পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

১৯০ আয়াত

৪৯ ) হে মুহাম্মাদ! বলে দাও, “ওহে লোকেরা, আমি তো তোমাদের জন্য শুধুমাত্র (খারাপ সময় আসার আগেই) একজন সুস্পষ্ট সতর্ককারী। ৯৪
قُلْ يَـٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنَّمَآ أَنَا۠ لَكُمْ نَذِيرٌۭ مُّبِينٌۭ ٤٩
৫০ ) কাজেই যারা ঈমান আনবে ও সৎকাজ করবে তাদের জন্য রয়েছে মাগফেরাত ও সম্মানজনক জীবিকা। ৯৫
فَٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ لَهُم مَّغْفِرَةٌۭ وَرِزْقٌۭ كَرِيمٌۭ ٥٠
৫১ ) আর যারা আমার আয়াতকে খাটো করার চেষ্টা করবে তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী।
وَٱلَّذِينَ سَعَوْا۟ فِىٓ ءَايَـٰتِنَا مُعَـٰجِزِينَ أُو۟لَـٰٓئِكَ أَصْحَـٰبُ ٱلْجَحِيمِ ٥١
৫২ ) আর হে মুহাম্মাদ! তোমার পূর্বে আমি এমন কোন রসূল ও নবী পাঠাইনি ৯৬ (যার সাথে এমন ঘটনা ঘটেনি যে) যখন সে তামান্না করেছে। ৯৭ শয়তান তার তামান্নায় বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে। ৯৮ এভাবে শয়তান যা কিছু বিঘ্ন সৃষ্টি করে আল্লাহ‌ তা দূর করে দেন এবং নিজের আয়াতসমূহকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন, ৯৯ আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়। ১০০
وَمَآ أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن رَّسُولٍۢ وَلَا نَبِىٍّ إِلَّآ إِذَا تَمَنَّىٰٓ أَلْقَى ٱلشَّيْطَـٰنُ فِىٓ أُمْنِيَّتِهِۦ فَيَنسَخُ ٱللَّهُ مَا يُلْقِى ٱلشَّيْطَـٰنُ ثُمَّ يُحْكِمُ ٱللَّهُ ءَايَـٰتِهِۦ ۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌۭ ٥٢
৫৩ ) (তিনি এজন্য এমনটি হতে দেন) যাতে শয়তানের নিক্ষিপ্ত অনিষ্টকে পরীক্ষায় পরিণত করেন তাদের জন্য যাদের অন্তরে (মুনাফিকীর) রোগ রয়েছে এবং যাদের হৃদয়বৃত্তি মিথ্যা-কলূষিত--- আসলে এ জালেমরা শত্রুতায় অনেক দূরে পৌঁছে গেছে---
لِّيَجْعَلَ مَا يُلْقِى ٱلشَّيْطَـٰنُ فِتْنَةًۭ لِّلَّذِينَ فِى قُلُوبِهِم مَّرَضٌۭ وَٱلْقَاسِيَةِ قُلُوبُهُمْ ۗ وَإِنَّ ٱلظَّـٰلِمِينَ لَفِى شِقَاقٍۭ بَعِيدٍۢ ٥٣
৫৪ ) এবং যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে তারা জেনে নেয় যে, তোমার রবের পক্ষ থেকে এটা সত্য এবং তারা এর প্রতি ঈমান আনে এবং এর সামনে তাদের অন্তর ঝুঁকে পড়ে; যারা ঈমান আনে তাদেরকে অবশ্যই আল্লাহ চিরকাল সত্য-সরল পথ দেখিয়ে থাকেন। ১০১
وَلِيَعْلَمَ ٱلَّذِينَ أُوتُوا۟ ٱلْعِلْمَ أَنَّهُ ٱلْحَقُّ مِن رَّبِّكَ فَيُؤْمِنُوا۟ بِهِۦ فَتُخْبِتَ لَهُۥ قُلُوبُهُمْ ۗ وَإِنَّ ٱللَّهَ لَهَادِ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓا۟ إِلَىٰ صِرَٰطٍۢ مُّسْتَقِيمٍۢ ٥٤
৫৫ ) অস্বীকারকারীরা তো তার পক্ষ থেকে সন্দেহের মধ্যেই পড়ে থাকবে যতক্ষণ না তাদের ওপর কিয়ামত এসে পড়বে অকস্মাত অথবা নাযিল হয়ে যাবে একটি ভাগ্যাহত ১০২ দিনের শাস্তি।
وَلَا يَزَالُ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ فِى مِرْيَةٍۢ مِّنْهُ حَتَّىٰ تَأْتِيَهُمُ ٱلسَّاعَةُ بَغْتَةً أَوْ يَأْتِيَهُمْ عَذَابُ يَوْمٍ عَقِيمٍ ٥٥
৫৬ ) সেদিন বাদশাহী হবে আল্লাহর এবং তিনি তাদের মধ্যে ফায়সালা করে দেবেন। যারা ঈমানদার ও সৎকর্মশীল হবে তারা যাবে নিয়ামত পরিপূর্ণ জান্নাতে
ٱلْمُلْكُ يَوْمَئِذٍۢ لِّلَّهِ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ ۚ فَٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ فِى جَنَّـٰتِ ٱلنَّعِيمِ ٥٦
৫৭ ) আর যারা কুফরী করে থাকবে এবং আমার আয়াতকে মিথ্যা বলে থাকবে তাদের জন্য হবে লাঞ্ছনাকর শাস্তি।
وَٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ وَكَذَّبُوا۟ بِـَٔايَـٰتِنَا فَأُو۟لَـٰٓئِكَ لَهُمْ عَذَابٌۭ مُّهِينٌۭ ٥٧
৫৮ ) আর যারা আল্লাহর পথে হিজরত করেছে তারপর নিহত হয়েছে বা মারা গেছে, আল্লাহ‌ তাদেরকে ভালো জীবিকা দেবেন এবং নিশ্চয়ই আল্লাহই সবচেয়ে ভালো রিযিকদাতা।
وَٱلَّذِينَ هَاجَرُوا۟ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ ثُمَّ قُتِلُوٓا۟ أَوْ مَاتُوا۟ لَيَرْزُقَنَّهُمُ ٱللَّهُ رِزْقًا حَسَنًۭا ۚ وَإِنَّ ٱللَّهَ لَهُوَ خَيْرُ ٱلرَّٰزِقِينَ ٥٨
৯৪.
আমি তোমাদের ভাগ্য নির্ণায়ক নই বরং একজন সতর্ককারী মাত্র। সর্বনাশ ঘটার আগে তোমাদের সতর্ক করে দেয়াই আমার কাজ, এর বেশী কোন দায়িত্ব আমার ওপর নেই। পরবর্তী ফায়সালা করা আল্লাহর কাজ। তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন কাকে কতদিন পর্যন্ত অবকাশ দেবেন এবং কবে কোন্ অবস্থায় শাস্তি দেবেন।
৯৫.
“মাগফেরাত” বলতে বুঝানো হয়েছে অপরাধ, পাপ, ভুল-ভ্রান্তি ও দুর্বলতা উপেক্ষা করা ও এড়িয়ে চলা। আর “সম্মানজনক জীবিকা”র দু’টি অর্থ হয়। প্রথমত, উত্তম জীবিকা দেয়া এবং দ্বিতীয়ত, মর্যাদার সাথে প্রতিষ্ঠিত করে জীবিকা দেয়া।
.
৯৬.
রসূল ও নবীর মধ্যে পার্থক্যের ব্যাপারটির ব্যাখ্যা সূরা মারয়ামের ৩০ টীকায় আলোচিত হয়েছে।
৯৭.
মূল শব্দটি হচ্ছে, تَمَنَّى (তামান্না)। আরবী ভাষায় এ শব্দটি দু’টি অর্থে ব্যবহৃত হয়। একটি অর্থ হচ্ছে কোন জিনিসের আশা-আকাংখা করা। দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে তেলাওয়াত অর্থাৎ কিছু পাঠ করা।
৯৮.
“তামান্না” শব্দটি যদি প্রথম অর্থ গ্রহণ করা হয় তাহলে এর অর্থ হবে, শয়তানও তার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হবার পথে বাধার সৃষ্টি করে। আর দ্বিতীয় অর্থে গ্রহণ করলে এর অর্থ হবে, যখনই তিনি লোকদেরকে আল্লাহর বাণী শুনিয়েছেন তখনই শয়তান সে সম্পর্কে লোকদের মনে নানা সন্দেহ-সংশয় ও আপত্তি সৃষ্টি করে দিয়েছে, সেগুলোর অদ্ভূত অদ্ভূত অর্থ তাদের সামনে তুলে ধরেছে এবং একমাত্র সঠিক অর্থটি ছাড়া বাকি সব ধরনের উল্টা-পাল্টা অর্থ লোকদেরকে বুঝিয়েছে।
৯৯.
প্রথম অর্থটির দৃষ্টিতে এর তাৎপর্য হবে এই যে, আল্লাহ শয়তানের বিঘ্ন সৃষ্টি সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত নবীর তামান্না তথা আশা-আকাঙ্ক্ষা (আর নবীর আশা-আকাংখা এছাড়া আর কি হতে পারে যে, তাঁর প্রচেষ্টা ফলবতী এবং মিশন বাস্তবায়িত হবে) পূর্ণ করেন এবং নিজের আয়াতকে (অর্থাৎ নবীর সাথে অঙ্গীকার করেছিলেন) পাকাপোক্ত ও মজবুত অঙ্গীকারে পরিণত করেন। দ্বিতীয় অর্থটির দৃষ্টিতে এর তৎপর্য হবে, শয়তানের ঢুকানো সন্দেহ-সংশয় ও আপত্তি আল্লাহ দূর করে দেন এবং এক একটি আয়াত সম্পর্কে সে লোকদের মনে যেসব জটিলতা সৃষ্টি করে পরবর্তী কোন অধিকতর সুস্পষ্ট আয়াতের মাধ্যমে সেগুলো পরিষ্কার করে দেয়া হয়।
১০০.
অর্থাৎ তিনি জানেন শয়তান কোথায় কি বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে এবং তার কি প্রভাব পড়েছে। তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা শয়তানী ফিতনার প্রতিবিধান করে।
.
১০১.
অর্থাৎ শয়তানের ফিতনাবাজীকে আল্লাহ লোকদের জন্য পরীক্ষা এবং নকল থেকে আসলকে আলাদ করার একটা মাধ্যমে পরিণত করেছেন। বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন লোকেরা এসব জিনিস থেকে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং এগুলো তাদের জন্য ভ্রষ্টতর উপকরণে পরিণত হয়। অন্যদিকে স্বচ্ছ চিন্তার অধিকারী লোকেরা এসব কথা থেকে নবী ও আল্লাহর কিতাবের সত্য হবার দৃঢ় প্রত্যয় লাভ করে এবং তারা অনুভব করতে থাকে যে, এগুলো শয়তানের অনিষ্টকর কার্যকলাপ। এ জিনিসটি তাদেরকে একদম নিশ্চিন্ত করে দেয় যে, এটি নির্ঘাত কল্যাণ ও সত্যের দাওয়াত, নয়তো শয়তান এতে এতো বেশী অস্থির হয়ে পড়তো না।

বক্তব্য পরম্পরা সামনে রাখলে এ আয়াতগুলোর অর্থ পরিষ্কার বুঝা যায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত এ সময় যে পর্যায়ে ছিল তা দেখে বাহ্যজ্ঞান সম্পন্ন লোকেরা বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। তারা মনে করছিল তিনি নিজের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয়েছেন। সাধারণ দর্শকরা এটাই দেখছিল যে, এক ব্যক্তির বিপুল আকাঙ্ক্ষা ছিল। তিনি আশা করছিলেন তাঁর জাতি তাঁর প্রতি ঈমান আনবে। তের বছর ধরে নাউযুবিল্লাহ অনেক মাথা খোড়ার পর তিনি শেষমেশ নিজের মুষ্টিমেয় কয়েকজন সঙ্গী সাথী নিয়ে প্রিয় স্বদেশভূমি থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য হলেন। এ অবস্থায় লোকেরা যখন তাঁর এ বক্তব্য দেখতো যেখানে তিনি বলছেন, আমি আল্লাহর নবী এবং তিনি আমাকে সাহায্য-সহায়তা দান করছেন আর এ সঙ্গে কুরআনের এ ঘোষণাবলীও দেখতো, যাতে বলা হয়েছে, নবীর প্রতি মিথ্যা আরোপকারী জাতি আল্লাহর আযাবের সুম্মখীন হয় তখন তাদের কাছে তাঁর ও কুরআনের সত্যতা সংশয়িত হয়ে যেতো। তাঁর বিরোধীরা এর ফলে গায়ে পড়ে নানা কথা বলতো। তারা বলতো, কোথায় গেলো সে আল্লাহর সাহায্য-সহায়তা? কি হলো সে শাস্তির ভয় দেখাবার? আমাদের যে আযাবের ভয় দেখানো হতো তা এখন আসে না কেন? এর আগের আয়াতগুলোতে এসব কথার জবাব দেয়া হয়েছিল। এবং এরই জবাবে এ আয়াত নাযিল হয়েছে। আগের আয়াতগুলোতে জবাবের লক্ষ্য ছিল কাফেররা এবং এ আয়াতগুলোতে এর লক্ষ্য হচ্ছে এমন সব লোক যারা কফেরদের প্রচারণায় প্রভাবিত হচ্ছিল। সমগ্র জবাবের সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছেঃ

“কোন জাতি কর্তৃক তার নবীর প্রতি মিথ্যা আরোপ করার ব্যাপারটি ইতিহাসে কোন নতুন ঘটনা নয়। ইতিপূর্বেও এমনটিই হয়েছে। তারপর এ মিথ্যা আরোপের পরিণাম ও ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের আকারে তোমাদের সামনে রয়েছে। শিক্ষা নিতে চাইলে এ থেকে নিতে পারো। তবে মিথ্যা আরোপ এবং নবীর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করার সাথে সাথেই কুরআনের অসংখ্য আয়াতে যে আযাবের ভয় দেখানো হয়েছে তা শুরু হয়ে যায়নি কেন, এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, প্রত্যেকটি প্রত্যাখ্যান সঙ্গে সঙ্গেই আযাব নিয়ে আসে একথা কবে বলা হয়েছিল? আর আযাব নিয়ে আসা নবীর নিজের কাজ একথাই বা তিনি কবে বলেছিলেন? এর ফায়সালা তো আল্লাহ নিজেই করেন এবং তিনি তাড়াহুড়া করে কাজ করেন না। ইতিপূর্বেও তিনি আযাব নাযিল করার আগে জাতিগুলোকে অবকাশ দিয়ে এসেছেন এবং এখনো দিচ্ছেন। এ অবকাশকাল যদি শত শত বছর পর্যন্তও দীর্ঘ হয় তাহলে এ থেকে নবীর দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারীদের প্রতি আযাব নাযিলের হুমকি দেয়া হয়েছিল তা অন্তঃসারশূন্য প্রমাণিত হয় না।

তারপর নবীর আশা-আকাংখা পূর্ণ হবার পথে বাধার সৃষ্টি হওয়া বা তাঁর দাওয়াতের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ এবং বিভিন্ন প্রকার সন্দেহ-সংশয়-আপত্তির প্রবল ঝড় সৃষ্টি হওয়াও কোন নতুন কথা নয়। পূর্বে সকল নবীর দাওয়াতের মোকাবিলায় এসব কিছুই হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মহান আল্লাহ এসব শয়তানী ফিতনার মুলোচ্ছেদ করেছেন। বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও সত্যের দাওয়াত সম্প্রসারিত হয়েছে। সুস্পষ্ট ও বিস্তারিত আয়াতের মাধ্যমে সন্দেহ-সংশয়ের বিঘ্ন দূরীভূত হয়েছে। শয়তান ও তার সাংগ পাংগরা এসব কৌশল অবলম্বন করে আল্লাহর আয়াতকে মর্যাদাহীন করতে চেয়েছে। কিন্তু আল্লাহ সেগুলোকেই মানুষের মধ্যে আসল ও নকলের পার্থক্য করার মাধ্যমে পরিণত করেছেন। এ পথেই আসল ও নির্ভেজাল মানুষেরা সত্যের দাওয়াতের দিকে এগিয়ে আসে এবং ভেজাল ও মেকী লোকেরা ছাঁটাই হয়ে আলাদা হয়ে যায়।”

পূর্বাপর বক্তব্যের আলোকে এ হচ্ছে এ আয়াতগুলোর পরিষ্কার ও সহজ-সরল অর্থ। কিন্তু দুঃখের বিষয় একটি রেওয়ায়াত এ আয়াতগুলোর ব্যাখ্যার মধ্যে এমন জটিলতা সৃষ্টি করে দিয়েছে যার ফলে কেবল এদের অর্থেরই আমূল পরিবর্তন ঘটেনি বরং সমগ্র দ্বীনের বুনিয়াদই বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। এখানে আমি এর আলোচনা এজন্য করছি যে, কুরআনের জ্ঞানানুশীলনকারীকে অবশ্যই কুরআনের অর্থ ও তাৎপর্য অনুধাবন করার ক্ষেত্রে রেওয়ায়াতের সাহায্য গ্রহণ করার সঠিক ও বেঠিক পদ্ধতিগুলোর পার্থক্য ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে এবং তাদের জানতে হবে রেওয়ায়াতের প্রতি মর্যাদা প্রদানের ক্ষেত্রে অবৈধ বাড়াবাড়ির ফল কি হয় এবং কুরআনের ভুল ব্যাখ্যা প্রদানকারী রেওয়ায়াত যাচাই করার সঠিক পদ্ধতি কি।

ঘটনা এভাবে বর্ণনা করা হয় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মনে আকাঙ্ক্ষা জাগে, আহা, যদি কুরআনে এমন কোন আয়াত নাযিল হতো যার ফলে ইসলামের বিরুদ্ধে কুরাইশ বংশীয় কাফেরদের ঘৃণা দূর হয়ে যেতো এবং তারা কিছুটা কাছাকাছি এসে যেতো! অথবা কমপক্ষে তাদের ধর্মের বিরুদ্ধে এমন কড়া সমালোচনা না হতো যা তাদেরকে উত্তেজিত করে। এ আকাঙ্ক্ষা তাঁর মনের মধ্যেই ছিল এমন সময় একদিন কুরাইশদের একটি বড় মজলিসে বসে থাকা অবস্থায় তাঁর ওপর সূরা নজম নাযিল হয় এবং তিনি তা পড়তে শুরু করেন। যখন তিনি أَفَرَأَيْتُمُ اللَّاتَ وَالْعُزَّى - وَمَنَاةَ الثَّالِثَةَ الْأُخْرَى আয়াতে পৌঁছেন তখন হঠাৎ তাঁর মুখ থেকে নাকি বের হয়ে যায়ঃ تلك الغرائقة العلى وان شفاعتهن لترجى (এরা মহিয়সী দেবী, এদের সুপারিশ অবশ্যই কাংখিত) এরপর তিনি সামনের দিকে সূরা নজমের আয়াতগুলো পড়ে যেতে থাকেন। এমনকি সূরা শেষে যখন তিনি সিজদা করেন তখন মুশরিক মুসলিম নির্বিশেষে সবাই সিজদা করে। কুরাইশ বংশীয় কাফেররা বলতে থাকে, এখন আর মুহাম্মাদের সাথে আমাদের কোন বিরোধ নেই। আমরাও তো এ কথাই বলতাম, আল্লাহ হচ্ছেন সৃষ্টিকর্তা ও রিযিকদাতা আর আমাদের এ দেবদেবীরা তাঁর দরবারে আমাদের জন্য সুপারিশকারী। সন্ধ্যায় জিব্রীল আসেন। তিনি বলেন, এ আপনি কি করলেন? এ দু’টি বাক্য তো আমি নিয়ে আসিনি। এতে তিনি বড়ই দুঃখ ভারাক্রান্ত হন। তখন মহান আল্লাহ সূরা বনী ইসরাঈলের ৮ রুকূ’র নিম্নোক্ত আয়াতটি নাযিল করেনঃ

وَإِنْ كَادُوا لَيَفْتِنُونَكَ عَنِ الَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ لِتَفْتَرِيَ عَلَيْنَا غَيْرَهُ ............... ثُمَّ لَا تَجِدُ لَكَ عَلَيْنَا نَصِيرًا

এ বিষয়টি সব সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুঃখ ভারাক্রান্ত করে রাখে। শেষে সূরা হজ্জের এ আয়াতটি নাযিল হয় এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ মর্মে সান্ত্বনা দেয়া হয় যে, তোমার পূর্বেও নবীদের সাথে এমনিতর ঘটনা ঘটতে থেকেছে। ওদিকে কুরআন শুনে কুরাইশের লোকেরাও নবীর ﷺ সাথে সিজদা করেছে এ ঘটনাটি হাবশার মুহাজিরদের কাছেও এভাবে পৌঁছে যায় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে সাথে মক্কার কাফেরদের সমঝোতা হয়ে গেছে তাই বহু মুহাজির মক্কায় ফিরে আসেন। কিন্তু এখানে এসে তারা জানতে পারেন সমঝোতা ও সন্ধির খবরটি ভুল ছিল, ইসলাম ও কুফরের শত্রুতা আগের মতই অপরিবর্তিত আছে।

এ ঘটনাটি ইবনে জারীর ও অন্যান্য বহু তাফসীরকার নিজেদের তাফসীর গন্থে, ইবনে সা’দ তাবকাতে আল ওয়াহেদী, আসবাবুন নুযুলে, মূসা ইবনে উকবাহ মাগাযীতে, ইবনে ইসহাক সীরাতে এবং ইবনে আবূ হাতেম, ইবনুল মুনযির, বাযযার, ইবনে মারদুইয়া ও তাবারানী নিজেদের হাদীস সংকলনে উদ্ধৃত করেছেন। যেসব বর্ণনা পরম্পরায় এ ঘটনাটি উদ্ধৃত হয়েছে সেগুলো মুহাম্মাদ ইবনে কায়েস, মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব কুরযী, উরওয়াহ ইবনে যুবাইর, আবু সালেহ, আবুল আলীয়াহ, সা’ঈদ ইবনে জুবাইর, দ্বাহহাক, আবু বকর ইবনে আবদুর রহমান ইবনে হারেস, কাতাদাহ, মুজাহিদ, সুদ্দী, ইবনে শিহাব, যুহরী ও ইবনে আব্বাস পর্যন্ত এসে শেষ হয়েছে। (উল্লেখ্য, ইবনে আব্বাস ছাড়া এঁদের মধ্যে আর একজনও সাহাবী নেই।) ঘটনাটির বিস্তারিত বর্ণনা ক্ষেত্রে সামান্য ছোট-খাটো বিরোধ ও অসামঞ্জস্য বাদ দিলেও দু’টি বড় বড় বিরোধ দেখা যায়। একটি হচ্ছে, মূর্তির প্রশংসায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ থেকে যেসব শব্দ বেরিয়েছে বলে বর্ণনা করা হয়েছে তা প্রায় প্রত্যেক বর্ণনায় অন্য বর্ণনা থেকে আলাদা। আমি এগুলো একত্র করার চেষ্টা করেছি। ফলে পনেরটি ইবারতে আলাদা শব্দ পেয়েছি। দ্বিতীয় বড় বিরোধটি হচ্ছে, কোন্ বর্ণনার প্রেক্ষিতে এ শব্দগুলো অহীর মাঝখানে শয়তান তাঁর মনে ঢুকিয়ে দেয় এবং তিনি মনে করেন এও বুঝি জিব্রীল এনেছেন। কোন বর্ণনায় বলা হয়েছে, এ শব্দগুলো নিজের পূর্বের বাসনার প্রভাবে ভুলক্রমে তাঁর মুখ থেকে বের হয়ে গেছে। কোনটায় বলা হয়েছে, সে সময় তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন এবং এ অবস্থায় এ শব্দগুলো তাঁর কন্ঠ থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। করোর বর্ণনা হচ্ছে, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে একথা বলেন কিন্তু অস্বীকারমূলক জিজ্ঞাসা হিসেবেই বলেন। কারো বক্তব্য হচ্ছে, শয়তান তাঁর আওয়াজের সাথে আওয়াজ মিলিয়ে এ শব্দগুলো বলে দেয় এবং মনে করা হয় তিনি এগুলো বলেছেন। আবার কারো মতে মুশরিকদের মধ্য থেকে কেউ একথা বলে।

ইবনে কাসীর, বাইহাকী, কাযী আইয়ায, ইবনে খুযাইমা, কাযী আবু বকর ইবনুল আরাবী, ইমাম রাযী, কুরতুবী, বদরুদ্দীন আইনী, শাওকানী, আলূসী প্রমুখ মহোদয়গণ এ ঘটনাটিকে সম্পূর্ণ মিথ্যা গণ্য করেন। ইবনে কাসীর বলেন, “যতগুলো সনদের মাধ্যমে এ হাদীসটি বর্ণনা করা হয়েছে সবগুলোই মুরসাল১ ও মুনকাতে২। কোন সহীহ মুত্তাসিল৩ সনদের মাধ্যমে এ হাদীসটি আমি পাইনি।” বাইহাকী বলেন, “হাদীস বিচারের যথার্থ পদ্ধতিতে এ ঘটনাটি প্রমাণিত নয়।” ইবনে খুযাইমাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয়, তাতে তিনি বলেন, “এটি যিনদিকদের (যরোথুষ্ট্রীয়পন্থী নাস্তিক্যবাদী গোষ্ঠী) তৈরি করা।” কাযী আইয়ায বলেন, “এর দুর্বলতা এখান থেকেই সুস্পষ্ট যে, সিহাহে সিত্তার৪ লেখকদের একজনও নিজের গন্থে একে স্থান দেননি এবং কোন সহীহ্ মুত্তাসিল ত্রুটিমুক্ত সনদ সহকারে নির্ভরযোগ্য রাবীদের মাধ্যমেও এটি উদ্ধৃত হয়নি।” ইমাম রাযী, কাযী আবু বকর ও আলূসী এর ওপর বিস্তারিত আলোচনা করে শক্তিশলী যুক্তির ভিত্তিতে একে প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু অন্যদিকে হাফেয ইবনে হাজার আসকালানীর মতো উচ্চস্তরের মুহাদ্দিস, আবু বকর জাসসাসের ন্যায় খ্যাতিমান ফকীহ, যামাখশারীর মতো যুক্তিবাদী মুফাসসির এবং ইবনে জারীরের ন্যায় তাফসীর, ইতিহাস ও ফিকাহর ইমাম একে সহীহ বলে স্বীকার করেন এবং একেই আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যা গণ্য করেন। ইবনে হাজারের মুহাদ্দিস সুলভ যুক্তি হচ্ছেঃ

----------------

১। মুরসালঃ যে হাদীসের সনদের শেষের দিকে তাবেঈর পরে কোন রাবী নেই এবং তাবেঈ নিজেই বলেছেন, “রসূলুল্লাহ ﷺ বলেন।”

২। মুনকাতেঃ যে হাদীসের কোন স্তরে এক বা একাধিক রাবীর নাম বাদ পড়ে যায়।

৩। মুত্তাসিলঃ যে হাদীসের সনদের কোন স্তরে কোন রাবী বাদ পড়েনি এবং সকল রাবীর নাম যথাস্থানে উল্লেখিত হয়েছে।

৪। সিহাহে সিত্তাঃ ছয়টি সহীহ তথা নির্ভুল হাদীস গন্থ যেমন বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ।

“সাঈদ ইবনে জুবাইরের মাধ্যম ছাড়া বাকি অন্যান্য যেসব মাধ্যমে এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে, তা হয় যঈফ৫ আর নয়তো মুনকাতে’। কিন্তু মাধ্যমের সংখ্যাধিক্য একথা প্রকাশ করে যে, এর নিশ্চয়ই কোন মূল আছে। এছাড়াও এটি একটি মাধ্যমে মুত্তাসিল পদ্ধতিতে সহীহ সনদ সহকারেও বর্ণিত হয়েছে। বযযার এটি উদ্ধৃত করেছেন। (এখানে ইউসুফ ইবনে হাম্মাদ-উমাইয়াহ ইবনে খালেদ থেকে, তিনি শু’বা থেকে, তিনি আবু বিশর থেকে, তিনি সাঈদ ইবনে জুবাইর থেকে, তিনি ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত হাদীসটির কথা বলা হয়েছে) অন্য দু’টি মাধ্যমে যদিও মুরসাল বর্ণিত হয়েছে কিন্তু এর রাবীগণ ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের শর্তানুযায়ী পূর্ণ গুণ সম্পন্ন। তাবারী এ দু’টি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। একটি উদ্ধৃত হয়েছে ইউনুস ইবনে ইয়াযীদ কর্তৃক ইবনে শিহাব থেকে এবং অন্যটি মুতামির ইবনে সুলাইমান ও হাম্মাদ ইবনে সালামাহ কর্তৃক দাউদ ইবনে আবী হিন্দ থেকে এবং তিনি আবীল আলীয়াহ থেকে।”

সমর্থকদের ব্যাপারে বলা যায়, তারা তো এ হাদীসটিকে সহীহ বলে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু বিরোধীরাও সাধারণভাবে এর বিরুদ্ধে সমালোচনার হক আদায় করেননি। একটি দল একে প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ তাদের দৃষ্টিতে এর সনদ শক্তিশালী নয়। এর অর্থ এই দাঁড়ায়, যদি সনদ শক্তিশালী হতো তাহলে তারা এ কাহিনীটি মেনে নিতেন। দ্বিতীয় দলটি একে এজন্য প্রত্যাখ্যান করেন যে, এর ফলে সমগ্র দ্বীনই সন্দেহযুক্ত হয়ে যায় এবং দ্বীনের প্রত্যেকটি বিষয়ের ব্যাপারে সন্দেহ দেখা দেয় যে, না জানি আরো কোথায় কোথায় শয়তানী কুমন্ত্রণা ও মিশ্রণের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। অথচ এ ধরনের যুক্তি তো কেবল এমনসব লোককে নিশ্চিত করতে পারে যারা আগে থেকে দৃঢ় ও পরিপক্ক ঈমানের ওপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন। কিন্তু যারা প্রথম থেকেই সন্দেহ-সংশয়ের মধ্যে অবস্থান করছেন অথবা যারা এখন গবেষণা-অনুসন্ধানের মাধ্যমে ঈমান আনা বা না আনার ফায়সালা করতে চান তাদের মনে তো যেসব জিনিসের কারণে এ দ্বীন সন্দেহযুক্ত হয়ে যায় সেগুলো প্রত্যাখ্যান করার অনুভূতি জাগতে পারে না। বরং তারা বলবেন, যখন কমপক্ষে একজন প্রখ্যাত সাহাবী এবং বহু তাবেঈ, তাবে’তাবেঈ ও অসংখ্য নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারীদের বর্ণনার মাধ্যমে একটি ঘটনা প্রমাণ হচ্ছে তখন তাকে শুধুমাত্র এজন্যই বা কেন প্রত্যাখ্যান করা হবে যে, এর ফলে আপনার দ্বীন সংশয়পূর্ণ হয়ে যায়? এর পরিবর্তে আপনার দ্বীনকেই বা সংশয়পূর্ণ মনে করা হবে না কেন যখন এ ঘটনাটি তাকে সংশয়পূর্ণ বলে প্রমাণ করছে?

এখন সমালোচনা ও যাচাই ও বাছাইয়ের সঠিক পদ্ধতি চিহ্নিত করা দরকার, যার কষ্ঠি পাথরে যাচাই করে এর সনদ যতই শক্তিশালী বা দুর্বল হোক না কেন একে অগ্রহণযোগ্য গণ্য করা যে

তে পারে।

----------------

৫। যঈফঃ যে হাদীসের রাবীর মধ্যে ‘আদালত’ ও ‘যবত’ গুণ যে কোন পর্যায়েই থাকে না। আদালত মানে হচ্ছে (১) তাকওয়া ও পবিত্রতা গুণ থাকা, (২) মিথ্যা না বলা, (৩) কবীরা গুনাহ না করা, (৪) অজ্ঞাতনামা না হওয়া অর্থাৎ দোষগুণ বিচারের জন্য যার জীবনী জানা সম্ভব হয় না এবং (৫) শরীয়াত বিরোধী আকীদা-বিশ্বাসের অধিকারী এবং বিদআতীও নয়। অন্যদিকে “যবত” হচ্ছে এমনশক্তি যার সাহায্যে মানুষ শোনা বা লিখিত বিষয়কে ভুলে যাওয়া বা বিনষ্ট হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে এবং ইচ্ছা মতো তাকে সঠিকভাবে স্মরণ করতে পারে।-অনুবাদক

প্রথম জিনিসটি হচ্ছে তার আভ্যন্তরীন সাক্ষ্য। এটি তাকে ভুল প্রমাণ করে কাহিনীটিতে বর্ণনা করা হয়েছে, হাবশায় হিজরত সম্পন্ন হয়ে যাবার পর ঘটনাটি ঘটে এবং এই ঘটনার খবর শুনে হাবশায় হিজরাতকারীদের একটি দল মক্কায় ফিরে আসে। এবার একটু তারিখের পার্থক্য বিবেচনা করুন।

০---নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক বর্ণনার ভিত্তিতে জানার যায় হাবশায় হিজরত অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম নববী সালের রজব মাসে। আর হাবশার মুহাজিরদের একটি দল সমঝোতার ভুল খবর শুনে তিন মাস পরে (অর্থাৎ একই বছর প্রায় শাওয়াল মাসে) মক্কায় ফিরে আসে। এ থেকে জানা যায়, এটি নির্ঘাত পঞ্চম নববী সনের ঘটনা।

০---সূরা বনী ইসরাঈলের একটি আয়াতের ব্যাপারে বলা হচ্ছে, সেটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ কাজের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও ক্ষোভ প্রকাশের উদ্দেশে নাযিল হয়েছিল। সূরা বনী ইসরাঈল মি’রাজের পরে নাযিল হয়। আর নির্ভরযোগ্য বর্ণনাসমূহের ভিত্তিতে বলা যায়, ১১ বা ১২ নববী সালে মি’রাজ অনুষ্ঠিত হয়। এর অর্থ দাঁড়ায়, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ কাজের পাঁচ ছয় বছর পর আল্লাহ তাঁর অসন্তোষ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

০---আর পূর্বাপর বক্তব্যের ভিত্তিতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে আলোচ্য আয়াতটি ১ হিজরী সনে নাযিল হয়। অর্থাৎ ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশের পরও যখন আরো দুই আড়াই বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে তখন ঘোষণা করা হয়, এ মিশ্রণ তো শয়তানী কুমন্ত্রণার মাধ্যমে ঘটে গিয়েছিল। আল্লাহ একে রহিত করে দিয়েছেন। কোন বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি কি একথা মেনে নিতে পারে যে, মিশ্রণের কাজটি হলো আজ, তার ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করা হলো ৬ বছর পর এবং মিশ্রণটি রহিত করার ঘোষণা হলো ৯ বছর পর?

তারপর এ ঘটনায় বলা হয়েছে, এ মিশ্রণটি হয়েছিল সূরা নজমে এবং এভাবে হয়েছিল যে, শুরু থেকে নবী (সা.) আসল সূরার শব্দাবলী পাঠ করে আসছিলেন। হঠাৎ وَمَنَاةَ الثَّالِثَةَ الْأُخْرَى বাক্যাংশে পৌঁছে তিনি নিজেই বা শয়তানী প্ররোচনায় এ বাক্য মিশিয়ে দিলেন এবং তারপর সামনের দিকে আবার সূরা নজমের আসল আয়াত পড়তে থাকলেন। এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, মক্কার কাফেররা এটা শুনে খুশী হয়ে গিয়েছিল এবং তারা বলেছিল, এখন আমাদের ও মুহাম্মাদের মধ্যে বিরোধ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু সূরা নজমের বক্তব্য পরম্পরায় এ প্রক্ষিপ্ত বাক্যটি সংযুক্ত করে দেখুন তো কি দাঁড়ায়ঃ

“তারপর তোমরা কি একটু চিন্তা করে দেখেছো এই লাত, উযযা ও তৃতীয় একটি (দেবী) মানাত সম্পর্কে? এরা হচ্ছে উচ্চ মর্যাদাশালিনী দেবী। এদের সুপারিশ অবশ্যি কাংখিত।

তোমাদের জন্য হবে পুত্রগণ এবং তার (অর্থাৎ আল্লাহর) জন্য হবে কন্যাগণ? এতো বড় অন্যায় ভাগ-ভাটোয়ারা। আসলে এগুলো কিছুই নয় তবে কতিপয় নাম, যা তোমরা ও তোমাদের বাপ-দাদারা রেখে দিয়েছে। আল্লাহ এগুলোর জন্য কোন প্রমাণপত্র অবর্তীণ করেননি। লোকেরা নিছক অনুমান ও মনগড়া চিন্তার অনুসরণ করে চলছে। অথচ তাদের রবের পক্ষ থেকে সঠিক পথ-নির্দেশনা এসে গেছে।”

দেখুন এ প্যারাগ্রাফটির মধ্যে রেখাচিহ্নিত বাক্যটির বক্তব্য কেমন পরিষ্কার বৈপরীত্য সৃষ্টি করে দিয়েছে। এক কথায় বলে দেয়া হচ্ছে, যথার্থই তোমাদের এ দেবীগুলো উচ্চমর্যাদার অধিকারী, এদের সুপারিশ অবশ্যই আকাংখার বস্তু। অন্য কথায় উল্টা দিকে মুখ করে আবার তাদেরই ওপর আঘাত হানা হচ্ছে এই বলে যে, নির্বোধের দল! তোমরা আল্লাহর জন্য এ মেয়েদেরকে কেমন করে ঠিক করে রাখলে? ধাপ্পা তো মন্দ নয়, তোমরা নিজেরা তো পেলে পুত্র আর আল্লাহর হিসসায় কন্যা। এসব তোমাদের মনগড়া। এগুলোর সপক্ষে আল্লাহর কোন প্রমাণপত্র তোমাদের কাছে নেই। এটি একটি স্রেফ পরস্পর বিরোধী ভাষণ--- যা কোন বুদ্ধিমান ও জ্ঞানবান মানুষের মুখ থেকে বের হতে পারে না। কিন্তু কিছুক্ষণের জন্য এ প্রশ্নটি এড়িয়ে যান। মেনে নিন, শয়তান প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়ে একথা মুখ দিয়ে বের করিয়েছে। কিন্তু কুরাইশদের সে সমগ্র জনমণ্ডলী যারা একথা শুনছিল তারা কি একেবারে পাগল হয়ে গিয়েছিল যে, পরবর্তী বাক্যগুলোয় এই প্রশংসাপূর্ণ শব্দগুলোর সুস্পষ্ট প্রত্যাখ্যানের বার্তা শুনেও তারা একথাই মনে করতে থাকলো যে, তাদের দেবীদেরকে যথার্থই প্রশংসা করা হয়েছে। সূরা নজমের শেষ পর্যন্ত যে বক্তব্য পেশ করা হয়েছে সে সমগ্র বক্তব্যই এ একটি মাত্র প্রশংসামূলক বাক্যের সম্পূর্ণ বিরোধী। কেমন করে একথা মেনে নেয়া যেতে পারে যে, কুরাইশের লোকেরা এগুলো শেষ পর্যন্ত শোনার পর সবাই মিলে একযোগে এ বলে চিৎকার করে বলে থাকবে যে, চলো আজ আমাদের ও মুহাম্মাদের মধ্যকার বিরোধ খতম হয়ে গেছে?

এতো হচ্ছে এ ঘটনার আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য! এর মাধ্যমে ঘটনাটি যে একবারেই অর্থহীন ও বাজে একথাই প্রমাণিত হচ্ছে। এরপর দ্বিতীয় যে জিনিসটি দেখার তা হচ্ছে এই যে, এর মধ্যে তিনটি আয়াতের নাযিল হওয়ার যে কার্যকারণ বর্ণনা করা হচ্ছে কুরআনের বিন্যাসও তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত কি না? ঘটনায় বলা হচ্ছে, সূরা নজমে মিশ্রণ করা হয়েছিল। আর সূরা নজম ৫ নববী সনে নাযিল হয়। এ মিশ্রণের বিরুদ্ধে সূরা বনী ইসরাঈলের আয়াতে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। আবার একে রহিত ও ঘটনার ব্যাখ্যা করা হয় সূরা হজ্জের আলোচ্য আয়াতে। এখন অবশ্য দু’টি অবস্থার মধ্যে যে কোন একটিই হয়ে থাকবে। মিশ্রণের ঘটনা যখন ঘটেছে তখনই ক্রোধ প্রকাশ ও রহিত করার আয়াতগুলো নাযিল হয়েছে অথবা ক্রোধ সংক্রান্ত আয়াত সূরা বনী ইসরাঈলের সাথে এবং রহিত করা সংক্রান্ত আয়াত সূরা হজ্জের সাথে নাযিল হয়েছে। যদি প্রথম অবস্থাটি হয়ে থাকে, তাহলে বলতে হয় বড়ই বিস্ময়ের ব্যাপার! এ আয়াত দু’টি সূরা নজমে সংযুক্ত করা হলো না বরং ক্রোধ সংক্রান্ত আয়াতকে ছ’বছর পর্যন্ত এমনিভাবেই রেখে দেয়া হলো এবং সূরা বনী ইসরাঈল যখন নাযিল হলো তখনই তাকে এনে তার সাথে জুড়ে দেয়া হলো। তারপর আবার রহিত করা সংক্রান্ত আয়াত আরো দু’-আড়াই বছর পর্যন্ত পড়ে রইলো এবং সূরা হজ্জ নাযিল না হওয়া পর্যন্ত তাকে কোথাও সংযুক্ত করা হলো না। কুরআনের বিন্যাস কি এভাবেই হয়েছে, এক সময় যে আয়াতগুলো নাযিল হয় সেগুলো বিক্ষিপ্ত আকারে চারদিকে পড়ে থাকে এবং বছরের পর বছর পর হয়ে যাবার পর তাদের কোনটিকে কোন সূরার সাথে এবং কোনটিকে অন্য সূরার সাথে জুড়ে দেয়া হয়? কিন্তু যদি দ্বিতীয় অবস্থাটি হয়ে থাকে অর্থাৎ ক্রোধ সংক্রান্ত আয়াত ঘটনার ৬ বছর পর এবং রহিত করা সংক্রান্ত আয়াত আট নয় বছর পর নাযিল হয় তাহলে ইতিপূর্বে আমি যে অসামঞ্জস্যের কথা বলে এসেছি তা ছাড়াও এ প্রশ্ন দেখা দেয় যে, সূরা বনী ইসরাঈল ও সূরা হজ্জের মধ্যে এ আয়াতগুলোর নাযিল হওয়ার সুযোগ কোথায়?

এখানে এসে যথার্থ সমালোচনার তৃতীয় ধারাটি আমাদের সামনে আসে। অর্থাৎ কোন আয়াতের যে ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে কুরআনের পূর্বাপর বক্তব্যও তা গ্রহণ করে কি না তা দেখতে হবে। সূরা বনী ইসরাঈলের ৮ রুকূ’ পড়ে দেখুন। তার পূর্বের ও পরের বক্তব্যের ওপর ও চোখ বুলিয়ে নিন। এ বক্তব্য পরম্পরায় নবীকে ছ’বছর আগের একটি ঘটনার জন্য শাসিয়ে দেবার সুযোগ কোথায় পাওয়া যায়? إِنْ كَادُوا لَيَفْتِنُونَكَ আয়াতে নবীকে কোন প্রকার শাসানো হচ্ছে কিনা এবং আয়াতের শব্দাবলী কাফেরদের ফিতনায় নবীর জড়িয়ে পড়ার কথা বলছে, না তার প্রতিবাদ করছে--- এ প্রশ্ন বাদ দিলে এভাবে সূরা হজ্জও আপনার সামনে আছে। আলোচ্য আয়াতের পূর্বের বক্তব্যও পড়ুন এবং পরের বক্তব্যও। এ প্রেক্ষাপটে “হে নবী! ৯ বছর পূর্বে কুরআনে মিশ্রণ ঘটাবার যে কাজ তুমি করেছিলে, সে ব্যাপারে ভয় পেয়ো না, ইতিপূর্বেকার নবীদের সাথেও শয়তান এ ব্যবহার করে এসেছে এবং যখনই নবীরা এ ধরনের কাজ করে তখনই আল্লাহ তাকে রহিত করে নিজের আয়াতকে আবার শক্তিশালী ও তরতাজা করে দেন।” ---এ ধরনের বক্তব্য কেমন করে এসে গেলো, এর কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ কি আপনি বুঝতে পেরেছেন?

আমি এর আগেও বার বার বলেছি এবং এখানে আবার তার পুনরাবৃত্তি করছি যে, কোন রেওয়ায়াত তার বর্ণনা পরম্পরা যতই সূর্যের চাইতেও উজ্জল হোক না কেন তার ‘মতন’১ যখন তার ভুলের দ্ব্যর্থহীন প্রমাণ পেশ করতে থাকে এবং কুরআনের শব্দাবলী, পূর্বাপর বক্তব্য, বিন্যাস, সবকিছুই তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করতে থাকে তখন তা কোনক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ যুক্তিগুলো একজন সন্দেহবাদী ও নিরপেক্ষ অনুসন্ধানীকে অবশ্য নিশ্চিত করে দেবে। তিনি এ কাহিনীটি পুরোপুরি মিথ্যা বলে মেনে নেবেন। আর কোন মু’মিন তো একে কখনো সত্য বলে মেনে নিতে পারেন না। কারণ তিনি প্রকাশ্য দেখছেন এ রেওয়ায়াতটি কুরআনের একটি নয় বহু আয়াতের সাথে সংঘর্ষশীল। একজন মুসলমানের পক্ষে একথা মেনে নেয়া বড়ই সহজ যে, এ হাদীসটির বর্ণনাকারীদেরকে শয়তান বিভ্রান্ত করেছে। এর তুলনায় তারা কখনো একথা মেনে নিতে পারে না যে, রসূলুল্লাহ ﷺ কখনো নিজেই নিজেই মানসিক আকংখার তাড়নায় কুরআনে একটি শব্দও মেশাতে পারতেন অথবা তাঁর মনে কখনো মুহূর্তকালের জন্যও এ চিন্তা আসতে পারতো যে, তাওহীদের সাথে শিরকের কিছুটা মিশ্রণ ঘটিয়ে কাফেরদেরকে সন্তুষ্ট করা হোক কিংবা আল্লাহর ফরমানসমূহের ব্যাপারে তিনি কখনো এ আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতে পারতেন যে, আল্লাহ যেন এমন কোন কথা বলে না বসেন যার ফলে কাফেররা নারাজ হয়ে যায় অথবা তাঁর কাছে এমন কোন অসংরক্ষিত ও সংশয়পূর্ণ পদ্ধতিতে অহী আসতো যার ফলে জিব্রীলের সাথে সাথে শয়তানও তাঁর কাছে নিজের কোন শব্দ প্রক্ষেপ করতো এবং তিনি তাকেও জিব্রীলের নিয়ে আসা শব্দ মনে করার ভুল ধারণায় নিমজ্জিত থাকতেন। এর মধ্যে প্রত্যেকটি কথাই কুরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্য বিরোধী। আমাদের মনে কুরআন ও মুহাম্মাদ ﷺ সম্পর্কে যে সব আকীদা-বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত আছে এগুলো তারও বিরোধী। এমন ধরনের রেওয়ায়াতের পেছনে দৌঁড়ানো থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই,নিছক সনদের সংযোগ রাবীরে নির্ভরযোগ্যতা কিংবা বর্ণনাসূত্রের আধিক্য দেখে কোন মুসলমানকে আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রসূলের ব্যাপারে এমন কঠিন কথাও স্বীকার করে নিতে উদ্বুদ্ধ করে।

এত বিপুল সংখ্যক, হাদীস বর্ণনাকারীকে এ ঘটনাটি বর্ণনা করার সাথে জড়িত থাকতে দেখে মনে যে সন্দেহ জাগে এ প্রসঙ্গে তা দূর করে দেয়া সঙ্গত মনে করি। এক ব্যক্তি প্রশ্ন করতে পারে, যদি এ ঘটনাটির মূলে কোন সত্য না-ই থাকে তাহলে নবী ও কুরআনের বিরুদ্ধে এত বড় অপবাদ হাদীসের এত বিপুল সংখ্যক রাবীদের মাধ্যমে যাদের মধ্যে বড় বড় খ্যাতিমান নির্ভরযোগ্য বুযর্গও রয়েছেন, কেমন করে বিস্তার লাভ করলো? এর জবাব হচ্ছে, হাদীসের বিপুল সম্পদের মধ্যেই আমরা এর কারণ খুঁজে পাই। বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ ও মুসনাদে আহমদে আসল ঘটনাটি এভাবে এসেছেঃ নবী ﷺ সূরা নজম তেলাওয়াত করেন। সূরা শেষে যখন তিনি সিজদা করেন তখন মুসলিম-মুশরিক নির্বিশেষে সকল উপস্থিতি ব্যক্তিবর্গ সিজদা করে। আসল ঘটনা শুধু এতটুকুই ছিল। আর কোন বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল না। প্রথমত, কুরআনের শক্তিশালী বক্তব্য এবং অত্যন্ত প্রভাবশালী বর্ণনা ভংগী, এর ওপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কণ্ঠে এর যাদুকরী প্রকাশের পর যদি তা শুনে উপস্থিত সমগ্র জনমণ্ডলী বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে তাঁর সাথে সাথে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে তাহলে তাতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। এ জিনিসটির জন্যই তো কুরাইশরা বলতো, এ ব্যক্তি যাদুকর। তবে মনে হয়, পরে কুরাইশরা নিজেদের এ সাময়িক ভাবাবেগের জন্য কিছুটা লজ্জিত হয়ে থাকবে এবং তাদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তি অথবা কিছু লোক নিজেদের এ কাজের এ ব্যাখ্যা দিয়ে থাকবে যে, জনাব আমরা তো মুহাম্মাদের মুখ থেকে নিজেদের মাবুদদের প্রশংসায় কিছু কথা শুনেছিলাম, যে কারণে আমরা তাঁর সাথে সিজদায় লুটিয়ে পড়েছিলাম। অন্যদিকে এ ঘটনাটি হাবশার মুহাজিরদের কাছে এভাবে পৌঁছে যে, নবী ﷺ ও কুরাইশদের মধ্যে সন্ধি হয়ে গেছে। কারণ লোকেরা তাঁকে এবং মুশরিক ও মু’মিনদেরকে এক সাথে সিজদা করতে দেখেছিল। এ গুজব এতো বেশী ছড়িয়ে পড়ে যে, প্রায় ৩৩ জন মুহাজির মক্কায় ফিরে আসেন। এক শতাব্দীর মধ্যে এ তিনটি কথা অর্থাৎ কুরাইশদের সিজদা, এ সিজদার এ ব্যাখ্যা এবং হাবশার মুহাজিরদের ফিরে আসা একসাথে মিশে একটি কাহিনীর আকার ধারণ করে এবং অনেক মুত্তাকী, বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য লোকও এ ঘটনা বর্ণনা করতে থাকেন। মানুষ যাই হোক না কেন মূলত মানুষই। বড় বড় সৎকর্মপরায়ণ ও জ্ঞানবান লোকেরাও অনেক সময় ভুল-ভ্রান্তি করে বসেন এবং তাদের এ ভুল সাধারণ লোকের ভুলের তুলনায় অনেক বেশী ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়। এদের প্রতি সীমাতিরিক্ত ভক্তি শ্রদ্ধা পোষণকারীরা এদের সঠিক কথার সাথে সাথে ভুল কথাগুলোও চোখ বন্ধ করে গ্রহণ করে নেয়। আর মন্দ চরিত্রের লোকেরা এদের ভুলগুলো বাছাই করে করে একত্র করে এবং এগুলোকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করে বলতে থাকে, এদের মাধ্যমে আমাদের কাছে যা কিছু পৌঁছেছে সবই আগুনে পুড়িয়ে ফেলার যোগ্য।

১০২.
মূলে আছে عَقِيمٍ শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে “বন্ধ্যা” দিনকে বন্ধ্যা বলার দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, এমন ভাগ্য বিড়ম্বিত দিন যার মধ্যে কোন রকম কলাকৌশল কার্যকর হয় না। প্রত্যেকটা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় প্রত্যেকটা আশা নিরাশায় পরিণত হয়। দুই, এমন দিন যার পরে রাত দেখা আর ভাগ্যে জোটে না। উভয় অবস্থায়ই এর অর্থ হচ্ছে, এমন দিন যেদিন কোন জাতির ধ্বংসের ফায়সালা হয়ে যায়। যেমন, যেদিন নূহের জাতির ওপর তুফান এলো সেদিনটি তাদের জন্য ছিল ‘বন্ধ্যা’ দিন। এমনিভাবে আদ, সামূদ, লূতের জাতি, মাদয়ানবাসী ও অন্যান্য সকল ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির জন্য আল্লাহর আযাব নাযিলের দিনটি বন্ধ্যা দিনই প্রামাণিত হয়েছে। কারণ “সেদিনের” পরে আর তার “পরের দিন” দেখা যায়নি এবং নিজেদের বিপর্যস্ত ভাগ্যকে সৌভাগ্যে রূপান্তরিত করার কোন পথই খুঁজে পাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
.
.
.
.
অনুবাদ: