পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

১৫১ আয়াত

৩৪ ) তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, তোমাদের তৈরী করা, শরীকদের মধ্যে কেউ আছে কি যে সৃষ্টির সূচনা করে আবার তার পুনরাবৃত্তিও করে?-বলো, একমাত্র আল্লাহই সৃষ্টির সূচনা করে এবং তার পুনরাবৃত্তির ঘটনা, ৪১ কাজেই তোমরা কোন উল্টো পথে চলে যাচ্ছো? ৪২
قُلْ هَلْ مِن شُرَكَآئِكُم مَّن يَبْدَؤُا۟ ٱلْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيدُهُۥ ۚ قُلِ ٱللَّهُ يَبْدَؤُا۟ ٱلْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيدُهُۥ ۖ فَأَنَّىٰ تُؤْفَكُونَ ٣٤
৩৫ ) তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, তোমাদের তৈরী করা শরীকদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি যে সত্যের দিকে পথনির্দেশ করে? ৪৩ বলো, একমাত্র আল্লাহই সত্যের দিকে পথনির্দেশ করেন তাহলে বলো, যিনি সত্যের দিকে পথনির্দেশ করেন তাহলে বলো, যিনি সত্যের দিকে পথনির্দেশ করেন তিনি আনুগত্য লাভের বেশী হকদার না যাকে পথ না দেখলে পথ পায় না- সে বেশী হকদার? তোমাদের হয়েছে কি? কেমন উল্টো সিদ্ধান্ত করে বসছো?
قُلْ هَلْ مِن شُرَكَآئِكُم مَّن يَهْدِىٓ إِلَى ٱلْحَقِّ ۚ قُلِ ٱللَّهُ يَهْدِى لِلْحَقِّ ۗ أَفَمَن يَهْدِىٓ إِلَى ٱلْحَقِّ أَحَقُّ أَن يُتَّبَعَ أَمَّن لَّا يَهِدِّىٓ إِلَّآ أَن يُهْدَىٰ ۖ فَمَا لَكُمْ كَيْفَ تَحْكُمُونَ ٣٥
৩৬ ) আসলে তাদের বেশীরভাগ লোকই নিছক আন্দাজ-অনুমানের পেছনে চলছে। ৪৪ অথচ আন্দাজ-অনুমান দ্বারা সত্যের প্রয়োজন কিছুমাত্র মেটে না। তারা যা কিছু করছে তা আল্লাহ‌ ভালভাবেই জানেন।
وَمَا يَتَّبِعُ أَكْثَرُهُمْ إِلَّا ظَنًّا ۚ إِنَّ ٱلظَّنَّ لَا يُغْنِى مِنَ ٱلْحَقِّ شَيْـًٔا ۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمٌۢ بِمَا يَفْعَلُونَ ٣٦
৩৭ ) আর এ কুরআন আল্লাহর অহী ও শিক্ষা ছাড়া রচনা করা যায় না। বরং এ হচ্ছে যা কিছু আগে এসেছিল তার সত্যায়ন এবং আল কিতাবের বিশদ বিবরণ। ৪৫ এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এটি বিশ্বজাহানের অধিকর্তার পক্ষ থেকে এসেছে।
وَمَا كَانَ هَـٰذَا ٱلْقُرْءَانُ أَن يُفْتَرَىٰ مِن دُونِ ٱللَّهِ وَلَـٰكِن تَصْدِيقَ ٱلَّذِى بَيْنَ يَدَيْهِ وَتَفْصِيلَ ٱلْكِتَـٰبِ لَا رَيْبَ فِيهِ مِن رَّبِّ ٱلْعَـٰلَمِينَ ٣٧
৩৮ ) তারা কি একথা বলে, পয়গম্বর নিজেই এটা রচনা করেছে? বলো, “তোমাদের এ দোষারোপের ব্যাপারে তোমরা যতি সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে এরই মতো একটি সূরা রচনা করে আনো এবং এক আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাকে ডাকতে পারো সাহায্যের জন্য ডেকে নাও” ৪৬
أَمْ يَقُولُونَ ٱفْتَرَىٰهُ ۖ قُلْ فَأْتُوا۟ بِسُورَةٍۢ مِّثْلِهِۦ وَٱدْعُوا۟ مَنِ ٱسْتَطَعْتُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ إِن كُنتُمْ صَـٰدِقِينَ ٣٨
৩৯ ) আসল ব্যাপার হচ্ছে, যে জিনিসটি এদের জ্ঞানের আওতায় আসেনি এবং যার পরিমাণও এদের সামনে নেই তাকে এরা (অনর্থক আন্দাজে) মিথ্যা বলে। ৪৭ এমনি ভাবে এদের আগের লোকেরাও মিথ্যা আরোপ করেছে। কাজেই দেখো জালেমদের পরিণাম কী হয়েছে!
بَلْ كَذَّبُوا۟ بِمَا لَمْ يُحِيطُوا۟ بِعِلْمِهِۦ وَلَمَّا يَأْتِهِمْ تَأْوِيلُهُۥ ۚ كَذَٰلِكَ كَذَّبَ ٱلَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ ۖ فَٱنظُرْ كَيْفَ كَانَ عَـٰقِبَةُ ٱلظَّـٰلِمِينَ ٣٩
৪০ ) তাদের মধ্য থেকে কিছু লোক ঈমান আনবে এবং কিছু লোক ঈমান আনবে না। আর তোমার রব এ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদেরকে ভালভাবেই জানেন। ৪৮
وَمِنْهُم مَّن يُؤْمِنُ بِهِۦ وَمِنْهُم مَّن لَّا يُؤْمِنُ بِهِۦ ۚ وَرَبُّكَ أَعْلَمُ بِٱلْمُفْسِدِينَ ٤٠
৪১ ) যদি তারা তোমরা প্রতি মিথ্যা আরোপ করে তাহলে তুমি বলে দাও, আমার আমল আমার জন্য এবং তোমাদের আমল তোমাদের জন্য। আমি যা কিছু করি তার দায়িত্ব থেকে তোমরা মুক্ত এবং তোমরা যা কিছু করছো তার দায়িত্ব থেকে আমি মুক্ত। ৪৯
وَإِن كَذَّبُوكَ فَقُل لِّى عَمَلِى وَلَكُمْ عَمَلُكُمْ ۖ أَنتُم بَرِيٓـُٔونَ مِمَّآ أَعْمَلُ وَأَنَا۠ بَرِىٓءٌۭ مِّمَّا تَعْمَلُونَ ٤١
৪২ ) তাদের মধ্যে বহু লোক আছে যারা তোমার কথা শোনে। কিন্তু তুমি কি বধিরদের শুনাবে তারা কিছু না বুঝলেও? ৫০
وَمِنْهُم مَّن يَسْتَمِعُونَ إِلَيْكَ ۚ أَفَأَنتَ تُسْمِعُ ٱلصُّمَّ وَلَوْ كَانُوا۟ لَا يَعْقِلُونَ ٤٢
৪৩ ) তাদের মধ্যে বহু লোক আছে যারা তোমাকে দেখে। কিন্তু তুমি কি অন্ধদের পথ দেখাবে, তারা কিছু না দেখতে পেলেও? ৫১
وَمِنْهُم مَّن يَنظُرُ إِلَيْكَ ۚ أَفَأَنتَ تَهْدِى ٱلْعُمْىَ وَلَوْ كَانُوا۟ لَا يُبْصِرُونَ ٤٣
৪১.
সৃষ্টির সূচনা সম্পর্কে মুশরিকরাও স্বীকার করতো যে, এটা একমাত্র আল্লাহরই কাজ। তার সাথে যাদেরকে তারা শরীক করে তাদের কারো এ কাজে কোন অংশ নেই। আর সৃষ্টির পুনরাবৃত্তির ব্যাপারটিও সুস্পষ্ট। অর্থাৎ প্রথমে যিনি সৃষ্টি করেন তার পক্ষেই দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করা সম্ভব। কিন্তু যে প্রথমবারই সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি সে দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করতে পারে কেমন করে? এটি যদিও একটি অকাট্য যুক্তিসঙ্গত কথা এবং মুশরিকদের মন ও ভেতর থেকে এর সত্যতার সাক্ষ্য দিতো তবুও তারা শুধুমাত্র এ কারণে একথা স্বীকার করতে ইতস্তত করতো যে, এটা মেনে নিলে পরকাল অস্বীকার করা কঠিন হয়ে পড়বে। এ কারণেই পূর্ববর্তী প্রশ্নের জবাবে তো আল্লাহ‌ বললেন যে, তারা নিজেরাই বলবে, যে এটা আল্লাহর কাজ। কিন্তু এখানে এর পরিবর্তে নবী (সা.) কে বলা হচ্ছে, তুমি জোরালো কণ্ঠে বলে দাও প্রথমবার সৃষ্টি এবং সৃষ্টির পুনরাবৃত্তি সবই একমাত্র আল্লাহর কাজ।
৪২.
অর্থাৎ যখন তোমাদের জীবনের সূচনার প্রান্তভাগ আল্লাহর হাতে এবং শেষের প্রান্ত ভাগও তাঁরই হতে। তখন নিজেদের কল্যাণকামী হয়ে একবার ভেবে দেখো, তোমাদের কিভাবে একথা বুঝানো হয়েছে, এই দুই প্রান্তের মাঝখানে আল্লাহ‌ ছাড়া অন্য জন তোমাদের বন্দেগী ও নযরানা লাভের অধিকার লাভ করেছে?
৪৩.
এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। একটু বিস্তারিতভাবে এটিকে বুঝে নিতে হবে। দুনিয়ায় মানুষের প্রয়োজন শুধুমাত্র তার খাদ্য, পানীয়, পোশাক ও জীবন যাপনের জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি লাভ করা এবং বিপদ-আপদ ও ক্ষতি থেকে সংরক্ষিত থাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং জীবন যাপন করার সঠিক পদ্ধতি জানাও তার একটি প্রয়োজন (এবং সবচেয়ে বড় প্রয়োজন)। তার আরো জানতে হবে, নিজের ব্যক্তিগত সত্তার সাথে, নিজের শক্তি, সমার্থ, যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতার সাথে, পৃথিবীতে যে উপায় উপকরণ ও সাজ-সরঞ্জাম তার কর্তৃত্বাধীনে আছে তার সাথে, যে অসংখ্য মানুষের সাথে বিভিন্নভাবে তাকে জড়িত হতে হয় তাদের সাথে এবং সামগ্রিকভাবে যে বিশ্ব ব্যবস্থার আওতাধীনে তাকে কাজ করতে হয় তার সাথে তার কি ব্যবহার করতে হবে এবং কিভাবে করতে হবে। এটা জানা এ জন্য প্রয়োজন যেন তার জীবন সামগ্রিকভাবে সফলকাম হয় এবং তার প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম বিভিন্ন ভুল পথে নিয়োজিত হয়ে ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়। এ সঠিক পদ্ধতির নাম হক বা সত্য আর যে পথ নিদর্শনা মানুষকে এ পদ্ধতির দিকে নিয়ে সেটিই হকের হেদায়াত বা সত্যের পথ নির্দেশনা। কুরআন সমস্ত মুশরিককে এবং নবীর শিক্ষা মেনে নিতে অস্বীকার করেছে এমন সকল লোককে জিজ্ঞেস করে, তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদের বন্দেগী করো তাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি যার মাধ্যমে তোমরা সত্যের পথ নির্দেশনা লাভ করতে পার? অবশ্যই সবাই জানে, এর জবাব না ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ মানুষ আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদেরকে বন্দেগী করে তারা দু’টি বড় বড় ভাগে বিভক্ত।

একঃ দেব-দেবী, জীবিতও মৃত মানুষ, যাদের পূজা করা হয়। তারা অলৌকিক পদ্ধতিতে মানুষের প্রয়োজন পূর্ণ করবে এবং তাকে বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করবে এ উদ্দেশ্যেই মানুষ তাদের দিকে রুজু হয়। আর সত্যের পথ নির্দেশনার ব্যাপারে বলা যায়, এ জিনিসটা কখনো ঐসব দেব-দেবী ইত্যাদির পক্ষ থেকে আসেওনি, মুশরিকরাও কখনো এজন্য তাদের কাছে ধর্ণা দেয়নি এবং কোন মুশরিক একথা বলেও না যে, তার দেবতারা তাকে নৈতিকতা, সামাজিক জীবন যাপন পদ্ধতি, সাংস্কৃতিক বিধান, অর্থনীতি, রাজনীতি, আইন আদালত, ইত্যাদির মূলনীতি শেখায়।

দুইঃ এমন ধরনের মানুষ যাদের রচিত নীতিমালা ও আইনের আনুগত্য করা হয়। এ দিক দিয়ে তারা যে নেতা এবং পথপ্রদর্শক, তাতে কোনই সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে তারা কি সত্য পন্থী নেতা বা নেতা হতে পারে? মানুষের জীবন যাপনের সঠিক মূলনীতি রচনা করার জন্য যেসব তত্ত্ব জানা প্রয়োজন তাদের কেউ কি সেসব সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞান রাখে? মানুষের জীবনের সাথে সম্পর্কিত সমস্যাগুলো যে বিস্তীর্ণ পরিসরে ছড়িয়ে আছে তাদের কারো দৃষ্টি কি তার সবটার ওপর পৌঁছে যায়? তাদের কেউ কি এমন সব দুর্বলতা, স্বার্থ প্রীতি, একদেশদর্শিতা, গোষ্ঠীপ্রীতি, ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত আশা আকাঙ্ক্ষা লোভ লালসা ও ঝোক প্রবণতা থেকে মুক্ত যা মানুষের সমাজ জীবনের জন্য ন্যায়নিষ্ঠা আইন প্রণয়নের পথে বাধা হয়ে থাকে? জবাব যদি না বাচক হয় এবং এ কথা সুস্পষ্ট যে, কোন সুস্থ বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি এ প্রশ্নগুলোর হাঁ বাচক জবাব দিতে পারবেন না তাহলে এরা কি সত্য পথ নির্দেশনার উৎস হতে পারে?

এ কারণে কুরআন এ প্রশ্ন করে, হে লোকেরা! তোমাদের এ ধর্মীয় ও তামাদ্দুনিক প্রভুদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি যে তোমাদের সত্য সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করতে পারে? ওপরের প্রশ্নগুলোর সাথে মিলে এ শেষ প্রশ্নটি দ্বীন ও ধর্মের সমগ্র বিষয়ের ফয়সালা করে দেয়। মানুষের সমস্ত প্রয়োজন দুই ধরনের, এক ধরনের প্রয়োজন হচ্ছে, তার একজন প্রতিপালক হবে, একজন আশ্রয়দাতা হবে, একজন প্রার্থনা শ্রবণকারী ও অভাব পূরণকারী হবে। এ কার্যকারণের জগতের অস্থায়ী ও অস্থিতিশীল সহায়গুলোর মধ্যে অবস্থান করে সে তার স্থায়ী সহায় অবলম্বন করতে পারবে। বস্তুত ওপরের প্রশ্নগুলো এ ফয়সালা করে দিয়েছে যে, আল্লাহ‌ ছাড়া আর কেউ এ প্রয়োজন পূর্ণ করতে পারবে না। আর এক ধরনের প্রয়োজন হচ্ছে এই যে, এমন একজন পথ প্রদর্শক থাকতে হবে যিনি দুনিয়ায় বসবাস করার সঠিক নীতি নির্ধারণ করে দেবেন এবং যার দেয়া জীবন বিধানের আনুগত্য পরিপূর্ণ আস্থার সাথে করা যেতে পারে। এই শেষ প্রশ্নটি এ ব্যাপারটিরও মীমাংসা করে দিয়েছে যে, একমাত্র আল্লাহই সেই পথ প্রদর্শক হতে পারেন। এরপরে একমাত্র জিদ ও হঠকারিতা ছাড়া মানুষের মুশরিকী ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষ (Secular) তামাদ্দুনিক, নৈতিক ও রাজনৈতিক নীতির সাথে লেপটে থাকার আর কোন কারণ থাকে না।

.
৪৪.
অর্থাৎ যারা বিভিন্ন ধর্ম প্রবর্তন করেছে, দর্শন রচনা করেছে এবং জীবন বিধান তৈরী করেছে, তারাও এসব কিছু জ্ঞানের ভিত্তিতে নয় বরং আন্দাজ অনুমানের ভিত্তিতে করেছে। আর যারা এসব ধর্মীয় ও দ্বীনি নেতৃবৃন্দের আনুগত্য করেছে তারাও জেনে বুঝে নয় বরং নিছক অনুমানের ভিত্তিতে তাদের পেছনে চলেছে। কারণ তরা মনে করে, এত বড় বড় লোকেরা যখন একথা বলেন এবং আমাদের বাপ দাদারা এসব মেনে আসছেন আবার এ সঙ্গে দুনিয়ার বিপুলসংখ্যক লোক এগুলো মেনে নিয়ে এ অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে তখন নিশ্চয়ই এই লোকেরা ঠিক কথাই বলে থাকবেন।
.
৪৫.
যা কিছু আগে এসে গিয়েছিল তার সত্যায়ণ-অর্থাৎ শুরু থেকে নবীদের মাধ্যমে মানুষকে যে মৌলিক শিক্ষা দান করা হতে থাকে এ কুরআন তা থেকে সরে গিয়ে কোন নতুন জিনিস পেশ করছে না। বরং তার সত্যতা প্রমাণ করছে এবং তাকে পাকাপোক্ত করছে। যদি এটা কোন নতুন ধর্মপ্রবর্তকের মস্তিষ্কের উদ্ভাবনী ক্ষমতার ফসল হতো, তাহলে অবশ্যই এর মধ্যে পুরাতন সত্যগুলোর সাথে কিছু নিজের অভিনব বক্তব্য মিশিয়ে দিয়ে এর একটা অভিনব ও বিশিষ্ট চরিত্র ফুটিয়ে তোলার প্রচেষ্টা দেখা যেতো।

আল কিতাবের বিশদ বিবরণ-অর্থাৎ সমস্ত আসমানী কিতাবের সারমর্ম যে মৌলিক শিক্ষাবলীর সমষ্টি, সেগুলো এর মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে যুক্তি প্রমাণ সহকারে উপদেশ দান ও বুঝাবার ভঙ্গিতে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে এবং বাস্তব অবস্থার সাথে সম্পৃক্ত করে বর্ণনা করা হয়েছে।

.
৪৬.
সাধারণভাবে লোকেরা এ চ্যালেঞ্জটিকে নিছক কুরআনের ভাষা শৈলী অহংকার ও সাহিত্য সুষমার দিক দিয়ে ছিল বলে মনে করে। কুরআনের অলৌকিকতার ওপর যেভাবে আলোচনা করা হয়েছে তার ফলে এ ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু কুরআন যে, তার অনন্য ও অতুলনীয় হবার দাবীর ভিত্তি নিছক নিজের শাব্দিক সৌন্দর্য সুষমার ওপর প্রতিষ্ঠিত করেনি, এ ধরনের সীমিত ব্যাপার থেকে কুরআনের মর্যাদা অনেক ঊর্ধ্বে। নিঃসন্দেহে ভাষাশৈলীর দিক দিয়েও কুরআন নজিরবিহীন। কিন্তু মূলত যে জিনিসটির ভিত্তিতে বলা হয়েছে যে, কোন মানবিক মেধা ও প্রতিভা এহেন কিতাব রচনা করতে পারে না, সেটি হচ্ছে তার বিষয়বস্তুও শিক্ষা। এর মধ্যে অলৌকিকতার যেসব দিক রয়েছে এবং যেসব কারণে বলা যায় যে, এটি নিঃসন্দেহে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল করা কিতাব এবং কোন মানুষের পক্ষে এ ধরনের কিতাব রচনা করা অসম্ভব তা এ কুরআনেরই বিভিন্ন জায়গায় বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে। এ ধরনের বর্ণনা ইতিপূর্বে যেখানেই এসেছে সেখানে আমরা তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে এসেছি এবং পরবর্তীতেও করে যেতে থাকবো। তাই কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় এখানে এর আলোচনা করা হলো না। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন আত-তুর টীকা ২৬, ২৭)।
৪৭.
কুরআনকে মিথ্যা সাব্যস্ত করার দু’টি ভিত্তি হতে পারতো। গবেষণা করে তথ্য প্রমাণাদির মাধ্যমে নিশ্চিতভাবে জানা যেতো যে, এটি বানোয়াট ও নকল। অথবা এতে যে সত্য বর্ণনা করা হয়েছে এবং যে খবর দেয়া হয়েছে তা মিথ্যা প্রমাণিত হলে তার ভিত্তিতে এ মিথ্যা সাব্যস্ত করণকে যুক্তিসঙ্গত মনে করা যেতো। কিন্তু মিথ্যা সাব্যস্ত করার এ দু’টি কারণের মধ্য থেকে কোন একটি কারণও এখানে বর্তমান নেই। কোন ব্যক্তি একথা বলতে পারে না যে, এ কিতাবটি কেউ নিজে তৈরী করে আল্লাহর নামে চালিয়ে দিয়েছে, একথা সে তথ্য-জ্ঞানের ভিত্তিতে জানে। কেউ অদৃশ্যের পরদা উন্মোচন করে ভিতরে উকি দিয়ে দেখেও নেয়নি যে, সত্যিই সেখানে বহুসংখ্যক খোদা রয়েছে এবং এ কিতাবটিতে অনর্থক শুধুমাত্র একজন ইলাহর কথা শুনানো হচ্ছে। অথবা আসলে আল্লাহ‌ ফেরেশতা অহী ইত্যাদির কোন সত্যতাই নেই এবং এ কিতাবে অযথা এসব গালগল্প বানিয়ে নেয়া হয়েছে। কেউ মরে গিয়েও দেখে নেয়নি যে এ কিতাবে বর্ণিত পরকালীন জীবন এবং তার হিসাব নিকাশ ও শাস্তি-পুরস্কারের সমস্ত কাহিনীই মিথ্যা। কিন্তু এ সত্ত্বেও নিছক সন্দেহ ও ধারণার ভিত্তিতে এমনভাবে একে মিথ্যা বলা হচ্ছে যে, তাতে মনে হয় যেন এটি যে নকল ও মিথ্যা তা তাত্ত্বিকভাবেই চূড়ান্ত অনুসন্ধানের মাধ্যমে স্থিরিকৃত হয়ে গেছে।
.
৪৮.
যারা ঈমান আনে না তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, আল্লাহ‌ এ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদেরকে খুব ভাল করেই জানেন। অর্থাৎ নবীর কথা আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না বলে সদিচ্ছা সহকারেই আমরা তা মেনে নিতে পারছি না। এরূপ অজুহাত দিয়ে তারা দুনিয়া বাসীর মুখ বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু মনের গোপন কথা যিনি জানেন সেই আল্লাহ‌ তাদের প্রতিটি ব্যক্তি সম্পর্কে জানেন, সে কিভাবে নিজের হৃদয় ও মস্তিষ্কের দরজায় তালা এটে দিয়েছে, নিজেই নিজেকে গাফলতির সাগরে ডুবিয়ে দিয়েছে নিজের বিবেকের কণ্ঠরোধ করেছে, নিজের অন্তরে সত্যের সাক্ষ্যকে দমিয়ে দিয়েছে এবং নিজের মস্তিষ্ক থেকে সত্যকে গ্রহণ করার যোগ্যতার বিলুপ্তি ঘটিয়েছে। সে শুনেও শোনেনি। বুঝেও না বুঝার ভান করেছে। সত্যের মোকাবিলায় নিজের অন্ধ বিদ্বেষকে নিজের পার্থিব স্বার্থকে নিজের বাতিলের সাথে সংঘর্ষ মুখর স্বার্থকে এবং নিজের নফসানী খাহেশ ও আগ্রহকে প্রাধান্য দিয়েছে। তাই সে নিষ্পাপ ভ্রষ্টাচারী নয় বরং প্রকৃত অর্থে বিপর্যয়কারী।
৪৯.
অর্থাৎ অযথা বিরোধ ও কূটতর্ক করার কোন প্রয়োজন নেই। যদি আমি মিথ্যা আরোপ করে থাকি তাহলে আমার কাজের জন্য আমি দায়ী হবো। এর কোন দায়ভার তোমাদের ওপর পড়বে না। আর যদি তোমরা সত্য কথাকে মিথ্যা বলে থাকো তাহলে এর মাধ্যমে আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। বরং এ দ্বারা তোমরা নিজেদেরই ক্ষতি করছো।
৫০.
শ্রবণ কয়েক রকমের হতে পারে। পশুরা যেমন আওয়াজ শোনে তেমনি এক ধরনের শ্রবণ আছে। আবার আর এক ধরনের শ্রবণ হয়, যার মধ্যে অর্থের দিকে নজর থাকে এবং এমনি ধরনের একটা প্রবণতা দেখা দেয় যে, যুক্তিসঙ্গত কথা হলে মেনে নেয়া হবে। যারা কোন প্রকার বদ্ধ ধারণা বা অন্ধ বিদ্বেষ আক্রান্ত থাকে এবং যারা আগে থেকেই ফয়সালা করে বসে থাকে, যে নিজের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আকীদা-বিশ্বাস ও পদ্ধতিসমূহের বিরুদ্ধে এবং নিজের প্রবৃত্তির আশা আকাঙ্ক্ষা ও আগ্রহ বিরোধী কথা যত যুক্তিসঙ্গতই হোক না কেন মেনে নেবো না, তারা সবকিছু শুনেও আসলে কিছুই শোনে না। তেমনিভাবে যারা দুনিয়ায় পশুদের মতো উদাসীন জীবন যাপন করে, চারদিকে বিচরণ করা ছাড়া আর কিছুতেই যাদের আগ্রহ নেই অথবা যারা প্রবৃত্তির স্বাদ-আনন্দের পেছনে এমন পাগলের মতো দৌড়ায় যে, তারা নিজেরা যা কিছু করেছে তার ন্যায় বা অন্যায় হবার কথা চিন্তা করে না তারা শুনেও শোনে না। এ ধরনের লোকদের কান বধির হয় না কিন্তু মন বধির হয়।
৫১.
ওপরের বাক্যাংশে যে কথা বলা হয়েছে এখানেও সেই একই কথা বলা হয়েছে। চোখের দৃষ্টি উন্মুক্ত থাকলে কোন লাভ নেই, চোখ দিয়ে তো পশুরাও দেখে। আসল জিনিস হচ্ছে মনের দৃষ্টি উন্মুক্ত থাকা। এ জিনিসটি যদি কারোর অর্জিত না হয়ে থাকে তাহলে সে সবকিছু দেখেও কিছুই দেখে না।

এ আয়াত দু’টিতে নবী (সা.) কে সম্বোধন করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু তিনি যাদের সংশোধন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাদের বিরুদ্ধে নিন্দাবাদ উচ্চারণ করা হচ্ছে। আর এ নিন্দাবাদের উদ্দেশ্য নিছক নিন্দাবাদ নয় বরং বিদ্রুপবানে বিদ্ধ করে তাদের সুপ্ত মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তোলা এবং চোখ ও কানের মাধ্যমে তাদের মনের ভেতরে প্রবেশ করার পথ খুলে দেয়াই এর উদ্দেশ্য এভাবে যুক্তিসঙ্গত কথা ও সমবেদনা পূর্ণ উপদেশ সেখানে পৌঁছবে পারবে। এ বর্ণনা পদ্ধতিটি কিছুটা এমনি ধরনের যেমন কোন সৎ লোক অসৎ লোকদের মাঝে উন্নত চারিত্রিক গুণাবলী সহকারে বাস করতে থাকে এবং অত্যন্ত আন্তরিকতা ও দরদ সহকারে তারা যে পতনশীল অবস্থার মধ্যে পড়ে আছে সে সম্পর্ক তাদের মনে অনুভূতি জাগাতে থাকে। তাদের জীবনযাপন প্রণালীতে কি কি গলদ আছে এবং সঠিক জীবনযাপন প্রণালী কি তা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে ও যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতিতে সে তাদেরকে বুঝাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার পূত-পবিত্র জীবন থেকে কেউ এ শিক্ষা নিচ্ছে না এবং তার এ শুভাকাংখামূলক উপদেশকেও কেউ গ্রাহ্য করছে না। এ অবস্থায় যখন সে তাদেরকে বুঝাবার কাজে ব্যস্ত রয়েছে এবং তারা তার কথাগুলোর প্রতি কর্ণপাত করছে না ঠিক এমন সময় তার কোন বন্ধু এসে তাকে তাকে বলে, আরে ভাই এ তুমি কি করছো? তুমি এমন লোকদের শুনাচ্ছো যারা কানে শুনে না এবং এমন লোকদের পথ দেখাচ্ছো যারা চোখ দেখে না। এদের মনের কানে তালা লেগেছে এবং এদের হৃদয়ের চোখ কানা হয়ে গেছে। এ সৎ লোককে তার সংস্কার প্রচেষ্টা থেকে বিরত রাখা তার বন্ধুর একথা বলার উদ্দেশ্য নয়। বরং তার উদ্দেশ্য হল, হয়তো এ বিদ্রূপ ও তিরস্কারের ফলে অচেতন লোকদের কিছুটা চেতন ফিরে আসবে।

অনুবাদ: