পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

১১০ আয়াত

৪২ ) এরা মিথ্যা শ্রবণকারী ও হারাম আহারকারী। ৬৯ কাজেই এরা যদি তোমাদের কাছে (নিজেদের মামলা নিয়ে) আসে তাহলে তোমরা চাইলে তাদের মীমাংসা করে দিতে অথবা অস্বীকার করে দিতে পারো। অস্বীকার করে দিলে এরা তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আর মীমাংসা করে দিলে যথার্থ ইনসাফ সহকারে মীমাংসা করো। কারণ আল্লাহ‌ ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন।
سَمَّـٰعُونَ لِلْكَذِبِ أَكَّـٰلُونَ لِلسُّحْتِ ۚ فَإِن جَآءُوكَ فَٱحْكُم بَيْنَهُمْ أَوْ أَعْرِضْ عَنْهُمْ ۖ وَإِن تُعْرِضْ عَنْهُمْ فَلَن يَضُرُّوكَ شَيْـًۭٔا ۖ وَإِنْ حَكَمْتَ فَٱحْكُم بَيْنَهُم بِٱلْقِسْطِ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلْمُقْسِطِينَ ٤٢
৪৩ ) আর এরা ৭০ তোমাকে কিভাবে বিচারক মানছে যখন এদের কাছে তাওরাত রয়ে গেছে, যাতে আল্লাহর হুকুম লিখিত আছে আর তারপরও এরা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে? ৭১ আসলে এরা ঈমানই রাখে না।
وَكَيْفَ يُحَكِّمُونَكَ وَعِندَهُمُ ٱلتَّوْرَىٰةُ فِيهَا حُكْمُ ٱللَّهِ ثُمَّ يَتَوَلَّوْنَ مِنۢ بَعْدِ ذَٰلِكَ ۚ وَمَآ أُو۟لَـٰٓئِكَ بِٱلْمُؤْمِنِينَ ٤٣
৪৪ ) আমি তাওরাত নাযিল করেছি। তাতে ছিল পথ নির্দেশ ও আলো। সমস্ত নবী, যারা মুসলিম ছিল, সে অনুযায়ী এ ইহুদী হয়ে যাওয়া লোকদের ৭২ যাবতীয় বিষয়ের ফায়সালা করতো। আর এভাবে রব্বানী ও আহবারও ৭৩ (এরই ওপর তাদের ফায়সালার ভিত্তি স্থাপন করতো) । কারণ তাদেরকে আল্লাহর কিতাব সংরক্ষণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এবং তারা ছিল এর ওপর সাক্ষী। কাজেই (হে ইহুদী গোষ্ঠী!) তোমরা মানুষকে ভয় করো না বরং আমাকে ভয় করো এবং সামান্য তুচ্ছ মূল্যের বিনিময়ে আমার আয়াত বিক্রি করা পরিহার করো। আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী যারা ফায়সালা করে না তারাই কাফের।
إِنَّآ أَنزَلْنَا ٱلتَّوْرَىٰةَ فِيهَا هُدًۭى وَنُورٌۭ ۚ يَحْكُمُ بِهَا ٱلنَّبِيُّونَ ٱلَّذِينَ أَسْلَمُوا۟ لِلَّذِينَ هَادُوا۟ وَٱلرَّبَّـٰنِيُّونَ وَٱلْأَحْبَارُ بِمَا ٱسْتُحْفِظُوا۟ مِن كِتَـٰبِ ٱللَّهِ وَكَانُوا۟ عَلَيْهِ شُهَدَآءَ ۚ فَلَا تَخْشَوُا۟ ٱلنَّاسَ وَٱخْشَوْنِ وَلَا تَشْتَرُوا۟ بِـَٔايَـٰتِى ثَمَنًۭا قَلِيلًۭا ۚ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْكَـٰفِرُونَ ٤٤
৪৫ ) তাওরাতে আমি ইহুদীদের জন্য এ বিধান লিখে দিয়েছিলাম যে প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং সব রকমের যখমের জন্য সমপর্যায়ের বদলা। ৭৪ তারপর যে ব্যক্তি ঐ শাস্তি সাদকা করে দেবে তা তার জন্য কাফ্‌ফারায় পরিণত হবে। ৭৫ আর যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে না তারাই জালেম।
وَكَتَبْنَا عَلَيْهِمْ فِيهَآ أَنَّ ٱلنَّفْسَ بِٱلنَّفْسِ وَٱلْعَيْنَ بِٱلْعَيْنِ وَٱلْأَنفَ بِٱلْأَنفِ وَٱلْأُذُنَ بِٱلْأُذُنِ وَٱلسِّنَّ بِٱلسِّنِّ وَٱلْجُرُوحَ قِصَاصٌۭ ۚ فَمَن تَصَدَّقَ بِهِۦ فَهُوَ كَفَّارَةٌۭ لَّهُۥ ۚ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلظَّـٰلِمُونَ ٤٥
৪৬ ) তারপর ঐ নবীদের পরে মারয়ামপুত্র ঈসাকে পাঠিয়েছি। তাওরাতের মধ্য থেকে যা কিছু তার সামনে ছিল সে তার সত্যতা প্রমাণকারী ছিল। আর তাকে ইনজিল দিয়েছি। তাতে ছিল পথনির্দেশ ও আলো এবং তাও তাওরাতের মধ্যে থেকে যা কিছু সে সময় বর্তমান ছিল তার সত্যতা প্রমাণকারী ছিল ৭৬
وَقَفَّيْنَا عَلَىٰٓ ءَاثَـٰرِهِم بِعِيسَى ٱبْنِ مَرْيَمَ مُصَدِّقًۭا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ ٱلتَّوْرَىٰةِ ۖ وَءَاتَيْنَـٰهُ ٱلْإِنجِيلَ فِيهِ هُدًۭى وَنُورٌۭ وَمُصَدِّقًۭا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ ٱلتَّوْرَىٰةِ وَهُدًۭى وَمَوْعِظَةًۭ لِّلْمُتَّقِينَ ٤٦
৪৭ ) আর তা ছিল আল্লাহভীরুদের জন্য পথনির্দেশ ও উপদেশ। আমার নির্দেশ ছিল, ইনজীলে আল্লাহ‌ যে আইন নাযিল করেছেন ইনজীল অনুসারীরা যেন সে মোতাবেক ফায়সালা করে। আর যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে না তারাই ফাসেক। ৭৭
وَلْيَحْكُمْ أَهْلُ ٱلْإِنجِيلِ بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فِيهِ ۚ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْفَـٰسِقُونَ ٤٧
৪৮ ) তারপর হে মুহাম্মাদ! তোমাদের প্রতি এ কিতাব নাযিল করেছি, যা সত্য নিয়ে এসেছে এবং আল কিতাবের মধ্য থেকে তার সামনে যা কিছু বর্তমান আছে তার সত্যতা প্রমাণকারী ৭৮ ও তার সংরক্ষক। ৭৯ কাজেই তুমি আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী লোকদের বিভিন্ন বিষয়ের ফায়সালা করো এবং যে সত্য তোমার কাছে এসেছে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না।--তোমাদের ৮০ প্রত্যেকের জন্য একটি শরীয়াত ও একটি কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করে রেখেছি। আল্লাহ চাইলে তোমাদের সবাইকে একই উম্মতের অন্তর্ভুক্ত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তোমাদের যা দিয়েছেন তার মধ্যে তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য এমনটি করেছেন। কাজেই সৎকাজে একে অপরের চাইতে অগ্রবর্তী হবার চেষ্টা করো। শেষ পর্যন্ত তোমাদের সবাইকে আল্লাহর দিকে ফিরে যেতে হবে। তারপর তিনি সেই প্রকৃত সত্যটি তোমাদের জানিয়ে দেবেন যে ব্যাপারে তোমরা মতবিরোধ করে আসছিলে। ৮১
وَأَنزَلْنَآ إِلَيْكَ ٱلْكِتَـٰبَ بِٱلْحَقِّ مُصَدِّقًۭا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ ٱلْكِتَـٰبِ وَمُهَيْمِنًا عَلَيْهِ ۖ فَٱحْكُم بَيْنَهُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ ۖ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَآءَهُمْ عَمَّا جَآءَكَ مِنَ ٱلْحَقِّ ۚ لِكُلٍّۢ جَعَلْنَا مِنكُمْ شِرْعَةًۭ وَمِنْهَاجًۭا ۚ وَلَوْ شَآءَ ٱللَّهُ لَجَعَلَكُمْ أُمَّةًۭ وَٰحِدَةًۭ وَلَـٰكِن لِّيَبْلُوَكُمْ فِى مَآ ءَاتَىٰكُمْ ۖ فَٱسْتَبِقُوا۟ ٱلْخَيْرَٰتِ ۚ إِلَى ٱللَّهِ مَرْجِعُكُمْ جَمِيعًۭا فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ ٤٨
৪৯ ) কাজেই ৮২ হে মুহাম্মাদ! তুমি আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী তাদের যাবতীয় বিষয়ের ফায়সালা করো এবং তাদের খেয়ালখুশীর অনুসরণ করো না। সাবধান হয়ে যাও, এরা যেন তোমাকে ফিতনার মধ্যে নিক্ষেপ করে সেই হেদায়াত থেকে সামান্যতমও বিচ্যুত করতে না পারে, যা আল্লাহ‌ তোমার প্রতি নাযিল করছেন। যদি এরা এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে জেনে রাখো, আল্লাহ‌ এদের কোন কোন গোনাহর কারণে এদেরকে বিপদে ফেলার সিদ্ধান্তই করে ফেলেছেন। আর যথার্থই এদের অধিকাংশ ফাসেক।
وَأَنِ ٱحْكُم بَيْنَهُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَآءَهُمْ وَٱحْذَرْهُمْ أَن يَفْتِنُوكَ عَنۢ بَعْضِ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ إِلَيْكَ ۖ فَإِن تَوَلَّوْا۟ فَٱعْلَمْ أَنَّمَا يُرِيدُ ٱللَّهُ أَن يُصِيبَهُم بِبَعْضِ ذُنُوبِهِمْ ۗ وَإِنَّ كَثِيرًۭا مِّنَ ٱلنَّاسِ لَفَـٰسِقُونَ ٤٩
৫০ ) (যদি এরা আল্লাহর আইন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়) তাহলে কি এরা আবার সেই জাহেলিয়াতের ৮৩ ফায়সালা চায়? অথচ যারা আল্লাহর প্রতি দৃঢ় প্রত্যয়ের অধিকারী তাদের দৃষ্টিতে আল্লাহর চাইতে ভাল ফায়সালাকারী আর কেউ নেই।
أَفَحُكْمَ ٱلْجَـٰهِلِيَّةِ يَبْغُونَ ۚ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ ٱللَّهِ حُكْمًۭا لِّقَوْمٍۢ يُوقِنُونَ ٥٠
৫১ ) হে ঈমানদারগণ! ইহুদী ও খৃস্টানদেরকে নিজেদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। আর যদি তোমাদের মধ্য থেকে কেউ তাদেরকে বন্ধু হিসেবে পরিগণিত করে তাহলে সেও তাদের মধ্যেই গণ্য হবে। অব্যশ্যি আল্লাহ‌ জালেমদেরকে নিজের পথনির্দেশনা থেকে বঞ্চিত রাখেন।
۞ يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا تَتَّخِذُوا۟ ٱلْيَهُودَ وَٱلنَّصَـٰرَىٰٓ أَوْلِيَآءَ ۘ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَآءُ بَعْضٍۢ ۚ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُۥ مِنْهُمْ ۗ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَهْدِى ٱلْقَوْمَ ٱلظَّـٰلِمِينَ ٥١
৬৯.
এখানে বিশেষ করে তাদের সে সব মুফতী ও বিচারপতিদের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, যারা মিথ্যা সাক্ষ্য নিয়ে ও মিথ্যা বিবরণ শুনে এমন সব লোকদের পক্ষে ইনসাফ ও ন্যায়নীতি বিরোধী ফায়সালা করতো যাদের কাছ থেকে তারা ঘুষ নিতো অথবা যাদের সাথে তাদের অবৈধ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট থাকতো।
.
৭০.
ইহুদীরা তখনো পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্রের নিয়মিত প্রজা হিসেবে গণ্য হয়নি। বরং সন্ধি ও চুক্তির ভিত্তিতে ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে তাদের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এ চুক্তিগুলোর প্রেক্ষিতে ইহুদীরা তাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়সমূহে স্বাধীনতা ভোগ করতো এবং তাদের মামলার ফায়সালা তাদের আইন অনুযায়ীই তাদের নিজেদের বিচারপতিরাই করতো। নবী ﷺ বা তাঁর নিযুক্ত বিচারপতিদের কাছে নিজেদের মামলা-মোকদ্দমা আনার ব্যাপারে আইনের দিক দিয়ে তারা বাধ্য ছিল না। কিন্তু যেসব ব্যাপারে তারা নিজেদের দর্শীয় আইন অনুযায়ী ফায়সালা করতে চাইতো না যেসব ব্যাপারে ফায়সালা করার জন্য তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসতো। তারা আশা করতো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শরীয়াতে হয়তো তাদের জন্য অন্য কোন বিধান আছে এবং এভাবে নিজেদের ধর্মীয় আইনের আনুগত্য করা থেকে তারা নিষ্কৃতি লাভ করতে পারবে।

এখানে বিশেষ করে যে মামলাটির দিকে ইশারা করা হয়েছে সেটি ছিল খয়বরের সম্ভ্রান্ত ইহুদী পরিবার সংক্রান্ত। এ পরিবারগুলোর এক মহিলার সাথে এক পুরুষের অবৈধ সম্পর্ক পাওয়া গিয়েছিল। তাওরাতের বিদান অনুসারে তাদের শাস্তি ছিল ‘রজম’ অর্থাৎ উভয়কে পাথর নিক্ষেপে হত্যা করা। (দ্বিতীয় বিবরণী পুস্তক ২২: ২৩-২৪) কিন্তু ইহুদীরা এ শাস্তি প্রয়োগ করতে চাচ্ছিল না। তাই তারা পারস্পরিক পরামর্শক্রমে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শালিস মানার সিদ্ধান্ত করলো এবং একথাও স্থির করলো যে, যদি তিনি রজম ছাড়া অন্য কোন হুকুম দেন তাহলে তা নেয়া হবে আর যদি রজমেরই হুকুম দেন তাহলে তা মানা হবে না। কাজেই রসূলের সামনে মামলা পেশ করা হলো। তিনি রজমের হুকুম দিলেন। তারা এ হুকুম মানতে অস্বীকার করলো। তখন রসূল ﷺ তাদের জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমাদের ধর্মে এর শাস্তির ব্যাপারে কি বিধান আছে? তারা জবাব দিলঃ বেত্রাঘাত করা এবং মুখে কালি মাখিয়ে গাধার পিঠে চড়িয়ে প্রদক্ষিণ করানো। তিনি তাদের আলেমদেরকে কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেনঃ বিবাহিত ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীর ব্যাপারে তাওরাতে কি এ বিধানই আছে? তারা আবার সেই মিথ্যা জবাব দিলেন। কিন্তু তাদের মধ্য থেকে একজন নীরব থাকলেন। তার নাম ছিল ইবনে সূরিয়া। ইহুদীদের বর্ণনা অনুযায়ী সে সময় তাওরাতের তার চেয়ে বড় আলেম আর দ্বিতীয় কেউ ছিল না। নবী ﷺ তাকে সম্বোধন করে বললেনঃ আমি তোমাকে সেই আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি যিনি তোমাদের বাঁচিয়েছিলেন ফেরাউনের কবল থেকে এবং তুর পাহাড়ে তোমাদের শরীয়াত দান করেছিলেন, সত্যিই কি তাওরাতে ব্যভিচারের জন্য এ শাস্তির বিধান আছে? ইবনে সূরিয়া জবাব দিলেনঃ “আপনি আমাকে এ ধরনের কঠিন কসম না দিলে আমি বলতাম না। প্রকৃতপক্ষে রজমই ব্যভিচারের শাস্তি। কিন্তু আমাদের এখানে যখন ব্যভিচার বেড়ে যেতে লাগলো তখন আমাদের শাসকরা এ রীতি অবলম্বন করলো যে, কোন বড় লোক ব্যভিচার করলে তাকে ছেড়ে দিতো এবং গরীবরা এ দুষ্কর্ম করলে তাদেরকে রজম করতো। তারপর এতে যখন জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো তখন আমরা তাওরাতের আইনের মধ্যে পরিবর্তন সাধন করে ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীকে বেত্রাঘাত করার এবং তাদের মুখে কালি দিয়ে উল্টো মুখে গাধার পিঠে চড়াবার শাস্তির বিধান দিলাম।” এরপর ইহুদীদের আর কিছু বলার অবকাশ রইলো না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশে ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীকে পাথর নিক্ষেপ করে মেরে ফেলা হলো।

৭১.
এ আয়াতে আল্লাহ ইহুদীদের দুর্নীতির মুখোস পুরোপুরি উন্মোচন করে দিয়েছেন। এ “ধর্মীয় লোকেরা” সারা আরবে এরূপ প্রচারণার জাল বিস্তার করে রেখেছিল যে, ঐ সামজে দ্বীনদারী ও “কিতাবী-জ্ঞানের” ব্যাপারে তাদের কোন জুড়ি নেই। এদের অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছিল যে, যে কিতাবকে তারা নিজেরা আল্লাহর কিতাব বলে মানতো এবং তারা যার প্রতি ঈমান রাখে বলে দাবী করতো, তার বিধান পরিহার করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিজেদের মামলা নিয়ে এসেছিল। অথচ তাঁকে নবী বলে মেনে নিতেও তারা কঠোরভাবে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। এ থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, এ ইহুদীরা আসলে কোন জিনিসের ওপরই যথার্থ ঈমান রাখতো না। আসলে তাদের ঈমান ছিল নিজেদের নফস ও প্রবৃত্তির ওপর। আল্লাহর কিতাব বলে তারা যাকে মানে তার নির্দেশ তাদের নফস ও প্রবৃত্তির কাছে অপছন্দনীয় বলেই তারা তাকে মানতে অস্বীকার করে। আর (নাউযুবিল্লাহ) যাকে তারা মিথ্যা নবুওয়াতের দাবীদার বলে প্রচার করে বেড়ায় সেখান থেকে নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী কোন ফায়সালা লাভ করা যায় কিনা কেবলমাত্র এ আশায় তার কাছে ধর্ণা দেয়।
.
৭২.
এখানে প্রসঙ্গক্রমে এ সত্যটিও প্রকাশ করে দেয়া হয়েছে যে, সকল নবীই ছিলেন মুসলিম। অন্যদিকে এ ইহুদীরা ইসলাম থেকে সরে এসে সাম্প্রদায়িক দলাদলিতে লিপ্ত হয়ে কেবলমাত্র “ইহুদী” হিসেবেই থেকে গিয়েছিল।
৭৩.
রব্বানী মানে আলেম এবং আহবার মানে ফকীহ।
.
৭৪.
তুলনামূলক অধ্যয়নের জন্য তাওরাতের যাত্রাপুস্তুক ২১: ২৩-২৫ দেখুন।
৭৫.
অর্থাৎ যে ব্যক্তি সাদকার নিয়তে কিসাস মাফ করে দেবে তার জন্য এ নেকীটি তার অনেক গোনাহর কাফফারায় পরিণত হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিম্নোক্ত বাণীটি এ অর্থেই উক্ত হয়েছেঃ

مَنْ جُرِحَ فِى مِنْ جَسَدِهِ جِرَاحَةٌفتصدق بها كفر عنه ذنوبه بمثل ما تصدق به-

“যার শরীরে কোন আঘাত করা হয়েছে এবং সে তা মাফ করে দিয়েছে, এক্ষেত্রে যে পর্যায়ের ক্ষমা হবে ঠিক একই পর্যায়ের গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে।”

.
৭৬.
অর্থাৎ ঈসা আলাইহিস সালাম কোন নতুন ধর্ম নিয়ে আসেননি। বরং ইতিপূর্বেকার বিভিন্ন পয়গম্বরের দ্বীনই ছিল তাঁর দ্বীন এবং মানুষকে তিনি এ দ্বীনেরই দাওয়াত দিতেন। তাওরাতের আসল শিক্ষাবলীর যে অংশ তাঁর যুগে সংরক্ষিত ছিল তাকে তিনি নিজেও মানতেন এবং ইনজীলও তার সত্যতা প্রমাণ করতো (মথি ৫:১৭-১৮ দেখুন)। কুরআন বারবার এ কথাটি ঘোষণা করেছে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়ার বিভিন্ন এলাকায় যত নবী এসেছেন তাদের একজনও পূর্ববর্তী নবীদের প্রতিবাদ করার এবং তাদের কার্যাবলীকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে নিজের নতুন ধর্ম প্রবর্তন করার জন্য আসেননি। বরং প্রত্যেক নবী তাঁর পূর্ববর্তী নবীদের সত্যতার সাক্ষ্য দিতেন এবং পূর্ববর্তী নবীগণ নিজেদের পবিত্র উত্তরাধিকার হিসেবে যেসব কাজ রেখে যেতেন সেগুলোর পরিবৃদ্ধি ও বিকাশ সাধনের জন্য আসতেন। অনুরূপভাবে পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবগুলোর প্রতিবাদ করার জন্য আল্লাহ কখনো নিজের কোন কিতাব পাঠাননি। বরং তাঁর প্রত্যেকটি কিতাব ইতিপূর্বে প্রেরিত সমস্ত কিতাবের সমর্থক ও তার সত্যতা প্রমাণকারী হিসেবে উপস্থিত হয়েছে।
৭৭.
যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে না তাদের সম্পর্কে আল্লাহ এখানে তিনটি বিধান দিয়েছেন। এক, তারা কাফের। দুই, তারা জালেম। তিন, তারা ফাসেক। এর পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুম ও তার নাযিল করা আইন ত্যাগ করে নিজের বা অন্য মানুষের মনগড়া আইনের ভিত্তিতে ফায়সালা করে সে আসলে বড় ধরনের অপরাধ করে। প্রথমত তার এ কাজটি আল্লাহর হুকুম অস্বীকার করার শামিল। কাজেই এটি কুফরী। দ্বিতীয়ত তার এ কাজটি ইনসাফ ও ভারসাম্যনীতির বিরোধী। কারণ, আল্লাহ যথার্থ ইনসাফ ও ভারসাম্যনীতি অনুযায়ীই হুকুম দিয়েছিলেন। কাজেই আল্লাহর হুকুম থেকে সরে এসে যখন সে ফয়সালা করলো তখন সে আসলে জুলুম করলো। তৃতীয়ত বান্দা হওয়া সত্ত্বেও যখনই সে নিজের প্রভুর আইন অমান্য করে নিজের বা অন্যের মনগড়া আইন প্রবর্তন করলো তখনই সে আসলে বন্দেগী ও আনুগত্যের গণ্ডীর বাইরে পা রাখলো। আর এটি অবাধ্যতা বা ফাসেকী। এ কুফরী, জুলুম ও ফাসেকী তার নিজের ধরন ও প্রকৃতির দিক দিয়ে অনিবার্যভাবেই পুরোপুরি আল্লাহর হুকুম অমান্যেরই বাস্তব রূপ। যেখানে আল্লাহর হুকুম অমান্য করা হবে সেখানে এ তিনটি বিষয় থাকবে না, এটা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। তবে আল্লাহর হুকুম অমান্য করার যেমন পর্যায়ভেদ আছে তেমনি এ তিনটি বিষয়েরও পর্যায়ভেদ আছে। যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুমকে ভুল এবং নিজের বা অন্য কোন মানুষের হুকুমকে সঠিক মনে করে আল্লাহর হুকুম বিরোধী ফায়সালা করে সে পুরোপুরি কাফের, জালেম ও ফাসেক। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুমকে সত্য বলে বিশ্বাস করে কিন্তু কার্যত তার বিরুদ্ধে ফয়সালা করে সে ইসলামী মিল্লাত বহির্ভূত না হলেও নিজের ঈমানকে কুফুরী, জুলুম ও ফাসেকীর সাথে মিশিয়ে ফেলছে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি সমস্ত ব্যাপারে আল্লাহর হুকুম অমান্য করে সে সকল ব্যাপারেই কাফের, ফাসেক ও জালেম। আর যে ব্যক্তি কিছু ব্যাপারে অনুগত এবং কিছু ব্যাপারে অবাধ্য তার জীবনে ঈমান ও ইসলাম এবং কুফরী, জুলুম ও ফাসেকীর মিশ্রণ ঠিক তেমনি হারে অবস্থান করছে যে হারে সে আনুগত্য ও অবাধ্যতাকে এক সাথে মিশিয়ে রেখেছে। কোন কোন তাফসীরকার এ আয়াতগুলোকে আহলি কিতাবদের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত বলে গণ্য করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আল্লাহর কালামের শব্দের মধ্যে এ ধরনের ব্যাখ্যা করার কোন অবকাশ নেই। হযরত হুযাইফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বক্তব্যই এ ধরনের ব্যাখ্যার সঠিক ও সর্বোত্তম জবাব। তাঁকে একজন বলেছিল, এ আয়াত তিনটি তো বনী ইসরাঈলের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। সে বুঝাতে চাচ্ছিল যে, ইহুদীদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি আল্লাহর নাযিল করা হুকুমের বিরুদ্ধে ফায়সালা করে সে-ই কাফের, জালেম ও ফাসেক। একথা শুনে হযরত হুযাইফা বলে ওঠেনঃ

نعم الاخوة لكم بنو اسرائيل ان كانت لهم كل مرةولكم كل حلوة كلا والله لتسلكن طريقهم قدر الشراك-

“এ বনী ইসরাঈল গোষ্ঠী তোমাদের কেমন চমৎকার ভাই, তিতোগুলো সব তাদের জন্য আর মিঠাগুলো সব তোমাদের জন্য! কখ্খনো নয়, আল্লাহর কসম তাদেরই পথে তোমরা কদম মিলিয়ে চলবে।”

৭৮.
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্যের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ বক্তব্যটিকে যদিও এভাবে বলা যেতো যে, “আগের কিতাবগুলোর মধ্য থেকে যা কিছু তার প্রকৃত ও সঠিক অবস্থায় বর্তমান আছে কুরআন তার সত্যতা প্রমাণ করে।” কিন্তু আল্লাহ এখানে “আগের কিতাবগুলোর” পরিবর্তে “আল কিতাব” শব্দ ব্যবহার করেছেন। এ থেকে এ রহস্য উদঘাটিত হয় যে, কুরআন এবং বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন ভাষায় আল্লাহর পক্ষ থেকে যে কিতাবগুলো নাযিল হয়েছে সবই মূলত একটি কিতাবের অন্তর্ভুক্ত। তাদের রচয়িতাও একজন। তাদের মূল বক্তব্য, উদ্দেশ্য-লক্ষ্যও একই। তাদের শিক্ষাও একই। তাদের মাধ্যমে মানব জাতিকে একই জ্ঞান দান করা হয়েছে। এ কিতাবগুলোর মধ্যে পার্থক্য থাকলে তা আছে কেবল মাত্র ইবারাত অর্থাৎ বাক্য সংগঠন ও বক্তব্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে একই উদ্দেশ্যে বিভিন্ন শ্রোতৃমণ্ডলীর প্রেক্ষিতে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বিত হয়েছে। কাজেই প্রকৃত সত্য কেবল এতটুকুই নয় যে, এ কিতাবগুলো পরস্পরের বিরোধী নয় বরং সমর্থক এবং পরস্পরের প্রতিবাদকারী নয় বরং সত্যতা প্রমাণকারী। বরং প্রকৃত সত্য এর চাইতেও অনেক বেশী। অর্থাৎ এরা সবাই একই “আল কিতাবের” বিভিন্ন সংস্করণ মাত্র।
৭৯.
মূলে “মুহাইমিন” শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আরবীতে হাইমানা, ইউহাইমিনু, হাইমানাতান (هَيمَنَ-يُهَيمِنُ-هَيمَنَةً) মানে হচ্ছে দেখাশুনা, সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ, সাক্ষ্য দান, আমানতদারী, সহায়তা দান ও সমর্থন করা। যেমন বলা হয় هيمن الرجل الشيئ অর্থাৎ লোকটি অমুক জিনিসটি হেফাজত ও সংরক্ষণ করেছে। আরো বলা হয়ঃ هيمن الطائر على فراخه অর্থাৎ পাখিটি নিজের বাচ্চাকে নিজের ডানার মধ্যে নিয়ে সংরক্ষিত করে ফেলেছে। হযরত উমর (রা.) একবার লোকদের বলেনঃ انى داع فهيمنواঅর্থাৎ আমি দোয়া করি, তোমরা সমর্থনে আ-মীন বলো। অর্থাৎ কুরআনকে আল-কিতাব বলার পর “মুহাইমিন” বলার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবগুলোতে যেসব সত্য শিক্ষা ছিল কুরআন তার সবগুলোই নিজের মধ্যে সংরক্ষিত করে নিয়েছে। সে সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণকারী এই হিসেবে যে, এখন তাদের এ সত্য শিক্ষাগুলোর কোন অংশের নষ্ট হবার আর কোন সম্ভাবনাই নেই। সে সেগুলোর সমর্থক এ অর্থে যে, ঐ কিতাবগুলোতে আল্লাহর কালাম যে অবস্থায় আছে কুরআন তার সত্যতা প্রমাণ করে। সে সেগুলোর ওপর সাক্ষ্যদানকারী এ অর্থে যে, ঐ কিতাবগুলোতে আল্লাহর কালাম ও মানুষের বাণীর মধ্যে যে মিশ্রণ ঘটে গেছে কুরআনের সাক্ষ্যের মাধ্যমে তাকে আবার ছেঁটে আলাদা করা যেতে পারে। সেগুলোর মধ্যে যেগুলো কুরআনের সাথে সামঞ্জস্যশীল এবং তার অনুরূপ সেগুলো আল্লাহর কালাম আর যেগুলো কুরআন বিরোধী সেগুলো মানুষের বাণী।
৮০.
এটি একটি প্রসঙ্গ কথা। একটি প্রশ্নের বিশ্লেষণই এর উদ্দেশ্য। ওপরের ধারাবাহিক ভাষণ শোনার পর শ্রোতার মনে এ প্রশ্নটি সংশয় ও জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। প্রশ্নটি হচ্ছে, সকল নবী ও সকল কিতাব যখন একই ধর্মের দিকে আহবান জানিয়েছে এবং তারা সবাই পরস্পরের সত্যতা প্রমাণ করে ও পরস্পরের সহযোগী তখন শরীয়াতের বিস্তারিত বিধানের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে পার্থক্য কেন? ইবাদাত-বন্দেগীর বাহ্যিক অবয়ব ও আনুষ্ঠানিকতা, হালাল-হারামের বিধি-নিষেধ এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আইন-কানুনের খুঁটিনাটি ব্যাপারে বিভিন্ন নবী ও আসমানী কিতাবসমূহের শরীয়াতগুলোর মধ্যে কমবেশী পার্থক্য দেখা যায় কেন?
৮১.
এটি হচ্ছে উপরোল্লিখিত প্রশ্নটির একটি পরিপূর্ণ জবাব। এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা নিম্নরূপঃ

একঃ নিছক শরীয়াতের বিভিন্নতা দেখে এ শরীয়াতগুলো বিভিন্ন মূল ও বিভিন্ন উৎস থেকে উৎসারিত হয়েছে বলে মনে করা ভুল হবে। আসলে মহান আল্লাহ বিভিন্ন জাতির জন্য বিভিন্ন যুগে ও বিভিন্ন অবস্থায় বিধি বিধান নির্ধারণ করে থাকেন।

দুইঃ নিঃসন্দেহে প্রথম থেকেই সমগ্র মানব জাতির জন্য একটি বিধান নির্ধারিত করে সবাইকে এক উম্মতে পরিণত করা যেতো। কিন্তু বিভিন্ন নবীর শরীয়াতের মধ্যে আল্লাহ যে পার্থক্য সৃষ্টি করেছেন তার পেছনে বিভিন্ন কারণের মধ্যে একটি বড় কারণ এই ছিল যে, এভাবে আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করতে চাচ্ছিলেন। যারা প্রকৃত দ্বীন, তার প্রাণসত্তা ও তাৎপর্য অনুধাবন করে, দ্বীনের মধ্যে এ বিধানগুলোর যথার্থ মর্যাদা জানে এবং কোন প্রকার বিদ্বেষ ভাবাপন্ন হয় না তারা সত্যকে চিনে ফেলবে এবং গ্রহণ করে নেবে, যেভাবেই তা আসুক না কেন। তারা আল্লাহ প্রেরিত আগের বিধানের জায়গায় পরবর্তী বিধান মেনে নেবার ব্যাপারে কোন প্রকার ইতস্তত করবে না। পক্ষান্তরে যারা দ্বীনের মূল প্রাণশক্তি থেকে দূরে অবস্থান করে, দ্বীনের বিধান ও খুটিনাটি নিয়ম-কানুনকেই আসল দ্বীন মনে করে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত জিনিসের গায়ে নিজেরাই তকমা এঁটে দিয়ে সে ব্যাপারে স্থবিরতা ও বিদ্বেষে নিমজ্জিত হয়, তারা পরবর্তীকালে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত প্রত্যেকটি আয়াত প্রত্যাখ্যান করতে থাকে। এ দুই ধরনের লোককে পৃথক করার জন্য এ ধরনের পরীক্ষা অপরিহার্য ছিল। তাই মহান আল্লাহ বিভিন্ন শরীয়াতের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে দিয়েছেন।

তিনঃ সমস্ত শরীয়াতের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে নেকী ও কল্যাণ অর্জন করা। যে সময় আল্লাহ যে হুকুম দেন তা পালন করার মাধ্যমেই এগুলো অর্জিত হতে পারে। কাজেই যারা আসল উদ্দেশ্যের প্রতি দৃষ্টি রাখে তাদের জন্য শরীয়াতের বিভিন্নতা ও পথের পার্থক্য নিয়ে বিরোধ করার পরিবর্তে আল্লাহর কাছে গৃহীত পথের মাধ্যমে মূল উদ্দেশ্যের দিকে অগ্রসর হওয়াই হচ্ছে সঠিক কর্মপদ্ধতি।

চারঃ মানুষেরা নিজেদের স্থবিরতা, বিদ্বেষ, হঠকারিতা ও মানসিক অস্থিরতার কারণে নিজেরাই যে সমস্ত বিরোধ সৃষ্টি করেছে, কোন বিতর্ক সভায় বা যুদ্ধের ময়দানে সেগুলোর চূড়ান্ত ফায়সালা হবে না। সেগুলোর চূড়ান্ত ফায়সালা করবেন আল্লাহ নিজেই, যেদিন প্রকৃত সত্যকে সকল প্রকার আবরণমুক্ত করে দেয়া হবে। সেদিন লোকেরা দেখবে, যেসব বিরোধের মধ্যে তারা নিজেদের সমগ্র জীবনকাল অতিবাহিত করে দুনিয়া থেকে চলে এসেছে তার মধ্যে “সত্য” কতটুকু ছিল এবং “মিথ্যা” মিশ্রণ কতটুকু।

৮২.
ওপরে যে ধারাবাহিক ভাষণ চলছিল এখান থেকে আবার তা শুরু হচ্ছে।
.
৮৩.
জাহেলিয়াত শব্দটি ইসলামের বিপরীত শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ইসলাম হচ্ছে পুরোপুরি জ্ঞানের পথ। কারণ ইসলামের পথ দেখিয়েছেন আল্লাহ নিজেই। আর আল্লাহ সমস্ত বিষয়ের পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন। অপরদিকে ইসলাম থেকে ভিন্নধর্মী যেকোন পথই জাহেলিয়াতের পথ। আরবের ইসলাম পূর্ব যুগকে জাহেলিয়াতের যুগ বলার কারণ হচ্ছে এই যে, সে যুগে জ্ঞান ছাড়াই নিছক ধারণা, কল্পনা, আন্দাজ, অনুমান বা মানসিক কামনা বাসনার ভিত্তিতে মানুষেরা নিজেদের জন্য জীবনের পথ তৈরী করে নিয়েছিল। যেখানেই যে যুগেই মানুষেরা এ কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করবে তাকে অবশ্যি জাহেলিয়াতের কর্মপদ্ধতি বলা হবে। মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যা কিছু পড়ানো হয় তা নিছক আংশিক জ্ঞান। মানুষকে পথ দেখাবার জন্য এ জ্ঞান কোনক্রমেই যথেষ্ট নয়। কাজেই আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানকে বাদ দিয়ে এ আংশিক জ্ঞানের মাধ্যমে আন্দাজ, অনুমান, কল্পনা ও লালসা-কামনার মিশ্রণে যে জীবন বিধান তৈরী করা হয়েছে তাও ঠিক প্রাচীন জাহেলী পদ্ধতির মতো জাহেলিয়াতের সংজ্ঞার আওতাভুক্ত হয়।
.
.
অনুবাদ: