আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১
আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২
আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২
আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩
আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭
আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১
আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০
আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭
আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০
আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২
আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫
হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২
ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২
আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮
বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪
আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫
আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮
আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০
আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫
আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫
আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০
আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭
ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১
আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬
ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭
আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০
আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯
আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২
আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০
আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬
সূরা আল বাকারার আয়াত এবং এ আয়াতটির মধ্যে বাহ্যত কেবলমাত্র এতটুকু বিরোধ দেখা যায়, সেখানে শুধু “রক্ত” বলা হয়েছে আর এখানে বলা হয়েছে “বহমান রক্ত।” অর্থাৎ কোন প্রাণীকে জখম বা জবাই করে যে রক্ত বের করা হয়। কিন্তু এটা আসলে কোন বিরোধ নয় বরং ঐ নির্দেশটির ব্যাখ্যা। অনুরূপভাবে সূরা আল মায়েদাহর আয়াতে এ চারটি জিনিস ছাড়াও আরো কয়েকটি জিনিসের হারাম হওয়ার উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ এমনসব প্রাণীকেও সেখানে হারাম গণ্য করা হয়েছে যারা কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে, আঘাত পেয়ে, ওপর থেকে পড়ে অথবা ধাক্কা খেয়ে মরে গেছে। অথবা কোন হিংস্র প্রাণী যাকে চিরে ফেড়ে ফেলেছে। কিন্তু আসলে এটাও কোন বিরোধ নয়। বরং এটাও একটা ব্যাখ্যা। এ থেকে জানা যায়, এভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাণীরাও ‘মরা’ বলে গণ্য হবে।
মুসলিম ফকীহগণের একটি দলের মতে আহারযোগ্য প্রাণীদের এ চারটি অবস্থায়ই মাত্র হারাম। এছাড়া আর সব ধরনের প্রাণী খাওয়া জায়েয। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) ও হযরত আয়েশা (রা.)ও এমত পোষণ করতেন। কিন্তু একাধিক হাদীস থেকে জানা যায়, নবী ﷺ কোন কোন জিনিস খেতে মানা করেছেন অথবা সেগুলোর প্রতি নিজের ঘৃণা ও অপছন্দের ভাব প্রকাশ করেছেন। যেমন গৃহপালিত গাধা, নখরযুক্ত হিংস্র পশু ও পাঞ্জাধারী পাখি। এ কারণে অধিকাংশ ফকীহ হারামকে এ চারটির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তাঁরা এর সীমারেখা আরো বিস্তৃত করেছেন। কিন্তু এরপরও আবার বিভিন্ন জিনিসের হারাম ও হালাল হওয়ার ব্যাপারে ফকীহদের মধ্যে মতবিরোধ হয়েছে যেমন গৃহপালিত গাধা ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক ও ইমাম শাফেঈ হারাম গণ্য করেন। কিন্তু অন্যান্য কয়েকজন ফকীহ বলেন, গৃহপালিত গাধা হারাম নয় বরং কোন বিশেষ কারণে নবী ﷺ এক সময় এর প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। হানাফীদের মতে হিংস্র পশু, শিকারী পাখি ও মৃত ভক্ষণকারী প্রাণী একবারেই হারাম। কিন্তু ইমাম মালেক ও ইমাম আওযাঈর মতে শিকারী পাখি হালাল। ইমাম লাইসের মতে বিড়াল হালাল। ইমাম শাফেঈর মতে একমাত্র মানুষের ওপর আক্রমণকারী হিংস্র পশু যেমন বাঘ, সিংহ, নেকড়ে ইত্যাদি হারাম। ইকরামার মতে কাক ও চিল উভয়ই হালাল। অনুরূপভাবে হানাফীরা সব রকমের পোকামাকড় হারাম গণ্য করে। কিন্তু ইবনে আবী, লাইলা, ইমাম মালেক ও আওযাঈর মতে সাপ হালাল।
এসব বিভিন্ন বক্তব্য ও এর পক্ষের বিপক্ষের যুক্তি প্রমাণাদি বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কারভাবে একথা জানা যায় যে, আসলে কুরআনে যে চারটি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়াতে সে চারটিই চূড়ান্ত ও অকাট্যভাবে হারাম। এ চারটি জিনিস যেখানে নেই সেখানে বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের মাকরূহ বা অপছন্দের ভাব রয়েছে। যেগুলোর মাকরূহ হবার বিষয়টি সহী হাদীসের মাধ্যমে নবী ﷺ থেকে প্রমাণিত সেগুলো হারাম হবার বেশী নিকটবর্তী। আর যেগুলোর ব্যাপারে ফকীহদের মধ্যে মতবিরোধ হয়েছে তাদের হারাম হবার ব্যাপারটি সন্দেহযুক্ত। তবে রুচিগতভাবে কোন কোন শ্রেণীর মানুষ কোন কোন জিনিস পছন্দ করে না অথবা শ্রেণীগতভাবে কোন কোন শ্রেণীর মানুষ কোন কোন জিনিস অপছন্দ করে বা জাতিগতভাবে কোন কোন জাতি কোন কোন জিনিসকে ঘৃণা করে, এসব ক্ষেত্রে আল্লাহর শরীয়াত কাউকে বাধ্য করে না যে, যে জিনিসটি হারাম করা হয়নি প্রয়োজন না হলেও অযথা তা তাকে খেতেই হবে। অনুরূপভাবে কোন ব্যক্তি নিজের অপছন্দকে আইনে পরিণত করবে এবং সে নিজে যা পছন্দ করে না অন্যেরা তা ব্যবহার করছে বলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনবে, এ ধরনের কোন অধিকারও শরীয়াত কাউকে দেয়নি।
একঃ তাওরাত নাযিল হবার শত শত বছর আগে ইয়াকুব (ইসরাইল) আলাইহিস সালাম কোন কোন জিনিসের ব্যবহার ত্যাগ করেছিলেন। তাঁর পরে তাঁর সন্তানরাও সেগুলো ত্যাগ করেছিল। এমনকি ইহুদী ফকীহগণ এগুলোকে রীতিমত হারাম মনে করতে থাকে এবং এগুলোর হারাম হওয়ার বিষয়টি তাওরাতে লিখে নেয়। উট, খরগোশ ও শাফনও এ হারামের তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্তমান বাইবেলে আমরা তাওরাতের যে অংশটুকু পাই তাতে এ তিনটিরই হারাম হবার বিষয়টি উল্লেখিত হয়েছে। (লেবীয় পুস্তক ১১: ৪-৬ এবং দ্বিতীয় বিবরণ ১৪: ৭) কিন্তু কুরআন মজীদে ইহুদীদের এ বলে চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়েছিলঃ আনো তাওরাত এবং দেখাও কোথায় এ জিনিসগুলো হারাম বলে লেখা হয়েছে, তা থেকে জানা যায় যে, তাওরাতে এ বিধানগুলো বৃদ্ধি করা হয়েছে এ ঘটনার পর। কারণ তখন যদি তাওরাতে এ বিধানগুলো থাকতো, তাহলে বনী ইসরাঈল সঙ্গে সঙ্গেই তাওরাত এনে তা দেখিয়ে দিতো।
দুইঃ দ্বিতীয় পার্থক্যটি সৃষ্টি হবার কারণ হচ্ছে এই যে, ইহুদীরা যখন আল্লাহর নাযিলকৃত শরীয়াতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলো এবং নিজেদের আইন নিজেরাই প্রণয়ন করতে শুরু করলো তখন নিজেদের চুলচেরা আইনগত বিশ্লেষণ ও বাড়াবাড়ির মাধ্যমে তারা অনেক পাক-পবিত্র জিনিসকে নিজেরাই হারাম করে নিয়েছিল এবং এর শাস্তি হিসেবে আল্লাহ তাদেরকে এ বিভ্রান্তির মধ্যে অবস্থান করতে দিয়েছিলেন। সেগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে নখরধারী প্রাণী। অর্থাৎ উটপাখি, বক, হাঁস ইত্যাদি। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, গরু ও ছাগলের চর্বি। এ দু’ ধরনের হারামকে বাইবেলে তাওরাতের বিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। (লেবীয় পুস্তক ১১: ১৬-১৮, দ্বিতীয় বিবরণ ১৪: ১৪-১৫-১৬, লেবীয় পুস্তক ৩: ১৭ এবং ৭: ২২-২৩) কিন্তু সূরা নিসা থেকে জানা যায়, এ জিনিসগুলো তাওরাতে হারাম ছিল না। বরং হযরত ইসা আলাইহিস সালামের পর এগুলো হারাম হয়েছে। ইতিহাসও সাক্ষ্য দেয় বর্তমান ইহুদী শরীয়াত লিপিবদ্ধ করার কাজ দ্বিতীয় খৃস্টাব্দের শেষের দিকে রাব্বি ইয়াহুদার হাতে সম্পন্ন হয়।
এখন বাকি থাকে এ প্রশ্নটি, তাহলে মহান আল্লাহ এ জিনিসগুলো সম্পর্কে এখানে এবং সূরা নিসায় (আমি হারাম করেছি) শব্দ ব্যবহার করলেন কেন? এর জওয়াব হচ্ছে, আল্লাহ কেবলমাত্র নবী ও কিতাবের মাধ্যমে কোন জিনিস হারাম করেন না। বরং তিনি কখনো তাঁর বিদ্রোহী বান্দাদের ওপর বানোয়াট বিধান রচয়িতা ও আইন প্রণেতাদের চাপিয়ে দেন এবং তারা পাক-পবিত্র জিনিসগুলো তাদের জন্য হারাম করে দেয়। প্রথম ধরনের হারামটি আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত হিসেবে প্রবর্তিত হয় এবং দ্বিতীয় ধরনের হারামটি প্রবর্তিত হয় তাঁর পক্ষ থেকে শাস্তি ও লানত হিসেবে।
এখানে প্রথম কথা বলা হয়েছে, নিজেদের অন্যায় কাজ ও গোমরাহীর জন্য আল্লাহর ইচ্ছাকে ওযর হিসেবে পেশ করা এবং এর বাহানা বানিয়ে সঠিক হেদায়াত ও পথনির্দেশ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানো অপরাধীদের প্রাচীন রীতি হিসেবে চলে আসছে। এর পরিণামে দেখা গেছে অবশেষে তারা ধ্বংস হয়ে গেছে এবং সত্যের বিরুদ্ধে চলার অশুভ পরিণাম তারা স্বচক্ষে দেখে নিয়েছে। তারপর বলা হয়েছে, তোমরা যে ওযরটি পেশ করছো তার পেছনে প্রকৃত জ্ঞানগত ও তথ্যগত কোন ভিত্তি নেই। বরং আন্দাজ-অনুমানের ভিত্তিতে তোমরা এটি পেশ করছো। তোমরা নিছক কোথাও আল্লাহর ইচ্ছার কথা শুনতে পেয়েছো তারপর তার ওপর অনুমানের একটি বিরাট ইমারত দাঁড় করিয়ে দিয়েছো। মানুষের ব্যাপারে আল্লাহর ইচ্ছা কি, একথা বুঝার চেষ্টাই তোমরা করোনি। তোমরা আল্লাহর ইচ্ছা বলতে মনে করছো, চোর যদি আল্লাহর ইচ্ছার অধীনে চুরি করে তাহলে সে অপরাধী নয়। কারণ সে তো আল্লাহর ইচ্ছার আওতাধীনে চুরি করেছে। অথচ মানুষের ব্যাপারে আল্লাহর ইচ্ছা হচ্ছে এই যে, সে কৃতজ্ঞতা ও কুফরী, হেদায়াত ও গোমরাহী এবং আনুগত্য ও অবাধ্যতার মধ্য থেকে যে পথটিই নিজের জন্য নির্বাচিত করবে, আল্লাহ তার জন্য সে পথটিই উন্মুক্ত করে দেবেন। তারপর মানুষ ন্যায়-অন্যায় ও ভুল-নির্ভুল যে কাজটিই করতে চাইবে, আল্লাহর নিজের বিশ্বব্যাপী কার্যক্রমের দৃষ্টিতে যতটুকু সঙ্গত মনে করবেন তাকে সে কাজটি করার অনুমতি ও সুযোগ দান করবেন। কাজেই তোমরা ও তোমাদের বাপ-দাদারা আল্লাহর ইচ্ছার আওতাধীনে যদি শিরক ও পবিত্র জিনিসগুলোকে হারাম গণ্য করার সুযোগ লাভ করে থাকো তাহলে এর অর্থ কখনোই এ নয় যে, তোমরা নিজেদের এসব কাজের জন্য দায়ী নও এবং এর জন্য তোমাদের জওয়াবদিহি করতে হবে না। তোমরা নিজেরাই নিজেদের ভুল পথ নির্বাচন, ভুল সংকল্প গ্রহণ ও ভুল প্রচেষ্টার জন্য দায়ী।
সবশেষে একটি বাক্যের মধ্যে আসল কথাটি বলে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ বলা হয়েছেঃ
فَلِلَّهِ الْحُجَّةُ الْبَالِغَةُ فَلَوْ شَاءَ لَهَدَاكُمْ أَجْمَعِينَ
নিজেদের ওযর পেশ করতে গিয়ে তোমরা এ মর্মে যে যুক্তিটির অবতারণা করেছো যে, “আল্লাহ চাইলে আমরা শির্ক করতাম না।” এর মাধ্যমে সম্পূর্ণ কথাটি ব্যক্ত হয়নি। সম্পূর্ণ কথাটি বলতে হলে এভাবে বলোঃ “আল্লাহ চাইলে তোমাদের সবাইকে হেদায়াত দান করতেন।” অন্য কথায় তোমরা নিজেরা নিজেদের নির্বাচনের মাধ্যমে সঠিক পথ গ্রহণ করতে প্রস্তুত নও। বরং তোমরা চাও, আল্লাহ যেভাবে ফেরেশতাদেরকে জন্মগতভাবে সত্যানুসারী বানিয়েছেন সেভাবে তোমাদেরকেও বানাতেন। মানুষের ব্যাপারে আল্লাহ এ ইচ্ছা করলে অবশ্যি করতে পারতেন। কিন্তু এটি তাঁর ইচ্ছা নয়। কাজেই নিজেদের জন্য তোমরা নিজেরাই যে গোমরাহীটি পছন্দ করে নিয়েছো আল্লাহ তার মধ্যেই তোমাদের ফেলে রাখবেন।