পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

১৫৯ আয়াত

১৬৮ ) আমি তাদেরকে পৃথিবীতে খন্ড বিখন্ড করে বহু সংখ্যক জাতিতে বিভক্ত করে দিয়েছি। তাদের মধ্যে কিছু লোক ছিল সৎ এবং কিছু লোক অন্য রকম। আর আমি ভাল ও খারাপ অবস্থায় নিক্ষেপ করার মাধ্যমে তাদেরকে পরীক্ষা করতে থাকি, হয়তো তারা ফিরে আসবে।
وَقَطَّعْنَـٰهُمْ فِى ٱلْأَرْضِ أُمَمًۭا ۖ مِّنْهُمُ ٱلصَّـٰلِحُونَ وَمِنْهُمْ دُونَ ذَٰلِكَ ۖ وَبَلَوْنَـٰهُم بِٱلْحَسَنَـٰتِ وَٱلسَّيِّـَٔاتِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ ١٦٨
১৬৯ ) তারপর পরবর্তী বংশধরদের পর এমন কিছু অযোগ্য লোক তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়, যারা আল্লাহর কিতাবের উত্তরাধিকারী হয়ে এ তুচ্ছ দুনিয়ার স্বার্থ আহরণে লিপ্ত হয় এবং বলতে থাকে আশা করা যায়, আমাদের ক্ষমা করা হবে। পরক্ষনেই সেই ধরনের পার্থিব সামগ্রী যদি আবার তাদের সামনে এসে যায়, তাহলে তৎক্ষনাৎ দৌড়ে গিয়ে তা লুফে নেয়। ১২৯ তাদের কাছ থেকে কি কিতাবের অঙ্গীকার নেয়া হয়নি যে, তারা আল্লাহর নামে কেবলমাত্র সত্য ছাড়া আর কিছুই বলবে না? আর কিতাবে যা লেখা আছে তাতো তারা নিজেরাই পড়ে নিয়েছে। ১৩০ আখেরাতের আবাস তো আল্লাহর ভয়ে ভীত লোকদেরই জন্য ভাল ১৩১ -এতটুকু কথাও কি তোমরা বুঝো না?
فَخَلَفَ مِنۢ بَعْدِهِمْ خَلْفٌۭ وَرِثُوا۟ ٱلْكِتَـٰبَ يَأْخُذُونَ عَرَضَ هَـٰذَا ٱلْأَدْنَىٰ وَيَقُولُونَ سَيُغْفَرُ لَنَا وَإِن يَأْتِهِمْ عَرَضٌۭ مِّثْلُهُۥ يَأْخُذُوهُ ۚ أَلَمْ يُؤْخَذْ عَلَيْهِم مِّيثَـٰقُ ٱلْكِتَـٰبِ أَن لَّا يَقُولُوا۟ عَلَى ٱللَّهِ إِلَّا ٱلْحَقَّ وَدَرَسُوا۟ مَا فِيهِ ۗ وَٱلدَّارُ ٱلْـَٔاخِرَةُ خَيْرٌۭ لِّلَّذِينَ يَتَّقُونَ ۗ أَفَلَا تَعْقِلُونَ ١٦٩
১৭০ ) যারা কিতাবের বিধান যথাযথভাবে মেনে চলে এবং নামায কায়েম করে, নিঃসন্দেহে এহেন সৎকর্মশীল লোকদের কর্মফল আমি নষ্ট করবো না।
وَٱلَّذِينَ يُمَسِّكُونَ بِٱلْكِتَـٰبِ وَأَقَامُوا۟ ٱلصَّلَوٰةَ إِنَّا لَا نُضِيعُ أَجْرَ ٱلْمُصْلِحِينَ ١٧٠
১৭১ ) তাদের কি সেই সময়টার কথা কিছু মনে আছে যখন আমি পাহাড়কে হেলিয়ে তাদের ওপর ছাতার মত এমনভাবে বিস্তৃত করে দিয়ে ছিলাম, যে তারা ধারণা করেছিল, তা বুঝি তাদের ওপর পতিত হবে? সে সময় আমি তাদেরকে বলেছিলাম, তোমাদেরকে আমি যে কিতাব দিচ্ছি তাকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরো এবং তাতে যা কিছু লেখা আছে তা স্মরণ রাখো, আশা করা যায়, তোমরা ভুল পথ অবলম্বন করা থেকে বাঁচতে পারবে। ১৩২
۞ وَإِذْ نَتَقْنَا ٱلْجَبَلَ فَوْقَهُمْ كَأَنَّهُۥ ظُلَّةٌۭ وَظَنُّوٓا۟ أَنَّهُۥ وَاقِعٌۢ بِهِمْ خُذُوا۟ مَآ ءَاتَيْنَـٰكُم بِقُوَّةٍۢ وَٱذْكُرُوا۟ مَا فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ١٧١
১৭২ ) আর হে নবী! ১৩৩ লোকদের স্মরণ করিয়ে দাও সেই সময়ের কথা, যখন তোমাদের রব বনী আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের বংশধরদের বের করেছিলেন এবং তাদেরকে তাদের নিজেদের ওপর সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আমি কি তোমাদের রব নই?” তারা বলেছিল, “নিশ্চয়ই তুমি আমাদের রব, আমরা এর সাক্ষ্য দিচ্ছি।” ১৩৪ এটা আমি এ জন্য করেছিলাম যাতে কিয়ামতের দিন তোমরা না বলে বসো, “আমরা তো একথা জানতাম না।”
وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِنۢ بَنِىٓ ءَادَمَ مِن ظُهُورِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَأَشْهَدَهُمْ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ ۖ قَالُوا۟ بَلَىٰ ۛ شَهِدْنَآ ۛ أَن تَقُولُوا۟ يَوْمَ ٱلْقِيَـٰمَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَـٰذَا غَـٰفِلِينَ ١٧٢
১৭৩ ) অথবা না বলে ওঠো, “শিরকের সূচনা তো আমাদের বাপ-দাদারা আমাদের পূর্বেই করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে তাদের বংশে আমাদের জন্ম হয়েছে। তবে কি ভ্রষ্টাচারী লোকেরা যে অপরাধ করেছিল সেজন্য তুমি আমাদের পাকড়াও করছো?" ১৩৫
أَوْ تَقُولُوٓا۟ إِنَّمَآ أَشْرَكَ ءَابَآؤُنَا مِن قَبْلُ وَكُنَّا ذُرِّيَّةًۭ مِّنۢ بَعْدِهِمْ ۖ أَفَتُهْلِكُنَا بِمَا فَعَلَ ٱلْمُبْطِلُونَ ١٧٣
১৭৪ ) দেখো, এভাবে আমি নিদর্শনসমূহ সুস্পষ্টভাবে পেশ করে থাকি। ১৩৬ আর এ জন্য করে থাকি যাতে তারা ফিরে আসে। ১৩৭
وَكَذَٰلِكَ نُفَصِّلُ ٱلْـَٔايَـٰتِ وَلَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ ١٧٤
১৭৫ ) আর হে মুহাম্মাদ! এদের সামনে সেই ব্যক্তির অবস্থা বর্ণনা করো, যাকে আমি দান করেছিলাম আমার আয়াতের জ্ঞান। ১৩৮ কিন্তু সে তা যথাযথভাবে মেনে চলা থেকে দূরে সরে যায়। অবশেষে শয়তান তার পিছনে লাগে। শেষ পর্যন্ত সে বিপথগামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়েই যায়।
وَٱتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ٱلَّذِىٓ ءَاتَيْنَـٰهُ ءَايَـٰتِنَا فَٱنسَلَخَ مِنْهَا فَأَتْبَعَهُ ٱلشَّيْطَـٰنُ فَكَانَ مِنَ ٱلْغَاوِينَ ١٧٥
১৭৬ ) আমি চাইলে ঐ আয়াতগুলোর সাহায্যে তাকে উচ্চ মর্যাদা দান করতাম কিন্তু সে তো দুনিয়ার প্রতিই ঝুঁকে রইল এবং নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করলো। কাজেই তার অবস্থা হয়ে গেল কুকুরের মত, তার ওপর আক্রমণ করলেও সে জিভ ঝুলিয়ে রাখে আর আক্রমণ না করলেও জিভ ঝুলিয়ে রাখে। ১৩৯ যারা আমার আয়াতকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে তাদের দৃষ্টান্ত এটাই। তুমি এ কাহিনী তাদেরকে শুনাতে থাকো, হয়তো তারা কিছু চিন্তা-ভাবনা করবে।
وَلَوْ شِئْنَا لَرَفَعْنَـٰهُ بِهَا وَلَـٰكِنَّهُۥٓ أَخْلَدَ إِلَى ٱلْأَرْضِ وَٱتَّبَعَ هَوَىٰهُ ۚ فَمَثَلُهُۥ كَمَثَلِ ٱلْكَلْبِ إِن تَحْمِلْ عَلَيْهِ يَلْهَثْ أَوْ تَتْرُكْهُ يَلْهَث ۚ ذَّٰلِكَ مَثَلُ ٱلْقَوْمِ ٱلَّذِينَ كَذَّبُوا۟ بِـَٔايَـٰتِنَا ۚ فَٱقْصُصِ ٱلْقَصَصَ لَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ ١٧٦
১৭৭ ) যারা আমার আয়াতকে মিথ্যা বলেছে, তাদের দৃষ্টান্ত বড়ই খারাপ এবং তার নিজেরাই নিজেদের প্রতি জুলুম চালিয়ে গেছে।
سَآءَ مَثَلًا ٱلْقَوْمُ ٱلَّذِينَ كَذَّبُوا۟ بِـَٔايَـٰتِنَا وَأَنفُسَهُمْ كَانُوا۟ يَظْلِمُونَ ١٧٧
.
১২৯.
অর্থাৎ গুনাহ করে। তারা জানে এ কাজটি করা গুনাহ তবুও এ আশায় তারা এ কাজটি করে যে, কোন না কোনভাবে তাদের গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। কারণ তারা মনে করে, তারা আল্লাহর প্রিয়পাত্র এবং তারা যত কঠিন অপরাধই করুক না কেন তাদের ক্ষমালাভ অপরিহার্য। এ ভুল ধারণার ফলে কোন গুনাহ করার পর তারা লজ্জিত হয় না এবং তাওবাও করে না। বরং ঐ একই ধরনের গুনাহ করার সুযোগ এলে তারা আবার তাতে জড়িয়ে পড়ে। এ হতভাগ্য লোকেরা এমন একটি কিতাবের উত্তরাধীকারী ছিল, যা তাদেরকে দুনিয়ার নেতৃত্বের পদে আসীন করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের হীনমন্যতা ও নীচাশয়তার ফলে, তারা এ সৌভাগ্যের পরশমণিটির সাহায্যে তুচ্ছ পার্থিব সম্পদ আহরণ করার চাইতে বড় কোন জিনিস উপার্জনের হিম্মতই করলো না। তারা দুনিয়ার ন্যায়-ইনসাফ, সত্য-সততার পতাকাবাহী এবং কল্যাণ ও সুকৃতির অগ্রপথিক ও পদপ্রদর্শক হবার পরিবর্তে নিছক দুনিয়ার কুকুর হয়েই রইল।
১৩০.
অর্থাৎ তারা নিজেরাই জানে, তাওরাতের কোথাও বনী ইসরাঈলের জন্য শর্তহীন মুক্তি সনদ দেয়ার উল্লেখ নেই। আল্লাহ‌ কখনো তাদেরকে একথা বলেননি এবং তাদের নবীগণও কখনো তাদেরকে এ ধরনের নিশ্চয়তা দেননি যে, তোমরা যা ইচ্ছা করতে পারো, তোমাদের সকল গুনাহ অবশ্যি মাফ হয়ে যাবে। তাছাড়া আল্লাহ‌ নিজে যে কথা কখনো বলেননি, তাকে আল্লাহর কথা বলে প্রচার করার কি অধিকারই বা তাদের থাকতে পারে? অথচ তাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নেয়া হয়েছিল যে, আল্লাহর নামে কোন অসত্য কথা তারা বলবে না।
১৩১.
এ আয়াতটির দু’টি অনুবাদ হতে পারে। একটি অনুবাদ আমি এখানে করেছি। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, “আল্লাহর ভয়ে ভীত লোকদের জন্য তো আখেরাতের আবাসই ভাল।” প্রথম অনুবাদের আলোকে আয়াতের তাৎপর্য হবে এই যে, মাগফেরাত কারোর একচেটিয়া ব্যক্তিগত বা পারিবারিক অধিকার নয়। তুমি এমন কাজ করবে যা শাস্তি লাভের যোগ্য, কিন্তু আখেরাতে তুমি নিছক ইহুদী বা ইসরাঈলী হবার কারণে ভাল জায়গা পেয়ে যাবে, এটা কখনো হতে পারে না। তোমাদের মধ্যে সামান্যতম বিবেক-বুদ্ধি থাকলেও তোমরা নিজেরাই বুঝতে পারবে যে, আখেরাতের ভাল জয়গা একমাত্র তারাই পেতে পারে যারা দুনিয়ায় আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে কাজ করে। আর দ্বিতীয় অনুবাদটি গ্রহণ করলে মর্ম এ দাঁড়ায় যে, যেসব লোক আল্লাহর ভয়ে ভীত নয় একমাত্র তারাই দুনিয়াবী লাভ ও স্বার্থকে আখেরাতের ওপর অগ্রাধিকার দেয়। আল্লাহর ভয়ে ভীত লোকেরা নিশ্চিতভাবে আখেরাতের স্বার্থকে দুনিয়ার স্বার্থের ওপর এবং আখেরাতের কল্যাণ ও লাভকে দুনিয়ার আয়েশ-আরামের ওপর অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।
.
.
১৩২.
মূসা আলাইহিস সালামকে অঙ্গীকারনামা খোদিত শিলালিপি গুলো দেবার সময় সিনাই পাহাড়ের পাদদেশে যে ঘটনাটি ঘটেছিল সেদিকে এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে। বাইবেলে নিম্নোক্ত ভাষায় এ ঘটনাটি বর্ণনা দেয়া হয়েছেঃ

"পরে মূসা আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করিয়ে দেয়ার জন্য লোকদেরকে শিবির থেকে বাইরে আনলেন। আর তারা পর্বতের তলায় দাঁড়ালো। তখন সমস্ত সিনাই পর্বত ওপর থেকে নীচে পর্যন্ত ধোঁয়ায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল। কারণ মহান আল্লাহ‌ অগ্নিশিখার মধ্য দিয়ে তার ওপর নেমে এলেন। আর ভাঁটির ধোঁয়ার মত ধোঁয়া ওপরে উঠছিল এবং গোটা পর্বত ভীষণভাবে কাঁপছিল।” (যাত্র পুস্তক ১৯: ১৭-১৮)

এভাবে আল্লাহ‌ কিতাবের বিধান মেনে চলার জন্য বনী ইসরাঈলীদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নেন। এ অঙ্গীকার নিতে গিয়ে বাইরে তাদের জন্য একটি বিশেষ পরিবেশ সৃষ্টি করেন, যাতে আল্লাহর প্রতাপ-প্রতিপত্তি, তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ব এবং এ অঙ্গীকারের গুরুত্ব তাদের মনে পুরোপুরি অনুভূত হয় এবং বিশ্বজাহানের সার্বভৌম ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকারী শাহেনশাহের সাথে অঙ্গীকার ও চুক্তি সম্পাদন করাকে তারা যেন মামুলি ব্যাপার মনে করতে না পারে। এ থেকে এ ধারণা করা ঠিক হবে না যে, তারা আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার করতে প্রস্তুত ছিল না, ভয় দেখিয়ে জোর জবরদস্তি করে তাদেরকে অঙ্গীকারাব্ধ হতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। আসল ব্যাপার হচ্ছে, তারা সবাই ছিল মু’মিন। সিনাই পাহাড়ের পাদদেশে তারা গিয়েছিল অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে। কিন্তু আল্লাহ‌ তাদের সাথে মামুলীভাবে অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হবার পরিবর্তে এ অঙ্গীকারের অনুভূতি তাদের মনে ভালভাবে বদ্ধমূল করার চেষ্টা করেন। অঙ্গীকার করার সময় কোন মহাশক্তিধর সত্তার সাথে তারা অংগীকার করছে এবং তাঁর সাথে অঙ্গীকার ভঙ্গ করার পরিণাম কি হতে পারে, তা যেন তারা অনুভব করতে পারবে, এটাই ছিল আল্লাহর অভিপ্রায়।

এখানে এসে বনী ইসরাঈল জাতিকে সম্বোধনের পালা শেষ হয়ে যায়। পরবর্তী রুকূ'গুলোতে সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে বক্তব্য পেশ করা হয়েছে। বিশেষ করে নবী ﷺ যাদেরকে সরাসরি ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছিলেন, তাদেরকে লক্ষ্য করে বক্তব্য রাখা হয়েছে।

১৩৩.
পূর্ববর্তী আলোচনা যেখানে শেষ হয়েছিল সেখানে বলা হয়েছিল, মহান আল্লাহ‌ বনী ইসরাঈলের কাছ থেকে বন্দেগী ও আনুগত্যের অঙ্গীকার নিয়েছিলেন এখন সাধারণ মানুষকে সম্বোধন করে তাদেরকে জানানো হচ্ছে যে, এ ব্যাপারে বনী ইসরাঈলের কোন বিশেষত্ব নেই বরং প্রকৃতপক্ষে তোমরা সবাই নিজেদের স্রষ্টার সাথে একটি অঙ্গীকারে আবদ্ধ এবং এ অঙ্গীকার তোমরা কতটুকু পালন করেছো সে ব্যাপারে তোমাদের একদিন জবাবদিহি করতে হবে।
১৩৪.
বিভিন্ন হাদীস থেকে জানা যায়, এটি আদম সৃষ্টির সময়কার একটি ঘটনা। সে সময় একদিকে যেমন ফেরেশতাদের একত্র করে প্রথম মানুষটিকে সিজদা করানো হয়েছিল এবং পৃথিবীতে মানুষের খিলাফতের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল, অন্যদিকে ঠিক তেমনি কিয়ামত পর্যন্ত আদমের যে অগণিত সংখ্যক বংশধর জন্মলাভ করবে, মহান আল্লাহ‌ তাদের সবাইকে একই সঙ্গে সজীব ও সচেতন সত্তায় আবির্ভূত করে নিজের সামনে উপস্থিত করেছিলেন এবং তাদের কাছ থেকে তাঁর রব হবার ব্যাপারে সাক্ষ্য গ্রহণ করেছিলেন। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত উবাই ইবনে কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু সম্ভবত নবী ﷺ থেকে জ্ঞান লাভ করে যা কিছু বর্ণনা করেন তা এ বিষয়ের সবচেয়ে ভাল ব্যাখ্যা বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। তিনি বলেনঃ

“মহান আল্লাহ‌ সবাইকে একত্র করেন। (এক এক ধরনের বা এক এক যুগের) লোকদেরকে আলাদা আলাদা দলে সংগঠিত করেন। তাদেরকে মানবিক আকৃতি ও বাকশক্তি দান করেন। তারপর তাদের থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। তাদেরকে নিজেদের ওপর সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞেস করেনঃ আমি কি তোমাদের রব নই? তারা বলেঃ অবশ্যই তুমি আমাদের রব। তখন আল্লাহ‌ বলেনঃ কিয়ামতের দিন যাতে তোমরা না বলতে পারো আমরা তো একথা জানতাম না, তাই আমি তোমাদের ওপর পৃথিবী ও আকাশ এবং তোমাদের পিতা আদমকে সাক্ষী করছি। ভালভাবে জেনে রাখো, আমি ছাড়া ইবাদাত লাভের যোগ্য আর কেউ নেই এবং আমি ছাড়া আর কোন রব নেই। তোমরা আমার সাথে আর কাউকে শরীক করো না। আমি তোমাদের কাছে আমার নবী পাঠাবো। আমার সাথে তোমরা যেসব অঙ্গীকার করছো তারা সেসব তোমাদের স্মরণ করিয়ে দেবে। আর তোমাদের প্রতি আমার কিতাব নাযিল করবো। এ কথায় সমস্ত মানুষ বলে ওঠেঃ আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, তুমিই আমাদের রব, তুমিই আমাদের মাবুদ, তুমি ছাড়া আমাদের আর কোন রব ও মাবুদ নেই।”

কেউ কেউ এ ব্যাপারটিকে নিছক রূপক বা উপমা হিসেবে বর্ণিত একটি ব্যাপার মনে করে থাকেন। তাদের মতে এখানে কুরআন মজীদ কেবল একথাই বুঝাতে চায় যে, আল্লাহর রব হবার বিষয়টির স্বীকৃতি মানবিক প্রকৃতির মধ্যে নিহিত রয়েছে এবং এ কথাটি এখানে এমনভাবে বর্ণিত হয়েছে, যেন এটি বাস্তব জগতে অনুষ্ঠিত একটি ঘটনা ছিল। কিন্তু এ ব্যাখ্যাকে আমি সঠিক মনে করি না। কুরআন ও হাদীসে এটিকে একটি বাস্তব ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আর শুধু ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করেই শেষ করে দেয়া হয়নি বরং এ সঙ্গে একথাও বলা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন অনাদিকালের এ অঙ্গীকারটিকে মানুষের বিরুদ্ধে একটি দলীল ও প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হবে। কাজেই একে নিছক একটি রূপক বর্ণনা গণ্য করার কোন কারণ আমি দেখি না। আমার মতে, বাস্তবে যেমন বিভিন্ন ঘটনা ঘটে থাকে ঠিক তেমনিভাবে এ ঘটনাটিও ঘটেছিল। মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ‌ কিয়ামত পর্যন্ত যেসব মানুষকে সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, তাদের সবাইকে বাস্তবে একই সঙ্গে জীবন, চেতনা ও বাকশক্তি দান করে নিজের সামনে হাযির করেছিলেন এবং বাস্তবে তাদেরকে এ সত্যটি সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত করেছিলেন যে, তাঁর মহান, পবিত্র ও উন্নত সত্তা ছাড়া তাদের আর কোন রব ও ইলাহ নেই এবং তাঁর বন্দেগী ও হুকুমের আনুগত্য (ইসলাম) ছাড়া তাদের জন্য আর কোন সঠিক জীবন বিধান নেই। এ সম্মেলন অনুষ্ঠানকে কোন ব্যক্তি যদি অসম্ভব মনে করে থাকে, তাহলে এটি নিছক তার চিন্তার পরিসরের সংকীর্ণতার ফল ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্যথায় বাস্তবে মানব সন্তানের বর্তমান পর্যায়ক্রমিক জন্ম ও বিকাশ যতটা সম্ভব, সৃষ্টির আদিতে তার সামষ্টিক আবির্ভাব ও অন্তে তার সামষ্টিক পুনরুত্থান ও সমাবেশ ঠিক ততটাই সম্ভবপর। তাছাড়া মানুষের মত একটি সচেতন, বুদ্ধিমান ও স্বাধীন ক্ষমতা সম্পন্ন সৃষ্টিকে পৃথিবীতে নিজের প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্তির প্রাক্কালে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে প্রকৃত সত্য জানিয়ে দেয়া এবং তার কাছ থেকে নিজের পক্ষে বিশ্বস্ততার অঙ্গীকার নিয়ে নেয়াটা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত বলেই মনে হচ্ছে। এ ধরনের একটা ঘটনা ঘটা মোটেই বিস্ময়কর নয়। বরং এ ধরনের একটা ঘটনা না ঘটলেই অবাক হতে হতো।

.
১৩৫.
আদিকালে তথা সৃষ্টির সূচনালগ্নে সমগ্র মানব জাতির কাছ থেকে যে অঙ্গীকার নেয়া হয়েছিল এখানে তার উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে। সেই উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানব জাতির মধ্য থেকে যারা আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্মক আচরণ করবে তারা যেন নিজেরাই নিজেদের এ অপরাধের জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী হয়। নিজেদের সাফাই গাইবার জন্য না জানার অজুহাত পেশ করার কোন সুযোগ যেন তাদের না থাকে এবং পূর্ববর্তী বংশধরদের ওপর নিজেদের গোমরাহীর সমস্ত দায়-দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা দায়মুক্ত হতেও না পারে। অন্য কথায় বলা যায়, প্রত্যেকটি মানুষ ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিজের মধ্যে আল্লাহর একমাত্র ইলাহ ও একমাত্র রব হবার সাক্ষ্য ও স্বীকৃতি বহন করে চলেছে, আদিতম অঙ্গীকারকে আল্লাহ‌ প্রত্যেকটি মানুষের জন্য এরই প্রমাণ হিসেবে গণ্য করেছেন। এ জন্য কোন ব্যক্তি নিজের অজ্ঞতা অথবা ভ্রান্ত পরিবেশে লালিত হবার কারণে তার গোমরাহীর জন্য মোটেই দায়ী নয়, একথা কোনক্রমেই বলা যেতে পারে না।

এখন প্রশ্ন দেখা দেয়, সৃষ্টির প্রথম দিনের এ অঙ্গীকার যদি বাস্তবে সংঘটিত হয়েও থাকে তাহলে তা কি আমাদের চেতনা ও স্মৃতিপটে সংরক্ষিত আছে? আমাদের মধ্য থেকে কোন একজনও কি একথা জানে, সৃষ্টির সূচনালগ্নে তাকে আল্লাহর সামনে পেশ করা হয়েছিল, সেখানে তার সামনে أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ (আমি কি তোমাদের রব নই? ) প্রশ্ন করা হয়েছিল এবং তার জবাবে সে বলেছিল بَلَى(হ্যাঁ)? জবাব যদি নেতিবাচক হয়ে থাকে, তাহলে যে অঙ্গীকারের কথা আমাদের চেতনা ও স্মৃতিপট থেকে উধাও হয়ে গেছে তাকে কেমন করে আমাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে?

এর জবাবে বলা যায়, সেই অঙ্গীকারের কথা যদি মানুষের চেতনা ও স্মৃতিপটে জাগরুক রাখা হতো, তাহলে মানুষকে দুনিয়ার বর্তমান পরীক্ষাগারে পাঠানোর ব্যাপারটা একেবারে অর্থহীন হয়ে যেতো। কারণ এরপর পরীক্ষার আর কোন অর্থই থাকতো না। তাই এ অঙ্গীকারের কথা চেতনা ও স্মৃতিপটে জাগরুক রাখা হয়নি ঠিকই, কিন্তু অবচেতন মনে (Sub-conscious mind) ও সুপ্ত অনুভূতিতে (Intution) তাকে অবশ্যি সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। তার অবস্থা আমাদের অবচেতন ও অনুভূতি সঞ্জাত অন্যান্য জ্ঞানের মতই। সভ্যতা, সংস্কৃতি, নৈতিক ও ব্যবহারিক জীবনের সকল বিভাগে মানুষ আজ পর্যন্ত যা কিছুর উদ্ভব ঘটিয়েছে, তা সবই আসলে মানুষের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে (Potentially) বিরাজিত ছিল। বাইরের কার্যকারণ ও ভিতরের উদ্যোগ-আয়োজন ও চেষ্টা-সাধনা মিলেমিশে কেবলমাত্র অব্যক্তকে ব্যক্ত করার কাজটুকুই সম্পাদন করেছে। এমন কোন জিনিস যা মানুষের মধ্যে অব্যক্তভাবে বিরাজিত ছিল না, তাকে কোন শিক্ষা, অনুশীলন, পরিবেশের প্রভাব ও আভ্যন্তরীন চেষ্টা-সাধনার বলে কোনক্রমেই তার মধ্যে সৃষ্টি করা সম্ভব নয় এটি একটি জাজ্বল্যমান সত্য। আর এ প্রভাব-প্রচেষ্টাসমূহ নিজের সর্বশক্তি নিয়োগ করলেও মানুষের মধ্যে যেসব জিনিস অব্যক্তভাবে বিরাজিত রয়েছে তাদের কোনটিকেও পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেবার ক্ষমতা রাখে না। বড়জোর তারা তাকে তার মূল স্বাভাব প্রকৃতি থেকে বিকৃত (Pervert) করতে পারে মাত্র। তবুও সব রকমের বিকৃতি ও বিপথগামীতা সত্ত্বেও সেই জিনিসটি তার মধ্যে বিদ্যমান থাকবে, আত্মপ্রকাশের প্রচেষ্টা চালাতে থাকবে এবং বাইরের আবেদনে সাড়া দেয়ার জন্য সর্বক্ষণ উন্মুখ থাকবে। এ ব্যাপারটি যেমন আমি ইতিপূর্বে বলেছি, আমাদের সকল প্রকার অবচেতন ও প্রচ্ছন্ন অনুভূতিলব্ধ জ্ঞানের ক্ষেত্রে সর্বতোভাবে সত্যঃ

ঃ এগুলো সবই আমাদের মধ্যে অব্যক্তভাবে রয়েছে। আমরা বাস্তবে যা কিছু ব্যক্ত করি এবং যেসব কাজ করি, তার মাধ্যমেই এগুলোর অস্তিত্বের নিশ্চিত প্রমাণ আমরা পেয়ে থাকি।

ঃ এগুলোর কার্যকর অভিব্যক্তির জন্য বাইরের আলোচনা (স্মরণ করিয়ে দেয়া) শিক্ষা, অনুশীলন ও কাঠামো নির্মাণের প্রয়োজন হয়। আর আমাদের দ্বারা বাস্তবে যা কিছু সংঘটিত হয়, তা আসলে বাইরের সেই আবেদনেরই সাড়া বলে প্রতীয়মান হয়, যা আমাদের মধ্যে সুপ্তভাবে বিরাজমান জিনিসসমূহের পক্ষ থেকে এসে থাকে।

ঃ ভিতরের ভ্রান্ত কামনা, বাসনা ও বাইরের প্রতিকূল প্রভাব, প্রতিপত্তি ও কার্যক্রম এগুলোকে দাবিয়ে দিয়ে বিকৃত ও বিপথগামী করে এবং এগুলোর ওপর আবরণ ফেলে দিয়ে এগুলোকে নিস্তেজ ও নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে কিন্তু সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে না। আর এজন্যই ভিতরের চেতনা ও বাইরের প্রচেষ্টা-উভয়ের সহায়তায় সংস্কার, সংশোধন ও পরিবর্তন (conversion) সম্ভবপর।

বিশ্বজাহানে আমাদের যথার্থ মর্যাদা এবং বিশ্বজাহানের স্রষ্টার সাথে আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে আমরা যে সুপ্ত চেতনালব্ধ জ্ঞানের অধিকারী তার অবস্থাও এ একই পর্যায়ভুক্ত এ জ্ঞান যে আবহামানকাল ধরেই বিরাজমান তার প্রমাণ হচ্ছে এই যে, তা মানব জীবনের প্রতি যুগে, পৃথিবীর সব এলাকায়, প্রতিটি জনপদে, প্রত্যেকটি বংশে, প্রজন্মে ও পরিবারে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং কখনো দুনিয়ার কোন শক্তিই তাকে নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম হয়নি।

ঃ ঐ জ্ঞান যে প্রকৃত সত্যের অনুরূপ তার প্রমাণ হচ্ছে এই যে, যখনই তা আত্মপ্রকাশ করে আমাদের জীবনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে তখনই তা সুস্থ ও কল্যাণকর ফল প্রদান করতে সক্ষম হয়েছে।

ঃ তার আত্মপ্রকাশ করার ও কার্যকর রূপলাভ করার জন্য সবসময় একটি বহিরাগত আবেদনের প্রয়োজন হয়েছে। তাই নবীগণ, আসমানী কিতাবসমূহ ও তাদের আনুগত্যকারী সত্যের আহবায়কদের সবাই এ দায়িত্বই পালন করে এসেছেন। এ জন্যই কুরআনে তাদেরকে মুযাক্কির (স্মারক) এবং তাদের কাজকে তাযকীর (স্মরণ করিয়ে দেয়া), যিকর (স্মরণ) ও তাযকিরাহ (স্মৃতি) ইত্যাদি শব্দাবলীর মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, নবীগণ, কিতাবসমূহ ও সত্যের আহবায়কগণ, মানুষের মধ্যে কোন নতুন জিনিস সৃষ্টি করেন না বরং তার মধ্যে আগে থেকেই যে জিনিসটির অস্তিত্ব বিরাজ করছিল, তাকে জাগিয়ে তোলেন এবং নতুন জীবনীশক্তি দান করেন মাত্র।

ঃ মানবাত্মার পক্ষ থেকে প্রতি যুগে এ স্মরণ করিয়ে দেবার প্রয়াসে ইতিবাচক সাড়া দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে যে প্রকৃতপক্ষে এমন এক জ্ঞান সুপ্ত ছিল, যা নিজের আহ্বানকারীরা আওয়াজ চিনতে পেরে তার জবাব দেবার জন্য জেগে উঠেছে, এটি তার আর একটি প্রমাণ।

ঃ তারপর মূর্খতা, অজ্ঞতা, ইন্দ্রিয় লিপ্সা, স্বার্থপ্রীতি এবং মানুষ ও জ্বীনের বংশদ্ভূত শয়তানদের বিভ্রান্তিকর শিক্ষা ও প্ররোচনা তাকে সবসময় দাবিয়ে রাখার, বিপথগামী ও বিকৃত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এর ফলে শিরক, আল্লাহ‌ বিমুখতা, আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং নৈতিক ও কর্মক্ষেত্রে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। কিন্তু বিভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতার এ সমুদয় শক্তির সম্মিলিত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, সেই জ্ঞানের জন্মগত ছাপ মানুষের হৃদয়পটে কোন না কোন পর্যায়ে অক্ষুন্ন থেকেছে। এ জন্যই স্মরণ করিয়ে দেয়া ও নবায়নের প্রচেষ্টা তাকে জাগিয়ে তোলার ব্যাপারে সফল ভূমিকা পালন করে এসেছে।

অবশ্যি দুনিয়ার বর্তমান জীবনে যারা পরম সত্য ও বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে বদ্ধপরিকর, তারা নিজেদের তথাকথিত যুক্তিবাদের ভিত্তিতে জন্মগতভাবে হৃদয়ফলকে খোদিত এ লিপিটির অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারে অথবা কমপক্ষে একে সন্দেহযুক্ত সাব্যস্ত করতে পারে। কিন্তু যেদিন হিসেব-নিকেশ ও বিচারের আদালত প্রতিষ্ঠিত হবে, সেদিন মহাশক্তিশালী স্রষ্টা তাদের চেতনা ও স্মৃতিপটে সৃষ্টির প্রথম দিনের সেই সম্মেলনটির স্মৃতি জাগিয়ে তুলবেন। সৃষ্টির প্রথম দিনে তারা একযোগে যে মহান স্রষ্টাকে তাদের একমাত্র রব ও মাবুদ বলে স্বীকার করে নিয়েছিল, সেই স্মৃতি আবার পুরোদমে তরতাজা করে দেবেন। তারপর তিনি তাদের নিজেদের অভ্যন্তর থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করে এ অঙ্গীকারলিপি যে তাদের হৃদয়ে সবসময় খোদিত ছিল তা দেখিয়ে দেবেন। তাদের জীবনের সংরক্ষিত কার্যবিবরণী থেকে সর্বসম্মুখে এও দেখিয়ে দেবেন যে, তারা কিভাবে হৃদয়ফলকে খোদিত সে লিপিটি উপেক্ষা করেছে, কখন কোন সময় তাদের হৃদয়ের অভ্যন্তর থেকে এ লিপির সত্যতার স্বীকৃতি স্বগতভাবে উচ্চারিত হয়েছে, নিজের ও নিজের চারপাশের ভ্রষ্টতার ওপর তাদের বিবেক কোথায় কখন অসম্মতি ও বিদ্রোহের আওয়াজ বুলন্দ করেছে, সত্যের আহবায়কদের আহবানের জবাব দেয়ার জন্য তাদের অভ্যন্তরের লুকানো জ্ঞান কতবার কত জায়গায় আত্মপ্রকাশে উন্মুখ হয়েছে এবং তারা নিজেদের স্বার্থপ্রীতি ও প্রবৃত্তির লালসার বশবর্তী হয়ে কোন ধরনের তাল বাহানার মাধ্যমে তাকে ক্রমাগত প্রতারিত ও স্তব্ধ করে দিয়েছে। সেদিন যখন এসব গোপন কথা প্রকাশ হয়ে পড়বে, তখন যুক্তি-তর্ক করার অবকাশ থাকবে না বরং পরিষ্কারভাবে অপরাধ স্বীকার করে নিতে হবে। তাই কুরআন মজিদ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষনা করেছেঃ সেদিন অপরাধীরা একথা বলবে না, আমরা মুর্খ ছিলাম, অজ্ঞ ছিলাম, আমরা গাফেল ছিলাম বরং তারা একথা বলতে বাধ্য হবে, আমরা কাফের ছিলাম, অর্থাৎ আমরা জেনে বুঝে সত্যকে অস্বীকার করেছিলাম।

وَشَهِدُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ أَنَّهُمْ كَانُوا كَافِرِينَ

“আর তারা নিজেদের ব্যাপারেই সাক্ষ্য দেবে, তারা কাফের তথা অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যানকারী ছিল।”(আন'আমঃ ১৩০)

১৩৬.
অর্থাৎ সত্যকে উপলব্ধি করার ও চিনে নেবার যেসব উপকরণ ও নিদর্শন মানুষের নিজের মধ্যে রয়েছে সেগুলো পরিষ্কারভাবে তুলে ধরি।
১৩৭.
অর্থাৎ বিদ্রোহ ও বিকৃতি-বিভ্রান্তির নীতি পরিত্যাগ করে বন্দেগী ও আল্লাহর আনুগত্যের আচরণের দিকে যেন ফিরে আসে।
১৩৮.
এ বাক্যটিতে কোন এক নির্দিষ্ট ব্যক্তির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে বলে মনে হয়। কিন্তু আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূলের উৎকৃষ্টতম নৈতিক মানও এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তাঁর যখনই কারোর কোন দুষ্কৃতির উদাহরণ দেন তখন দোষটি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন না। বরং তার ব্যক্তিত্বকে উহ্য রেখে শুধুমাত্র তার দোষটি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন। এভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অবমাননা ও লাঞ্ছনা ছাড়াই আসল উদ্দেশ্য সফল হয়ে যায়। তাই যে ব্যক্তির দৃষ্টান্ত এখানে পেশ করা হয়েছে, কুরআন ও হাদীসের কোথাও তার পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। মুফাসসিরগণ রসূলের যুগের এবং তাঁর পূর্ববর্তী যুগের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে এ দৃষ্টান্তের লক্ষ্য বলে চিহ্নিত করেছেন। কেউ বাল’আম ইবনে বাউরার নাম নিয়েছেন। কেউ নিয়েছেন উমাইয়া ইবনে আবীস সালতের নাম। আবার কেউ বলেছেন, এ ব্যক্তি ছিল সাইফী ইবনুর রাহেব। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উদাহরণ হিসেবে যে বিশেষ ব্যক্তির ভূমিকা এখানে পেশ করা হয়েছে, সে তো পর্দান্তরালেই রয়ে গেছে। তবে যে ব্যক্তিই এ ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে তার ব্যাপারে এ উদাহরণটি প্রযোজ্য হবেই।
.
১৩৯.
এ দু’টি সংক্ষিপ্ত বাক্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বর্ণনা করা হয়েছে। এ বিষয়টি একটু বিস্তারিতভাবে অনুধাবন করা প্রয়োজন। এখানে যে ব্যক্তির উদাহরণ পেশ করা হয়েছে সে আল্লাহর কিতাবের জ্ঞানের অধিকারী ছিল। অর্থাৎ প্রকৃত সত্য সম্পর্কে অবহিত ছিল। এ ধরনের জ্ঞানের অধিকারী হবার কারণে যে কর্মনীতিকে সে ভুল বলে জানতো তা থেকে দূরে থাকা এবং যে কর্মনীতিকে সঠিক মনে করতো তাকে অবলম্বন করাই তার উচিত ছিল। এ যথার্থ জ্ঞান অনুযায়ী কাজ করলে আল্লাহ‌ তাকে মানবতার উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত করতেন। কিন্তু সে দুনিয়ার স্বার্থ, স্বাদ ও আরাম-আয়েশের দিকে ঝুঁকে পড়ে। প্রবৃত্তির লালসার মোকাবিলা করার পরিবর্তে সে তার সামনে নতজানু হয়। উচ্চতর বিষয় সমূহ লাভের জন্য সে পার্থিব লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে ওঠার পরিবর্তে তার মধ্যে এমনভাবে ডুবে যায় যার, ফলে নিজের সমস্ত উচ্চতর আশা-আকাংখা, বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক উন্নতির সমস্ত সম্ভাবনা পরিত্যাগ করে বসে। তার নিজের জ্ঞান যেসব সীমানা রক্ষণাবেক্ষণের দাবী জানিয়ে আসছিল, সেগুলো লংঘন করে এগিয়ে চলতে থাকে। তারপর যখন সে নিছক নিজের নৈতিক দুর্বলতার কারণে জেনে বুঝে সত্যকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চললো, তখন তার নিকটেই ওঁৎ পেতে থাকা শয়তান তার পেছনে লেগে যায় এবং অনবরত তাকে এক অধঃপতন থেকে আর এক অধঃপতনের দিকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। অবশেষে এ জালেম শয়তান তাকে এমন সব লোকের দলে ভিড়িয়ে দেয়, যারা তার ফাঁদে পা দিয়ে বুদ্ধি-বিবেক সব কিছু হারিয়ে বসেছিল।

এরপর আল্লাহ‌ এ ব্যক্তির অবস্থাকে এমন একটি কুকুরের সাথে তুলনা করেছেন, যার জিভ সবসময় ঝুলে থাকে এবং এ ঝুলন্ত জিভ থেকে অনবরত লালা টপকে পড়তে থাকে। এহেন অবস্থা তার উদগ্র লালসার আগুন ও অতৃপ্ত কামনার কথা প্রকাশ করে। যে কারণে আমাদের ভাষায় আমরা এহেন পার্থিব লালসায় অন্ধ ব্যক্তিকে দুনিয়ার কুকুর বলে থাকি। ঠিক সেই একই কারণে এ বিষয়টিকে এখানে উপমার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। কুকুরের স্বভাব কি? লোভ ও লালসা। চলাফেরার পথে তার নাক সব সময় মাটি শুকতে থাকে, হয়তো কোথাও কোন খাবারের গন্ধ পাওয়া যাবে এ আশায়। তার গায়ে কেউ কোন পাথর ছুড়েঁ মারলেও তার ভুল ভাংবে না। বরং তার মনে সন্দেহ জাগবে, যে জিনিসটি দিয়ে তাকে মারা হয়েছে সেটি হয়তো কোন হাড় বা রুটির টুকরা হবে। পেট পূজারী লোভী কুকুর একবার লাফিয়ে দৌড়ে গিয়ে সেই নিক্ষিপ্ত পাথরটিও কামড়ে ধরে। পথিক তার দিকে কোন দৃষ্টি না দিলেও দেখা যাবে সে লোভ-লালসার প্রতিমূর্তি হয়ে বিরাট আশায় বুক বেঁধে জিভ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাপাচ্ছে। সে তার পেটের দৃষ্টি দিয়ে সারা দুনিয়াকে দেখে। কোথাও যদি কোন বড় লাশ পড়ে থাকে, কয়েকটি কুকুরের পেট ভরার জন্য সেটি যথেষ্ট হলেও, একটি কুকুর তার মধ্য থেকে কেবলমাত্র তার নিজের অংশটি নিয়েই ক্ষান্ত হবে না বরং সেই সম্পূর্ণ লাশটিকে নিজের একার জন্য আগলে রাখার চেষ্টা করবে এবং অন্য কাউকে তার ধারে কাছেও ঘেঁষতে দেবে না। এ পেটের লালসার পর যদি দ্বিতীয় কোন বস্তু তার ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে তাহলে সেটি হচ্ছে যৌন লালসা। সারা শরীরের মধ্যে কেবলমাত্র লজ্জাস্থানটিই তার কাছে আকর্ষনীয় এবং সেটিরই সে ঘ্রাণ নিতে ও তাকেই চাটতে থাকে। কাজেই এখানে এ উপমা দেবার উদ্দেশ্য হচ্ছে একথাটি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা যে, দুনিয়াপূজারী ব্যক্তি যখন জ্ঞান ও ঈমানের বাঁধন ছিড়ে ফেলে প্রবৃত্তির অন্ধ লালসার কাছে আত্মসমর্পণ করে এগিয়ে চলতে থাকে, তার অবস্থা পেট ও যৌনাংগ সর্বস্ব কুকুরের মত হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।

.
.
অনুবাদ: