পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

১৭০ আয়াত

২৩ ) যে মহিলাটির ঘরে সে ছিল সে তাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করতে থাকলো এবং একদিন সে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বললো, “চলে এসো।” ইউসুফ বললো, “আমি আল্লাহ‌র আশ্রয় নিচ্ছি, আমার রব তো আমাকে ভালই মর্যাদা দিয়েছেন (আর আমি এ কাজ করবো!)। এ ধরনের জালেমরা কখনো কল্যাণ লাভ করতে পারে না।” ২১
وَرَٰوَدَتْهُ ٱلَّتِى هُوَ فِى بَيْتِهَا عَن نَّفْسِهِۦ وَغَلَّقَتِ ٱلْأَبْوَٰبَ وَقَالَتْ هَيْتَ لَكَ ۚ قَالَ مَعَاذَ ٱللَّهِ ۖ إِنَّهُۥ رَبِّىٓ أَحْسَنَ مَثْوَاىَ ۖ إِنَّهُۥ لَا يُفْلِحُ ٱلظَّـٰلِمُونَ ٢٣
২৪ ) মহিলাটি তাঁর দিকে এগিয়ে এলো এবং ইউসুফও তার দিকে এগিয়ে যেতো যদি না তাঁর রবের জ্বলন্ত প্রমাণ প্রত্যক্ষ করতো। ২২ এমনটিই হলো, যাতে আমি তার থেকে অসৎবৃত্তি ও অশ্লীলতা দূর করে দিতে পারি। ২৩ আসলে সে ছিল আমার নির্বাচিত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত।
وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِۦ ۖ وَهَمَّ بِهَا لَوْلَآ أَن رَّءَا بُرْهَـٰنَ رَبِّهِۦ ۚ كَذَٰلِكَ لِنَصْرِفَ عَنْهُ ٱلسُّوٓءَ وَٱلْفَحْشَآءَ ۚ إِنَّهُۥ مِنْ عِبَادِنَا ٱلْمُخْلَصِينَ ٢٤
২৫ ) শেষ পর্যন্ত ইউসুফ ও সে আগে-পিছে দরজার দিকে দৌড়ে গেলো এবং সে পেছন থেকে ইউসুফের জামা (টেনে ধরে) ছিঁড়ে ফেললো। উভয়েই দরজার ওপর তার স্বামীকে উপস্থিত পেলো। তাকে দেখতেই মহিলাটি বলতে লাগলো, “তোমার পরিবারের প্রতি যে অসৎ কামনা পোষণ করে তার কি শাস্তি হতে পারে? তাকে কারাগারে প্রেরণ করা অথবা কঠোর শাস্তি দেয়া ছাড়া আর কি শাস্তি দেয়া যেতে পারে?”
وَٱسْتَبَقَا ٱلْبَابَ وَقَدَّتْ قَمِيصَهُۥ مِن دُبُرٍۢ وَأَلْفَيَا سَيِّدَهَا لَدَا ٱلْبَابِ ۚ قَالَتْ مَا جَزَآءُ مَنْ أَرَادَ بِأَهْلِكَ سُوٓءًا إِلَّآ أَن يُسْجَنَ أَوْ عَذَابٌ أَلِيمٌۭ ٢٥
২৬ ) ইউসুফ বললো, “সে-ই আমাকে ফাঁসাবার চেষ্টা করছিল।” মহিলাটির নিজের পরিবারের একজন (পদ্ধতিগত) সাক্ষ্য দিল, ২৪ “যদি ইউসুফের জামা সামনের দিক থেকে ছেঁড়া থাকে তাহলে মহিলাটি সত্য কথা বলেছে এবং সে মিথ্যুক
قَالَ هِىَ رَٰوَدَتْنِى عَن نَّفْسِى ۚ وَشَهِدَ شَاهِدٌۭ مِّنْ أَهْلِهَآ إِن كَانَ قَمِيصُهُۥ قُدَّ مِن قُبُلٍۢ فَصَدَقَتْ وَهُوَ مِنَ ٱلْكَـٰذِبِينَ ٢٦
২৭ ) আর যদি তাঁর জামা পেছনের দিক থেকে ছেঁড়া থাকে তাহলে মহিলাটি মিথ্যা কথা বলেছে এবং সে সত্যবাদী।” ২৫
وَإِن كَانَ قَمِيصُهُۥ قُدَّ مِن دُبُرٍۢ فَكَذَبَتْ وَهُوَ مِنَ ٱلصَّـٰدِقِينَ ٢٧
২৮ ) স্বামী যখন দেখলো ইউসুফের জামা পেছনের দিক থেকে ছেঁড়া তখন সে বললো, “এসব তোমাদের মেয়ে লোকদের ছলনা। সত্যিই বড়ই ভয়ানক তোমাদের ছলনা!
فَلَمَّا رَءَا قَمِيصَهُۥ قُدَّ مِن دُبُرٍۢ قَالَ إِنَّهُۥ مِن كَيْدِكُنَّ ۖ إِنَّ كَيْدَكُنَّ عَظِيمٌۭ ٢٨
২৯ ) হে ইউসুফ! এ ব্যাপারটি উপেক্ষা করো। আর হে নারী! তুমি নিজের অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো, তুমিই আসল অপরাধী।” ২৫(ক)
يُوسُفُ أَعْرِضْ عَنْ هَـٰذَا ۚ وَٱسْتَغْفِرِى لِذَنۢبِكِ ۖ إِنَّكِ كُنتِ مِنَ ٱلْخَاطِـِٔينَ ٢٩
৩০ ) শহরের মেয়েরা পরস্পর বলাবলি করতে লাগলো, “আযীযের স্ত্রী তার যুবক গোলামের পেছনে পড়ে আছে, প্রেম তাকে উন্মাদ করে দিয়েছে। আমাদের মতে সে পরিষ্কার ভুল করে যাচ্ছে।”
۞ وَقَالَ نِسْوَةٌۭ فِى ٱلْمَدِينَةِ ٱمْرَأَتُ ٱلْعَزِيزِ تُرَٰوِدُ فَتَىٰهَا عَن نَّفْسِهِۦ ۖ قَدْ شَغَفَهَا حُبًّا ۖ إِنَّا لَنَرَىٰهَا فِى ضَلَـٰلٍۢ مُّبِينٍۢ ٣٠
৩১ ) সে যখন তাদের এ শঠতাপূর্ণ কথা শুনলো তখন তাদেরকে ডেকে পাঠালো। তাদের জন্য হেলান দিয়ে বসার মজলিসের আয়োজন করলো। ২৬ খাওয়ার বৈঠকে তাদের সবার সামনে একটি করে ছুরি রাখলো। (তারপর ঠিক সেই মুহূর্তে যখন তারা ফল কেটে কেটে খাচ্ছিল) সে ইউসুফকে তাদের সামনে বের হয়ে আসার ইশারা করলো। যখন ঐ মেয়েদের দৃষ্টি তাঁর ওপর পড়লো, তারা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলো এবং নিজের হাত কেটে ফেললো। তারা বললো, “আল্লাহর কী অপার মহিমা! এতো মানুষ নয়, এতো এক মহিমান্বিত ফেরেশতা।”
فَلَمَّا سَمِعَتْ بِمَكْرِهِنَّ أَرْسَلَتْ إِلَيْهِنَّ وَأَعْتَدَتْ لَهُنَّ مُتَّكَـًۭٔا وَءَاتَتْ كُلَّ وَٰحِدَةٍۢ مِّنْهُنَّ سِكِّينًۭا وَقَالَتِ ٱخْرُجْ عَلَيْهِنَّ ۖ فَلَمَّا رَأَيْنَهُۥٓ أَكْبَرْنَهُۥ وَقَطَّعْنَ أَيْدِيَهُنَّ وَقُلْنَ حَـٰشَ لِلَّهِ مَا هَـٰذَا بَشَرًا إِنْ هَـٰذَآ إِلَّا مَلَكٌۭ كَرِيمٌۭ ٣١
৩২ ) আযীযের স্ত্রী বললো, “দেখলে তো! এ হলো সেই ব্যক্তি যার ব্যাপারে তোমরা আমার বিরুদ্ধে নিন্দাবাদ করতে। অবশ্যই আমি তাঁকে প্ররোচিত করার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু সে নিজেকে রক্ষা করেছে। যদি সে আমার কথা না মেনে নেয় তাহলে কারারুদ্ধ হবে এবং নিদারুণভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে।” ২৭
قَالَتْ فَذَٰلِكُنَّ ٱلَّذِى لُمْتُنَّنِى فِيهِ ۖ وَلَقَدْ رَٰوَدتُّهُۥ عَن نَّفْسِهِۦ فَٱسْتَعْصَمَ ۖ وَلَئِن لَّمْ يَفْعَلْ مَآ ءَامُرُهُۥ لَيُسْجَنَنَّ وَلَيَكُونًۭا مِّنَ ٱلصَّـٰغِرِينَ ٣٢
২১.
সাধারণভাবে মুফাস্সির ও অনুবাদকগণ মনে করে থাকেন, এখানে “আমার রব” তথা আমার প্রভু শব্দটি বলে হযরত ইউসুফ সে সময় যার অধীনে চাকরি করতেন তার কথা বলতে চেয়েছেন। তারা মনে করেন, তাঁর এ জবাবের অর্থ ছিল এই যে, আমার মনিব তো আমাকে খুব যত্নের সাথেই রেখেছেন, এ অবস্থায় আমি তার স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করার মতো নিমকহারামী কেমন করে করতে পারি? কিন্তু এ অনুবাদ ও ব্যাখ্যার আমি কঠোর বিরোধিতা করছি। যদিও আরবী ভাষার দিক দিয়ে এ অর্থ গ্রহণ করারও অবকাশ আছে, কারণ আরবীতে “রব” শব্দটি প্রভু অর্থে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু একজন নবী একটি গুনাহ থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে আল্লাহর পরিবর্তে কোন বান্দার প্রতি নজর দেবেন এটা তাঁর মর্যাদার তুলনায় অনেক নিম্নমানের। তাছাড়া কোন নবী আল্লাহ‌ ছাড়া অন্য কাউকে নিজের রব বলেছেন, কুরআনে এর কোন নজীরও নেই। সামনের দিকে ৪১, ৪২ ও ৫০ আয়াতে আমরা দেখছি হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম বারবার তাঁর নিজের ও মিসরীয়দের মতবাদের মধ্যে এ পার্থক্যটি সুস্পষ্ট করে তুলে ধরছেন যে, তাঁর রব হচ্ছেন আল্লাহ‌ এবং মিসরীয়রা বান্দাকে নিজেদের রব বানিয়ে রেখেছে। কাজেই এখানে আয়াতের শব্দের মধ্যে যখন এ অর্থ গ্রহণ করার অবকাশ রয়েছে যে, হযরত ইউসুফ “রব্বী” বলে আল্লাহর সত্তা বুঝাতে চেয়েছেন তখন কি কারণে আমরা এমন একটি অর্থ গ্রহণ করবো যার মধ্যে দোষের দিকটি সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে?
২২.
মূল আয়াতে আছে “বুরহান।” বুরহান মানে দলীল বা প্রমাণ। রবের প্রমাণ মানে রবের দেখিয়ে দেয়া বা বুঝিয়ে দেয়া এমন প্রমাণ যার ভিত্তিতে হযরত ইউসুফের (আ) বিবেক ব্যক্তিসত্তার কাছ থেকে একথার স্বীকৃতি আদায় করেছে যে, এ নারীর ভোগের আহবানে সাড়া দেয়া তাঁর পক্ষে শোভনীয় নয়। এ প্রমাণটি কি ছিল? ইতিপূর্বে পিছনের বাক্যেই তা বলে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ সেখানে বলা হয়েছেঃ “আমার রব তো আমাকে ভালই মর্যাদা দিয়েছেন আর আমি খারাপ কাজ করবো! এ ধরনের জালেমরা কখনো কল্যাণ লাভ করতে পারে না।” এ অকাট্য যুক্তিই হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামকে সদ্যোন্মিত যৌবনকালের এ সংকট সন্ধিক্ষণে পাপ কাজ থেকে বিরত রেখেছিল। তারপর বলা হলো, “ইউসুফও তার দিকে এগিয়ে যেতো যদি তা তাঁর রবের জ্বলন্ত প্রমাণ প্রত্যক্ষ করতো।” এ থেকে নবীগণের নিষ্পাপ হবার (ইস্মতে আম্বিয়া) তত্ত্বের অর্ন্তনিহিত সত্য পুরোপুরি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। নবীর নিষ্পাপ হবার মানে এ নয় যে, তাঁর গুনাহ, ভুল ও ত্রুটি করার ক্ষমতা ও সামর্থ ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে, ফলে তাঁর দ্বারা গুনাহর কাজ সংঘটিত হতেই পারে না। বরং এর মানে হচ্ছে, নবী যদিও গুনাহ করার শক্তি রাখেন কিন্তু সমস্ত মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন হওয়া এবং যাবতীয় মানবিক আবেগ, অনুভূতি, ইচ্ছা-প্রবণতা থাকা সত্ত্বেও তিনি এমন সদাচারী ও আল্লাহ ভীরু হয়ে থাকেন যে, জেনে বুঝে কখনো গুনাহ করার ইচ্ছা করেন না। তাঁর বিবেকের অভ্যন্তরে আল্লাহর এমন সব শক্তিশালী দলীল প্রমাণ তিনি রাখেন যেগুলোর মোকাবিলায় প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা কখনো সফলকাম হবার সুযোগ পায় না। আর যদি সজ্ঞানে তিনি কোন ত্রুটি করেই বসেন তাহলে মহান আল্লাহ তখনই সুস্পষ্ট অহীর মাধ্যমে তা সংশোধন করে দেন। কারণ তাঁর পদস্খলন শুধুমাত্র এক ব্যক্তির পদস্খলন নয় বরং সমগ্র উম্মতের পদস্খলনের রূপ নেয়। তিনি সঠিক পথ থেকে এক চুল পরিমাণ সরে গেলে সারা দুনিয়া গোমরাহীর পথে মাইলের পর মাইল চলে যায়।
২৩.
এ উক্তির দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, তাঁর রবের প্রমাণ দেখা ও গুনাহ থেকে রক্ষা পাওয়া আমার দেয়া সুযোগ ও পথপ্রদর্শনের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে। কেননা, আমি নিজের এ নির্বাচিত বান্দাটি থেকে অসৎবৃত্তি ও অশ্লীলতা দূর করতে চাচ্ছিলাম। এর দ্বিতীয় অর্থ এও হতে পারে এবং এটি অত্যন্ত গভীর অর্থবোধক যে, ইউসুফের সাথে এই যে ব্যাপারটি ঘটে গেলো এটি আসলে তাঁর প্রশিক্ষণ পর্বের একটি প্রয়োজনীয় পর্যায় ছিল। তাঁকে অসৎ প্রবণতা ও অশ্লীলতা মুক্ত করার এবং তাঁর আত্মিক পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতাকে পূর্ণতার পর্যায়ে পৌঁছিয়ে দেবার জন্য আল্লাহর নিয়ম অনুযায়ী অপরিহার্য ছিল যে, তাঁর সামনে গুনাহের এমনি একটি সংকটময় পরিস্থিতি আসুক এবং সেই পরীক্ষার সময় তিনি নিজের সমগ্র ইচ্ছাশক্তিকে তাকওয়া ও আল্লাহ ভীতির পাল্লায় রেখে দিয়ে নিজের নফসের অসৎ প্রবণতাগুলোকে চিরকালের জন্য চূড়ান্তভাবে পরাজিত করুন। বিশেষ করে তদানীন্তন মিসরীয় সমাজে যে নৈতিক পরিবেশ বিরাজিত ছিল তা দৃষ্টি সমক্ষে রাখলে এ বিশেষ প্রশিক্ষণ পদ্ধতি অবলম্বন করার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সহজেই উপলব্ধি করা যাবে। সামনের দিকে চতুর্থ রুকূ’তে এ পরিবেশের একটি সামান্যতম নমুনা দেখানো হয়েছে। এ থেকে অনুমান করা যাবে, তৎকালীন ‘সুসভ্য মিসরে’ সাধারণভাবে এবং বিশেষ করে সে দেশের উচ্চ শ্রেণীতে স্বাধীন যৌনাচারিতা প্রায় বর্তমান যুগে পাশ্চাত্য দেশসমূহে এবং আমাদের দেশের ফিরিংগী প্রভাবিত সমাজের সমমানে অবস্থান করছিল। এ ধরনের বিকৃত রুচিসম্পন্ন লোকদের মধ্যে হযরত ইউসুফকে কাজ করতে হবে। এ কাজ করতে হবে একজন সাধারণ লোক হিসেবে নয় বরং দেশের শাসনকর্তা হিসেবে। এখন একথা সুস্পষ্ট যে, একজন সুন্দর ও সুশ্রী গোলামের জন্য যেসব ভদ্র মহিলা নিজেদেরকে এভাবে বিলীন করে দিচ্ছিল তারা একজন যুবক বয়সের সুদর্শন শাসনকর্তাকে পথভ্রষ্ট করার ও ফাঁদে ফেলার জন্য কত কী-ইনা করতে পারতো। আল্লাহ এরই পথ বন্ধ করার জন্য এ পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন যে, প্রথমেই এ পরীক্ষার মধ্য দিয়ে অগ্রসর করিয়ে হযরত ইউসুফকে পাকাপোক্ত করে দিয়েছে তারপর অন্যদিকে মিসরীয় মহিলাদেরকেও তাঁর ব্যাপারে হতাশ করে দিয়ে তাদের সমস্ত ছলনা ও কারসাজির দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন।
.
.
২৪.
এ ব্যাপারটি মনে হয় এভাবে ঘটে থাকবে যে, গৃহকর্তার সাথে সংশ্লিষ্ট মহিলার আত্মীয়দের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তিও আসছিল। সে এ ঝগড়া শুনে হয়তো বলেছেঃ এরা দু’জনেই যখন পরস্পরের প্রতি দোষারোপ করছে এবং উপস্থিত ঘটনার কোন সাক্ষীও নেই তখন পরিবেশগত সাক্ষ্যের সূত্র ধরে বিষয়টি সম্পর্কে এভাবে অনুসন্ধান চালানো যেতে পারে। কোন কোন বর্ণনায় বলা হয়েছে, একটি দুগ্ধপোষ্য শিশু এ সাক্ষ্য পেশ করেছিল। শিশুটি ঐ ঘরে দোলনায় শায়িত ছিল। আল্লাহ‌ তাকে বাকশক্তি দান করে তার মুখ দিয়ে এ সাক্ষ্যের কথা উচ্চারণ করিয়েছিলেন। কিন্তু এ বর্ণনাটি কোন নির্ভুল সনদের মাধ্যমে প্রমাণিত নয়। আর তাছাড়া এ ব্যাপারে অযথা মু’জিযার সাহায্য নেয়ার কোন প্রয়োজন অনুভূত হয় না। সাক্ষ্যদাতা যে পরিবেশগত সাক্ষ্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা ছিল যথার্থই যুক্তিসঙ্গত ব্যাপার এ সাক্ষ্যের প্রতি দৃষ্টি দিলে এক মুহূর্তেই বুঝা যায় যে, এ ব্যক্তি অতীব বিচক্ষণ, সূক্ষ্মদর্শী ও ব্যাপকতর অভিজ্ঞতার অধিকারী ছিল। ঘটনার চিত্র তার সামনে এসে যেতেই সে তার গভীরে পৌঁছে গেছে। বিচিত্র নয় যে, উল্লেখিত ব্যক্তি কোন বিচারপতি বা ম্যাজিস্ট্রেট হতে পারে। (উল্লেখ থাকে, মুফাস্সিরগণ দুগ্ধপোষ্য শিশুর সাক্ষ্যদানের যে বর্ণনা উপস্থাপন করেছেন তা ইহুদী বর্ণনা থেকে গৃহীত হয়েছে। দেখুন, তালমূদের নির্বাচিত অংশ, পল ইসহাক হিরশূন, লণ্ডন ১৮৮০, ২৫৬ পৃষ্ঠা)
.
২৫.
এর মানে হচ্ছে, ইউসুফের কাপড় যদি সামনের দিক থেকে ছেঁড়া থাকে তাহলে ইউসুফের পক্ষ থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল এবং মহিলাটি নিজেকে বাঁচাবার জন্য ধস্তাধস্তিতে লিপ্ত হয়েছিল, এটা হবে তার স্পষ্ট আলামত। কিন্তু যদি ইউসুফের কাপড় পেছনের দিক থেকে ছেঁড়া থাকে তাহলে স্পষ্ট বুঝতে হবে, মহিলাটি তাঁর পেছনে লেগেছিল এবং ইউসুফ তার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল। এছাড়াও আর একটি বাস্তব সাক্ষ্যও এ সাক্ষ্যের মধ্যে লুকিয়েছিল। সেটি হচ্ছে, এ সাক্ষী শুধুমাত্র ইউসুফ আলাইহিস সালামের কাপড়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়েছে। এ থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, মহিলাটির শরীরে বা পোশাকে আদতে বল প্রয়োগের কোন আলামতই ছিল না। অথচ যদি এটা বলাৎকারজনিত মামলা হতো তাহলে মহিলাটির শরীরে ও পোশাকে এর পরিষ্কার আলামত দেখা যেতো।
.
২৫(ক).
বাইবেলে এ কাহিনীকে যে কদাকাররূপে চিত্রিত করা হয়েছে নিচের বর্ণনায় তা দেখা যেতে পারেঃ

“তখন সে যোসেফের বস্ত্র ধরিয়া বলিল, আমার সহিত শয়ন কর; কিন্তু যোসেফ তাহার হস্তে আপন বস্ত্র ফেলিয়া রাখিয়া বাহিরে পালাইয়া গেলেন। তখন যোসেফ তাহার হস্তে বস্ত্র ফেলিয়া রাখিয়া বাহিরে পলাইলেন দেখিয়া, সে নিজ ঘরের লোকদিগকে ডাকিয়া কহিল, দেখ তিনি আমাদের সাথে ঠাট্টা করিতে একজন ইব্রীয় পুরুষকে আনিয়াছেন, সে আমার সঙ্গে শয়ন করিবার জন্য আমার নিকটে আসিয়াছিল, তাহতে আমি চীৎকার করিয়া উঠিলাম, আমার চীৎকার শুনিয়া সে আমার নিকটে নিজ বস্ত্রখানি ফেলিয়া বাহিরে পলাইয়া গেল। আর যে পর্যন্ত তাহার কর্তা ঘরে না আসিলেন, সে পর্যন্ত সেই স্ত্রীলোক তাঁহার বস্ত্র আপনার কাছে রাখিয়া দিল। ........তাঁহার প্রভু যখন আপন স্ত্রীর একথা শুনিলেন যে, “তোমার দাস আমার প্রতি এরূপ ব্যবহার করিয়াছে”, তখন ক্রোধে প্রজ্বলিত হইয়া উঠিলেন। অতএব যোসেফের প্রভু তাঁহাকে লইয়া কারাগারে রাখিলেন, যে স্থানে রাজার বন্দিগণ বদ্ধ থাকিত।” (আদি পুস্তক ৩৯: ১২-২০)

এ অদ্ভূত বর্ণনার সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে এই যে, হযরত ইউসুফ এমন ধরনের পোশাক পরেছিলেন যে, যুলাইখা তাতে হাত লাগাতেই সমস্ত পোশাকটাই খুলে তার হাতে এসে পড়লো! তারপর আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, হযরত ইউসুফ নিজে পোশাক তার কাছে রেখে দিয়ে একেবারে দিগম্বর হয়ে ভাগলেন এবং তাঁর পোশাক (অর্থাৎ তাঁর অপরাধের অনস্বীকার্য প্রমাণ) ঐ মহিলার কাছে রয়ে গেলো। এরপরে হযরত ইউসুফের অপরাধী হবার ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে কি?

এতো গেলো বাইবেলের বর্ণনা। অন্যদিকে তালমূদের বর্ণনা হচ্ছে, পোটীফর যখন তার স্ত্রীর মুখ থেকে এ অভিযোগ শুনলেন তখন তিনি ইউসুফকে খুব মারধর করালেন। তারপর তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করলেন। আদলতে কর্মকর্তারা হযরত ইউসুফের পোশাক পরীক্ষা করে রায় দিল, “দোষ মহিলাটির, কারণ কাপড় সামনের দিক থেকে নয় বরং পেছনের দিক থেকে ছেঁড়া।” কিন্তু যে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি সামান্য চিন্তা করলেই একথাটি বুঝতে পারে যে, কুরআনের বর্ণনা তালমূদের বর্ণনা থেকে অনেক বেশী যুক্তিসঙ্গত। একথা কেমন করে মেনে নেয়া যায় যে, এত বড় একজন মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি নিজের স্ত্রীর ওপর নিজের দাসের তথাকথিত চড়াও হবার মামলাটি নিজেই আদালতে নিয়ে গেছেন? এটি কুরআন ও ইসরাঈলী বর্ণনার মধ্যে পার্থক্যের একটি সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত। এ থেকে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ কাহিনীটি বনী ইসরাঈলদের থেকে শুনে বর্ণনা করেছেন বলে পশ্চিমী প্রাচ্যবিদরা যে অভিযোগ আনেন তার অন্তঃসারশূন্যতা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। সত্যি কথা হচ্ছে, কুরআন তাদের বর্ণনা সংশোধন করেছে এবং সঠিক সত্য ঘটনাটিই দুনিয়াবাসীর সামনে তুলে ধরেছে।

.
২৬.
অর্থাৎ এমন মজলিস যে মজলিসে মেহমানদের হেলান দিয়ে বসার জন্য বালিশ সাজানো ছিল। মিসরের প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ ও প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার থেকেও এর সত্যতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। দেখা গেছে তাদের মজলিসে মাহফিলে বালিশের ব্যাপক ব্যবহার ছিল।

বাইবেলে এ ভোজ সভার কোন উল্লেখ নেই। তবে তালমূদে এ ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু তার বর্ণনাধারা কুরআন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কুরআনের বর্ণনায় যে জীবন জোয়ার, যে প্রাণশক্তি, স্বাভাবিকতা ও উন্নত নৈতিকতার প্রমাণ পাওয়া যায় তালমূদে তার সামান্যতম স্পর্শও নেই।

.
২৭.
এ থেকে তদানীন্তন মিসরের উচ্চ ও অভিজাত সমাজে নৈতিকতার অবস্থা কোথায় গিয়ে ঠেকেছিল তা অনুমান করা যায়। একথা সুস্পষ্ট, আযীযের স্ত্রী যেসব মহিলাকে দাওয়াত দিয়েছিল তারা নিশ্চয়ই নগরের আমীর-উমরাহ ও বড় বড় সরকারী কর্মকর্তাদের বেগমই ছিল। এসব উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ভদ্র মহিলার সামনে সে নিজের প্রিয় যুবককে পেশ করলো। তার সুদর্শন যৌবনোদ্ভিন্ন দেহ সুষমা দেখিয়ে সে তাদের কাছ থেকে এ স্বীকৃতি আদায় করতে চাইলো যে, এমন সুন্দর যুবকের জন্য যদি আমি পাগল না হয়ে যাই তাহলে আর কী হবো! তারপর এসব পদস্থ ব্যক্তিবর্গের স্ত্রী-কন্যারা নিজেদের কাজের মাধ্যমে যেন একথার সত্যতা প্রমাণ করলো যে, সত্যিই এ ধরনের অবস্থায় তাদের প্রত্যেকেই ঠিক তাই করতো যা আযীযের স্ত্রী করেছে। আবার অভিজাত মহিলাদের এ ভরা মজলিসে মেজবান সাহেবা প্রকাশ্যে এ সংকল্প ঘোষণা করতে একটুও লজ্জা অনুভব করলো না যে, যদি এ সুন্দর যুবক তার কামনার ক্রীড়নক হতে রাজি না হয় তাহলে সে তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে দেবে। এ সবকিছুই একথা প্রমাণ করে যে ইউরোপ ও আমেরিকা এবং তাদের প্রাচ্যদেশীয় অন্ধ অনুসারীরা আজ যে নারী স্বাধীনতা এবং নারীদের অবাধ বিচরণ ও মেলামেশাকে বিংশ শতাব্দীর প্রগতিশীলতার অবদান মনে করে থাকে তা আসলে কোন নতুন জিনিস নয়, অনেক পুরাতন, প্রাচীন জিনিস। অতি প্রাচীনকালে দাকিয়ানুসের শাসনেরও বহুশত বছর আগে মিসরে ঠিক একই রকম শান-শওকতের সাথে এর প্রচলন ছিল যেমন আজকের এ “প্রগতিশীলতার” যুগে আছে।
অনুবাদ: