পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

৪৩১ আয়াত

২৫ ) বলো, আমি জানি না, যে জিনিসের প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেয়া হচ্ছে তা নিকটে, না তার জন্য আমার রব কোন দীর্ঘ মেয়াদ স্থির করছেন। ২৫
قُلْ إِنْ أَدْرِىٓ أَقَرِيبٌۭ مَّا تُوعَدُونَ أَمْ يَجْعَلُ لَهُۥ رَبِّىٓ أَمَدًا ٢٥
২৬ ) তিনি গায়েবী বিষয়ে জ্ঞানের অধিকারী। তিনি তাঁর গায়েবী বিষয়ের জ্ঞান কারো কাছে প্রকাশ করেন না। ২৬
عَـٰلِمُ ٱلْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ عَلَىٰ غَيْبِهِۦٓ أَحَدًا ٢٦
২৭ ) তবে যে রসূলকে (গায়েবী বিষয়ের কোন জ্ঞান দেয়ার জন্য) মনোনীত করেছেন ২৭ তাকে ছাড়া। তিনি তার সামনে ও পেছনে প্রহরী নিয়োজিত করেন। ২৮
إِلَّا مَنِ ٱرْتَضَىٰ مِن رَّسُولٍۢ فَإِنَّهُۥ يَسْلُكُ مِنۢ بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِۦ رَصَدًۭا ٢٧
২৮ ) যাতে তিনি নিশ্চিতরূপে জানতে পারেন যে, রসূলগণ তাদের রবের বাণীসমূহ পৌঁছিয়ে দিয়েছেন ২৯ তিনি তাদের গোটা পরিবেশ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত। আর তিনি প্রতিটি জিনিস গুণে গুণে হিসেব করে রেখেছেন। ৩০
لِّيَعْلَمَ أَن قَدْ أَبْلَغُوا۟ رِسَـٰلَـٰتِ رَبِّهِمْ وَأَحَاطَ بِمَا لَدَيْهِمْ وَأَحْصَىٰ كُلَّ شَىْءٍ عَدَدًۢا ٢٨
১ ) হে বস্ত্র মুড়ি দিয়ে শয়নকারী
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلْمُزَّمِّلُ ١
২ ) রাতের বেলা নামাযে রত থাকো। তবে কিছু সময় ছাড়া
قُمِ ٱلَّيْلَ إِلَّا قَلِيلًۭا ٢
৩ ) অর্ধেক রাত, কিংবা তার চেয়ে কিছু কম করো।
نِّصْفَهُۥٓ أَوِ ٱنقُصْ مِنْهُ قَلِيلًا ٣
৪ ) অথবা তার ওপর কিছু বাড়িয়ে নাও। আর কুরআন থেমে থেমে পাঠ করো।
أَوْ زِدْ عَلَيْهِ وَرَتِّلِ ٱلْقُرْءَانَ تَرْتِيلًا ٤
৫ ) আমি অতি শীঘ্র তোমার ওপর একটি গুরুভার বাণী নাযিল করবো।
إِنَّا سَنُلْقِى عَلَيْكَ قَوْلًۭا ثَقِيلًا ٥
৬ ) প্রকৃতপক্ষে রাতের বেলা জেগে ওঠা প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে অনেক বেশী কার্যকর এবং যথাযথভাবে কুরআন পড়ার জন্য উপযুক্ত সময়
إِنَّ نَاشِئَةَ ٱلَّيْلِ هِىَ أَشَدُّ وَطْـًۭٔا وَأَقْوَمُ قِيلًا ٦
২৫.
বর্ণনাভঙ্গি থেকেই বুঝা যায়, এটি একটি প্রশ্নের জওয়াব। এখানে প্রশ্নটি উল্লেখ না করে শুধু তার জবাব দেয়া হয়েছে। সম্ভবত ওপরে উল্লেখিত কথা শুনে বিরোধীরা বিদ্রূপের ভঙ্গীতে প্রশ্ন করে থাকবে যে, যে সময়ের ভয় তিনি দেখাচ্ছেন সে সময়টি কখন আসবে? তার জবাবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তাদের বলো, সে সময়টি আগমন তো নিশ্চিত, তবে তার আগমনের দিনক্ষণ আমাকে জানানো হয়নি। সে সময়টি অতি আসন্ন, না তার জন্য দীর্ঘ সময় নির্দিষ্ট রয়েছে তা একমাত্র আল্লাহ‌ তা’আলাই জানেন।
২৬.
অর্থাৎ গায়েবী বিষয়ের সবটুকু জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। গায়েবী বিষয়ের এ পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান তিনি কাউকেই দেন না।
২৭.
অর্থাৎ রসূল নিজে “আলেমুল গায়েব” বা গায়েবী বিষয়ে জ্ঞানের অধিকারী নন। বরং আল্লাহ‌ তা’আলা যখন তাকে রিসালাতের দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার জন্য মনোনীত করেন তখন তিনি ইচ্ছামত তাঁকে অদৃশ্য বস্তুসমূহের জ্ঞান দান করেন।
২৮.
প্রহরী মানে ফেরেশতা। অর্থাৎ আল্লাহ‌ তা’আলা যখন অহীর মাধ্যমে গায়েবী বিষয়ের গভীর জ্ঞান ও তাৎপর্য তাঁর রসূলের কাছে পাঠান তখন তার রক্ষণাবেক্ষণ ও পাহারাদারীর জন্য সবখানে ফেরেশতা মোতায়েন করেন। যাতে সে জ্ঞানটি অত্যন্ত সুরক্ষিত পন্থায় রসূলের কাছে পৌঁছতে পারে এবং তার মধ্যে বাইরের কোন কিছু সংমিশ্রত হতে না পারে। ওপরে ৮ও ৯ নং আয়াতে একথাটিই বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত প্রাপ্তির পর জ্বীনরা দেখলো তাদের ঊর্ধ্ব জগতে প্রবেশের সব পথ বন্ধ। তারা দেখলো সব জায়গায় কঠোর প্রহরা বসানো হয়েছে যার কারণে ছিটে ফোঁটা কিছু আভাস লাভের সুযোগও তাদের নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
২৯.
এর তিনটি অর্থ হতে পারে। এক, রসূল নিশ্চিতভাবে জানবেন যে, ফেরেশতারা তাঁর কাছে আল্লাহ‌ তা’আলার বাণীসমূহ ঠিক ঠিক পৌঁছিয়ে দিয়েছে। দুই, আল্লাহ‌ তা’আলা জানবেন যে, ফেরেশতারা তাদের রবের বাণীসমূহ তাঁর রসূলের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছিয়ে দিয়েছে। তিন, আল্লাহ‌ তা’আলা জানবেন যে রসূলগণ তাঁদের রবের বাণীসমূহ তাঁর বান্দাদের কাছে ঠিকমত পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। আয়াতটির শব্দমালা এ তিনটি অর্থেরই ধারক। অসম্ভব নয় যে, এখানে যুগপৎ এ তিনটি অর্থই বুঝানো হয়েছে। এছাড়াও আয়াতটির আরো দু’টি অর্থ হয়। প্রথমটি হলো রিসালাতের দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার জন্য রসূলকে যতটুকু “ইলমে গায়েব” বা অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান দান করা জরুরী ততটুকু জ্ঞান দান করা। দ্বিতীয়টি হলো, যেসব ফেরেশতাকে প্রহরা কাজে নিয়োজিত করা হয় তারা রসূল পর্যন্ত সুরক্ষিত পন্থায় অহী পৌঁছে যাওয়ার ব্যাপারটুকুই শুধু তত্ত্বাবধান করেন না বরং রসূল তাঁর রবের বাণীসমূহ তাঁর বান্দাদের কাছে যাতে পুরোপুরি পৌঁছিয়ে দিতে পারেন তার তত্ত্বাবধানও করে থাকেন।
৩০.
অর্থাৎ আল্লাহর ক্ষমতা রসূল ও ফেরেশতা উভয়কে এমনভাবে পরিব্যাপ্ত করে আছে যে, তারা যদি তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে চুল পরিমাণ কাজও করেন তাহলে সঙ্গে সঙ্গে পাকড়াও হবেন। আর যে বাণীসমূহ আল্লাহ‌ পাঠান তার প্রতিটি বর্ণ গোণা ও হিসেব করা। তার একটি বর্ণের হ্রাস-বৃদ্ধি করার ক্ষমতাও রসূল বা ফেরেশতা করো নেই।
১.
এ শব্দগুলো দ্বারা আল্লাহ‌ তা’আলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি যেন রাতের বেলা ওঠেন এবং ইবাদতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন। এ থেকে বুঝা যায় যে, সে সময় তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন অথবা ঘুমানোর জন্য চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। এ সময় তাকে হে নবী (সাঃ ) অথবা হে রসূল বলে সম্বোধন করে হে বস্ত্র মুড়ি দিয়ে শয়নকারী বলে সম্বোধন একটি তাৎপর্যপূর্ণ সম্বোধন। এর যে অর্থ দাঁড়ায় তা হলো, এখন আর সে সময় নেই যখন তিনি নিশ্চিন্তে আরামে ঘুমাতেন। এখন তাঁর ওপর এক বিরাট কাজের বোঝা চাপানো হয়েছে যার দাবী ও চাহিদা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের।
২.
এর দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, নামাযে দাঁড়িয়ে রাত অতিবাহিত করো এবং রাতের অল্প কিছু সময় মাত্র ঘুমে কাটাও। দুই, তোমার কাছে সমস্ত রাতই নামায পড়ে কাটিয়ে দেয়ার দাবী করা হচ্ছে না। বরং তুমি বিশ্রামও করো এবং রাতের একটি ক্ষুদ্র অংশ ইবাদত-বন্দেগীতেও ব্যয় করো। কিন্তু পরবর্তী বিষয়বস্তুর সাথে প্রথমোক্ত অর্থটাই অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ। সূরা দাহরের ২৬ নং আয়াত থেকে একথারই সমর্থন পাওয়া যায়। উক্ত আয়াতে বলা হয়েছেঃ

وَمِنَ اللَّيْلِ فَاسْجُدْ لَهُ وَسَبِّحْهُ لَيْلًا طَوِيلًا

"রাতের বেলা আল্লাহর সামনে সিজদায় পড়ে থাকো এবং রাতের বেশীর ভাগ সময় তাঁর তাসবীহ ও প্রশংসায় অতিবাহিত করো। “

.
৩.
যে সময়টুকু ইবাদাত করে কাটাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল সেময়ের পরিমাণ কি হবে এটা তারই ব্যাখ্যা। এতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইখতিয়ার দেয়া হয়েছে, তিনি ইচ্ছা করলে অর্ধেক রাত নামায পড়ে কাটাতে পারেন কিংবা তার চেয়ে কিছু কম বা বেশী করতে পারেন। তবে বাচনভঙ্গী থেকে বুঝা যায় যে, অর্ধেক রাত-ই অগ্রাধিকার যোগ্য। কারণ অর্ধেক রাতকে মানদণ্ড নির্ধারিত করে তার থেকে কিছু কম বা তার চেয়ে কিছু বেশী করার ইখতিয়ার দেয়া হয়েছে।
৪.
অর্থাৎ তাড়াতাড়ি ও দ্রুতগতিতে পড়ো না। বরং ধীরে ধীরে প্রতিটি শব্দ সুন্দরভাবে মুখে উচ্চারণ করে পড়ো। এক একটি আয়াত পড়ে থেমে যাও যাতে মন আল্লাহর বাণীর অর্থ ও তার দাবীকে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারে এবং তার বিষয়বস্তু দ্বারা প্রভাবিত হয়। কোন জায়গায় আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলীর উল্লেখ থাকলে তার মহত্ব শ্রেষ্ঠত্ব ও ভীতি যেন মনকে ঝাঁকুনি দেয়। কোন জায়গায় তাঁর রহমত ও করুণার বর্ণনা আসলে হৃদয়-মন যেন কৃতজ্ঞতার আবেগে আপ্লুত হয়ে ওঠে। কোন জায়গায় তাঁর গযব ও শাস্তির উল্লেখ থাকলে হৃদয়-মন যেন তার ভয়ে কম্পিত হয়। কোথাও কোন কিছু করার নির্দেশ থাকলে কিংবা কোন কাজ করতে নিষেধ করা হয়ে থাকলে কি কাজ করতে আদেশ করা হয়েছে এবং কোন কাজ করতে নিষেধ করা হয়েছে তা যেন ভালভাবে বুঝে নেয়া যায়। মোটকথা কুরআনে শব্দগুলো শুধু মুখ থেকে উচ্চারণ করার নাম কুরআন পাঠ নয়, বরং মুখ থেকে উচ্চারণ করার সাথে সাথে তা উপলব্ধি করার জন্য গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনাও করতে হবে। হযরত আনাসকে (রা.) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোরআন পাঠের নিয়ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেনঃ নবী ﷺ শব্দগুলোকে টেনে পড়তেন। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” পড়ে বললেন যে, তিনি আল্লাহ, রহমান এবং রাহীম শব্দকে মদ্দ করে বা টেনে পড়তেন। (বুখারী) হযরত উম্মে সালমাকে একই প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেনঃ নবী ﷺ এক একটি আয়াত আলাদা আলাদা করে পড়তেন এবং প্রতিটি আয়াত পড়ে থামতেন। যেমন اَلحَمْدُ لَلّهِ رَبِّ العَلَمِيْنَ পড়ে থামতেন, তারপর الرَّحْمَانِ الّرحِيْمٍ পড়ে থামতেন এবং কিছু সময় থেমে থেকে مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ পড়তেন। (মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী) আরেকটি রেওয়ায়েতে হযরত উম্মে সালমা (রা.) বলেনঃ নবী ﷺ এককেটি শব্দ স্পষ্ট উচ্চারণ করে পড়তেন। (তিরমিযী, নাসায়ী) হযরত হুযায়ফা ইবনে ইয়ামান বর্ণনা করেছেন যে, একদিন রাতে আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে নামায পড়তে দাঁড়ালাম। আমি দেখলাম, তিনি এমভাবে কুরআন তেলাওয়াত করছেন যে, যেখানে তাসবীহের বিষয় আসছে সেখানে তিনি তাসবীহ পড়ছেন, যেখানে দোয়ার বিষয় আসছে সেখানে দোয়া করছেন এবং যেখানে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনার বিষয় আসছে সেখানে তিনি আশ্রয় প্রার্থনা করছেন। (মুসলিম, নাসায়ী) হযরত আবু যান বর্ণনা করেছেন যে, একবার রাতের নামাযে কুরআন তেলাওয়াত করতে করতে নবী ﷺ যখন এ আয়াতটির কাছে পৌঁছলেনاِنْ تَعُذُّبْهُمْ فَاِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَاِنْ تَغْفِرْ لَهُمْ فَاِنَّكَ اََنْتَ الْعَزِيْْزُ الْحَكِيْمُ"তুমি যদি তাদের শাস্তি দাও, তারা তোমারই বান্দা। আর যদি তুমি তাদের ক্ষমা করে দাও তাহলে তুমি পরাক্রমশালী ও বিজ্ঞ। তখন তিনি বার বার এ আয়াতটিই পড়তে থাকলেন এবং এভাবে ভোর হয়ে গেল। ” (মুসনাদে আহমাদ, বুখারী)
৫.
এর অর্থ হলো তোমাকে রাতের বেলা নামায পড়ার এ নির্দেশ এ জন্য দেয়া হচ্ছে যে, আমি একটি অতি গুরুভার বাণী তোমার ওপরে নাযিল করছি। এ ভার বহন করার এবং তা বরদাশত করার শক্তি তোমার মধ্যে সৃষ্টি হওয়া আবশ্যক। তুমি এ শক্তি অর্জন করতে চাইলে আরাম পরিত্যাগ করে রাতের বেলা নামাযের জন্য ওঠো এবং অর্ধেক রাত কিংবা তার চেয়ে কিছু কম বা বেশী রাত ইবাদাত বন্দেগীতে কাটিয়ে দাও। কুরআনকে গুরুভার বাণী বলার কারণ হলো, তার নির্দেশ অনুসার কাজ করা, তার শিক্ষার উদাহরণ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরা, সারা দুনিয়ার সামনে তার দাওয়াত বা আহবান নিয়ে দাঁড়ানো এবং তদনুযায়ী আকীদা-বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা, নৈতিক চরিত্র ও আচার-আচরণ এবং তাহযীব-তামাদ্দুনের গোটা ব্যবস্থায় বিপ্লব সংঘটিত করা এমন একটি কাজ যে, এর চেয়ে বেশী কঠিনও গুরুভার কাজের কল্পনাও করা যায় না। এ জন্যও একে গুরুভার ও কঠিন বাণী বলা হয়েছে যে, তার অবতরণের ভার বহন করা অত্যন্ত কঠিন কাজ ছিল। হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত(রা.) বর্ণনা করেছেন যে, একবার রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর অহী নাযিল হওয়ার সময় তিনি আমার উরুর ওপর তাঁর উরু ঠেকিয়ে বসেছিলেন। আমার উরুর ওপর তখন এমন চাপ পড়ছিলো যে, মনে হচ্ছিলো তা এখনই ভেঙে যাবে। হযরত আয়েশা বর্ণনা করেনঃ আমি প্রচণ্ড শীতের দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর অহী নাযিল হতে দেখেছি। সে সময়ও তাঁর কপাল থেকে ঘাম ঝরতে থাকতো। (বুখারী, মুসলিম, মালিক, তিরমিযী, নাসায়ী) আরেকটি রেওয়ায়েতে হযরত আয়েশা (রা.) বলেছেনঃ উটনীর ওপর সওয়ার থাকা অবস্থায় যখনই তাঁর ওপর অহী নাযিল হতো উটনী তখন তার বুক মাটিতে ঠেকিয়ে দিতো। অহী নাযিল শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে নড়াচড়া পর্যন্ত করতে পারতো না। (মুসনাদে আহমাদ, হাকেম, ইবনে জারীর)।
৬.
মূল ইবারতেنَاشِئَةَ اللَّيْلِ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যার ব্যাখ্যায় মুফাস্সির ও ভাষাবিদদের চারটি ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। একটি মত হলো, ناشئة শব্দের মানে রাতের বেলা শয্যা ত্যাগকারী ব্যক্তি। দ্বিতীয় মতটি হলো এর অর্থ রাত্রিকালীন সময়। তৃতীয় মত হলো এর অর্থ রাতের বেলা জেগে থাকা বা ওঠা। আর চতুর্থ মতটি হলো, এর অর্থ শুধু রাতের বেলা ওঠা বা জেগে থাকা নয়। বরং ঘুমিয়ে পড়ার পর জেগে ওঠা। হযরত আয়েশা এবং মুজাহিদ এ চতুর্থ অর্থটিই গ্রহণ করেছেন।
৭.
আয়াতে اشد وطاء আসাদ্দু ওয়াতয়ান শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ এতো ব্যাপক যে, একটি মাত্র বাক্যে তা বুঝানো সম্ভব নয়। এর একটি অর্থ হলো রাতের বেলা ইবাদাত-বন্দেগীর কাজ, শয্যা ত্যাগ করে ওঠা এবং দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকা যেহেতু মানুষের স্বভাব-বিরুদ্ধ কাজ, মানুষের মনও প্রবৃত্তি এ সময় আরাম কামনা করে, তাই এটি এমন একটি কাজ ও চেষ্টা-সাধনা যা প্রবৃত্তিকে অবদমিত ও বশীভূত করার জন্য অত্যন্ত কার্যকর পন্থা। যে ব্যক্তি এ পন্থায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয় এবং দেহ ও মন-মগজের ওপর প্রভাব বিস্তার করে নিজের এ শক্তিকে আল্লাহর পথে ব্যবহার করতে সক্ষম হয় সে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে সত্য ও শাশ্বত এ দ্বীনের দাওয়াতকে পৃথিবীতে বিজয়ী করার কাজ করতে পারে। দ্বিতীয় অর্থ হলো, এ কাজটি মানুষের হৃদয়-মন ও বক্তব্যের মধ্যে সামঞ্জস্য সৃষ্টি করার একটা কার্যকর উপায়। কারণ রাতের এ সময়টিতে বান্দা ও আল্লাহর মধ্যে আর কেউ আড়াল হয়না। এ অবস্থায় মানুষ মুখে যা বলে তা তার হৃদয়ের কথার প্রতিধ্বনি। তৃতীয় অর্থ হলো, এটি মানুষের ভেতর ও বাহিরের মধ্যে সঙ্গতি ও মিল সৃষ্টির অতি কার্যকর একটি উপায়। কারণ যে ব্যক্তি রাতের নির্জন নিথর পরিবেশে আরাম পরিত্যাগ করে ইবাদত-বন্দেগীর জন্য উঠবে সে নিঃসন্দেহে খালেস মনেই এরূপ করবে। তাতে প্রদর্শনীর বা লোক দেখানোর আদৌ কোন সুযোগ থাকে না। চতুর্থ হলো, মানুষের জন্য এ ধরনের ইবাদত-বন্দেগীর যেহেতু দিনের বেলার ইবাদত-বন্দেগীর চেয়ে অনেক বেশী কষ্টকর। তাই তা নিয়মিত করার ফলে মানুষের মধ্যে অনেক বেশী দৃঢ়তা সৃষ্টি হয় সে অত্যন্ত শক্ত হয়ে আল্লাহর পথে অগ্রসর হতে পারে এবং এ পথে কঠোরতা সমূহকে সে অটল ও অবিচল থেকে বরদাশত করতে পারে।
৮.
মূল ইবারতে اقوم قيلا বলা হয়েছে। এর আভিধানিক অর্থ হলো, কথাকে আরো বেশী যথার্থ ও সঠিক বানায়। তবে এর মূল বক্তব্য হলো, সে সময় মানুষ আরো বেশী প্রশান্তি, তৃপ্তি ও মনোযোগ সহকারে বুঝে কুরআন শরীফ পড়তে পারে। ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে اجدران يفقه في القران অর্থাৎ গভীর চিন্তা-ভাবনা ও মনোনিবেশ সহ কুরআন পাঠের জন্য এটা একটা অপেক্ষাকৃত উপযুক্ত সময়। (আবু দাউদ)
অনুবাদ: