পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

১৯০ আয়াত

১০১ ) তবে যাদের ব্যাপারে আমার পক্ষ থেকে পূর্বাহ্নেই কল্যাণের ফায়সালা হয়ে গিয়েছে তাদেরকে অবশ্যি এ থেকে দূরে রাখা হবে, ৯৭
إِنَّ ٱلَّذِينَ سَبَقَتْ لَهُم مِّنَّا ٱلْحُسْنَىٰٓ أُو۟لَـٰٓئِكَ عَنْهَا مُبْعَدُونَ ١٠١
১০২ ) তার সামান্যতম খস্খসানিও তারা শুনবে না এবং তারা চিরকাল নিজেদের মন মতো জিনিসের মধ্যে অবস্থান করবে।
لَا يَسْمَعُونَ حَسِيسَهَا ۖ وَهُمْ فِى مَا ٱشْتَهَتْ أَنفُسُهُمْ خَـٰلِدُونَ ١٠٢
১০৩ ) সেই চরম ভীতিকর অবস্থা তাদেরকে একটুও পেরেশান করবে না ৯৮ এবং ফেরেশতারা এগিয়ে এসে তাদেরকে সাদরে অভ্যর্থনা জানাবে এই বলে, “এ তোমাদের সেই দিন যার প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেয়া হতো।”
لَا يَحْزُنُهُمُ ٱلْفَزَعُ ٱلْأَكْبَرُ وَتَتَلَقَّىٰهُمُ ٱلْمَلَـٰٓئِكَةُ هَـٰذَا يَوْمُكُمُ ٱلَّذِى كُنتُمْ تُوعَدُونَ ١٠٣
১০৪ ) সেদিন, যখন আকাশকে আমি এমনভাবে গুটিয়ে ফেলবো যেমন বাণ্ডিলের মধ্যে গুটিয়ে রাখা হয় লিখিত কাগজ, যেভাবে আমি প্রথমে সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম ঠিক তেমনিভাবে আবার তার পুনরাবৃত্তি করবো, এ একটি প্রতিশ্রুতি, যা আমার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত এবং এ কাজ আমাকে অবশ্যই করতে হবে।
يَوْمَ نَطْوِى ٱلسَّمَآءَ كَطَىِّ ٱلسِّجِلِّ لِلْكُتُبِ ۚ كَمَا بَدَأْنَآ أَوَّلَ خَلْقٍۢ نُّعِيدُهُۥ ۚ وَعْدًا عَلَيْنَآ ۚ إِنَّا كُنَّا فَـٰعِلِينَ ١٠٤
১০৫ ) আর যবুরে আমি উপদেশের পর একথা লিখে দিয়েছি যে, যমীনের উত্তরাধিকারী হবে আমার নেক বান্দারা।
وَلَقَدْ كَتَبْنَا فِى ٱلزَّبُورِ مِنۢ بَعْدِ ٱلذِّكْرِ أَنَّ ٱلْأَرْضَ يَرِثُهَا عِبَادِىَ ٱلصَّـٰلِحُونَ ١٠٥
১০৬ ) এর মধ্যে একটি বড় খবর আছে ইবাদাতকারী লোকদের জন্য। ৯৯
إِنَّ فِى هَـٰذَا لَبَلَـٰغًۭا لِّقَوْمٍ عَـٰبِدِينَ ١٠٦
১০৭ ) হে মুহাম্মাদ! আমি যে তোমাকে পাঠিয়েছি, এটা আসলে দুনিয়াবাসীদের জন্য আমার রহমত। ১০০
وَمَآ أَرْسَلْنَـٰكَ إِلَّا رَحْمَةًۭ لِّلْعَـٰلَمِينَ ١٠٧
১০৮ ) এদেরকে বলো, “আমার কাছে যে অহী আসে তা হচ্ছে এই যে, কেবলমাত্র এক ইলাহই তোমাদের ইলাহ, তারপর কি তোমরা আনুগত্যের শির নত করছো?”
قُلْ إِنَّمَا يُوحَىٰٓ إِلَىَّ أَنَّمَآ إِلَـٰهُكُمْ إِلَـٰهٌۭ وَٰحِدٌۭ ۖ فَهَلْ أَنتُم مُّسْلِمُونَ ١٠٨
১০৯ ) যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে বলে দাও, “আমি সোচ্চার কণ্ঠে তোমাদের জানিয়ে দিয়েছি। এখন আমি জানি না, তোমাদের সাথে যে বিষয়ের ওয়াদা করা হচ্ছে ১০১ তা আসন্ন, না দূরবর্তী।
فَإِن تَوَلَّوْا۟ فَقُلْ ءَاذَنتُكُمْ عَلَىٰ سَوَآءٍۢ ۖ وَإِنْ أَدْرِىٓ أَقَرِيبٌ أَم بَعِيدٌۭ مَّا تُوعَدُونَ ١٠٩
১১০ ) আল্লাহ সে কথাও জানেন যা সোচ্চার কণ্ঠে বলা হয় এবং তাও যা তোমরা গোপনে করো। ১০২
إِنَّهُۥ يَعْلَمُ ٱلْجَهْرَ مِنَ ٱلْقَوْلِ وَيَعْلَمُ مَا تَكْتُمُونَ ١١٠
৯৭.
এখানে এমন সব লোকের কথা বলা হয়েছে যারা দুনিয়ায় নেকী ও সৌভাগ্যের পথ অবলম্বন করেছে। এ ধরনের লোকদের ব্যাপারে আল্লাহ পূর্বাহ্ণে ওয়াদা করেছেন যে, তারা এর আযাব থেকে সংরক্ষিত থাকবে এবং তাদেরকে নাজাত দেয়া হবে।
.
৯৮.
অর্থাৎ হাশরের দিন এবং আল্লাহর সামনে হাজির হবার সময়, যা সাধারণ লোকদের জন্য হবে চরম ভীতি ও পেরেশানীর সময়, নেক লোকেরা সে সময় একটি মানসিক নিশ্চিন্ততার মধ্যে অবস্থান করবে। কারণ, সবকিছু ঘটতে থাকবে তাদের আশা-আকাংখা ও কামনা-বাসনা অনুযায়ী। ঈমান ও সৎকাজের যে পুঁজি নিয়ে তারা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিল তা সে সময় পর্যন্ত আল্লাহর মেহেরবানীতে তাদের মনোবল দৃঢ় করবে এবং ভয় ও দুঃখের পরিবর্তে তাদের মনে এ আশার সঞ্চার করবে যে, শীঘ্রই তারা নিজেদের প্রচেষ্টা ও তৎপরতার সুফল লাভ করবে।
.
.
.
৯৯.
এ আয়াতের অর্থ অনুধাবন করতে অনেকে ভীষণভাবে বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন। তারা এর এমন একটি অর্থ বের করে নিয়েছেন যা সমগ্র কুরআনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে দাঁড়ায় এবং দ্বীনের সমগ্র ব্যবস্থাটিকেই শিকড় শুদ্ধ উপড়ে ফেলে দেয়। তারা আয়াতের অর্থ এভাবে করেন যে, দুনিয়ার বর্তমান জীবনে যমীনের উত্তরাধিকার (অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনা ও শাসন এবং পৃথিবীর বস্তু সম্পদ ও উপকরণাদির ভোগ-ব্যবহার) শুধুমাত্র সৎলোকেরাই লাভ করে থাকে এবং তাদেরকেই আল্লাহ এ নিয়ামত দান করেন। তারপর এ সার্বিক নিয়ম থেকে তারা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান যে, সৎ ও অসতের মধ্যকার ফারাক ও পার্থক্যের মানদণ্ড হচ্ছে এ পৃথিবীর উত্তরাধিকার। যে এ উত্তরাধিকার লাভ করে সে সৎ এবং যে এ থেকে বঞ্চিত হয় সে অসৎ। এরপর তারা সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে দুনিয়ায় ইতিপূর্বে যেসব জাতি পৃথিবীর উত্তরাধিকার লাভ করেছিল এবং যারা আজ উত্তরাধিকারী হয়ে আছে তাদের প্রতি দৃষ্টি দেয়। এখানে কাফের, মুশরিক, নাস্তিক, দুষ্কৃতিকারী সবাই এ উত্তরাধিকার আগেও লাভ করেছে এবং আজো লাভ করছে। কুরআন যেসব গুণকে কুফরী, ফাসেকী, দুষ্কৃতি, পাপ ও অসৎ বলে চিহ্নিত করেছে যেসব জাতির মধ্যে সেগুলো পাওয়া গেছে এবং আজও পাওয়া যাচ্ছে তারা এ উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়নি বরং এটি তাদেরকে দান করা হয়েছে এবং আজো দান করা হচ্ছে। ফেরাউন, নমরূদ থেকে শুরু করে এ যুগের কম্যুনিষ্ট শাসকরা পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক লোক প্রকাশ্যে আল্লাহকে অস্বীকার করে, আল্লাহর বিরোধিতা করে বরং আল্লাহর প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে এবং এরপরও তারা যমীনের উত্তরাধিকার লাভ করেছে। এ চিত্র দেখে তারা এ মত পোষণ করেন যে, কুরআন বর্ণিত সার্বিক নিয়ম তো ভুল হতে পারে না। কাজেই ভুল যা কিছু তা এ “সৎ” শব্দটির অর্থের মধ্যে রয়ে গেছে। অর্থাৎ মুসলমানরা এ পর্যন্ত “সালেহ” বা “সৎ” শব্দটির যে অর্থ গ্রহণ করে এসেছে তা সম্পূর্ণ ভুল। তাই তারা সৎ শব্দটির একটি নতুন সংজ্ঞা তালাশ করছেন। এ শব্দটির এমন একটি অর্থ তারা চাচ্ছেন যার পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবীর উত্তরাধিকার লাভকারী সকল ব্যক্তি সমানভাবে “সৎ” গণ্য হতে পারে। তিনি আবু বকর সিদ্দীক ও উমর ফারুক অথবা চেংগীস ও হালাকু যে কেউ হতে পারেন। এ নতুন অর্থ সন্ধান করার ক্ষেত্রে ডারউইনের ক্রমবিবর্তন মতবাদ তাদেরকে সাহায্য করে। ফলে তারা কুরআনের “সৎ” (আরবী) এর মতবাদকে ডারউইনী “যোগ্যতা” বা Fitness (صلاح) (صلاحيت)-এর মতবাদের সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন।

এ সংশ্লিষ্ট তাফসীরের প্রেক্ষিতে আলোচ্য আয়াতের অর্থ দাঁড়াবে এইঃ যে ব্যক্তি বা দল দেশ জয় করার জন্য শক্তি প্রয়োগ করে, তার ওপর শাসন কর্তৃত্ব চালাবার এবং পৃথিবীর বস্তু সম্পদ ও জীবন যাপনের উপকরণাদি সাফল্যের সাথে ব্যবহার করার যোগ্যতা রাখে সে-ই হচ্ছে “আল্লার সৎ বান্দা।” তার এ কর্ম সমস্ত “ইবাদাত গুজার” মানব সমাজের জন্য এমন একটি বাণী যাতে বলা হয়েছে, এ ব্যক্তি ও দল যে কাজটি করছে সেটিই “ইবাদাত।” তোমরা যদি এ ইবাদাত না করো এবং পরিণামে পৃথিবীর উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত থেকে যাও তাহলে তোমাদেরকে “সৎলোক”দের মধ্যে গণ্য করা হবে না এবং তোমাদেরকে আল্লাহর ইবাদাত গুজার বান্দাও বলা যেতে পারে না।

এ অর্থ গ্রহণ করার পর এদের সামনে প্রশ্ন দেখা দিল যে, যদি “সততা” ও ইবাদাতের” সংজ্ঞা এই হয়ে থাকে তাহলে ঈমান (আল্লাহর প্রতি ঈমান, আখেরাতের প্রতি ঈমান, রসূলের প্রতি ঈমান ও কিতাবের প্রতি ঈমান) এর অর্থ কি? ঈমান ছাড়া তো স্বয়ং এ কুরআনের দৃষ্টিতে আল্লাহর কাছে কোন সৎকাজ গ্রহণযোগ্য নয়। আর তাছাড়া এরপর কুরআনের এ দাওয়াতের কি অর্থ হবে যেখানে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাঁর রসূলের মাধ্যমে যে নৈতিক ব্যবস্থা ও জীবন বিধান পাঠিয়েছেন তার আনুগত্য করো? আবার বারবার কুরআনের একথা বলার অর্থই বা কি যে, রসূলকে যে মানে না এবং আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের যে আনুগত্য করে না সে কাফের, ফাসেক, শাস্তিলাভের অধিকারী এবং আল্লাহর দরবারে ঘৃণিত অপরাধী? এ প্রশ্নগুলো এমন পর্যায়ের ছিল যে, এরা যদি ঈমানদারীর সাথে এগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতেন তাহলে অনুভব করতেন যে, এ আয়াতের অর্থ অনুধাবন করার এবং সততার একটি নতুন ধারণা সৃষ্টি করার ব্যাপারে তারা ভুল করছেন। কিন্তু তারা নিজেদের ভুল অনুভব করার পরিবর্তে অত্যন্ত দুঃসাহসের সাথে ঈমান, ইসলাম, তাওহীদ, আখেরাত, রিসালাত প্রত্যেকটি জিনিসের অর্থ বদলে দিয়েছেন, শুধুমাত্র এ সবগুলোকে তাদের একটি আয়াতের ব্যাখ্যার সাথে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য। একটিমাত্র জিনিসকে ঠিকভাবে বসাবার জন্য কুরআনের সমস্ত শিক্ষাকে ওলট-পালট করে দিয়েছেন। এর ওপর আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, যারা তাদের এ “দ্বীনের মেরামতি”র বিরোধী তাদের বিরুদ্ধে তারা উলটো অভিযোগ আনছেন এই বলে যে, “নিজেরা পরিবর্তিত না হয়ে করছেন কুরআনের পরির্বতন। এটি আসলে বস্তুগত উন্নয়নেচ্ছার বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়। কিছু লোক মারাত্মকভাবে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এজন্য তারা কুরআনের অর্থ বিকৃত করতেও দ্বিধা করছেন না।

তাদের এ ব্যাখ্যার প্রথম মৌলিক ভুলটি হচ্ছে এই যে, তারা কুরআনের একটি আয়াতের এমন একটি ব্যাখ্যা করছেন যা কুরআনের সামগ্রিক শিক্ষার বিরোধী। অথচ নীতিগতভাবে কুরআনের প্রত্যেকটি আয়াতের এমন ব্যাখ্যাই সঠিক হতে পারে যা তার অন্যান্য বর্ণনা ও তার সামগ্রিক চিন্তাধারার সাথে সামঞ্জস্যশীল হয়। যে ব্যক্তি কুরআনকে অন্তত একবারও বুঝে পড়ার চেষ্টা করেছেন তিনি একথা না জেনে পারেন না যে, কুরআন যে জিনিসকে নেকী, তাকওয়া ও কল্যাণ বলছে তা “বস্তুগত উন্নতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্যতার” সমার্থক নয়। আর “সৎ” কে যদি “যোগ্যতা সম্পন্ন”-এর অর্থে গ্রহণ করা হয় তাহলে এ একটি আয়াত সমগ্র কুরআনের বিরোধী হয়ে ওঠে।

তাদের এ ভুলের দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে এই যে, তারা একটি আয়াতকে তার প্রেক্ষাপট ও পূর্বাপর সম্পর্ক থেকে আলাদা করে নিয়ে নির্দ্ধিধায় ইচ্ছা মতো যে কোন অর্থ তার শব্দাবলী থেকে বের করে নিচ্ছেন। অথচ প্রত্যেকটি আয়াতের সঠিক অর্থ কেবলমাত্র সেটিই হতে পারে যা তার পূর্বাপর সম্পর্কের সাথে সামঞ্জস্য রাখে। যদি এ ভুলটি তারা না করতেন তাহলে সহজেই দেখতে পেতেন যে, উপর থেকে ধারাবাহিকভাবে যে বিষয়বস্তু চলে আসছে সেখানে আখেরাতের জীবনে সৎকর্মশীল মু’মিন এবং কাফের ও মুশরিকদের পরিণাম সম্পর্কে আলোচনা করা হচ্ছে। এ বিষয়বস্তুর মধ্যে আকস্মিকভাবে দুনিয়ায় যমীনের উত্তরাধিকার ব্যবস্থা কোন্ নিয়মের ভিত্তিতে চলছে একথা বলার সুযোগ কোথায় পাওয়া গেলো?

কুরআন ব্যাখ্যার সঠিক নীতি অনুসরণ করলে দেখা যাবে আয়াতের অর্থ পরিষ্কার। অর্থাৎ এর আগের আয়াতে যে দ্বিতীয়বার সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে সে সৃষ্টিকালে যমীনের উত্তরাধিকারী হবে শুধুমাত্র সৎকর্মশীল লোকেরা। সেই চিরন্তন জীবনের ব্যবস্থাপনায় বর্তমানের সাময়িক জীবন ব্যবস্থার অবস্থা বিরাজিত থাকবে না। এখানে বর্তমান জীবন ব্যবস্থায় তো যমীনে জালেম ও ফাসেকদেরও রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় কিন্তু সেখানে তা হবে না। সূরা মু’মিনূনের ৪-১১ আয়াতে এ বিষয়বস্তুই আলোচিত হয়েছে। এর চাইতেও পরিষ্কার ভাষায় সূরা যুমারের শেষে বলা হয়েছে। সেখানে আল্লাহ কিয়ামত এবং প্রথম সিংগা ধ্বনির কথা বলার পর নিজের ন্যায় বিচারের উল্লেখ করেছেন এবং তারপর কুফরীর পরিণাম বর্ণনা করে সৎলোকদের পরিণাম এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ

وَسِيقَ الَّذِينَ اتَّقَوْا رَبَّهُمْ إِلَى الْجَنَّةِ زُمَرًا حَتَّى إِذَا جَاءُوهَا وَفُتِحَتْ أَبْوَابُهَا وَقَالَ لَهُمْ خَزَنَتُهَا سَلَامٌ عَلَيْكُمْ طِبْتُمْ فَادْخُلُوهَا خَالِدِينَ - وَقَالُوا الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي صَدَقَنَا وَعْدَهُ وَأَوْرَثَنَا الْأَرْضَ نَتَبَوَّأُ مِنَ الْجَنَّةِ حَيْثُ نَشَاءُ فَنِعْمَ أَجْرُ الْعَامِلِينَ

“আর যারা নিজেদের রবের ভয়ে তাকওয়া অবলম্বন করেছিল তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। অবশেষে যখন তারা সেখানে পৌঁছে যাবে, তাদের জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হবে এবং তার ব্যবস্থাপক তাদেরকে বলবে তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক, তোমরা খুব ভালো থেকেছো, এখন এসো, এর মধ্যে চিরকাল থাকার জন্য প্রবেশ করো। আর তারা বলবেঃ প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি আমাদের সাথে তাঁর ওয়াদা পূর্ণ করেছেন এবং আমাদের যমীনের উত্তরাধিকারী বানিয়ে দিয়েছেন। আমরা জান্নাতে যেখানে ইচ্ছা নিজেদের জায়গা তৈরি করে নিতে পারি। কাজেই সর্বোত্তম প্রতিদান হচ্ছে সৎকর্মশীলদের জন্য।” (যুমারঃ৭৩-৭৪)

দেখুন এ দু’টি আয়াত একই বিষয় বর্ণনা করছে এবং দু’জায়গায়ই যমীনের উত্তরাধিকারের সম্পর্ক পরকালীন জগতের সাথে প্রতিষ্ঠিত, ইহকালীন জগতের সাথে নয়।

এখন যবুরের প্রসঙ্গে আসা যাক। আলোচ্য আয়াতে এর বরাত দেয়া হয়েছে। যদিও আমাদের পক্ষে একথা বলা কঠিন যে, বাইবেলের পুরাতন নিয়মে যবুর নামে যে পুস্তকটি বর্তমানে পাওয়া যায় তা তার আসল অবিকৃত অবস্থায় আছে কি নেই। কারণ, এখানে দাউদের গীতের মধ্যে অন্য লোকদের গীতও মিশে একাকার হয়ে গেছে এবং মূল যবুরের কপি কোথাও নেই। তবুও যে যবুর বর্তমানে আছে সেখানেও নেকী, সততা, সত্যনিষ্ঠা ও আল্লাহ নির্ভরতার উপদেশ দেয়ার পর বলা হচ্ছেঃ

------------------------

“কারণ দুরাচারগণ উচ্ছিন্ন হইবে, কিন্তু যাহারা সদাপ্রভুর অপেক্ষা করে, তাহারাই দেশের অধিকারী হইবে। আর ক্ষণকাল, পরে দুষ্টলোক আর নাই, তুমি তাহার স্থান তত্ব করিবে, কিন্তু সে আর নাই। কিন্তু মৃদুশীলেরা দেশের অধিকারী হইবে এবং শান্তির বাহুল্যে আমোদ করিবে। . . . . . . . . . তাহাদের অধিকার চিরকাল থাকিবে। . . . . . . . . . . ধার্মিকেরা দেশের অধিকারী হইবে, তাহারা নিয়ত তথায় বাস করিবে।” (দাউদের সঙ্গীত ৩৭: ৯, ১০, ১১, ১৮, ২৯) দেখুন এখানে ধার্মিকদের জন্য যমীনের চিরন্তন উত্তরাধিকারের কথা বলা হয়েছে। আর একথা সুস্পষ্ট যে, আসমানী কিতাবগুলোর দৃষ্টিতে “খুলূদ”, “তথা চির অবস্থান” ও চিরন্তন জীবন আখেরাতেরই হয়ে থাকে, এ দুনিয়ায় নয়।

দুনিয়ায় যমীনের সাময়িক উত্তরাধিকার যে নিয়মে বন্টিত হয় তাকে সূরা আ’রাফে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ

إِنَّ الْأَرْضَ لِلَّهِ يُورِثُهَا مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ

“যমীনের মালিক আল্লাহ, নিজের বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তাকে তিনি এর উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেন।” (১২৮ আয়াত)

আল্লাহর ইচ্ছার আওতায় মু’মিন ও কাফের, সৎ ও অসৎ এবং হুকুম পালনকারী ও হুকুম অমান্যকারী নির্বিশেষে সবাই এর উত্তরাধিকার লাভ করে। কর্মফল হিসেবে তারা এটা লাভ করে না বরং লাভ করে পরীক্ষা হিসেবে। যেমন এ আয়াতের পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছেঃ

وَيَسْتَخْلِفَكُمْ فِي الْأَرْضِ فَيَنْظُرَ كَيْفَ تَعْمَلُونَ

“আর তিনি তোমাদেরকে যমীনে খলীফা করবেন তারপর দেখবেন তোমরা কেমন কাজ করো।” (১২৯ আয়াত)

এ উত্তরাধিকার চিরন্তন নয়। এটি নিছক একটি পরীক্ষার ব্যাপার। আল্লাহর একটি নিয়মের আওতায় দুনিয়ায় বিভিন্ন জাতিকে পালাক্রমে এ পরীক্ষায় ফেলা হয়। বিপরীতপক্ষে আখেরাতে এ যমীনেরই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হবে এবং কুরআনের বিভিন্ন সুস্পষ্ট উক্তির আলোকে তা যে নিয়মের ভিত্তিতে হবে তা হচ্ছে এই যে, “যমীনের মালিক হচ্ছেন আল্লাহ। তিনি নিজের বান্দাদের মধ্য থেকে একমাত্র সৎকর্মশীল মু’মিনদেরকে এর উত্তরাধিকারী করবেন। পরীক্ষা করার জন্য নয় বরং দুনিয়ায় তারা যে সৎ প্রবণতা অবলম্বন করেছিল তার চিরন্তন প্রতিদান হিসেবে।” (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা নূর, ৮৩ টীকা)।

১০০.
এর আর একটি অনুবাদ হতে পারে, “আমি তোমাকে দুনিয়াবাসীদের জন্য রহমতে পরিণত করেই পাঠিয়েছি।” উভয় অবস্থায়ই এর অর্থ হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমন আসলে মানবজাতির জন্য আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ। কারণ, তিনি এসে গাফলতিতে ডুবে থাকা দুনিয়াকে জাগিয়ে দিয়েছেন। তাকে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে ফারাক করার জ্ঞান দিয়েছেন। দ্বিধাহীন ও সংশয় বিমুক্ত পদ্ধতিতে তাকে জানিয়ে দিয়েছেন। তার জন্য ধ্বংসের পথ কোনটি এবং শান্তি ও নিরাপত্তার পথ কোনটি। মক্কার কাফেররা নবীর ﷺ আগমনকে তাদের জন্য বিপদ ও দুঃখের কারণ মনে করতো। তারা বলতো, এ ব্যক্তি আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে, নখ থেকে গোশত আলাদা করে রেখে দিয়েছে। তাদের একথার জবাবে বলা হয়েছেঃ অজ্ঞের দল! তোমরা যাকে দুঃখ ও কষ্ট মনে করো তা আসলে তোমাদের জন্য আল্লাহর রহমত।
.
১০১.
অর্থাৎ আল্লাহর পাকড়াও। রিসালাতের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করার কারণে যে কোন ধরনের আযাবের আকারে আল্লাহর যে পাকড়াও আসবে।
.
১০২.
সূরার শুরুতে যেসব বিরোধিতাপূর্ণ কথা, ষড়যন্ত্র ও নীরব কানাকানির কথা বলা হয়েছিল সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। সেখানেও রসূলের মুখ দিয়ে এদের এ জবাব দেয়া হয়েছিল যে, তোমরা যেসব কথা বলছো সেগুলো সবই আল্লাহ‌ শুনছেন এবং তিনি সেগুলো জানেন। অর্থাৎ এমন মনে করো না যে, এসব বাতাসে উড়ে গেছে এবং এসবের জন্য আর কখনো জবাবদিহি করতে হবে না।
অনুবাদ: