৩৬.
অনেকে মনে করেন নাসারা
(نَصَارَى) শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে হযরত ঈসার জন্মভূমির নাম ‘নাসেরা’
(نَاصِره) থেকে। কিন্তু এ ধারণা ভুল। আসলে নাসারা শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ‘নুসরাত’
(نُصرَت) থেকে। ঈসা আলাইহিস সালামের উক্তি
مَنْ أَنْصَارِى إِلَى اللَّهِ (আল্লাহর পথে কে আমার সাহায্যকারী হবে? ) এর জবাবে তাঁর হাওয়ারীগণ
نَحنُ أَنصَارُ الله (আমরা হবো আল্লাহর কাজে সাহায্যকারী) বলে বক্তব্য পেশ করেছিলেন। সেখান থেকেই এর উৎপত্তি। খৃস্টান লেখকরা নিছক বাহ্যিক সাদৃশ্য দেখে এ বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন যে, খৃস্টবাদের ইতিহাসের প্রথম যুগে নাসেরীয়া (Nazarenes) নামে একটি সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল, তাদেরকে তাচ্ছিল্যের সাথে নাসেরী ও ইবূনী বলা হতো এবং কুরআন দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করছে যে, তারা নিজেরাই বলেছিলঃ ‘আমরা নাসার’। আর একথাও সুস্পষ্ট যে, খৃস্টানরা নিজেরা কখনো নিজেদেরকে নাসেরী বলে পরিচয় দেয়নি।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম কখনো নিজের অনুসারীদেরকে ‘ঈসায়ী’ ‘খৃস্টান’ বা ‘মসীহী’ নামে আখ্যায়িত করেননি। কারণ তিনি নিজের নামে কোন নতুন ধর্মের ভিত্তিস্থাপন করতে আসেননি। হযরত মূসা আলাইহিস সালাম এবং তাঁর আগের ও পরের নবীগণ যে দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছিলেন তারই পুনরুজ্জীবন ছিল তাঁর দাওয়াতের লক্ষ্য। তাই তিনি সাধারণ বনী ইসরাঈলদের এবং মূসার শরীয়াতের অনুসারীদের থেকে আলাদা কোন দলগঠন করেননি এবং তাদের কোন আলাদা নামও রাখেননি। তাঁর প্রাথমিক যুগের অনুসারীরা নিজেদেরকে ইসরাঈলী মিল্লাত থেকে আলাদা মনে করতেন না এবং নিজেরা কোন স্বতন্ত্র দল হিসেবেও সংগঠিত হননি। নিজেদের পরিচিতির জন্য তারা কোন বৈশিষ্ট্যমূলক নাম ও চিহ্ন গ্রহণ করেননি। তারা ইহুদীদের সাথে বাইতুল মাকদিসের হাইকেলেই (ধর্মধাম) ইবাদাত করতে যেতেন এবং মূসার শরীয়াতের বিধিবিধান মেনে চলাকেই নিজেদের কর্তব্য মনে করতেন। (দেখুন বাইবেল, প্রেরিতদের কার্য বিবরণ পুস্তক ৩: ১-১০, ৫: ২১-২৫)।
পরবর্তী সময়ে উভয় পক্ষ থেকেই বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম শুরু হয়েছে। একদিকে হযরত ঈসার (আ) অনুসারীদের মধ্য থেকে সেন্টপল ঘোষণা করেন যে, শরীয়াতের বিধান অনুসরণের আর প্রয়োজন নেই। কেবলমাত্র ঈসার ওপর ঈমান আনাই নাজাতের তথা পরকালীন মুক্তির জন্য যথেষ্ট। আবার অন্যদিকে ইহুদী আলেমগণও হযরত ঈসার অনুসারীদেরকে একটি পথভ্রষ্ট সম্প্রদায় বলে ঘোষণা করে তাদেরকে সাধারণ বনী ইসরাঈলদের থেকে বিচ্ছিন্ন করেন। কিন্তু এ বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও শুরুতে এ নতুন সম্প্রদায়ের কোন পৃথক নাম ছিল না। হযরত ঈসার অনুসারীরা নিজেদেরকে কখনো ‘শিষ্য’ বলে উল্লেখ করতেন, কখনো ‘ভ্রাতৃগণ’ (ইখওয়ান), ‘বিশ্বাসী’ (মু’মিন), ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে’ (আল্লাযীনা আমানূ) আবার কখনো ‘পবিত্রগণ’ বলেও উল্লেখ করেছেন (প্রেরিতদের কার্যবিবরণ পুস্তক, ২:৪৪, ৪:৩২, ৯:২৬, ১১:২৯, ১৩:৫২, ১৫:১ ও ২৩, রোমীয় ১৫:২৫, কলসীয় ১:১২)। অন্যদিকে ইহুদীরা এদেরকে কখনো ‘গালীলী’, কখনো ‘নাসেরী’ বা ‘নাসরতী’ আবার কখনো ‘বেদাতী সম্প্রদায়’ বলে অভিহিত করতো (প্রেরিতদের কার্য বিবরণ ২৪:৫, লুক ১৩:২)। নিছক নিন্দা ও বিদ্রূপচ্ছলে হযরত ঈসার অনুসারীদেরকে এ নামে ডাকার কারণ ছিল এই যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মভূমি ছিল নাসেরা এবং তা ছিল ফিলিস্তিনের গালীল জেলার অন্তর্গত। কিন্তু তাদের এ বিদ্রূপাত্মক শব্দগুলো খুব বেশী প্রচলিত হতে পারেনি। ফলে এগুলো হযরত ঈসার অনুসরীদের নামে পরিণত হতে সক্ষম হয়নি।
এ দলের বর্তমান নাম “খৃস্টান” (Christian) সর্বপ্রথম আন্তাকিয়াতে
(أَنطَاكِيَّه) প্রদত্ত হয়। সেখানে ৪৩ বা ৪৪ খৃস্টাব্দে কতিপয় মুশরিক অধিবাসী হযরত ঈসার অনুসরীদেরকে এ নামে অভিহিত করে। সে সময় সেন্টপল ও বার্নাবাস সেখানে পৌঁছে ধর্ম প্রচারের কাজে নিয়োজিত হন। (প্রেরিতদের কার্য ১১:২৬)। এ নামটিও মূলত বিরোধীদের পক্ষ থেকেই ঠাট্টা-বিদ্রূপচ্ছলেই রাখা হয়েছিল। ঈসার অনুসারীরা নিজেরাও এটাকে তাদের নাম হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু তাদের শত্রুরা যখন তাদেরকে ঐ নামে ডাকতে শুরু করলো তখন তাদের নেতারা বললেন, যদি তোমাদেরকে খৃস্টের সাথে যুক্ত করে খৃস্টান বলে ডাকা হয়। তাহলে তাতে তোমাদের লজ্জা পাবার কি কারণ থাকতে পারে? (১-পিতর ৪:১৬) এভাবে তারা নিজেরাই ধীরে ধীরে শত্রুদের বিদ্রূপচ্ছলে দেয়া এ নাম নিজদেরকে আখ্যায়িত করতে থাকে। অবশেষে তাদের মধ্যে এ অনুভূতিই খতম হয়ে যায় যে, এটি আসলে একটি খারাপ নাম এবং তাদেরকে শত্রুরা বিদ্রূপচ্ছলে এ নাম দিয়েছিল।
কুরআন এ কারণেই খৃস্টের অনুসারীদের ঈসায়ী, মসীহী বা খৃস্টান নাম আখ্যায়িত করেনি। বরং তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, তোমরা আসলে সেসব লোকদের অন্তর্গত যাদেরকে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম ‘মান আনসারী ইলাল্লাহ (কে আল্লাহর পথে আমাকে সাহায্য করবে? ) বলে আহবান জানিয়েছিলেন এবং এর জবাবে সেই লোকেরা বলেছিল ‘নাহ্নু আনসারুল্লাহ (আমরা আল্লাহর সাহায্যকারী)। তাই তোমরা নিজেদের প্রাথমিক ও মৌলিক তাৎপর্যের দিক দিয়ে নাসারা বা আনসার। কিন্তু আজকের খৃষ্টীয় মিশনারীরা এ বিস্মৃত বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেবার কারণে কুরআনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার পরিবর্তে উল্টো অভিযোগ জানাচ্ছে যে, কুরআন তাদেরকে খৃস্টান না বলে নাসারা বলছে কেন?