّىٰ كِبْرَهُۥ مِنْهُمْ لَهُۥ عَذَابٌ عَظِيمٌۭ ١١
১২ ) যখন তোমরা এটা শুনেছিলে তখনই কেন মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারীরা নিজেদের সম্পর্কে সুধারণা করেনি ১২ এবং কেন বলে দাওনি এটা সুস্পষ্ট মিথ্যা দোষারোপ? ১৩
لَّوْلَآ إِذْ سَمِعْتُمُوهُ ظَنَّ ٱلْمُؤْمِنُونَ وَٱلْمُؤْمِنَـٰتُ بِأَنفُسِهِمْ خَيْرًۭا وَقَالُوا۟ هَـٰذَآ إِفْكٌۭ مُّبِينٌۭ ١٢
৫.
অর্থাৎ অ-তাওবাকারী ব্যভিচারীর জন্য ব্যভিচারিণীই উপযোগী অথবা মুশরিক নারী। কোন সৎ মু’মিন নারীর জন্য সে মোটেই উপযোগী পুরুষ নয়। আর মু’মিনদের জন্য জেনে বুঝে নিজেদের মেয়েদেরকে এ ধরনের অসচ্চরিত্র লোকদের হাতে সোপর্দ করা হারাম। এভাবে যিনাকারীনী (অ-তাওবাকারী) মেয়েদের জন্য তাদেরই মতো যিনাকারীরা অথবা মুশরিকরাই উপযোগী। সৎ মু’মিনদের জন্য তারা মোটেই উপযোগী নয়। যেসব নারীর চরিত্রহীনতার কথা মু’মিনরা জানে তাদেরকে বিয়ে করা তাদের জন্য হারাম। যে সমস্ত পুরুষ ও নারী তাদের চরিত্রহীনতার পথে গা ভাসিয়ে দিয়েছে একমাত্র তাদের জন্য এ নিয়ম প্রযোজ্য। তবে যারা তাওবা করে নিজেদের সংশোধন করে নিয়েছে তাদের জন্য এটা প্রযোজ্য নয়। কারণ তাওবা ও সংশোধনের পর “যিনাকারী” হবার দোষ আর তাদের জন্য প্রযুক্ত হয় না।

যিনাকারীর সাথে বিয়ে হারাম হবার অর্থ ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল এ নিয়েছেন যে, আদতে তার সাথে বিয়ে অনুষ্ঠিতই হয় না। কিন্তু এক্ষেত্রে সঠিক কথা হচ্ছে, এর অর্থ নিছক নিষেধাজ্ঞা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধাচরণ করে যদি কেউ বিয়ে করে তাহলে আইনগতভাবে তা বিয়েই হবে না এবং এ বিয়ে সত্ত্বেও উভয় পক্ষকে যিনাকারী গণ্য করতে হবে একথা ঠিক নয়। নবী ﷺ একটি সার্বজনীন নিয়ম হিসেবে বলেনঃ الحرام لايحرم الحلال “হারাম হালালকে হারাম করে দেয় না।” (তাবারানী ও দারুকুতনী) অর্থাৎ একটি বেআইনী কাজ অন্য একটি আইনসঙ্গত কাজকে বেআইনী করে দেয় না। কাজেই কোন ব্যক্তির যিনা করার কারণে সে যদি বিয়েও করে তাহলে তা তাকে যিনায় পরিণত করে দিতে পারে না এবং বিবাহ চুক্তির দ্বিতীয় পক্ষ যে ব্যভিচারী নয় সেও ব্যভিচারী গণ্য হবে না। নীতিগতভাবে বিদ্রোহ ছাড়া কোন অপরাধ এমন নেই, যা অপরাধ সম্পাদনকারীকে নিষিদ্ধ ব্যক্তিতে (Outlaw) পরিণত করে। যার পরে তার কোন কাজই আইনসঙ্গত হতে পারে না। এ বিষয়টি সামনে রেখে যদি আয়াত সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা যায়, তাহলে আসল উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে এই মনে হয় যে, যাদের ব্যভিচারী চরিত্র জনসমক্ষে পরিচিত তাদেরকে বিয়ে করার জন্য নির্বাচিত করা একটি গোনাহর কাজ। মু’মিনদের এ গোনাহ থেকে দূরে থাকা উচিত। কারণ এর মাধ্যমে ব্যভিচারীদের হিম্মত বাড়িয়ে দেয়া হয়। অথচ শরীয়াত তাদেরকে সমাজের অবাঞ্ছিত ও ঘৃণ্য জীব গণ্য করতে চায়।

অনুরূপভাবে এ আয়াত থেকে এ সিদ্ধান্তও টানা যায় না যে, যিনাকারী মুসলিম পুরুষের বিয়ে মুশরিক নারীর সাথে এবং যিনাকারীনী মুসলিম নারীর বিয়ে মুশরিক পুরুষের সাথে সঠিক হবে। আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে একথা বলা যে, যিনা একটি চরম নিকৃষ্ট কুকর্ম। যে ব্যক্তি মুসলমান হয়েও এ কাজ করে সে মুসলিম সমাজের সৎ ও পাক-পবিত্র লোকদের সাথে আত্মীয় সম্পর্ক গড়ে তোলার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। তার নিজের মতো যিনাকারীদের সাথেই আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত অথবা মুশরিকদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত, যারা আদৌ আল্লাহর বিধানের প্রতি বিশ্বাসই রাখে না।

এ প্রসঙ্গে নবী ﷺ থেকে যেসব হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে সেগুলোই আসলে আয়াতের সঠিক অর্থ প্রকাশ করে। মুসনাদে আহমাদ ও নাসাঈতে আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আসের (রাঃ) রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, উম্মে মাহ্যাওল নামে একটি মেয়ে পতিতাবৃত্তি অবলম্বন করেছিল। এক মুসলমান তাকে বিয়ে করতে চায় এবং এজন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে অনুমতি চায়। তিনি নিষেধ করে এ আয়াতটি পড়েন। তিরমিযী ও আবু দাউদে বলা হয়েছে, মারসাদ ইবনে আবি মারসাদ একজন সাহাবী ছিলেন। জাহেলী যুগে মক্কার ঈনাক নামক এক ব্যভিচারিণীর সাথে তার অবৈধ সম্পর্ক ছিল। পরে তিনি তাকে বিয়ে করার ইচ্ছা করেন এবং রসূলুল্লাহর ﷺ কাছে অনুমতি চান। দু’বার জিজ্ঞেস করার পরও তিনি নীরব থাকেন। আবার তৃতীয়বার জিজ্ঞেস করেন, এবার তিনি জবাব দেনঃ

يا مرثد الزَّانِى لاَ يَنْكِحُ إِلاَّ زَانِيَةً أَوْ مُشْرِكَةً فلاَ يَنْكِحُهَا “হে মারসাদ! ব্যভিচারী এক ব্যভিচারিণী বা মুশরিক নারী ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না, কাজেই তাকে বিয়ে করো না।”

এছাড়াও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) ও হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির (রাঃ) থেকেও বিভিন্ন হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। সেগুলোতে বলা হয়েছে, নবী ﷺ বলেছেনঃ “কোন দাইয়ুস (অর্থাৎ যে ব্যক্তি জানে তার স্ত্রী ব্যভীচারিনী এবং এরপরও সে তার স্বামী থাকে) জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে না।” (আহমাদ, নাসাঈ, আবু দাউদ) প্রথম দুই খলীফা হযরত আবু বকর (রাঃ) ও হযরত উমর (রাঃ) উভয়ই এ ব্যাপারে যে পদ্ধতি অবলম্বন করেন তা ছিল এই যে, তাঁদের আমলে যে অবিবাহিত পুরুষ ও নারী যিনার অভিযোগে গ্রেফতার হতো তাদেরকে তাঁরা প্রথমে বেত্রাঘাতের শাস্তি দিতেন তারপর তাদেরকেই পরস্পরের সাথে বিয়ে দিয়ে দিতেন। ইবনে উমর (রাঃ) বর্ণনা করেন, একদিন এক ব্যক্তি বড়ই পেরেশান অবস্থায় হযরত আবু বকরের (রাঃ) কাছে আসে। সে এমনভাবে কথা বলতে থাকে যেন তার মুখে কথা ভালভাবে ফুটছিল না। হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত উমরকে (রাঃ) বলেন ওকে অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়ে একান্তে জিজ্ঞেস করুন ব্যাপারখানা কি? হযরত উমর (রাঃ) জিজ্ঞেস করতে সে বলে, তাদের বাড়িতে মেহমান হিসেবে এক ব্যক্তি এসেছিল। সে তার মেয়ের সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে বসেছে। হযরত উমর (রাঃ) বলেনঃ قَبَّحَكِ اللَّهُ الا سترت على ابْنَتَكَ “তোমার মন্দ হোক, তুমি নিজের মেয়ের আবরণ ঢেকে দিলে না? ” শেষ পর্যন্ত পুরুষটি ও মেয়েটির বিরুদ্ধে মামলা চলে। উভয়কে বেত্রাঘাতের শাস্তি দেয়া হয়। তারপর উভয়কে পরস্পরের সাথে বিয়ে দিয়ে হযরত আবু বকর (রাঃ) এক বছরের জন্য তাদেরকে দেশান্তর করেন। এ ধরনেরই আরো কয়েকটি ঘটনা কাযী আবু বকর ইবনুল আরাবী তাঁর আহকামুল কুরআন গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন (পৃষ্ঠা ৮৬, ২য় খণ্ড)।

.
৬.
এ হুকুমটির উদ্দেশ্য হচ্ছে, সমাজে লোকদের গোপন প্রণয় ও অবৈধ সম্পর্কের আলোচনা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়া। কারণ এর মাধ্যমে অসংখ্য অসৎকাজ, অসৎবৃত্তি ও অসৎ প্রবণতার প্রসার ঘটে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অসৎবৃত্তিটি হলো, এভাবে সবার অলক্ষ্যে একটি ব্যভিচারমূলক পরিবেশ তৈরী হয়ে যেতে থাকে। একজন নিছক কৌতুকের বশে কারোর সত্য বা মিথ্যা কুৎসিত ঘটনাবলী অন্যের সামনে বর্ণনা করে বেড়ায়। অন্যেরা তাতে লবণ মরিচ মাখিয়ে লোকদের সামনে পরিবেশন করতে থাকে এবং এ সঙ্গে আরো কিছু লোকের ব্যাপারেও নিজেদের বক্তব্য বা কু-ধারণা বর্ণনা করে। এভাবে কেবলমাত্র যৌন কামনা-বাসনার একটি ব্যাপক ধারাই প্রবাহিত হয় না বরং খারাপ প্রবণতার অধিকারী নারী-পুরুষরা জানতে পারে যে, সমাজের কোথায় কোথায় অবৈধ সুযোগ-সুবিধা লাভ করতে পারবে। শরীয়াত প্রথম পদক্ষেপেই এ জিনিসটির পথ রোধ করতে চায়। একদিকে সে হুকুম দেয়, যদি কেউ যিনা করে এবং সাক্ষী-সাবুদের মাধ্যমে তার যিনা প্রমাণিত হয় তাহলে তাকে এমন চরম শাস্তি দাও যা কোন অপরাধে দেয়া হয় না। আবার অন্যদিকে সে ফায়সালা করে, যে ব্যক্তি অন্যের বিরুদ্ধে যিনার অভিযোগ আনে সে সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে নিজের অভিযোগ প্রমাণ করবে আর যদি প্রমাণ করতে না পারে তাহলে তাকে আশি ঘা বেত্রাঘাত করো, যাতে ভবিষ্যতে আর সে কখনো এ ধরনের কোন কথা বিনা প্রমাণে নিজের মুখ থেকে বের করার সাহস না করে। ধরে নেয়া যাক যদি অভিযোগকারী কাউকে নিজের চোখে ব্যভিচার করতে দেখে তাহলেও তার নীরব থাকা উচিত এবং অন্যদের কাছে একথা না বলা উচিত ফলে ময়লা যেখানে আছে সেখানেই পড়ে থাকবে এবং আশেপাশে ছড়িয়ে যেতে পারবে না। তবে তার কাছে যদি সাক্ষী থাকে তাহলে সমাজে আজেবাজে কথা ছড়াবার পরিবর্তে বিষয়টি শাসকদের কাছে নিয়ে যেতে হবে এবং আদালতে অভিযুক্তের অপরাধ প্রমাণ করে তাকে শাস্তি দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।

এ আইনটি পুরোপুরি অনুধাবন করার জন্য এর বিস্তারিত বিষয়াবলী দৃষ্টি সমক্ষে থাকা উচিত। তাই আমি নীচে এর বিস্তারিত বর্ণনা দিচ্ছিঃ

একঃ আয়াতে وَالَّذِينَ يَرْمُونَ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ হয় “যেসব লোক অপবাদ দেয়।” কিন্তু পূর্বাপর আলোচনা বলে, এখানে অপবাদ মানে সব ধরনের অপবাদ নয় বরং বিশেষভাবে যিনার অপবাদ। প্রথমে যিনার বিধান বর্ণনা করা হয়েছে এবং সামনের দিকে আসছে “লি’আন”-এর বিধান। এ দু’য়ের মাঝখানে এ বিধানটির আসা পরিষ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে এখানে অপবাদ বলতে কোন্ ধরনের অপবাদ বুঝানো হয়েছে। তারপর يَرْمُونَ الْمُحْصَنَاتِ (অপবাদ দেয় সতী মেয়েদেরকে) থেকেও এ মর্মে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, এখানে এমন অপবাদের কথা বলা হয়েছে যা সতীত্ব বিরোধী। তাছাড়া অপবাদদাতাদের কাছে তাদের অপবাদের প্রমাণস্বরূপ চারজন সাক্ষী আনার দাবী করা হয়েছে। সমগ্র ইসলামী আইন ব্যবস্থায় একমাত্র যিনার সাক্ষ্যদাতাদের জন্য চারজনের সংখ্যা রাখা হয়েছে। এসব প্রমাণের ভিত্তিতে সমগ্র উম্মতের আলেম সমাজের মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, এ আয়াতে শুধুমাত্র যিনার অপবাদের বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। এজন্য উলামায়ে কেরাম স্বতন্ত্র পারিভাষিক শব্দ “কাযাফ” নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যাতে অন্যান্য অপবাদসমূহ (যেমন কাউকে চোর, শরাবী, সূদখোর বা কাফের বলা) এ বিধানের আওতায় এসে না পড়ে। “কাযাফ” ছাড়া অন্য অপবাদসমূহের শাস্তি কাজী নিজেই নির্ধারণ করতে পারেন অথবা দেশের মজলিসে শূরা প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের জন্য অপমান বা মানহানির কোন সাধারণ আইন তৈরী করতে পারেন।

দুইঃ আয়াতে يَرْمُونَ الْمُحْصَنَاتِ (সতী নারীদেরকে অপবাদ দেয়) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু ফকীহগণ এ ব্যাপারে একমত যে, শুধুমাত্র নারীদেরকে অপবাদ দেয়া পর্যন্ত এ বিধানটি সীমাবদ্ধ নয় বরং নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী পুরুষদেরকে অপবাদ দিলেও এ একই বিধান কার্যকর হবে। এভাবে যদিও অপবাদদাতাদের জন্য الَّذِينَ يَرْمُونَ (যারা অপবাদ দেয়) পুরুষ নির্দেশক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তবুও এর মাধ্যমে শুধুমাত্র পুরুষদেরকেই নির্দেশ করা হয়নি বরং মেয়েরাও যদি “কাযাফ”-এর অপরাধ করে তাহলে তারাও এ একই বিধানের আওতায় শাস্তি পাবে। কারণ অপরাধের ব্যাপারে অপবাদদাতা ও যাকে অপবাদ দেয়া হয় তাদের পুরুষ বা নারী হলে কোন পার্থক্য দেখা দেয় না। কাজেই আইনের আকৃতি হবে এ রকম--- যে কোন পুরুষ ও নারী কোন নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী পুরুষ ও নারীর ওপর যিনার অপবাদ চাপিয়ে দেবে তার জন্য হবে এ আইন (উল্লেখ্য, এখানে “মুহসিন” ও “মুহসিনা” মানে বিবাহিত পুরুষ ও নারী নয় বরং নিষ্কলুষ চরিত্র সম্পন্ন পুরুষ ও নারী)।

তিনঃ অপবাদদাতা যখন কোন নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী পুরুষ ও নারীর বিরুদ্ধে এ অপবাদ দেবে একমাত্র তখনই এ আইন প্রযোজ্য হবে। কোন কলঙ্কযুক্ত ও দাগী চরিত্র সম্পন্ন পুরুষ ও নারীর বিরুদ্ধে অপবাদ দিলে এটি প্রযুক্ত হতে পারে না। দুশ্চরিত্র বলে পরিচিত ব্যক্তি যদি ব্যভিচারী হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে “অপবাদ” দেবার প্রশ্নই ওঠে না কিন্তু যদি সে এমন না হয়, তাহলে তার ওপর প্রমাণ ছাড়াই অপবাদদাতার জন্য কাজী নিজেই শাস্তি নির্ধারণ করতে পারেন অথবা এ ধরনের অবস্থার জন্য মজলিসে শূরা প্রয়োজন অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করতে পারে।

চারঃ কোন মিথ্যা অপবাদ (কাযাফ) দেয়ার কাজটি শাস্তিযোগ্য হবার জন্য শুধুমাত্র এতটুকুই যথেষ্ট নয় যে, একজন অন্য জনের ওপর কোন প্রমাণ ছাড়াই ব্যভিচার করার অপবাদ দিয়েছে। বরং এজন্য কিছু শর্ত অপবাদদাতার মধ্যে, কিছু শর্ত যাকে অপবাদ দেয়া হচ্ছে তার মধ্যে এবং কিছু শর্ত স্বয়ং অপবাদ কর্মের মধ্যে থাকা অপরিহার্য।

অপবাদদাতার মধ্যে যে শর্তগুলো থাকতে হবে সেগুলো হচ্ছেঃ প্রথমত তাকে প্রাপ্ত বয়স্ক হতে হবে। শিশু যদি অপবাদ দেবার অপরাধ করে তাহলে তাকে আইন–শৃঙ্খলা বিধানমূলক (তা’যীর) শাস্তি দেয়া যেতে পারে। কিন্তু তার ওপর শরিয়াতী শাস্তি (হদ) জারি হতে পারে না। দ্বিতীয়ত তাকে মানসিকভাবে সুস্থ হতে হবে। পাগলের ওপর “কাযাফের” শাস্তি জারি হতে পারে না। অনুরূপভাবে হারাম নেশা ছাড়া অন্য কোন ধরনের নেশাগ্রস্ত অবস্থায় যেমন ক্লোরোফরমের প্রভাবাধীন অপবাদদাতাকেও অপরাধী গণ্য করা যেতে পারে না। তৃতীয়ত সে নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় (ফকীহগণের পরিভাষায় ‘তায়েআন’) এ কাজ করবে। কারোর বল প্রয়োগে অপবাদদানকারীকে অপরাধী গণ্য করা যেতে পারে না। চতুর্থত সে, যাকে অপবাদ দেয়া হচ্ছে তার নিজের বাপ বা দাদা নয়। কারণ তাদের ওপর অপবাদের হদ জারি হতে পারে না। এগুলো ছাড়া হানাফীদের মতে পঞ্চম আর একটি শর্তও আছে। সেটি হচ্ছে, সে বাকশক্তি সম্পন্ন হবে, বোবা হবে না। বোবা যদি ইশারা ইঙ্গিতে অপবাদ দেয় তাহলে তার ফলে অপবাদের শাস্তি ওয়াজিব হয়ে যাবে না। ইমাম শাফেঈ এ থেকে ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি বলেন যদি বোবার ইশারা একেবারেই সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন হয় এবং তা দেখে সে কি বলতে চায় তা লোকেরা বুঝতে পারে, তাহলে তো সে অপবাদদাতা। কারণ তার ইশারা এক ব্যক্তিকে লাঞ্ছিত ও বদনাম করে দেবার ক্ষেত্রে কথার মাধ্যমে প্রকাশ করার তুলনায় কোন অংশে কম নয়। পক্ষান্তরে হানাফীদের মতে নিছক ইশারার মাধ্যমে বক্তব্য প্রকাশ এত বেশী শক্তিশালী নয়, যার ভিত্তিতে এক ব্যক্তিকে ৮০ ঘা বেত্রাঘাতের শাস্তি দেয়া যেতে পারে। তারা তাকে শুধুমাত্র দমনমূলক (তা’যীর) শাস্তি দেবার পক্ষপাতী।

যাকে ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া হয় তার মধ্যেও নিম্নোক্ত শর্তগুলো পাওয়া যেতে হবে। প্রথমত তাকে বুদ্ধি সচেতন হতে হবে। অর্থাৎ তার ওপর এমন অবস্থায় যিনা করার অপবাদ দেয়া হয় যখন সে বুদ্ধি সচেতন ছিল। পাগলের প্রতি (পরে সে বুদ্ধি সচেতন হয়ে গিয়ে থাক বা না থাক) যিনা করার অপবাদদানকারী ‘কাযাফ’-এর শাস্তি লাভের উপযুক্ত নয়। কারণ পাগল তার নিজের চারিত্রিক নিষ্কলুষতা সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করতে পারে না। আর তার বিরুদ্ধে যিনা করার সাক্ষ্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেও সে যিনার শাস্তির উপযুক্ত হয় না এবং তার মর্যাদাও ক্ষুণ্ণ হয় না। কাজেই তার প্রতি অপবাদদানকারীরও কাযাফের শাস্তি লাভের যোগ্য হওয়া উচিত নয়। কিন্তু ইমাম মালেক ও ইমাম লাইস ইবনে সা’দ বলেন, পাগলের প্রতি ব্যভিচারের অপবাদদানকারী কাযাফের শাস্তি লাভের যোগ্য। কারণ সে একটি প্রমাণ বিহীন অপবাদ দিচ্ছে, এতে সন্দেহ নেই। দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, তাকে প্রাপ্ত বয়স্ক হতে হবে। অর্থাৎ প্রাপ্ত বয়স্ক অবস্থায় তার ওপর যিনা করার অপবাদ দেয়া হয়। শিশুর বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া অথবা যুবকের বিরুদ্ধে এ মর্মে অপবাদ দেয়া যে, সে শৈশবে এ কাজ করেছিল, এ ধরনের অপবাদের ফলে ‘কাযাফ’-এর শাস্তি ওয়াজিব হয় না। কারণ পাগলের মত শিশুও নিজের চারিত্রিক নিষ্কলুষতা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে না। ফলে কাযাফ-এর শাস্তি তার ওপর ওয়াজিব হয় না এবং তার মান-সম্মানও নষ্ট হয় না। কিন্ত ইমাম মালেক বলেন, যে ছেলে প্রাপ্ত বয়স্কের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে তার বিরুদ্ধে যদি যিনা করার অপবাদ দেয়া হয় তাহলে তো অপবাদ দানকারীর ওপর কাযাফ-এর শাস্তি ওয়াজিব হবে না কিন্তু যদি একই বয়সের মেয়ের ওপর যিনা করার অভিযোগ আনা হয় যার সাথে সহবাস করা সম্ভব, তাহলে তার প্রতি অপবাদদানকারী কাযাফ-এর শাস্তি লাভের যোগ্য। কারণ এর ফলে কেবলমাত্র মেয়েরই নয় বরং তার পরিরবারেরও মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয় এবং মেয়ের ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে যায়। তৃতীয় শর্ত হচ্ছে, তাকে মুসলমান হতে হবে। অর্থাৎ মুসলিম থাকা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে যিনা করার অপবাদ দেয়া হয়। কাফেরের বিরুদ্ধে এ অপবাদ অথবা মুসলিমের বিরুদ্ধে এ অপবাদ যে, সে কাফের থাকা অবস্থায় এ কাজ করেছিল, তার জন্য কাযাফ-এর শাস্তি ওয়াজিব করে দেয় না। চতুর্থ শর্ত হচ্ছে, তাকে স্বাধীন হতে হবে। বাঁদি বা গোলামের বিরুদ্ধে এ অপবাদ অথবা স্বাধীনের বিরুদ্ধে এ অপবাদ যে, সে গোলাম থাকা অবস্থায় এ কাজ করেছিল, তার জন্য কাযাফ-এর শাস্তি ওয়াজিব করে দেয় না। কারণ গোলামীর অসহায়তা ও দুর্বলতার দরুন তার পক্ষে নিজের চারিত্রিক নিষ্কলুষতার ব্যবস্থা করা সম্ভব নাও হতে পারে। স্বয়ং কুরআনই গোলামীর অবস্থাকে ‘ইহ্সান’ তথা পূর্ণ বিবাহিত অবস্থা গণ্য করেনি। তাই সূরা নিসায় শব্দটি বাঁদীর প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু দাউদ যাহেরী এ যুক্তি মানেন না। তিনি বলেন, বাঁদি ও গোলামের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদদানকারীও কাযাফ-এর শাস্তি লাভের যোগ্য। পঞ্চম শর্ত হচ্ছে, তাকে নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। অর্থাৎ তার জীবন যিনা ও যিনাসদৃশ চালচলন থেকে মুক্ত হবে। যিনা মুক্ত হবার অর্থ হচ্ছে, সে বাতিল বিবাহ, গোপন বিবাহ, সন্দেহযুক্ত মালিকানা বা বিবাহ সদৃশ যৌন সঙ্গম করেনি। তার জীবন যাপন এমন ধরনের নয় যেখানে তার বিরুদ্ধে চরিত্রহীনতা ও নির্লজ্জ বেহায়াপনার অভিযোগ আনা যেতে পারে এবং যিনার চেয়ে কম পর্যায়ের চরিত্রহীনতার অভিযোগ তার প্রতি ইতিপূর্বে কখনো প্রমাণিত হয়নি। কারণ এসব ক্ষেত্রেই তার চারিত্রিক নিষ্কলুষতা ক্ষুণ্ণ হয়ে যায় এবং এ ধরনের অনিশ্চিত নিষ্কলুষতার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনকারী ৮০ ঘা বেত্রাঘাতের শাস্তি লাভের যোগ্য হতে পারে না। এমন কি যদি ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদের (কাযাফ) শাস্তি জারি হবার আগে যার প্রতি অপবাদ দেয়া হয় তার বিরুদ্ধে কখনো কোন যিনার অপরাধের সাক্ষ্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়ে থাকে তাহলেও মিথ্যা অপবাদদানকারীকে ছেড়ে দেয়া হবে। কারণ যার প্রতি সে অপবাদ আরোপ করেছিল সে নিষ্কলুষ থাকেনি।

কিন্তু এ পাঁচটি ক্ষেত্রে শরীয়াত নির্ধারিত শাস্তি (হদ্) জারি না হবার অর্থ এ নয় যে, পাগল, শিশু, কাফের, গোলাম বা অনিষ্কলুষ ব্যক্তির প্রতি প্রমাণ ছাড়াই যিনার অপবাদ আরোপকারী দমনমূলক (তা’যীর) শাস্তি লাভের যোগ্য হবে না।

এবার স্বয়ং মিথ্যা অপবাদ কর্মের মধ্যে যেসব শর্ত পাওয়া যেতে হবে সেগুলোর আলোচনায় আসা যাক। একটি অভিযোগকে দু’টি জিনিসের মধ্য থেকে কোন একটি জিনিস মিথ্যা অপবাদে পরিণত করতে পারে। এক, অভিযোগকারী অভিযুক্তের ওপর এমন ধরনের নারী সঙ্গমের অপবাদ দিয়েছে যা সাক্ষ্যের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়ে গেলে অভিযুক্ত ব্যক্তির ওপর যিনার শাস্তি ওয়াজিব হবে যাবে। দুই, অথবা সে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জারজ সন্তান গণ্য করেছে। কিন্তু উভয় অবস্থায়ই এ অপবাদটি পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট হতে হবে। ইশারা-ইঙ্গিত গ্রহণযোগ্য নয়। এর সাহায্যে যিনা বা বংশের নিন্দার অর্থ গ্রহণ করা মিথ্যা অপবাদদাতার নিয়তের ওপর নির্ভরশীল হয়। যেমন কাউকে ফাসেক, পাপী, ব্যভিচারী বা দুশ্চরিত্র ইত্যাদি বলে দেয়া অথবা কোন মেয়েকে বেশ্যা, কস্বী বা ছিনাল বলা কিংবা কোন সৈয়দকে পাঠান বলে দেয়া--- এসব ইশারা হয়। এগুলোর মাধ্যমে দ্ব্যর্থহীন মিথ্যা অপবাদ প্রমাণ হয় না। অন্যরূপভাবে যেসব শব্দ নিছক গালাগালি হিসেবে ব্যবহার হয়, যেমন হারামি বা হারামজাদা ইত্যাদিকেও সুস্পষ্ট মিথ্যা অপবাদ গণ্য করা যেতে পারে না। তবে ‘তা’রীয’ (নিজের প্রতি আপত্তিকর বক্তব্য অস্বীকৃতির মাধ্যমে অন্যকে খোঁটা দেয়া) এর ব্যাপারে ফকীহগণের মধ্যে এটাও অপবাদ কিনা এ ব্যাপারে মতবিরোধ আছে। যেমন কেউ অন্যকে সম্বোধন করে বলে, “হ্যাঁ, কিন্তু আমি তো আর যিনাকারী নই” অথবা “আমার মা তো আর যিনা করে আমাকে জন্ম দেয়নি।” ইমাম মালেক বলেন, এমন কোন “তা’রীয” “কাযাফ” বা যিনার মিথ্যা অপবাদ হিসেবে গণ্য হবে যা থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়, প্রতিপক্ষকে যিনাকারী বা জারজ সন্তান গণ্য করাই বক্তার উদ্দেশ্য। এ অবস্থায় “হদ” বা কাযাফ-এর শাস্তি ওয়াজিব হয়ে যায়। কিন্তু ইমাম আবু হানীফা, তাঁর সাথীগণ এবং ইমাম শাফেঈ, সুফিয়ান সওরী, ইবনে শুব্রুমাহ ও হাসান ইবনে সালেহ বলেন, “তা’রীযে”র ক্ষেত্রে অবশ্যই সন্দেহের অবকাশ থাকে এবং সন্দেহ সহকারে কাযাফের শাস্তি জারি হতে পারে না। ইমাম আহমাদ ও ইসহাক ইবনে রাহ্ওয়াইহ্ বলেন, যদি ঝগড়া-বিবাদের মধ্যে “তা’রীয” করা হয়, তাহলে তা হবে ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ আর হাসি-ঠাট্টার মধ্যে করা হলে তা ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ হবে না। খলীফাগণের মধ্যে হযরত উমর (রাঃ), হযরত আলী (রাঃ) তা’রীযের জন্য কাযাফ-এর শাস্তি দেন। হযরত উমরের আমলে দু’জন লোকের মধ্যে গালিগালাজ হয়। একজন অন্য জনকে বলে, “আমার বাবাও যিনাকারী ছিল না, আমার মাও যিনাকারীনী ছিল না।” মামলাটি হযরত উমরের দরবারে পেশ হয়। তিনি উপস্থিত লোকদেরকে জিজ্ঞেস করেন, আপনারা এ থেকে কি মনে করেন? কয়েকজন বলে, “সে নিজের বাবা-মার প্রশংসা করেছে। দ্বিতীয় ব্যক্তির বাবা-মা’র উপর আক্রমণ করেনি।” আবার অন্য কয়েকজন বলে, “তার নিজের বাবা-মা’র প্রশংসা করার জন্য কি শুধু এ শব্দগুলোই রয়ে গিয়েছিল? এ বিশেষ শব্দগুলোকে এ সময় ব্যবহার করার পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে, দ্বিতীয় ব্যক্তির বাবা-মা ব্যভিচারী ছিল।” হযরত উমর (রাঃ) দ্বিতীয় দলটির সাথে একমত হন এবং ‘হদ’ জারি করেন। (জাস্সাস, ৩য় খণ্ড, ৩৩০ পৃষ্ঠা) কারোর প্রতি সমকামিতার অপবাদ দেয়া ব্যভিচারের অপবাদ কিনা এ ব্যাপারেও মতবিরোধ রয়েছে। ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মাদ, ইমাম মালেক ও ইমাম শাফেঈ একে ব্যভিচারের অপবাদ গণ্য করেন এবং ‘হদ’ জারি করার হুকুম দেন।

পাঁচঃ ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ সরাসরি সরকারী হস্তক্ষেপযোগ্য অপরাধ (Cognizable Offence) কিনা এ ব্যাপারে ফকীহগণের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। ইবনে আবী লাইলা বলেন, এটি হচ্ছে আল্লাহর হক। কাজেই যার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয়েছে সে দাবী করুক বা নাই করুক মিথ্যা অপবাদদাতার বিরুদ্ধে কাযাফ-এর শাস্তি জারি করা ওয়াজিব। কিন্তু তার বিরুদ্ধে মামলা চালানো, যার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয়েছে, তার দাবীর ওপর নির্ভর করে এবং এদিক দিয়ে এটি ব্যক্তির হক। ইমাম শাফেঈ ও ইমাম আওযাঈও এ একই মত পোষণ করেছেন। ইমাম মালেকের মতে যদি শাসকের সামনে মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয় তাহলে তা হবে সরকারী হস্তক্ষেপযোগ্য অপরাধ অন্যথায় এর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে যার বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া হয়েছে তার দাবীর ওপর নির্ভরশীল।

ছয়ঃ ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ দেবার অপরাধ, আপোসে মিটিয়ে ফেলার মতো অপরাধ (Compoundable Offence) নয়। অপবাদ আরোপিত ব্যক্তির আদালতে মামলা দায়ের না করাটা ভিন্ন ব্যাপার কিন্তু আদালতে বিষয়টি উত্থাপিত হবার পর অপবাদ দানকারীকে তার অপবাদ প্রমাণ করতে বাধ্য করা হবে। আর প্রমাণ করতে না পারলে তার ওপর ‘হদ’ জারি করা হবে। আদালত তাকে মাফ করতে পারে না, অপবাদ আরোপিত ব্যক্তিও পারে না এবং কোন প্রকার অর্থদণ্ড দিয়েও ব্যাপারটির নিষ্পত্তি করা যেতে পারে না। তাওবা করে মাফ চেয়েও সে শাস্তি থেকে রেহাই পেতে পারে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ উক্তি আগেই আলোচিত হয়েছেঃ

تَعَافَوُا الْحُدُودَ فِيمَا بَيْنَكُمْ فَمَا بَلَغَنِى مِنْ حَدٍّ فَقَدْ وَجَبَ

“অপরাধকে আপোসে মিটিয়ে দাও কিন্তু যে অপরাধের নালিশ আমার কাছে চলে এসেছে, সেটা ওয়াজিব হয়ে গেছে।”

সাতঃ হানাফীদের মতে মিথ্যা অপবাদের শাস্তি দাবী করতে পারে অপবাদ আরোপিত ব্যক্তি নিজেই অথবা যখন দাবী করার জন্য অপবাদ আরোপিত ব্যক্তি নিজে উপস্থিত নেই এমন অবস্থায় যার বংশের মর্যাদাহানি হয় সেও দাবী করতে পারে। যেমন বাবা, মা, ছেলেমেয়ে এবং ছেলেমেয়ের ছেলেমেয়েরা এ দাবী করতে পারে। কিন্তু ইমাম মালেক ও ইমাম শাফেঈর মতে এ অধিকার উত্তরাধিকার সূত্রে লাভযোগ্য। অপবাদ আরোপিত ব্যক্তি মারা গেলে তার প্রত্যেক শরয়ী উত্তরাধিকার হদ্ জারি করার দাবী জানাতে পারে। তবে আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, ইমাম শাফেঈ স্ত্রী ও স্বামীকে এর বাইরে গণ্য করছেন। এ ব্যাপারে তাঁর যুক্তি হচ্ছে, মৃত্যুর সাথে সাথেই দাম্পত্য সম্পর্ক খতম হয়ে যায় এবং এ অবস্থায় স্বামী বা স্ত্রী কোন এক জনের বিরুদ্ধে অপবাদ দিলে অন্যের বংশের কোন মর্যাদাহানি হয় না। অথচ এ দু’টি যুক্তিই দুর্বল। কারণ শাস্তি দাবী করাকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অধিকার বলে মেনে নেবার পর মৃত্যু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার দাম্পত্য সম্পর্ক খতম করে দিয়েছে বলে স্বামী ও স্ত্রী এ অধিকারটি লাভ করবে না একথা বলা স্বয়ং কুরআনের বক্তব্য বিরোধী। কারণ কুরআন এক জনের মরে যাওযার পর অন্যজনকে উত্তরাধিকারী গণ্য করেছে। আর স্বামী-স্ত্রীর মধ্য থেকে কোন একজনের বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া হলে অন্য জনের বংশের কোন মর্যাদাহানি হয় না একথাটি স্বামীর ব্যাপারে সঠিক হলেও হতে পারে কিন্তু স্ত্রীর ব্যাপারে একদম সঠিক নয়। কারণ যার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া হয় তার তো সমস্ত সন্তান-সন্ততির বংশধারাও সন্দেহযুক্ত হয়ে যায়। তাছাড়া শুধুমাত্র বংশের মর্যাদাহানির কারণে ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদের শাস্তি ওয়াজিব গণ্য করা হয়েছে, এ চিন্তাও সঠিক নয়। বংশের সাথে সাথে মান-সম্মান-ইজ্জত-আব্রুর বিরুদ্ধে প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়াও এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। সম্ভ্রান্ত পরিবারের একজন পুরুষ ও নারীর জন্য তার স্বামী বা স্ত্রীকে ব্যভিচারী বা ব্যভিচারিণী গণ্য করা কম মর্যাদাহানিকর নয়। কাজেই ব্যভিচারের মিথ্যা সাক্ষ্য দেবার দাবী যদি উত্তরাধিকারিত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে থাকে তাহলে স্বামী-স্ত্রীকে তা থেকে আলাদা করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।

আটঃ কোন ব্যক্তি ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে একথা প্রমাণ হয়ে যাবার পর কেবলমাত্র নিম্নলিখিত জিনিসটিই তাকে শাস্তি থেকে বাঁচাতে পারে। তাকে এমন চারজন সাক্ষী আনতে হবে যারা আদালতে এ মর্মে সাক্ষ্য দেবে যে, তারা অপবাদ আরোপিত জনকে অমুক পুরুষ বা মেয়ের সাথে কার্যত যিনা করতে দেখেছে। হানাফীয়াদের মতে এ চারজন সাক্ষীকে একই সঙ্গে আদালতে আসতে হবে এবং একই সঙ্গে তাদের সাক্ষ্য দিতে হবে। কারণ যদি তারা একের পর এক আসে তাহলে তাদের প্রত্যেক মিথ্যা অপবাদদাতা হয়ে যেতে থাকবে এবং তার জন্য আবার চারজন সাক্ষীর প্রয়োজন হয়ে পড়বে। কিন্তু এটি একটি দুর্বল কথা। ইমাম শাফেঈ ও উসমানুল বাত্তি এ ব্যাপারে যে কথা বলেছেন সেটিই সঠিক। তারা বলেছেন, সাক্ষীদের একসঙ্গে বা একের পর এক আসার মধ্যে কোন পার্থক্য দেখা যায় না। বরং বেশী ভাল হয় যদি অন্যান্য মামালার মতো এ মামলায় সাক্ষীরা একের পর এক আসে এবং সাক্ষ্য দেয়। হানাফীয়াদের মতে এ সাক্ষীদের “আদেল” তথ্য ন্যায়নিষ্ঠ হওয়া জরুরী নয়। যদি অপবাদদাতা চারজন ফাসেক সাক্ষীও আনে তাহলে সে মিথ্যা অপবাদের শাস্তি থেকে রেহাই পাবে এবং অপবাদ আরোপিত ব্যক্তিও যিনার শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে যাবে। কারণ সাক্ষী “আদেল” নয়। তবে কাফের, অন্ধ, গোলাম বা মিথ্যা অপবাদের অপরাধে পূর্বাহ্ণে শাস্তিপ্রাপ্ত সাক্ষী পেশ করে অপবাদদাতা শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে না। কিন্তু ইমাম শাফেঈ বলেন, অপবাদদাতা যদি ফাসেক সাক্ষী পেশ করে, তাহলে সে এবং তার সাক্ষী সবাই শরীয়াতের শাস্তির যোগ্য হবে। ইমাম মালেকও একই রায় পেশ করেন। এ ব্যাপারে হানাফীয়াদের অভিমতই নির্ভুলতার বেশী নিকটবর্তী বলে মনে হয়। সাক্ষী যদি “আদেল” (ন্যায়নিষ্ঠ) হয় অপবাদদাতা অপবাদের অপরাধ মুক্ত হয়ে যাবে এবং অপবাদ আরোপিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে যিনার অপরাধ প্রমাণিত হবে। কিন্তু সাক্ষী যদি “আদেল” না হয়, তাহলে অপবাদদাতার অপবাদ, অপবাদ আরোপিত ব্যক্তির যিনা ও সাক্ষীদের সত্যবাদিতা ও মিথ্যাচার সবাই সন্দেহযুক্ত হয়ে যাবে এবং সন্দেহের ভিত্তিতে কাউকেও শরীয়াতের শাস্তির উপযুক্ত গণ্য করা যেতে পারবে না।

নয়ঃ যে ব্যক্তি এমন সাক্ষ্য পেশ করতে সক্ষম হবে না, যা তাকে অপবাদের অপরাধ থেকে মুক্ত করতে পারে তার ব্যাপারে কুরআন তিনটি নির্দেশ দেয়ঃ এক, তাকে ৮০ ঘা বেত্রাঘাত করতে হবে। দুই, তার সাক্ষ্য কখনও গৃহীত হবে না। তিন, সে ফাসেক হিসেবে চিহ্নিত হবে। অতঃপর কুরআন বলছেঃ

إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ وَأَصْلَحُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ

“তারা ছাড়া যারা এরপর তাওবা করে ও সংশোধন করে নেয়, কেননা, আল্লাহ ক্ষমাশীল ও করুণাময়।” (আন নূর-৫)

এখানে প্রশ্ন দেখা দেয়, এখানে তাওবা ও সংশোধনের মাধ্যমে যে ক্ষমার কথা বলা হয়েছে তার সম্পর্ক ঐ তিনটি নির্দেশের মধ্য থেকে কোনটির সাথে আছে? প্রথম হুকুমটির সাথে এর সম্পর্ক নেই, এ ব্যাপারে ফকীহগণ একমত। অর্থাৎ তাওবার মাধ্যমে “হদ” তথা শরীয়াতের শাস্তি বাতিল হয়ে যাবে না এবং যে কোন অবস্থায়ই অপরাধীকে বেত্রাঘাতের শাস্তি দেয়া হবে। শেষ হুকুমটির সাথে ক্ষমার সম্পর্ক আছে, এ ব্যাপারেও সকল ফকীহ একমত। অর্থাৎ তাওবা করার ও সংশোধিত হবার পর অপরাধী ফাসেক থাকবে না। আল্লাহ তাকে মাফ করে দেবেন। (এ ব্যাপারে অপরাধী শুধুমাত্র মিথ্যা অপবাদ দেবার কারণেই ফাসেক হয়, না আদালতের ফায়সালা ঘোষিত হবার পর ফাসেক হিসেবে গণ্য হয়, সে ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে। ইমাম শাফেঈ ও লাইস ইবনে সাদের মতে, মিথ্যা অপবাদ দেবার কারণেই ফাসেক হয়। এ কারণে তাঁরা সে সময় থেকেই তাকে প্রত্যাখ্যাত সাক্ষী গণ্য করেন। বিপরীতপক্ষে ইমাম আবু হানীফা, তাঁর সহযোগীগণ ও ইমাম মালেক বলেন, আদালতের ফায়সালা জারি হবার পর সে ফাসেক হয়। তাই তাঁরা হুকুম জারি হবার পূব পর্যন্ত তাকে গ্রহণযোগ্য সাক্ষী মনে করেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, অপরাধীর আল্লাহর কাছে ফাসেক হওয়ার ব্যাপারটি মিথ্যা অপবাদ দেবার ফল এবং তার মানুষের কাছে ফাসেক হওয়ার বিষয়টি আদালতে তার অপরাধ প্রমাণিত হওয়া এবং তার শাস্তি পাওয়ার ওপর নির্ভর করে।) এখন থেকে যায় মাঝখানের হুকুমটি অর্থাৎ “মিথ্যা অপবাদদাতার সাক্ষ্য কখনো গ্রহণ করা হবে না।” إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا বাক্যাংশটির সম্পর্ক এ হুকুমটির সাথে আছে কিনা এ ব্যাপারে ফকীহগণের অভিমত ব্যাপকভাবে বিভক্ত হয়ে গেছে। একদল বলেন, কেবলমাত্র শেষ হুকুমটির সাথে এ বাক্যাংশটির সম্পর্ক আছে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি তাওবা ও সংশোধন করে নেবে সে আল্লাহর সমীপে এবং মানুষের কাছেও ফাসেক থাকবে না। কিন্তু এ সত্ত্বে প্রথম দু’টি হকুম অপরিবর্তিত থাকবে। অর্থাৎ অপরাধীর বিরুদ্ধে শরীয়াতের শাস্তি জারি করা হবে এবং তার সাক্ষ্যও চিরকাল প্রত্যাখ্যাত থাকবে। এ দলের রয়েছেন কাযী শুরাইহ, সাঈদ ইবনে মুসাইয়েব, সাঈদ ইবনে জুবাইর, হাসান বসরী, ইবরাহীম নাখঈ’, ইবনে সিরীন, মাকহুল, আবদুর রহমান ইবনে যায়েদ, আবু হানীফা, আবু ইউসুফ, যুফার, মুহাম্মাদ, সুফ্ইয়ান সওরী ও হাসান ইবনে সালেহর মতো শীর্ষ স্থানীয় ফকীহগণ। দ্বিতীয় দলটি বলেন, إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا এর সম্পর্ক প্রথম হুকুমটির সাথে তো নেই-ই তবে শেষের দু’টো হুকুমের সাথে আছে অর্থাৎ তাওবার পর মিথ্যা অপবাদে শাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধীর সাক্ষ্যও গ্রহণ করা হবে এবং সে ফাসেক হিসেবেও গণ্য হবে না। এ দলে রয়েছেন আতা, তাউস, মুজাহিদ, শা’বী, কাসেম ইবনে মুহাম্মাদ, সালেম, যুহরী, ইকরামাহ, উমর ইবনুল আযীয, ইবনে আবী নুজাইহ, সুলাইমান ইবনে ইয়াসার, মাসরূক, দ্বাহ্হাক, মালেক ইবনে আনাস, উসমান আলবাত্তী, লাইস ইবনে সা’দ, শাফেঈ, আহমাদ ইবনে হাম্বল ও ইবনে জারীর তাবারীর মতো শ্রেষ্ঠ ফকীহবৃন্দ। এরা নিজেদের মতের সমর্থনে অন্যান্য যুক্তি-প্রমাণের সাথে সাথে হযরত উমর রাদিয়াল্লাহ আনহু, মুগীরাহ ইবনে শু’বার মামলায় যে ফায়সালা দিয়েছিলেন সেটিও পেশ করে থাকেন। কারণ তার কোন কোন বর্ণনায় একথা বলা হয়েছে যে, ‘হদ’ জারি করার পর হযরত উমর (রাঃ), আবু বাক্রাহ ও তার দুই সাথীকে বলেন, যদি তোমরা তওবা করে নাও (অথবা “নিজেদের মিথ্যাচারিতা স্বীকার করে নাও”) তাহলে আমি আগামীতে তোমাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করে নেবো অন্যথায় তা গ্রহণ করা হবে না। সাথী দু’জন স্বীকার করে নেয় কিন্তু আবু বাক্রাহ নিজের কথায় অনড় থাকেন। বাহ্যত এটি একটি বড় শক্তিশালী সমর্থন মনে হয়। কিন্তু মুগীরাহ ইবনে শু’বার মামলার যে বিস্তারিত বিবরণী আমি পূবেই পেশ করেছি সে সম্পর্কে চিন্তা করলে পরিষ্কার প্রকাশ হয়ে যাবে যে, এ নজিরের ভিত্তিতে এ বিষয়ে যুক্তি প্রদর্শন করা সঠিক নয়। সেখানে মূল কাজটি ছিল সর্ববাদী সম্মত এবং স্বয়ং মুগীরাহ ইবনে শু’বাও এটি অস্বীকার করেননি। মেয়েটি কে ছিল, এ নিয়ে ছিল বিরোধ। মুগীরাহ (রাঃ) বলছিলেন, তিনি ছিলেন তাঁর স্ত্রী, যাকে এরা উম্মে জামীল মনে করেছিলেন। এ সঙ্গে একথাও প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল যে, হযরত মুগীরার স্ত্রী ও উম্মে জামীলের চেহারায় এতটা সাদৃশ্য ছিল যে, ঘটনাটি যে পরিমাণ আলোয় যতটা দূর থেকে দেখা গেছে তাতে মেয়েটিকে উম্মে জামীল মনে করার মতো ভুল ধারণা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু আন্দাজ-অনুমান সবকিছু ছিল মুগীরার পক্ষে এবং বাদীপক্ষের একজন সাক্ষীও একথা স্বীকার করেছিলেন যে, মেয়েটিকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল না। এ কারণে হযরত উমর (রাঃ), মুগীরাহ ইবনে শু’বার পক্ষে রায় দেন এবং ওপরে উল্লেখিত হাদীসে যে কথাগুলো উদ্ধৃত হয়েছে আবু বাক্রাহকে শাস্তি দেবার পর সেগুলো বলেন। এসব অবস্থা পর্যালোচনা করলে পরিষ্কার বোঝা যায়, হযরত উমরের উদ্দেশ্য ছিল আসলে একথা বুঝানো যে, তোমরা অযথা একটি কুধারণা পোষণ করেছিলে, একথা মেনে নাও এবং ভবিষ্যতে আর কখনো এ ধরনের কুধারণার ভিত্তিতে লোকদের বিরুদ্ধে অপবাদ না দেবার ওয়াদা করো। অন্যথায় ভবিষ্যতে তোমাদের সাক্ষ্য কখনো গৃহীত হবে না। এ থেকে এ সিদ্ধান্ত টানা যেতে পারে না যে, সুস্পষ্ট মিথ্যাবাদী প্রমাণিত ব্যক্তিও যদি তাওবা করে তাহলে এরপর হযরত উমরের মতে তার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হতে পারতো। আসলে এ বিষয়ে প্রথম দলটির মতই বেশী শক্তিশালী মনে হয়। মানুষের তাওবার অবস্থা আল্লাহ ছাড়া আর কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। আমাদের সামনে যে ব্যক্তি তাওবা করবে আমরা তাকে বড় জোর ফাসেক বলবো না। এতটুকু সুবিধা তাকে আমরা দিতে পারি। কিন্তু যার মুখের কথার উপর আস্থা একবার খতম হয়ে গেছে সে কেবলমাত্র আমাদের সামনে তাওবা করছে বলে তার মুখের কথাকে আবার দাম দিতে থাকবো, এত বেশী সুবিধা তাকে দেয়া যেতে পারে না। এছাড়া কুরআনের আয়াতের বর্ণনাভঙ্গীও একথাই বলছে--- إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا “তবে যারা তাওবা করেছে” এর সম্পর্ক শুধুমাত্র أُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ “তারাই ফাসেক” এর সাথেই রয়েছে। তাই এ বাক্যের মধ্যে প্রথম দু’টি কথা বলা হয়েছে কেবলমাত্র নির্দেশমূলক শব্দের মাধ্যমে। অর্থাৎ “তাদেরকে আশি ঘা বেত্রাঘাত করো।” “এবং তাদের সাক্ষ্য কখনো গ্রহণ করো না।” আর তৃতীয় কথাটি বলা হয়েছে খবর পরিবেশন করার ভঙ্গীতে। অর্থাৎ “তারা নিজেরাই ফাসেক”। এ তৃতীয় কথাটির পরে সাথে সাথেই, “তারা ছাড়া যারা তাওবা করে নিয়েছে” একথা বলা প্রকাশ করে দেয় যে, এ ব্যতিক্রমের ব্যাপারটি শেষের খবর পরিবেশন সংক্রান্ত বাক্যাংশটির সাথে সম্পর্কিত। পূর্বের দু’টি নির্দেশমূলক বাক্যাংশের সাথে এর সম্পর্ক নেই। তবুও যদি এ কথা মেনে নেয়া হয় যে, এ ব্যতিক্রমের ব্যাপারটি শেষ বাক্যাংশ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়, তাহলে এরপর বুঝে আসে না তা “সাক্ষ্য গ্রহণ করো না” বাক্যাংশ পর্যন্ত এসে থেমে গেল কেন, “আশি ঘা বেত্রাঘাত করো” বাক্যাংশ পর্যন্ত পৌঁছে গেল না কেন?

দশঃ প্রশ্ন করা যেতে পারে, إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا এর মাধ্যমে ব্যতিক্রম করাটাকে প্রথম হুকুমটির সাথে সম্পর্কিত বলে মেনে নেয়া যায় না কেন? মিথ্যা অপবাদ তো আসলে এক ধরনের মানহানিই। এরপর এক ব্যক্তি নিজের দোষ মেনে নিয়েছে, অপবাদ আরোপিত ব্যক্তির কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে এবং ভবিষ্যতে আর এ ধরনের কাজ করবে না বলে তাওবা করেছে। তাহলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে না কেন? অথচ আল্লাহ নিজেই হুকুম বর্ণনা করার পর বলছেন, إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا................... فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ আল্লাহ মাফ করে দেবেন কিন্তু বান্দা মাফ করবে না, এটাতো সত্যই বড় অদ্ভূত ব্যাপার হবে। এর জবাব হচ্ছেঃ তাওবা আসলে ت-و-ب-ه সমন্বিত চার অক্ষরের একটি শব্দ মাত্র নয়। বরং হৃদয়ের লজ্জানুভূতি, সংশোধনের দৃঢ়-সংকল্প ও সততার দিকে ফিরে যাওয়ার নাম। এর এ জিনিসটির অবস্থা আর কারোর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তাই তাওবার কারণে পার্থিব শাস্তি মাফ হয় না। বরং শুধুমাত্র পরকালীন শাস্তি মাফ হয়। এ কারণে আল্লাহ বলেননি, যদি তারা তাওবা করে নেয় তাহলে তোমরা তাদেরকে ছেড়ে দাও বরং বলেছেন, যারা তাওবা করে নেবে আমি তাদের জন্য ক্ষমাশীল ও করুণাময়। যদি তাওবার সাহায্যে পার্থিব শাস্তি মাফ হয়ে যেতে থাকে, তাহলে শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য তাওবা করবে না এমন অপরাধী কে আছে?

এগারঃ এ প্রশ্নও করা যেতে পারে, এক ব্যক্তির নিজের অভিযোগের স্বপক্ষে সাক্ষী পেশ করতে না পারার মানে তো এ নয় যে, সে মিথ্যুক। এটা কি সম্ভব নয় যে, তার অভিযোগ যথার্থই সঠিক কিন্তু সে এর স্বপক্ষে প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারেনি? তাহলে শুধুমাত্র প্রমাণ পেশ করতে না পারার কারণে তাকে কেবল মানুষের সামনেই নয়, আল্লাহর সামনেও ফাসেক গণ্য করা হবে, এর কারণ কি? এর জবাব হচ্ছে, এক ব্যক্তি নিজের চোখেও যদি কাউকে ব্যভিচার করতে দেখে তাহলেও সে তা নিয়ে আলোচনা করলে এবং সাক্ষী ছাড়া তার বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপ করতে থাকলে গোনাহগার হবে। এক ব্যক্তি যদি কোন ময়লা আবর্জনা নিয়ে এক কোণে বসে থাকে তাহলে অন্য ব্যক্তি উঠে সমগ্র সমাজ দেহে তা ছড়িয়ে বেড়াক আল্লাহর শরীয়াত এটা চায় না। সে যদি এ ময়লা-আবর্জনার খবর জেনে থাকে তাহলে তার জন্য দু’টি পথ থাকে। যেখানে তা পড়ে আছে সেখানে তাকে পড়ে থাকতে দেবে অথবা তার উপস্থিতির প্রমাণ পেশ করবে, যাতে ইসলামী রাষ্ট্রের শাসকগণ তা পরিষ্কার করে ফেলতে পারেন। এ দু’টি পথ ছাড়া তৃতীয় কোন পথ তার জন্য নেই। যদি সে জনগণের মধ্যে এর আলোচনা শুরু করে দেয় তাহলে এক জায়গায় আটকে থাকা আবর্জনাকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেবার অপরাধে অভিযুক্ত হবে। আর যদি সে যথেষ্ট পরিমাণ সাক্ষ্য ছাড়াই বিষয়টি প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কাছে নিয়ে যায় তাহলে শাসকগণ তা পরিষ্কার করতে পারবেন না। ফলে এ মামলায় ব্যর্থতা আবর্জনা ছড়িয়ে পড়ার কারণও হবে এবং ব্যভিচারীদের মনে তা সাহসের সঞ্চারও করবে। এজন্য সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া মিথ্যা অভিযোগকারী বাস্তবে যতই সত্যবাদী হোক না কেন সে একজন ফাসেকই।

বারঃ মিথ্যা অপবাদের ‘হদে’র ব্যাপারে হানাফী ফকীহগণের অভিমত হচ্ছে অপবাদদাতাকে যিনাকারীর তুলনায় হাল্কা মার মারতে হবে। অর্থাৎ ৮০ ঘা বেতই মারা হবে কিন্তু যিনাকারীকে যেমন কঠোরভাবে প্রহার করা হয় তাকে ঠিক ততটা কঠোরভাবে প্রহার করা হবে না। কারণ যে অভিযোগের দরুন তাকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে সে ব্যাপারে তার মিথ্যাবাদী হওয়াটা পুরোপুরি নিশ্চিত নয়।

তেরঃ মিথ্যা অপবাদের পুনরাবৃত্তির ব্যাপারে হানাফী ও অধিকাংশ ফকীহের অভিমত হচ্ছে এই যে, অপবাদদাতা শাস্তি পাবার আগে বা মাঝখানে যতবারই এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপ করুক না কেন ‘হদ’ তার ওপর একবারই জারি হবে। আর যদি হদ জারি করার পর সে নিজের পূর্ববর্তী অপরাধেরই পুনরাবৃত্তি করতে থাকে তাহলে যে ‘হদ’ তার বিরুদ্ধে জারি করা হয়েছে তা-ই যথেষ্ট হবে। তবে যদি হদ জারি করার পর সে ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে নতুন কোন যিনার অপবাদ দেয় তাহলে আবার নতুন করে মামলা দায়ের করা হবে। মুগীরাহ ইবনে শু’বার (রাঃ) মামলায় শাস্তির পাবার পর আবু বাক্রাহ প্রকাশ্যে বলতে থাকেন, ‘‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুগীরাহ যিনা করেছিল।’’ হযরত উমর (রাঃ) আবার তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার সংকল্প করেন। কিন্তু যেহেতু তিনি আগের অপবাদেরই পুনরাবৃত্তি করছিলেন, তাই হযরত আলী (রাঃ) তার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় মামলা চালানো যেতে পারে না বলে রায় দেন। হযরত উমর তাঁর রায় গ্রহণ করেন। এরপর ফকীহগণ ঐকমত্যে পৌঁছেন যে, শাস্তিপ্রাপ্ত মিথ্যা অপবাদদাতাকে কেবলমাত্র নতুন অপবাদেই পাকড়াও করা যেতে পারে, আগের অপবাদের পুনরাবৃত্তিতে নয়।

চৌদ্দঃ কোন দল বা গোষ্ঠীর ওপর মিথ্যা অপবাদের ব্যাপারে ফকীহগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। হানাফীরা বলেন, যদি এক ব্যক্তি বহু লোকের বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়, যদিও তা একটি শব্দে বা আলাদা আলাদা শব্দে হয়, তাহলেও তার ওপর একটি ‘হদ’ জারি করা হবে। তবে যদি ‘হদ’ জারির পর সে আবার কোন নতুন মিথ্যা অপবাদের অবতারণা করে তাহলে সে জন্য পৃথক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। কারণ আয়াতের শব্দের মধ্যে বলা হয়েছেঃ ‘‘যারা সতী সাধ্বী মেয়েদের বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়।” এ কথা থেকে জানা যায়, এক ব্যক্তির বিরুদ্ধেই নয়, একটি দলের বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপকারীও শুধুমাত্র একটি ‘হদের’ হকদার হয়। এ ব্যাপারে আরো একটি যুক্তি এই যে, যিনার এমন কোন অপবাদই হতে পারে না যা কমপক্ষে দু’ব্যক্তির ওপর আরোপিত হয় না। কিন্তু এ সত্ত্বেও শরীয়াত প্রবর্তক একটি ‘হদেরই হুকুম দিয়েছেন। নারীর বিরুদ্ধে অপবাদের জন্য আলাদা এবং পুরুষের বিরুদ্ধে অপবাদের জন্য আলাদা ‘হদ’ জারি করার হকুম দেননি। এর বিপরীতে ইমাম শাফেঈ বলেন, একটি দলের বিরুদ্ধে অপবাদ দানকারী এক শব্দে বা আলাদা আলাদা শব্দে অপবাদ দান করুক না কেন, সে জন্য প্রত্যেক ব্যক্তির বাবদ এক একটি পূর্ণ ‘হদ’ জারি করা হবে। উসমান আলবাত্তীও এ অভিমত প্রকাশ করেন। এ ব্যাপারে ইবনে আবীলাইলার উক্তি, শা’বী ও আওযাঈও যার সাথে অভিন্ন মত পোষণ করেন তা হচ্ছে এই যে, একটি বিবৃতির মাধ্যমে পুরো দলের বিরুদ্ধে যিনার অপবাদ আরোপকারী একটি হদের হকদার হবে এবং আলাদা আলাদা বিবৃতির মাধ্যমে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে যিনার অপবাদ আরোপকারী প্রত্যেকটি অপবাদের জন্য আলাদা আলাদা হদের অধিকারী হবে।

.
.
.
৭.
এ আয়াত পেছনের আয়াতের কিছুকাল পরে নাযিল হয়। মিথ্যা অপবাদের বিধান যখন নাযিল হয় তখন লোকদের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দেয়, ভিন পুরুষ ও নারীর চরিত্রহীনতা দেখে তো মানুষ সবর করতে পারে, সাক্ষী না থাকলে ঠোঁটে তালা লাগাতে পারে এবং ঘটনাটি উপেক্ষা করতে পারে। কিন্তু নিজের স্ত্রীর চরিত্রহীনতা দেখলে কি করবে? হত্যা করলে তো উল্টো শাস্তি লাভের যোগ্য হয়ে যাবে। সাক্ষী খুঁজতে গেলে তাদের আসা পর্যন্ত অপরাধী সেখানে অপেক্ষা করতে যাবে কেন? আর সবর করলে তা করবেই বা কেমন করে। তালাক দিয়ে স্ত্রীকে বিদায় করে দিতে পারে। কিন্তু এর ফলে না মেয়েটির কোন বস্তুগত বা নৈতিক শাস্তি হলো, না তার প্রেমিকের। আর যদি তার অবৈধ গর্ভসঞ্চার হয়, তাহলে অন্যের সন্তান নিজের গলায় ঝুললো। এ প্রশ্নটি প্রথমে হযরত সা’দ ইবনে উবাদাহ একটি কাল্পনিক প্রশ্নের আকারে পেশ করেন। তিনি এতদূর বলে দেন, আমি যদি আল্লাহ না করুন নিজের ঘরে এ অবস্থা দেখি, তাহলে সাক্ষীর সন্ধানে যাবো না বরং তলোয়ারের মাধ্যমে তখনই এর হেস্তনেস্ত করে ফেলবো। (বুখারী ও মুসলিম) কিন্তু মাত্র কিছুদিন পরেই এমন কিছু মামলা দায়ের হলো যেখানে স্বামীরা স্বচক্ষেই এ ব্যাপার দেখলো এবং নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এর অভিযোগ নিয়ে গেলো। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও ইবনে উমরের রেওয়ায়াত অনুযায়ী আনসারদের এক ব্যক্তি (সম্ভবত উওয়াইমির আজ্লানী) রসূলের সামনে হাযির হয়ে বলেন, হে আল্লাহর রসূল! যদি এক ব্যক্তি নিজের স্ত্রীর সাথে পরপুরুষকে পায় এবং সে মুখ থেকে সে কথা বের করে ফেলে, তাহলে আপনি তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদের “হদ” জারি করবেন, হত্যা করলে আপনি তাকে হত্যা করবেন, নীরব থাকলে সে চাপা ক্রোধে ফুঁসতে থাকবে। শেষমেশ সে করবে কি? এ কথায় রসূলুল্লাহ্ ﷺ দোয়া করেনঃ হে আল্লাহ! এ বিষয়টির ফায়সালা করে দাও। (মুসলিম, বুখারী, আবু দাউদ, আহমাদ ও নাসাঈ) ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেন, হেলাল ইবনে উমাইয়াহ এসে নিজের স্ত্রীর ব্যাপারটি পেশ করেন। তিনি তাকে নিজের চোখে ব্যভিচারে লিপ্ত থাকতে দেখেছিলেন। নবী ﷺ বলেন, “প্রমাণ আনো, অন্যথায় তোমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদের শাস্তি জারি হবে।” এতে সাহাবীদের মধ্যে সাধারণভাবে পেরেশানী সৃষ্টি হয়ে যায় এবং হেলাল বলেন, সেই আল্লাহর কসম যিনি আপনাকে নবী বানিয়ে পাঠিয়েছেন, আমি একদম সঠিক ঘটনাই তুলে ধরছি, আমার চোখ এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে এবং কান শুনেছে। আমি বিশ্বাস করি আল্লাহ আমার ব্যাপারে এমন হুকুম নাযিল করবেন যা আমার পিঠ বাঁচাবে। এ ঘটনায় এ আয়াত নাযিল হয়। (বুখারী, আহমাদ ও আবুদ দাউদ) এখানে মীমাংসার যে পদ্ধতি দেয়া হয়েছে তাকে ইসলাম আইনের পরিভাষায় “লি’আন” বলা হয়।

এ হুকুম এসে যাবার পর নবী ﷺ যেসব মামলার ফায়সালা দেন সেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ হাদীসের কিতাবগুলোতে লিখিত আকারে সংরক্ষিত রয়েছে এবং সেগুলোই লি’আন সংক্রান্ত বিস্তারিত আইনগত কার্যধারার উৎস।

হেলাল ইবনে উমাইয়ার মামলার যে বিস্তারিত বিবরণ সিহাহে সিত্তা ও মুসনাদে আহমাদ এবং তাফসীরে ইবনে জারিরে ইবনে আব্বাস ও আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত হয়েছে তাতে বলা হয়েছেঃ এ আয়াত নাযিল হবার পর হেলাল ও তার স্ত্রী দু’জনকে নবীর আদালতে হাযির করা হয়। রসূলুল্লাহ্ ﷺ প্রথমে আল্লাহর হুকুম শুনান। তারপর বলেন, “খুব ভালভাবে বুঝে নাও, আখেরাতের শাস্তি দুনিয়ার শাস্তির চাইতে কঠিন।” হেলাল বলেন, “আমি এর বিরুদ্ধে একদম সত্য অভিযোগ দিয়েছি।” স্ত্রী বলে, “এ সম্পূর্ণ মিথ্যা।” রসূলুল্লাহ্ ﷺ বলেন, “বেশ, তাহলে এদের দু’জনের মধ্যে লি’আন করানো হোক।” তদনুসারে প্রথমে হেলাল উঠে দাঁড়ায়। তিনি কুরআনী নির্দেশ অনুযায়ী কসম খাওয়া শুরু করেন। এ সময় নবী ﷺ বারবার বলতে থাকেন, “আল্লাহ্ জানেন তোমাদের মধ্যে অবশ্যই একজন মিথ্যেবাদী। তারপর কি তোমাদের মধ্য থেকে কেউ তাওবা করবে?” পঞ্চম কসমের পূর্বে উপস্থিত লোকেরা হেলালকে বললো, “আল্লাহকে ভয় করো। দুনিয়ার শাস্তি পরকালের শাস্তির চেয়ে হালকা। এ পঞ্চম কসম তোমার ওপর শাস্তি ওয়াজিব করে দেবে।” কিন্তু হেলাল বলেন, যে আল্লাহ এখানে আমার পিঠ বাঁচিয়েছেন তিনি পরকালেও আমাকে শাস্তি দেবেন না। একথা বলে তিনি পঞ্চম কসমও খান। তারপর তার স্ত্রী ওঠে। সেও কসম খেতে শুরু করে। পঞ্চম কসমের পূর্বে তাকেও থামিয়ে বলা হয়, “আল্লাহকে ভয় করো, আখেরাতের আযাবের তুলনায় দুনিয়ার আযাব বরদাশত করে নেয়া সহজ। এ শেষ কসমটি তোমার ওপর আল্লাহর আযাব ওয়াজিব করে দেবে।” একথা শুনে সে কিছুক্ষণ থেমে যায় এবং ইতস্তত করতে থাকে। লোকেরা মনে করে নিজের অপরাধ স্বীকার করতে চাচ্ছে। কিন্তু তারপর সে বলতে থাকে। “আমি চিরকালের জন্য নিজের গোত্রকে লাঞ্ছিত করবো না।” তারপর সে পঞ্চম কসমটিও খায়। অতঃপর নবী ﷺ তাদের উভয়ের মধ্যে ছাড়াছাড়ি করে দেন এবং ফায়সালা দেন, এর সন্তান (যে তখন মাতৃগর্ভে ছিল) মায়ের সাথে সম্পর্কিত হবে। বাপের সাথে সম্পর্কিত করে তার নাম ডাকা হবে না। তার বা তার সন্তানের প্রতি অপবাদ দেবার অধিকার কারোর থাকবে না। যে ব্যক্তি তার বা তার সন্তানের প্রতি অপবাদ দেবে সে মিথ্যা অপবাদের (কাযাফ) শাস্তির অধিকারী হবে। ইদ্দতকালে তার খোরপোশ ও বাসস্থান লাভের কোন অধিকার হেলালের ওপর বর্তায় না। কারণ তাকে তালাক বা মৃত্যু ছাড়াই স্বামী থেকে আলাদা করা হচ্ছে। তারপর তিনি লোকদের বলেন, তার সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর দেখো সে কার মতো হয়েছে। যদি এ আকৃতির হয় তাহলে হেলালের হবে। আর যদি ঐ আকৃতির হয়, তাহলে যে ব্যক্তির সাথে মিলিয়ে একে অপবাদ দেয়া হয়েছে এ তার হবে। শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পর দেখা গেলো সে শেষোক্ত ব্যক্তির আকৃতি পেয়েছে। এ অবস্থায় নবী ﷺ বলেন, لو لا الايمان অর্থাৎ যদি কসমসমূহ না হতো (অথবা বর্ণনান্তরে لَكَانَ لِى وَلَهَا شَأْنٌ (لَوْلاَ مَا مَضَى مِنْ كِتَابِ اللَّهِ) আল্লাহর কিতাব প্রথমেই ফায়সালা না করে দিতো) তাহলে আমি এ মেয়েটির সাথে কঠোর ব্যবহার করতাম।

‘উওয়াইমির আজলানীর মামলার বিবরণ পাওয়া যায় বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ ও মুসনাদে আহমাদ। সাহল ইবনে সা’দ সা’ঈদী ও ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে এগুলো বর্ণিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছেঃ উওয়াইমির ও তার স্ত্রী উভয়কে মসজিদে নববীতে ডাকা হয়। তারা নিজেদের ওপর ‘লি’আন’ করার আগে রসূলুল্লাহ্ ﷺ তাদেরকেও সতর্ক করে দিয়ে তিনবার বলেন, “আল্লাহ্ খুব ভালভাবেই জানেন তোমাদের একজন অবশ্যই মিথ্যাবাদী। তাহলে কি তোমাদের কেউ তাওবা করবে?” দু’জনের কেউ যখন তাওবা করলো না তখন তাদের ‘লি’আন’ করানো হয়। এরপর ‘উওয়াইমির বলেন, “হে আল্লাহর রসূল! যদি আমি এ স্ত্রীকে রেখে দেই তাহলে মিথ্যুক হবো।” একথা বলেই রসূলুল্লাহ্ ﷺ তাকে হুকুম দেয়া ছাড়াই তিনি তিন তালাক দিয়ে দেন। সাহল ইবনে সা’দ বলেন, “রসূলুল্লাহ্ ﷺ এ তালাক জারি করেন, তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি করে দেন এবং বলেন, “যে দম্পতি লি’আন করবে তাদের জন্য এ ছাড়াছাড়ি।” লি’আনকারী স্বামী-স্ত্রীকে আলাদা করে দেবার এ সুন্নত কায়েম হয়ে যায়। এরপর তারা আর কখনো একত্র হতে পারবে না। সাহল ইবনে সা’দ একথাও বর্ণনা করেন যে, স্ত্রী গর্ভবতী ছিল এবং ‘উওয়াইমির বলেন, এ গর্ভ আমার ঔরসজাত নয়। এজন্য শিশুকে মায়ের সাথে সম্পর্কিত করা হয় এবং এ সুন্নত জারি হয় যে, এ ধরনের সন্তান মায়ের উত্তরাধিকারী হবে এবং মা তার উত্তরাধিকারী হবে।

এ দু’টি মামলা ছাড়া হাদীসের কিতাবগুলোতে আমরা এমন বহু রেওয়ায়াত পাই যেগুলো থেকে এ মামলাগুলো কাদের সাথে জড়িত ছিল তা সুস্পষ্টভাবে জানা যায় না। হতে পারে সেগুলোর কোন কোনটি এ দু’টি মামলার সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু কয়েকটিতে অন্য কিছু মামলার কথা বলা হয়েছে এবং সেগুলো থেকে লি’আন আইনের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর আলোকপাত হয়।

ইবনে উমর একটি মামলার বিবরণ দিয়েছেন। তিনি বলেন, স্বামী-স্ত্রী লি’আন শেষ করার পর নবী ﷺ তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি করে দেন। (বুখারী, মুসলিম, নাসাঈ, আহমাদ ও ইবনে জারীর) ইবনে উমরের অন্য এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, এক ব্যক্তি ও তার স্ত্রীর মধ্যে লি’আন করানো হয়। তারপর স্বামীটি গর্ভের সন্তান অস্বীকার করে। নবী ﷺ তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি করে দেন এবং ফায়সালা শুনিয়ে দেন, সন্তান হবে শুধুমাত্র মায়ের। (সিহাহে সিত্তা ও আহমাদ) ইবনে উমরেরই আর একটি রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে, উভয়ের লি’আন করার পরে রসূলুল্লাহ্ ﷺ বলেন, “তোমাদের হিসাব এখন আল্লাহর জিম্মায়। তোমাদের একজন অবশ্যই মিথ্যুক।” তারপর তিনি পুরুষটিকে বলেন, لَا سَبِيلَ لَكَ عَلَيْهَا (অর্থ এখন এ আর তোমার নয়। তুমি এর ওপর নিজের কোন অধিকার দেখাতে পারো না। এর ওপর কোনরকম হস্তক্ষেপও করতে পারো না। অথবা এর বিরুদ্ধে অন্য কোন প্রকার প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করার অধিকারও আর তোমার নেই)। পুরুষটি বলে হে আল্লাহর রসূল! আর আমার সম্পদ? (অর্থাৎ যে মোহরানা আমি তাকে দিয়েছিলাম তা আমাকে ফেরত দেবার ব্যবস্থা করুন)। রসূলুল্লাহ্ ﷺ বলেনঃ

لاَ مَالَ لَكَ ، إِنْ كُنْتَ صَدَقْتَ عَلَيْهَا ، فَهْوَ بِمَا اسْتَحْلَلْتَ مِنْ فَرْجِهَا ، وَإِنْ كُنْتَ كَذَبْتَ عَلَيْهَا ، فَذَاكَ أَبْعَدُ وأَبْعَدُ لَكَ منها-

“সম্পদ ফেরত নেবার কোন অধিকার তোমার নেই। যদি তুমি তার ওপর সত্য অপবাদ দিয়ে থাকো তাহলে ঐ সম্পদ সে আনন্দ উপভোগের প্রতিদান যা তুমি হালাল করে তার থেকে লাভ করেছো। আর যদি তুমি তার ওপর মিথ্যা অপবাদ দিয়ে থাকো। তাহলে সম্পদ তোমার কাছ থেকে আরো অনেক দূরে চলে গেছে। তার তুলনায় তোমার কাছ থেকে তা বেশী দূরে রয়েছে।” (বুখারী, মুসলিম ও আবু দাউদ)।

দারুকুত্নী আলী ইবনে আবু তালেব ও ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুমার উক্তি উদ্ধৃত করেছে। তাতে বলা হয়েছেঃ “সুন্নাত এটিই নির্ধারিত হয়েছে যে, লি’আনকারী স্বামী-স্ত্রী পরবর্তী পর্যায়ে আর কখনো একত্র হতে পারে না।” (অর্থাৎ দ্বিতীয়বার আর কোনদিন তাদের মধ্যে বিয়ে হতে পারে না)। আবার এ দারুকত্নী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, নবী ﷺ বলেন, এরা দু’জন আর কখনো একত্র হতে পারে না।

কাবীসাহ ইবনে যুওয়াইব বর্ণনা করেছেন, হযরত উমরের আমলে এক ব্যক্তি নিজের স্ত্রীর গর্ভের সন্তানকে অবৈধ গণ্য করে তারপর আবার তা নিজের বলে স্বীকার করে নেয়। তারপর সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর বলতে থাকে, এ শিশু আমার নয়। ব্যাপারটি হযরত উমরের আদালতে পেশ হয়। তিনি তার ওপর কাযাফের শাস্তি জারি করেন এবং ফায়সালা দেন, শিশু তার সাথেই সম্পর্কিত হবে। (দারুকুত্নী বাইহাকী)।

ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন, এক ব্যক্তি হাযির হয়ে বলে, আমার একটি স্ত্রী আছে, আমি তাকে ভীষণ ভালবাসি। কিন্তু তার অবস্থা হচ্ছে এই যে, সে কোন স্পর্শকারীর হাত ঠেলে দেয় না। (উল্লেখ্য, এটি একটি রূপক ছিল। এর অর্থ যিনাও হতে পারে আবার যিনার কম পর্যায়ের নৈতিক দুর্বলতাও হতে পারে।) নবী ﷺ বলেন, তালাক দিয়ে দাও। সে বলে, আমি তাকে ছাড়া থাকতে পারি না। জবাব দেন, তুমি তাকে রেখে দাও। (অর্থাৎ তিনি তার কাছ থেকে তার ইঙ্গিতের ব্যাখ্যা নেননি এবং তার উক্তিকে যিনার অপবাদ হিসেবে গণ্য করে লি’আন করার হুকুম দেননি।) ---নাসাঈ।

আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেছেন, এক ব্যক্তি হাজির হয়ে বলে, আমার স্ত্রী কালো ছেলে জন্ম দিয়েছে। আমি তাকে আমার সন্তান বলে মনে করি না। (অর্থাৎ নিছক শিশু সন্তানের গায়ের রং তাকে সন্দেহের মধ্যে নিক্ষেপ করেছিল। নয়তো তার দৃষ্টিতে স্ত্রীর ওপর যিনার অপবাদ লাগাবার অন্য কোন কারণ ছিল না।) রসূলুল্লাহ্ ﷺ জিজ্ঞেস করেন, তোমার তো কিছু উট আছে? সে বলে, হ্যাঁ, আছে। জিজ্ঞেস করেন, সেগুলোর রং কি? জবাব দেয় লাল। জিজ্ঞেস করেন, তাদের মধ্যে কোনটা কি খাকি রংয়ের আছে? জবাব দেয়, জি হ্যাঁ, কোন কোনটা এমনও আছে। জিজ্ঞেস করেন, এ রংটি কোথায় থেকে এলো? জবাব দেয়, হয়তো কোন শিরা টেনে নিয়ে গেছে। (অর্থাৎ তাদের বাপ-দাদাদের কেউ এ রংয়ের থেকে থাকবে এবং তার প্রভাব এর মধ্যে এসে গেছে।) তিনি বলেন, “সম্ভবত এ শিশুটিকেও কোন শিরা টেনে নিয়ে গেছে।” তারপর তিনি তাকে সন্তানের বংশধারা অস্বীকার করার অনুমতি দেননি। (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ ও আবুদ দাউদ।)

আবু হুরাইরার (রাঃ) অন্য একটি রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে, নবী ﷺ লি’আন সম্পর্কিত আয়াত আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, “যে স্ত্রী কোন বংশে এমন সন্তান প্রবেশ করায় যে ঐ বংশের নয় (অর্থাৎ হারামের শিশু গর্ভে ধারণ করে স্বামীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়) তার আল্লাহর সাথে কোন সম্পর্ক নেই। আল্লাহ তাকে কখ্খনো জান্নাতে প্রবেশ করাবেন না। আর যে পুরুষ নিজের সন্তানের বংশধারা অস্বীকার করে অথচ সন্তান তাকে দেখছে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাকে পর্দা করবেন এবং পূর্বের ও পরের সমস্ত সৃষ্টির সামনে তাকে লাঞ্ছিত করবেন। (আবু দাউদ, নাসাঈ ও দারেমী।)

লি’আনের আয়াত এবং এ হাদীসগুলো, নজিরসমূহ ও শরীয়াতের সাধারণ মূলনীতিগুলোই হচ্ছে ইসলামের লি’আনের আইনের উৎস। এগুলোর আলোকে ফকীহগণ লি’আনের বিস্তারিত আইন-কানুন তৈরী করেছেন। এ আইনের গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো হচ্ছেঃ

একঃ যে ব্যক্তি স্ত্রীর ব্যভিচার স্বচক্ষে দেখে লি’আনের পথ অবলম্বন না করে হত্যা করে বসে তার ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। একটি দল বলে, তাকে হত্যা করা হবে। কারণ নিজের উদ্যোগে ‘হদ’ জারি করার তথা আইন হাতে তুলে নেয়ার অধিকার তার ছিল না। দ্বিতীয় দল বলে, তাকে হত্যা করা হবে না এবং তার কর্মের জন্য তাকে জবাবদিহিও করতে হবে না, তবে এক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে তার দাবীর সত্যতা প্রমাণিত হতে হবে (অর্থাৎ যথার্থই সে তার যিনার কারণে এ কাজ করেছে)। ইমাম আহমাদ ও ইসহাক ইবনে রাহ্ওয়াইহ্ বলেন, এটিই হত্যার কারণ এ মর্মে তাকে দু’জন সাক্ষী আনতে হবে। মালেকীদের মধ্যে ইবনুল কাসেম ও ইবনে হাবীব এ মর্মে অতিরিক্ত শর্ত আরোপ করেন যে, যাকে হত্যা করা হয়েছে সেই যিনাকারীর বিবাহিত হতে হবে। অন্যথায় কুমার যিনাকারীকে হত্যা করলে তার কাছ থেকে কিসাস নেয়া হবে। কিন্তু অধিকাংশ ফকীহের মতে তাকে কিসাস থেকে শুধুমাত্র তখনই মাফ করা হবে যখন সে যিনার চারজন সাক্ষী পেশ করবে অথবা নিহত ব্যক্তি মরার আগে নিজ মুখে একথা স্বীকার করে যাবে যে, সে তার স্ত্রীর সাথে যিনা করছিল এবং এ সঙ্গে নিহত ব্যক্তিকে বিবাহিতও হতে হবে। (নাইলুল আওতার, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ২২৮ পৃষ্ঠা)।

দুইঃ ঘরে বসে লি’আন হতে পারে না। এজন্য আদালতে যাওয়া জরুরী। তিনঃ লি’আন দাবী করার অধিকার শুধু স্বামীর নয়, স্ত্রীরও। স্বামী যখন তার ওপর যিনার অপবাদ দেয় অথবা তার শিশুর বংশধারা মেনে নিতে অস্বীকার করে তখন স্ত্রী আদালতে গিয়ে লি’আন দাবী করতে পারে।

চারঃ সব স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কি লি’আন হতে পারে অথবা এজন্য তাদের দু’জনের মধ্যে কিছু শর্ত পাওয়া যেতে হবে? এ বিষয়ে ফকীহদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায়। ইমাম শাফেঈ বলেন, যার কসম আইনের দিক দিয়ে নির্ভরযোগ্য এবং যার তালাক দেবার ক্ষমতা আছে সে লি’আনের যোগ্যতা সম্পন্ন হবার জন্য যথেষ্ট। এক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী মুসলিম বা কাফের, গোলাম বা স্বাধীন, গ্রহণযোগ্য সাক্ষ্যের অধিকারী হোক বা না হোক এবং মুসলিম স্বামীর স্ত্রী মুসলমান বা জিম্মি যেই হোক না কেন তাতে কিছু আসে যায় না। প্রায় একই ধরণের অভিমত ইমাম মালেক ও ইমাম আহমাদেরও। কিন্তু হানাফীগণ বলেন, লি’আন শুধুমাত্র এমন স্বাধীন মুসলমান স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হতে পারে যারা কাযাফের অপরাধে শাস্তি পায়নি। যদি স্বামী ও স্ত্রী দু’জনই কাফের, গোলাম বা কাযাফের অপরাধে পূর্বেই শাস্তি প্রাপ্ত হয়ে থাকে, তাহলে তাদের মধ্যে লি’আন হতে পারে না। এছাড়াও যদি স্ত্রী এর আগেও কখনো হারাম বা সন্দেহযুক্ত পদ্ধতিতে কোন পুরুষের সাথে মাখামাখি করে থাকে, তাহলে এক্ষেত্রেও লি’আন ঠিক হবে না। হানাফীগনের এর শর্তগুলো আরোপ করার কারণ হচ্ছে এই যে, তাদের মতে লি’আন ও কাযাফের আইনের মধ্যে এছাড়া আর কোন পার্থক্য নেই যে, অন্য ব্যক্তি যদি ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ দেয় তাহলে তার জন্য রয়েছে ‘হদ’ আর স্বামী এ অপবাদ দিলে সে লি’আন করে অব্যাহতি লাভ করতে পারে। বাকি অন্যান্য সবদিক দিয়ে লি’আন ও কাযাফ একই জিনিস। এ দেবার যোগ্যতা নেই এমন কোন ব্যক্তিকে তারা এর অনুমতি দেয় না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ ব্যাপারে হানাফীদের অভিমত দুর্বল এবং ইমাম শাফেঈ যে কথাটি বলেছেন সেটিই সঠিক। এর প্রথম কারণ হচ্ছে, কুরআন স্ত্রীর বিরুদ্ধে কাযাফের ব্যাপারটিকে কাযাফের আয়াতের একটি অংশে পরিণত করেনি বরং সেজন্য একটি স্বতন্ত্র আইন বর্ণনা করেছেন তাই তাকে কাযাফের আয়াতের শব্দাবলী থেকে আলাদা এবং উভয় হুকুমও ভিন্ন। তাই লি’আনের আয়াত থেকেই লি’আনের বিধান গ্রহণ করা উচিত। কাযাফের আয়াত থেকে নয়। যেমন কাযাফের আয়াতের শাস্তি লাভের যোগ্য হচ্ছে এমন লোক যে সতী সাধ্বী স্ত্রীর শর্ত আরোপ করা হয়নি। একটি মেয়ে কোন সময় হয়তো পাপ কাজ করেছিল, যদি পরবর্তীকালে সে তাওবা করে কোন পুরুষকে বিয়ে করে এবং তারপর তার স্বামী তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেয়, তাহলে লি’আনের আয়াত একথা বলে না যে, এ মেয়ের স্বামীকে এর বিরুদ্ধে অপবাদ দেবার বা এর সন্তানের বংশধারা অস্বীকার করার ব্যাপক অনুমতি দিয়ে দাও, কারণ এর জীবন এক সময় কলুষিত ছিল। দ্বিতীয় এবং ঠিক একই পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে এই যে, স্ত্রীর বিরুদ্ধে কাযাফ ও অপরিচিতার বিরুদ্ধে কাযাফের মধ্যে আসমান যমীন ফারাক। এদের উভয়ের ব্যাপারে আইনের প্রকৃতি এক হতে পারে না। পরনারীর সাথে অন্য পুরুষের আবেগ-অনুভূত, ইজ্জত-আব্রু, সমাজ-সংস্কৃতি ও বংশ গোত্রগত কোন সম্পর্ক হতে পারে না। তার চালচলনের ব্যাপারে যদি কোন ব্যক্তির খুব বেশী আগ্রহ সৃষ্টি হতে পারে তাহলে তা হবে তার সমাজকে চরিত্রহীনতা মুক্ত দেখার আবেগ থেকে। পক্ষান্তরে নিজের স্ত্রীর সাথে মানুষের সম্পর্ক এক ধরনের নয়, কয়েক ধরনের এবং অত্যন্ত গভীর। সে একাধারে তার বংশধারা, ধন-সম্পদ ও গৃহের আমানতদার। তার জীবন সঙ্গিনী। তার গোপনীয়তার সংরক্ষক। তার অত্যন্ত গভীর ও সংবেদনশীল আবেগ-অনুভূতি তার সাথে জড়িত। তার খারাপ চালচলনে মানুষের আত্মমর্যাদা, ইজ্জত, স্বার্থ ও ভবিষ্যত বংশধরদের পর সুগভীর আঘাত আসে। এ দু’টি ব্যাপার কোন্ দিক দিয়ে এক, যার ফলে উভয়ের জন্য আইনের একই প্রকৃতি হতে হবে? একজন জিম্মি অথবা গোলাম কিংবা সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির জন্য তার স্ত্রীর ব্যাপার কি কোন স্বাধীন সাক্ষ্যদানের যোগ্য মুসলমানের ব্যাপার থেকে সামান্যতম ভিন্ন অথবা গুরুত্ব ও ফলাফলের দিক দিয়ে একটুখানিও কম? সে যদি নিজের চোখের নিজের স্ত্রীকে কারোর সাথে ডলাডলি করতে দেখতো অথবা সে যদি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করতো যে, তার স্ত্রী অন্য কারোর সংস্পর্শে গর্ভবতী হয়ে গেছে, তাহলে তাকে লি’আন করার অধিকার না দেবার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে কি? আর এ অধিকার তার থেকে ছিনিয়ে নেবার পর আমাদের আইনে তার জন্য আর কি পথ আছে? কুরআন মজীদের উদ্দেশ্য তো পরিষ্কার জানা যায়। বিবাহিত দম্পতিদের মধ্যে স্ত্রীর যথার্থ ব্যভিচার বা অবৈধ গর্ভধারণের ফলে একজন স্বামী এবং স্বামীর মিথ্যা অপবাদ বা সন্তানের বংশ অযথা অস্বীকারের ফলে একজন স্বামী এবং স্বামীর মিথ্যা অপবাদ বা সন্তানের বংশ অযথা অস্বীকারের ফলে একজন স্ত্রী যে জটিল সমস্যায় ভুগতে থাকে কুরআন তাদেরকে তা থেকে উদ্ধার করার জন্য একটি উপায় বের করতে চায়। এ প্রয়োজন শুধুমাত্র সাক্ষ্যদানের যোগ্য স্বাধীন মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট নয় এবং কুরআনের শব্দাবলীর মধ্যেও এমন কোন জিনিস নেই যা এ প্রয়োজনটি শুধুমাত্র তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে। তবে কুরআন লি’আনের কসমকে সাক্ষ্যদান হিসেবে গণ্য করেছে তাই সাক্ষ্যদানের শর্তাবলী এখানে আরোপিত হবে, এ যুক্তি পেশ করলে এর দাবী হবে, ন্যায়নিষ্ঠ গ্রহণযোগ্য সাক্ষ্যের অধিকারী স্বামী যদি কসম খায় এবং স্ত্রী কসম খেতে ইতস্তত করে তাহলে স্ত্রীকে রজম করা হবে। কারণ ব্যভিচারের ওপর সাক্ষ্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। কিন্তু বিস্ময়কর হচ্ছে, এ অবস্থায় হানাফীগণ রজম করার হুকুম দেন না। তারা নিজেরাই যে এ কসমগুলোকে হুবহু সাক্ষ্যের মর্যাদা দান করেন না এটা তারই সুস্পষ্ট প্রমাণ। বরং সত্য বলতে কি স্বয়ং কুরআনও এ কসমগুলোকে সাক্ষ্য শব্দের মাধ্যমে ব্যক্ত করল এগুলোকে সাক্ষ্য গণ্য করে না। নয়তো স্ত্রীকে চারটি কসমের পরিবর্তে আটটি কসম খাবার হুকুম দিতো।

পাঁচঃ নিছক ইশারা-ইঙ্গিত, রূপক, উপমা বা সন্দেহ-সংশয় প্রকাশের ফলে লি’আন অনিবার্য হয়ে পড়ে না। বরং কেবলমাত্র এমন অবস্থায় তা অনিবার্য হয় যখন স্বামী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় যিনার অপবাদ দেয় অথবা সুস্পষ্ট ভাষায় সন্তানকে নিজের বলে মেনে নিতে অস্বীকার করে। ইমাম মালেক ও লাইস ইবনে সা’দ এর ওপর আরো এ শর্তটি বাড়ান যে, কসম খাবার সময় স্বামীকে বলতে হবে, সে নিজের চোখে স্ত্রীকে ব্যভিচারে রত থাকতে দেখেছে। কিন্তু এটি একটি ভিত্তিহীন শর্ত। কুরআনে এর কোন ভিত্তি নেই, হাদীসেও নেই।

ছয়ঃ যদি অপবাদ দেবার পর স্বামী কসম খেতে ইতস্তত করে বা ছলনার আশ্রয় নেয় তাহলে ইমাম আবু হানীফা ও তাঁর সহযোগীগণ বলেন, তাকে বন্দী করতে হবে এবং যতক্ষণ সে লি’আন না করে অথবা নিজের অপবাদকে মিথ্যা বলে না মেনে নেয় ততক্ষণ তাকে মুক্তি দেয়া হবে না। আর মিথ্যা বলে মেনে নিলে তার বিরুদ্ধে কাযাফের দণ্ড জারি হয়ে যাবে। এর বিপরীতপক্ষে ইমাম মালেক, শাফেঈ, হাসান ইবনে, সালেহ ও লাইস ইবনে সা’দের মতে, লি’আন করতে ইতস্তত করার ব্যাপারটি নিজেই মিথ্যার স্বীকারোক্তি। তাই কাযাফের হদ্ ওয়াজিব হয়ে যায়।

সাতঃ স্বামীর কসম খাওয়ার পর স্ত্রী যদি লি’আন করতে ইতস্তত করে, তাহলে হানাফীদের মতে তাকে বন্দী করতে হবে এবং ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে মুক্তি দেয়া যাবে না যতক্ষণ না সে লি’আন করবে অথবা তারপর যিনার স্বীকারোক্তি না করে নেবে। অন্যদিকে উপরোক্ত ইমামগণ বলেন, এ অবস্থায় তাকে রজম করে দেয়া হবে। তারা কুরআনের ঐ উক্তি থেকে পেশ করেন যে, একমাত্র কসম খাওয়ার পরই স্ত্রী শাস্তি মুক্ত হবে। এখন যেহেতু সে কসম খাচ্ছে না, তাই নিশ্চিতভাবেই সে শাস্তি যোগ্য হবে। কিন্তু এ যুক্তির দুর্বলতা হচ্ছে, কুরআন এখানে “শাস্তির’ ধরণ বলে দেয়নি বরং সাধারণভাবে শাস্তির কথা বলছে। যদি বলা হয়, শাস্তি মানে এখানে যিনার শাস্তিই হতে পারে, তাহলে এর জবাব হচ্ছে, যিনার শাস্তির জন্য কুরআন সুস্পষ্ট ভাষায় চার জন সাক্ষীর শর্ত আরোপ করেছে। নিছক এক জনের চারটি কসম এ শর্ত পূরা করতে পারে না। স্বামীর কসম তো তার নিজের কাযাফের শাস্তি থেকে বেঁচে যাওয়া এবং স্ত্রীর ওপর লি’আনের বিধান প্রবর্তিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট কিন্তু তার মাধ্যমে স্ত্রীর বিরুদ্ধে যিনার অপবাদ প্রমাণিত হবার জন্য যথেষ্ট নয়। স্ত্রীর জবাবী কসম খেতে অস্বীকার করার ফলে অবশ্যই সন্দেহ সৃষ্টি করে দেয় এবং বড়ই গভীর সন্দেহ সৃষ্টি করে সত্য কিন্তু সন্দেহের ভিত্তিতে হদ জারী করা যেতে পারে না। এ বিষয়টিকে পুরুষের কাযাফের হদের সাথে তুলনা করা উচিত নয়। কারণ তার কাযাফ তো প্রমাণিত, এ কারণেই তাকে লি’আন করতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু এর বিপরীতে স্ত্রীর ওপর যিনার অপবাদ প্রমাণিত হয়। কারণ তার নিজের স্বীকারোক্তি অথবা চারজন স্বচক্ষে প্রত্যক্ষকারী সাক্ষীর সাক্ষ্য ছাড়া তা প্রমাণিত হতে পারে না।

আটঃ যদি লি’আনের সময় স্ত্রী গর্ভবর্তী থাকে তাহলে ইমাম আহমাদের মতে স্বামী গর্ভস্থিত সন্তানকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করুক বা না করুক স্বামীর গর্ভস্থিত সন্তানের দায়মুক্ত হবার এবং সন্তান তার ঔরসজাত গণ্য না হবার জন্য লি’আন নিজেই যথেষ্ট। ইমাম শাফেঈ বলেন, স্বামীর যিনার অপবাদ ও গর্ভস্থিত সন্তানের দায়িত্ব অস্বীকার করা এক জিনিস নয়। এজন্য স্বামী যতক্ষণ গর্ভস্থিত সন্তানের দায়িত্ব গ্রহণ করতে সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার না করবে ততক্ষণ তা যিনার অপবাদ সত্ত্বেও তার ঔরসজাত গণ্য হবে। কারণ স্ত্রী যিনাকারীনী হওয়ার ফলেই বর্তমান গর্ভজাত সন্তানটি যে, যিনার কারণে জন্ম নিয়েছে, এটা অপরিহার্য নয়।

নয়ঃ ইমাম মালেক, ইমাম শাফেঈ, ইমাম আহমাদ স্ত্রীর গর্ভধারণকালে স্বামীকে গর্ভস্থিত সন্তান অস্বীকার করার অনুমতি দিয়েছেন এবং এরই ভিত্তিতে লি’আনকে বৈধ বলেন। কিন্তু ইমাম আবু হানীফা বলেন, যদি স্বামীর অপবাদের ভিত্তি যিনা না হয়ে থাকে বরং শুধু এটাই হয়ে থাকে যে, সে স্ত্রীকে এমন অবস্থায় গর্ভবতী পেয়েছ যখন তার মতে এ গর্ভস্থিত সন্তান তার হতে পারে না তখন এ অবস্থায় লি’আনের বিষয়টিকে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত মূলতবী করে দেয়া উচিত। কারণ অনেক সময় কোন কোন রোগের ফলে গর্ভ সঞ্চার হয়েছে বলে সন্দেহ দেখা দেয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গর্ভসঞ্চার হয় না।

দশঃ যদি পিতা সন্তানের বংশধারা অস্বীকার করে তাহলে লি’আন অনিবার্য হয় পড়ে, এ ব্যাপারে সবাই একমত। আবার এ ব্যাপারেও সবাই একমত যে, একবার সন্তানকে গ্রহণ করে নেবার পর (সে গ্রহণ করাটা যে কোন পর্যায়েরই হোক না কে, সুস্পষ্ট শব্দাবলী ও বাক্যের মাধ্যমে গ্রহণ করা হোক অথবা এমন কাজ করা হোক যাতে মনে হয় শিশুকে গ্রহণ করে নেয়া হয়েছে যেমন, জন্মের পর মোবারকবাদ গ্রহণ করা অথবা শিশুর সাথে পিতৃসুলভ স্নেহপূর্ণ ব্যবহার করা কিংবা তার প্রতিপালনের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করা) পিতার পক্ষে আর তার বংশধারা অস্বীকার করার অধিকার থাকে না। এ অবস্থায় পিতা বংশধারা অস্বীকার করলে কাযাফের শাস্তির অধিকারী হবে। তবে পিতা কতক্ষণ পর্যন্ত বংশধারা অস্বীকার করার অধিকার রাখে, এ ব্যাপারে মতভেদ আছে। ইমাম মালেকের মতে, স্ত্রী যে সময় গর্ভবতী ছিল সে সময় যদি স্বামী গৃহে উপস্থিত থেকে থাকে তাহলে গর্ভসঞ্চারের সময় থেকে নিয়ে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত সময়-কালের মধ্যে স্বামীর জন্য সন্তানের বংশধারা অস্বীকার করার সুযোগ আছে। এরপর তার অস্বীকার করার অধিকার নেই। তবে এ সময় যদি সে অনুপস্থিত থেকে থাকে এবং তার অসাক্ষাতে সন্তান জন্ম নিয়ে থাকে তাহলে যখনই সে জানবে তখন তাকে অস্বীকার করে তাহলে লি’আন করে সন্তানের দায়িত্ব মুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু যদি এক-দু’বছর পরে অস্বীকার করে তাহলে লি’আন হবে ঠিকই কিন্তু সন্তানের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হতে পারবে না। ইমাম আবু ইউসুফের মতে, শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পরে বা জন্ম সম্পর্ক জানার পরে চল্লিশ দিনের মধ্যে পিতার বংশধারা অস্বীকার করার অধিকার আছে। এরপর এ অধিকার বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু এ চল্লিশ দিনের শর্ত অর্থহীন। সঠিক কথা সেটিই যেটি ইমাম আবু হানীফা বলেছেন। অর্থাৎ জন্মের পর বা জন্মের কথা জানার পর এক-দু’দিনের মধ্যেই বংশধারা অস্বীকার করা যেতে পারে। তবে যদি এক্ষেত্রে কোন বাধা থাকে, যাকে যথার্থ বাধা বলে স্বীকার করে নেয়া যেতে পারে, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা।

এগারঃ যদি স্বামী তালাক দেবার পর সাধারণভাবে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর বিরুদ্ধে যিনার অপবাদ দেয় তাহলে ইমাম আবু হানীফার মতে লি’আন হবে না। বরং তার বিরুদ্ধে কাযাফের মামলা দায়ের করা হবে। কারণ লি’আন হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর জন্য। আর তালাকপ্রাপ্তা নারীটি তার স্ত্রী নয়। তবে যদি রজ’ঈ তালাক হয় এবং রুজু (স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেবার) করার সময়-কালের মধ্যে সে অপবাদ দেয়, তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু ইমাম মালেকের মতে, এটি শুধুমাত্র এমন অবস্থায় কাযাফ হবে যখন কোন গর্ভস্থিত বা ভূমিষ্ঠ সন্তানের বংশধারা গ্রহণ করা বা না করার সমস্যা মাঝখানে থাকবে না। অন্যথায় বায়েন তালাক দেবার পরও পুরুষের লি’আন করার অধিকার থাকে। কারণ সে স্ত্রী লোককে বদনাম করার জন্য নয় বরং নিজেই এমন এক শিশুর দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি লাভের উদ্দেশ্যে লি’আন করছে যাকে সে নিজের বলে মনে করে না। ইমাম শাফেঈ প্রায় এই একই মত দিয়েছেন।

বারঃ লি’আনের আইনগত ফলাফলের মধ্য থেকে কোনটার ব্যাপারে সবাই একমত আবার কোনটার ব্যাপারে ফকীহগণের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছে।

যেসব ফলাফলের ব্যাপারে মতৈক্য হয়েছে সেগুলো হচ্ছেঃ স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই কোন শাস্তি লাভের উপযুক্ত হয় না। স্বামী যদি সন্তানের বংশধারা অস্বীকার করে তাহলে সন্তান হবে একমাত্র মায়ের। সন্তান বাপের সাথে সম্পর্কিত হবে না এবং তার উত্তরাধিকারীও হবে না। মা তার উত্তরাধিকারী হবে এবং সে মায়ের উত্তরাধিকারী হবে। নারীকে ব্যভিচারিণী এবং তার সন্তানকে জারজ সন্তান বলার অধিকার কারোর থাকবে না। যদিও লি’আনের সময় তার অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যার ফলে তার ব্যভিচারিণী হবার ব্যাপারে কারোর মনে সন্দেহ না থাকে তবুও তার সন্তানের বিরুদ্ধে আগের অপবাদের পুনরাবৃত্তি করবে সে ‘হদে’র যোগ্য হবে। নারীর মোহরানা বাতিল হয়ে যাবে না। ইদ্দত পালনকালে নারী পুরুষের থেকে খোরপোশ ও বাসস্থানের সুবিধা লাভের হকদার হবে না। নারী ঐ পুরুষের জন্য হারাম হয়ে যাবে।

দু’টি বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। এক, লি’আনের পরে পুরুষ ও নারী কিতাবে আলাদা হবে? দুই, লি’আনের ভিত্তিতে আলাদা হয়ে যাবার পর কি তাদের উভয়ের আবার মিলিত হওয়া সম্ভব? প্রথম বিষয়ে ইমাম শাফেঈ বলেন, যখনই পুরুষ লি’আন শেষ করবে, নারী জবাবী লি’আন করুক বা না করুক তখনই সঙ্গে সঙ্গেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে। ইমাম মালেক, লাইস ইবনে সা’দ ও যুফার বলেন, পুরুষ ও নারী উভয়েই যখন লি’আন শেষ করে তখন ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। অন্যদিকে ইমাম আবু হানিফা, আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ বলেন, লি’আনের ফলে ছাড়াছাড়ি আপনা আপনি হয়ে যায় না বরং আদালত ছাড়াছাড়ি করে দেবার ফলেই ছাড়াছাড়ি হয়। যদি স্বামী নিজেই তালাক দিয়ে দেয় তাহলে ভালো, অন্যথায় আদালতের বিচারপতি তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি করার কথা ঘোষণা করবেন। দ্বিতীয় বিষয়টিতে ইমাম মালেক, আবু ইউসুফ, যুফার, সুফিয়ান সওরী, ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহ, শাফেঈ, আহমেদ ইবনে হাম্বল ও হাসান ইবনে যিয়াদ বলেন, লি’আনের মাধ্যমে যে স্বামী-স্ত্রী আলাদা হয়ে গেছে তারা এরপর থেকে চিরকালের জন্য পরস্পরের ওপর হারাম হয়ে যাবে। তারা পুনর্বার পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইলেও কোন অবস্থাতেই পারবে না। হযরত উমর (রাঃ), হযরত আলী (রাঃ) ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদও (রাঃ) একই মত পোষণ করেন। বিপরীতপক্ষে সা’ঈদ ইবনে মুসাইয়েব, ইবরাহীম নাখঈ, শা’বী, সাঈদ ইবনে জুবাইর, আবু হানীফা ও মুহাম্মাদ রাহেমাহুমুল্লাহর মতে, যদি স্বামী নিজের মিথ্যা স্বীকার করে নেয় এবং তার ওপর কাযাফের হদ জারি হয়ে যায় তাহলে তাদের দু’জনের মধ্যে পুনর্বার বিয়ে হতে পারে। তারা বলেন, তাদের উভয়কে পরস্পরের জন্য হারামকারী জিনিস হচ্ছে লি’আন। যতক্ষণ তারা এর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে ততক্ষণ হারামও প্রতিষ্ঠিত থাকবে কিন্তু যখনই স্বামী নিজের মিথ্যা স্বীকার করে নিয়ে শাস্তি লাভ করবে তখনই লি’আন খতম হয়ে যাবে এবং হারামও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

.
৮.
হযরত আয়েশার (রাঃ) বিরুদ্ধে যে অপবাদ রটানো হয়েছিল সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ অপবাদকে “ইফ্ক” শব্দের মাধ্যমে উল্লেখ করে স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকেই এ অপরাধকে পুরোপুরি খণ্ডন করা হয়েছে। ‘ইফ্ক’ শব্দের অর্থ হচ্ছে, কথা উল্টে দেয়া, বাস্তব ঘটনাকে বিকৃত করে দেয়া। এ অর্থের দিক দিয়ে এ শব্দটিকে ডাহা মিথ্যা ও অপবাদ দেয়া অর্থে ব্যবহার করা হয়। আর কোন দোষারোপ অর্থে শব্দটি ব্যবহার করলে তখন এর অর্থ হয় সুস্পষ্ট মিথ্যা অপবাদ।

এ সূরাটি নাযিলের মূলে যে ঘটনাটি আসল কারণ হিসেবে কাজ করেছিল এখান থেকে তার ওপর আলোচনা শুরু হয়েছে। ভূমিকায় এ সম্পর্কিত প্রারম্ভিক ঘটনা আমি হযরত আয়েশার বর্ণনার মাধ্যমে উদ্ধৃত করেছি। পরবর্তী ঘটনাও তাঁরই মুখে শুনুন। তিনি বলেনঃ “এ মিথ্যা অপবাদের গুজব কমবেশি এক মাস ধরে সারা শহরে ছড়াতে থাকে। নবী ﷺ মারাত্মক ধরনের মানসিক কষ্টে ভুগতে থাকেন। আমি কাঁদতে থাকি। আমার বাপ-মা চরম পেরেশানী ও দুঃখে-শোকে ভুগতে থাকেন। শেষে একদিন রসূলুল্লাহ্ ﷺ আসেন এবং আমার কাছে বসেন। এ সমগ্র সময়-কালে তিনি কখনো আমার কাছে বসেননি। হযরত আবু বকর (রাঃ) ও উম্মে রুমান (হযরত আয়েশার মা) অনুভব করেন আজ কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকর কথা হবে। তাই তাঁরা দু’জনেও কাছে এসে বসেন। রসূলুল্লাহ্ ﷺ বলেন, আয়েশা! তোমার সম্পর্কে আমার কাছে এই খবর পৌঁছেছে। যদি তুমি নিরপরাধ হয়ে থাকো তাহলে আশা করা যায় আল্লাহ তোমার অপরাধ মুক্তির কথা প্রকাশ করে দেবেন। আর যদি তুমি সত্যিই গোনাহে লিপ্ত হয়ে থাকো তাহলে আল্লাহর কাছে তাওবা করো এবং ক্ষমা চাও। বান্দা যখন তার গোনাহ স্বীকার করে নিয়ে তাওবা করে তখন আল্লাহ তা মাফ করে দেন। একথা শুনে আমার চোখের পানি শুকিয়ে যায়। আমি আমার পিতাকে বলি, আপনি রসূলুল্লাহ্র কথার জবাব দিন। তিনি বলেনঃ “মা, আমি কিছু বুঝতে পারছিনা, কি বলবো।” আমি আমার মাকে বললাম, “তুমিই কিছু বলো” তিনিও একই কথা বলেন, “আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না।” একথায় আমি বলি, আপনাদের কানে একটা কথা এসেছে এবং তা মনের মধ্যে জমে বসে গেছে। এখন আমি যদি বলি, আমি নিরপরাধ এবং আল্লাহ সাক্ষী আছেন আমি নিরপরাধ--- তাহলে আপনারা তা মেনে নেবেন না। আর যদি এমন একটি কথা আমি স্বীকার করে নিই যা আমি করিনি--- আর আল্লাহ জানেন আমি করিনি--- তাহলে আপনারা তা মেনে নেবেন। আমি সে সময় হযরত ইয়াকুবের (আঃ) নাম স্মরণ করার চেষ্টা করি কিন্তু নামটি মনে করতে পারিনি। শেষে আমি বলি, এ অবস্থায় আমার জন্য এছাড়া আর কি উপায় থাকে যে, আমি সেই একই কথা বলি যা হযরত ইউসুফের বাপ বলেছিলেন فَصَبْرٌ جَمِيلٌ (এখানে সে ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যখন হযরত ইয়াকুবের সামনে তার ছেলে বিন ইয়াইমিনের বিরুদ্ধে চুরির অপবাদের কথা বর্ণনা করা হয়েছিলঃ সূরা ইউসুফ ১০ রুকূ’তে একথা আলোচিত হয়েছে)। একথা বলে আমি শুয়ে পড়ি এবং অন্যদিকে পাশ ফিরি। সে সময় আমি মনে মনে বলছিলাম, আল্লাহ জানেন আমি গোনাহ করিনি, তিনি নিশ্চয়ই সত্য প্রকাশ করে দেবেন। যদিও একথা আমি কল্পনাও করিনি যে, আমার স্বপক্ষে অহী নাযিল হবে এবং তা কিয়ামত পর্যন্ত পঠিত হতে থাকবে। আল্লাহ নিজেই আমার পক্ষ সমর্থন করবেন। এ থেকে নিজেকে আমি অনেক নিম্নতর মনে করতাম। কিন্তু আমার ধারণা ছিল, রসূলুল্লাহ ﷺ কোন স্বপ্ন দেখবেন, যার মাধ্যমে আল্লাহ আমার নির্দোষিতার কথা জানিয়ে দেবেন। এরই মধ্যে রসূলুল্লাহ্র ﷺ ওপর এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়ে গেলো যা অহী নাযিল হবার সময় হতো, এমন কি ভীষণ শীতের দিনেও তাঁর মুবারক চেহারা থেকে মুক্তোর মতো স্বেদবিন্দু টপকে পড়তে থাকতো। আমরা সবাই চুপ করে গেলাম। আমি তো ছিলাম একদম নির্ভীক। কিন্তু আমার বাপ-মার অবস্থা ছিল যেন কাটলে শরীর থেকে এক ফোঁটা রক্তও পড়বে না। তারা ভয় পাচ্ছিল, না জানি আল্লাহ কি সত্য প্রকাশ করেন। যখন সে অবস্থা খতম হয়ে গেলো তখন রসূলুল্লাহ্ ﷺ ছিলেন অত্যন্ত আনন্দিত। তিনি হেসে প্রথমে যে কথাটি বলেন, সেটি ছিলঃ মুবারক হোক আয়েশা! আল্লাহ তোমার নির্দোষিতার কথা নাযিল করেছেন এবং এরপর নবী ﷺ দশটি আয়াত শুনান (অর্থাৎ ১১ নম্বর আয়াত থেকে ২০ নম্বর পর্যন্ত)। আমার মা বলেন ওঠো এবং রসূলুল্লাহ্র ﷺ প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। আমি বললাম, “আমি তাঁর প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো না, তোমাদের দু’জনের প্রতিও না। বরং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, যিনি আমার নির্দোষিতার কথা নাযিল করেছেন। তোমরা তো এ মিথ্যা অপবাদ অস্বীকারও করোনি।” (উল্লেখ্য, এটি কোন একটি বিশেষ হাদীসের অনুবাদ নয় বরং হাদীস ও সীরাতের কিতাবগুলোতে এ সম্পর্কিত যতগুলো বর্ণনা হযরত আয়েশার (রাঃ) উদ্ধৃত হয়েছে সবগুলোর সার নির্যাস আমি এখানে পরিবেশন করেছি)।

এ প্রসঙ্গে আরও একটি সূক্ষ্ম কথা অনুধাবন করতে হবে। হযরত আয়েশার (রাঃ) নিরপরাধ হবার কথা বর্ণনা করার আগে পুরো একটি রুকূ’তে যিনা, কাযাফ ও লি’আনের বিধান বর্ণনা করে মহান আল্লাহ প্রকৃতপক্ষে এ সত্যটির ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করে দিয়েছেন যে, যিনার অপবাদ দেবার ব্যাপারটি কোন ছেলেখেলা নয়, নিছক কোন মাহফিলে হাস্যরস সৃষ্টি করার জন্য একে ব্যবহার করা যাবে না। এটি একটি মারাত্মক ব্যাপার। অপবাদদাতার অপবাদ যদি সত্য হয় তাহলে তাকে সাক্ষী আনতে হবে। যিনাকারী ও যিনাকারীনীকে ভয়াবহ শাস্তি দেয়া হবে। আর অপবাদ যদি মিথ্যা হয় তাহলে অপবাদদাতা ৮০ ঘা বেত্রাঘাত লাভের যোগ্য, যাতে ভবিষ্যতে সে আর এ ধরনের কোন কাজ করার দুঃসাহস না করে। এ অভিযোগ যদি স্বামী দিয়ে থাকে তাহলে আদালতে লি’আন করে তাকে ব্যাপারটি পরিষ্কার করে নিতে হবে। একথাটি একবার মুখে উচ্চারণ করে কোন ব্যক্তি ঘরে নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারে না। কারণ এটা হচ্ছে একটা মুসলিম সমাজ। সারা দুনিয়ায় কল্যাণ ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য এ সমাজ প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। এখানে যিনা কোন আনন্দদায়ক বিষয়ে পরিণত হতে পারে না এবং এর আলোচনাও হাস্য রসালাপের বিষয়বস্তুতে পরিণত হতে পারে না।

৯.
হাদীসে মাত্র কয়েকজন লোকের নাম পাওয়া যায়। তারা এ গুজবটি ছড়াচ্ছিল। তারা হচ্ছে আবদুল্লাহ্‌ ইবনে উবাই, যায়েদ ইবনে রিফা’আহ (এ ব্যক্তি সম্ভবত রিফা’আ ইবনে যায়েদ ইহুদী মুনাফিকের ছেলে), মিস্‌তাহ ইবনে উসামাহ, হাস্‌সান ইবনে সাবেত ও হামনা বিনতে জাহশ। এর মধ্যে প্রথম দু’জন ছিল মুনাফিক এবং বাকি তিনজন মু’মিন। মু’মিন তিন জন বিভ্রান্তি ও দুর্বলতার কারণে এ চক্রান্তের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এরা ছাড়া আর যারা কমবেশী এ গোনাহে জড়িয়ে পড়েছিলেন তাদের নাম হাদীস ও সীরাতের কিতাবগুলোতে আমার নজরে পড়েনি।
১০.
এর অর্থ হচ্ছে ভয় পেয়ো না। মুনাফিকরা মনে করছে তারা তোমাদের ওপর একটা বিরাট আঘাত হেনেছে। কিন্তু ইনশাআল্লাহ্ এটি উল্টো তাদের ওপরই পড়বে এবং তোমাদের জন্য ভালো প্রমাণিত হবে। যেমন আমি ইতিপূর্বে ভূমিকায় বর্ণনা করে এসেছি, মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্বের যে আসল ময়দান ছিল মুনাফিকরা সেখানেই তাদেরকে পরাস্ত করার জন্য এ প্রপাগাণ্ডা শুরু করে। অর্থাৎ নৈতিকতার ময়দান। এখানে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করার কারণে তারা প্রত্যেকটি ময়দানে নিজেদের প্রতিপক্ষের ওপর বিজয় লাভ করে চলছিল। আল্লাহ তাকেও মুসলমানদের কল্যাণের উপকরণে পরিণত করে দিলেন। এ সময় একদিকে নবী ﷺ , অন্যদিকে হযরত আবু বকর ও তাঁর পরিবারবর্গ এবং তৃতীয় দিকে সাধারণ মু’মিনগন যে কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করেন তা থেকে একথা দিবালোকের মতো সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, তাঁরা অসৎকর্ম থেকে কত দূরে অবস্থান করেন, কতটা সংযম ও সহিষ্ণুতার অধিকারী, কেমন ন্যায়নিষ্ঠ ও কি পরিমাণ ভদ্র ও রুচিশীল মানসিকতার ধারক। নবী ﷺ এর ইজ্জতের ওপর যারা আক্রমণ চালিয়েছিল তাঁর একটি মাত্র ইঙ্গিতই তাদের শিরচ্ছেদের জন্য যথেষ্ট ছিল, কিন্তু এক মাস ধরে তিনি সবরের সাথে সবকিছু বরদাশ্ত করতে থাকেন এবং আল্লাহর হুকুম এসে যাবার পর কেবলমাত্র যে তিনজন মুসলমানের বিরুদ্ধে কাযাফ তথা যিনার মিথ্যা অপবাদের অপরাধ প্রমাণিত ছিল তাদের ওপর ‘হদ’ জারি করেন। এরপরও তিনি মুনাফিকদেরকে কিছুই বলেননি। হযরত আবু বকরের নিজের আত্মীয়, যার নিজের ও পরিবারের ভরণপোষন তিনি করতেন, সেও তাঁদের কলিজায় তীর বিঁধিয়ে দিতে থাকে কিন্তু এর জবাবে আল্লাহর এ নেক বান্দাটি না তার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করেন, না তার পরিবার-পরিজনকে সাহায্য-সহায়তা দেয়া বন্ধ করেন। নবীর পবিত্র স্ত্রীগণের একজনও সতীনের দুর্নাম ছড়াবার কাজে একটুও অংশ নেননি। বরং কেউ এ অপবাদের প্রতি নিজের সামান্যতমও সন্তোষ, পছন্দ অথবা মেনে নেয়ার মনোভাবও প্রকাশ করেননি। এমনিক হযরত যয়নবের সহোদর বোন হাম্না বিনতে জাহ্শ নিছক নিজের বোনের জন্য তার সতীনের দুর্নাম রটাচ্ছিলেন কিন্তু তিনি স্বয়ং সতীনের পক্ষে ভালো কথাই বলেন। হযরত আয়েশার নিজের বর্ণনা, রসূলের স্ত্রীগণের মধ্যে সবচেয়ে বেশী আড়ি চলতো আমার যয়নবের সাথে। কিন্তু “ইফ্ক”-এর ঘটনা প্রসঙ্গে রসূলুল্লাহ্ ﷺ যখন তাকে জিজ্ঞেস করেন, আয়েশা সম্পর্কে তুমি কি জানো? তখন এর জবাবে তিনি বলেন, হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহর কসম, আমি তার মধ্যে ভালো ছাড়া আর কিছুই জানি না। হযরত আয়েশার নিজের ভদ্রতা ও রুচিশীলতার অবস্থা এই ছিল যে, হযরত হাস্সান ইবনে সাবেত তাঁর দূর্নাম রটাবার ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ করেন কিন্তু এতদসত্ত্বেও তিনি সবসময় তাঁর প্রতি সম্মান ও বিনয়পূর্ণ ব্যবহার করেছেন। লোকেরা স্মরণ করিয়ে দেয়, ইনি তো সেই ব্যক্তি যিনি আপনার বিরুদ্ধে দুর্নাম রটিয়েছিলেন। কিন্তু এ জবাব দিয়ে তিনি তাদের মুখ বন্ধ করে দেন যে, এ ব্যক্তি ইসলামের শত্রু কবি গোষ্ঠীকে রসূলুল্লাহ্ ﷺ ও ইসলামের পক্ষ থেকে দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতেন। এ ঘটনার সাথে যাদের সরাসরি সম্পর্ক ছিল এ ছিল তাদের অবস্থা। আর সাধারণ মুসলমানদের মানসিকতা কতদূর পরিচ্ছন্ন ছিল তা এ ঘটনা থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, হযরত আবু আইয়ুব আনসারীর স্ত্রী যখন তাঁর কাছে এ গুজবগুলোর কথা বললেন তখন তিনি বলেন, “আইয়ুবের মা! যদি সে সময় আয়েশার জায়গায় তুমি হতে, তাহলে তুমি কি এমন কাজ করতে?” তিনি বলেন, “আল্লাহ্র কসম, আমি কখনো এমন কাজ করতাম না।” হযরত আবু আইয়ুব বলেন, “তাহলে আয়েশা তোমার চেয়ে অনেক বেশী ভাল। আর আমি বলি কি, যদি সাফওয়ানের জায়গায় আমি হতাম, তাহলে এ ধরনের কথা কল্পনাই করতে পারতাম না। সফওয়ান তো আমার চেয়ে ভালো মুসলমান।” এভাবে মুনাফিকরা যা কিছু চেয়েছিল ফল হলো তার একেবারে উল্টো এবং মুসলমানদের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব আগের তুলনায় আরো বেশী সুস্পষ্ট হয়ে গেল।

এছাড়া এ ঘটনার মধ্যে কল্যাণের আর একটি দিকও ছিল। সেটি ছিল এই যে, এ ঘটনাটি ইসলামের আইন-কানুন, বিধি-বিধান ও তামাদ্দুনিক নীতি-নিয়মের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজনের উপলক্ষ্যে পরিণত হয়। এর বদৌলতে মুসলমানরা আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন সব নির্দেশ লাভ করে যেগুলো কার্যকর করে মুসলিম সমাজকে চিরকালের জন্য অসৎকর্মের উৎপাদন ও সেগুলোর সম্প্রসারণ থেকে সংরক্ষিত রাখা যেতে পারে আর অসৎকর্ম উৎপাদিত হয়ে গেলেও যথাসময়ে তার পথ রোধ করা যেতে পারে।

এছাড়াও এর মধ্যে কল্যাণের আর একটি দিকও ছিল। মুসলমানরা সকলেই একথা ভালোভাবে জেনে যায় যে, নবী ﷺ অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী নন। যা কিছু আল্লাহ জানান তাই তিনি জানেন। এর বাইরে তাঁর জ্ঞান ততটুকুই যতটুকু জ্ঞান একজন মানুষের থাকতে পারে। একমাস পর্যন্ত হযরত আয়েশার (রাঃ) ব্যাপারে তিনি ভীষণ পেরেশান থাকেন। কখনো চাকরানীকে জিজ্ঞেস করতেন, কখনো পবিত্র স্ত্রীগণকে, কখনো হযরত আলীকে (রাঃ), কখনো হযরত উসামাকে (রাঃ)। শেষ পর্যন্ত হযরত আয়েশাকে (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেও এভাবে জিজ্ঞেস করেন যে, যদি তুমি এ গোনাহটি করে থাকো, তাহলে তাওবা করো আর না করে থাকলে আশা করা যায় আল্লাহ তোমার নিরপরাধ হওয়া প্রমাণ করে দেবেন। যদি তিনি অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী হতেন তাহলে এ পেরেশানী, এ জিজ্ঞাসাবাদ এবং এ তাওবার উপদেশ কেন? তবে আল্লাহর অহী যখন সত্য কথা জানিয়ে দেয় তখন সারা মাসে তিনি যা জানতেন না তা জানতে পারেন। এভাবে আকীদার অন্ধ আবেগের বশবর্তী হয়ে সাধারণত লোকেরা নিজেদের নেতৃবর্গের ব্যাপারে যে বাড়াবাড়ি ও আতিশয্যের শিকার হয়ে থাকে তা থেকে আল্লাহ সরাসরি অভিজ্ঞতা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে বাঁচার ব্যবস্থা করেন। বিচিত্র নয়, এক মাস পর্যন্ত অহী না পাঠাবার পেছনে আল্লাহর এ উদ্দেশ্যটাও থেকে থাকবে। প্রথম দিনেই অহী এসে গেলে এ ফায়দা লাভ করা যেতে পারতো না। (আরো বেশী বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আন্ নাম্ল, ৮৩ টীকা)।

১১.
অর্থাৎ আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই। সে ছিল এ অপবাদটির মূল রচয়িতা এবং এ কদর্য প্রচারাভিযানের আসল নায়ক। কোন কোন হাদীসে ভুলক্রমে হযরত হাস্সান ইবনে সাবেতকে (রাঃ) এ আয়াতের লক্ষ্য বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু এটা মূলত বর্ণনাকারীদের নিজেদেরই বিভ্রান্তির ফল। নয়তো হযরত হাস্সানের (রাঃ) দুর্বলতা এর চেয়ে বেশী কিছু ছিল না যে, তিনি মুনাফিকদের ছড়ানো এ ফিত্নায় জড়িয়ে পড়েন। হাফেয ইবনে কাসীর যথার্থ বলেছেন, এ হাদীসটি যদি বুখারী শরীফে উদ্ধৃত না হতো, তাহলে এ প্রসঙ্গটি আলোচনাযোগ্যই হতো না। এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে বড় মিথ্যা অপবাদ হচ্ছে এই যে, বনী উমাইয়াহ হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে এ আয়াতের লক্ষ্য মনে করে। বুখারী, তাবারানী ও বাইহাকীতে হিশাম ইবনে আবদুল মালিক উমুবীর উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে الَّذِى تَوَلَّى كِبْرَهُ অর্থ হচ্ছে আলী ইবনে আবু তালেব। অথচ এ ফিত্নায় হযরত আলীর (রাঃ) গোড়া থেকেই কোন অংশ ছিল না। ব্যাপার শুধু এতটুকু ছিল, যখন তিনি নবী ﷺ কে খুব বেশী পেরেশান দেখেন, তখন নবী ﷺ তাঁর কাছে পরামর্শ চাওয়ায় তিনি বলেন, আল্লাহ এ ব্যাপারে আপনাকে কোন সংকীর্ণ পরিসরে আবদ্ধ রাখেননি, বহু মেয়ে আছে, আপনি চাইলে আয়েশাকে তালাক দিয়ে আর একটি বিয়ে করতে পারেন। এর অর্থ কখনোই এটা ছিল না যে, হযরত আয়েশার বিরুদ্ধে যে মিথ্যা অপবাদ দেয়া হচ্ছিল হযরত আলী তাকে সত্য বলেছিলেন। বরং শুধুমাত্র নবী ﷺ এর পেরেশানী দূর করাই ছিল এর উদ্দেশ্য।
.
১২.
অন্য একটি অনুবাদ এও হতে পারে, নিজেদের লোকদের অথবা নিজেদের সমাজের লোকদের ব্যাপারে ভালো ধারণা করোনি কেন? আয়াতের শব্দাবলী দু’ধরনের অর্থের অবকাশ রাখে। আর এ দ্ব্যর্থবোধক বাক্য ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে একটি গভীর তত্ত্ব। এটি ভালোভাবে অনুধাবন করতে হবে। হযরত আয়েশা (রাঃ) ও সাফ্ওয়ান ইবনে মু’আত্তালের (রাঃ) মধ্যে যে ব্যাপারটি ঘটে গিয়েছিল তা তো এই ছিল যে, কাফেলার এক ভদ্র মহিলা (তিনি নবী পত্নী ছিলেন একথা বাদ দিলেও) ঘটনাক্রমে পেছনে থেকে গিয়েছিলেন। আর কাফেলারই এক ব্যক্তি যিনি ঘটনাক্রমে পেছনে থেকে গিয়েছিলেন, তিনি তাঁকে নিজের উটের পিঠে বসিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। এখন যদি কেউ বলে, নাউযুবিল্লাহ্ এরা দু’জন নিজেদেরকে একান্তে পেয়ে গোনাহে লিপ্ত হয়ে গেছেন, তাহলে তার একথার বাহ্যিক শব্দাবলীর আড়ালে আরো দু’টো কাল্পনিক কথাও রয়ে গেছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, বক্তা (পুরুষ হোক বা নারী) যদি নিজেই ঐ জায়গায় হতেন, তাহলে কখনোই গোনাহ না করে থাকতেন না। কারণ তিনি যদি গোনাহ থেকে বিরত থেকে থাকেন তাহলে এটা শুধু এজন্য যে, বিপরীত লিংগের কেউ এ পর্যন্ত এভাবে একান্তে তার নাগালে আসেনি নয়তো এমন সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারাবার লোক তিনি নন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, যে সমাজের তিনি একজন সদস্য, তার নৈতিক অবস্থা সম্পর্কে তার ধারণা হচ্ছে, এখানে এমন একজন নারী ও পুরুষ নেই যিনি এ ধরনের সুযোগ পেয়ে গোনাহে লিপ্ত হননি। এতো শুধুমাত্র তখনকার ব্যাপার যখন বিষয়টি নিছক একজন পুরুষ ও একজন নারীর সাথে জড়িত থাকে। আর ধরুন যদি সে পুরুষ ও নারী উভয়ই এক জায়গার বাসিন্দা হন এবং যে মহিলাটি ঘটনাক্রমে কাফেলা থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন তিনি ঐ পুরুষটির কোন বন্ধু, আত্মীয় বা প্রতিবেশীর স্ত্রী, বোন বা মেয়ে হয়ে থাকেন তাহলে ব্যাপারটি আরো গুরুতর হয়ে যায়। এক্ষেত্রে এর অর্থ এ দাঁড়ায় যে, বক্তা নিজেই নিজের ব্যক্তি সত্ত্বা সম্পর্কেও এমন জঘন্য ধারণা পোষণ করেন যার সাথে ভদ্রতা ও সৌজন্যবোধের দূরতম সম্পর্কও নেই। কে এমন সজ্জন আছেন যিনি একথা চিন্তা করতে পারেন যে, তার কোন বন্ধু, প্রতিবেশী বা পরিচিত ব্যক্তির গৃহের কোন মহিলার সাথে বিপদগ্রস্ত অবস্থায় তার পথে দেখা হয়ে যাবে এবং প্রথম অবস্থায়ই তিনি তার ইজ্জত লুটে নেবার কাজ করবেন তারপর তাকে গৃহে পৌঁছিয়ে দেবার কথা চিন্তা করবেন। কিন্তু এখানে তো ব্যাপার ছিল এর চেয়ে হাজার গুণ গুরুতর মহিলা অন্য কেউ ছিলেন না, তিনি ছিলেন স্বয়ং রসূলুল্লাহ্ ﷺ এর স্ত্রী, যাঁদেরকে প্রত্যেকটি মুসলমান নিজের মায়ের চেয়েও বেশী সম্মানের যোগ্য মনে করতো এবং যাঁদেরকে আল্লাহ নিজেই প্রত্যেক মুসলমানের ওপর নিজের মায়ের মতই হারাম গণ্য করেছিলেন। পুরুষটি কেবলমাত্র ঐ কাফেলার একজন সদস্য, ঐ সেনাদলের একজন সৈন্য এবং ঐ শহরের একজন অধিবাসীই ছিলেন না বরং তিনি মুসলমানও ছিলেন। ঐ মহিলার স্বামীকে তিনি আল্লাহর রসূল এবং নিজের নেতা ও পথপ্রদর্শক বলে মেনে নিয়েছিলেন আর তাঁর হুকুমে প্রাণ উৎসর্গ করে দেয়ার জন্য বদরের যুদ্ধের মতো ভয়াবহ জিহাদে অংশ নিয়েছিলেন। এ অবস্থায় তো এ উক্তির মানসিক প্রেক্ষাপট জঘন্যতার এমন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়, যার চেয়ে নোংরা ও ঘৃণা কোন প্রেক্ষাপটের কথা চিন্তাই করা যায় না। তাই মহান আল্লাহ বলছেন, মুসলিম সমাজের যেসব ব্যক্তি একথা তাদের কণ্ঠে উচ্চারণ করেছে অথবা কমপক্ষে একে সন্দেহযোগ্য মনে করেছে তারা নিজেদের মন-মানসিকতারও খুবই খারাপ ধারণা দিয়েছে এবং নিজেদের সমাজের লোকদেরকেও অত্যন্ত হীন চরিত্র ও নিকৃষ্ট নৈতিকবৃত্তির অধিকারী মনে করেছে।
১৩.
অর্থাৎ একথাতো বিবেচনার যোগ্যই ছিল না। একথা শোনার সাথে সাথেই প্রত্যেক মুসলমানের একে সুস্পষ্ট মিথ্যাচার, মিথ্যা ও বানোয়াট কথা ও অপবাদ আখ্যা দেয়া উচিত ছিল। সম্ভবত কেউ এখানে প্রশ্ন করতে পারে, একথাই যদি ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে স্বয়ং রসূলুল্লাহ্ ﷺ ও আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহুই বা প্রথম দিনই একে মিথ্যা বলে দিলেন না কেন? কেন তারা একে এতটা গুরুত্ব দিলেন? এর জবাব হচ্ছে, স্বামী ও পিতার অবস্থা সাধারণ লোকদের তুলনায় ভিন্ন ধরনের হয়। যদিও স্ত্রীকে স্বামীর চেয়ে বেশী কেউ চিনতে বা জানতে পারে না এবং একজন সৎ, ভদ্র ও সম্ভ্রান্ত স্ত্রী সম্পর্কে কোন সুস্থ বুদ্ধি সম্পন্ন স্বামী লোকদের অপবাদের কারণে খারাপ ধারণা করতে পারে না, তবুও যদি তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া হয় তাহলে তখন সে এমন এক ধরনের সংকটের মুখোমুখি হয় যার ফলে সে একে মিথ্যা অপবাদ বলে প্রত্যাখ্যান করলে প্রচারণাকারীদের মুখ বন্ধ হবে না বরং তারা নিজেদের কণ্ঠ আরো এক ডিগ্রী উঁচুতে চড়িয়ে বলতে থাকবে, দেখো, বউ কেমন স্বামীর বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, সবকিছু করে যাচ্ছে আর স্বামী মনে করছে আমার স্ত্রী বড়ই সতী সাধ্বী। এ ধরনের সংকট মা-বাপের ক্ষেত্রেও দেখা দেয়। সে বেচারারা নিজেদের মেয়ের সতীত্বের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদের প্রতিবাদে যদি মুখ খোলেও তাহলে মেয়ের অবস্থান পরিষ্কার হয় না। প্রচারণাকারীরা একথাই বলবে, মা-বাপ তো, কাজেই নিজের মেয়ের পক্ষ সমর্থন করবে না তো আর কি করবে। এ জিনিসটিই রসূলুল্লাহ্ ﷺ এবং হযরত আবু বকর ও উম্মে রুমানকে ভিতরে ভিতরে শোকে-দুঃখে জর্জরিত ও বিহবল করে চলছিল। নয়তো আসলে তাদের মনে কোন সন্দেহ ছিল না। রসূলুল্লাহ্ ﷺ তো তাঁর ভাষণে পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন, আমি আমার স্ত্রীর মধ্যে কোন খারাপ জিনিস দেখিনি এবং যে ব্যক্তির সম্পর্কে এ অপবাদ দেয়া হচ্ছে তার মধ্যেও না।
অনুবাদ: