পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

১৫১ আয়াত

১০৪ ) হে নবী! বলে দাও, ১০৬ "হে লোকেরা! যদি তোমরা এখনো পর্যন্ত আমার দ্বীনের ব্যাপারে কোন সন্দেহের মধ্যে থাকো তাহলে শুনে রাখো, তোমরা আল্লাহ‌ ছাড়া যাদের বন্দেগী করো আমি তাদের বন্দেগী করি না বরং আমি কেবলমাত্র এমন আল্লাহর বন্দেগী করি যার করতলে রয়েছে তোমাদের মৃত্যু। ১০৭
قُلْ يَـٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِن كُنتُمْ فِى شَكٍّۢ مِّن دِينِى فَلَآ أَعْبُدُ ٱلَّذِينَ تَعْبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ وَلَـٰكِنْ أَعْبُدُ ٱللَّهَ ٱلَّذِى يَتَوَفَّىٰكُمْ ۖ وَأُمِرْتُ أَنْ أَكُونَ مِنَ ٱلْمُؤْمِنِينَ ١٠٤
১০৫ ) আমাকে মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত হবার জন্য হুকুম দেয়া হয়েছে। আর আমাকে বলা হয়েছে, তুমি একনিষ্ঠ হয়ে নিজেকে ঠিকভাবে এ দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত করো। ১০৮ এবং কখখোনো মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। ১০৯
وَأَنْ أَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًۭا وَلَا تَكُونَنَّ مِنَ ٱلْمُشْرِكِينَ ١٠٥
১০৬ ) আর আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন কোন সত্তাকে ডেকো না, যে তোমার না কোন উপকার করতে না ক্ষতি করতে পারে। যদি তুমি এমনটি করো তাহলে জালেমদের দলভুক্ত হবে।
وَلَا تَدْعُ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَنفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَ ۖ فَإِن فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًۭا مِّنَ ٱلظَّـٰلِمِينَ ١٠٦
১০৭ ) যদি আল্লাহ‌ তোমাকে কোন বিপদে ফেলেন তাহলে তিনি ছাড়া আর কেউ নেই যে, এ বিপদ দুর করতে পারে। আর যদি তিনি তোমার কোন মঙ্গল চান তাহলে তার অনুগ্রহ রদ করারও কেউ নেই। তিনি তার বান্দাদের মধ্যে থেকে যাকে চান অনুগ্রহ করেন এবং তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।”
وَإِن يَمْسَسْكَ ٱللَّهُ بِضُرٍّۢ فَلَا كَاشِفَ لَهُۥٓ إِلَّا هُوَ ۖ وَإِن يُرِدْكَ بِخَيْرٍۢ فَلَا رَآدَّ لِفَضْلِهِۦ ۚ يُصِيبُ بِهِۦ مَن يَشَآءُ مِنْ عِبَادِهِۦ ۚ وَهُوَ ٱلْغَفُورُ ٱلرَّحِيمُ ١٠٧
১০৮ ) হে মুহাম্মাদ! বলে দাও, “হে লোকেরা! তোমাদের কাছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে সত্য এসে গেছে। এখন যারা সোজা পথ অবলম্বন করবে তাদের সোজা পথ অবলম্ব তাদের জন্যই কল্যাণকর হবে। এবং যারা ভুল পথ অবলম্বন করবে তাদের ভুল পথ অবলম্বন তাদের জন্যই ধ্বংস কর হবে। আর “আমি তোমাদের ওপর হাবিলদার হয়ে আসেনি।"
قُلْ يَـٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ قَدْ جَآءَكُمُ ٱلْحَقُّ مِن رَّبِّكُمْ ۖ فَمَنِ ٱهْتَدَىٰ فَإِنَّمَا يَهْتَدِى لِنَفْسِهِۦ ۖ وَمَن ضَلَّ فَإِنَّمَا يَضِلُّ عَلَيْهَا ۖ وَمَآ أَنَا۠ عَلَيْكُم بِوَكِيلٍۢ ١٠٨
১০৯ ) হে নবী! তোমার কাছে অহীর মাধ্যমে যে হেদায়াত পাঠানো হচ্ছে তুমি তার অনুসরণ করো। আর আল্লাহ‌ ফায়সালা দান করা পর্যন্ত সবর করো এবং তিনিই সবচেয়ে ভালো ফায়সালাকারী।
وَٱتَّبِعْ مَا يُوحَىٰٓ إِلَيْكَ وَٱصْبِرْ حَتَّىٰ يَحْكُمَ ٱللَّهُ ۚ وَهُوَ خَيْرُ ٱلْحَـٰكِمِينَ ١٠٩
১ ) আলিফ-লাম-র। একটি ফরমান। এর আয়াতগুলো পাকাপোক্ত এবং বিস্তারিতভাবে বিবৃত হয়েছে, এক পরম প্রজ্ঞাময় ও সর্বজ্ঞ সত্তার পক্ষ থেকে।
الٓر ۚ كِتَـٰبٌ أُحْكِمَتْ ءَايَـٰتُهُۥ ثُمَّ فُصِّلَتْ مِن لَّدُنْ حَكِيمٍ خَبِيرٍ ١
২ ) (এতে বলা হয়েছে) তোমরা আল্লাহ‌ ছাড়া আর কারোর বন্দেগী করবে না। আমি তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য সতর্ককারীও এবং সুসংবাদদাতাও।
أَلَّا تَعْبُدُوٓا۟ إِلَّا ٱللَّهَ ۚ إِنَّنِى لَكُم مِّنْهُ نَذِيرٌۭ وَبَشِيرٌۭ ٢
৩ ) আরো বলা হয়েছেঃ তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও এবং তাঁর দিকে ফিরে এসো, তাহলে তিনি একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তোমাদের উত্তম জীবন সামগ্রী দেবেন এবং অনুগ্রহ লাভের যোগ্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার অনুগ্রহ দান করবেন। তবে যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে আমি তোমাদের ব্যাপারে একটি অতীব ভয়াবহ দিনের আযাবের ভয় করছি।
وَأَنِ ٱسْتَغْفِرُوا۟ رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُوٓا۟ إِلَيْهِ يُمَتِّعْكُم مَّتَـٰعًا حَسَنًا إِلَىٰٓ أَجَلٍۢ مُّسَمًّۭى وَيُؤْتِ كُلَّ ذِى فَضْلٍۢ فَضْلَهُۥ ۖ وَإِن تَوَلَّوْا۟ فَإِنِّىٓ أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍۢ كَبِيرٍ ٣
৪ ) তোমাদের সবাইকে আল্লাহর দিকে ফিরে যেতে হবে এবং তিনি সবকিছুই করতে পারেন।
إِلَى ٱللَّهِ مَرْجِعُكُمْ ۖ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَىْءٍۢ قَدِيرٌ ٤
১০৬.
যে বক্তব্য দিয়ে ভাষণ শুরু করা হয়েছিল। এখন আবার তারই মাধ্যমে ভাষণ শেষ করা হচ্ছে। তুলনামূলক পাঠের জন্য প্রথম রুকুর আলোচনার ওপর আর একবার নজর বুলিয়ে নিন।
১০৭.
মূল আয়াতে يَتَوَفَّاكُمْ(ইয়াতাওয়াফ্ফাকুম) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর শাব্দিক অনুবাদ হচ্ছে "যিনি তোমাদের মৃত্যু দান করেন।" কিন্তু এ শাব্দিক অনুবাদ থেকে আসল মর্মবাণীর প্রকাশ হয় না। এ উক্তির মর্মবাণী হচ্ছে এই যে, "তোমাদের প্রাণ যে সত্তার করতলগত, যিনি তোমাদের ওপর এমনই পূর্ণাঙ্গ শাসন কর্তৃত্বের অধিকারী যে, যতক্ষণ তিনি ইচ্ছা করেন ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা জীবনী শক্তি লাভ করতে পারো এবং তার ইশারা হবার সাথে সাথেই তোমাদের নিজেদের প্রাণ সেই প্রাণ স্রষ্টার হাতে সোর্পদ করে দিতে হয়, আমি কেবলমাত্র সেই সত্তারই উপাসনা, বন্দেগী ও দাসত্ব এবং আনুগত্য করার ও হুকুম মেনে চলার কথা বলি।" এখানে আরো একটি কথা বুঝে নিতে হবে। মক্কার মুশরিকরা একথা মানতো এবং আজো সকল শ্রেণীর মুশরিকরা একথা স্বীকার করে যে, মৃত্যু একমাত্র আল্লাহ‌ রব্বুল আলামীনের ইখতিয়ারাধীন। এর ওপর অন্য কারো নিয়ন্ত্রণ নেই। এমনকি এ মুশরিকরা যেসব মনীষীকে আল্লাহর গুণাবলী ও ক্ষমতায় শরীক করে তাদের কেউই যে তাদের মৃত্যুর সময় পিছিয়ে দিতে পারেনি, তাদের ব্যাপারে একথাও তারা স্বীকার করে। কাজেই বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য আল্লাহর অসংখ্য গুণাবলির মধ্য থেকে অন্য কোন গুণের কথা বর্ণনা করার পরিবর্তে এ বিশেষ গুণটি যে, "যিনি তোমাদের মৃত্যু দান করেন" এখানে বর্ণনা করার জন্য এ উদ্দেশ্যে নির্বাচন করা হয়েছে যে, নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করার সাথে সাথে তার সঠিক হওয়ার যুক্তিও এর মাধ্যমে এসে যাবে। অর্থাৎ সবাইকে বাদ দিয়ে আমি একমাত্র তার বন্দেগী করি এ জন্য যে, জীবন ও মৃত্যুর ওপর একমাত্র তারই কর্তৃত্ব রয়েছে। আর তার ছাড়া অন্যের বন্দেগী করবোই বা কেন, তারা তো অন্য কারোর জীবন-মৃত্যু তো দূরের কথা খোদ তাদের নিজেদেরই জীবন-মৃত্যুর ওপর কোন কর্তৃত্ব রাখে না। তাছাড়া আলঙ্কারিক মাধুর্যকে ও এখানে এভাবে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়েছে যে, "তিনি আমাকে মৃত্যু দান করবেন" না বলে বলা হয়েছে, "তিনি তোমাদের মৃত্যু দান করেন।" এভাবে একটি বাক্যের সাহায্যে মূল বক্তব্য বিষয়, বক্তব্যের স্বপক্ষের যুক্তি এবং বক্তব্যের প্রতি আহবান তিনটিই সম্পন্ন করা হয়েছে। যদি বলা হতো, "আমি এমন সত্তার বন্দেগী করি যিনি আমাকে মৃত্যু দান করবেন" তাহলে এর অর্থ কেবল এতটুকুই হতো যে, "আমার তার বন্দেগী করা উচিত"। তবে এখন যে কথা বলা হয়েছে যে, "আমি এমন এক সত্তার বন্দেগী করি যিনি তোমাদের মৃত্যু দান করেন",- এর অর্থ হবে, শুধু আমারই নয় তোমাদেরও তার বন্দেগী করা উচিত আর তোমরা তাকে বাদ দিয়ে অন্যদের বন্দেগী করে ভুল করে যাচ্ছো।
১০৮.
এ দাবী কত জোরালো, তা গভীরভাবে প্রণিধানযোগ্য। বক্তব্য এভাবেও বলা যেতো, “তুমি এ দ্বীন অবলম্বন করো” অথবা “এ দ্বীনের পথে চলো” কিংবা “এ দ্বীনের অনুগত ও অনুসারী হয়ে যাও।” কিন্তু মহান আল্লাহ‌ এ বর্ণনাভঙ্গিকে ঢিলেঢালা সাব্যস্ত করেছেন। এ দ্বীন যেমন অবিচল ও তেজোদ্দীপ্ত আনুগত্য চায় এ দুর্বল শব্দসমূহের সাহায্যে তা প্রকাশ করা সম্ভব হতো না। তাই নিজের দাবী তিনি নিম্নোক্ত শব্দাবলীর মাধ্যমে পেশ করেছেনঃ

أَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا

এখানে أَقِمْ وَجْهَكَ(আকিম ওয়াজহাকা) এর শাব্দিক মানে হচ্ছে, “নিজের চেহরাকে স্থির করে দাও।” এর অর্থ, তুমি একই দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকো। নড়াচড়া করো না এবং এদিক ওদিক ফিরো না। সামনে, পেছনে, ডাইনে, বাঁয়ে মুড়ে যেয়ো না। একেবারে নাক বরাবর সোজা পথে দৃষ্টি রেখে চলো, যে পথ তোমাকে দেখানো হয়েছে। এটি বড়ই শক্ত বাঁধন ছিল। কিন্তু এখানেই ক্ষান্ত থাকা হয়নি। এর ওপর আরো একটু বাড়তি বাধন দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে حَنِيفًا(হানিফা) অর্থাৎ সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে শুধুমাত্র একদিকে মুখ করে থাকো। কাজেই দাবী হচ্ছে, এ দ্বীন, আল্লাহর বন্দেগীর এ পদ্ধতি এবং জীবন যাপন প্রণালীর ক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহ‌ রব্বুল আলামীনের উপসনা আরাধনা, ইবাদত-বন্দেগী, দাসত্ব আনুগত্য করতে ও হুকুম মেনে চলতে হবে। এমন একনিষ্ঠভাবে করতে হবে যে, অন্য কোন পদ্ধতির দিকে সামান্যতম ঝুঁকে পড়াও যাবে না। যেসব পথ তুমি ইতিপূর্বে পরিত্যাগ করে এসেছো এ পথে এসে সেই ভুল পথগুলোর সাথে সামান্যতম সম্পর্কও রাখবে না এবং দুনিয়ার মানুষ যেসব বাঁকা পথে চলেছে সেসব পথের দিকে একবার ভুল করেও তাকাবে না।

১০৯.
অর্থাৎ যারা আল্লাহর সত্তা, তার গুণাবলী, অধিকার ও ক্ষমতা-ইখতিয়ারে কোনভাবে অন্য কাউকে শরীক করে কখখোনো তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। এ অন্য কেউ তারা নিজেরাও হতে পারে আবার অন্য কোন মানুষ, মানব গোষ্ঠী, কোন আত্মা, জিন, ফেরেশতা অথবা কোন বস্তুগত, কাল্পনিক বা আনুমানিক সত্তাও হতে পারে। কাজেই পূর্ণ অবিচলতা সহকারে নির্ভেজাল তাওহীদের পথ অনুসরণ করার মত ইতিবাচক পদ্ধতির মধ্যেই শুধু দাবীকে আটকে রাখা হয়নি। বরং নেতিবাচক অবস্থায় ক্ষেত্রে এমনসব লোকের থেকে আলাদা হয়ে যাবার দাবী জানানো হয়েছে যারা কোন না কোন প্রকারে শিরক করে থাকে। শুধু আকীদা বিশ্বাসের ক্ষেত্রেই নয় কাজে কর্মে ও ব্যক্তি জীবন ধারায়ই নয় সামষ্টিক জীবন বিধানের ক্ষেত্রেও, ইবাদতগাহ ও উপাসনালয়েই নয় শিক্ষায়তনেও, আদালত গৃহে, আইন প্রণয়ন পরিষদে, রাজনৈতিক, মঞ্চে, অর্থনৈতিক বাজারে সর্বত্রই যারা নিজেদের চিন্তা ও কর্মের সমগ্র ব্যবস্থাই আল্লাহর আনুগত্য ও গায়রুল্লাহর আনুগত্যের মিশ্রণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছে। সব জায়গাই তাদের পদ্ধতি থেকে নিজেদের পদ্ধতি আলাদা করে নাও। তাওহীদের অনুসারীরা জীবনের কোন ক্ষেত্রে ও বিভাগেও শিরকের অনুসারীদের অনুসৃত পথে পায়ের সাথে পা মিলিয়ে চলতে পারে না। এক্ষেত্রে তাদের শিরকের অনুসারীদের পেছনে চলার তো প্রশ্নই ওঠে না এবং এভাবে পেছনে চলার পরও তাদের তাওহীদবাদের দাবী ও চাহিদা নিশ্চিন্ত পূরণ হতে থাকবে একথা কল্পনাই করা যায় না।

তারপর শুধুমাত্র সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন শিরক (শিরকে জলী) থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়নি বরং অস্পষ্ট শিরক (শিরকে খফী) থেকেও পুরোপুরি ও কঠোরভাবে দূরে থাকারও আদেশ দেয়া হয়েছে। বরং অস্পষ্ট শিরক আরো বেশী বিপজ্জনক এবং তার ব্যাপারে সতর্ক থাকার প্রয়োজন আরো অনেক বেশী। কোন কোন অজ্ঞ ব্যক্তি অস্পষ্ট শিরককে হালকা শিরক মনে করে থাকেন। তারা ধারণা করেন, এ ধরনের শিরকের ব্যাপারটা সুস্পষ্ট শিরকের মত অতোটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। অথচ অস্পষ্ট (খফী) মানে হালকা নয় বরং গুপ্ত ও গোপনে লুকিয়ে থাকা। এখন চিন্তা করার ব্যাপার হচ্ছে, যে শত্রু দিন-দুপুরে চেহারা উন্মুক্ত করে সামনে এসে যায় সেই বেশী বিপজ্জনক, না যে কাপড়ের মধ্যে লুকিয়ে বা বন্ধু ছদ্মাবরণে এসে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করছে সেই বেশী বিপজ্জনক? যে রোগের আলামত একেবারে পরিষ্কার দেখা যায় সেটি বেশী ধ্বংসকারক, না যেটি দীর্ঘকাল সুস্থতার ছদ্মাবরণে ভেতরে ভেতরে স্বাস্থ্যকে কুরে কুরে খেয়ে ফেলে সেই বেশী ধ্বংসকর? যে শিরককে প্রত্যেক ব্যক্তি এক নজর দেখেই বলে দেয় এটি শিরক তার সাথে তাওহীদ দ্বীনের সংঘাত একেবারে মুখোমুখি। কিন্তু যে শিরককে বুঝাতে হলে গভীর দৃষ্টি ও তাওহীদের দাবীসমূহের নিবিড় ও অতলস্পর্শী উপলব্ধি প্রয়োজন, সে তার অদৃশ্য শিকড়গুলো দ্বীনের ব্যবস্থার মধ্যে এমনভাবে ছড়িয়ে দেয় যে, সাধারণ তাওহীদবাদীরা তা ঘুণাক্ষরেও টের পায় না তারপর ধীরে ধীরে অবচেতন পদ্ধতিতে সে দ্বীনের সার পদার্থসমূহ এমনভাবে খেয়ে ফেলে যে, কোথাও কোন বিপদ-ঘন্টা বাজাবার সুযোগই আসে না।

.
.
.
.
১.
মূল আয়াতে ‘কিতাব’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে বর্ণনাভঙ্গীর সাথে সামঞ্জস্য রেখে তার অনুবাদ করা হয়েছে “ফরমান।” আরবী ভাষায় এ শব্দটি কেবলমাত্র কিতাব ও লিপি অর্থে ব্যবহৃত হয় না বরং হুকুম ও বাদশাহী ফরমান অর্থেও ব্যবহৃত হয়। কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় এ শব্দটি এ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।
২.
অর্থাৎ এ ফরমানে যেসব কথা বলা হয়েছে সেগুলো পাকা ও অকাট্য কথা এবং সেগুলোর কোন নড়চড় নেই। ভালোভাবে যাচাই পর্যালোচনা করে সে কথাগুলো বলা হয়েছে। নিছক বড় বড় বুলি আওড়াবার উদ্দেশ্যে বলা হয়নি। বক্তার বক্তৃতার যাদু এবং ভাব-কল্পনার কবিত্ব এখানে নেই। প্রকৃত ও হুবহু সত্য বর্ণনা করা হয়েছে। প্রকৃত সত্যের চেয়ে কম বা তার চেয়ে বেশী একটি শব্দও এতে নেই। তারপর এ আয়াতগুলো বিস্তারিতও। এর মধ্যে প্রত্যেকটি কথা খুলে খুলে ও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। বক্তব্য জটিল, বক্র ও অস্পষ্ট নয়। প্রত্যেকটি কথা আলাদা আলাদা করে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে বলা হয়েছে।
.
.
৩.
অর্থাৎ দুনিয়ায় তোমাদের অবস্থান করার জন্য যে সময় নির্ধারিত রয়েছে সেই সময় পর্যন্ত তিনি তোমাদের খারাপভাবে নয় বরং ভালোভাবেই রাখবেন। তাঁর নিয়ামতসমূহ তোমাদের ওপর বর্ষিত হবে। তাঁর বরকত ও প্রাচূর্যলাভে তোমরা ধন্য হবে। তোমরা সচ্ছল ও সুখী-সমৃদ্ধ থাকবে। তোমাদের জীবন শান্তিময় ও নিরাপদ হবে। তোমরা লাঞ্ছনা, হীনতা ও দীনতার সাথে নয় বরং সম্মান ও মর্যাদার সাথে জীবন যাপন করবে। এ বক্তব্যটিই সূরা নাহলের ৯৭ আয়াতে এভাবে বলা হয়েছেঃ

مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً (النحل: 97)

“যে ব্যক্তিই ঈমান সহকারে সৎকাজ করবে, সে পুরুষ হোক বা নারী, আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করবো।”

লোকদের মধ্যে সাধারণভাবে ছড়িয়ে থাকা একটি বিভ্রান্তি দূর করাই এর উদ্দেশ্য। বিভ্রান্তিটি হচ্ছে, আল্লাহ ভীতি, সততা, সাধুতা ও দায়িত্বানুভূতির পথ অবলম্বন করলে মানুষ আখেরাতে লাভবান হলেও হতে পারে কিন্তু এর ফলে তার দুনিয়া একদম বরবাদ হয়ে যায়। এ মন্ত্র শয়তান প্রত্যেক দুনিয়ার মোহে মুগ্ধ অজ্ঞ-নির্বোধের কানে ফুঁকে দেয়। এ সঙ্গে তাকে এ প্ররোচনাও দেয়া যে, এ ধরনের আল্লাহ ভীরু ও সৎলোকদের জীবনে দারিদ্র, অভাব ও অনাহার ছাড়া আর কিছুই নেই। আল্লাহ এ ধারণার প্রতিবাদ করে বলেন, এ সঠিক পথ অবলম্বন করলে তোমাদের শুধুমাত্র আখেরাতই নয়, দুনিয়াও সমৃদ্ধ হবে। আখেরাতের মতো ও এ দুনিয়ায় যথার্থ মর্যাদা ও সাফল্যও এমনসব লোকের জন্য নির্ধারিত, যারা আল্লাহর প্রতি যথার্থ আনুগত্য সহকারে সৎ জীবন যাপন করে, যারা পবিত্র ও ত্রুটিমুক্ত চরিত্রের অধিকারী হয়, যাদের ব্যবহারিক জীবনে ও লেনদেনে কোন ক্লেদ ও গ্লানি নেই, যাদের ওপর প্রত্যেকটি বিষয়ে ভরসা করা যেতে পারে, যাদের থেকে প্রত্যেক ব্যক্তি কল্যাণের আশা পোষণ করে এবং কোন ব্যক্তি বা জাতি যাদের থেকে অকল্যাণের আশঙ্কা করে না।

এছাড়া متاع حسن (উত্তম জীবন সামগ্রী) শব্দের মধ্যে আর একটি দিকও রয়েছে। এ দিকটি দৃষ্টির অগোচরে চলে যাওয়া উচিত নয়। কুরআন মজীদের দৃষ্টিতে দুনিয়ার জীবন সামগ্রী দু’প্রকারের। এক প্রকারের জীবন সামগ্রী আল্লাহ বিমুখ লোকদেরকে ফিত্নার মধ্যে নিক্ষেপ করার জন্য দেয়া হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে প্রতারিত হয়ে তারা নিজেদেরকে দুনিয়া পূজা ও আল্লাহ বিস্মৃতির মধ্যে আরো বেশী করে হারিয়ে যায়। আপাতদৃষ্টিতে এটি নিয়ামত ঠিকই কিন্তু গভীরভাবে নিরীক্ষণ করলে দেখা যাবে এটি আল্লাহর লানত ও আযাবের পটভূমিই রচনা করে। কুরআন মজীদ (আরবী) তথা প্রতারণার সামগ্রী নামেও একে স্মরণ করে। দ্বিতীয় প্রকারের জীবন সামগ্রী মানুষকে আরো বেশী সচ্ছল, সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করে তাকে তার আল্লাহর আরো বেশী কৃতজ্ঞ বান্দায় পরিণত করে। এভাবে সে আল্লাহর, তাঁর বান্দাদের এবং নিজের অধিকার আরো বেশী করে আদায় করতে সক্ষম হয়। আল্লাহর দেয়া উপকরণাদির সাহায্যে শক্তি সঞ্চয় করে সে দুনিয়ায় ভালো, ন্যায় ও কল্যাণের উন্নয়ন এবং মন্দ, বিপর্যয় ও অকল্যাণের পথ রোধ করার জন্য এর বেশী প্রভাবশালী ও কার্যকর প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। এ হচ্ছে কুরআনের ভাষায় উত্তম জীবন সামগ্রী। অর্থাৎ এমন উন্নত পর্যায়ের জীবন সামগ্রী যা নিছক দুনিয়ার আয়েশ-আরামের মধ্যেই খতম হয়ে যায় না বরং পরিণামে আখেরাতেরও শান্তির উপকরণে পরিণত হয়।

৪.
অর্থাৎ যে ব্যক্তি চরিত্রগুণে ও নেক আমলে যত বেশী এগিয়ে যাবে আল্লাহ তাকে ততই বড় মর্যাদা দান করবেন। আল্লাহর দরবারে কারোর কৃতিত্ব ও সৎকাজকে নষ্ট করা হয় না। তাঁর কাছে যেমন অসৎকাজ ও অসৎবৃত্তির কোন মর্যাদা নেই তেমনি সৎকাজ ও সৎবৃত্তিরও কোন অমর্যাদা হয় না। তাঁর রাজ্যের রীতি এ নয় যে,

“আরবী ঘোড়ার পিঠে জরাজীর্ণ জিন
আর গাধার গলায় ঝোলে সোনার শৃংখল।”

যে ব্যক্তিই নিজের চরিত্র ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজেকে যেরূপ মর্যাদার অধিকারী প্রমাণ করবে তাকে আল্লাহ সে মর্যাদা অবশ্যই দেবেন।

.
.
অনুবাদ: