পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

১৫১ আয়াত

১১৩ ) নবী ও যারা ঈমান এনেছে তাদের পক্ষে মুশরিকদের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করা, সঙ্গত নয়, তারা তাদের আত্মীয়-স্বজন হলেই বা কি এসে যায়, যখন একথা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তারা জাহান্নামেরই উপযুক্ত। ১১১
مَا كَانَ لِلنَّبِىِّ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓا۟ أَن يَسْتَغْفِرُوا۟ لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوٓا۟ أُو۟لِى قُرْبَىٰ مِنۢ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَـٰبُ ٱلْجَحِيمِ ١١٣
১১৪ ) ইবরাহীম তার বাপের জন্য যে মাগফিরাতের দোয়া করেছিল তা তো সেই ওয়াদার কারণে ছিল যা সে তার বাপের সাথে করেছিল্ ১১২ কিন্তু যখন তার কাছে একথা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, তার বাপ আল্লাহর দুশমন তখন সে তার প্রতি বিমুখ হয়ে গেছে। যথার্থই ইবরাহীম কোমল হৃদয়, আল্লাহ‌ ভীরু ও ধৈর্যশীল ছিল। ১১৩
وَمَا كَانَ ٱسْتِغْفَارُ إِبْرَٰهِيمَ لِأَبِيهِ إِلَّا عَن مَّوْعِدَةٍۢ وَعَدَهَآ إِيَّاهُ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُۥٓ أَنَّهُۥ عَدُوٌّۭ لِّلَّهِ تَبَرَّأَ مِنْهُ ۚ إِنَّ إِبْرَٰهِيمَ لَأَوَّٰهٌ حَلِيمٌۭ ١١٤
১১৫ ) লোকদেরকে হেদায়াত দান করার পর আবার গোমরাহীতে লিপ্ত করা আল্লাহর রীতি নয়, যতক্ষণ না তিনি তাদেরকে কোন জিনিস থেকে সংযত হয়ে চলতে হবে তা পরিষ্কার করে জানিয়ে দেন। ১১৪ আসলে আল্লাহ‌ প্রত্যেকটি জিনিসের জ্ঞান রাখেন।
وَمَا كَانَ ٱللَّهُ لِيُضِلَّ قَوْمًۢا بَعْدَ إِذْ هَدَىٰهُمْ حَتَّىٰ يُبَيِّنَ لَهُم مَّا يَتَّقُونَ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ بِكُلِّ شَىْءٍ عَلِيمٌ ١١٥
১১৬ ) আর এও সত্য, আসমান ও যমীনের রাজত্ব আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন, জীবন ও মৃত্যু তাঁরই ইখতিয়ার ভুক্ত এবং তোমাদের এমন কোন সহায় ও সাহায্যকারী নেই যে তোমাদেরকে তাঁর হাত থেকে বাঁচাতে পারে।
إِنَّ ٱللَّهَ لَهُۥ مُلْكُ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ ۖ يُحْىِۦ وَيُمِيتُ ۚ وَمَا لَكُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ مِن وَلِىٍّۢ وَلَا نَصِيرٍۢ ١١٦
১১৭ ) আল্লাহ নবীকে মাফ করে দিয়েছেন এবং অত্যন্ত কঠিন সময়ে যে মুহাজির ও আনসারগণ নবীর সাথে সহযোগিতা করেন তাদেরকেও মাফ করে দিয়েছেন। ১১৫ যদিও তাদের মধ্য থেকে কিছু লোকের দিল বক্রতার দিকে আকৃষ্ট হতে যাচ্ছিল ১১৬ (কিন্তু তারা এ বক্রতার অনুগামী না হয়ে নবীর সহযোগী হয়েছেন। ফলে) আল্লাহ‌ তাদেরকে মাফ করে দিয়েছেন। ১১৭ নিঃসন্দেহে এলোকদের প্রতি তিনি স্নেহশীল ও মেহেরবান।
لَّقَد تَّابَ ٱللَّهُ عَلَى ٱلنَّبِىِّ وَٱلْمُهَـٰجِرِينَ وَٱلْأَنصَارِ ٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوهُ فِى سَاعَةِ ٱلْعُسْرَةِ مِنۢ بَعْدِ مَا كَادَ يَزِيغُ قُلُوبُ فَرِيقٍۢ مِّنْهُمْ ثُمَّ تَابَ عَلَيْهِمْ ۚ إِنَّهُۥ بِهِمْ رَءُوفٌۭ رَّحِيمٌۭ ١١٧
১১৮ ) আর কে তিনজনের ব্যাপার মুলতবী করে দেয়া হয়েছিল তাদেরকেও তিনি মাফ করে দিয়েছেন ১১৮ পৃথিবী তার সমগ্র ব্যাপকতা সত্ত্বেও যখন তাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে গেলো, তাদের নিজেদের প্রাণও তাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ালো এবং তারা জেনে নিল যে, আল্লাহর হাত থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর নিজের রহমতের আশ্রয় ছাড়া আর কোন আশ্রয়স্থল নেই তখন আল্লাহ‌ নিজ অনুগ্রহে তাদের দিকে ফিরলেন যাতে তারা তার দিকে ফিরে আসে। অবশ্যই আল্লাহ‌ বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়। ১১৯
وَعَلَى ٱلثَّلَـٰثَةِ ٱلَّذِينَ خُلِّفُوا۟ حَتَّىٰٓ إِذَا ضَاقَتْ عَلَيْهِمُ ٱلْأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ وَضَاقَتْ عَلَيْهِمْ أَنفُسُهُمْ وَظَنُّوٓا۟ أَن لَّا مَلْجَأَ مِنَ ٱللَّهِ إِلَّآ إِلَيْهِ ثُمَّ تَابَ عَلَيْهِمْ لِيَتُوبُوٓا۟ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ ١١٨
১১৯ ) হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সহযোগি হও।
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ ٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ وَكُونُوا۟ مَعَ ٱلصَّـٰدِقِينَ ١١٩
১২০ ) মদীনাবাসী ও তাদের আশপাশে বেদুইনদের জন্য আল্লাহর রসূলকে ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে থাকা এবং তার ব্যাপারে বেপরোয়া হয়ে নিজেদের জীবনের চিন্তায় মশগুল হয়ে যাওয়া কোন ক্রমেই সমীচীন ছিল না। কারণ আল্লাহর পথে তারা যখনই ক্ষুধা-তৃষ্ণা ও শারীরিক কষ্ট ভোগ করবে, যখনই এমন পথ অবলম্বন করবে যা সত্য অমান্য কারীদের কাছে অসহনীয় এবং যখনই কোন দুশমনের ওপর (সত্যের প্রতি দুশমনির) প্রতিশোধ নেবে তৎক্ষনাৎ তার বদলে তাদের জন্য একটি সৎকাজ লেখা হবেই। এর ব্যতিক্রম কখনো হবে না। অবশ্যই আল্লাহর দরবারে সৎ কর্মশীলদের পরিশ্রম বিফল যায় না।
مَا كَانَ لِأَهْلِ ٱلْمَدِينَةِ وَمَنْ حَوْلَهُم مِّنَ ٱلْأَعْرَابِ أَن يَتَخَلَّفُوا۟ عَن رَّسُولِ ٱللَّهِ وَلَا يَرْغَبُوا۟ بِأَنفُسِهِمْ عَن نَّفْسِهِۦ ۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ لَا يُصِيبُهُمْ ظَمَأٌۭ وَلَا نَصَبٌۭ وَلَا مَخْمَصَةٌۭ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ وَلَا يَطَـُٔونَ مَوْطِئًۭا يَغِيظُ ٱلْكُفَّارَ وَلَا يَنَالُونَ مِنْ عَدُوٍّۢ نَّيْلًا إِلَّا كُتِبَ لَهُم بِهِۦ عَمَلٌۭ صَـٰلِحٌ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُضِيعُ أَجْرَ ٱلْمُحْسِنِينَ ١٢٠
১২১ ) অনুরূপভাবে তারা যখনই (আল্লাহর পথে) কম বা বেশী কিছু সম্পদ ব্যয় করবে এবং (সংগ্রাম সাধনায়) যখনই কোন উপত্যকা অতিক্রম করবে, অমনি তা তাদের নামে লেখা হয়ে যাবে, যাতে আল্লাহ‌ তাদেরকে তাদের এ ভাল কাজের পুরস্কার দান করেন।
وَلَا يُنفِقُونَ نَفَقَةًۭ صَغِيرَةًۭ وَلَا كَبِيرَةًۭ وَلَا يَقْطَعُونَ وَادِيًا إِلَّا كُتِبَ لَهُمْ لِيَجْزِيَهُمُ ٱللَّهُ أَحْسَنَ مَا كَانُوا۟ يَعْمَلُونَ ١٢١
১২২ ) আর মুমিনদের সবার এক সাথে বের হয়ে পড়ার কোন দরকার ছিল না। কিন্তু তাদের জনবসতির প্রত্যেক অংশের কিছু লোক বেরিয়ে এলে ভাল হতো। তারা দ্বীন সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করতো এবং ফিরে গিয়ে নিজের এলাকার লোকদের কে সতর্ক করতো, যাতে তারা (অমুসলমানী আচরণ থেকে) বিরত থাকতো, এমনটি হলো না কেন? ১২০
۞ وَمَا كَانَ ٱلْمُؤْمِنُونَ لِيَنفِرُوا۟ كَآفَّةًۭ ۚ فَلَوْلَا نَفَرَ مِن كُلِّ فِرْقَةٍۢ مِّنْهُمْ طَآئِفَةٌۭ لِّيَتَفَقَّهُوا۟ فِى ٱلدِّينِ وَلِيُنذِرُوا۟ قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوٓا۟ إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ ١٢٢
১১১.
কোন ব্যক্তির জন্য ক্ষমার আবেদন জানানোর অনিবার্য অর্থ হচ্ছে এই যে, আমরা তার প্রতি সহানুভূতিশীল এবং তাকে ভালবাসি। আমরা তার দোষকে ক্ষমা যোগ্য মনে করি। যারা বিশ্বস্তদের অন্তর্ভুক্ত এবং শুধুমাত্র গোনাহগার তাদের ক্ষেত্রে এ দুটো কথাই ঠিক। কিন্তু যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে তার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া তাকে ভালবাসা ও তার অপরাধকে ক্ষমা যোগ্য মনে করা শুধু যে নীতিগতভাবে ভুল তাই নয় বরং এর ফলে আমাদের নিজেদের বিশ্বস্ততা ও সন্দেহযুক্ত হয়ে পড়ে। আর যদি শুধুমাত্র আমাদের আত্মীয় বলে আমরা তাকে মাফ করে দিতে চাই তাহলে এর মানে হবে, আমাদের কাছে আত্মীয়তার সম্পর্ক আল্লাহর প্রতি বিশ্বস্ততার দাবীর তুলনায় অনেক বেশী মূল্যবান। আল্লাহ‌ ও তার দ্বীনের প্রতি আমাদের ভালবাসা নির্ভেজাল ও শর্তহীন নয়। আল্লাহ‌ দ্রোহীদের সাথে আমরা যে সম্পর্কে জুড়ে রেখেছি তার ফলে আমরা চাচ্ছি, আল্লাহ‌ নিজেও যেন এ সম্পর্ক গ্রহণ করেন এবং আমাদের আত্মীয়কে যেন অবশ্যই ক্ষমা করে দেন, যদিও এ একই অপরাধ করার কারণে অন্যান্য অপরাধীদেরকে তিনি জাহান্নামের শাস্তি দিয়ে থাকেন। বস্তুত এ সমস্ত কথাই ভুল আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততার বিরোধী এবং সেই একনিষ্ঠ ঈমানের পরিপন্থী যার দাবী হচ্ছে, আল্লাহ‌ ও তার দ্বীনের প্রতি আমাদের ভালবাসা নির্ভেজাল হতে হবে, আল্লাহর বন্ধু হবে আমাদের বন্ধু এবং তার শত্রু হবে আমাদের শত্রু। এ কারণে মহান আল্লাহ‌ এ কথা বলেননি যে, তোমরা মুশরিকদের জন্য মগফিরাতের দোয়া করো না। বরং তিনি বলেছেন তাদের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করা তোমাদের পক্ষে শোভা পায় না। অর্থাৎ আমার মানা করায় যদি তোমরা বিরত থাকো তাহলে তো এর তেমন কোন গুরুত্ব থাকে না। মূলত তোমাদের মধ্যে আনুগত্যও বিশ্বস্ততার অনুভূতি এত বেশী তীব্র হওয়া উচিত যার ফলে আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণাকারীদের সাথে সহানুভূতির সম্পর্ক রাখা এবং তাদের অপরাধকে ক্ষমা যোগ্য মনে করা তোমাদের নিজেদের কাছেই অশোভন ঠেকে।

এখানে আরো এতটুকু বুঝে নিতে হবে যে, আল্লাহ‌ দ্রোহীদের প্রতি যে সহানুভূতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে তা কেবলমাত্র এমন পর্যায়ের সহানুভূতি যা দ্বীনের ব্যাপারে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে মানবিক সহানুভূতি এবং পার্থিব সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আত্মীয়তা ও রক্ত সম্পর্ক এবং স্নেহ-সম্প্রীতি পূর্ণ ব্যবহার এসব নিষিদ্ধ নয় বরং প্রশংসনীয়। আত্মীয় কাফের হোক বা মু’মিন, তার সামাজিক অধিকার অবশ্যই প্রদান করতে হবে। বিপদগ্রস্ত মানুষকে সকল অবস্থায় সাহায্য দিতে হবে। অভাবীকে যে কোন সময় সহায়তা দন করতে হবে। রুগ্ন ও আহতের সেবা ও তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের ব্যাপারে কোন ত্রুটি দেখানো যাবে না। ইয়াতীমের মাথায় অবশ্যই স্নেহের হত বুলাতে হবে। এসব ব্যাপারে কখনো মুসলিম ও অমুসলিমের বাচবিচার করা চলবে না।

১১২.
হযরত ইবরাহীম তার মুশরিক পিতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার সময় যে কথা বলেছিলেন সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। তিনি বলেছিলেনঃ

سَلَامٌ عَلَيْكَ سَأَسْتَغْفِرُ لَكَ رَبِّي إِنَّهُ كَانَ بِي حَفِيًّا

আপনার প্রতি সালাম, আপনার জন্য আমি আমার রবের কাছে দোয়া করবো যেন তিনি আপনাকে মাফ করে দেন। তিনি আমার প্রতি বড়ই মেহেরবান। (মারয়ামঃ ৪৭)

তিনি আরো বলেছিলেনঃ

لَأَسْتَغْفِرَنَّ لَكَ وَمَا أَمْلِكُ لَكَ مِنَ اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ

আমি আপনার জন্য অবশই ক্ষমা চাইবো। তবে আপনাকে আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচানোর ক্ষমতা আমার নেই। (আল মুমতাহিনাঃ ৪)

উপরোক্ত ওয়াদার ভিত্তিতে তিনি নিজের পিতার জন্য এ দোয়া করেছিলেনঃ

وَاغْفِرْ لِأَبِي إِنَّهُ كَانَ مِنَ الضَّالِّينَ - وَلَا تُخْزِنِي يَوْمَ يُبْعَثُونَ - يَوْمَ لَا يَنْفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ - إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ

আর আমার পিতাকে মাফ করে দাও, তিনি পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আর যেদিন সকল মানুষকে উঠানো হবে সেদিন আমাকে লাঞ্ছিত করো না। যেদিন ধনসম্পদ এবং সন্তান সন্তুতি কারোর কোন কাজে লাগবে না। একমাত্র সেই নাজাত পাবে, যে আল্লাহর সামনে হাযির হবে বিদ্রোহ মুক্ত হৃদয় নিয়ে। (আশ শুআরাঃ ৮৬-৮৯)

এ দোয়া তো প্রথমত অত্যন্ত সতর্ক ও সংযত ভাষায় করা হয়েছিল। কিন্তু পরক্ষনেই হযরত ইবরাহীম চিন্তা করলেন যে, তিনি যে ব্যক্তির জন্য দোয়া করেছেন সে তো ছিল প্রকাশ্য আল্লাহ‌ দ্রোহী এবং আল্লাহর দ্বীনের ঘোরতর শত্রু তখন তিনি এ থেকে বিরত হলেন এবং একজন যথার্থ বিশ্বস্ত মু’মিনের মত বিদ্রোহীর প্রতি সহানুভূতি দেখানো থেকে পরিষ্কারভাবে সরে দাঁড়লেন। অথচ এ বিদ্রোহী ছিল তার পিতা, যে এক সময় স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে তাকে লালন পালন করেছিল।

১১৩.
মূলে اواه (আওওয়াহুন) ও حَكِيم(হালীমুন) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আওওয়াহুন মানে হচ্ছে, যে অনেক বেশী হা-হুতাশ করে, কান্নাকাটি করে, ভয় পায় ও আক্ষেপ করে। আর হালীম এমন ব্যক্তিকে বলা হয়, যে নিজের মেজায সংযত রাখে, রাগে, শত্রুতায় ও বিরোধিতায় বেসামাল আচরণ করে না এবং অন্যদিকে ভালবাসায়, বন্ধুত্বের ও হৃদ্যতা পূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রম করে যায় না। এখানে এ শব্দ দু’টি দ্বিবিধ অর্থ প্রকাশ করছে। হযরত ইবরাহীম (আ) তার পিতার জন্য মাগফিরাতের দোয়া করেছেন। কারণ তিনি ছিলেন অত্যন্ত সংবেদনশীল হৃদয় বৃত্তির অধিকারী। তার পিতা জাহান্নামের ইন্ধনে পরিণত হবে, একথা ভেবে তিনি কেঁপে উঠেছিলেন। আবার তিনি ছিলেন “হালিম”-সংযমী ও ধৈর্যশীল। তার পিতা ইসলামের পথে এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে বাধা দেবার জন্য তার ওপর যে জুলুম নির্যাতন চালিয়েছিল তা সত্ত্বেও তার মুখ থেকে পিতার জন্য দোয়া বের হয়ে গিয়েছিল। তারপর তিনি দেখলেন, তাঁর পিতা আল্লাহর দুশমন, তাই তিনি তার থেকে নিজেকে দায়মুক্ত করে নিলেন। কারণ তিনি আল্লাহকে ভয় করতেন এবং কারোর প্রতি ভালোবাসায় সীমা অতিক্রম করতেন না।
১১৪.
অর্থাৎ লোকদের কোন চিন্তা কার্যধারা ও পদ্ধতি থেকে বাঁচতে হবে তা আল্লাহ‌ আগেই বলে দেন। তারপর যখন তারা তা থেকে বিরত হয় না এবং ভুল চিন্তা ও কাজে লিপ্ত হয়ে তার ওপর অবিচল থাকে তখন আল্লাহও তাদের হেদায়াত করার ও সঠিক পথ নির্দেশনা দেয়া থেকে বিরত হন এবং যে ভুল পথে তারা যেতে চায় তার ওপর তাদেরকে ঠেলে দেন।

এ বক্তব্যটি থেকে একটি মূলনীতি অনুধাবন করা যায়। আল্লাহ‌ কুরআন মজীদের যেসব জায়গায় হেদায়াত দেয়া ও গোমরাহ করাকে তার নিজের কাজ বলে উল্লেখ করেছেন সেগুলো এ মূলনীতিটির মাধ্যমে ভালভাবে বুঝে যেতে পারে। আল্লাহর হেদায়াত দেয়ার মানে হচ্ছে, তিনি নিজের নবী ও কিতাসমূহের সাহায্যে লোকদের সামনে সঠিক চিন্তা ও কর্মধারা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। তারপর যারা স্বেচ্ছায় এ পথে চলতে উদ্যোগী হয় তাদের চলার সুযোগ ও সামর্থ্য দান করেন। আর আল্লাহর গোমরাহীতে লিপ্ত করার মানে হচ্ছে তিনি যে সঠিক চিন্তা ও কর্মপদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন যদি তার বিপরীত পথে চলার জন্য কেউ জোর প্রচেষ্টা চালায় এবং সোজা পথে চলতে না চায় তাহলে আল্লাহ‌ জোর করে তাকে সত্য পথ দেখান না এবং সত্যের দিকে চালিত ও করেন না বরং যেদিকে সে নিজে যেতে চায় সেদিকে যাবার সুযোগ ও সামর্থ্য তাকে দান করেন।

আলোচ্য ভাষণটি একথাটি কোন প্রসঙ্গে বর্ণনা করা হয়েছে, আগের ও পরের ভাষণ গুলো গভীর মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করলে তা সহজেই বুঝা যেতে পারে। এটা এক ধরনের সতর্কবাণী। একে অত্যন্ত সঙ্গত ভাবে আগের বর্ণনার সমাপ্তি হিসাবেও গণ্য করা যেতে পারে। আবার পরে যে আলোচনা আসছে তার ভূমিকা ও বলা যেতে পারে।

.
.
১১৫.
অর্থাৎ তাবুক যুদ্ধে নবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের যেসব ছোটখাটো ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছিল তাদের উৎকৃষ্ট মানের কার্যকলাপের বদৌলতে আল্লাহ‌ সেগুলো মাফ করে দিয়েছেন। নবী (সা.) এর কাজে যে ত্রুটি হয়েছিল আগেই ৪৩ আয়াতে তা উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও পিছনে থেকে যাওয়ার অনুমতি চেয়েছিল তাদেরকে তিনি অনুমতি দিয়েছিলেন।
১১৬.
অর্থাৎ কোন কোন আন্তরিকতা সম্পন্ন সাহাবাও এ কঠিন সময়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে কোন না কোন ভাবে ইতস্তত করেছিলেন। কিন্তু যেহেতু তাদের দিলে ঈমান ছিল এবং তারা আন্তরিকভাবে আল্লাহর সত্য দ্বীনকে ভালবাসতেন তাই শেষ পর্যন্ত তারা নিজেদের দুর্বলতার ওপর বিজয়ী হতে পেরেছিলেন।
১১৭ .
অর্থাৎ তাদের মনে ভ্রান্তি নীতির প্রতি ও ঝোঁক কেন সৃষ্টি হয়েছিল সেজন্য আল্লাহ‌ এখন আর তাদেরকে পাকড়াও করবেন না। কারণ মানুষ নিজেই যে দুর্বলতার সংশোধন করে নেয় আল্লাহ‌ সেজন্য কোন কৈফিয়ত তলব করেন না।
.
১১৮.
নবী (সা.) যখন তাবুক থেকে মদীনায় ফিরে এলেন তখন যারা পিছনে অর্থাৎ মদীনায় থেকে গিয়েছিল। তারা ওযর পেশ করার জন্য হাজির হলো। তাদের মধ্যে ৮০ জনেরও বেশী ছিল মুনাফিক। মুনাফিকরা মিথ্যা ওযর পেশ করেছিল এবং রসূলুল্লাহ(সা.) তা মেনে নিচ্ছিলেন। তারপর এলো এ তিন জন মু’মিনের পালা। তারা পরিষ্কারভাবে নিজেদের দোষ স্বীকার করলেন। নবী (সা.) তাদের তিনজনের ব্যাপারে ফয়সালা মুলতবী রাখলেন।

তিনি সাধারণ মুসলমানদের হুকুম দিলেন, আল্লাহর নির্দেশ না আসা পর্যন্ত তাদের সাথে কোন প্রকার সামাজিক সম্পর্ক রাখা যাবে না। এ বিষয়টির ফয়সালা করার জন্য এ আয়াত নাযিল হয়। (এখানে একথাটি অবশ্যই) সামনে রাখতে হবে যে, ৯৯ টীকায় যে সাতজন সাহাবীর আলোচনা এসেছে তাদের ব্যাপারটি কিন্তু এদের থেকে স্বতন্ত্র। তারা তো জবাবদিহির আগেই নিজেরাই নিজেদের শাস্তি দিয়েছিলেন।

১১৯.
এ তিন জন সাহাবী ছিলেন কাব ইবনে মালেক, হিলাল ইবনে উমাইয়াহ এবং মুরারাহ ইবনে রুবাই। আগেই বলেছি, এরা তিনজন ছিলেন সাচ্চা মু’মিন। এর আগে তারা বহুবার নিজেদের আন্তরিকতার প্রমাণ দিয়েছিলেন। অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। শেষের দুজন তো বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কাজেই তাদের ঈমানী সত্যতাসব রকমের সংশয়-সন্দেহের ঊর্ধ্বে ছিল। আর প্রথম জন যদিও বদরী সাহাবী ছিলেন না কিন্তু বদর ছাড়া প্রতিটি যুদ্ধে নবী (সা.) এর সাথে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ইসলামের জন্য তার এমন ত্যাগ প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম-সাধনা সত্ত্বেও এমন এক নাজুক সময়ে যখন যুদ্ধ করার শক্তি ও সমর্থের অধিকারী প্রত্যেক মু’মিনকে যুদ্ধ করার জন্য এগিয়ে আসার হুকুম দেয়া হয়েছিল তখন তারা যে অলসতা ও গাফলতির পরিচয় দিয়েছিলেন সেজন্য তাদেরকে কঠোর ভাবে পাকড়াও করা হয়েছিল। নবী (সা.) তাবুক থেকে ফিরে এসে মুসলমানদের প্রতি কড়া নির্দেশ জারি করেন কেউ এদের সাথে সালাম কালাম করতে পারবে না। ৪০ দিন পরে তাদের স্ত্রীদেরকে ও তাদের থেকে আলাদা বসবাস করার কঠোর আদেশ দেয়া হলো। আসলে এ আয়াতে তাদের অবস্থার যে ছবি আঁকা হয়েছে মদীনার জনবসতিতে তাদের অবস্থা ঠিক তাই হয়ে গিয়েছিল। শেষে তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ব্যাপারটি যখন ৫০ দিনে এসে ঠেকালো তখন ক্ষমার এ ঘোষণা নাযিল হলো।

এ তিন জনের মধ্য থেকে হযরত কাব ইবনে মালেক অত্যন্ত বিস্তারিত ভাবে নিজের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। এ ঘটনা বড়ই শিক্ষাপ্রদ। বৃদ্ধ বয়সে তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এ সময় তার ছেলে আবদুল্লাহ তাকে হাত ধরে নিয়ে চলাফেরা করতেন। আবদুল্লাহকে তিনি নিজেই এ ঘটনা এভাবে শুনানঃ

তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে নবী (সা.) যখনই মুসলমানদেরকে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার আবেদন জানাতেন তখনই আমি মনে মনে সংকল্প করে নিতাম যে, যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নেবো। কিন্তু ফিরে এসে আমাকে অলসতায় পেয়ে বসতো এবং আমি বলতাম, এখনই এতো তাড়াহুড়া কিসের, রওয়ানা দেবার সময় যখন আসবে তখন তৈরী হতে কতটুকু সময়ই বা লাগবে। এভাবে আমার প্রস্তুতি পিছিয়ে যেতে থাকলো। তারপর একদিন সেনাবাহিনীর রওয়ানা দেবার সময় এসে গেল। অথচ তখনো আমি তৈরী ছিলাম না। আমি মনে মনে বললাম, সেনাবাহিনী চলে যাক, আমি এক দুদিন পরে পথে তাদের সাথে যোগ দেবো। কিন্তু তখনো একই অলসতা আমার পথের বাধা হয়ে দাঁড়ালো। এভাবে সময় পার হয়ে গেলো।

এ সময় যখন আমি মদীনায় থেকে গিয়েছিলাম আমার মন ক্রমেই বিষিয়ে উঠেছিল। কারণ আমি দেখছিলাম যাদের সাথে এ শহরে আমি রয়েছি তার হয়, মুনাফিক, নয়তো দুর্বল, বৃদ্ধ ও অক্ষম লোক, যাদেরকে আল্লাহ‌ অব্যাহতি দিয়েছেন।

নবী (সা.) তাবুক থেকে ফিরে এসে যথারীতি মসজিদে প্রবেশ করে দু’রাকাত নফল নামায পড়লেন। তারপর তিনি লোকদের সাথে সাক্ষাত করার জন্য বসলেন। মুনাফিকরা এ মজলিসে এসে লম্বা লম্বা কসম খেয়ে তাদের ওযর পেশ করতে লাগলো। এদের সংখ্যা ছিল ৮০ এর চাইতেও বেশী। রসূলুল্লাহ ﷺ তাদের প্রত্যেকের বনোয়াট ও সাজানো কথা শুনলেন। তাদের লোক দেখানো ওযর মেনে নিলেন এবং তাদের অন্তরের ব্যাপার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়ে বললেন, আল্লাহ‌ তোমাদের মাফ করুন। তারপর আমার পালা এলো। আমি সামনে গিয়ে সালাম দিলাম। তিনি আমার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বললেন, আসুন! আপনাকে কিসে আটকে রেখেছিল? আমি বললাম, আল্লাহর কসম! যদি আমি কোন দুনিয়াদারের সামনে হাযির হতাম তাহলে অবশ্যই কোন না কোন কথা বানিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করতাম। কথা বানিয়ে বলার কৌশল আমিও জানি। কিন্তু আপনার ব্যাপারে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি এখন কোন মিথ্যা ওযর পেশ করে আমি আপনাকে সন্তুষ্ট করেও নেই তাহলে আল্লাহ‌ নিশ্চয়ই আপনাকে আমার প্রতি আবার নারাজ করে দেবেন। তবে যদি আমি সত্য বলি তাহলে আপনি নারাজ হয়ে গেলেও আমি আশা রাখি আল্লাহ‌ আমার জন্য ক্ষমার কোন পথ তৈরী করে দেবেন। আসলে পেশ করার মতো, কোন ওযরই আমার নেই। যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে আমি পুরোপুরি সক্ষম ছিলাম। একথা শুনে রসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, এ ব্যক্তি সত্য কথা বলেছে। ঠিক আছে, চলে যাও এবং আল্লাহ‌ তোমার ব্যাপারে কোন ফয়সালা না দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকো। আমি উঠে নিজের গোত্রের লোকদের মধ্যে গিয়ে বসলাম। এখানে সবাই আমার পিছনে লাগলো। তারা আমাকে এ বলে তিরস্কার করতে লাগলো যে, তুমি ও কোন মিথ্যা ওযর পেশ করলে না কেন এসব কথা শুনে আবার রসূলের কাছে গিয়ে কিছু বানোয়াট ওযর পেশ করার জন্য আমার মনে আগ্রহ সৃষ্টি হলো। কিন্তু যখন শুনলাম আরো দুজন সৎ লোক (মুরারাহ ইবনে রুবাই ও হেলাল ইবনে উমাইয়াহ) আমার মতো একই সত্য কথা বলেছেন তখন আমি মানসিক প্রশান্তি অনুভব করলাম এবং আমার সত্য কথার ওপর অটল থাকলাম।

এরপর নবী (সা.) সাধারণ হুকুম জারি করলেন, আমাদের তিন জনের সাথে কেউ কথা বলতে পারবে না। অন্য দুজন তো ঘরের মধ্যে বসে রইলো কিন্তু আমি বাইরে বের হতাম, জামায়াতে নামায পড়তাম এবং বাজারে ঘোরাফেরা করতাম। কিন্তু কেউ আমার সাথে কথা বলতো না। মনে হয়তো, এ দেশটি একদম বদলে গেছে। আমি যেন এখানে একজন অপরিচিত আগন্তুক। এ জনপদের কেউ আমাকে জানে না, চেনা না। মসজিদে নামায পড়তে গিয়ে যথারীতি নবী (সা.) কে সালাম করতাম। আমার সালামের জবাবে তার ঠোঁট নড়ে উঠছে কিনা তা দেখার জন্য আমি অপেক্ষা করতাম। কিন্তু শুধু অপেক্ষা করাই সার হতো। তার নজর আমার ওপর কিভাবে পড়ছে তা দেখার জন্য আমি আড়চোখে তার প্রতি তাকাতাম। কিন্তু অবস্থা ছিল এই যে, যতক্ষণ আমি নামায পড়তাম ততক্ষণ তিনি আমাকে দেখতে থাকতেন এবং যেই আমি নামায শেষ করতাম অমনি আমার ওপর থেকে তিনি চোখ ফিরিয়ে নিতেন। একদিন ঘাবড়ে গিয়ে আমার চাচাত ভাই ও ছেলে বেলার বন্ধু আবু কাতাদার কাছে গেলাম। তার বাগানের পাঁচিলের ওপর উঠে তাকে সালাম দিলাম। কিন্তু আল্লাহর সেই বান্দাটি আমার সালামের জবাবও দিলো না। আমি বললামঃ হে আবু কাতাদাহ! আমি তোমাকে আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি আমি কি আল্লাহ‌ ও তার রসূলকে ভালবাসি না? সে নীরব রইলো। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, সে নীরব রইলো। তৃতীয়বার যখন আমি কসম দিয়ে তাকে এ প্রশ্ন করলাম তখন সে শুধুমাত্র এতটুকু বললোঃ আল্লাহ‌ ও তার রসূলই ভাল জানেন। একথায় আমার চোখে পানি এসে গেলো। আমি পাঁচিল থেকে নেমে এলাম। এ সময় আমি একদিন বাজার দিয়ে যাচ্ছিলাম। এমন সময় সিরিয়ার নাবতী বংশীয় এক লোকের সাথে দেয়া হলো। সে রেশমে মোড়া গাসসান রাজার একটি পত্র আমার হাতে দিল। আমি পত্রটি খুলে পড়লাম। তাতে লেখা ছিল, আমরা শুনেছি, তোমার নেতা তোমার ওপর উৎপীড়ন করছে। তুমি কোন নগণ্য ব্যক্তি নও। তোমাকে ধ্বংস হতে দেয়া যায় না। আমাদের কাছে চলে এসো। আমরা তোমাকে মর্যাদা দান করবো। আমি বললাম, এ দেখি আর এক আপদ! তখনই চিঠিটাকে চুলোর আগুনে ফেলে দিলাম।

চল্লিশটা দিন এভাবে কেটে যাবার পর রসূলুল্লাহ ﷺ কাছে থেকে তার দূত এই হুকুম নিয়ে এলেন, যে নিজের স্ত্রী থেকে ও আলাদা হয়ে যাও। আমি জিজ্ঞেস করলাম তাকে কি তালাক দিয়ে দিবো? জবাব এলো, না, তালাক নয়। শুধু আলাদা থাকো। কাজেই আমি স্ত্রীকে বলে দিলাম, তুমি বাপের বাড়ি চলে যাও এবং আল্লাহ‌ এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকো।

এভাবে উনপঞ্চাশ দিন পার হয়ে পঞ্চাশ দিন পড়লো। সেদিন সকালে নামাযের পরে আমি নিজের ঘরের ছাদের ওপর বসে ছিলাম। নিজের জীবনের প্রতি আমার ধিক্কার জাগছিল হঠাৎ এক ব্যক্তি চেঁচিয়ে বললোঃ কাব ইবনে মালিককে অভিনন্দন। একথা শুনেই আমি সিজদায় নত হয়ে গেলাম। আমি নিশ্চিত হলাম যে, আমার ক্ষমার ঘোষণা জারি হয়েছে। এরপর লোকেরা দলে দলে ছুটে আসতে লাগলো। তারা প্রত্যেকে পাল্লা দিয়ে আমাকে মুবারকবাদ দিচ্ছিল। তারা বলছিল তোমার তওবা কবুল হয়েছে। আমি উঠে সোজা মসজিদে নববীর দিকে গেলাম। দেখলাম, নবী (সা.) এর চেহারা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আমি সালাম দিলাম। তিনি বললেন, তোমাকে মোবারকবাদ! আজকের দিনটি তোমার জীবনের সর্বোত্তম দিন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ ক্ষমা কি আপনার পক্ষ থেকে না আল্লাহর পক্ষ থেকে? বললেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং এ সঙ্গে তিনি সংশ্লিষ্ট আয়াত শুনিয়ে দিলেন। আমি বললামঃ হে আল্লাহর রসূল! আমার সমস্ত ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে সদকা করে দিতে চাই। এটাও আমার তাওবার অংশ বিশেষ। বললেনঃ কিছু রেখে দাও, এটাই তোমার জন্য ভাল। এ বক্তব্য অনুযায়ী আমি নিজের খয়বরের সম্পত্তির অংশটুকু রেখে দিলাম। বাদবাকি সব সাদকা করে দিলাম। তারপর আল্লাহর কাছে অঙ্গীকার করলাম, যে সত্য কথা বলার কারণে আল্লাহ‌ আমাকে মাফ করে দিয়েছেন তার ওপর আমি সারা জীবন প্রতিষ্ঠিত থাকবো। কাজেই আজ পর্যন্ত আমি জেনে বুঝে যথার্থ সত্য ও প্রকৃত ঘটনা বিরোধী কোন কথা বলিনি এবং আশা করি আল্লাহ‌ আগামীতেও তা থেকে আমাকে বাঁচাবেন।

এ ঘটনার মধ্যে শিক্ষণীয় অনেক কিছু আছে। প্রত্যেক মু’মিনের মনে তা বদ্ধমূল হয়ে যাওয়া উচিত।

এ থেকে প্রথম যে শিক্ষাটি পাওয়া যায়, তা হচ্ছে, কুফর ও ইসলামের সংঘাতের ব্যাপারটি বড়ই গুরুত্বপূর্ণ ও নাজুক। এ সংঘাতে কুফরের সাথে সহযোগিতা করা তো দূরের কথা, যে ব্যক্তি ইসলামের সাথে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে অসৎ উদ্দেশ্যে নয়, সৎ উদ্দেশ্যে এবং সারা জীবনও নয় বরং কোন একসময় ভুল করে বসে, তারও সারা জীবনের ইবাদত-বন্দেগী ও দ্বীনদারী ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। এমনকি এমন উন্নত মর্যাদাসম্পন্ন লোকও পাকড়াও হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে না যে, বদর ওহোদ আহযাব ও হুনাইনের ভয়াবহ যুদ্ধ ক্ষেত্রে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করেছিল এবং যার ঈমানও আন্তরিকতার মধ্যে বিন্দুমাত্র খাদ ছিলো না।

দ্বিতীয় শিক্ষাটিও এর চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেটি হচ্ছে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে গড়িমসি করা কোন মামুলি ব্যাপার নয়। বরং অনেক সময় শুধুমাত্র গড়িমসি করতে করতে মানুষ এমন কোন ভুল করে বসে যা বড় বড় গোনাহের অন্তর্ভুক্ত। তখন একথা বলে সে নিষ্কৃতি পেতে পারে না। সে অসৎ উদ্দেশ্যে এ কাজটি করেনি।

নবী (সা.) এর নেতৃত্বে যে সমাজ গড়ে উঠেছিল। এ ঘটনা খুবই চমৎকারভাবে তার প্রাণসত্তা উন্মোচন করে দেয়। একদিকে রয়েছে মুনাফিকদের দল। তাদের বিশ্বাসঘাতকতা সবার কাছে সুস্পষ্ট ছিল। এরপরও তাদের বাহ্যিক ওযরসমূহ শোনা হয় এবং সেগুলোর সত্যাসত্য এড়িয়ে যাওয়া হয়। কারণ তাদের কাছ থেকে তো আন্তরিকতার আশাই করা হয়নি কোন দিন। কাজেই এখন আন্তরিকতার অভাব নিয়ে অভিযোগ তোলার কোন প্রশ্নই ওঠে না। অন্যদিকে রয়েছেন একজন পরীক্ষিত মু’মিন। তার উৎসর্গীত প্রাণ কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে কারো মনে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশই নেই। তিনি মিথ্যা ও বলেন না। দ্ব্যর্থ হীন ভাষায় নিজের ভুল স্বীকার করে নেন। কিন্তু তার ওপর ক্রোধ বর্ষিত হয়। এ ক্রোধের কারণ এ নয় যে, তার মু’মিন হবার ব্যাপারে সন্দেহ দেখা দিয়েছে বরং এর কারণ হচ্ছে, মু’মিন হওয়া সত্ত্বেও সে মুনাফিক সুলভ কাজ করলো কেন? আসলে এভাবে তাকে একথাই বলা হচ্ছে, যে, তোমরাই পৃথিবীর সার বস্তু। তোমাদের থেকে যদি মৃত্তিকা উর্বরতা লাভ করতে না পারে তাহলে উর্বরতা কোথা থেকে আসবে? তারপর মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ পুরো ঘটনায় নেতা যেভাবে শাস্তি দিচ্ছেন এবং ভক্ত যেভাবে তা মাথা পেতে নিচ্ছেন আর এ সাথে সমগ্র দলটি যেভাবে এ শাস্তি কার্যকর করছে তার প্রত্যেকটি দিকই তুলনাবিহীন। এক্ষেত্রে কে বেশী প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য তা স্থির করাই কঠিন। নেতা অত্যন্ত কঠোর শাস্তি দিচ্ছেন। কিন্তু সেখানে ক্রোধ বা ঘৃণার লেশমাত্র নেই। বরং গভীর স্নেহ ও প্রীতি সহকারে তিনি শাস্তি দিচ্ছেন। ক্রুদ্ধ পিতার ন্যায় তার দৃষ্টি একদিকে অনল বর্ষণ করে চলেছে ঠিকই কিন্তু অন্য দিকে আবার তাকে প্রতি মুহূর্তে একথা জনিয়ে দিচ্ছে যে, তোমার সাথে কোন শত্রুতা নেই বরং তোমার ভুলের কারণে আমার অন্তরটা ব্যাথায় টনটন করছে। তুমি নিজের ভুল শুধরে নিলে তোমাকে এ বুকে জড়িয়ে ধরার জন্য আমি ব্যাকুলভাবে অপেক্ষা করছি। ভক্ত শাস্তির তীব্রতায় অস্থির হয়ে পড়ছে। কিন্তু তার পদযুগল আনুগত্যের রাজপথ থেকে এক চুল পরিমাণও টলছে না। সে আত্মম্ভরিতা ও জাহেলী দাম্ভিকতারও শিকার হচ্ছে না এবং প্রকাশ্যে অহংকার করে বেড়ানোর তো দূরের কথা, এমনকি নিজের প্রিয় নেতার বিরুদ্ধে মনের গভীরে সামান্যতম অভিযোগও সৃষ্টি হতে দিচ্ছে না। বরং নেতার প্রতি ভালবাসায় তার মন আরো ভরে উঠেছে। শাস্তির পুরো পঞ্চাশ দিন তার দৃষ্টি সবচেয়ে বেশী অধীর হয়ে যে জিনিসটি খুজে বেড়িয়েছে, সেটি হচ্ছে, নেতার চোখে তার প্রতি আগের সেই মমত্ব পূর্ণ দৃষ্টি বহাল আছে কিনা, যা তার সমস্ত আশা আকাংখার শেষ আশ্রয় স্থল। সে যেন একজন দুর্ভিক্ষপীড়িত কৃষক। আকাশের এক কিনারে যে ছোট্ট এক টুকরো মেঘ দেখা যাচ্ছে। সেটিই তার সমস্ত আশার একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু। তারপর দলের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে যে, তার অভূতপূর্ব শৃংখলা বিরাজিত যে, নেতার মুখ থেকে বয়কটের নির্দেশ উচ্চারিত হবার সাথে সাথেই অপরাধীর ওপর থেকে দলের সমস্ত লোক দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছে। প্রকাশ্যে তো দূরের কথা গোপনেও কোন নিকটতম আত্মীয় এবং সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধুও তার সাথে কথা বলছে না। স্ত্রীও তার থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহর দোহাই দিয়ে সে জিজ্ঞেস করছে, আমার আন্তরিকতায় কি তোমাদের কোন সন্দেহ জেগেছে? কিন্তু যারা দীর্ঘকাল তাকে আন্তরিক দেখে আসছিল তারা পরিষ্কার বলে দিচ্ছেঃ আমাদের কাছ থেকে নয়, আল্লাহ‌ ও তার রসূলের কাছ থেকে নিজের আন্তরিকতার সনদ নাও। অন্যদিকে দলের নৈতিক প্রাণসত্তা এত বেশী উন্নত ও পবিত্র যে, এক ব্যক্তির উচু মাথা নীচু হবার সাথে সাথেই নিন্দুকদের কোন দল তার নিন্দায় সোচ্চার হয়ে উঠে না। বরং শাস্তির এ পুরো সময়টায় দলের প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের এ সাজাপ্রাপ্ত ভাইয়ের বিপদে মর্মবেদনা অনুভব করে এবং পুনরায় তাকে উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরার জন্য ব্যকুল থাকে। ক্ষমার কথা ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথেই লোকেরা অতি দ্রুত তার কাছে পৌঁছে তার সাথে সাক্ষাত করার এবং তাকে সুসংবাদ দেবার জন্য দৌড়াতে থাকে। কুরআন যে ধরনের সত্যনিষ্ঠা দল দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করতে চায় এটি হচ্ছে তারই দৃষ্টান্ত।

এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখিত আয়াত বিশ্লেষণ করলে আমাদের কাছে একথাটি সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, এ সাহাবীগণ আল্লাহর দরবার থেকে যে ক্ষমা লাভ করেছিলেন এবং সেই ক্ষমার কথা বর্ণনা করার ভাষায় মধ্যে যে স্নেহ ও করুণা ধারা প্রবাহিত হচ্ছে তার মূলে রয়েছে তাদের আন্তরিকতা। পঞ্চাশ দিনের কঠোর শাস্তি ভোগকালে তারা এ আন্তরিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। ভুল করার পর যদি তারা অহংকার করতেন, নিজেদের নেতার অসন্তোষের জবাবে ক্রোধ ও ক্ষোভের প্রকাশ ঘটাতেন, শাস্তি লাভের ফলে এমনই বিক্ষুদ্ধ হতেন যেমন স্বার্থবাদী লোকদের আত্মাভিমানে আঘাত লাগলে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সামাজিক বয়কট কালে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে রাজি। কিন্তু নিজের আত্মাভিমানকে আহত করতে রাজি নই-এ নীতি অবলম্বন করতেন এবং যদি এ সমগ্র শাস্তি কালে দলের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে বেড়াতেন এবং অসন্তুষ্ট ও বিক্ষুব্ধ লোকদের খুঁজে বের করে এক সাথে মিলিয়ে জোটবদ্ধ করতেন, তাহলে তাদের ক্ষমা করা তো দূরের কথা বরং নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, দল থেকে তাদেরকে আলাদা করে দেয়া হতো এবং এ শাস্তির মেয়াদ শেষ হবার পর তাদের যোগ্য শাস্তিই তাদেরকে দেয়া হতো। তাদেরকে বলা হতো, যাও তোমরা নিজেদের অহম পূজায় লিপ্ত থাকো। সত্যের কালেমা বুলন্দ করার সংগ্রামে অংশ নেবার সৌভাগ্য তোমাদের আর কখনো হবে না।

কিন্তু এ কঠিন পরীক্ষায় ঐ তিনজন সাহাবী এ পথ অবলম্বন করেননি, যদিও এ পথটি তাদের জন্য খোলা ছিল। তারা বরঞ্চ আমাদের আলোচিত পূর্বোক্ত পথ অবলম্বন করেছিলেন। এ পথ অবলম্বন করে তারা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে, আল্লাহর আনুগত্যের নীতি তাদের হৃদয় থেকে পূজা ও বন্দনা করার মতো সকল মূর্তি অপসারিত করেছে। নিজেদের সমগ্র ব্যক্তিসত্তাকে তারা আল্লাহর পথে সাধনা করার জন্য নিয়োজিত করে দিয়েছে। নিজেদের ফিরে যাবার নৌকা গুলোকে এমনভাবে জ্বালিয়ে দিয়ে ইসলামী জামায়াতে প্রবেশ করেছিলেন যে, পেছনে ফিরে যেতে চাইলেও আর ফেরার কোন জায়গা ছিল না। এখানেই মার খাবেন এবং এখানেই মরবেন। অন্য কোথাও কোন বৃহত্তম সম্মান ও মর্যাদা লাভের নিশ্চয়তা পেলেও এখানকার লাঞ্ছনা ত্যাগ করে তা গ্রহণ করতে এগিয়ে যাবেন না। এরপর তাদেরকে উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে না ধরে আর কী করা যেতো? এ কারণেই আল্লাহ‌ তাদের ক্ষমার কথা বলেছেন অত্যন্ত স্নেহ মাখা ভাষায়। তিনি বলেছেনঃ আমি তাদের দিকে ফিরলাম যাতে তারা আমার দিকে ফিরে আসে। এ কয়েকটি শব্দের মাধ্যমে এমন একটি অবস্থার ছবি আঁকা হয়েছে যা থেকে বুঝা যায় যে, প্রভু আগে এ বান্দাদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু যখন তারা পালিয়ে না গিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে তারই দোরগাড়ায় বসে পড়লো তখন তাদের বিশ্বস্ততার চিত্র দেখে প্রভু নিজে আর স্থির থাকতে পারলেন না। প্রেমের আবেগে অধীর হয়ে তাকে দরজা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাবার জন্য তিনি নিজেই বের হয়ে এলেন।

.
.
.
১২০.
এ আয়াতের অর্থ অনুধাবন করার জন্য এ সূরার ৯৭ আয়াতটি সামনে রাখতে হবে। তাতে বলা হয়েছেঃ

“মরুচারী আরবরা কুফরী ও মুনাফিকীতে অপেক্ষাকৃত শক্ত এবং আল্লাহ‌ তার রসূলের প্রতি যে দ্বীন নাযিল করেছেন তা সীমারেখা সম্পর্কে তাদের অজ্ঞ হওয়ার সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত বেশী।”

সেখানে শুধু এতটুকু বলেই শেষ করা হয়েছিল যে, দারুল ইসলামের গ্রামীণ এলাকার বেশীরভাগ জনবসতি মুনাফিকী রোগে আক্রান্ত। কারণ এসব লোক অজ্ঞতার মধ্যে ডুবে আছে। জ্ঞানের কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ না থাকা এবং জ্ঞানবানদের সাহচর্যে না পাওয়ার ফলে এরা আল্লাহর দ্বীনের সীমারেখা জানে না। আর এখানে বলা হচ্ছে, গ্রামীণ জনবসতিকে এ অবস্থায় থাকতে দেয়া যাবে না। বরং তাদের অজ্ঞতা দূর এবং তাদের মধ্যে ইসলামী চেতনা সৃষ্টি করার জন্য এখন যথাযথ ব্যবস্থা হওয়া দরকার। এ জন্য গ্রামীণ এলাকার সমস্ত আরব অধিবাসীদের নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে মদীনায় জামায়েত হবার এবং এখানে বসে জ্ঞান অর্জন করার প্রয়োজন নেই। বরং এ জন্য প্রয়োজন হচ্ছে, প্রত্যেক গ্রাম, পল্লী ও গোত্র থেকে কয়েকজন করে লোক বের হবে। তারা জ্ঞানের কেন্দ্রগুলো যেমন মদীনা ও মক্কা এবং এ ধরনের অন্যান্য জায়গায় আসবে। এখানে এসে তারা দ্বীনের জ্ঞান আহরণ করবে। এখান থেকে তারা নিজেদের জনবসতিতে ফিরে যাবে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্বীনি চেতনা ও জাগরণ সৃষ্টিতে তৎপর হবে।

এটি ছিল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ। ইসলামী আন্দোলনকে শক্তিশালী ও মজবুত করার জন্য সঠিক সময়ে এ নির্দেশটি দেয়া হয়েছিল। শুরুতে ইসলাম যখন আরবে ছিল একেবারেই নতুন এবং একটি চরম প্রতিকূল পরিবেশে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল তখন এ ধরনের নির্দেশের প্রয়োজন ছিল না। কারণ তখন যে ব্যক্তি ইসলাম কে পুরোপুরি বুঝে নিতো এবং সব দিকে দিয়ে তাকে যাচাই করে নিশ্চিত হতে পারতো একমাত্র সে ই ইসলাম গ্রহণ করতে। কিন্তু যখন এ আন্দোলন সাফল্যের পর্যায়ে প্রবেশ করলো এবং পৃথিবীতে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো তখন দলে দলে লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলো এবং এলাকার পর এলাকা ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিতে থাকলো। এ সময় খুব কম লোকই ইসলামের যাবতীয় চাহিদাও দাবী অনুধাবন করে ভালভাবে জেনে বুঝে ইসলাম গ্রহণ করতো। বেশীর ভাগ লোকই নিছক অবচেতনভাবে, সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে চলে আসছিল। নতুন মুসলিম জনবসতির এ দ্রুত বিস্তার বাহ্যত ইসলামের শক্তিমত্তার কারণ ছিল। কেননা ইসলামের অনুসারীদের সংখ্যা বেড়ে চলছিল। কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের জনবসতি ইসলামী ব্যবস্থার কোন কাজে লাগছিল না বরং তার জন্য ক্ষতিকর ছিল। কারণ তাদের ইসলামী চেতনা ছিল না এবং এ ব্যবস্থার নৈতিক দাবী পূরণ করতেও তারা প্রস্তুত ছিল না। বস্তুত তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতির সময় এ ক্ষতি সুস্পষ্ট আকারে সামনে এসে গিয়েছিল। তাই সঠিক সময়ে মহান আল্লাহ‌ নির্দেশ দিলেন, ইসলামী আন্দোলনের বিস্তৃতির কাজ যে গতিতে চলছে তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে তাকে শক্তিশালী ও মজবুত করার ব্যবস্থা করতে হবে। আর সে ব্যবস্থাটি হচ্ছে, প্রত্যেক এলাকার লোকদের মধ্য থেকে কিছু লোককে নিয়ে শিক্ষা ও অনুশীলন দান করতে হবে, তারপর তারা প্রত্যেকে নিজেদের এলাকায় ফিরে গিয়ে সাধারণ মানুষের শিক্ষা ও অনুশীলনের দায়িত্ব পালন করবে। এভাবে সমগ্র মুসলিম জনবসতিতে ইসলামের চেতনা ও আল্লাহর বিধানের সীমারেখা সম্পর্কিত জ্ঞান ছড়িয়ে পড়বে।

এ প্রসঙ্গে এতটুকু কথা অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে যে, এ আয়াতে যে সাধারণ শিক্ষার ব্যবস্থা করার হুকুম দেয়া হয়েছে তার আসল উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষকে নিছক সাক্ষরতা সম্পন্ন করা এবং এদের মধ্যে বইপত্র পড়ার মতো যোগ্যতা সৃষ্টি করা ছিল না। বরং লোকদের মধ্যে দ্বীনের বোধ ও জ্ঞান সৃষ্টি করা এবং তাদেরকে অমুসলিম সুলভ জীবনধারা থেকে রক্ষা করা, সতর্ক ও সজ্ঞান করে তোলা এর আসল উদ্দেশ্য হিসেবে সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয়েছিল। এটিই মুসলমানদের শিক্ষার উদ্দেশ্য। মহান আল্লাহ‌ নিজেই চিরকালের জন্য এ উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। প্রত্যেকটি শিক্ষা ব্যবস্থাকে এ দৃষ্টিকোণ থেকে যাচাই করতে হবে। দেখতে হবে এ উদ্দেশ্য সে কতটুকু পূরণ করতে সক্ষম। এর অর্থ এ নয় যে, ইসলাম লোকদেরকে লেখা-পড়া শেখাতে, বই পড়তে সক্ষম করতে তুলতে ও পার্থিব জ্ঞান দান করতে চায় না। বরং এর অর্থ হচ্ছে, ইসলাম লোকদের মধ্যে এমন শিক্ষা বিস্তার করতে চায় যা ওপরে বর্ণিত শিক্ষালাভের জন্য সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত আসল উদ্দেশ্যের দিকে মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায়। নয়তো প্রত্যেক ব্যক্তি যদি তার যুগের আইনস্টাইন ও ফ্রয়েড হয়ে যায় কিন্তু দ্বীনের জ্ঞানের ক্ষেত্রে তারা শূন্যের কোঠায় অবস্থান করে এবং অমুসলিম সুলভ জীবনধারায় বিভ্রান্ত হতে থাকে তাহলে ইসলাম এ ধরনের শিক্ষার ওপর অভিশাপ বর্ষণ করে।

এ আয়াতে উল্লেখিত لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ(লিয়াতাফাক্কাহু ফিদ্দ্বীন) বাক্যাংশটির ফলে পরবর্তীকালে লোকদের মধ্যে আশ্চর্য ধরনের ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়ে গেছে। মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষা বরং তাদের ধর্মীয় জীবনধারার ওপর এর বিষময় প্রভাব দীর্ঘকাল থেকে মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। আল্লাহ‌ “তাফাক্কুহ্ ফিদ্ দ্বীন” কে শিক্ষার উদ্দেশ্যে পরিণত করেছিলেন। এর অর্থ হচ্ছেঃ দ্বীন অনুধাবন করা বা বুঝা, দ্বীনের ব্যবস্থা সম্পর্কে গভীর পর্যবেক্ষণ শক্তি ও অন্তর্দৃষ্টি লাভ করা, তার প্রকৃতি ও প্রাণশক্তির সাথে পরিচিত হওয়া এবং এমন যোগ্যতার অধিকারী হওয়া যার ফলে চিন্তা ও কর্মের সকল দিক ও জীবনের প্রত্যেকটি বিভাগে কোন চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি ইসলামের প্রাণশক্তির অনুসারী ত মানুষ জানতে পারে। কিন্তু পরবর্তীকালে যে আইন সম্পর্কিত জ্ঞান পারিভাষিক অর্থে ফিকহ নামে পরিচিত হয় এবং যা ধীরে ধীরে ইসলামী জীবনের নিছক বাহ্যিক কাঠামোর (প্রাণশক্তির মোকাবিলায়) বিস্তারিত জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, লোকেরা শাব্দিক অভিন্নতার কারণে তাকেই আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী শিক্ষার চরম ও পরম লক্ষ মনে করে বসেছে। অথচ সেটিই সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নয়। বরং তা ছিল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের একটি অংশ মাত্র। এ বিরাট ভুল ধারণার ফলে দ্বীন ও তার অনুসারীদের যে ক্ষতি হয়েছে তা বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করতে হলে একটি বিরাট গ্রন্থের প্রয়োজন। কিন্তু এখানে আমরা এ সম্পর্কে সতর্ক করে দেবার জন্য সংক্ষেপে শুধুমাত্র এতটুকু ইঙ্গিত করছি যে, মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষাকে যে জিনিসটি দ্বীনি প্রাণশক্তি বিহীন করে নিছক দ্বীনি কাঠামো ও দ্বীনি আকৃতির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে এবং অবশেষে যার বদৌলতে মুসলমানদের জীবনে একটি নিছক প্রাণহীন বাহ্যিকতা দ্বীনদারীর শেষ মনজিলে পরিণত হয়েছে তা বহুলাংশে এ ভুল ধারণারই ফল।

অনুবাদ: