আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১
আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২
আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২
আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩
আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭
আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১
আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০
আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭
আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০
আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২
আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫
হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২
ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২
আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮
বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪
আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫
আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮
আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০
আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫
আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫
আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০
আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭
ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১
আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬
ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭
আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০
আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯
আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২
আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০
আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬
এ মেয়েদের বাপের ব্যাপারে আমাদের এখানে এ কথা প্রচার হয়ে গেছে যে, তিনি ছিলেন হযরত শু’আইব আলাইহিস সালাম। কিন্তু কুরআন মজীদে ইশারা ইঙ্গিতে কোথাও এমন কথা বলা হয়নি যা থেকে বুঝা যেতে পারে তিনি শু’আইব আলাইহিস সালাম ছিলেন। অথচ শু’আইব আলাইহিস সালাম কুরআন মজীদে একটি পরিচিত ব্যক্তিত্ব। এ মেয়েদের পিতা যদি তিনিই হতেন তাহলে এখানে একথা সুস্পষ্ট না করে দেয়ার কোন কারণই ছিল না। নিঃসন্দেহে কোন কোন হাদীসে তাঁর নাম স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। কিন্তু আল্লামা ইবনে জারীর ও ইবনে কাসীর উভয়ে এ ব্যাপারে একমত যে, এগুলোর কোনটিরও সনদ তথা বর্ণনাসূত্র নির্ভুল নয়। তাই ইবনে আব্বাস, ইবনে বসরী, আবু উবাইদাহ ও সাঈদ ইবনে জুবাইরের ন্যায় বড় বড় তফসীরকারক বনী ইসরাইলের বর্ণনার ওপর নির্ভর করে তালমূদ ইত্যাদি গ্রন্থে এ মনীষীর যে নাম উল্লেখিত হয়েছে সেটিই বলেছেন। অন্যথায় বলা নিষ্প্রয়োজন, যদি নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হযরত শু’আইবের নাম স্পষ্ট করে বলা হতো তাহলে তাঁরা কখনো অন্য নাম উল্লেখ করতেন না।
বাইবেলের এক জায়গায় এ মনীষীর নাম বলা হয়েছে রূয়েল এবং অন্য জায়গায় বলা হয়েছে যিথ্রো এবং বলা হয়েছে তিনি মাদয়ানের যাজক ছিলেন। (যাত্রা পুস্তক ২: ১৬-১৮, ৩: ১ এবং ১৮: ৫) তালমূদীয় সাহিত্যে রূয়েল, যিথ্রো ও হুবাব তিনটি ভিন্ন ভিন্ন নাম বলা হয়েছে। আধুনিক ইহুদী আলেমগণের মতে যিথ্রো ছিল ‘হিজ এক্সেলেন্সী’ এর সমার্থক একটি উপাধি এবং আসল নাম ছিল রূয়েল বা হুবাব। অনুরূপভাবে কাহেন বা যাজক (Kohen Midian) শব্দটির ব্যাখ্যার ব্যাপারেও ইহুদী আলেমগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ একে পুরোহিত (Priest) বা এর সমার্থক হিসেবে নিয়েছেন আবার কেউ রইস বা আমীর (Prince) অর্থে নিয়েছেন।
তালমূদে তাঁর যে জীবন বৃত্তান্ত বর্ণনা করা হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, হযরত মূসার জন্মের পূর্বে ফেরাউনের কাছে তাঁর যাওয়া-আসা ছিল। ফেরাউন তাঁর জ্ঞান ও বিচক্ষণতার প্রতি আস্থা রাখতো। কিন্তু যখন বণী ইসরাঈলের ওপর জুলুম-শোষণ চালাবার জন্য মিশরের রাজ পরিষদে পরামর্শ হতে লাগলো এবং তাদের সন্তানদের জন্মের পর পরই হত্যা করার সিদ্ধান্ত হলো তখন তিনি ফেরাউনকে এ অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য অনেক চেষ্টা চালান। তাকে এ জুলুমের অশুভ পরিণামের ভয় দেখালেন। তিনি পরামর্শ দিলেন, এদের অস্তিত্ব যদি আপনার কাছে এতই অসহনীয় হয়ে থাকে তাহলে এদেরকে মিসর থেকে বের করে এদের পিতৃ পুরুষের দেশ কেনানের দিকে পাঠিয়ে দিন। তাঁর এ ভূমিকায় ফেরাউন তাঁর প্রতি অসন্তষ্ট হয়ে তাঁকে অপদস্থ করে নিজের দরবার থেকে বের করে দিয়েছিল। সে সময় থেকে তিনি নিজের দেশ মাদ্য়ানে চলে এসে সেখানেই অবস্থান করছিলেন।
তাঁর ধর্ম সম্পর্কে অনুমান করা হয়, হযরত মূসা আলাইহিস সালামের মতো তিনিও ইবরাহীমী দ্বীনের অনুসারী ছিলেন। কেননা, যেভাবে হযরত মূসা ছিলেন ইসহাক ইবনে ইবরাহীমের (আলাইহিস সালাম) আউলাদ ঠিক তেমনি তিনিও ছিলেন মাদ্য়ান ইবনে ইবরাহীমের বংশধর। এ সম্পর্কের কারণেই সম্ভবত তিনি ফেরাউনকে বনী ইসরাঈলের ওপর জুলুম-নির্যাতন-নিপীড়ন করতে নিষেধ করেন এবং তার বিরাগভাজন হন। কুরআন ব্যাখ্যাতা নিশাপুরী হযরত হাসান বাসরীর বরাত দিয়ে লিখেছেনঃ
أَنَّهُ كَانَ رَجُلاً مُسْلِمًا قَبْلَ الدَّيْنِ مِنْ شُعَيْبِ“তিনি একজন মুসলমান ছিলেন। হযরত শু’আইবের দ্বীন তিনি গ্রহণ করে নিয়েছিলেন।”
তালমূদে বলা হয়েছে, তিনি মাদ্য়ানবাসীদের মূর্তি পূজাকে প্রকাশ্যে নির্বুদ্ধিতা বলে সমালোচনা করতেন। তাই মাদয়ানবাসীরা তাঁর বিরোধী হয়ে গিয়েছিল।
جائت تمشى على استحياء قائلة بثوبها على وجهها ليست بسلفع من النساء دلاجة خراجة-
“সে নিজের মুখ ঘোমটার আড়ালে লুকিয়ে লজ্জাজড়িত পায়ে হেঁটে এলো। সেই সব ধিংগি চপলা মেয়েদের মতো হন হন করে ছুটে আসেনি, যারা যেদিকে ইচ্ছা যায় এবং যেখানে খুশী ঢুকে পড়ে।”
এ বিষয়বস্তু সম্বলিত কয়েকটি রেওয়ায়েত সাঈদ ইবনে মানসুর, ইবনে জারীর, ইবনে আবী হাতেম ও ইবনুল মুনযির নির্ভরযোগ্য সনদ সহকারে উমর থেকে উদ্ধৃত করেছেন। এ থেকে পরিষ্কার জানা যায়, সাহাবায়ে কেরামের যুগে কুরআন ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বদৌলতে এ মনীষীগণ লজ্জাশীলতার ইসলামী ধারণা লাভ করেছিলেন তা অপরিচিত ও ভিন্ পুরুষদের সামনে চেহারা খুলে রেখে ঘোরাফেরা করা এবং বেপরোয়াভাবে ঘরের বাইরে চলাফেরা করার সম্পূর্ণ বিরোধী ছিল। হযরত উমর (রা) পরিষ্কার ভাষায় এখানে চেহারা ঢেকে রাখাকে লজ্জাশীলতার চিহ্ন এবং তা ভিন পুরুষের সামনে উন্মুক্ত রাখাকে নির্লজ্জতা গণ্য করেছেন।
এখানে দেখুন বনী ইসরাঈলের আর একটি কীর্তি। তারা তাদের মহান মর্যাদাসম্পন্ন নবী এবং নিজেদের সবচেয়ে বড় হিতকারী ও জাতীয় হিরোর কী দুর্গতি করেছে। তালমূদে বলা হয়েছে, “মূসা রূয়েলের বাড়িতে অবস্থান করতে থাকেন। তিনি নিজের মেজবানের মেয়ে সাফুরার প্রতি অনুগ্রহ দৃষ্টি দিচ্ছিলেন। এমনকি শেষ পর্যন্ত তিনি তাকে বিয়ে করলেন।” আর একটি ইহুদী বর্ণনা জুয়িশ ইনসাইক্লোপিডিয়ায় উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, “হযরত মূসা যখন যিথ্রোকে সমস্ত ঘটনা শুনালেন তখন তিনি বুঝতে পারলেন এ ব্যক্তির হাতেই ফেরাউনের রাজ্য ধ্বংস হবার ভবিষ্যতবানী করা হয়েছিল। তাই তিনি সঙ্গে সঙ্গেই হযরত মূসাকে বন্দী করে ফেললেন, যাতে তাঁকে ফেরাউনের হাতে সোপর্দ করে দিয়ে পুরস্কার লাভ করতে পারেন। সাত বা দশ বছর পর্যন্ত তিনি তার বন্দীশালায় থাকলেন। ভূ-গর্ভস্থ একটি অন্ধকার কুঠুরীতে তিনি বন্দী ছিলেন। কিন্তু যিথ্রোর মেয়ে যাফূরা (বা সাফূরা), যার সাথে কূয়ার পাড়ে তাঁর প্রথম সাক্ষাত হয়েছিল, চুপি চুপি তার সাথে কারাগৃহে সাক্ষাত করতে থাকে। সে তাঁকে খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ করতো। তাদের দু’জনের মধ্যে বিয়ের গোপন চুক্তি হয়ে গিয়েছিল। সাত বা দশ বছর পর যাফূরা তার বাপকে বললো এত দীর্ঘকাল হয়ে গেল আপনি এক ব্যক্তিকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছিলেন এবং তারপর তার কোন খবরও নেননি। এতদিন তার মরে যাবারই কথা। কিন্তু যদি জীবিত থাকে তাহলে নিশ্চয়ই সে কোন আল্লাহ ওয়ালা ব্যক্তি। যিথ্রো তার একথা শুনে কারাগারে গেলেন। সেখানে হযরত মূসাকে জীবিত থাকতে দেখে তার মনে বিশ্বাস জন্মালো অলৌকিকতার মাধ্যমে এ ব্যক্তি জীবিত আছে। তখন তিনি যাফূরার সাথে তার বিয়ে দিয়ে দিলেন।”
যেসব পাশ্চাত্য প্রাচ্যবিদ কুরআনী কাহিনীগুলোর উৎস খুঁজে বেড়ান, কুরআনী বর্ণনা ও ইসরাঈলী বর্ণনার মধ্যে এই যে সুস্পষ্ট পার্থক্য এখানে দেখা যাচ্ছে তা কি কখনো তাদের চোখে পড়ে?
ঘটনার বিন্যাসের দিক দিয়ে বাইবেলের বর্ণনা এখানে কুরআন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বাইবেল বলে, হযরত মূসা তাঁর শশুরের ছাগল চরাতে চরাতে “প্রান্তরের পশ্চাদ্ভাগে মেষপালক লইয়া গিয়া হোরেবে ঈশ্বরের পর্বতে” চলে গিয়েছিলেন। তারপর তিনি নিজের শশুরের কাছে ফিরে গিয়েছিলেন। এবং তাঁর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নিজের সন্তান-সন্ততি সহকারে মিসরের পথে যাত্রা করেছিলেন। (যাত্রা পুস্তক ৩:১ এবং ৪:১৮) অপরদিকে কুরআন বলে, হযরত মূসা মেয়াদ পুরা করার পর নিজের পরিবার পরিজন নিয়ে মাদয়ান থেকে রওয়ানা হয়েছিলেন এবং এ সফরে আল্লাহর সাথে কথাবার্তা এবং নবুওয়াতের দায়িত্ব লাভ করার ঘটনা সংঘটিত হয়েছিলেন।
বাইবেল ও তালমূদের সম্মিলিত বর্ণনা হচ্ছে, যে ফেরাউনের পরিবারের হযরত মূসা প্রতিপালিত হয়েছিলেন তাঁর মাদয়ানে অবস্থানকালে সে মারা গিয়েছিল এবং তারপর অন্য একজন ফেরাউন ছিল মিসরের শাসক।
বাহু বা হাত বলতে সম্ভবত ডান হাত বুঝানো হয়েছে। কারণ সাধারণভাবে হাত বললে ডান হাতই বুঝানো হয়। চেপে ধরা দু’রকম হতে পারে। এক, হাত পার্শ্বদেশের সাথে লাপিয়ে চাপ দেওয়া। দুই, এক হাতকে অন্য হাতের বগলের মধ্যে রেখে চাপ দেয়া। এখানে প্রথম অবস্থাটি প্রযোজ্য হবার সম্ভাবনা বেশি। কারণ এ অবস্থায় অন্য কোন ব্যক্তি অনুভব করতে পারবে না যে, এ ব্যক্তি মনের ভয় দূর করার জন্য কোন বিশেষ কাজ করছে।
হযরত মূসাকে যেহেতু একটি জালেম সরকারের মোকাবিলা করার জন্য কোন সৈন্য সামন্ত ও পার্থিব সাজ-সরঞ্জাম ছাড়াই পাঠানো হচ্ছিলো তাই তাঁকে এ ব্যবস্থা অবলম্বন করতে বলা হয়। বার বার এমন ভয়ানক ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিলো যাতে একজন মহান দৃঢ়চেতা নবীও আতংকমুক্ত থাকতে পারতেন না। মহান আল্লাহ বলেন, এ ধরণের কোন অবস্থা দেখা দিলে তুমি স্রেফ এ কাজটি করো, ফেরাউন তার সমগ্র রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করেও তোমার মনের জোর শিথিল করতে পারবে না।
وَإِذْ نَادَى رَبُّكَ مُوسَى أَنِ ائْتِ الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ - قَوْمَ فِرْعَوْنَ
“যখন তোমার রব মূসাকে ডেকে বললেন, যাও জালেম জাতির কাছে, ফেরাউনের জাতির কাছে।”