পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

১৭০ আয়াত

৮৬ ) আল্লাহর দেয়া উদ্বৃত্ত তোমাদের জন্য ভালো যদি তোমরা মু’মিন হয়ে থাকো। মোট কথা আমি তোমাদের ওপর কোন কর্ম তত্ত্বাবধানকারী নই।” ৯৫
بَقِيَّتُ ٱللَّهِ خَيْرٌۭ لَّكُمْ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ ۚ وَمَآ أَنَا۠ عَلَيْكُم بِحَفِيظٍۢ ٨٦
৮৭ ) তারা জবাব দিলঃ “হে শো’আয়েব! তোমার নামায কি তোমাকে একথা শেখায় যে, ৯৬ আমরা এমন সমস্ত মাবুদকে পরিত্যাগ করবো যাদেরকে আমাদের বাপ-দাদারা পূজা করতো? অথবা নিজেদের ধন-সম্পদ থেকে নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী খরচ করার ইখতিয়ার আমাদের থাকবে না? ৯৭ ব্যস, শুধু তুমিই রয়ে গেছো একমাত্র উচ্চ হৃদয়ের অধিকারী ও সদাচারী!”
قَالُوا۟ يَـٰشُعَيْبُ أَصَلَوٰتُكَ تَأْمُرُكَ أَن نَّتْرُكَ مَا يَعْبُدُ ءَابَآؤُنَآ أَوْ أَن نَّفْعَلَ فِىٓ أَمْوَٰلِنَا مَا نَشَـٰٓؤُا۟ ۖ إِنَّكَ لَأَنتَ ٱلْحَلِيمُ ٱلرَّشِيدُ ٨٧
৮৮ ) শো’আয়েব বললোঃ “ভাইয়েরা! তোমরা নিজেরাই ভেবে দেখো, যদি আমি আমার রবের পক্ষ থেকে একটি সুস্পষ্ট সাক্ষ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে থাকি, তারপর তিনি আমাকে উত্তম রিযিক দান করেন ৯৮ (তাহলে এরপর আমি তোমাদের গোমরাহী ও হারামখোরীর কাজে তোমাদের সাথে কেমন করে শরীক হতে পারি?) আর যেসব বিষয় থেকে আমি তোমাদের বিরত রাখতে চাই আমি নিজে কখনো সেগুলোতে লিপ্ত হতে চাই না। ৯৯ আমি তো আমার সাধ্য অনুযায়ী সংশোধন করতে চাই। যা কিছু আমি করতে চাই তা সবই আল্লাহর তাওফীকের ওপর নির্ভর করে। তাঁরই ওপর আমি ভরসা করেছি এবং সব ব্যাপারে তাঁরই দিকে রুজু করি।
قَالَ يَـٰقَوْمِ أَرَءَيْتُمْ إِن كُنتُ عَلَىٰ بَيِّنَةٍۢ مِّن رَّبِّى وَرَزَقَنِى مِنْهُ رِزْقًا حَسَنًۭا ۚ وَمَآ أُرِيدُ أَنْ أُخَالِفَكُمْ إِلَىٰ مَآ أَنْهَىٰكُمْ عَنْهُ ۚ إِنْ أُرِيدُ إِلَّا ٱلْإِصْلَـٰحَ مَا ٱسْتَطَعْتُ ۚ وَمَا تَوْفِيقِىٓ إِلَّا بِٱللَّهِ ۚ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْهِ أُنِيبُ ٨٨
৮৯ ) আর হে আমার সম্প্রদায়ের ভাইয়েরা! আমার বিরুদ্ধে তোমাদের একগুঁয়েমি যেন এমন পর্যায়ে না পৌঁছে যায় যে, শেষ পর্যন্ত তোমাদের ওপরও সেই একই আযাব এসে পড়ে, যা এসেছিল নূহ, হূদ বা সালেহের সম্প্রদায়ের ওপর। আর লূতের সম্প্রদায় তো তোমাদের থেকে বেশী দূরের নয়। ১০০
وَيَـٰقَوْمِ لَا يَجْرِمَنَّكُمْ شِقَاقِىٓ أَن يُصِيبَكُم مِّثْلُ مَآ أَصَابَ قَوْمَ نُوحٍ أَوْ قَوْمَ هُودٍ أَوْ قَوْمَ صَـٰلِحٍۢ ۚ وَمَا قَوْمُ لُوطٍۢ مِّنكُم بِبَعِيدٍۢ ٨٩
৯০ ) দেখো, নিজেদের রবের কাছে ক্ষমা চাও এবং তাঁর দিকে ফিরে এসো। অবশ্যি আমার রব করুণাশীল এবং নিজের সৃষ্টিকে ভালোবাসেন।” ১০১
وَٱسْتَغْفِرُوا۟ رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُوٓا۟ إِلَيْهِ ۚ إِنَّ رَبِّى رَحِيمٌۭ وَدُودٌۭ ٩٠
৯১ ) তারা জবাব দিলঃ “হে শো’আয়েব! তোমার অনেক কথাই তো আমরা বুঝতে পারি না ১০২ আর আমরা দেখছি তুমি আমাদের মধ্যে একজন দুর্বল ব্যক্তি। তোমার ভ্রাতৃগোষ্ঠী না থাকলে আমরা কবেই তোমাকে পাথর নিক্ষেপে মেরে ফেলতাম। আমাদের ওপর প্রবল হবার মতো ক্ষমতা তোমার নেই।” ১০৩
قَالُوا۟ يَـٰشُعَيْبُ مَا نَفْقَهُ كَثِيرًۭا مِّمَّا تَقُولُ وَإِنَّا لَنَرَىٰكَ فِينَا ضَعِيفًۭا ۖ وَلَوْلَا رَهْطُكَ لَرَجَمْنَـٰكَ ۖ وَمَآ أَنتَ عَلَيْنَا بِعَزِيزٍۢ ٩١
৯২ ) শো’আয়েব বললোঃ “ভাইয়েরা! আমার ভ্রাতৃজোট কি তোমাদের ওপর আল্লাহর চাইতে প্রবল যে, তোমরা (ভ্রাতৃজোটের ভয় করলে এবং) আল্লাহকে একেবারে পেছনে ঠেলে দিলে? জেনে রাখো, যা কিছু তোমরা করছো তা আল্লাহর পাকড়াও--- এর বাইরে নয়।
قَالَ يَـٰقَوْمِ أَرَهْطِىٓ أَعَزُّ عَلَيْكُم مِّنَ ٱللَّهِ وَٱتَّخَذْتُمُوهُ وَرَآءَكُمْ ظِهْرِيًّا ۖ إِنَّ رَبِّى بِمَا تَعْمَلُونَ مُحِيطٌۭ ٩٢
৯৩ ) হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা নিজেদের পথে কাজ করে যাও এবং আমি আমার পথে কাজ করে যেতে থাকবো। শিগগীরই তোমরা জানতে পারবে কার ওপর লাঞ্ছনার আযাব আসছে এবং কে মিথ্যুক? তোমরা প্রতীক্ষা করতে থাকো এবং আমিও তোমাদের সাথে প্রতীক্ষারত রইলাম।”
وَيَـٰقَوْمِ ٱعْمَلُوا۟ عَلَىٰ مَكَانَتِكُمْ إِنِّى عَـٰمِلٌۭ ۖ سَوْفَ تَعْلَمُونَ مَن يَأْتِيهِ عَذَابٌۭ يُخْزِيهِ وَمَنْ هُوَ كَـٰذِبٌۭ ۖ وَٱرْتَقِبُوٓا۟ إِنِّى مَعَكُمْ رَقِيبٌۭ ٩٣
৯৪ ) শেষ পর্যন্ত যখন আমার ফায়সালার সময় এসে গেলো তখন আমি নিজের রহমতের সাহায্যে শো’আয়েব ও তাঁর সাথী মু’মিনদেরকে উদ্ধার করলাম। আর যারা জুলুম করেছিল একটি প্রচণ্ড আওয়াজ তাদেরকে এমনভাবে পাকড়াও করলো যে, নিজেদের আবাস ভূমিতেই তারা নির্জীব নিস্পন্দের মতো পড়ে রইলো,
وَلَمَّا جَآءَ أَمْرُنَا نَجَّيْنَا شُعَيْبًۭا وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ مَعَهُۥ بِرَحْمَةٍۢ مِّنَّا وَأَخَذَتِ ٱلَّذِينَ ظَلَمُوا۟ ٱلصَّيْحَةُ فَأَصْبَحُوا۟ فِى دِيَـٰرِهِمْ جَـٰثِمِينَ ٩٤
৯৫ ) যেন তারা সেখানে কোনদিন বসবাসই করতো না। শোন, মাদ্য়ানবাসীরাও দূরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে যেমন সামূদ নিক্ষিপ্ত হয়েছিল।
كَأَن لَّمْ يَغْنَوْا۟ فِيهَآ ۗ أَلَا بُعْدًۭا لِّمَدْيَنَ كَمَا بَعِدَتْ ثَمُودُ ٩٥
৯৫.
অর্থাৎ তোমাদের ওপর আমার কোন জোর নেই। আমি তো শুধু একজন কল্যাণকামী উপদেষ্টা মাত্র। বড় জোর আমি তোমাদের বুঝাতে পারি। তারপর তোমরা চাইলে মানতে পারো আবার নাও মানতে পারো। আমার কাছে জবাবদিহি করার ভয় করা বা না করার প্রশ্ন নয়। বরং আসল প্রশ্ন হচ্ছে আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করা। আল্লাহর কিছু ভয় যদি তোমাদের মনে থেকে থাকে তাহলে তোমরা যা কিছু করছো তা থেকে বিরত থাকো।
৯৬.
এটি আসলে একটি তিরস্কারসূচক বাক্য। যে সমাজ আল্লাহকে ভুলে গেছে এবং ফাসেকী, অশ্লীলতা ও নৈতিকতা বিরোধী কার্যকলাপের মধ্যে ডুবে গেছে এমন প্রত্যেকটি সমাজেই এ ভাবধারা আজো মূর্ত দেখা যাবে। যেহেতু নামায দ্বীনদারীর সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে সুস্পষ্ট চিহ্ন এবং ফাসেক ও ব্যভিচারী লোকেরা নামাযকে একটি ভয়ংকর বরং সবচেয়ে মারাত্মক রোগ মনে করে থাকে তাই এ ধরনের লোকদের সমাজে নামায ইবাদাতের পরিবর্তে রোগের চিহ্ন হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। নিজেদের মধ্যে কোন ব্যক্তিকে নামায পড়তে দেখলে সঙ্গে সঙ্গেই তাদের মনে এ অনুভূতি জাগে যে, এ ব্যক্তির ওপর “দ্বীনদারীর আক্রমণ” ঘটেছে। তারপর এরা দ্বীনদারীর এ বৈশিষ্ট্যও ভালোভাবে জানে যে, এ জিনিসটি যার মধ্যে সৃষ্টি হয়ে যায় সে কেবল নিজের সৎ ও পরিচ্ছন্ন কর্মধারার ওপরই সন্তুষ্ট থাকে না বরং অন্যদেরকেও সংশোধন করার চেষ্টা করে এবং বে-দ্বীনী ও নৈতিকতা বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সমালোচনা না করে সে স্থির থাকতে পারে না। তাই নামাযের বিরুদ্ধে এদের অস্থিরতা শুধুমাত্র এ আকারে দেখা দেয় না যে, এদের এক ভাই দ্বীনদারীর মধ্যে পরিবেষ্টিত হয়ে গেছে বরং এ সঙ্গে এদের মনে সন্দেহ জাগে যে, এবার খুব শিগগির চরিত্র, নৈতিকতা ও দ্বীনদারীর ওয়াজ-নসীহত শুরু হয়ে যাবে আর এ সাথে সমাজ জীবনের প্রত্যেকটি দিকে খুঁত বের করার একটি দীর্ঘ সিলসিলার সূচনা হবে। এ কারণেই এ ধরনের সমাজে নামায সবচেয়ে বেশী ভর্ৎসনা, তিরস্কার, নিন্দা ও সমালোচনার সম্মুখীন হয়। আর নামাযী সম্পর্কে পূর্বাহ্ণে যে ধরনের আশঙ্কা করা হয়েছিল কোন নামাযী যদি ঠিক সেই পর্যায়েই অসৎকাজের সমালোচনা ও ভালো কাজ করার উপদেশ দিতে শুরু করে দেয় তাহলে তো নামাযীকে এমনভাবে দোষারোপ করা শুরু হয়ে যায় যেন সে-ই এসব আপদের উৎস।
৯৭.
এ বক্তব্যটি ইসলামের মোকাবিলায় জাহেলী মতবাদের পূর্ণ পরিচয় তুলে ধরছে। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, আল্লাহর বন্দেগী ছাড়া বাকি অন্যান্য যাবতীয় পদ্ধতিই ভুল। এগুলো অনুসরণ করা উচিত নয়। কারণ অন্য কোন পদ্ধতির পক্ষে বুদ্ধি, জ্ঞান ও আসমানী কিতাবসমূহে কোন যুক্তি-প্রমাণ নেই। আর তাছাড়া শুধুমাত্র একটি সীমিত ধর্মীয় গণ্ডীর মধ্যে আল্লাহর বন্দেগী হওয়া উচিত নয় বরং তামাদ্দুনিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক তথা জীবনের সকল বিভাগেই হওয়া উচিত। কারণ দুনিয়ায় মানুষের কাছে যা কিছু আছে সব আল্লাহর মালিকানাধীন। আল্লাহর ইচ্ছার গণ্ডী ভেদ করে স্বাধীনভাবে কোন একটি জিনিসও মানুষ ব্যবহার করার অধিকার রাখে না। এর মোকাবিলায় জাহেলী মতবাদ হচ্ছে, বাপ-দাদা থেকে যে পদ্ধতি চলে আসছে মানুষের তারই অনুসারী হওয়া উচিত। এর অনুসরণের জন্য এছাড়া আর অতিরিক্ত কোন যুক্তি প্রমাণের প্রয়োজন নেই যে, এটা বাপ-দাদাদের পদ্ধতি। তাছাড়া শুধুমাত্র পূজা-অর্চনার সাথে দ্বীন ও ধর্মের সম্পর্ক রয়েছে। আর আমাদের জীবনের সাধারণ পার্থিব বিষয়াবলীর ব্যাপারে আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা দরকার, যেভাবে ইচ্ছা আমরা সেভাবে কাজ করতে পারি।

এ থেকে একথাও আন্দাজ করা যেতে পারে যে, জীবনকে ধর্মীয় ও পার্থিব এ দু’ভাগে ভাগ করার চিন্তা আজকের কোন নতুন চিন্তা নয় বরং আজ থেকে তিন সাড়ে তিন হাজার বছর আগে হযরত শো’আয়েব আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ও এ বিভক্তির ওপর ঠিক তেমনিই জোর দিয়েছিল যেমন আজকের যুগে পাশ্চাত্যবাসীরা এবং তাদের পাচ্য দেশীয় শাগরিদবৃন্দ জোর দিচ্ছেন। এটা আসলে কোন “নতুন আলো” বা “প্রগতি” নয় যা “মানসিক উন্নয়নে”র কারণে মানুষ আজ লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। বরং এটা সেই একই পুরাতন অন্ধকার ও পশ্চাৎপদ চিন্তা যা হাজার হাজার বছর আগের জাহেলিয়াতের মধ্যেও আজকের মতো একই আকারে বিরাজমান ছিল। এর সাথে ইসলামের সংঘাত আজকের নয়, অনেক পুরাতন।

.
৯৮.
রিজিক শব্দটি এখানে দ্বিবিধ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এর একটি অর্থ হচ্ছে, সত্য-সঠিক জ্ঞান, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে, আর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে এ শব্দটি থেকে সাধারণত যে অর্থ বুঝা যায় সেটি অর্থাৎ আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে জীবন যাপন করার জন্য যে জীবন সামগ্রী দান করে থাকেন। প্রথম অর্থটির প্রেক্ষিতে এ আয়াত থেকে এমন একটি বিষয়বস্তুর প্রকাশ ঘটে, যা এ সূরায় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, নূহ (আ) ও সালেহ আলাইহিস সালামের মুখ থেকে প্রকাশ হয়ে এসেছে। অর্থাৎ নবুওয়াতের আগেও আমি নিজের রবের পক্ষ থেকে সত্যের স্বপক্ষে সুস্পষ্ট সাক্ষ্য নিজের মনের মধ্যে ও বিশ্ব-জগতের সমস্ত নিদর্শনের মধ্যে পাচ্ছিলাম এবং এরপর আমার রব আমাকে সরাসরিভাবেও সত্য-জ্ঞান দান করেছেন। এখন তোমরা যেসব গোমরাহী ও নৈতিকতা বিরোধী কাজে লিপ্ত রয়েছো তাতে আমার পক্ষে জেনে বুঝে লিপ্ত হওয়া কেমন করে সম্ভবপর হতে পারে? আর দ্বিতীয় অর্থের প্রেক্ষিতে হযরত শো’আয়েবকে তারা ভর্ৎসনা করেছিল এ আয়াতটিকে তার জওয়াব বলা যায়। হযরত শো’আয়বকে তারা ভর্ৎসনা করে বলেছিলঃ “ব্যস শুধু তুমিই রয়ে গেছো একজন উদারমনা ও সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তি। এ কড়া ও তিক্ত আক্রমণের জবাব এভাবে দেয়া হয়েছেঃ “ভাইয়েরা! যদি আমার রব সত্যকে চিনবার মতো অন্তরদৃষ্টি এবং হালাল রিযিক আমাকে দিয়ে থাকেন তাহলে তোমাদের নিন্দাবাদের কারণে এ অনুগ্রহ কি করে বিগ্রহে পরিণত হবে? আল্লাহ যখন আমর প্রতি মেহেরবানী করেছেন তখন তোমাদের ভ্রষ্টতা ও হারাম খাওয়াকে আমি সত্য ও হালাল গণ্য করে তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞ হই কেমন করে?
৯৯.
অর্থাৎ একথা থেকেই তোমরা আমার সত্যতা আন্দাজ করে নিতে পারো যে, অন্যদের আমি যা কিছু বলি আমি নিজেও তা করি। যদি আমি তোমাদের আল্লাহ‌ ছাড়া অন্য কোন ইলাহর পূজা বেদীতে যেতে নিষেধ করতাম এবং নিজে কোন বেদীর সেবক হয়ে বসতাম তাহলে নিঃসন্দেহে তোমরা বলতে পারতে, নিজের পীরগিরির ব্যবসায়ের প্রসারের জন্য অন্য দোকানগুলোর সুনাম নষ্ট করতে চাচ্ছি। যদি আমি তোমাদের হারাম জিনিস খেতে নিষেধ করতাম এবং নিজের কারবারে বেঈমানী করতে থাকতাম তাহলে তোমরা অবশ্যই এ সন্দেহ পোষণ করতে পারতে যে, আমি নিজের সুনাম প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ঈমানদারীর ঢাক পিটাচ্ছি। কিন্তু তোমরা দেখছো, যেসব অসৎকাজ থেকে আমি তোমাদের নিষেধ করছি, আমি নিজেও সেগুলো থেকে দূরে থাকছি। যেসব কলঙ্ক থেকে আমি তোমাদের মুক্ত দেখতে চাচ্ছি আমার নিজের জীবনও তা থেকে মুক্ত। তোমাদের আমি যে পথের দিকে আহবান জানাচ্ছি আমার নিজের জন্যও আমি সেই পথটিই পছন্দ করেছি। এসব জিনিস একথা প্রমাণ করে যে, আমি যে দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছি সে ব্যাপারে আমি সত্যবাদী ও একনিষ্ঠ।
.
১০০.
অর্থাৎ লূতের সম্প্রদায়ের ঘটনা তো খুব বেশী দিনের কথা নয়। তোমাদের সামনে এ ঘটনা এখনো তরতাজা আছে। তোমাদের কাছাকাছি এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছিল। সম্ভবত লূতের কওমের ধ্বংসের পর তখন ছ’ সাতশো বছরের বেশী সময় অতিক্রান্ত হয়নি। আর ভৌগোলিক দিক দিয়েও লূতের কওম যেখানে বসবাস করতো শো’আয়েবের কওমের এলাকাও ছিল একেবারে তার লাগোয়া।
১০১.
অর্থাৎ মহান আল্লাহ‌ পাষাণ হৃদয় ও নির্দয় নন। নিজের সৃষ্টির সাথে তাঁর কোন শত্রুতা নেই। তাদেরকে অযথা শাস্তি দিতে তিনি চান না। নিজের বান্দাদেরকে মারপিট করে তিনি খুশী হন না। তোমরা যখন নিজেদের বিদ্রোহাত্মক কার্যকলাপে সীমা অতিক্রম করে যাও এবং কোন প্রকারেই বিপর্যয় সৃষ্টিতে বিরত হও না তখন তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও তোমাদের শাস্তি দেন। নয়তো তাঁর অবস্থা হচ্ছে এই যে, তোমরা যতই দোষ কর না কেন যখনই তোমরা নিজেদের কৃতকর্মের ব্যাপারে লজ্জিত হয়ে তাঁর দিকে ফিরে আসবে তখনই তাঁর হৃদয়কে নিজেদের জন্য প্রশস্ততর পাবে। কারণ নিজের সৃষ্ট জীবের প্রতি তাঁর স্নেহ ও ভালোবাসার অন্ত নেই।

এ বিষয়বস্তুটিকে নবী ﷺ দু’টি অত্যন্ত সূক্ষ্ম দৃষ্টান্ত দিয়ে সুস্পষ্ট করেছেন। তিনি একটি দৃষ্টান্ত এভাবে দিয়েছেন যে, তোমাদের কোন ব্যক্তির উট যদি কোন বিশুষ্ক তৃণ-পানিহীন এলাকায় হারিয়ে গিয়ে থাকে, তার পিঠে তার পানাহারের সামগ্রীও থাকে এবং সে ব্যক্তি তার খোঁজ করতে করতে নিরাশ হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় জীবন সম্পর্কে নিরাশ হয়ে সে একটি গাছের নীচে শুয়ে পড়ে। ঠিক এমনি অবস্থায় সে দেখে তার উটটি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এ সময় সে যে পরিমাণ খুশী হবে আল্লাহর পথভ্রষ্ট বান্দা সঠিক পথে ফিরে আসার ফলে আল্লাহ‌ তার চেয়ে অনেক বেশী খুশী হন। দ্বিতীয় দৃষ্টান্তটি এর চেয়ে আরো বেশী মর্মস্পর্শী। হযরত উমর (রা.) বলেন, একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কিছু যুদ্ধবন্দী এলো। এদের মধ্যে একজন মহিলাও ছিল। তার দুগ্ধপোষ্য শিশুটি হারিয়ে গিয়েছিল। মাতৃস্নেহে সে এতই অস্থির হয়ে পড়েছিল যে, কোন বাচ্চা সামনে দেখলেই তাকে তুলে নিয়ে বুকে চেপে ধরতো এবং নিজের বুকের দুধ তাকে পান করাতে থাকতো। তার এ অবস্থা দেখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি মনে করো এ মা তার নিজের বাচ্চাকে নিজের হাতে আগুনে ছুঁড়ে ফেলতে পারে? আমরা জবাব দিলামঃ কখনোই নয়, তার নিজের ছুঁড়ে দেবার তো কোন প্রশ্নই ওঠে না, বাচ্চা নিজেই যদি আগুনে পড়ে যায় তাহলে সে তাকে বাঁচাবার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। তিনি বলেনঃ

اللَّهُ أَرْحَمُ بِعِبَادِهِ مِنْ هَذِهِ بِوَلَدِهَا

“এ মহিলা তার বাচ্চার প্রতি যে পরিমাণ অনুগ্রহশীল আল্লাহর অনুগ্রহ তাঁর বান্দার প্রতি তার চেয়ে অনেক বেশী।”

আর এমনি চিন্তা-ভাবনা করলে একথা সহজেই বুঝা যায়। আল্লাহই তো বাচ্চার লালন-পালনের জন্য মা-বাপের মনে স্নেহ-প্রীতি সৃষ্টি করে দিয়েছেন। নয়তো আল্লাহ যদি এ স্নেহ-প্রীতি সৃষ্টি না করে দিতেন তাহলে বাচ্চাদের মা-বাপের চেয়ে বড় শত্রু আর হতো না। কারণ তারা মা-বাপের জন্য হয় সবচেয়ে বেশী কষ্টদায়ক। এখন যে আল্লাহ মাতৃ-পিতৃ স্নেহের স্রষ্টা তাঁর নিজের মধ্যে নিজের সৃষ্টির জন্য কি পরিমাণ স্নেহ-প্রীতি-ভালোবাসা থাকবে--- একথা প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেই আন্দাজ করতে পারে।

১০২.
হযরত শো’আয়েব কোন বিদেশী ভাষায় কথা বলছিলেন তাই তারা বুঝতে পারছিল না, এমন কোন ব্যাপার ছিল না। অথবা তাঁর কথা কঠিন, সূক্ষ্ম বা জটিলও ছিল না। কথা সবই সোজা ও পরিষ্কার ছিল। সেখানকার প্রচলিত ভাষায়ই কথা বলা হতো। কিন্তু তাদের মানসিক কাঠামো এত বেশী বেঁকে গিয়েছিল যে, হযরত শো’আয়েবের সোজা সরল কথাবার্তা তার মধ্যে কোন প্রকারেই প্রবেশ করতে পারতো না। একথা স্বতঃসিদ্ধ যে, যারা অন্ধপ্রীতি, বিদ্বেষ ও গোষ্ঠী স্বার্থ দোষে দুষ্ট হয় এবং প্রবৃত্তির লালসার পূজা করার ক্ষেত্রে একগুঁয়েমির নীতি অবলম্বন করে, আবার এ সঙ্গে কোন বিশেষ চিন্তাধারার ওপর অনড় হয়ে বসে থাকে তারা তো প্রথমত এমন কোন কথা শুনতেই পারে না যা তাদের চিন্তাধারা থেকে ভিন্নতর আর যদি কখনো শুনেই নিয়ে থাকে তাহলে তারা বুঝতেই পারে না যে, এসব আবার কেমন ধারার কথা!
১০৩.
একথা অবশ্যি সামনে থাকা দরকার যে, এ আয়াতগুলো যখন নাযিল হয় তখন হুবহু একই রকম অবস্থা মক্কাতেও বিরাজ করছিল। সে সময় কুরাইশরাও একইভাবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রক্ত পিপাসু হয়ে উঠেছিল। তারা তাঁর জীবননাশ করতে চাচ্ছিল। কিন্তু শুধু নবী হাশেম তাঁর পেছনে ছিল বলেই তাঁর গায়ে হাত দিতে ভয় পাচ্ছিল। কাজেই হযরত শো’আয়েব ও তাঁর কওমের এ ঘটনাকে যথাযথভাবে কুরাইশ ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে দিয়ে বর্ণনা করা হচ্ছে এবং সামনের দিকে হযরত শো’আয়েরবের যে চরম শিক্ষণীয় জবাব উদ্ধৃত করা হয়েছে তার মধ্যে এ অর্থ লুকিয়ে রয়েছে যে, হে কুরইশের লোকেরা! তোমাদের জন্যও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে এ একই জবাব দেয়া হলো।
.
.
.
.
অনুবাদ: