পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

১৭৫ আয়াত

৭ ) আল্লাহর আরশের ধারক ফেরেশতাগণ এবং যারা আরশের চার পাশে হাজির থাকে তারা সবাই প্রশংসাসহ তাদের রবের পবিত্রতা বর্ণনা করে। তাঁর প্রতি ঈমান পোষণ করে এবং ঈমানদারদের জন্য দোয়া করে। তারা বলেঃ হে আমাদের রব, তুমি তোমার রহমত ও জ্ঞান দ্বারা সবকিছু পরিবেষ্টন করে আছো। তাই মাফ করে দাও এবং দোযখের আগুন থেকে রক্ষা করো যারা তাওবা করেছে এবং তোমার পথ অনুসরণ করেছে তাদেরকে।
ٱلَّذِينَ يَحْمِلُونَ ٱلْعَرْشَ وَمَنْ حَوْلَهُۥ يُسَبِّحُونَ بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَيُؤْمِنُونَ بِهِۦ وَيَسْتَغْفِرُونَ لِلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ رَبَّنَا وَسِعْتَ كُلَّ شَىْءٍۢ رَّحْمَةًۭ وَعِلْمًۭا فَٱغْفِرْ لِلَّذِينَ تَابُوا۟ وَٱتَّبَعُوا۟ سَبِيلَكَ وَقِهِمْ عَذَابَ ٱلْجَحِيمِ ٧
৮ ) হে আমাদের রব উপরন্তু তাদেরকে তোমার প্রতিশ্রুত ১০ চিরস্থায়ী জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দাও। আর তাদের বাপ, মা, স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে যারা সৎকর্মশীল (তাদেরকেও সেখানে তাদের সাথে পৌঁছিয়ে দাও) । ১১ তুমি নিঃসন্দেহে সর্বশক্তিমান ও মহাকৌশলী।
رَبَّنَا وَأَدْخِلْهُمْ جَنَّـٰتِ عَدْنٍ ٱلَّتِى وَعَدتَّهُمْ وَمَن صَلَحَ مِنْ ءَابَآئِهِمْ وَأَزْوَٰجِهِمْ وَذُرِّيَّـٰتِهِمْ ۚ إِنَّكَ أَنتَ ٱلْعَزِيزُ ٱلْحَكِيمُ ٨
৯ ) আর তাদেরকে মন্দ কাজসমূহ থেকে রক্ষা করো। ১২ কিয়ামতের দিন তুমি যাকে মন্দ ও অকল্যাণসমূহ ১৩ থেকে রক্ষা করেছো তার প্রতি তুমি বড় করুণা করেছো। এটাই বড় সফলতা।
وَقِهِمُ ٱلسَّيِّـَٔاتِ ۚ وَمَن تَقِ ٱلسَّيِّـَٔاتِ يَوْمَئِذٍۢ فَقَدْ رَحِمْتَهُۥ ۚ وَذَٰلِكَ هُوَ ٱلْفَوْزُ ٱلْعَظِيمُ ٩
১০ ) যারা কুফরী করেছে কিয়ামতের দিন তাদের ডেকে বলা হবে, “আজ তোমরা নিজেদের ওপর যতটা ক্রোধান্বিত হচ্ছো, আল্লাহ‌ তোমাদের ওপর তার চেয়েও অধিক ক্রোধান্বিত হতেন তখন যখন তোমাদেরকে ঈমানের দিকে আহ্বান জানানো হতো আর তোমরা উল্টা কুফরী করতে।” ১৪
إِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ يُنَادَوْنَ لَمَقْتُ ٱللَّهِ أَكْبَرُ مِن مَّقْتِكُمْ أَنفُسَكُمْ إِذْ تُدْعَوْنَ إِلَى ٱلْإِيمَـٰنِ فَتَكْفُرُونَ ١٠
১১ ) তারা বলবেঃ হে আমাদের রব, প্রকৃতই তুমি আমাদেরকে দু’বার মৃত্যু দিয়েছো এবং দু’বার জীবন দান করেছো। ১৫ এখন আমরা অপরাধ স্বীকার করছি। ১৬ এখন এখান থেকে বের হওয়ার কোন উপায় কি আছে? ১৭
قَالُوا۟ رَبَّنَآ أَمَتَّنَا ٱثْنَتَيْنِ وَأَحْيَيْتَنَا ٱثْنَتَيْنِ فَٱعْتَرَفْنَا بِذُنُوبِنَا فَهَلْ إِلَىٰ خُرُوجٍۢ مِّن سَبِيلٍۢ ١١
১২ ) (জবাব দেয়া হবে) এ অবস্থা যার মধ্যে তোমরা আছো, তা এ কারণে যে, যখন একমাত্র আল্লাহর দিকে ডাকা হতো তখন তোমরা তা মানতে অস্বীকার করতে। কিন্তু যখন তাঁর সাথে অন্যদেরকেও শামিল করা হতো তখন মেনে নিতে। এখন তো ফায়সালা মহান ও মর্যাদাবান আল্লাহর হাতে। ১৮
ذَٰلِكُم بِأَنَّهُۥٓ إِذَا دُعِىَ ٱللَّهُ وَحْدَهُۥ كَفَرْتُمْ ۖ وَإِن يُشْرَكْ بِهِۦ تُؤْمِنُوا۟ ۚ فَٱلْحُكْمُ لِلَّهِ ٱلْعَلِىِّ ٱلْكَبِيرِ ١٢
১৩ ) তিনিই তো তোমাদের নিদর্শনসমূহ দেখান ১৯ এবং তোমাদের জন্য আসমান থেকে রিযিক নাযিল করেন ২০ (কিন্তু এসব নিদর্শন দেখে) কেবল তারাই শিক্ষা গ্রহণ করে যারা আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী ২১
هُوَ ٱلَّذِى يُرِيكُمْ ءَايَـٰتِهِۦ وَيُنَزِّلُ لَكُم مِّنَ ٱلسَّمَآءِ رِزْقًۭا ۚ وَمَا يَتَذَكَّرُ إِلَّا مَن يُنِيبُ ١٣
১৪ ) (সুতরাং হে প্রত্যাবর্তনকারীরা, ) দ্বীনকে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে ২২ তাঁকেই ডাকো, তোমাদের এ কাজ কাফেরদের কাছে যতই অসহনীয় হোক না কেন।
فَٱدْعُوا۟ ٱللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ وَلَوْ كَرِهَ ٱلْكَـٰفِرُونَ ١٤
১৫ ) তিনি উচ্চ মর্যাদার অধিকারী, ২৩ আরশের অধিপতি। ২৪ তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যার কাছে ইচ্ছা নিজের হুকুমে ‘রূহ’ নাযিল করেন ২৫ যাতে সে সাক্ষাতের দিন ২৬ সম্পর্কে সাবধান করে দেয়।
رَفِيعُ ٱلدَّرَجَـٰتِ ذُو ٱلْعَرْشِ يُلْقِى ٱلرُّوحَ مِنْ أَمْرِهِۦ عَلَىٰ مَن يَشَآءُ مِنْ عِبَادِهِۦ لِيُنذِرَ يَوْمَ ٱلتَّلَاقِ ١٥
১৬ ) সেটি এমন দিন যখন সব মানুষের সবকিছু প্রকাশ হয়ে পড়বে। আল্লাহ‌র কাছে তাদের কোন কথাই গোপন থাকবে না। (সেদিন ঘোষণা দিয়ে জিজ্ঞেস করা হবে)। আজ রাজত্ব কার? ২৭ (সমস্ত সৃষ্টি বলে উঠবে) একমাত্র আল্লাহর যিনি কাহ্‌হার।
يَوْمَ هُم بَـٰرِزُونَ ۖ لَا يَخْفَىٰ عَلَى ٱللَّهِ مِنْهُمْ شَىْءٌۭ ۚ لِّمَنِ ٱلْمُلْكُ ٱلْيَوْمَ ۖ لِلَّهِ ٱلْوَٰحِدِ ٱلْقَهَّارِ ١٦
৬.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গীদেরকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য একথা বলা হয়েছে। তারা সে সময় মক্কার কাফেরদের বিদ্রূপ, কটূভাষণ ও অত্যাচার এবং তাদের সামনে নিজেদের অসহায়ত্ব দেখে দেখে ভগ্ন হৃদয় হয়ে পড়ছিলো। তাই বলা হয়েছে, এসব নীচু ও হীন লোকদের কথায় তোমরা মন খারাপ করছো কেন? তোমরা এমন মর্যাদার অধিকারী যে, আল্লাহর আরশের ধারক ফেরেশতারা এবং আরশের চারপাশে অবস্থানরত ফেরেশতারা পর্যন্ত তোমাদের সহযোগী। তারা তোমাদের জন্য মহান আল্লাহর কাছে সুপারিশ করছে। সাধারণ ফেরেশতাদের কথা না বলে আল্লাহর আরশের ধারক ও তার চারপাশে অবস্থানকারী ফেরেশতাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এ ধারণা দেয়ার জন্য যে, মহান আল্লাহর বিশাল সাম্রাজ্যের কর্মচারীরা তো বটেই, তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে অবস্থানরত যেসব ফেরেশতা ঐ সাম্রাজ্যের স্তম্ভ স্বরূপ এবং বিশ্ব-জাহানের শাসন কর্তার কাছে যারা নৈকট্য লাভ করেছে তারা পর্যন্ত তোমাদের প্রতি গভীর আগ্রহ ও সমবেদনা পোষণ করে। আরো বলা হয়েছে যে, এসব ফেরেশতা আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণ এবং ঈমানদারদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। একথা দ্বারা প্রকাশ পায় যে, ঈমানের বন্ধনই প্রকৃত বন্ধন যা আসমান ও যমীনবাসীদেরকে পরস্পর একই সূত্রে গেঁথে দিয়েছে। এ সম্পর্কের কারণেই আরশের পাশে অবস্থানকারী ফেরেশতাদের তাদের মতই আল্লাহ‌ তা’আলার প্রতি ঈমান পোষণকারী মাটির মানুষদের সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। আল্লাহর প্রতি ফেরেশতাদের ঈমান পোষণ করার অর্থ এই নয় যে, তারা কুফরি করতে পারতো। কিন্তু তা না করে তারা ঈমান গ্রহণ করেছে। বরং এর অর্থ হচ্ছে, তারা এক ও লা-শরীক আল্লাহর ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকেই স্বীকার করে নিয়েছে। এমন আর কোন সত্তা নেই যে তাদের আদেশ দান করে আর তারাও তার আনুগত্য করে চলে। ঈমান গ্রহণকারী মানুষ যখন এ পথই গ্রহণ করলো তখন এত বড় জাতিগত পার্থক্য ও স্থানগত দূরত্ব সত্ত্বেও তাদের এবং ফেরেশতাদের মধ্যে একই দৃষ্টিভঙ্গিগত দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
৭.
অর্থাৎ তোমার বান্দার দুর্বলতা, বিচ্যুতি ও ভুল-ত্রুটি তোমার অজানা নয়। নিঃসন্দেহে তুমি সবকিছু জানো। কিন্তু তোমার জ্ঞানের মত তোমার রহমতও ব্যাপক ও বিস্তৃত। তাই তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি জানা সত্ত্বেও এই অসহায়দের ক্ষমা করে দাও। আরেকটি অর্থ এও হতে পারে যে, তোমার জ্ঞানানুসারে যাদের সম্পর্কে তুমি জান যে, তারা সরল মনে ‘তাওবা’ করেছে এবং প্রকৃতপক্ষে তোমার পথ অবলম্বন করেছে, দয়া ও রহমত দিয়ে তাদের সবাইকে ক্ষমা করে দাও।
৮.
ক্ষমা করা ও দোযখের আযাব থেকে রক্ষা করা যদিও পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং এর একটি কথা বলার পর বাহ্যত অপর কথাটি বলার কোন প্রয়োজন থাকে না। তবে এ বাচনভঙ্গি দ্বারা মূলত ঈমনদারদের প্রতি ফেরেশতাদের গভীর আগ্রহ প্রকাশ পায়। প্রচলিত নিয়ম হচ্ছে, কোন ব্যাপারে কারো মন যদি আকৃষ্ট হয় সে যখন শাসকের কাছে আবেদন জানানোর সুযোগ লাভ করে তখন একই আবেদনকে সে বার বার নানাভাবে মিনতি করে পেশ করতে থাকে। এক্ষেত্রে একটি কথা একবার মাত্র পেশ করে সে তৃপ্তি ও সান্ত্বনা পায় না।
৯.
অর্থাৎ অবাধ্যতা পরিত্যাগ করেছে, বিদ্রোহ থেকে বিরত হয়েছে এবং আনুগত্য গ্রহণ করে তোমার নিজের নির্দেশিত জীবন পথে চলতে শুরু করেছে।
.
১০.
একথাটির মধ্যেও সেই মিনতি ভরা আবেদনের সুস্পষ্ট ছাপ বিদ্যমান, যার প্রতি আমরা ওপরে ৮ নং টীকায় ইঙ্গিত দিয়েছি। একথা সুস্পষ্ট যে, ক্ষমা করা এবং দোযখ থেকে রক্ষা করা দ্বারা জান্নাতে প্রবেশ করার অর্থও আপনা আপনিই এবং অনিবার্যভাবেই প্রকাশ পায়। তাছাড়া আল্লাহ‌ তা’আলা নিজে ইমানদারদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মু’মিনদেরকে সেটি দেয়ার জন্য দোয়া করা বাহ্যত অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয় কিন্তু ফেরেশতাদের মনে ঈমানদারদের জন্য কল্যাণকামিতার এতটা আবেগ বিদ্যমান যে, তারা নিজেদের পক্ষ থেকে তাদের জন্য একাধারে কল্যাণ কামনা করে দোয়া করে যাচ্ছে। অথচ তারা জানে, আল্লাহ‌ তাদের প্রতি এসব অনুগ্রহ অবশ্যই করবেন।
১১.
অর্থাৎ তাদের চক্ষু শীতল করার জন্য তাদের মা-বাবা, স্ত্রী এবং সন্তান-সন্ততিদেরও তাদের সাথে একত্রিত করে দেবেন। জান্নাতে ঈমানদারদেরকে যেসব নিয়ামত দান করা হবে তার বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা নিজেও একথা বলেছেন। দেখুন, সূরা রা’দ, আয়াত ২৩ এবং সূরা তূর, আয়াত ২১। সূরা তূরের আয়াতে এ কথাও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, কেউ যদি জান্নাতে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হয় এবং তার মা, বাবা ও সন্তান-সন্ততি অনুরূপ মর্যাদার লাভ না করে তাহলে তাকে উচ্চ মর্যাদা থেকে নাযিয়ে তাদের সাথে মিলিত করার পরিবর্তে আল্লাহ‌ তা’আলা তার বাবা-মা ও সন্তান-সন্ততিকেই উচ্চ মর্যাদা দিয়ে তার পর্যায়ে উন্নীত করবেন।
.
১২.
سَيِّئَات (মন্দ কাজসমূহ) তিনটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। এখানে তিনটি অর্থই প্রযোজ্য। এক, ভুল আকীদা-বিশ্বাস, বিকৃত নৈতিক চরিত্র এবং মন্দ কাজ কর্ম। দুই, গোমরাহী ও মন্দ কাজের পরিণাম। তিন, বিপদাপদ ও দুঃখ কষ্ট-----তা এ পৃথিবীর হোক, আলমে বারযাখ বা মৃত্যুর পরের জীবনের হোক কিংবা কিয়ামতের দিনের হোক। ফেরেশতাদের দোয়ার লক্ষ্য হলো, যেসব জিনিস তাদের জন্য অকল্যাণকর সেরূপ প্রতিটি জিনিস থেকে তাদের রক্ষা করো।
১৩.
কিয়ামতের দিনের অকল্যাণ অর্থ হাশরের ময়দানের ভয়াবহতা ছাড়াও অন্যান্য আরাম-আয়েশ ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়া, হিসেবে-নিকেশের কঠোরতা, সমস্ত সৃষ্টির সামনে জীবনের গোপন বিষয়সমূহ প্রকাশ হয়ে যাওয়ার লাঞ্ছনা ও অপমান এবং সেখানে অপরাধীরা আর যেসব লাঞ্ছনা ও কষ্টের সম্মুখীন হবে তাও।
.
১৪.
অর্থাৎ কিয়ামতের দিন কাফেররা যখন দেখবে যে, তারা পৃথিবীতে শিরক, নাস্তিকতা, আখেরাত অস্বীকৃতি এবং নবী রসূলদের বিরোধিতার ওপর নিজেদের গোটা জীবনের তৎপরতার ভিত্তি স্থাপন করে যারপরনাই নির্বুদ্ধিতার কাজ করেছে এবং সে নির্বুদ্ধিতার কারণে এখন চরম অকল্যাণকর ও অশুভ পরিণামের সম্মুখীন হয়েছে তখন তারা নিজেদের আঙ্গুল কামড়াতে থাকবে এবং বিরক্ত হয়ে নিজেরাই নিজেদেরই অভিশাপ দিতে থাকবে। তখন ফেরেশতারা তাদের ডেকে বলবে, আজ তোমরা নিজেরাই নিজেদের ওপর অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হচ্ছো। কিন্তু ইতিপূর্বে পৃথিবীতে তোমাদেরকে এ পরিণাম থেকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহ‌ তা’আলা এবং সৎকর্মশীল লোকেরা সঠিক পথের দিকে আহবান জানাতেন আর তোমরা সে আহবান প্রত্যাখ্যান করতে তখন আল্লাহ‌ তা’আলার ক্রোধ এর চেয়েও বেশী করে প্রজ্জ্বলিত হতো।
১৫.
দু’বার মৃত্যু এবং দু’বার জীবন বলতে সূরা বাকারার ২৮ আয়াতে যা বলা হয়েছে তাই বুঝানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, তোমরা আল্লাহর সাথে কি কুফরী করো, অথচ তোমরা প্রাণহীন ছিলে, তিনি তোমাদের প্রাণ দান করেছেন। এরপর তিনি পুনরায় তোমাদের মৃত্যু দিবেন এবং পরে আবার জীবন দান করবেন। কাফেররা এসব ঘটনার প্রথম তিনটি অস্বীকার করে না। কারণ, ঐগুলো বাস্তবে প্রত্যক্ষ করা যায় এবং সেজন্য অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু তারা শেষোক্ত ঘটনাটির সংঘটন অস্বীকার করে। কারণ, এখনো পর্যন্ত তারা তা প্রত্যক্ষ করেনি এবং শুধু নবী-রসূলগণই এটির খবর দিয়েছেন। কিয়ামতের দিন এ চতুর্থ অবস্থাটিও তারা কার্যত দেখতে পাবে এবং তখন স্বীকার করবে যে, আমাদেরকে যে বিষয়ের খবর দেয়া হয়েছিলো তা প্রকৃতই সত্যে পরিণত হলো।
১৬.
অর্থাৎ এ দ্বিতীয় জীবনটির কথা অস্বীকার করে আমরা যে ভুল করেছি এবং এ ভ্রান্ত মতবাদ অনুসারে কাজ করে আমাদের জীবন যে পাপে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে তা আমরা স্বীকার করি।
১৭.
অর্থাৎ এখন আমরা আযাবের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মত যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি আমাদের পক্ষ থেকে অপরাধের স্বীকৃতিকে গ্রহণ করে তা থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন সম্ভাবনা কি আছে?
১৮.
অর্থাৎ যে আল্লাহর প্রভুত্ব মেনে নিতে তোমরা রাজি ছিলে না সেই একমাত্র অল্লাহর হাতেই এখন ফায়সালা। আর ইলাহী ক্ষমতা ও কর্তৃত্বে যাদেরকে অংশীদার বানাতে তোমরা জিদ ধরেছিলে, ফায়সালার ক্ষেত্রে এখন তাদের কোন হাত নেই। (একথাটা বুঝার জন্য সূরা যুমারের ৪৫ আয়াত এবং তার ৬৪ নং টীকার প্রতিও লক্ষ্য রাখতে হবে) এ আয়াতংশের মধ্যে আপনা থেকে এ অর্থও অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছে যে, এখন আযাবের এ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন পথও নেই। কারণ, তোমরা শুধু আখেরাত অস্বীকার করেছিলে তাই নয়, বরং তোমাদের স্রষ্টা ও পালনকর্তা আল্লাহর প্রতিও ছিল তোমাদের চরম বিদ্রূপভাব। তাছাড়া তাঁর সাথে অন্যদের শরীক করা ছাড়া তোমরা আদৌ কোন মানসিক তৃপ্তি লাভ করতে পারতে না।
১৯.
নিদর্শনসমূহ বলতে সেসব নিদর্শনকে বুঝানো হয়েছে যা থেকে এ বিশ্ব-জাহানের নির্মাতা, কারিগর, প্রশাসক ও ব্যবস্থাপক যে একমাত্র আল্লাহ‌ তা’আলা তা জানা যায়।
২০.
এখানে রিযিক অর্থ বৃষ্টিপাত। কেননা, মানুষ এ পৃথিবীতে যত প্রকার রিযিক লাভ করে থাকে তা সবই বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভর করে। আল্লাহ‌ তা’আলা তাঁর অসংখ্য নিদর্শনসমূহের মধ্য থেকে এ একটি মাত্র নিদর্শনের কথা তুলে ধরে এ মর্মে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে, তোমরা যদি কেবল এ একটি জিনিসের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করো তাহলে বুঝতে পারবে, কুরআনে তোমাদেরকে বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলা বিধানের যে ধারণা দেয়া হচ্ছে সেটিই বাস্তব ও সত্য। পৃথিবী ও তার সমস্ত সৃষ্টিকুল এবং পানি, বাতাস, সূর্য, উষ্ণতা ও শীতলতা সবকিছুর স্রষ্টা যদি একমাত্র আল্লাহ‌ হন কেবল সে ক্ষেত্রেই এ ধরনের ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলা বিধান সম্ভব। আর সে অনাদি অনন্ত আল্লাহই যদি চালু রাখেন কেবল তখনই এ ব্যবস্থা লক্ষ কোটি বছর পর্যন্ত একাধারে নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলতে পারে। এ ধরনের ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠাকারী কেবল একমাত্র আল্লাহই হতে পারেন যিনি মহাজ্ঞানী, অতি দয়াবান ও পালনকর্তা। যিনি পৃথিবীতে মানুষ, জীবজন্তু ও উদ্ভিদরাজি সৃষ্টি করার সাথে সাথে তাদের প্রয়োজন অনুসারে পানিও সৃষ্টি করেছেন এবং তা নিয়মিতভাবে পৃথিবী পৃষ্ঠে পৌঁছিয়ে দেয়া ও ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বিস্ময়কর এ ব্যবস্থাপনাও দিয়েছেন। যে ব্যক্তি এসব দেখে শুনেও আল্লাহকে অস্বীকার করে কিংবা আরো কিছু সত্তাকে তাঁর প্রভুত্বে অংশীদার বানায় তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হতে পারে?
২১.
অর্থাৎ আল্লাহ‌ বিমুখ ব্যক্তি যার জ্ঞান বুদ্ধির ওপর গাফলতি এবং গোঁড়ামি ও সংকীর্ণতার পর্দা পড়ে আছে সে কোন জিনিস দেখেও শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না। তার পশু-চক্ষু এ দৃশ্য অবশ্যই দেখবে যে, বাতাস বয়ে গেল, মেঘরাশি উড়ে আসলো, বিদ্যুৎ চমকালো ও বজ্র ধ্বনি হলো এবং বৃষ্টিপাত হলো কিন্তু তার মানবিক মন-মগজ ভেবে দেখবে না, এসব কেন হচ্ছে, কে করছে এবং আমার কাছে তার কি কি অধিকার ও প্রাপ্য রয়েছে।
২২.
দ্বীনকে আল্লাহর জন্য নিবেদিত করার বিস্তারিত ব্যাখ্যা সূরা যুমারের ৩ নং টীকায় করা হয়েছে।
.
২৩.
অর্থাৎ সমস্ত সৃষ্টি থেকে তার মর্যাদা অনেক উচ্চে। এ বিশ্ব-জাহানে বিদ্যমান কোন সত্তাই সে ফেরেশতা, নবী, অলী বা অন্য কোন সৃষ্টি যাই হোক না কেন আর তার মর্যাদা অন্য সব সৃষ্টিকুলের তুলনায় যত উচ্চ ও উন্নতই হোক না কেন, আল্লাহ‌ তা’আলার গুণাবলী এবং ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের তাঁর শরীক হওয়ার ধারণা করা তো দূরের কথা তাঁর সুউচ্চ মর্যাদার ধারে কাছে পৌঁছার কথাও কল্পনা করা যায় না।
২৪.
অর্থাৎ সমগ্র বিশ্ব-জাহানের বাদশাহ ও শাসক এবং এ সাম্রাজ্যের সিংহাসনের অধিপতি। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল আ’রাফ, টীকা ৪১; ইউনুস, টীকা ৪; আর রা’দ, টীকা ৩ ; ত্বা-হা, টীকা ২)।
২৫.
রূহ অর্থ অহী ও নবুওয়াত। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, আন-নাহল, টীকা ২ ; বনী ইসরাঈল, টীকা ১০৩।) আর “আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার ওপর ইচ্ছা এ রূহ নাযিল করেন।” এ বাণীর অর্থ হচ্ছে আল্লাহ‌র মেহেরবাণী ও অনুগ্রহের ওপর করো কোন ইজারাদারী নেই। অমুক ব্যক্তিকে সৌন্দর্য দান করা হয়েছে কেন এবং অমুক ব্যক্তিকে স্মরণ শক্তি বা অসাধারণ মেধা শক্তি দান করা হয়েছে কেন, একথা বলার অধিকার যেমন কেউ রাখে না, তেমনি কেউ একথা বলারও অধিকার রাখে না যে, অমুক ব্যক্তিকে নবুওয়াতের পদমর্যাদার জন্য বাছাই করা হয়েছে কেন এবং আমরা যাকে চাই তাকে নবী বানানো হয়নি কেন?
২৬.
অর্থাৎ যেদিন সমস্ত মানুষ, জিন ও শয়তান একই সময় তাদের রবের সামনে উপস্থিত হবে এবং তাদের কাজ-কর্মের সমস্ত সাক্ষীও উপস্থিত হবে।
.
২৭.
অর্থাৎ পৃথিবীতে তো বহু অহংকারী ভ্রান্ত লোক নিজেদের বাদশাহী ও শক্তিমত্তার ডঙ্কা বাজাতো আর বহু সংখ্যক নির্বোধ তাদের বাদশাহী ও শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করতো। এখন বলো প্রকৃতপক্ষে বাদশাহী কার? ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রকৃত মালিক কে? আর হুকুমই বা চলে কার? এটা এমন একটা বিষয় যে কোন ব্যক্তি যদি তা বুঝার চেষ্টা করে তাহলে সে যত বড় বাদশাহ কিংবা একনায়ক হয়ে থাকুক না কেন, ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে এবং তার মন-মগজ থেকে শক্তিমত্তার সমস্ত অহংকার উবে যাবে। এখানে ঐতিহাসিক এ ঘটনাটা উল্লেখ্য যে, সামানী খান্দানের শাসক নাসর ইবনে আহমাদ (৩০১-৩৩১হিঃ) নিশাপুরে প্রবেশ করলে একটি দরবার ডাকেন এবং সিংহাসনে বসার পর কুরআন মজীদ তিলাওয়াতের মাধ্যমে কাজকর্ম শুরু হবে বলে আদেশ দেন। একথা শুনে একজন সম্মানিত জ্ঞানী ব্যক্তি অগ্রসর হন এবং এ রুকূ’টি তিলাওয়াত করেন। যখন তিনি এ আয়াতটি তিলাওয়াত করছিলেন তখন নাসর ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি কাঁপতে কাঁপতে সিংহাসন থেকে নামলেন এবং মাথার মুকুট খুলে সিজদায় পড়ে বললেনঃ হে আমার প্রভু, বাদশাহী তোমারই, আমার নয়।
.
অনুবাদ: