আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১
আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২
আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২
আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩
আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭
আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১
আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০
আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭
আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০
আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২
আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫
হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২
ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২
আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮
বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪
আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫
আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮
আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০
আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫
আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫
আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০
আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭
ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১
আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬
ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭
আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০
আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯
আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২
আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০
আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬
(১) ইসলামের আহবায়কের জন্য যে গুণগুলো সবচেয়ে বেশী প্রয়োজনীয় সেগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে, তাকে কোমল স্বভাবের, সহিষ্ণু ও উদার হৃদয় হতে হবে। তাকে হতে হবে নিজের সঙ্গী-সহযোগীদের জন্য স্নেহশীল, সাধারণ মানুষের জন্য দয়াদ্র হৃদয় এবং নিজের বিরোধীদের জন্য সহিষ্ণু। নিজের সাথীদের দুর্বলতাগুলোও তাকে সহ্য করে নিতে হবে এবং নিজের বিরোধীদের কঠোর ব্যবহারকেও। চরম উত্তেজনাকর অবস্থার মধ্যেও তার নিজের আচরণে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। অত্যন্ত বিরক্তিকর ও অপছন্দনীয় কথাগুলোও উদার মনে এড়িয়ে যেতে হবে। বিরোধীদের পক্ষ থেকে যতই কড়া ভাষায় কথা বলা হোক, যতই দোষারোপ করা ও মনে ব্যাথা দেয়া হোক এবং যতই বর্বরোচিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা হোক না কেন, তাকে অবশ্যি এসবকিছুকে উপেক্ষার দৃষ্টিতে দেখতে হবে। কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা, কর্কশ আচরণ করা, তিক্ত ও কড়া কথা বলা এবং প্রতিশোধমূলক মানসিক উত্তেজনায় ভোগা এ কাজের জন্য বিষতুল্য। এতে গোটা কাজ পণ্ড হয়ে যায়। এ জিনিসটিকে নবী (সা.) এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ “আমার রব আমাকে হুকুম দিয়েছেন, আমি যেন ক্রোধ ও সন্তুষ্টি উভয় অবস্থায়ই ইনসাফের কথা বলি, যে আমার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে তার সাথে সম্পর্ক জুড়ি, যে আমাকে আমার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাকে তার অধিকার দান করি, যে আমার প্রতি জুলুম করে আমি তাকে মাফ করে দেই।” ইসলামের কাজে তিনি নিজের পক্ষ থেকে যাদেরকে পাঠাতেন, তাদেরকেও এ একই বিষয়গুলো মেনে চলার নির্দেশ দিতেন। তিনি বলেনঃ
بَشِّرُوا وَلاَ تُنَفِّرُوا وَيَسِّرُوا وَلاَ تُعَسِّرُوا
"যেখানে তোমরা যাবে সেখানে তোমাদের পদার্পণ যেন লোকদের জন্য সুসংবাদ হিসেবে দেখা দেয়, তা যেন লোকদের মধ্যে ঘৃণার সঞ্চার না করে। লোকদের জীবন যেন তোমাদের কারণে সহজ হয়ে যায়, কঠিন ও সংকীর্ণ হয়ে না পড়ে।”
আল্লাহ নিজে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ গুণেরই প্রশংসা করেছেনঃ
فَبِمَا رَحمَةٍ مِنَ الله لِنتَ لَهُم وَلَو كٌنتَ فَظًا غَلِيظَ القَلُبِ لاَنفَضُّوا من حَولِكَ-
"আল্লাহর রহমতে তুমি তাদের জন্য কোমল প্রমাণিত হয়েছো, নয়তো যদি তোমার ব্যবহার কর্কশ হতো এবং তোমার মন হতো সংকীর্ণ ও অনুদার, তাহলে এসব লোক তোমার চারদিক থেকে সরে যেতো।"-(আল ইমরানঃ ১৫৯)
(২) সত্যের দাওয়াতের সাফল্যের মূলমন্ত্র হচ্ছে, দাওয়াতদানকারীরা দার্শনিক তত্ব ও সূক্ষাতিসূক্ষ্ম তত্বালোচনার পরিবর্তে লোকদেরকে এমনসব সহজ-সরল সৎকাজের নির্দেশ দেবেন যা সবার কাছে সৎকাজ হিসেবে পরিচিত অথবা যাদের সৎকাজ হবার ব্যাপারটি বুঝার জন্য প্রত্যেক মানুষের সাধারণ জ্ঞানই (Common sence) যথেষ্ট হয়। এভাবে সত্যের আহবায়কের আবেদন সাধারণ-অসাধারণ নির্বিশেষে সবাইকে প্রভাবিত করে এবং প্রত্যেকটি শ্রোতার কান থেকে হৃদয় অভ্যন্তরে প্রবেশের পথ সে নিজেই তৈরী করে নেয়। এ ধরনের পরিচিত সৎকর্মের দাওয়াতের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদের ঝড় তোলে, তারা নিজেরাই নিজেদের ব্যর্থতা ও এ দাওয়াতের সাফল্যের পথ প্রসস্ত করে। কারণ সাধারণ মানুষ যতই বিদ্বেষ ভাবাপন্ন হোক না কেন যখন তারা দেখে যে, একদিকে সৎ, ভ্দ্র ও উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী এক ব্যক্তি সরল-সহজভাবে, সোজাসুজি সৎকাজের দাওয়াত দিচ্ছে এবং অন্যদিকে এক দল লোক তার বিরোধিতায় নেমে এমন পদ্ধতি অবলম্বন করছে যা নৈতিকতা ও মানবতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী, তখন স্বাভাবিকভাবেই ধীরে ধীরে সত্য বিরোধীদের প্রতি তাদের মন বিরূপ হয়ে উঠতে থাকে এবং সত্যের আহবায়কের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যেতে থাকে। এমনকি শেষ পর্যন্ত মোকাবিলার ময়দানে কেবলমাত্র এমন সব লোক থেকে যায়, বাতিল ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার মধ্যে যাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ নিহিত অথবা পূর্ববর্তীদের অন্ধ অনুকরণের প্রেরণা ও জাহেলী বিদ্বেষ যাদের মনে যে কোন ধরনের আলো গ্রহণ করার ক্ষমতা বিনষ্ট করে দিয়েছে। এ কর্মকৌশলের বদৌলতেই নবী (সা.) আরবে সাফল্য অর্জন করেন এবং তারপর মাত্র কিছু দিনের মধ্যে নিকটবর্তি দেশগুলোয় ইসলাম এমনভাবে বিস্তার লাভ করে যে, সেখানে কোথাও মুসলমানদের সংখ্যা দাঁড়ায় শতকরা একশ ভাগ, কোথাও নব্বই ভাগ এবং কোথাও আশি ভাগ।
(৩) সত্যের এ দাওয়াতের ক্ষেত্রে যেখানে একদিকে ন্যায় ও কল্যাণ অনুসন্ধানীদেরকে সৎকাজের দিকে উদ্বুদ্ধ করা জরুরী, সেখানে মূর্খদের সাথে কোন প্রকার সংঘর্ষ ও বিরোধে জড়িয়ে না পড়াও অপরিহার্য, চাই তারা সংঘর্ষ ও বিরোধ সৃষ্টি করার জন্য যত চেষ্টাই করুক। যারা ন্যায়সঙ্গতভাবে বুদ্ধি বিবেচনার সাথে বক্তব্য অনুধাবন করতে চায়, আহবায়কের উচিত একমাত্র তাদেরই সম্বোধন করা। এ ব্যাপারে তাঁকে অতি সাবধানী হতে হবে। অন্যদিকে যখন কোন ব্যক্তি নিরেট মূর্খের মত ব্যবহার শুরু করে দেয়, তর্ক-বিতর্ক, গোঁয়ার্তুমি, ঝগড়-ঝাটি ও গালিগালাজের পর্যায়ে নেমে আসে, তখন আহবায়কের তার প্রতিদ্বন্দ্বীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে অস্বীকার করা উচিত। কারণ এ ধরনের বিতর্ক ও ঝগড়া-ঝাঁটিতে লিপ্ত হয়ে কোন লাভ নেই। বরঞ্চ এতে সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ আহবায়কের যে শক্তি ইসলামী দাওয়াত সম্প্রসারণ ও ব্যক্তি চরিত্র সংশোধনের কাজে ব্যয়িত হওয়া উচিত, তা অযথা এ বাজে কাজে ব্যয় হয়ে যায়।
(৪) তিন নম্বরে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেই প্রসঙ্গে আরো নির্দেশ হচ্ছে এই যে, সত্যের আহবায়ক যখনই বিরোধীদের জুলুম, নির্যাতন ও অনিষ্টকর কার্যকলাপ এবং তাদের মূর্খতা প্রসূত অভিযোগ-আপত্তির কারণে মানসিক উত্তেজনা অনুভব করবে তখনই তার বুঝে নেয়া উচিত যে, এটি শয়তানের উস্কানি ছাড়া আর কিছুই নয়। তখনই তার আল্লাহর কাছে এ মর্মে আশ্রয় চাওয়া উচিত যে, আল্লাহ যেন তাঁর বান্দাকে এ উত্তেজনার স্রোতে ভাসিয়ে না দেন এবং তাকে এমন অসংযমী ও নিয়ন্ত্রনবিহীন না করেন যার ফলে সে সত্যের দাওয়াতকে ক্ষতিগ্রস্ত করার মত কোন কাজ করে বসে। সত্যের দাওয়াতের কাজ ঠাণ্ডা মাথায়ই করা যেতে পারে। আবেগ-উত্তেজনার বশবর্তী না হয়ে পরিবেশ পরিস্থিতি এবং সময়-সুযোগ দেখে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে যে পদক্ষেপটি নেয়া হয় একমাত্র সেটিই সঠিক হতে পারে। কিন্তু শয়তান যেহেতু এ কাজটির উন্নতি কখনো দু'চোখে দেখতে পারে না, তাই সে হামেশা নিজের সঙ্গী-সাথীদের সাহায্যে সত্যের আহবায়কের ওপর নানান ধরনের আক্রমণ পরিচালনার চেষ্টা চালায়। আবার প্রত্যেকটি আক্রমণের পর সে আহবায়ককে এই বলে ক্ষেপাতে থাকে যে, এ আক্রমণের জবাব তো অবশ্যই দেয়া দরকার। আহবায়কের মনের দুয়ারে শয়তানের এ আবেদন অধিকাংশ সময় অতিশয় প্রতারণাপূর্ণ ব্যাখ্যা ও ধর্মীয় সংস্কারের মোড়কে আবৃত হয়ে আসে। কিন্তু এর গভীরে সংকীর্ণ স্বার্থপ্রীতি ছাড়া আর কিছুই থাকে না। তাই শেষ দু'আয়াতে বলা হয়েছেঃ যারা মুক্তাকী (অর্থাৎ আল্লাহকে ভয় করে কাজ করে এবং অসৎকাজ থেকে দূরে থাকতে চায়) তারা নিজেদের মনে কোন শয়তানী প্ররোচানার প্রভাব এবং কোন অসৎ চিন্তার ছোয়া অনুভব করতেই সাথে সাথেই সজাগ হয়ে ওঠে। তারপর এ পর্যায়ে কোন ধরনের কর্মপদ্ধতি অবলম্বনে দ্বীনের স্বার্থ রক্ষিত হবে এবং সত্য প্রীতির প্রকৃত দাবী কি তা তারা পরিষ্কার দেখতে পায়। আর যাদের কাজের সাথে স্বার্থপ্রীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এবং এ জন্য শয়তানের সাথে যাদের ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তারা অবশ্যি শয়তানী প্ররোচনার মোকাবিলায় টিকে থাকতে পারে না এবং তার কাছে পরাজিত হয়ে ভুল পথে পা বাড়ায়। তারপর শয়তান তাদেরকে নাকে রশি লাগিয়ে যেখানে ইচ্ছা ঘোরাতে থাকে এবং কোথাও গিয়ে স্থির হতে দেয় না। বিরোধীদের প্রত্যেকটি গালির জবাবে তাদের কাছে গালির স্তূপ এবং তাদের প্রত্যেকটি অপকৌশলের জবাবে তার চাইতেও বড় অপকৌশল তাদের কাছে তৈরী থাকে।
এ বক্তব্যের একটি সাধারণ প্রয়োগ ক্ষেত্রও রয়েছে। মুত্তাকী লোকেরা নিজেদের জীবনে সাধারণত অমুত্তাকী লোকদের থেকে ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে। যারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহকে ভয় করে এবং সর্বান্তকরণে অসৎকাজ থেকে দূরে থাকতে চায়, তাদের মনে কখনো যদি অসৎ চিন্তার সামান্যতম স্পর্শও লাগে, তাহলে তাদের মনকে তা ঠিক তেমনিভাবে আহত করে যেমন আঙুলে কাঁটা বিঁধে গেলে বা চোখে বালির কণা পড়লে মানুষ যন্ত্রনা বোধ করে। যেহেতু তারা অসৎ চিন্তা, অসৎ কামনা-বাসনা ও অসৎ সংকল্প করতে অভ্যস্ত নয় তাই জিনিসগুলো তাদের জন্য আঙুলে কাঁটা ফুটে যাওয়া, চোখে বালি পড়া অথবা স্পর্শকাতর ও পরিচ্ছন্নতা প্রিয় ব্যক্তির কাপড় কালির দাগ লেগে যাওয়া বা ময়লার ছিঁটে পড়ার মত অস্বস্তিকর বোধ হয়। তারপর তাদের মনে এভাবে অস্বস্তির কাঁটা বিঁধে যাবার পর তাদের চোখ খুলে যায় এবং তাদের বিবেক জেগে উঠে, অসৎ প্রবণতার এ ধূলোমাটি ঝেড়ে ফেলার কাজে ব্যাপৃত হয়। অন্যদিকে যারা আল্লাহকে ভয় করে না, অসৎকাজ থেকে বাঁচতেও চায় না এবং শয়তানের সাথে নিবিড় সম্পর্কও কায়েম করে রেখেছে, তাদের মনে অসৎ চিন্তা, অসৎ সংকল্প ও অসৎ উদ্দেশ্য পরিপক্কতা লাভ করতে থাকে এবং তারা এসব পচা দুর্গন্ধময় আবর্জনায় কোন প্রকার অস্বস্তি অনুভব করে না। তাদের অবস্থা হয় ঠিক তেমনি যেমন কোন ডেকচিতে শুয়োরের মাংস রান্না করা হচ্ছে কিন্তু ডেকচি এর কোন খবরই রাখে না যে, তার মধ্যে কি রান্না হচ্ছে। অথবা কোন ধাঙড়ের সারা দেহ ও কাপড় চোপড় ময়লায় ভরে গেছে এবং তা থেকে ভীষণ দুর্গন্ধও বেরুচ্ছে কিন্তু তার মধ্যে কোন অনুভূতিই নেই যে, সে কিসের মধ্যে আছে।
এ আয়াতের মূল উদ্দেশ্য তো আমি ওপরে বর্ণনা করেছি। কিন্তু পরোক্ষভাবে এ থেকে এ বিধানটিও পাওয়া যায় যে, যখন আল্লাহর কালাম পাঠ করা হয়, তখন লোকদের আদব সহকারে নীরব থাকা এবং মনোযোগ সহকারে তা শোনা উচিত। এ থেকে এ কথাটিও প্রমাণিত হয় যে, নামাযের মধ্যে ইমাম যখন কুরআন তেলাওয়াত করতে থাকেন তখন মুকতাদীদের নীরবে তা শোনা উচিত। কিন্তু এ বিষয়ে ইমামদের মধ্যে বিভিন্ন মতের সৃষ্টি হয়েছে। ইমাম আবু হানিফা (রা.) এবং তার সাথীদের মতে, ইমামদের ক্বেরাত উচ্চস্বরে হোক বা অনুচ্চ স্বরে হোক সব অবস্থায় মুকতাদীদের নীরব থাকতে হবে। ইমাম মালিক (র) ও ইমাম আহমদের (র) মতে, কেবলমাত্র ইমাম যখন উচ্চ স্বরে ক্বেরাত পড়বেন তখনই মুকতাদীদের নীরব থাকতে হবে। কিন্তু ইমাম শাফেঈ (র) বলেন, ইমামের উচ্চ ও অনুচ্চ স্বরে ক্বেরাত পড়ার উভয় অবস্থায়ই মুকতাদীদের ক্বেরাত পড়তে হবে। কারণ কোন কোন হাদীসের ভিত্তিতে তিনি মনে করেন, যে ব্যক্তি নামাযে সূরা ফাতেহা পড়ে না তার নামায হয় না।
কুরআন মজীদে চৌদ্দটি স্থানে সিজদার আয়াত এসেছে। এ আয়াতগুলো পড়লে বা শুনলে সিজদা করতে হবে, এটি ইসলামী শরীয়াতের একটি বিধিবদ্ধ বিষয়, এ ব্যাপারে সবাই একমত। তবে এ সিজদা ওয়াজিব হবার ব্যাপারে বিভিন্ন মত রয়েছে। ইমাম আবু হানীফা (র) তেলাওয়াতে সিজদাকে ওয়াজিব বলেন। অন্যান্য উলামা বলেন, এটি সুন্নত। নবী ﷺ অনেক সময় একটি বড় সমাবেশ কুরআনে পড়তেন এবং সেখানে সিজদার আয়াত এলে তিনি নিজে তৎক্ষণাৎ সিজদা করতেন এবং সাহাবীগণ এর যিনি যেখানে থাকতেন তিনি সেখানেই সিজদাবনত হতেন। এমনকি কেউ কেউ সিজদা করার জায়গা না পেয়ে নিজের সামনের ব্যক্তির পিঠের ওপর সিজদা করতেন। হাদীসে একথাও এসেছে, মক্কা বিজয়ের সময় তিনি কুরআন পড়েন। সেখানে সিজদার আয়াত এলে যারা মাটির ওপর দাঁড়িয়েছিলেন তারা মাটিতে সিজদা করেন এবং যারা ঘোড়ার ও উটের পিঠে সওয়ার ছিলেন তারা নিজেদের বাহনের পিঠেই ঝুঁকে পড়েন। কখনো নবী (সা.) খুতবার মধ্যে সিজদার আয়াত পড়তেন, তখন মিম্বার থেকে নেমে সিজদা করতেন তারপর আবার মিম্বারের ওপর উঠে খুতবা দিতেন।
অধিকাংশ আলেমের মতে নামাযের জন্য যেসব শর্ত নির্ধারিত, এ তেলাওয়াতের সিজদার জন্যও তাই নির্ধারিত। অর্থাৎ অযুসহকারে কিবলার দিকে মুখ করে নামাযের সিজদার মত করে মাটিতে মাথা ঠেকাতে হবে। কিন্তু তেলাওয়াতের সিজদার অধ্যায়ে আমরা যতগুলো হাদীস পেয়েছি সেখানে কোথাও এ শর্তগুলোর স্বপক্ষে কোন প্রমাণ নেই। সেখান থেকে তো একথাই জানা যায় যে, সিজদার আয়াত শুনে যে ব্যক্তি যেখানে যে অবস্থায় থাকে, সে অবস্থায়ই যেন সিজদা করে-তার অযু থাক বা না থাক, কিবলামুখী হওয়া তার পক্ষে সম্ভব হোক বা না হোক, মাটিতে মাথা রাখার সুযোগ পাক বা না পাক তাতে কিছু আসে যায় না। প্রথম যুগের আলেমদের মধ্যেও আমরা এমন অনেক লোক দেখি যারা এভাবেই তেলাওয়াতের সিজদা করেছেন। ইমাম বুখারী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) সম্পর্কে লিখেছেন, তিনি অযু ছাড়াই তেলাওয়াতের সিজদা করতেন। ফাতহুল বারীতে আবু আবদুর রহমান সুলামী সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি পথ চলতে কুরআন মজীদ পড়তেন এবং কোথাও সিজদার আয়াত এলেই মাথা ঝুঁকিয়ে নিতেন। অযু সহকারে থাকুন বা না থাকুন এবং কিবলার দিকে মুখ ফিরানো থাক বা না থাক, তার পরোয়া করতেন না। এসব কারণে আমি মনে করি, যদিও অধিকাংশ আলেমের মতটিই অধিকতর সতর্কতামূলক তবুও কোন ব্যক্তি যদি অধিকাংশ আলেমের মতের বিপরীত আমল করে, তাহলে তাকে তিরস্কার করা যেতে পারে না। কারণ অধিকাংশ আলেমের মতের স্বপক্ষে কোন প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত সুন্নাত নেই। আবার প্রথম দিকের আলেমদের মধ্যে এমনসব লোকও পাওয়া গেছে, যাদের রীতি ছিল পরবর্তীকালের অধিকাংশ আলেমদের থেকে ভিন্নতর।
মহান আল্লাহ সূরা আনফাল নাযিল করার জন্য এ মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশ বেছে নিয়েছেন। এ বিষয় দিয়ে যুদ্ধ সংক্রান্ত নিজের পর্যালোচনামূলক বক্তব্যের সূচনা করেছেন। প্রথম বাক্যটির মধ্যেই প্রশ্নের জবাব নিহিত ছিল। বলেছেনঃ “তোমার কাছে গনীমতের মাল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে?” মূল বক্তব্যে গনীমতের মালকে ‘আনফাল’ বলা হয়েছে। এ ‘আনফাল’ শব্দের মধ্যে মূল সমস্যার সমাধান নিহিত রয়ে গেছে। আনফাল বহুবচন। এর একবচন হচ্ছে “নাফল”। আরবী ভাষায় ওয়াজিব অথবা যথার্থ অধিকার ও মূল পাওনার অতিরিক্তকে নফল বলা হয়। এ ধরনের নফল যদি কোন অধীনের পক্ষ থেকে হয় তাহলে তার অর্থ হয়, গোলাম নিজের প্রভুর জন্য স্বেচ্ছাকৃতভাবে অবশ্য পালনীয় কর্তব্যের চাইতে বাড়তি কিছু কাজ করেছে। আর যখন তা মালিক বা কর্তার পক্ষ থেকে হয় তখন তার অর্থ হয়, এমন ধরনের দান বা পুরস্কার যা প্রভুর পক্ষ থেকে বান্দা বা গোলামকে তার যথার্থ পাওনা ও অধিকারের অতিরিক্ত বা বখশিস হিসেবে দেয়া হয়েছে। কাজেই এখানে এ বক্তব্যের অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর দেয়া পুরস্কার ও অনুগ্রহ সম্পর্কেই কি এ সমস্ত বাদানুবাদ, জিজ্ঞাসাবাদ ও কলহ-বিতর্ক চলেছে? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে তোমরা কবেই বা তার মালিক ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলে যে, তোমরা নিজেরাই তা বণ্টন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে? যিনি এ সম্পদ দান করেছেন তিনিই সিদ্ধান্ত দেবেন, কাকে দেয়া হবে, কাকে দেয়া হবে না এবং যাকে দেয়া হবে কতটুকু দেয়া হবে?
যুদ্ধ প্রসঙ্গে এটা ছিল একটা অনেক বড় ধরনের নৈতিক সংস্কার। মুসলমানদের যুদ্ধ দুনিয়ার বস্তুগত স্বার্থ ও সম্পদ লাভ করার জন্য নয় বরং সত্যের নীতি অনুযায়ী দুনিয়ার নৈতিক ও তামাদ্দুনিক বিকৃতির সংস্কার সাধন করার জন্যই তা হয়ে থাকে। আর এ যুদ্ধনীতি বাধ্য হয়ে তখনই অবলম্বন করা হয়, যখন প্রতিবন্ধক শক্তিগুলো স্বাভাবিক দাওয়াত ও প্রচার পদ্ধতির মাধ্যমে সংস্কার সাধনের সমস্ত পথ রুদ্ধ করে দেয়। কাজেই সংস্কারদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকতে হবে উদ্দেশ্যের প্রতি। উদ্দেশ্যের জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার হিসেবে যেসব সম্পদ লাভ করা হয়, সেদিকে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকা উচিত নয়। শুরুতেই যদি এসব স্বার্থ থেকে তাদের দৃষ্টি সরিয়ে না দেয়া হয়, তাহলে অতি দ্রুত তাদের মধ্যে নৈতিক অধঃপতন সূচিত হবে এবং তারা এসব স্বার্থলাভকে নিজেদের উদ্দেশ্য হিসেবে গণ্য করবে।
তাছাড়া এটা যুদ্ধ প্রসঙ্গে একটা বড় রকমের প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সংস্কারও ছিল। প্রাচীন যুগের পদ্ধতি ছিল, যুদ্ধে যে মালমাত্তা যার হস্তগত হতো সে-ই তার মালিক গণ্য হতো। অথবা বাদশাহ ও সেনাপতি সমস্ত গনীমতের মালের মালিক হয়ে বসতো। প্রথম অবস্থায় দেখা যেতো, প্রায়ই বিজয়ী সেনাদলের মধ্যে গনীমতের মাল নিয়ে প্রচণ্ড সংঘাত দেখা দিয়েছে। এমনকি অনেক সময় তাদের এ অভ্যন্তরীণ সংঘাত তাদের বিজয়কে পরাজয়ে রূপান্তরিত করে দিতো। দ্বিতীয় অবস্থায় সৈন্যরা চুরি করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়তো। তারা গনীমতের মাল লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করতো। কুরআন গনীমতের মালকে আল্লাহ ও রসূলের সম্পদ গণ্য করে প্রথমে এ নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে যে, সমস্ত গনীমতের মাল কোন রকম কমবেশী না করে পুরোপুরি ইমামের সামনে এনে রেখে দিতে হবে। তার মধ্য থেকে একটি সুঁইও লুকিয়ে রাখা যাবে না। তারপর সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে এ সম্পদ বন্টনের জন্য নিম্নোক্ত আইন প্রণয়ন করেছেঃ এ সম্পদের পাঁচ ভাগের এক ভাগ আল্লাহর কাজ ও তাঁর গরীব বান্দাদের সাহায্যের জন্য বায়তুল মালে জমা দিতে হবে। আর বাকি চার ভাগ যুদ্ধে যে সেনাদল শরীক হয়েছিল তাদের মধ্যে সমানভাগে ভাগ করে দিতে হবে। এভাবে জাহেলী যুগের পদ্ধতিতে যে দু’টি ত্রুটি ছিল তা দূর হয়ে গেছে।
এখানে আরো একটি সূক্ষ্ম তত্ত্বও জেনে রাখতে হবে। গনীমতেরমাল সম্পর্কে এখানে শুধুমাত্র এতটুকু কথা বলেই শেষ করে দেয়া হয়েছে যে, “এটা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের।” এ সম্পদ বন্টনের কোন প্রসঙ্গ এখানে উত্থাপন করা হয়নি। এর কারণ, প্রথমে স্বীকৃতি ও আনুগত্যের ভাবধারার পূর্ণতা লাভই ছিল উদ্দেশ্য। তারপর সামনের দিকে গিয়ে কয়েক রুকূ' পরে এ সম্পদ কিভাবে বণ্টন করতে হবে তা বলে দেয়া হয়েছে। তাই এখানে একে ‘আনফাল’ বলা হয়েছে এবং পঞ্চম রুকু'তে এ সম্পদ বণ্টন করার বিধান বর্ণনা প্রসঙ্গে একে ‘গানায়েম’ (গনীমতের বহুবচন) বলা হয়েছে।