পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

১৫৪ আয়াত

৫৩ ) আমি নিজের নফ্‌সকে দোষমুক্ত করছি না। নফ্‌স তো খারাপ কাজ করতে প্ররোচিত করে, তবে যদি কারোর প্রতি আমার রবের অনুগ্রহ হয় সে ছাড়া। অবশ্যি আমার রব বড়ই ক্ষমাশীল ও মেহেরবান।”
۞ وَمَآ أُبَرِّئُ نَفْسِىٓ ۚ إِنَّ ٱلنَّفْسَ لَأَمَّارَةٌۢ بِٱلسُّوٓءِ إِلَّا مَا رَحِمَ رَبِّىٓ ۚ إِنَّ رَبِّى غَفُورٌۭ رَّحِيمٌۭ ٥٣
৫৪ ) বাদশাহ বললো, “তাঁকে আমার কাছে আনো, আমি তাঁকে একান্তভাবে নিজের জন্য নির্দিষ্ট করে নেব।” <br/> ইউসুফ যখন তার সাথে আলাপ করলো, সে বললো, “এখন আপনি আমাদের এখানে সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী এবং আপনার আমানতদারীর ওপর পূর্ণ ভরসা আছে।” ৪৭
وَقَالَ ٱلْمَلِكُ ٱئْتُونِى بِهِۦٓ أَسْتَخْلِصْهُ لِنَفْسِى ۖ فَلَمَّا كَلَّمَهُۥ قَالَ إِنَّكَ ٱلْيَوْمَ لَدَيْنَا مَكِينٌ أَمِينٌۭ ٥٤
৫৫ ) ইউসুফ বললো, “দেশের অর্থ-সম্পদ আমার হাতে সোপর্দ করুন। আমি সংরক্ষণকারী এবং জ্ঞানও রাখি।” ৪৭(ক)
قَالَ ٱجْعَلْنِى عَلَىٰ خَزَآئِنِ ٱلْأَرْضِ ۖ إِنِّى حَفِيظٌ عَلِيمٌۭ ٥٥
৫৬ ) এভাবে আমি পৃথিবীতে ইউসুফের জন্য কর্তৃত্বের পথ পরিষ্কার করেছি। সেখানে সে যেখানে ইচ্ছা অবস্থান করতে পারতো। ৪৮ আমি যাকে ইচ্ছা নিজের রহমতে অভিষিক্ত করি। সৎকর্মশীল লোকদের প্রতিদান আমি নষ্ট করি না।
وَكَذَٰلِكَ مَكَّنَّا لِيُوسُفَ فِى ٱلْأَرْضِ يَتَبَوَّأُ مِنْهَا حَيْثُ يَشَآءُ ۚ نُصِيبُ بِرَحْمَتِنَا مَن نَّشَآءُ ۖ وَلَا نُضِيعُ أَجْرَ ٱلْمُحْسِنِينَ ٥٦
৫৭ ) আর যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া সহকারে কাজ করতে থেকেছে আখেরাতের প্রতিদান তাদের জন্য আরো ভালো। ৪৯
وَلَأَجْرُ ٱلْـَٔاخِرَةِ خَيْرٌۭ لِّلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَكَانُوا۟ يَتَّقُونَ ٥٧
৫৮ ) ইউসুফের ভাইয়েরা মিসরে এলো এবং তাঁর কাছে হাযির হলো। ৫০ সে তাদেরকে চিনে ফেললো। কিন্তু তারা তাঁকে চিনতে পারলো না। ৫১
وَجَآءَ إِخْوَةُ يُوسُفَ فَدَخَلُوا۟ عَلَيْهِ فَعَرَفَهُمْ وَهُمْ لَهُۥ مُنكِرُونَ ٥٨
৫৯ ) তারপর সে যখন তাদের জিনিসপত্র তৈরী করালো তখন চলার সময় তাদেরকে বললো, “তোমাদের বৈমাত্রেয় ভাইকে আমাদের কাছে আনবে, দেখছো না আমি কেমন পরিমাপ পাত্র ভরে দেই এবং আমি কেমন ভালো অতিথিপরায়ণ?
وَلَمَّا جَهَّزَهُم بِجَهَازِهِمْ قَالَ ٱئْتُونِى بِأَخٍۢ لَّكُم مِّنْ أَبِيكُمْ ۚ أَلَا تَرَوْنَ أَنِّىٓ أُوفِى ٱلْكَيْلَ وَأَنَا۠ خَيْرُ ٱلْمُنزِلِينَ ٥٩
৬০ ) যদি তোমরা তাকে না আনো তাহলে আমার কাছে তোমাদের জন্য কোন শস্য নেই বরং তোমরা আমার ধারে-কাছেও এসো না।” ৫২
فَإِن لَّمْ تَأْتُونِى بِهِۦ فَلَا كَيْلَ لَكُمْ عِندِى وَلَا تَقْرَبُونِ ٦٠
৬১ ) তারা বললো, “আমরা চেষ্টা করবো যাতে আব্বাজান তাঁকে পাঠাতে রাযী হয়ে যান এবং আমরা নিশ্চয়ই এমনটি করবো।”
قَالُوا۟ سَنُرَٰوِدُ عَنْهُ أَبَاهُ وَإِنَّا لَفَـٰعِلُونَ ٦١
৬২ ) ইউসুফ নিজের গোলামদেরকে ইশারা করে বললো, “ওরা শস্যের বিনিময়ে যে অর্থ দিয়েছে তা চুপিসারে ওদের জিনিসপত্রের মধ্যেই রেখে দাও।” ইউসুফ এটা করলো এ আশায় যে, বাড়িতে পৌঁছে তারা নিজেদের ফেরত পাওয়া অর্থ চিনতে পারবে (অথবা এ দানশীলতার ফলে তারা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হবে) এবং বিচিত্র নয় যে, তারা আবার ফিরে আসবে।
وَقَالَ لِفِتْيَـٰنِهِ ٱجْعَلُوا۟ بِضَـٰعَتَهُمْ فِى رِحَالِهِمْ لَعَلَّهُمْ يَعْرِفُونَهَآ إِذَا ٱنقَلَبُوٓا۟ إِلَىٰٓ أَهْلِهِمْ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ ٦٢
.
৪৭.
এটা যেন বাদশাহর পক্ষ থেকে এ মর্মে একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল যে, আপনার হাতে যে কোন দায়িত্বপূর্ণ কাজ সোপর্দ করা যেতে পারে।
৪৭(ক).
এর আগে যেসব আলোচনা হয়েছে তার আলোকে পর্যালোচনা করলে একথা পরিষ্কার বুঝা যাবে যে, কোন পদলোভী ব্যক্তি বাদশাহর ইশারা পাওয়ার সাথে সাথেই যেমন কোন পদ লাভের জন্য আবেদন করে বসে এটি তেমনি ধরনের কোন চাকরির আবেদন ছিল না। আসলে এটি ছিল একটি বিপ্লবের দরজা খোলার জন্য সর্বশেষ আঘাত। হযরত ইউসুফের নৈতিক শক্তির বলে বিগত দশ-বারো বছরের মধ্যে এ বিপ্লব ক্রমবিকাশ লাভ করে আত্মপ্রকাশ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল এবং এখন এর দরজা খোলার জন্য শুধুমাত্র একটি হালকা আঘাতের প্রয়োজন ছিল। হযরত ইউসুফ (আ) একটি সুদীর্ঘ ধারাবাহিক পরীক্ষার অঙ্গন অতিক্রম করে আসছিলেন। কোন অজ্ঞাত স্থানে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। বরং বাদশাহ থেকে শুরু করে মিসরের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই এ সম্পর্কে অবগত ছিল। এসব পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি একথা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে, আমানতদারী, সততা, ধৈর্য, সংযম, উদারতা, বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শীতার ক্ষেত্রে অন্তত সমকালীন লোকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁর ব্যক্তিত্বের এ গুণগুলো এমনভাবে বিকশিত হয়ে উঠেছিল যে, এগুলো অস্বীকার করার সাধ্য কারোর ছিল না। দেশবাসী মুখে এগুলোর পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিল। তাদের হৃদয় এগুলোর দ্বারা বিজিত হয়েছিল। বাদশাহ নিজেই এগুলোর সামনে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। এখন তাঁর “সংরক্ষণকারী” ও “জ্ঞানী হওয়া শুধুমাত্র একটি দাবীর পর্যায়ভুক্ত ছিল না বরং এটি ছিল একটি প্রমাণিত ঘটনা। সবাই এটা বিশ্বাস করতো। এখন শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কর্তৃত্ব পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করার ক্ষেত্রে হযরত ইউসুফের সম্মতিটুকুই বাকি ছিল। বাদশাহ, তাঁর মন্ত্রী পরিষদ ও রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাগণ একথা ভালোভাবেই জেনেছিলেন যে, তিনি ছাড়া এ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করার মতো আর দ্বিতীয় কোন যোগ্য ব্যক্তিত্বই নেই। কাজেই নিজের এ উক্তির সাহায্যে তিনি এ সম্মতিটুকুরই প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন মাত্র। তাঁর কন্ঠে এ দাবীটুকু উচ্চারিত হবার সাথে সাথেই বাদশাহ ও তাঁর রাজপরিষদ যেভাবে দু’হাত বাড়িয়ে তা গ্রহণ করে নিয়েছেন তা একথাই প্রমাণ করে যে, ফল পুরোপুরি পেকে গিয়েছিল এবং তা ছিঁড়ে পড়ার জন্য শুধুমাত্র একটা ইশারার অপেক্ষায় ছিল। (তালমূদের বর্ণনা মতে হযরত ইউসুফকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব দান করার ফায়সালাটি কেবল বাদশাহ একাই করেননি। বরং সমগ্র রাজপরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে তাঁর পক্ষে রায় দিয়েছিল।

হযরত ইউসুফ (আ) এই যে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব চান এবং যা তাকে দেয়া হয়, এটা কোন্ ধরনের ছিল? অজ্ঞ লোকেরা এখানে خَزَائِنِ الْأَرْضِ (দেশের ধন-সম্পদ) শব্দ এবং পরবর্তী পর্যায়ে অগ্রসর হয়ে খাদ্য বন্টনের ঘটনাবলীর উল্লেখ দেখে মনে করেন সম্ভবত তিনি ধনভান্ডারের কর্তা, অর্থ বিভাগীয় কর্মকর্তা, দুর্ভিক্ষ কমিশনার, অর্থমন্ত্রী অথবা খাদ্য মন্ত্রী ধরনের একটা কিছু ছিলেন। কিন্তু কুরআন, বাইবেল ও তালমূদের সম্মিলিত সাক্ষ্য হচ্ছে এই যে, আসলে ইউসুফকে মিসর রাজ্যের সর্বময় কর্তৃত্বের আসনে (রোমীয় পরিভাষায় ডিকটেটর) অধিষ্ঠিত করা হয়েছিল। দেশের সর্বময় কর্তৃত্ব তাঁকে দান করা হয়েছিল। কুরআন বলছে, হযরত ইয়াকূব (আ) যখন মিসরে পৌঁছলেন তখন ইউসুফ আলাইহিস সালাম সিংহাসনে বসেছিলেন وَرَفَعَ أَبَوَيْهِ عَلَى الْعَرْشِ এবং তিনি নিজের পিতা-মাতাকে তাঁর পাশে সিংহাসনে বসালেন)। হযরত ইউসুফের মুখ নিঃসৃত এ বাণী কুরআনে উদ্ধৃত হয়েছেঃ “হে আমার রব! তুমি আমাকে বাদশাহী দান করেছো।” (قَدْ آتَيْتَنِي مِنَ الْمُلْكِ)(يَتَبَوَّأُ مِنْهَا حَيْثُ يَشَاءُ) আবার আল্লাহ মিসরে তাঁর কর্তৃত্বের অবস্থা এভাবে বর্ণনা করছেন যেন সমগ্র মিসর তাঁর অধীনে ছিল অন্যদিকে বাইবেল সাক্ষ্য দিচ্ছেঃ

“তুমিই আমার বাটির অধ্যক্ষ হও, আমার সমস্ত প্রজা তোমার বাক্য শিরোধার্য করিবে, কেবল সিংহাসনে আমি তোমা হইতে বড় থাকিব”.......দেখো, আমি তোমাকে সমস্ত মিসর দেশের উপরে নিযুক্ত করিলাম। .........তোমার আজ্ঞা ব্যতিরেকে সমস্ত মিসর দেশে কোন লোক হাত কি পা তুলিতে পারিবে না। আর ফেরাউন যোসেফের নাম সাফনৎ পানেহ (দুনিয়ার মুক্তিদাতা) রাখিলেন।” (আদি পুস্তক ৪১: ৪০-৪৫)

আবার তালমূদ বলছে, ইউসুফের ভাইয়েরা মিসর থেকে ফিরে গিয়ে মিসরের শাসন-কর্তার (ইউসুফ) প্রশংসা করে বলেঃ

“দেশের অধিবাসীদের ওপর তিনি সর্বোচ্চ কর্তৃত্বশালী। তাঁর হুকুমে তারা বের হয় এবং তাঁর হুকুমে প্রবেশ করে তাঁর কণ্ঠ সারা দেশ শাসন করে। কোন ব্যাপারেই তাঁর ফেরাউনের অনুমতির প্রয়োজন হয় না।”

দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, হযরত ইউসুফ কি উদ্দেশ্যে এ কর্তৃত্ব চেয়েছিলেন? তিনি কি একটি কাফের সরকারের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রচলিত কুফরী নীতি ও আইনের ভিত্তিতেই পরিচালনা করার জন্য কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা চেয়েছিলেন? অথবা তাঁর সামনে এ লক্ষ্য ছিল যে, রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব লাভ করার পর দেশের তামাদ্দুনিক, নৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা ইসলামী নীতির-ভিত্তিতে ঢেলে সাজাবেন? এর সবচেয়ে চমৎকার জবাব আল্লামা যামাখ্শারী তাঁর তাফসীর “কাশ্শাফ” গ্রন্থে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেনঃ

“হযরত ইউসুফ اجْعَلْنِي عَلَى خَزَائِنِ الْأَرْضِ বলেছেন। একথা বলার পেছনে তাঁর কেবল এতটুকুই উদ্দেশ্য ছিল যে, তাঁকে আল্লাহর বিধান জারি ও সত্য প্রতিষ্ঠা করা এবং ন্যায় ও ইনসাফের সুফল চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেবার সুযোগ দেয়া হোক। আর যেসব কাজের জন্য নবীদেরকে পাঠানো হয়ে থাকে সেগুলো সম্পন্ন করার জন্য তিনি শক্তি অর্জন করবেন। তিনি রাজত্বের লোভে বা কোন বৈষয়িক লালসার বশবর্তী হয়ে এ দাবী করেননি। বরং তিনি ছাড়া আর কেউ এ কাজ করতে পারবে না একথা জেনেই এ দাবী করেছিলেন।”

আর সত্যি বলতে কি, এ প্রশ্নটি আসলে অন্য একটি প্রশ্নের জন্ম দেয়। সেটি অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক প্রশ্ন। সেটি হচ্ছে হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম নবীই ছিলেন কি না? যদি নবী থেকে থাকেন তাহলে কুরআন থেকে কি আমরা পয়গম্বরীর এ ধারণা লাভ করি যে, ইসলামের আহবায়ক নিজেই কুফরী ব্যবস্থাকে কাফেরী পদ্ধতিতে পরিচালনা করার জন্য নিজের শক্তি ও যোগ্যতা পেশ করছেন? বরং এ প্রশ্ন শুধু এখানেই শেষ হয়ে যায় না, এর চেয়েও আরো অনেক বেশী কঠিন ও নাজুক অন্য একটি প্রশ্নেরও জন্ম দেয়। অর্থাৎ হযরত ইউসুফ একজন সত্যবাদী ও সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন কি না? যদি সত্যবদী ও সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তি হয়ে থেকে থাকেন তাহলে সত্যবাদী ও সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তি কি এ ধরনের কাজ করে থাকেন যে, কারাগারে অবস্থানকালে এ প্রশ্নের মাধ্যমে তাঁর নবুওয়াতের দাওয়াতের সূচনা করেনঃ “অনেক প্রভু ভালো অথবা একজন আল্লাহ তিনি সবার ওপর বিজয়ী” এবং বারংবার মিসরবাসীদের কাছে একথা সুস্পষ্ট করে দেন যে, মিসরের বাদশাহও তোমাদের এসব বিভিন্ন মনগড়া প্রভুদের একজন আর এ সঙ্গে পরিষ্কারভাবে নিজের মিশনের এ মৌলিক বিশ্বাসটিও বর্ণনা করে দেন যে, “শাসন কর্তৃত্বের অধিকার এক আল্লাহ ছাড়া আর কারোর নেই।” কিন্তু যখন বাস্তব পরীক্ষার সময় আসে তখন এ ব্যক্তিই আবার হয়ে যান মিসরের বাদশাহর প্রভুত্ব ও কর্তৃত্বাধীনে পরিচালিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার খাদেম বরং ব্যবস্থাপক, সংরক্ষক ও পৃষ্ঠপোষক, যার মৌলিক আদর্শই ছিল, “শাসন কর্তৃত্ব আল্লাহর জন্য নয়, বাদশাহর জন্য নির্ধারিত?”

আসলে এ অংশের ব্যাখ্যায় পতন যুগের মুসলমানরা অনেকটা তেমনি ধরনের মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন যা এক সময় ইহুদিদের বৈশিষ্ট্য ছিল। ইহুদীদের অবস্থা ছিল এই যে, অতীত ইতিহাসের যেসব মনীষীর জীবন ও চরিত্র তাদেরকে উন্নতির শিখরে আরোহণে উদ্বুদ্ধ করতো, নিজেদের নৈতিক ও মানসিক পতনের যুগে তারা তাদের সবাইকে নিচে নামিয়ে নিজেদের সমপর্যায়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। এভাবে তারা নিজেদের জন্য জন্য আরো বেশি নিচে নেমে যাবার বাহানা সৃষ্টি করে নিয়েছিল। দুঃখের বিষয় যে, মুসলমানরাও একই ধরনের আচরণ করেছে। তাদের কাফের সরকারের চাকরি করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এভাবে নিচে নামতে গিয়ে ইসলাম ও তার পতাকাবাহীদের নৈতিক শ্রেষ্টত্ব দেখে তারা লজ্জা পেলো। তাই এ লজ্জা দূর করার এবং নিজেদের বিবেককে সন্তুষ্ট করার জন্য তারা নিজেদের সাথে এমন মহান মর্যাদাশীল পয়গম্বরকেও কুফরের সেবা করার পংকে নামিয়ে আনলো, যাঁর জীবন তাদেরকে এ শিক্ষা দিচ্ছিল যে, কোন দেশে যদি শুধুমাত্র একজন মর্দে মু’মিনও নির্ভেজাল ইসলামী চরিত্র এবং ঈমানী বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার অধিকারী থেকে থাকে, তাহলে সে একাকীই কেবলমাত্র নিজের চরিত্র ও বুদ্ধিমত্তার জোরে সে দেশে ইসলামী বিপ্লব সৃষ্টি করতে পারে। আর মর্দে মু’মিনের চারিত্রিক শক্তি (শর্ত হচ্ছে, সে যেন তা ব্যবহার করতে জানে এবং ব্যবহার করার ইচ্ছাও রাখে) সেনাবাহিনী ও অস্ত্র শস্ত্র ছাড়াই দেশ জয় করতে পারে এবং রাষ্ট্র ও সরকারের ওপর বিজয় লাভ করে।

৪৮.
অর্থাৎ এখন সমগ্র মিসর দেশ ছিল তার অধিকারভুক্ত। এ দেশের যে কোন জায়গায় তিনি নিজের আবাস গড়ে তুলতে পারতেন। এ দেশের কোন জায়গায় বসতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁকে বাধা দেবার ক্ষমতা কারো ছিল না। এ দেশের ওপর হযরত ইউসুফের যে পূর্ণাংগ কর্তৃত্ব অধিকার ছিল এ যেন ছিল তার বর্ণনা। প্রথম যুগের মুফাস্সিরগণ এ আয়াতের এ ব্যাখ্যাই করেছেন। ইবনে যায়েদের বরাত দিয়ে আল্লামা ইবনে জারীর তাবারী তাঁর নিজের তাফসীর গ্রন্থে এর এই অর্থ বর্ণনা করেছেন যে, আমি ইউসুফকে মিসরে যা কিছু ছিল সব জিনিসের মালিক বানিয়ে দিলাম। দুনিয়ার সেই এলাকার যেখানেই সে যা কিছু চাইতো করতে পারতো। সেই দেশটির সমগ্র এলাকা তার হাতে সোপর্দ করে দেয়া হয়েছিল। এমনকি সে যদি ফেরাউনকে নিজের অধীনস্থ করে তার ওপর কর্তৃত্ব করতে চাইতো তাহলে তাও করতে পারতো।” আল্লামা তাবারী দ্বিতীয় একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন, সেটি মুজাহিদের উক্তি। মুজাহিদ হচ্ছেন তাফসীর শাস্ত্রের প্রখ্যাত ইমাম। তাঁর মতে মিসরের বাদশাহ হযরত ইউসুফের হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
.
৪৯.
এখানে এ মর্মে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, কোন ব্যক্তি যেন পার্থিব রাষ্ট্রক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভ করাকে সততা ও সংকর্মশীলতার প্রকৃত পুরস্কার ও যথার্থ কাংখিত প্রতিদান মনে না করে বসে। বরং তাকে জেনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ আখেরাতে যে পুরস্কার দেবেন সেটিই সর্বোত্তম প্রতিদান এবং সেই প্রতিদানটিই মু’মিনের কাংখিত হওয়া উচিত।
৫০.
এখানে আবার সাত আট বছরের ঘটনা মাঝখানে বাদ দিয়ে বর্ণনার ধারাবাহিকতা এমন এক জায়গা থেকে শুরু করে দেয়া হয়েছে যেখান থেকে বনী ইসরাঈলের মিসরে স্থানান্তরিত হবার এবং হযরত ইয়াকূবের (আ) হারানো ছেলের সন্ধান পাওয়ার সূত্রপাত হয়। মাঝখানে যেসব ঘটনা বাদ দেয়া হয়েছে সেগুলোর সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে, হযরত ইউসুফের (আ) যেসব ঘটনা বাদ দেয়া হয়েছে সেগুলোর সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে, হযরত ইউসুফের (আ) রাজত্বের প্রথম সাত বছর মিসরে প্রচুর শস্য উৎপন্ন হয়। এসময় তিনি আসন্ন দুর্ভিক্ষের মোকাবিলা করার জন্য পূর্বাহ্ণে এমন সমস্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করেন যার পরামর্শ তিনি স্বপ্নের তা’বীর বলার সময় বাদশাহকে দিয়েছিলেন। এরপর শুরু হয় দুর্ভিক্ষের যামানা। এ দুর্ভিক্ষ শুধু মিসরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। আশেপাশের দেশগুলোতেও দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ে। সিরিয়া, ফিলিস্তিন, পূর্ব জর্দান, দক্ষিণ আরব সব জায়গায় চলে দুর্ভিক্ষের অবাধ বিচরণ। এ অবস্থায় হযরত ইউসুফের বিচক্ষণ ব্যবস্থাপনার কারণে একমাত্র মিসরে দুর্ভিক্ষ সত্ত্বেও খাদ্যশস্যের প্রাচুর্য থাকে। কাজেই প্রতিবেশী দেশগুলোর লোকেরা খাদ্যশস্য সংগ্রহের জন্য মিসরে আসতে বাধ্য হয়। এ সময় ফিলিস্তিন থেকে হযরত ইউসুফের (আ) ভাইয়েরা খাদ্যশস্য কেনার জন্য মিসরে পৌঁছে। সম্ভবত হযরত ইউসুফ (আ) খাদ্য ব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে তোলেন যার ফলে বাইরের দেশগুলোয় বিশেষ অনুমতিপত্র ছাড়া এবং বিশেষ পরিমাণের বেশী খাদ্য সরবরাহ করা যেতে পারতো না। এ কারণে ইউসুফের ভাইয়েরা যখন বহির্দেশ থেকে এসে খাদ্য সংগ্রহ করতে চেয়েছিল তখন সম্ভবত তাদের বিশেষ অনুমতিপত্র সংগ্রহ করার প্রয়োজন হয়েছিল এবং এভাবেই তাদের হযরত ইউসুফের সামনে হাযির হতে হয়েছিল।
৫১.
) ইউসুফের ভাইয়েরা যে ইউসুফকে চিনতে পারেনি এটা কোন অযৌক্তিক বা অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না। যে সময় তারা তাঁকে কূয়ায় ফেলে দিয়েছিল তখন তিনি ছিলেন সতের বছর বয়সের একটি কিশোর মাত্র। আর এখন তাঁর বয়স আটতিরিশ বছরের কাছাকাছি। এত দীর্ঘ সময়ে মানুষের চেহারার কাঠামোয় অনেক পরিবর্তন আসে। তাছাড়া যে ভাইকে তারা কূয়ায় ফেলে দিয়েছিল সে আজ মিসরের অধিপতি হবে, একথা তারা কল্পনাও করতে পারেনি।
.
৫২.
বর্ণনা সংক্ষেপের কারণে হয়তো কারো পক্ষে একথা অনুধাবন করা কঠিন হয়ে পড়ছে যে, হযরত ইউসুফ যখন নিজের ব্যক্তিত্বকে তাদের সামনে প্রকাশ করতে চাচ্ছিলেন না তখন আবার তাদের বৈমাত্রেয় ভাইয়ের কথা এলো কেমন করে? এবং তাকে আনার ব্যাপারে তাঁর এত বেশী পীড়াপীড়ি করারই বা অর্থ কি? কেননা, এভাবে তো রহস্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু সামান্য চিন্তা করলে একথা পরিষ্কার বুঝা যায়। সেখানে খাদ্যশস্যের নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা ছিল এবং প্রত্যেক ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য গ্রহণ করতে পারতো। শস্য নেবার জন্য তারা দশ ভাই এসেছিল। কিন্তু তারা তাদের পিতার ও একাদশতম ভাইয়ের অংশও হয়তো চেয়েছিল। একথায় হযরত ইউসুফ (আ) বলে থাকবেন, বুঝলাম তোমাদের পিতার না আসার জন্য যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। তিনি অত্যন্ত বৃদ্ধ এবং তার ওপর চোখে দেখতে পান না, ফলে তাঁর পক্ষে সশরীরে আসা সম্ভব নয়। কিন্তু ভাইয়ের না আসার কি ন্যায়সঙ্গত কারণ থাকতে পারে? এমন তো নয় যে, একজন বানোয়াট ভাইয়ের নাম করে অতিরিক্ত শস্য সংগ্রহ করে তোমরা অবৈধ ব্যবসায়ে নামার চেষ্টা করছো? জওয়াবে তারা হয়তো নিজেদের গৃহের অবস্থা বর্ণনা করেছে। তারা বলে থাকবে, সে আমাদের বৈমাত্রেয় ভাই। কিছু অসুবিধার কারণে পিতা তাকে আমাদের সাথে পাঠাতে ইতস্তত করেন। তাদের এসব কথায় হযরত ইউসুফ সম্ভবত বলেছেন, যাক এবারের জন্য তো আমি তোমাদের কথা বিশ্বাস করে পূর্ণ শস্য দিয়ে দিলাম কিন্তু আগামীতে তোমরা যদি তাকে সঙ্গে করে না আনো তাহলে তোমাদের ওপর থেকে আস্থা উঠে যাবে এবং এখান থেকে তোমরা আর কোন শস্য পাবে না। এ শাসক সুলভ হুমকি দেবার সাথে সাথে তিনি নিজের দাক্ষিণ্য ও মেহমানদারীর মাধ্যমে তাদেরকে বশীভূত করার চেষ্টা করেন। কারণ নিজের ছোট ভাইকে দেখার এবং ঘরের অবস্থা জানার জন্য তাঁর মন অস্থির হয়ে পড়েছিল। এটি ছিল ঘটনার একটি সাদামাটা চেহারা। সামান্য একটু চিন্তা-ভাবনা করলে ব্যাপারটি আপনা-আপনিই বুঝতে পারা যায়। এ অবস্থায় বাইবেলের আদি পুস্তকের ৪২-৪৩ অধ্যায়ে নানা প্রকার রং চড়িয়ে যে অতিরঞ্জিত কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে তার ওপর আস্থা স্থাপন করার কোন প্রয়োজন নেই।
.
.
অনুবাদ: