পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

১২৭ আয়াত

৩৬ ) আসলে যখন আল্লাহ‌ আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তখন থেকেই আল্লাহর লিখন ও গণনায় মাসের সংখ্যা বারো চলে আসছে। ৩৪ এর মধ্যে চারটি হারাম মাস। এটিই সঠিক বিধান। কাজেই এ চার মাসের নিজেদের ওপর জুলুম করো না। ৩৫ আর মুশরিকদের সাথে সবাই মিলে লড়াই করো যেমন তারা সবাই মিলে তোমাদের সাথে লড়াই করে। ৩৬ এবং জেনে রাখো আল্লাহ‌ মুত্তাকীদের সাথেই আছেন।
إِنَّ عِدَّةَ ٱلشُّهُورِ عِندَ ٱللَّهِ ٱثْنَا عَشَرَ شَهْرًۭا فِى كِتَـٰبِ ٱللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضَ مِنْهَآ أَرْبَعَةٌ حُرُمٌۭ ۚ ذَٰلِكَ ٱلدِّينُ ٱلْقَيِّمُ ۚ فَلَا تَظْلِمُوا۟ فِيهِنَّ أَنفُسَكُمْ ۚ وَقَـٰتِلُوا۟ ٱلْمُشْرِكِينَ كَآفَّةًۭ كَمَا يُقَـٰتِلُونَكُمْ كَآفَّةًۭ ۚ وَٱعْلَمُوٓا۟ أَنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلْمُتَّقِينَ ٣٦
৩৭ ) “নাসী” (মাসকে পিছিয়ে দেয়া) তো কুফরীর মধ্যে আরো একটি কুফরী কর্ম, যার সাহায্যে এ কাফেদের কে ভ্রষ্টতায় লিপ্ত করা হয়ে থাকে। কোন বছর একটি মাসকে হালাল করে নেয় এবং কোন বছর তাকে আবার হারাম করে নেয়, যাতে আল্লাহর হারাম মাসের সংখ্যাও পুরা করতে পারে এবং আল্লাহর হারাম করাকেও হালাল করতে পারে। ৩৭ তাদের খারাপ কাজগুলোকে তাদের জন্য শোভনীয় করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ‌ সত্য- অস্বীকারকারীদেরকে হেদায়াত দান করেন না।
إِنَّمَا ٱلنَّسِىٓءُ زِيَادَةٌۭ فِى ٱلْكُفْرِ ۖ يُضَلُّ بِهِ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ يُحِلُّونَهُۥ عَامًۭا وَيُحَرِّمُونَهُۥ عَامًۭا لِّيُوَاطِـُٔوا۟ عِدَّةَ مَا حَرَّمَ ٱللَّهُ فَيُحِلُّوا۟ مَا حَرَّمَ ٱللَّهُ ۚ زُيِّنَ لَهُمْ سُوٓءُ أَعْمَـٰلِهِمْ ۗ وَٱللَّهُ لَا يَهْدِى ٱلْقَوْمَ ٱلْكَـٰفِرِينَ ٣٧
৩৮ ) হে ঈমানদারগণ! ৩৮ তোমাদের কি হলো, যখনই তোমাদের আল্লাহর পথে বের হতে বলা হলো, অমনি তোমরা মাটি কামড়ে পড়ে থাকলে? তোমরা কি আখেরাতের মোকাবিলায় দুনিয়ার জীবন পছন্দ করে নিয়েছো? যদি তাই হয় তাহলে তোমরা মনে রেখো, দুনিয়ার জীবনের এমন সাজ সরঞ্জাম আখেরাতে খুব সামান্য বলে প্রমাণিত হবে। ৩৯
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ مَا لَكُمْ إِذَا قِيلَ لَكُمُ ٱنفِرُوا۟ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ ٱثَّاقَلْتُمْ إِلَى ٱلْأَرْضِ ۚ أَرَضِيتُم بِٱلْحَيَوٰةِ ٱلدُّنْيَا مِنَ ٱلْـَٔاخِرَةِ ۚ فَمَا مَتَـٰعُ ٱلْحَيَوٰةِ ٱلدُّنْيَا فِى ٱلْـَٔاخِرَةِ إِلَّا قَلِيلٌ ٣٨
৩৯ ) তোমরা যদি না বের হও তাহলে আল্লাহ‌ তোমাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেবেন ৪০ এবং তোমাদের জায়গায় আর একটি দলকে ওঠাবেন, ৪১ আর তোমরা আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তিনি সব জিনিসের ওপর শক্তিশালী।
إِلَّا تَنفِرُوا۟ يُعَذِّبْكُمْ عَذَابًا أَلِيمًۭا وَيَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ وَلَا تَضُرُّوهُ شَيْـًۭٔا ۗ وَٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَىْءٍۢ قَدِيرٌ ٣٩
৪০ ) তোমরা যদি নবীকে সাহায্য না কর, তাহলে কোন পরোয়া নেই। আল্লাহ‌ তাকে এমন সময় সাহায্য করেছেন যখন কাফেররা তাকে বের করে দিয়েছিল, যখন সে ছিল মাত্র দু’জনের মধ্যে দ্বিতীয় জন, যখন তারা দু’জন গুহার মধ্যে ছিল, তখন সে তার সাথীকে বলেছিল, চিন্তিত হয়ো না, আল্লাহ‌ আমাদের সাথে আছেন। ৪২ সে সময় আল্লাহ‌ নিজের পক্ষ থেকে তার ওপর মানসিক প্রশান্তি নাযিল করেন এবং এমন সেনাদল পাঠিয়ে তাকে সাহায্য করেন, যা তোমরা দেখনি এবং তিনি কাফেরদের বক্তব্যকে নিচু করে দেন। আর আল্লাহর কথা তো সমুন্নত আছেই। আল্লাহ‌ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।
إِلَّا تَنصُرُوهُ فَقَدْ نَصَرَهُ ٱللَّهُ إِذْ أَخْرَجَهُ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ ثَانِىَ ٱثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِى ٱلْغَارِ إِذْ يَقُولُ لِصَـٰحِبِهِۦ لَا تَحْزَنْ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَنَا ۖ فَأَنزَلَ ٱللَّهُ سَكِينَتَهُۥ عَلَيْهِ وَأَيَّدَهُۥ بِجُنُودٍۢ لَّمْ تَرَوْهَا وَجَعَلَ كَلِمَةَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ ٱلسُّفْلَىٰ ۗ وَكَلِمَةُ ٱللَّهِ هِىَ ٱلْعُلْيَا ۗ وَٱللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ ٤٠
৪১ ) ---বের হও, হালকা কিংবা ভারী যাই হওনা কেন, এবং জিহাদ করো আল্লাহর পথে নিজের ধন-প্রাণ দিয়ে। এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয় যদি তোমরা জানতে। ৪৩
ٱنفِرُوا۟ خِفَافًۭا وَثِقَالًۭا وَجَـٰهِدُوا۟ بِأَمْوَٰلِكُمْ وَأَنفُسِكُمْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ ۚ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌۭ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ ٤١
৪২ ) হে নবী! যদি সহজ লাভের সম্ভাবনা থাকতো এবং সফর হালকা হতো, তাহলে তারা নিশ্চয়ই তোমার পেছনে চলতে উদ্যত হতো। কিন্তু তাদের জন্য তো এ পথ বড়ই কঠিন হয়ে গেছে। ৪৪ এখন তারা আল্লাহর কসম খেয়ে খেয়ে বলবে, যদি আমরা চলতে পারতাম তাহলে অবশ্যই তোমাদের সাথে চলতাম। তারা নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আল্লাহ‌ ভালো করেই জানেন তারা মিথ্যাবাদী।
لَوْ كَانَ عَرَضًۭا قَرِيبًۭا وَسَفَرًۭا قَاصِدًۭا لَّٱتَّبَعُوكَ وَلَـٰكِنۢ بَعُدَتْ عَلَيْهِمُ ٱلشُّقَّةُ ۚ وَسَيَحْلِفُونَ بِٱللَّهِ لَوِ ٱسْتَطَعْنَا لَخَرَجْنَا مَعَكُمْ يُهْلِكُونَ أَنفُسَهُمْ وَٱللَّهُ يَعْلَمُ إِنَّهُمْ لَكَـٰذِبُونَ ٤٢
৪৩ ) হে নবী! আল্লাহ‌ তোমাকে মাফ করুন, তুমি তাদের অব্যাহতি দিলে কেন? (তোমরা নিজের তাদের অব্যাহতি না দেয়া উচিত ছিল) এভাবে তুমি জানতে পারতে কারা সত্যবাদী এবং কারা মিথ্যুক। ৪৫
عَفَا ٱللَّهُ عَنكَ لِمَ أَذِنتَ لَهُمْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكَ ٱلَّذِينَ صَدَقُوا۟ وَتَعْلَمَ ٱلْكَـٰذِبِينَ ٤٣
৪৪ ) যারা আল্লাহ‌ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, তারা কখনো তোমার কাছে তাদের ধন ও প্রাণ দিয়ে জিহাদ করা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য আবেদন জানাবে না। আল্লাহ‌ মুত্তাকীদের খুব ভাল করেই জানেন।
لَا يَسْتَـْٔذِنُكَ ٱلَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلْيَوْمِ ٱلْـَٔاخِرِ أَن يُجَـٰهِدُوا۟ بِأَمْوَٰلِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ ۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌۢ بِٱلْمُتَّقِينَ ٤٤
৪৫ ) এমন আবেদন তো একমাত্র তারাই করে; যারা আল্লাহ‌ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে না, যাদের মনে রয়েছে সন্দেহ এবং এ সন্দেহের দোলায় তারা দোদুল্যমান। ৪৬
إِنَّمَا يَسْتَـْٔذِنُكَ ٱلَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلْيَوْمِ ٱلْـَٔاخِرِ وَٱرْتَابَتْ قُلُوبُهُمْ فَهُمْ فِى رَيْبِهِمْ يَتَرَدَّدُونَ ٤٥
৩৪.
অর্থাৎ যখন আল্লাহ‌ চাঁদ, সূর্য ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তখন থেকেই এ হিসাবও চলে আসছে যে, প্রতি মাসে প্রথমার চাঁদ একবারই উঠে। এ হিসাবে এক বছরে ১২ মাস হয়। একথা বলার কারণ হচ্ছে এই যে, আরবের লোকেরা 'নাসী'র কারণে ১৩ বা ১৪ মাসে বছর বানিয়ে ফেলতো। যে হারাম মাসকে তারা হালাল করে নিয়েছে তাকে এভাবে বছরের পঞ্জিকায় জায়গা দেবার ব্যবস্থা করতো। সামনের দিকেও এ বিষয়টির আরো ব্যাখ্যা করা হবে।
৩৫.
অর্থাৎ যেসব উপযোগিতা ও কল্যাণকারিতার ভিত্তিতে এ মাসগুলোতে যুদ্ধ করা হারাম করা হয়েছে সেগুলোকে নষ্ট করো না এবং এ দিনগুলোতে শান্তি ভঙ্গ করে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে নিজেদের ওপর জুলুম করো না। চারটি হারাম মাস বলতে যিলকদ্দ, যিল হজ্জ ও মহররম মাসে হজ্জের জন্য এবং উমরাহের জন্য রজব মাস।
৩৬.
অর্থাৎ মুশরিকরা যদি উল্লেখিত মাসগুলোতে লড়াই থেকে বিরত না হয় তাহলে তারা যেমন একমত ও একজোট হয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে লড়েছে, তোমরাও তেমনি একমত ও একজোট হয়ে তাদের বিরুদ্ধে লড়ো। সূরা আল বাকারার ১৯৪ আয়াতটির এর ব্যাখ্যা পেশ করেছে।
.
৩৭.
আরবের ‘নাসী’ ছিল দু ধরনের। এক নাসীর প্রেক্ষিতে আরববাসীরা যুদ্ধ বিগ্রহ, লুট-তরাজ ও হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য কোন হারাম মাসকে হালাল গণ্য করতো এবং তার বদলে কোন হালাল মাসকে হারাম গণ্য করে হারাম মাসগুলোর সংখ্যা পূর্ণ করতো। আর দ্বিতীয় ধরনের নাসীর প্রেক্ষিতে তারা চান্দ্রবর্ষকে সৌরবর্ষ সদৃশ করার জন্য তাতে কাবীসা নামে একটা মাস বাড়িয়ে দিতো। তাদের উদ্দেশ্যে হতো, এভাবে হজ্জ সবসময় একই মওসুমে অনুষ্ঠিত হতে থাকবে। ফলে চান্দ্রবর্ষ অনুযায়ী বিভিন্ন মওসুমে হজ্জ অনুষ্ঠিত হবার ফলে তাদের যে কষ্ট করতে হতো তা থেকে তারা রেহাই পাবে। এভাবে ৩৩ বছর ধরে হজ্জ তার আসল সময়ে অনুষ্ঠিত না হয়ে অন্য তারিখে অনুষ্ঠিত হতো এবং শুধুমাত্র ৩৪ বছরের মাথায় একবার যিল হজ্জ মাসের ৯-১০ তারিখে অনুষ্ঠিত হতো। নবী (সা.) বিদায় হজ্জের সময় তার প্রদত্ত খুতবায় একথাটিই ছিলেনঃ

إنَّ الزَّمَانَ قَدِ اسْتَدَارَ كَهَيْئَتِهِ يَوْمَ خَلَقَ اللهُ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ

"এ বছর হজ্জের সময় ঘুরতে ঘুরতে ঠিক তার প্রকৃত হিসেব অনুযায়ী আসল তারিখে এসে গেছে। “

এ আয়াতে 'নাসী'কে নিষিদ্ধ ও হারাম গণ্য করে আরবের মূর্খ লোকদের উল্লেখিত দু’টি উদ্দেশ্য ও স্বার্থান্বেষণকেই বাতিল করে দেয়া হয়েছে। প্রথম উদ্দেশ্যটি তো একটি সুস্পষ্ট গুনাহ ছিল। এ ব্যাপারে কোন অস্পষ্টতা নেই। এর অর্থ তো এটাই ছিল, আল্লাহর হারাম করা জিনিসকে হালালও করে নেয়া হবে আবার কৌশল করে আইন মেনে চলার একটি বহিঃকাঠামোও তৈরী করে রেখে দেয়া হবে। আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি আপাত দৃষ্টিতে নির্দোষ ও কল্যাণ ভিত্তিক মনে হলেও আসলে এটাও ছিল আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধে নিকৃষ্টতম বিদ্রোহ। মহান আল্লাহ‌ তার আরোপিত ফরযগুলোর জন্য সৌর বর্ষের হিসেবের পরিবর্তে চান্দ্রবর্ষের হিসাব অবলম্বন করেছেন যেসব গুরুত্বপূর্ণ কল্যাণ কারিতার ভিত্তিতে তিনি এসব করেছেন তার মধ্যে একটি হচ্ছে, তার বান্দা কালের সকল প্রকার আবর্তনের মধ্যে সব রকমের অবস্থায় ও পরিস্থিতিতে তার হুকুম আহকাম মেনে চলতে অভ্যস্ত হবে। যেমন রমযান, কখনো আসে গরমকালে, কখনো বর্ষাকালে আবার কখনো শীতকালে। ঈমানদাররা এসব পরিবর্তিত অবস্থায় রোযা রেখে অনুগত থাকার প্রমাণও পেশ করে এবং এ সঙ্গে সর্বোত্তম নৈতিক প্রশিক্ষণও লাভ করে। অনুরূপভাবে হজ্জও চান্দ্রমাসের হিসেব অনুযায়ী বিভিন্ন মওসুমে আসে। এসব মওসুমের ভালো-মন্দ সব ধরনের অবস্থায় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে সফর করে বান্দা আল্লাহর পরীক্ষায় পুরোপুরি উতরে যায় এবং বন্দেগীর ক্ষেত্রে পরিপক্কতা অর্জন করে। এখন যদি এক দল লোক নিজেদের সফর, ব্যবসা-বাণিজ্য ও মেলা-পার্বণের সুবিধার্থে চিরদিনের জন্য অনুকূল মওসুমে হজ্জের প্রচলন করে, তাহলে সেটা হবে এরূপ যেন মুসলমানরা কোন সম্মেলন করে সিদ্ধান্ত নিল যে, আগামী থেকে রমযান মাসকে ডিসেম্বর বা জানুয়ারীর সাথে মিলিয়ে দেয়া হবে। এর পরিষ্কার মানে দাঁড়ায়, বান্দারা আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নিজেরাই স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী হয়ে গেছে। এ জিনিসটিরই নাম কুফরী। এছাড়াও একটি বিশ্বজনীন দ্বীন ও জীবন ব্যবস্থা, যা সমগ্র মানব জাতির জন্য এসেছে তা কেন সৌরমাসকে রোযা ও হজ্জের জন্য নির্ধারিত করবে? যে মাসটিই নির্ধারিত হবে সেটিই পৃথিবীর সব এলাকার বাসিন্দাদের জন্য সমান সুবিধাজনক মওসুম হবে না। কোথাও তা পড়বে গরম কালে, কোথাও পড়তে, শীতকালে, কোথাও তখন হবে বর্ষাকাল, কোথাও হবে খরার মওসুম কোথাও তখন ফসল কাটার কাজ চলবে আবার কোথাও চলবে বীজ বপন করার কাজ।

এ সঙ্গে একথাও মনে রাখতে হবে যে, ৯ হিজরীর হজ্জের সময় 'নাসী' বাতিল করার এ ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। পরের বছর ১০ হিজরীতে চান্দ্র মাসের হিসেব অনুযায়ী ঠিক নির্ধারিত তারিখেই হজ্জ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত সঠিক তারিখেই হজ্জ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

.
৩৮ .
তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি চলাকালে যে ভাষণটি নাযিল হয়েছিল এখান থেকে সেটিই শুরু হচ্ছে।
৩৯.
এর দুটো অর্থ হতে পারে। এক, আখেরাতের অনন্ত জীবন ও সেখানকার সীমা-সংখ্যাহীন সাজ সরঞ্জাম দেখার পর তোমরা জানতে পারবে, দুনিয়ার সামান্য জীবনকালে সুঐশ্বর্য ভোগের যে বড় বড় সম্ভাবনা তোমাদের করায়ত্ত ছিল এবং যে সর্বাধিক পরিমাণে বিলাস সামগ্রী তোমরা লাভ করতে পেরেছিলে তা আখেরাতের সেই সীমাহীন সম্ভাবনা এবং সেই অন্তহীন নিয়ামতে পরিপূর্ণ সুবিশাল রাজ্যের তুলনায় কিছুই নয়। তখন তোমরা নিজেদের সংকীর্ণ দৃষ্টি ও অদূরদর্শিতার জন্য এ মর্মে আফসোস করতে থাকবে, যে, আমরা হাজার বুঝানো সত্ত্বেও দুনিয়ার তুচ্ছ ও ক্ষণস্থায়ী লাভের মোহে তোমরা কেন নিজেদেরকে এ চিরন্তন ও বিপুল পরিমাণ লাভ থেকে বঞ্চিত রাখলে। দুই, দুনিয়ার জীবনের সামগ্রী আখেরাতে কোন কাজে লাগবে না। এখানে যতই ঐশ্বর্য সম্পদ ও সাজ-সরঞ্জাম তোমরা সংগ্রহ করো না কেন, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সাথে সাথেই সব কিছু থেকে হাত গুটিয়ে নিতে হবে। মৃত্যুর পরপারে যে জগত রয়েছে এখানকার কোন জিনিসই সেখানে তোমাদের সাথে স্থানান্তরিত হবে না। এখানকার জিনিসের যে অংশটুকু তোমরা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য কুরবানী করেছো এবং যে জিনিসকে ভালবাসার ওপর তোমরা আল্লাহ‌ ও তাঁর দ্বীনের প্রতি ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিয়েছো একমাত্র সেই অংশই তোমরা সেখানে পেতে পারো।
৪০.
এ থেকেই শরীয়তের এ বিধি জানা যায় যে, যতক্ষণ পর্যন্ত কোন সাধারণ ঘোষণা (যুদ্ধ করার জন্য সর্বসাধারণ মুসলমানদেরকে আহবান জানানো) না দেয়া হবে কিংবা কোন এলাকার সকল মুসলিম অধিবাসীকে বা মুসলমানদের কোন দলকে জিহাদের জন্য বের হবার হুকুম দেয়া না হবে ততক্ষণ তো জিহাদ ফরযে কিফায়াই থাকে। অর্থাৎ যদি কিছু লোক জিহাদ করতে থাকে তাহলে বাদবাকি লোকদের ওপর থেকে ঐ ফরয রহিত হয়ে যাবে। কিন্তু যখন মুসলমানদের শাসকের পক্ষ থেকে মুসলমানদেরকে সর্বাত্মক জিহাদের জন্য আহবান জানানো হবে অথবা কোন বিশেষ দলকে বা বিশেষ এলাকার অধিবাসীদেরকে ডাকা হবে তখন যাদেরকে ডাকা হয়েছে তাদের ওপর জিহাদ ফরযে আইন হয়ে যাবে এমনকি যে ব্যক্তি কোন যথার্থ অসুবিধা বা ওযর ছাড়া জিহাদে অংশগ্রহণ করবে না তার ঈমানই গ্রহণযোগ্য হবে না।
৪১.
অর্থাৎ আল্লাহর কাজ তোমাদের উপর নির্ভরশীল নয়। তোমরা করলে তা হবে এবং তোমরা না করলে তা হবে না এমন নয়। আসলে আল্লাহ‌ যে তোমাদের তাঁর দ্বীনের খেদমতের সুযোগ দিচ্ছেন, এটা তাঁর মেহেরবানী ও অনুগ্রহ। যদি তোমরা নিজেদের অজ্ঞতার কারণে এ সুযোগ হারাও, তাহলে তিনি অন্য কোন জাতিকে এ সুযোগ দেবেন এবং তোমরা ব্যর্থ হয়ে যাবে।
.
৪২.
মক্কার কাফেররা যখন নবী (সা.) কে হত্যা করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত করে ফেলেছিল, এটা সে সময়ের কথা। যে রাতে তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সে রাতেই তিনি মক্কা থেকে বের হয়ে মদীনার দিকে হিজরত করেছিলেন। ইতিপূর্বে দুজন চারজন করে যেতে যেতে মুসলমানদের বেশীর ভাগ মদীনায় পৌঁছে গিয়েছিল। মক্কায় কেবলমাত্র তারাই থেকে গিয়েছিল যারা ছিল একেবারেই অসহায় অথবা যাদের ঈমানের মধ্যে মোনাফেকীর মিশ্রণ ছিল এবং তাদের ওপর কোন প্রকারে ভরসা করা যেতে পারতো না। এ অবস্থায় যখন তিনি জানতে পারলেন, তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে, তখন তিনি শুধুমাত্র একজন সাথী হযরত আবু বকরকে(রা.) সঙ্গে নিয়ে মক্কা থেকে বের হয়ে পড়লেন। নিশ্চয়ই তার পেছনে ধাওয়া করা হবে, এ ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি মদিনার পথ ছেড়ে (যা ছিল উত্তরের দিকে) দক্ষিণের পথ অবলম্বন করলেন। এখানে তিন দিন সাওর নামক পর্বত গুহায় আত্মগোপন করে থাকলেন। তাঁর রক্ত পিপাসু দুশমনেরা তাঁকে চারদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। মক্কার আশপাশের উপত্যকাগুলোর কোন জায়গা খুঁজতে তারা বাকী রাখেনি। এভাবে তাদের কয়েকজন খুঁজতে খুঁজতে যে গিরি গুহায় তিনি লুকিয়েছিলেন তার মুখে পৌঁছে গেলো। হযরত আবু বরক(রা.) ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি ভাবলেন, দুশমনদের একজন যদি একটু ভিতরে ঢুকে উকি দেয়, তাহলে তাদের দেখে ফেলবে। কিন্তু নবী (সা.) একটুও বিচলিত না হয়ে হযরত আবু বকর(সা.) কে এ বলে সান্ত্বনা দিলেন, “চিন্তিত হয়ো না, মন খারাপ করো না, আল্লাহ‌ আমাদের সাথে আছেন।”
.
৪৩.
এখানে হালকা ও ভারী শব্দ দু’টি ব্যাপক অর্থবোধক। এর অর্থ হচ্ছে, বের হবার হুকুম যখন হয়ে গেছে তখন তোমাদের বের হয়ে পড়তে হবে। স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে হোক বা অনিচ্ছায়-অনাগ্রহে, সচ্ছলতায় ও সমৃদ্ধির মধ্যে হোক বা দারিদ্রের মধ্যে, বিপুল পরিমাণ সাজসরঞ্জাম থাক বা একেবারে নিঃসম্বল অবস্থায় হোক, অনুকূল অবস্থা হোক বা প্রতিকূল অবস্থা, যৌবন ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হও বা বৃদ্ধ দুর্বল হও, সর্বাবস্থায় বের হতে হবে।
৪৪.
অর্থাৎ মোকাবিলা রোমের মতো বড় শক্তির সাথে। একদিকে প্রচণ্ড গ্রীষ্মের মওসুম এসে গেছে এবং দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। তার ওপর নতুন বছরের বহু প্রত্যাশিত ফসল কাটার সময় এসে গেছে। এসব কারণে তাবুকের সফর তাদের কাছে বড়ই কঠিন ও চড়ামূল্যের বলে মনে হচ্ছিল।
.
৪৫.
কোন কোন মুনাফিক বানোয়াট ওযর পেশ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে যুদ্ধে যাওয়া থেকে অব্যাহতি চেয়েছিল। তিনিও নিজের স্বভাবগত কোমলতা ও উদারতার ভিত্তিতে তারা যে নিছক ভাওতাবাজী করেছে, তা জানা সত্ত্বেও তাদের অব্যাহতি দিয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহ‌ এটা পছন্দ করেননি। এ ধরনের উদার নীতি সঙ্গত নয় বলে তাঁকে সতর্ক করে দিয়েছেন। অব্যাহতি দেবার কারণে এ মুনাফিকরা নিজেদের মুনাফিকী ও প্রতারণামূলক কার্যকলাপ গোপন করার সুযোগ পেয়ে গেলো। যদি তাদের অব্যাহতি না দেয়া হতো এবং তারপর তারা ঘরে বসে থাকতো তাহলে তখন তাদের মিথ্যা ঈমানের দাবী সর্বসম্মুখে প্রকাশ হয়ে পড়তো।
.
৪৬.
এ থেকে জানা যায়, ইসলাম ও কুফরীর দ্বন্দ্ব একটি মাপকাঠি স্বরূপ। এর মাধ্যমে খাঁটি মুমিন ও নকল ঈমানের দাবীদারের পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। এ দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে যে ব্যক্তি মনপ্রাণ দিয়ে ইসলামকে সমর্থন করে এবং নিজের সমস্ত শক্তি সামর্থ্য ও উপায় উপকরণ তাকে বিজয়ী করার সংগ্রামে নিয়োজিত করে এবং এ পথে কোন প্রকার ত্যাগ স্বীকারে কুণ্ঠিত হয় না, সেই সাচ্চা মুমিন। পক্ষান্তরে এ দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে যে ব্যক্তি ইসলামের সাথে সহযোগিতা করতে ইতস্তত করে এবং কুফরের শির উঁচু হবার বিপদ সামনে দেখেও ইসলামের বিজয়ের জন্য জান-মালের কুরবানী করতে কুণ্ঠিত হয়, তার এ মনোভাব ও কার্যকলাপ এ সত্যটিকে সুস্পষ্ট করে দেয় যে, তার অন্তরে ঈমান নেই।
অনুবাদ: