আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১
আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২
আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২
আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩
আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭
আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১
আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০
আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭
আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০
আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২
আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫
হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২
ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২
আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮
বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪
আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫
আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮
আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০
আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫
আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫
আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০
আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭
ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১
আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬
ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭
আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০
আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯
আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২
আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০
আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬
এখানে এ আলোচনাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় যে, একদিকে কুরআন হযরত ইয়াকূব আলাইহিস সালামকে এভাবে পয়গম্বরের বিপুল মর্যাদা সহকারে পেশ করছে কিন্তু অন্যদিকে বনী ইসরাঈল তাঁকে পেশ করছে আরবের একজন সাধারণ বেদুইনের মতো করে। বাইবেলের বর্ণনা মতে, যখন ছেলেরা এসে খবর দিল, “ইউসুফ এখনো বেঁচে আছে এবং সেই-ই সারা মিসর দেশের শাসনকর্তা তখন ইয়াকূব হতভম্ব হয়ে গেলেন। কেননা তিনি এটা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না... পরে যখন তিনি তাঁদের নিয়ে যাবার জন্য ইউসুফের পাঠানো শকটগুলো দেখলেন তখন তাঁর ধড়ে প্রাণ এলো।” (আদি পুস্তক ৪৫: ২৬-২৭)
এখানে একজন জ্ঞানানুসন্ধানীর মনে প্রশ্ন জাগে, বনী ইসরাঈল যখন মিসরে প্রবেশ করে তখন হযরত ইউসুফ (আ) সহ তাদের সংখ্যা ছিল ৬৮ এবং প্রায় ৫ শত বছর পর যখন তারা মিসর থেকে বের হয় তখন তাদের সংখ্যা ছিল কয়েক লাখ। বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী মিসর ত্যাগ করার পরের বছর সিনাইয়ের মরু এলাকায় হযরত মূসা (আ) তাদের যে আদমশুমারী করান তাতে কেবলমাত্র যুদ্ধ করতে সমর্থ যুবকদের সংখ্যা ৬,০৩,৫৫০ ছিল। এর মানে এ দাঁড়ায়, নারী-পুরুষ-শিশু মিলিয়ে সব শুদ্ধ তাদের সংখ্যা হবে অন্তত ২০ লাখ। কোন হিসেবে কি ৬৮ জন থেকে ৫ শত বছরে বংশবৃদ্ধি পেয়ে ২০ লাখ হতে পারে? যদি ধরা যায়, সারা মিসরের জনসংখ্যা এ সময় ছিল ২ কোটি (যা অবশ্যি খুব বেশী অতিরঞ্জিত বিবেচিত হবে) তাহলে এর অর্থ এ দাঁড়াবে যে, শুধুমাত্র বনী ইসরাঈলের সংখ্যাই সেখানে ছিল শতকরা ১০ ভাগ। শুধুমাত্র বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে একটি পরিবারের লোকসংখ্যা কি এ পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে? এ প্রশ্নটি সম্পর্কে চিন্ত-ভাবনা করলে একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্যের প্রকাশ ঘটে। একথা ঠিক ৫শত বছরে একটি পরিবারের লোকসংখ্যা এত বেশী বাড়তে পারে না। কিন্তু বনী ইসরাঈল ছিল নবীদের সন্তান। তাদের নেতা হযরত ইউসুফের (আ) বদৌলতে তারা মিসরে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল। এ ইউসুফ (আ) নিজেই ছিলেন নবী। তারপর থেকে চার পাঁচশো বছর পর্যন্ত দেশের শাসন কর্তৃত্ব তাদেরই হাতে ছিল। এ সময় নিশ্চয়ই তারা মিসরে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচার করে থাকবেন। মিসরবাসীদের মধ্য থেকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল তাদের কেবল ধর্মই নয়, তামাদ্দুন এবং সমগ্র জীবন ব্যবস্থাই মিসরীয় অমুসলিমদের থেকে আলাদা হয়ে বনী ইসরাঈলের রঙে রঞ্জিত হয়ে গিয়ে থাকবে। মিসরীয়রা তাদের সবাইকে ঠিক তেমনি আগন্তুক গণ্য করে থাকবে যেমন ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দুরা ভারতীয় মুসলমানদেরকে গণ্য করে থাকে। অনারব মুসলমানদের ওপর আজ ‘মোহামেডান” শব্দটি যেভাবে লাগানো হয় তাদের ওপর ঠিক তেমনিভাবেই ‘ইসরাঈলী’ শব্দটি লাগানো হয়ে থাকবে। আর তাছাড়া তারা নিজেরাও দ্বীনী ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক এবং বিয়ে-শাদীর সম্পর্কের কারণে অমুসলিম মিসরীয়দের থেকে বিচ্ছিন্ন এবং বনী ইসরাঈলের সাথে একাত্ম হয়ে গিয়ে থাকবে। এ কারণে যখন মিসরে জাতীয়তাবাদের প্রবল জোয়ার উঠলো তখন কেবলমাত্র বনী ইসরাঈলই নির্যাতনের শিকার হলো না বরং মিসরীয় মুসলিমরাও তাদের সাথে একইভাবে নির্যাতীত হলো। আর বনী ইসরাঈল যখন মিসর ত্যাগ করলো তখন মিসরীয় মুসলমানরাও তাদের সাথে বের হলো এবং তাদের সবাইকে বনী ইসরাঈলের সাথে গণ্য করা হতে থাকলো। বাইবেলের বিভিন্ন ইঙ্গিত থেকে আমাদের এ ধারণার সমর্থন মেলে। উদাহরণস্বরূপ “যাত্রা পুস্তকে” যেখানে বনী ইসরাঈলদের মিসর থেকে বের হবার অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে সেখানে বাইবেল লেখক বলছেনঃ “আর তাহাদের সাথে মিশ্রিত লোকদের মহাজনতাও গেলো।” (১২: ৩৮) অনুরূপভাবে “গণনা পুস্তকে”ও তিনি আবার বলছেনঃ “আর তাহাদের মধ্যবর্তী মিশ্রিত লোকেরা লোভাতুর হইয়া উঠিল।” (১১: ৪) তারপর পর্যায়ক্রমে এ অইসরাঈলী মুসলমানদের জন্য “আগন্তুক” ও “পরদেশী” পরিভাষা ব্যবহার করা হতে থাকে। বস্তুত তাওরাতে হযরত মূসাকে যেসব বিধান দেয়া হয় তার মধ্যে আমরা পাইঃ
“তোমরা ও তোমাদের মধ্যে বসবাসকারী বিদেশী লোক, উভয়ের জন্য একই ব্যবস্থা হইবে; ইহা তোমাদের পুরুষানুক্রমে পালনীয় চিরস্থায়ী বিধি। সদা প্রভুর সামনে তোমরা ও বিদেশীয়েরা, উভয়ে সমান। তোমাদের ও তোমাদের মধ্যে বসবাসকারী বিদেশীয়দের জন্য একই ব্যবস্থা ও একই শাসন হইবে।” (গণনা পুস্তক ১৫: ১৫-১৬)
“কি স্বজাতীয় কি বিদেশী যে ব্যক্তি নিসংকোচে পাপ করে, সে সদাপ্রভুর অবমাননা করে, সেই ব্যক্তি আপন লোকদের মধ্য হইতে উচ্ছিন্ন হইবে।” (গণনা পুস্তক ১৫: ৩০)
“তোমরা তোমাদের ভ্রাতাদের মধ্যে, চাই স্বদেশী হোক বা বিদেশী হোক, ন্যায্য বিচার করিও।” (দ্বিতীয় বিবরণ ১: ১৬)
আল্লাহর কিতাবে অইসরাঈলীদের জন্য আসলে কি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছিল যাকে অনুবাদকরা ‘বিদেশী’ বানিয়ে রেখে দিয়েছে, সেটা এখন অনুসন্ধানের মাধ্যমে জানা কঠিন।
فَلَمَّا نَظَرَ رَكَضَ لِاسقِبَالِهِم مِن بَابِ الخِيمَةِ وَسَجَدَ اِلَى الَارضِ (تكوين: ٣-١٨)
তারপর যেখানে বলা হচ্ছে, হেতের সন্তানরা হযরত সারাকে দাফন করার জন্য বিনামূল্যে কবরের জন্য জমি দান করে, সেখানে উর্দূ বাইবেলে যা বলা হয়েছে তার বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়। “ইবরাহীম উঠে বনী হেতের সামনে, যারা সেই দেশের বাসিন্দা ছিল, কুর্নিশ করলেন এবং তাদের সাথে এভাবে আলাপ করলেন।” (বাংলা বাইবেলে বলা হয়েছেঃ তখন আব্রাহাম উঠিয়া তদ্দেশীয় লোকদিগের, অর্থাৎ হেতের সন্তানগণের কাছে প্রণিপাত করিলেন ও সম্ভাসন করিয়া কহিলেন,) তারপর যখন তারা শুধু কবরের জমিই নয়, পুরো একটি ক্ষেত এবং একটি গুহা দান করে তখন “ইবরাহীম সেই দেশীয় লোকদের সামনে মাথা নত করলেন” (বাংলা বাইবেলে বলা হয়েছেঃ তখন আব্রাহাম তদ্দেশীয় লোকদের সামনে প্রণিপাত করিলেন। কিন্তু আরবী অনুবাদে এ উভয় জায়গায় কুর্নিশ করা, প্রণিপাত করা, মাথা নত করা ইত্যাদির জন্য “সিজদাহ” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ
فقام ابراهيم وسجد لشعب الارض لبنى حت (تكوين: ٧-٢٢)
فسجد ابراهيم امام شعب الارض (تكوين: ١٢-٢٣)
ইংরেজী বাইবেলে এখানে যে শব্দাবলী ব্যবহার করা হয়েছে তা হচ্ছেঃ
“Bowed himself towards the ground.
“Bowed himself to the people of the land and Abrahan bowed down himself before the people of the land”
এ ধরনের বিষয়ের বহু দৃষ্টান্ত বাইবেলে পাওয়া যায়। এ থেকে পরিষ্কার জানা যায়, বর্তমানে ইসলামী পরিভাষায় “সিজদাহ” বলতে যা বুঝায় এ সিজদাহর অর্থ তা নয়।
যারা বিষয়টির যথার্থ স্বরূপ না জেনে এর ব্যাখ্যায় হালকাভাবে লিখে দিয়েছেন যে, পূর্ববর্তী শরীয়াতগুলোয় গায়রুল্লাহকে সম্মানের সিজদা অথবা আদবের সিজদা করা জায়েয ছিল তারা নিছক একটি ভিত্তিহীন কথা বলেছেন। ইসলামী পরিভাষায় যাকে সিজদা বলা হয়, যদি সিজদা বলতে তাকেই বুঝানো হয় তাহলে আল্লাহর পাঠানো শরীয়াতে তা কোনদিন গায়রুল্লাহর জন্য জায়েয ছিল না। বাইবেলে উল্লেখিত হয়েছে যে, ব্যবিলনের পরাধীনতার যুগে বাদশাহ অহশ্বেরশ যখন হামানকে নিজের প্রধান অধ্যক্ষ করলেন এবং তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার জন্য তাকে সিজদা করার জন্য সবাইকে হুকুম দিলেন তখন বনী ইসরাঈলের পরম খোদাভক্ত ওলী মর্দখয় (মর্দকী) তা করতে অস্বীকার করলেন। (ইষ্টের ৩: ১-২) তালমূদে এ ঘটনাটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে এর যে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে তা প্রণিধানযোগ্যঃ
“বাদশাহর কর্মচারীরা জিজ্ঞেস করলোঃ ব্যাপার কি, তুমি কেনইবা হামানকে সিজদা করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছো? আমরাও তো মানুষ কিন্তু আমরা বাদশাহর হুকুম মেনে চলি। তিনি জবাব দিলেনঃ তোমরা অজ্ঞ, একজন মরণশীল মানুষ, যে কাল মাটির সাথে মিশে যাবে, সে কি এমন যোগ্যতা রাখে যে, তার শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেয়া হবে? আমি কি এমন একজনকে সিজদা করবো, যে একটি মহিলার পেট থেকে জন্ম নিয়েছে? যে কাল শিশু ছিল, আজ যুবক হয়েছে, কাল বুড়ো হয়ে যাবে এবং পরশু মারা যাবে? না, আমি তো একমাত্র সেই অনাদি অনন্ত আল্লাহর সামনে মাথা নত করবো যিনি চিরঞ্জীব ও স্বয়ম্ভু....... যিনি বিশ্বলোকের স্রষ্টা ও শাসক, আমি তো একমাত্র তাঁকেই সম্মান করবো, আর কাউকে নয়।
কুরআন নাযিলের প্রায় এক হাজার বছর আগে একজন ইসরাঈলী মু’মিনের কন্ঠে কথাগুলো উচ্চারিত হয়। কোন অর্থেও গায়রুল্লাহকে সিজদা করা বৈধ এ ধরনের চিন্তার নামগন্ধও এতে পাওয়া যায় না।
হযরত ইউসুফের এ মূল্যবান ভাষণটিও বাইবেল ও তালমূদে কোন স্থান পায়নি। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এ কিতাব দু’টি অপ্রয়োজনীয় গল্প কাহিনীর বিস্তারিত বিবরণে ভরা। অথচ যেসব বিষয় নৈতিক মূল্যমান ও মূল্যবোধের সাথে সম্পর্ক রাখে এবং যার সাহায্যে নবীগণের মূল শিক্ষা, তাঁদের যথার্থ মিশন এবং তাঁদের সীরাতের শিক্ষণীয় দিকগুলোর ওপর আলোকপাত হয়, এ কিতাব দু’টিতে সেগুলোর কোন উল্লেখই নেই।
এখানে এ কাহিনী শেষ হচ্ছে। তাই পাঠকদেরকে পুনর্বার এ সত্যটির ব্যাপারে সজাগ করে দেয়া জরুরী মনে করি যে, হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম সম্পর্কে কুরআনের এ বর্ণনাটি একান্তই তার নিজস্ব ও স্বতন্ত্র বর্ণনা। এটি বাইবেল বা তালমূদের চর্বিতচর্বন নয়। তিনটি কিতাবের তুলনামূলক অধ্যয়নের পর একথা অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, কাহিনীটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশে কুরআনের বর্ণনা অন্য দু’টি থেকে আলাদা। কোন কোন জিনিস কুরআন তাদের চেয়ে বেশী বর্ণনা করে, কোন কোনটা কম এবং কোন কোনটায় তাদের বর্ণনার প্রতিবাদ করে। কাজেই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনী ইরসাঈলের থেকে এ কাহিনীটি শুনে থাকবেন এবং তারই ভিত্তিতে এটি বর্ণনা করেন, একথা বলার সুযোগই কারোর নেই।